লুক্কায়িত পাঠক্রম : শতানীক রায় ও শানু চৌধুরী

[ It is not good for man to keep reminding himself, that he is man. — E.M. Cioran
খুব বড়ো একটা পৃথিবীতে বসবাস করি। প্রতিদিন অনেক কিছু বদলায়। ভাঙে গড়ে। আমরা নিজেই ভেঙে আবার গড়ে উঠি। আমরা ভাবি। আমাদের এই নিগূঢ় অস্তিত্ব যাপনের পদ্ধতির মধ্যে এসে পড়ে অন্বেষণ। জানি না কক্ষনো। জানতে পারি না। গানটা কেন এভাবে হচ্ছে কেন এভাবে হেঁটে চলেছি আর শেষপর্যন্ত ভাবতে বাধ্য হই কেন বেঁচে আছি। এই অন্বেষণের একটা বড়ো অংশ হল বই। আর পৃথিবীর নানা ভাষার বই থেকে আমরা কিছু বই বেছে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, একটি বই কিন্তু আবার জীবনও। মানুষ অদ্ভুতভাবে সেখানে লুক্কায়িত আছে। তারই পাঠ করতে করতে আমরা গড়ে উঠি। শব্দ। বাক্য। বাক্যের মধ্যে মধ্যে লুপ্ত শব্দ। শূন্যতা আর কীভাবে যে নিজেদের সংশয়কে এসে যেতে দেখি। নিজেদের অস্তিত্বচিন্তা চেপে বসে। এঁটে যায়। এই ধারাবাহিক সেরকমই কিছু বই। সেরকম জীবনের সন্ধান যার কোনো-না-কোনো অণুর ভেতর আমিও আছি। আর চাইছি সেই বিচ্ছুরণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাক। এই ধারাবাহিকে শতানীক রায় সে-সব বই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবেন। আর শানু চৌধুরী সে-বইয়ের কিছু অংশ অনুবাদ করবেন। আসলে কোনো পাঠই সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ-না আপনি সে-পাঠের অংশ হয়ে উঠছেন।]

 

 

পর্ব – ২

 

দি আনওম্যানলি ফেস অব ওয়ার
স্বেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ্

 

যুদ্ধের থেকে মানুষ মহৎ

[A HUMAN BEING IS GREATER THAN WAR]

ভাষান্তর: শানু চৌধুরী

 

 

Millions of the cheaply killed
Have trod the path in darkness…

—OSIP MANDELSTAM

 

 

এই বইয়ের জার্নাল থেকে (১৯৭৮-১৯৮৫)

 

আমি একটি যুদ্ধ সম্পর্কিত বই লিখছি…

 

আমি, যে কোনোদিনই যুদ্ধ বিষয়ক বই পড়তে পছন্দ করিনি, যদিও আমার শৈশব আর যৌবনে সবার এই বইগুলোই ভীষণ পছন্দের ছিল। আর আমার সব পরিচিতদের কাছেও। এটা কোনো অবাক হওয়ার মতো বিষয়ই ছিল না যে— আমরা ছিলাম বিজয়ী সন্তান। বিজয়ীদের সন্তান। যুদ্ধ সম্পর্কে প্রথম কোন বিষয় আমি মনে করতে পারি? আমার শৈশবের যন্ত্রণা, সেই অতীতের অব্যক্ত আর ভীতিপ্রদ শব্দের মাঝে। যুদ্ধের ঘটনাগুলো সবসময়ই মনে রাখা হত: পথে-ঘাটে, স্কুলে, বাড়িতে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, নানান জায়গায়। এমনকী ছোটোদের কথোপকথনেও। একবার এক প্রতিবেশীর ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল: “মানুষ মাটির তলায় গর্তের ভেতর কী করে? সেখানে কীভাবে তারা বেঁচে থাকে?” আমরাও, এই যুদ্ধের রহস্য উন্মোচন করতে চেয়েছিলাম।”

 

এটা সেই সময় যখন আমি মৃত্যুর কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম… এবং নিজেকে সেই ভাবনা থেকে সরাতে চেয়েও হতাশ হয়েছিলাম; সেই ভাবনাই ধীরে ধীরে আমার জীবনের মূল রহস্য হয়ে উঠেছিল।

 

সেই ভয়ানক ও রহস্যময় পৃথিবীই আমাদের সবকিছুর উৎপত্তির কারণ হয়ে উঠল। আমাদের পরিবারে আমার ইউক্রেনীয় দাদু, আমার মায়ের বাবা, মারা গেছিল যুদ্ধে এবং কবর দেওয়া হয়েছিল হাঙ্গেরির কোনো এক কবরখানায়। আমার বেলারুশীয় ঠাকুমা, আমার বাবার মা, ছিলেন জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। তিনি মারা গিয়েছিলেন টাইফয়েডে; তাঁর তিন সন্তানই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই দু-জনের নিরুদ্দেশের খবর আসে, কেবলমাত্র একজন ফিরে এসেছিল। আমার বাবা। জার্মানরা আমাদের এগারো জন আত্মীয়কে তাদের সন্তান-সহ জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করে— অনেককে তাদের বাড়িতেই, অনেককে আবার গ্রামের গির্জায়। এই ঘটনা প্রত্যেক পরিবারের সঙ্গে ঘটেছিল। সবার সঙ্গেই ঘটেছিল।

