বাংলা সাহিত্যে আফগান প্রসঙ্গ অনুসন্ধান : শুভদীপ দেবনাথ

চলতি বছরের আগস্ট মাসে ন্যাটো কর্তৃক সেনা প্রত্যাহার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে আফগানিস্তান আবার খবরের শিরোনামে চলে আসে। মার্কিন সেনা বিদায় নেওয়ার আগেই আফগানিস্তানের সিংহ ভাগ অঞ্চল চলে যায় তালিবানদের দখলে। গত কয়েক দশক ধরে তালিবানি ক্রিয়াকলাপের যে নমুনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে এসেছে,তালিবানদের ক্ষমতা দখলের ঘটনায় সেই দুঃসহ স্মৃতি আবার ফিরে আসছে। যদিও আফগানিস্তানের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে এই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হবে না। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এই দেশ ভৌগোলিক কারণে বারংবার বিদেশি আক্রমণের শিকার হয়েছে, বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য আফগানিস্তানকে ‘করিডর’ হিসাবে ব্যবহার করেছে, সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকার ঠাণ্ডা যুদ্ধে ‘গিনিপিগ’ হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। গত শতকের সাতের দশকের শেষ দিকে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত রোধ করতে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে আসরে অবতীর্ণ হয় ধনতন্ত্রের প্রতিভূ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তি খর্ব করতে শুরু হয় তীব্র মৌলবাদী ইসলাম ধর্মের অপপ্রচার। পাকিস্তান এবং আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে জন্ম হয় কট্টর মৌলবাদী সংগঠন তালিবানের। নিরন্তর বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপ আর গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে হিন্দুকুশের কোল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর এই দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দ্রুত বদলাতে থাকে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবানরা। শুরু হয় সীমাহীন বর্বরতার এক নতুন অধ্যায়। সাধারণ মানুষ, বিশেষত আফগান মহিলাদের কাছে এই তালিবানি শাসন বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ধর্মের নামে চলে মনুষ্যত্বের নিধন-যজ্ঞ। সমস্ত রকম নান্দনিক সৃষ্টি সমূহ ধ্বংস করা হয় ধর্মের দোহাই দিয়ে। দেড় হাজার বছরের ঐতিহ্যশালী বামিয়ান বৌদ্ধ মূর্তি বিস্ফোরক দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। মৌলবাদের হাত ধরে হাজির হয় ওসামা বিন লাদেন এবং তার আল কায়দা গোষ্ঠী। এরপরের ঘটনাবলি সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে অন্ধকারতম অধ্যায়। আমেরিকার গর্ব বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের দুটি টাওয়ার জঙ্গি হামলায় ধ্বংস এবং তার প্রতিশোধ স্বরূপ সমগ্র আফগানিস্তানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মার্কিন প্রশাসন। সেই ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরতে থাকা আফগানিস্তান আবার থমকে গেল তালিবানের ক্ষমতা দখলের ঘটনায়।

সাহিত্যের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক পটভূমিকার উপস্থাপন একান্তই প্রাসঙ্গিক। সাহিত্য আমাদের জীবনেরই প্রতিফলন, কাজেই সামাজিক বা রাষ্ট্রিক জীবন সমস্যাসংকুল হলে সাহিত্যে তার বাস্তবায়ন ঘটবেই। বাংলা সাহিত্যের আঙিনাতেও তাই এই ধূসর, ঊষর, রুক্ষ আফগান ভূমি বারবার তার জীবন বাস্তবতাকে উপজীব্য করে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে হাল আমলের গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা বা ভ্রমণ সাহিত্যে আফগানিস্তান উঠে এসেছে তার স্বধর্মকে সঙ্গী করে। লেখনীর গুণে আফগানিস্তানের সেই রুক্ষ প্রান্তরই পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে পরম রমণীয়।

