মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। অপরজনের ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
১৩
মৃত্যুহীন অনন্তের স্বাদ!
দার্শনিক বলেন জীবন অনন্ত। বিজ্ঞানী বলেন, সম্ভবতঃ মহাবিশ্বও অনন্ত, কালও অনন্ত। সৃষ্টি, ধ্বংস, পুনরায় সৃষ্টি। ‘বিগ ব্যাং’-এর বিপুল ফুৎকারের পরে আসবে বিপুল সংকোচন বা, বিগ ক্রাঞ্চ, তারপরে আবারও একটা বিগ ব্যাং। আর আমরা, সাধারণ মানুষরা বলি—জীবন এত ছোট কেন ? একজীবনে আর কতটুকু জানা যায়, কতটুকু কাজ করা যায় ! প্রতিবার জন্মের পরে তো সেই আবার হাঁটতে শেখা থেকে শুরু করতে হয় মানবশিশুকে।
‘রূপসী বাংলা’-র কবি জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) লিখেছিলেন : ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে— এই বাংলায় / হয়তো মানুষ নয়— হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে’। এই স্বপ্নিল কবিতায় পুনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষার যে নেশাতুর আবেশ, তা আমাকে প্রাকযৌবনে আচ্ছন্ন করেছিল।
এর অনেক পরে আর এক কবির একটা কবিতার বই আমার হাতে আসে, যেটা আমি ১৯৮৯ সালে জামশেদপুর বইমেলায় কিনেছিলাম। একটা পাতলা চটি বই, ইংরিজীতে লেখা। আমাকে আপ্লুত করেছিল তার জীবনদর্শন, যেন অসীম ও অনন্তের ইশারা তাতে সুষমিত হয়ে আছে। লেখক বিদেশী, লেবানিজ-আমেরিকান। জীবনানন্দেরও অনেক আগে তিনি। নাম তাঁর খলিল জিব্রান (১৮৮৩-১৯৩১)। বইটার নাম ‘দি প্রফেট’।
জীবনানন্দ যখন শঙ্খচিল বা শালিখের বেশে পুনর্জন্মের কথা ভেবেছেন, সেখানে জিব্রানের লেখায় আছে : “A little while, a moment of rest upon the wind, and another woman shall bear me”. এই অমোঘ বাক্যটির চিরায়ত অভিঘাতে, এই দর্শনের মহাজাগতিক সৌন্দর্যে আমি নির্বাক হয়ে গেছিলাম। মনে হয়েছিল, এই কবি সত্যদ্রষ্টা।
কিন্তু, কি আশ্চর্য, আমি তো একক মানুষের পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না! ক্রমে এর গভীরে ঢুকে দেখলে মনে হয়, জিব্রানের কবিতার ওই লাইনটাও হয়তো সেই কথাই বলছে। চিরকালীনের মধ্যে, বহুর মধ্যে নিজেকে একীভূত জেনে, মৃত্যুহীন অনন্তের স্বাদ পাওয়া। -Another woman shall bear me, এই প্রত্যয়। -জিব্রান ছিলেন কবি, দার্শনিক, চিত্রকর। লেবাননের পাহাড় ঘেরা ‘শ্যরি’ [ Bsharri ] নগরে তাঁর জন্ম।
*
পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ ?