 

এই ঘটনার দীর্ঘ সময় পর গ্রামের শিশুরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলত যার নাম ওরা দিয়েছিল ‘জার্মান আর রাশিয়ান’। তারা চিৎকার করে বলত: “Hände hoch! Zurück! Hitler kaputt!”

 

আমরা যুদ্ধ ছাড়া কোনো পৃথিবীকে জানতাম না; এই যুদ্ধের পৃথিবীই আমাদের কাছে একমাত্র পরিচিত, আর এই যুদ্ধের মানুষদেরই আমরা জানি। এমনকী এখনও আমি যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো মানুষ বা কোনো পৃথিবীকে জানি না। অন্য মানুষেরও কি অস্তিত্ব ছিল?

 

——

আমাদের যুদ্ধ পরবর্তী গ্রাম ছিল মেয়েদের। গ্রামীণ মেয়েরা। আমরা সেখানকার কোনো পুরুষকণ্ঠ মনে করতে পারি না। এই বিষয়গুলো যেভাবে আমার মনে গেছে: মেয়েদের বয়ানে যুদ্ধের গল্প। তাঁরা কাঁদে। কান্নার মতো তাঁদের গান।

 

স্কুলের লাইব্রেরির অর্ধেক বই যুদ্ধ বিষয়ক। একই অবস্থা গ্রামের লাইব্রেরি, আর শহরের লাইব্রেরিও, বাবা সেখান থেকে প্রায়শই বই আনত। এখন আমি জানি এর কারণ কী? এটা কি কোনো দুর্ঘটনা? আমরা সবসময় যুদ্ধ করতাম, বা প্রস্তুতি নিয়েছি যুদ্ধের। মনে করেছি কীভাবে আমরা যুদ্ধ করেছি। আমরা অন্য কোনোভাবে বাঁচিনি, আর সম্ভবত জানতামও না। আমরা অন্য কোনোভাবে বাঁচার কথা ভাবতেও পারি না, যদি সেটা করি তাহলে অনেক সময় প্রয়োজন হবে।

 

স্কুলে আমাদের মৃত্যুকে ভালোবাসতে শেখানো হত। আমরা নানা কিছু লিখেছি যে, কার উদ্দেশে এবং কীভাবে আমরা মরতে চাই… স্বপ্ন দেখেছি…

 

কিন্তু বাইরে আরও অনেক কণ্ঠস্বর অন্যান্য মুগ্ধতার চিৎকার ছিল।

 

দীর্ঘ সময় আমি একজন বইয়ের নিবিষ্ট পাঠক ছিলাম, বাস্তবকে একইসঙ্গে ভয় পেতাম এবং আকৃষ্ট হতাম। আমার নির্ভীকতা পেয়েছিলাম জীবনের প্রতি অজ্ঞতা থেকে। আমি এখন ভাবি: যদি আমি আরও বাস্তবমুখী হতাম, তাহলে কি নিজেকে রসাতলে ঠেলে দিতে পারতাম? এ-সমস্ত কিছুর কারণ কি— অজ্ঞতা? নাকি পথের বোধ? এমন একটা পথের বোধ যা সত্যিই আছে…

 

আমি দীর্ঘ সময় ধরে খুঁজেছি… শব্দ আমাকে কী বোঝাতে পারে যা আমি শুনতে পাই? আমি একটা রীতির সন্ধান করেছি যা বিম্বিত করতে পারে আমি যেভাবে পৃথিবীকে দেখি, আমার চোখ, কান, যেভাবে তৈরি।

 

একবার একটা বই আমার হাতে আসে: ‘আই অ্যাম ফ্রম আ বার্নিং ভিলেজ’, লেখক ছিলেন অ্যালেস অ্যাডামোভিচ্, ইয়াঙ্কা ব্রেল এবং ভ্লাদিমির কোলেসনিক। এই বই পড়ার পর আমি দস্তয়েভ্‌স্কির লেখা পড়ার মতো আশ্চর্য হয়েছিলাম। এই উপন্যাস গতে বাঁধা ফর্মে লেখা নয়: এই উপন্যাসে উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর, যে-সব আমি শৈশব থেকে শুনে এসেছি, এখনও রাস্তায় চলতে গিয়ে শুনে থাকি, স্কুলে, বাসে, ক্যাফেতে শুনে থাকি। সেখানেই! আমার বৃত্ত সীমাবদ্ধ হয়ে এল। আমি যা খুঁছিলাম তা পেয়ে গেলাম। আমি জানি আমি পারব।