বাংলা সাহিত্যে আফগান প্রসঙ্গ আলোচনায় প্রথমেই যে রচনাটি আপামর বাঙালির মনে ভেসে ওঠে সেটি হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ছোটোগল্প ‘কাবুলিওয়ালা’। ১২৯৯ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত এই ছোটোগল্পটি অপত্যস্নেহের এক উজ্জ্বল দলিল। কলকাতার উচ্চশিক্ষিত বাবু এবং অসংস্কৃত এক কাবুলিওয়ালার একই মানবিক গুণে মিলেমিশে যাওয়ার কাহিনীকে রবীন্দ্রনাথ ছোটো প্রাণ ছোটো ব্যথায় ফুটিয়ে তুলেছেন । ছোটোগল্পের ছোটো পরিসরের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ আফগানিস্তানের প্রকৃতিকে অনবদ্য শিল্প সুষমায় তুলে ধরেছেন—
. . . আমি এমন উদ্ভিজ্জ প্রকৃতি যে, আমার কোণটুকু ছাড়িয়া একবার বাহির হইতে গেলে মাথায় বজ্রাঘাত হয়। এইজন্য সকালবেলায় আমার ছোটো ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া এই কাবুলির সঙ্গে গল্প করিয়া আমার অনেকটা ভ্রমণের কাজ হইত। দুই ধারে বন্ধুর দুর্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রেণী, মধ্যে সংকীর্ণ মরুপথ, বোঝাই-করা উষ্ট্রের শ্রেণী চলিয়াছে; পাগড়িপরা বণিক ও পথিকেরা কেহ-বা উটের পরে, কেহ-বা পদব্রজে; কাহারও হাতে হাতে বর্শা, কাহারও হাতে সেকেলে চক্মকি-ঠোকা বন্দুক— কাবুলি মেঘমন্দ্র স্বরে ভাঙা বাংলায় স্বদেশের গল্প করিত আর এই ছবি আমার চক্ষের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইত [১]।

কত সামান্য বর্ণনায় বাঙালি মননে এক টুকরো আফগানিস্তানের ছবি জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ ‘কাবুলিওয়ালা’। বাঙালির স্বভাব ধর্ম আর আফগান প্রকৃতির বৈপরীত্য এই গল্পের মূল দ্বন্দ্বকে গড়ে তুলেছে, অপত্যস্নেহের বাঁধনে যে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি। প্রাকৃতিক আনুকূল্য বাংলা ও বাঙালিকে যেমন কোমল করে তুলেছে তেমনই প্রকৃতির রুক্ষতা আফগানদের করে তুলেছে কঠোর, কঠিন, দুর্দম। সেই আপাত কাঠিন্যের অন্তরালেও যে একটি স্নেহভারাতুর পিতৃহৃদয় লুকিয়ে থাকতে পারে, আফগানিস্তানের ঊষর প্রান্তরেও যে মমত্বের স্নিগ্ধ বারিধারা সিঞ্চিত হতে পারে রহমত কাবুলি সেই সত্যকেই বাংলা সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেল।