হ্যাঁ, সমগ্র মানবজাতিই যেন পথভোলা এক পথিক। এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। আমরা ভেবে বসেছি যে, আমরাই এই বিশ্বভুবনের সর্বশক্তিমান অধীশ্বর। আমাদের ভোগের জন্যই যেন সৃষ্টি হয়েছে এই সুন্দর বিশ্ব। আমরা তাই হতে চেয়েছি সর্বত্রগামী। বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ অতিমারির কারণ অনুসন্ধানে নেমে আজ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে জেনেছেন এর কারণগুলো :
১. মানুষের বিপুল বংশবৃদ্ধি, যার জন্যে তার চাহিদাও বিপুল বেড়েছে।
২. বন কেটে বসত তৈরি করেছে সে, হাত বাড়িয়েছে ভূগর্ভস্থ জলেও, বর্জ্য পদার্থ দিয়ে দূষিত করেছে নদীকে। যত্রতত্র বাঁধ দিয়েছে। কারণ তার চাই তাপবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, আর অঢেল ফসলের জন্য সেচের জল।
৩. শহর ছেড়ে ট্যুরিজম ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গম প্রকৃতির গভীরে ; বিজ্ঞান গবেষণার জন্য নয়, প্রমোদ ভ্রমণের জন্য।
৪. অরণ্যপ্রকৃতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায়, লোকালয়ে বেরিয়ে এসেছে বন্যপ্রাণী, পাখি, সরীসৃপ। মানুষ তাদের হত্যা করে মাংস খেয়েছে নানা উপাদেয় রান্নায়।
৫. এইসব বন্যপ্রাণীর মাংস থেকে ছড়িয়ে পড়েছে নানা ধরণের মারণ ভাইরাস। এখন সেই অতিমারির কোপে মানুষ নিধন হচ্ছে বিপুল সংখ্যায়। এইভাবে চলতে থাকলে, আগামী বছরগুলোতে আরও অনেক মারণ ভাইরাসের সাথে লড়াই করতে হবে পৃথিবীর মানুষকে। আর তার নিস্তার নেই।
৬. বিশ্ব উষ্ণায়ন আর কোনও জল্পনার বিষয় নয়, এটা যে কঠোর বাস্তব, এর থেকে ফেরার যে আর পথ নেই, তা এতদিনে বুঝতে পেরেছেন বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা। বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ধনী মানুষ পৃথিবীতে আরও আরও সুখের সন্ধানে মেতে প্রকৃতিকে উপেক্ষা করেছে। যে ইউরোপ এতদিন ছিল প্রধানতঃ শীতের দেশ, সেখানে আজ কয়েক বছরের মধ্যেই তাপমাত্রা এক লাফে ৪০-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দাবানল জ্বলছে অরণ্যাঞ্চল জুড়ে। কখনো ঝড়ের তান্ডব আর প্লাবন। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে এতদিনে। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। পৃথিবী আজ মানুষের নিজের কারণেই ধ্বংসের পথে।
মূলতঃ একটাই সুত্র : মানুষের চিরন্তন অতৃপ্তি। -এর থেকেই জন্ম নিয়েছে আধিপত্যবাদ এবং সর্বত্রগামী হওয়ার ইচ্ছা, সকল রহস্যমোচনের ইচ্ছা। এর অবশ্যই ভালো দিক আছে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন মাত্রাজ্ঞান ও বিবেচনা। শুধু এক অঞ্জলি জল অর্পণ করে সত্যি যদি ব্রহ্ম থেকে তৃণ অবধি সমগ্র মহাবিশ্বের তৃপ্তিসাধন করা যেত, তাহলে কত সহজ ও সুন্দর হোত এই সংসার।
আমার ‘অফুরন্ত মালবেরি’-ছবিতে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত আক্ষেপ করেছেন—‘এই পৃথিবীকে আমরা কত সুন্দর বানাতে পারতাম, তার বদলে কি যাচ্ছেতাই হয়ে গেল!’ -সত্যিই তো।
*