 

অ্যালেস অ্যাডামোভিচ্ আমার শিক্ষক হয়ে উঠলেন।

 


দু-বছর ধরে আমি যতটা না সাক্ষাৎ করেছি আর লিখেছি তার চেয়ে অনেক বেশি ভেবেছি। পড়েছি। আমার বইটা কী নিয়ে হবে? যুদ্ধ নিয়ে আবার একটা বই? কীসের জন্য? ইতিহাসে হাজার হাজার যুদ্ধ হয়েছে— ছোটো বড়ো, জানা-অজানা। আর এসব নিয়ে লেখাও হয়েছে অনেক। কিন্তু… সে-সব ছিল পুরুষদের লেখা পুরুষদের সম্পর্কে— যা আরও পরিষ্কার হয়েছে ক্রমশ। আমরা যুদ্ধ সম্পর্কে যা কিছু জানি সে-সব ইতিহাস ‘পুরুষের কণ্ঠস্বর’। আমরা আবদ্ধ ‘পৌরুষে’, যুদ্ধ সম্পর্কে ‘পুরুষের’ ধারণায়। ‘পুরুষের’ শব্দে। যেখানে মেয়েরা নির্বাক্। এই নিয়ে একমাত্র আমিই একবার আমার ঠাকুমাকে প্রশ্ন করেছিলাম। মাকেও প্রশ্ন করেছিলাম। এবং যাঁরা সে-সময় যুদ্ধে ছিলেন তাঁরাও কিছু বলেননি। কখনো যদি তাঁদের কিছু মনে পড়ত, তারপরও তাঁরা ‘মেয়েদের’ যুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতেন না, শুধু ‘পুরুষদের’ যুদ্ধ নিয়ে বলতেন। এভাবেই তাঁরা চেপে যেতেন। তাঁরা কখনো কখনো বাড়িতে বা কোনো মেয়েলি আসরে তাঁদের সহযোদ্ধা সইদের মাঝে মেয়েদের যুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন, যে-যুদ্ধ আমার অজানা। শুধু আমারই না, আমাদের সবারই। তাঁদের সঙ্গে মিশে জেনেছি যে, আমি একাই এসবের সাক্ষী হচ্ছি, সম্পূর্ণ এক নতুন আখ্যান। আমাকে ছেলেবেলার মতো নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেইসব ভয়াবহ গল্পের ভয়ংকর ব্যাঙ্গ… যখন মেয়েরা সেই ঘটনাগুলো বলতেন, তাঁদের কথায় এমন কিছুই থাকত না যা আমরা পড়েছি বা শুনেছি: কেমন করে কিছু মানুষ দুঃসাহসিকভাবে অন্য মানুষদের হত্যা করে জিতেছে। অথবা হেরেছে। কী কী অস্ত্র ছিল যোদ্ধারা কেমন ছিল। মেয়েদের গল্পগুলো আলাদা আর নানারকম বিষয়ে। ‘মেয়েদের’ যুদ্ধের একটা নিজস্ব রং আছে, নিজস্ব গন্ধ আছে, নিজস্ব আলো এবং নিজস্ব অনুভূতির স্তর আছে। একদম নিজস্ব বয়ান। সেখানে কোনো নায়ক ছিল না, ছিল না অতুলনীয় কোনো কৌশল, তাঁরা সাধারণ মানুষ যাঁরা যুদ্ধে কিছু অমানবিক কাজ করেছিল। তাঁরাই (মানুষ!) যে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, পাশাপাশি পৃথিবী, পাখি, গাছও। পৃথিবীতে আমাদের সঙ্গে যারা সহবাস করে। তারা নিঃশব্দে সহ্য করে, যা আরও ভয়াবহ।

 

কিন্তু কেন? আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম একাধিকবার। কেন, নিজেদের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে একান্তই একটি পুরুষের জগতে, মেয়েরা কি নিজেদের ইতিহাসের তাগিদে উঠে দাঁড়ায়নি? তাঁদের শব্দ আর অনুভূতি? তাঁরা নিজেদের বিশ্বাস করতে চাননি। আস্ত একটা পৃথিবী আমাদের কাছ থেকে লুকোনো থেকেছে। তাঁদের যুদ্ধ অজানা থেকেছে…

 

আমি এই যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে চাই। একজন মেয়ের ইতিহাস।

 

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

1 thought on “লুক্কায়িত পাঠক্রম : শতানীক রায় ও শানু চৌধুরী Leave a comment

  1. এমন একটি পাঠের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। শানুর ভাষান্তর অপূর্ব।

Leave a Reply