আফগানিস্তান কেন্দ্রিক দ্বিতীয় যে রচনাটি আমাদের আলোচ্য তা শুধু এই প্রসঙ্গেই নয়, সমগ্র বাংলা গদ্য সাহিত্যের নিরিখেই এক বিশিষ্ট মাইল ফলক। বিশেষজ্ঞ সমালোচকের উচ্চ প্রশংসা এবং সাধারণ পাঠককুলের অকৃত্রিম ভালোবাসা খুব কম লেখার ভাগ্যে জুটে থাকে; সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ সেই রকমই এক বিরল শ্রেণির রচনা। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার পাঠ সাঙ্গ করে মুজতবা আলী আফগান সরকারের অনুরোধে ‘কাবুল কৃষি কলেজ’-এর ইংরেজি ও ফারসি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। মূলত সেই সময়কার (১৯২৭-২৯) আফগানিস্তানের শিক্ষা-কৃষি–ব্যবসা–বাণিজ্যের বিবরণসহ সেখানকার আর্থ-সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রিক পরিমণ্ডল বর্ণনার সরস উপস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ‘দেশে বিদেশে’। ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর ‘দেশে বিদেশে’ ১৯৪৮ সালে পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। বহুভাষাবিদ, বিদগ্ধ পণ্ডিত মুজতবা আলীর লেখনী গুণে শুষ্ক-মরুময় আফগানিস্তানও সজীব-প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে। ভ্রমণ কাহিনী, মন্ময় প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, রম্যরচনা— যে অভিধাতেই চিহ্নিত করা হোক না কেন এ রচনার গোত্র নির্ণয় করা কার্যত অসম্ভব। অপরিচিতকে জানবার কৌতূহল, স্বদেশপ্রীতি, মার্জিত প্রকাশভঙ্গীর সঙ্গে সমগ্র লেখা জুড়ে এক অন্তঃসলিলা হাস্যরসের ধারা ‘দেশে বিদেশে’কে পাঠকের কাছে অতি উচ্চমানের এক সাহিত্য সৃষ্টি হিসাবে উপস্থাপিত করেছে। আফগান মুলুকে পাঠানদের জাত্যভিমানের ছোট্ট এক উদাহরণ দিয়েছেন মুজতবা আলী এক ঘরোয়া আলাপচারিতার মোড়কে—
অধ্যাপক বললেন, ‘পাঠানের সোপ বক্স লেকচার শোনেননি বুঝি কখনো। সে বলে, ‘ভাই পাঠানসব, এস আমরা সব উড়িয়ে দি; ডিমোক্রেসি, অটোক্রেসি, বুরোক্রেসি, কমুনিজম, ডিক্টেটরশিপ— সব সব।’ আরেক পাঠান তখন চেঁচিয়ে বলল, ‘তুই বুঝি অ্যানার্কিস্ট?’ পাঠান বলল, ‘না, আমরা অ্যানার্কিও উড়িয়ে দেব।’
অধ্যাপক বললেন, ‘বুঝতে পেরেছেন?’
আমি বললুম, ‘বিলক্ষণ, রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তারপর ‘না’ হয়ে যাবে।’ এই তো?’
অধ্যাপক বললেন, ‘ঠিক ধরেছেন।’[২]

সামান্য এই কয়েকটি লাইনের মধ্যে থেকেই পাঠান জাতির মানসিকতা এবং আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ যেন নির্ধারিত হয়ে যায়। সমস্ত ‘দেশে বিদেশে’ জুড়ে এমনই ছোটো ছোটো বর্ণনায় লেখক আফগানিস্তানের প্রকৃতি, জলবায়ু, মানুষ, খাদ্যাভ্যাস, আদব-কায়দা সব কিছুকে ছুঁয়ে গেছেন। রুক্ষ আফগানিস্তানের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক এমন এক উদাহরণ টেনে আনেন যেখানে বীভৎস আর হাস্যরস একই সঙ্গে অবস্থান করে—
হস্টেলে স্টোভ ধরাতে গিয়ে এক আনাড়ি ছোকরা একবার জ্বলন্ত স্পিরিটে আরো স্পিরিট ঢালতে গিয়েছিল। ধপ করে বোতলে স্টোভে সর্বত্র আগুন লেগে ছোকরার ভুরু, চোখের লোম, মোলায়েম গোঁপ পুড়ে গিয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে এক অপরূপ রূপ ধারণ করেছিল। এখানে যেন ঠিক তাই। মা ধরণী কখন যেন হঠাৎ তাঁর মুখখানা সূর্যদেবের অত্যন্ত কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন— সেখানে আগুনের এক থাবড়ায় তাঁর চুল ভুরু সব পুড়ে গিয়ে মাটির চামড়া আর ঘাসের চুলের সেই অবস্থা হয়েছে।[৩]