আমার ভালো লাগছে, এদেশে আমরা যারা মহাকাশচর্চাকে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নানা ধরণের কাজকর্ম করে চলেছি, আমাদের কাজের প্রভাব ক্রমশঃ বিভিন্ন স্তরের মানুষকে উৎসাহিত করছে। মানুষ আজ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছেন, সংস্কারমুক্ত হচ্ছেন। এই ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঙ্গালোর অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির সদস্যরা কাজ করে চলেছেন, স্টার পার্টির আয়োজন করছেন, স্কুলছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিচ্ছেন মহাকাশ চেতনা। এই নিয়ে আগের একটি পর্বেও লিখেছি। কিন্তু এখনও আমাদের আশেপাশের অনেকেই অ্যাস্ট্রোনমি আর অ্যাস্ট্রোলজির তফাৎ জানেন না। যাঁরা এখনও পাঁজি দেখে চলাফেরা করেন, তাঁদের তো খুবই অসুবিধে। কলকাতা থেকে নাগপুর যাওয়ার টিকিট হয়তো কাটা হয়ে গেছে, কিন্তু মনমরা। কারণ, ওইদিন পশ্চিমে যাত্রা নিষেধ। অথচ পাঁজিতে যেদিন নিষেধ নেই, সেদিনের টিকিটের দাম অনেক বেশি। ফলত নিরানন্দ, মনমরা।
মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত কুসংস্কারে সওয়ারি হয়ে অনেক চতুর জ্যোতিষী করে খাচ্ছেন। এটা একটা উইন-উইন গেম। দুপক্ষেরই লাভ হচ্ছে, বিশ্বাসে ভর করে। কর্মজীবনে আমার দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অ্যাস্ট্রোলজিতে ঘোর বিশ্বাসী। তাঁদের কাছেই প্রথম আমি ‘রাহুকালম’ কথাটা শুনি। বৃহস্পতিবার বারবেলা পড়ে গেলে সেদিন তাঁরা কোনও রকমের কেনা কাটা, শপিং মল ইত্যাদি এড়িয়ে চলতেন। কারণটা ওই, রাহুকালম।
কয়েক বছর আগে, যখন ক্যালটেকের বিজ্ঞানী কেটি বাওম্যান ও তাঁর সহকর্মীরা বিশ্বের কাছে প্রথম প্রকাশ করলেন একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের (M87) ছবি, আর দেশে দেশে সংবাদমাধ্যমে সেই নিয়ে হইচই পড়ে গেল, তার কয়েকদিন পরে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও তার রেশ এসে লাগে। কয়েকদিনের মধ্যে অনেক সংবাদপত্রেই বিজ্ঞাপনের কলমে দেখা গেল, জ্যোতিষীরা সবরকম তন্ত্রমন্ত্র মারণ উচাটন বশীকরণ, শনির দশা ও কালসর্পযোগ খন্ডনের সাথে সাথে এবার কৃষ্ণগহ্বরের মারণ প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্যেও যজ্ঞাদি ও শান্তিস্বস্ত্যয়নের ঢের ব্যবস্থা করেছেন, রীতিমত গ্যারান্টি সহযোগে। কৃষ্ণগহ্বর-দোষ নাকি সমস্ত গ্রহদোষের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর।
যেকোনো পত্রিকার সম্পাদকীয়টা আমি যত্ন নিয়ে পড়ি। কয়েকদিন আগে (৪ জুলাই ২০২১) আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়তে গিয়ে এবার থমকে গেলাম। দেখলাম সেখানে রাজনীতি অর্থনীতি ইতিহাস ছেড়ে মহাকাশ নিয়ে আলোচনা। ভাবলাম, একটু পরেই হয়তো মহাকাশ ছেড়ে সেন্ট্রাল ভিস্টা, কোভিড, অথবা আইসল্যান্ডে দাবদাহের প্রসঙ্গ চলে আসবে। যেমনটা হয় আর কি। কিন্তু না, শ্রদ্ধেয় সম্পাদক পুরো কলামের ওপর থেকে নীচ অব্দি ধরে রাখলেন মহাকাশ, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, ব্রহ্মান্ডের প্রসারণ, ইত্যাদি বিষয়! এটা আমাকে খুবই বিস্মিত করেছে। এরকমটা আমার সত্তর বছরের জীবনে কখনো আর দেখেছি কি? বোঝা গেল, সময় পাল্টাচ্ছে। এবার ক্রমশঃ বড় বড় হাউসের কাগজেও মহাকাশ চেতনার কদর বাড়ছে।