নদ-নদী পরিবেষ্টিত শস্য-শ্যামলা প্রকৃতির কোলে বাসকারী বাঙালি মননে আফগানিস্তানের ঊষরভূমিকে এর চেয়ে প্রাঞ্জল ভাবে ব্যক্ত করা মুজতবা আলী ব্যতীত অন্য কোনো লেখকের দ্বারা সম্ভব নয়। সেই ঊষর প্রান্তরে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী হাতছানিকেও আলী সাহেব বর্ণনা করেন এক অদ্ভুত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে, যে নিরাসক্তি পাঠককে শিহরিত করে তোলে এক লহমায়—
তারপর দেখি মৃত্যুর বিভীষিকা। প্রকৃতি এই মরু প্রান্তরে প্রাণ সৃষ্টি করেন না বটে কিন্তু প্রাণ গ্রহণে তিনি বিমুখ নন। রাস্তার ঠিক উপরেই পড়ে আছে উটের এক বিরাট কঙ্কাল। গৃধিনী শকুনি অনাহারে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুভয়ে এখানে আসে না বলে কঙ্কাল এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়েনি। রৌদ্রের প্রকোপে ধীরে ধীরে মাংস শুকিয়ে গিয়ে ধুলো হয়ে ঝরে পড়েছে। মসৃণ শুভ্র সম্পূর্ণ কঙ্কাল যেন যাদুঘরে সাজানো বৈজ্ঞানিকের কৌতূহল সামগ্রী হয়ে পড়ে আছে।[৪]

আফগানভূমে মৃত্যু কতখানি নিষ্ঠুর হতে পারে শকুনের মৃত্যুভয় যেন সেই সত্যকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে। মানুষের বর্ণনা, রাস্তার বর্ণনা, সরাইখানার বর্ণনা— সব কিছুর মধ্যে দিয়েই মুজতবা আলী সমগ্র আফগানিস্তানকে তাঁর লেখায় জীবন্ত করে তোলেন। দেশে বিদেশের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো মানুষের লেখায় যখন আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো সরাইখানের বিবরণ দেখতে পাই তখন সেখানে এক তুলনামূলক সমালোচনা প্রত্যাশিত থাকে, কিন্তু লেখক যদি হন মুজতবা আলী তাহলে সেই বিবরণ কতখানি সরস হয়ে ওঠে তা পাঠকমাত্রেই অনুধাবন করতে পারবেন—
ঢুকেই থমকে দাঁড়ালুম। কত শত শতাব্দীর পুঞ্জীভূত দুর্গন্ধ আমাকে ধাক্কা মেরেছিল বলতে পারিনে, কিন্তু মনে হল আমি যেন সে ধাক্কায় তিন গজ পিছিয়ে গেলুম। ব্যাপারটা কি বুঝতে অবশ্য বেশী সময় লাগল না। এলাকাটা মৌসুমি হাওয়ার বাইরে, তাই এখানে কখনো বৃষ্টি হয় না— যথেষ্ট উঁচু নয় বলে বরফও পড়ে না। আশেপাশে নদী বা ঝরনা নেই বলে ধোয়ামোছার জন্য জলের বাজে খরচার কথাও ওঠে না। অতএব সিকন্দরশাহী বাজীরাজ থেকে আরম্ভ করে পরশুদিনের আস্ত ভেড়ার পাল যে সব ‘অবদান’ রেখে গিয়েছে, তার স্থূলভাগ মাঝে মাঝে সাফ করা হয়েছে বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম গন্ধ সর্বত্র এমনি স্তরীভূত হয়ে আছে যে, ভয় হয় ধাক্কা দিয়ে না সরালে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব; ইচ্ছে করলে চামচ দিয়ে কুরে কুরে তোলা যায়। চতুর্দিকে উঁচু দেয়াল, মাত্র একদিকে একখানা দরজা। বাইরের হাওয়া তারি সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়, অন্যদিকে পথ নেই দেখে ঐ জালিয়ানওয়ালাবাগে আর ঢোকে না। সূচীভেদ্য অন্ধকার দেখেছি, এই প্রথম সূচীভেদ্য দুর্গন্ধ শুঁকলুম।[৫]
‘দেশে বিদেশে’-র ছত্রে ছত্রে এভাবেই সূক্ষ্ম হিউমার সহযোগে আফগানিস্তানের মত একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। বর্ণনার গুণে ‘দেশে বিদেশে’-তে আফগানিস্তান নিছক পটভূমি হয়ে থাকে না, রাষ্ট্রিক-ভৌগোলিক সত্তাসহ নিজেই এক চরিত্র হয়ে ওঠে।