এর সাথে সাথে বেড়েছে, মহাকাশ সম্পর্কিত ভুল তথ্য ও ভুল সংবাদ পরিবেশনও। যার অনেকটাই হচ্ছে আমজনতার রিডারশিপ আর বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে টানার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টায়। যাচাই না করেই ছাপানো হচ্ছে ধোঁকাধারি গপ্পো। কারণ পাব্লিক নাকি এগুলো খাচ্ছে। এটাই এখন নতুন বিরিয়ানি। আজকাল তাই অনেকেই নিজেদের গান বাজনা নাটক কবিতা রং-তুলি শিকেয় তুলে, এক পিস মহাকাশ নামিয়ে দিচ্ছেন সম্পাদকের টেবিলে। গুচ্ছের এঁড়িগেঁড়ি ইংরেজী খবরের কাগজ থেকে সরাসরি বঙ্গানুবাদ হচ্ছে, কোনও ‘স্যানিটি চেক’ ছাড়াই। মহাকাশের সৌন্দর্যবোধ ছাড়াই। এঁদের ভারি পছন্দ কোয়ার্ক নিউট্রিনো ব্ল্যাক হোল আর কোয়ান্টাম শব্দগুলো নিয়ে কিছু ঢিসুম ঢুসুম।
আমিই বা আর কতটুকু জেনেছি, চল্লিশ বছর ধরে মহাকাশ নিয়ে মেতে আছি, তবুও মনে এত এত প্রশ্ন জাগে যে, লেখা এগোয় না। প্রয়োজনীয় তথ্যের সাথে বোধ বুদ্ধি ও কবিতার সৌন্দর্য মিলিয়ে মিশিয়ে এগুলো মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্য লেখা, যাঁরা গভীরে গিয়ে ভাবতে পারেন, যাঁদের মনে আমার মতোই অজস্র প্রশ্ন ওঠে। লেখক ও পাঠক দুজনেই যখন উত্তরমালার অপেক্ষায়, দুজনেই যখন সুন্দরের পিয়াসি।
*
আমার নজর রয়েছে আমেরিকার ইস্কুলে পড়া সেই বালিকার ওপরে, যার নাম অ্যালিসা কারসন। নাসা তাকে নির্বাচন করেছে ২০৩০-৩৩ সালে মঙ্গলগ্রহের মাটিতে সমগ্র মানবজাতির হয়ে প্রথম পা রাখার জন্য, যেমনটা নীল আর্মস্ট্রং একদিন চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন। নাসা জানাচ্ছে, এর মধ্যেই দীর্ঘ মহাকাশযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় বেসিক ট্রেনিংগুলোর সবই সফলভাবে শেষ করে ফেলেছে অ্যালিসা।
তার অনেক আগে, আজ থেকে আর মাত্র তিনমাস পরেই মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হতে চলেছে ‘জেমস ওয়েব’ নামের সেই অতিকায় ইনফ্রা-রেড টেলিস্কোপ, যার কথা আগের পর্বেই লিখেছি, যে দেখতে পাবে মহাকাশের গভীরে প্রায় তেরোশো ষাট কোটি আলোকবর্ষ অবধি, কালের বিচারে যখন সবেমাত্র নক্ষত্রপুঞ্জ ও গ্যালাক্সিদের জন্ম হয়েছে।
আজ থেকে এক-দেড়শো বছর পরে, এলন মাস্কের ‘স্পেসএক্স’ ও অন্যান্য প্রাইভেট কোম্পানিরা হয়তো মহাকাশে ট্যুরিস্ট নিয়ে যাতায়াত সহজ করে দেবে। হয়তো ছোটখাটো ৪-৫ বছরের ট্যুরগুলোতে থাকবে আমাদের সৌরমন্ডলের বিশেষ বিশেষ দর্শনীয় গ্রহ ও উপগ্রহগুলো। তবে সে তো কয়েক কোটি টাকার ধাক্কা। শরীরে কুলোলেও অত খরচ করতে পারবেন কজন ? এ তো আর ট্রেকিং করে ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’ দেখতে যাওয়া নয়। আমাদের তাই ভার্চুয়াল ট্যুরেই খুশি থাকতে হবে। এই ভার্চুয়াল সিমুলেশান মডেলটির নাম দেওয়া হয়েছে উচুউ (Uchuu)। জাপানী ভাষায় ‘উচুউ’-শব্দের অর্থ হল—বহির্বিশ্ব, গভীর মহাকাশ।
এই প্রকল্পকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গবেষক ও অধ্যাপকদের সাধ্যের আওতায় আনার জন্যে বাজারে আসতে চলেছে সমগ্র ব্রহ্মান্ডের এই ‘উচুউ’ নামের থ্রি-ডি মডেলের একটি সুলভ সংষ্করণ। সমস্ত প্রধান গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, কোয়াজার, পালসার, ও নেবুলাদের সঠিক আকারে ও অবস্থানে পাওয়া যাবে এই মডেলে, যা আপনি নিজের ল্যাপটপে ডাউনলোড করে নিয়ে ইচ্ছেমত মহাকাশের গভীরে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এই দৃশ্যজগতের (visible universe) কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের পৃথিবী। এটি তৈরি করতে লেগেছে ‘ATERUI II’ নামের একটি জাপানী সুপারকম্পিউটার এবং প্রায় চল্লিশ হাজার কম্পিউটার প্রসেসর।
এই ভার্চুয়াল ব্রহ্মান্ডকে সাধারণের কম্পিউটারে নামিয়ে আনার জন্য লাগবে একটু দামী ল্যাপটপ বা পিসি, যেখানে এই মডেলকে রাখা যায়। এর জন্য লাগবে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা দামের বিশেষ হার্ড ডিস্ক (Exadrive from Nimbus)। কারণ, এই মডেলের সাইজ বা আয়তন হবে প্রায় ১০০ টিবি (টেরাবাইট)। আসলে প্রায় ৩০০০ টিবির ফাইলকে কম্প্রেস করে ১০০ টিবিতে আনা হয়েছে। তবে হার্ড ডিস্কে ডাউনলোড না করেও, ব্রডব্যান্ডে অনলাইন কানেকশানের সাহায্যেও সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যাবে এই উচুউ-মডেলে।
এই প্রকল্পের জন্য ‘স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভে (SDSS : Sloan Digital Sky Survey)’ নামে একটি প্রজেক্টে প্রায় ২০ কুড়ি বছর ধরে পাওয়া বিশ্বের বড় বড় টেলিস্কোপের তথ্য নিয়ে কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি দল। বিগত ১৩০০ কোটি বছর ধরে জন্ম নিয়েছে যত নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্যালাক্সি, তাদের মধ্য থেকে প্রায় কুড়ি লক্ষ গ্যালাক্সিকে নিয়ে– যাদের প্রত্যেকটির মধ্যে আছে প্রায় দশ-পনেরো হাজার কোটি নক্ষত্র— তৈরী হয়েছে ব্রহ্মান্ডের এই আংশিক থ্রি-ডি মডেল। আমেরিকার উটা (Utah) বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ ডসন ( Kyle Dawson) ছিলেন এর নেতৃত্বে।
*
ভার্চুয়াল মহাকাশ সাফারিতে যাওয়ার আগে, নীচের ছবিতে একবার দেখে নেওয়া যাক সৌরমন্ডলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে যেসব গ্রহ ও গ্রহাণু, তাদের কক্ষপথ এবং নিজ নিজ অক্ষরেখাকে, যাকে কেন্দ্র করে তারা ঘুরে চলেছে ‘এক্লিপ্টিক প্লেন’-এ। এদের প্রত্যেকের অক্ষরেখা প্রায় ভার্টিকাল অর্থাৎ খাড়া হয়ে আছে। তবে সামান্য হেলে আছে অনেকেই। যেমন, পৃথিবীর অক্ষরেখাটি এক্লিপ্টিক তলের ওপরে ঠিক উল্লম্ব নয়, হেলে আছে ২৩.৪ ডিগ্রী। উত্তরমেরুর ওপরের আকাশ থেকে নীচে গ্রহটির দিকে তাকালে দেখা যাবে, এইসব গ্রহরা ঘুরছে আমাদের পৃথিবীর মতোই পশ্চিম থেকে পূবে, ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে (কাউন্টার ক্লকওয়াইজ)। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হচ্ছে দুটি গ্রহ—ভেনাস এবং ইউরেনাস। ভেনাসের অক্ষরেখাটি বিপরীতমুখী , অর্থাৎ গ্রহটি ঘুরছে ক্লকওয়াইজ। যার ফলে শুক্রগ্রহে সূর্যোদয় হয় পশ্চিম আকাশে এবং অস্ত যায় পূবে। আর ইউরেনাসের অক্ষরেখাটি যেন এক্লিপ্টিক প্লেনের ওপরে আড়াআড়ি শুয়ে আছে (নীচে ছবি)।
ভেনাস বা শুক্রগ্রহে আসার আগে, আমরা বরং সূর্যের সবচেয়ে কাছের ‘বুধ’-গ্রহ (Mercury) থেকে যাত্রা শুরু করি। বুধগ্রহ সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করে আমরা ক্রমে সূর্য থেকে দূরে চলে যেতে থাকবো ; যেপথে ক্রমান্বয়ে রয়েছে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, প্রধান গ্রহাণু বলয় (Main Asteroid Belt), বৃহস্পতি, গ্রহাণু ‘সিয়ারীজ’ (Ceres), শনি, ইউরেনাস, নেপচুন। এরপর আছে অনেকগুলো ছোট গ্রহ (Dwarf planets)–যেমন প্লুটো, হাউমিয়া, মাকেমাকে, ইত্যাদি। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে ‘কাইপার বেল্ট’, যেখানে লক্ষ লক্ষ গ্রহাণু ও ধুমকেতুর আবাস। এর পরে, সূর্যের তপ্ত প্লাজমা স্রোতপ্রবাহের শেষ প্রান্ত ‘হেলিওপজ’ (Heliopause)। এইখানে সৌরমন্ডল পার করে আমরা বেরিয়ে যাবো, যেভাবে কয়েক বছর আগে ভয়েজার ১ এবং ২ সৌরমন্ডল ছেড়ে চলে গেছে। এর পরে আসবে জমাট হিমশীতল বরফকণা দিয়ে গঠিত ‘ঊর্ট ক্লাউড’, যার প্রকান্ড গোলকের মধ্যে সমগ্র সৌরমন্ডলকে সে ঘিরে রেখেছে বলে মনে করা হয়।
এইখানে একটা চার্টের মধ্যে সাজিয়ে রাখা যাক সৌরমন্ডলে আমাদের প্রতিবেশীদের চরিত্রের কিছু জরুরী তথ্য। সৌরমন্ডলকে বোঝার জন্য এগুলো জানা জরুরী। আলোচনার মাঝে মাঝে চোখ রাখতে হবে ‘প্ল্যানেট ফ্যাক্ট শীট’ নামক এই চার্টে। তবে শুরু করা যাক, বুধগ্রহ দিয়ে।
বুধ (Mercury) :
আটটি গ্রহের মধ্যে সূর্যের সবচেয়ে কাছে, এবং আকারে সবচেয়ে ছোট সে ; ব্যাস মাত্র ৪৮৭৯ কিমি। তুলনায়, পৃথিবীর ব্যাস ১২,৭৫৬ কিমি। সূর্যের খুব কাছ দিয়ে ঘুরছে সে, এবং এতটাই ছোট, তাকে আকাশে দেখা যেতে পারে সূর্যালোক কমে এলে। খুব ভোরে পুবাকাশে অথবা, পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম দিগন্তে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৫ সালে তাকে প্রথম চিহ্নিত করা হয়, রোমানদের বাণিজ্যদেবতা মারকুরিয়াসের নামানুসারে। টেলিস্কোপে দেখলে বুধ এবং শুক্র, দুই গ্রহতেই প্রতিফলিত সূর্যালোকে আমাদের চাঁদের কলার মত হ্রাসবৃদ্ধি দেখা যায়। সূর্যের মাত্র ৫ কোটি ৭৯ লক্ষ কিমি দূর দিয়ে গিয়েছে বুধের কক্ষপথ। তাই তার গতিও খুব বেশি, প্রতি সেকেন্ডে ৪৭ কিমি! তুলনায়, সূর্য থেকে ১৫ কোটি কিমি দূরের কক্ষপথে পৃথিবীর গতি অনেকটা কম, সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিমি।
মানুষ কি থাকতে পারবে? স্পেস স্যুট পরলেও খুবই কঠিন হবে থাকা। কারণ, বুধের প্রায় কোনও বায়ুমন্ডলই নেই। খুবই মিহি, প্রায় শূন্য। তার গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু তাপমাত্রার তারতম্য অনেক বেশি। দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৪৩০ ডিগ্রি, আর রাতে সেটাই মাইনাস -১৭০ ডিগ্রি। বুধগ্রহে দিন আর বছরের আসা-যাওয়াও বিচিত্র। নিজের অক্ষের ওপর খুব ধীরে সে ঘুরছে, অত্যন্ত ধীরে। অথচ সূর্যের চারপাশে নিজের কক্ষপথে তার গতি অতি তীব্র। সূর্যকে সেখানে দেখতেও অনেক বড় লাগে ; পৃথিবী থেকে সূর্যকে যেমন দেখায়, তার চেয়ে তিনগুণ বড় বুধের সূর্য।
বুধের দিন আর বছর খুব গোলমেলে ব্যাপার, কারণ সে সূর্যকে একটা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে, যেখানে সূর্যের কাছাকাছি এলে তার চলার গতি বেড়ে যায় অনেক। বুধের একদিন মানে, আমাদের পৃথিবীতে প্রায় ৫৯-দিন। এই ৫৯ দিনে বুধ তার নিজের অক্ষের ওপর একপাক ঘুরে নেয়। কিন্তু এতেই তার দিন শেষ হয় না। আকাশে তখনও সূর্যকে দেখা যায়। বুধের মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশের সূর্যকে দেখলে তার আশ্চর্য চলন দেখা যায়। পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়ে ক্রমে পশ্চিমের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ সে কিছুক্ষণ আকাশে এক জায়গায় থেমে থাকে। তারপর উল্টোপথে আবার পূবের দিকেই কিছুক্ষণ চলে। তার পরে আবার সে চলতে থাকে পশ্চিম দিকে !! যদি বুধের আকাশে সুর্যকে ঠিক একই জায়গায় পরপর দুবার দেখতে পাওয়াকে একদিন বলে ধরি, সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয়, তবে তার একদিন মানে পৃথিবীর ১৭৬ দিন। এর মধ্যে অর্ধেক সময় (৮৮-দিন) দিবালোক, এবং বাকি অর্ধেক সময় রাত।
কিন্তু বুধের বছর খুব ছোট। নিজের কক্ষপথে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ করলে, তার এক বছর পূর্ণ হয়। এর জন্যে তার লাগে (পৃথিবীর হিসেবে) ৮৮-দিন। অর্থাৎ, বুধের একদিনের (Solar Day) মধ্যে তার দুটো বছর কেটে যায় ! একবছর কাটে সূর্যালোকে, আর পরের বছর কাটে তিমির আঁধারে। অর্থাৎ বুধে সূর্য ওঠে দুবছর পর পর।
এক বছর ধরে সূর্যের তেজ, তাপমাত্রা তখন ঝলসে যাওয়া ৪৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর পরের বছর জুড়ে অন্ধকার রাতের তাপমাত্রা প্রবল হিম মাইনাস ১৭০ ডিগ্রি। এখানে মানুষের পক্ষে বসবাস সম্ভব নয়। তবে দিন আর রাতের মাঝে যে গোধূলি অঞ্চল, যেখানে একটু পরেই সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্ত হবে, সেখানে তাপমাত্রা কিছুটা সহনীয়, প্রায় মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি। এই অঞ্চলকে, দিন আর রাতের মাঝে এই বিভাজনকে বলা হয় ‘টার্মিনেটর লাইন’। পৃথিবীতে বিষুবরেখার ওপরে এই টারমিনেটর লাইনের গতি ঘন্টায় প্রায় ১৬০০ কিমি। প্লেনে উড়ান থেকে, বিকেল ঘনিয়ে এলে ভূপৃষ্ঠের দিকে তাকালে, দেখা যায় এই টার্মিনেটর লাইনকে, যার একপাশে দিন আর অন্যপাশে রাত। অনেকেই খেয়াল করে দেখেছেন তাকে, আমিও দেখেছি।
তো, বুধগ্রহের ওপরে এই টারমিনেটর লাইনের গতি ঘন্টায় মাত্র ৩.৫ কিমি, প্রায় পায়ে হাঁটা গতির মতোই। তাই কয়েকটা বড় বড় ট্রাকে সংসার বোঝাই ক’রে কেউ যদি বুধগ্রহের ওপরে এই টারমিনেটর অঞ্চলে ক্যাম্প করে, এবং খুব ধীরে ধীরে একটু একটু করে এগোতে থাকে, তবে চিরকাল ধরে এই গোধূলি আলোর জগতে তারা থেকে যেতেও পারে। বসবাস করতে পারে ক্যারাভানে, সহনীয় মাইনাস ৭০-৮০ তাপমাত্রায়।
নীচে ছবিতে দেখা যাচ্ছে বুধগ্রহের ভূপৃষ্ঠে অজস্র ক্রেটার বা গহ্বর। আর সেই টার্মিনেটর জোন, যেখানে দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার এসে মিলেছে। ২০১২ সালে বুধের টার্মিনেটর জোনের এই ছবি তুলেছিল নাসার ‘মেসেঞ্জার’-নামক একটি উপগ্রহ।
বুধের নিজস্ব কোনও চাঁদ নেই। বুধগ্রহের ভূপৃষ্ঠে আছে বিরাট আকারের সব গহ্বর, একেকটা এমন বড় যে ইউরোপের কয়েকটা দেশ সেখানে এঁটে যাবে। এইসব ক্রেটারের হিমশীতল গভীরে, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না কখনো, বিজ্ঞানীরা মনে করেন সেখানে হয়তো জল আছে, কঠিন বরফ হয়ে। থাকতেও পারে।
এত ছোট একটা গ্রহ এই বুধ, অথচ তার চলাফেরায় এতখানি জটিলতা। আমাদের পৃথিবীর এই বাংলায়, কত বুধজন কত যুক্তি-তর্ক-গল্পের আসর জমিয়েছেন কত বুধসন্ধ্যায়, তাঁরা কি বুধগ্রহের এইসব জটিলতার কথা জানতে পেরেছেন কখনো? কখনো আগ্রহ হয়েছে?
শুক্রগ্রহ (Venus) :
সূর্য থেকে ক্রমে দূরে সরে এলে, বুধের পরের কক্ষপথেই রয়েছে শুক্রগ্রহ। এই গ্রহকেই আমরা ভোরের আকাশে শুকতারা বলি, বিকেলে একেই বলি সন্ধ্যাতারা। রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকে বালক অমল এই সন্ধ্যাতারার কথাই শুধিয়েছিল—‘সন্ধ্যাতারা কি উঠেছে ফকির?’ গ্রীক পুরাণে এই সন্ধ্যাতারার নামই হেসপারাস। আমার উৎপলকুমার বসুর কবিতা মনে পড়ছে—‘হেসপারাস, আশ্চর্য নক্ষত্র তুমি, এখনও এলে না’।
[Hesperus the Evening Star: painting by German painter Anton Raphael Mengs]
রোমানরা তাঁদের প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভিনাসের নামে এই গ্রহের নাম রেখেছেন। সারা বিশ্বে আজও এই দেবী সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষের আরাধ্য। পাঠকের মনে পড়তে পারে, বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রকরের আঁকা ছবি- ‘বার্থ অফ ভিনাস’ (১৪৮০)।
আমাদের পৃথিবীর সাথে আকার ও আয়তনে শুক্রগ্রহের কিছু মিল থাকলেও, অমিল অনেক। সূর্য থেকে ১০ কোটি ৮২ লক্ষ কিমি দূর দিয়ে গিয়েছে তার কক্ষপথ।
রুক্ষ, শুকনো এবং অতি বিপজ্জনক এই উজ্জ্বল সুন্দরী গ্রহ। এর কোনও চাঁদ নেই। নেই নিজস্ব চুম্বক ক্ষেত্র। ফলে মহাকাশ থেকে সতত বর্ষিত তেজস্ক্রিয় রশ্মি থেকে নিস্তার নেই এখানে। ফলতঃ কোনও প্রাণজীবন, এমনকি কোনও জীবাণুরও বেঁচে থাকা সম্ভব নয় এখানে। সম্পূর্ণ গ্রহটাই অতি তপ্ত এবং স্টারিলাইজড। গড় তাপমাত্রা ৪৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৌরমন্ডলের সবচেয়ে তপ্ত গ্রহ এই শুক্র। এত তপ্ত যে মুহূর্তে সীসাকেও গলিয়ে দেবে। এত তাপের কারণ এর ভারী বায়ুমন্ডল ঘন গ্যাসীয় মেঘে ঢাকা, সমস্ত তাপকে সে গ্রীনহাউসের মতো আটকে রাখে।
বাতাস ভরে আছে কার্বন আর সালফার ডাইঅক্সাইডের ঘন বাস্পে। বাতাসের চাপ পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৯২-গুণ বেশি !! এসব আসছে অসংখ্য আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে। শুক্রগ্রহে সমতল ভূমি ছাড়াও আছে বিশাল সব জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, পাহাড়, প্রকান্ড গহ্বর, আর হাজার হাজার মাইল গলিত ফুটন্ত লাভার নদী। ভূপৃষ্ঠের কাছে বায়ুমন্ডল কিছুটা শান্ত, কিন্তু ঊর্ধাকাশে ঘন মেঘ বাস্পের মধ্যে সর্বদা ঝড় বইছে, টর্নাডো ছুটছে ঘন্টায় ৪০০ কিমি গতিতে। মাঝে মাঝেই আছড়ে পড়ছে বিপুল শব্দে অতি তীব্র বজ্রবিদ্যুতের ঝলক। আকাশে অ্যাসিড বৃষ্টি হলেও তা মাটিতে পৌঁছতে পায় না। কারণ, ভূপৃষ্ঠের ৪৫০ ডিগ্রি তাপের কাছে আসার আগেই, বাস্পে পরিণত হয়, মুহূর্তেই।
সৌরমন্ডলের মধ্যে সুন্দরী ভিনাস বা শুক্রগ্রহ তাই এক ভয়াবহ নরক। গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমেরিকার নাসা, রাশিয়া এবং ইউরোপের স্পেস এজেন্সিগুলো অন্তত ৪০ বার উপগ্রহ পাঠিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে শুক্রগ্রহে।
আর একটা লক্ষ্ণণীয় জিনিস হল, সৌরমন্ডলের সমস্ত গ্রহরা তাদের অক্ষের ওপর ঘুরছে যেদিকে, তার ঠিক বিপরীতে ঘুরছে শুক্রগ্রহ। একমাত্রই সে-ই ঘুরছে বিপরীতে। তাই শুক্রগ্রহে সূর্য ওঠে পশ্চিম আকাশে, আর অস্ত যায় পূবে!
এছাড়া, শুক্রের একদিন তার এক বছরের চেয়েও বড়। নিজের অক্ষের ওপরে একবার পাক দিতে শুক্রের লাগে ২৪৩ দিন (পৃথিবীর দিনের হিসেবে)। সমগ্র সৌরমন্ডলে আর কারো একদিন পূর্ণ করতে এতটা সময় লাগে না। কিন্তু এর মধ্যে, অর্থাৎ একই দিনে, দুবার সূর্য ওঠে শুক্রের আকাশে, পৃথিবীর হিসেবে ১১৭ দিন পর পর। এছাড়া, সূর্যের চারিদিকে তার কক্ষপথে একবার পুরো ঘুরে আসতে শুক্রের লাগে প্রায় ২২৫ দিন, সেইটা তার এক বছর।
এর বেশি জটিলতার মধ্যে পাঠককে আমি আজ নিয়ে যেতে চাই না। এইসব থেকে ক্রমে আমাদের উপলব্ধি হবে, যখন সৌরমন্ডলের বাকি গ্রহগুলোও আমরা পরের পর্বে ঘুরে আসবো, বোঝা যাবে আমাদের পৃথিবী কেন সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে প্রিয়, কেন তাকে দুহাত দিয়ে আমাদের আগলে রাখা উচিত।
[ক্রমশঃ]
Posted in: PROSE, September 2021 - Serial