সৈয়দ মুজতবা আলীর অন্য যে রচনাটি এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য তা হল ‘শবনম’ (১৯৬০)। বাঙালি পাঠকের কাছে ‘শবনম’ পরিচিত আদ্যন্ত রোম্যান্টিক আখ্যান হিসাবে। তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান অষ্টাদশী শবনম এবং বাঙালি অধ্যাপক মজনুন-এর প্রেমকাহিনী এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য, আর এই আখ্যানের কাহিনী বিস্তার লাভ করেছে আফগানিস্তানের পাগনান, কাবুল প্রভৃতি শহরজুড়ে। কবিতায় মোড়া এই উপন্যাসের পরতে পরতে রয়েছে আফগান সংস্কৃতির টুকরো টুকরো অনুষঙ্গ। শবনম-মজনুনের প্রেমকাহিনীতে মুজতবা আলী দেশকালের প্রসঙ্গকে এড়িয়ে যাননি, তাদের সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার কথা উঠে এসেছে ‘শবনম’এর পাতায়—
. . . তার বাবাকে আমানুল্লাহ কান্দাহারে গবর্নর করে পাঠাচ্ছেন। ফ্রান্সের নির্বাসন শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরলেন বটে, কিন্তু আমানুল্লাহ আর সর্দার আওরঙ্গজেব খানেতে বনিবনা হল না; বিশেষত তিনি আমানুল্লাহর উগ্র ইউরোপীয় সংস্কার পদ্ধতি আদপেই পছন্দ করতেন না। এখন ইউরোপ যাবার মুখে তিনি বিশ্বাসী লোক খুঁজছেন। আওরঙ্গজেব নাকি প্রথমটায় যেতে চান নি। এখন স্থির হয়েছে, তিনি মাত্র তিন মাসের জন্য যাবেন। আওরঙ্গজেবের পিতৃভূমি কান্দাহার তিনি ভালো করে চেনেন— তিন মাস পরে অবস্থা দেখে আমানুল্লাহকে জানাবেন, ঠিক কোন লোককে তাঁর পরের গবর্নর করে পাঠালে সে কান্দাহারের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে।
এত দুঃখের মাঝখানেও ওইটুকু ছিল আনন্দের বাণী। কাবুলে রাজনৈতিক মরুভূমিতে বাস এক রকম অসম্ভব। হয় তুমি রাজার পক্ষে, রাজার প্রিয়ভাজন— নয় তুমি কারাগারে কিংবা ওপারে;[৬]
পারস্পরিক অবিশ্বাস, পশ্চিমী সংস্কৃতি- বিদ্বেষ, একনায়কতন্ত্র— সব কিছু মিলিয়ে আফগানিস্তানকে চিনে নিতে এতটুকু কষ্ট হয় না আমাদের। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি ‘শবনম’ আমাদের আফগান সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককেও সামনে নিয়ে আসে। যে কোনো সম্প্রদায়ের জাতিগত ঐতিহ্য লুকিয়ে থাকে তার বিভিন্ন সামাজিক লোকাচারের মধ্যে। শবনম-মজনুনের বিয়ের বর্ণনায় আমরা আফগান সংস্কৃতির সেইসব অজানা লোকাচারকেই প্রত্যক্ষ করি—
আমাকে মুখোমুখি বসিয়ে আমার হাতে কাঁচি দিয়ে বললে, ‘আমার জুল্ফ্ কাটো।’
বাঙলা জুলপি কথাটা ‘জুল্ফ্’ থেকে এসেছে। ইরান তুরানের কুমারীদের অনেকেই দু গুচ্ছ অলক রগ থেকে কানের ডগা অবধি ঝুলিয়ে রাখে। শবনমের চুল ঢেউ-খেলানো বলে তার জুল্ফ্ দুটির সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ।
আমি ঠিক জানি নে, একদা বোধ হয় ইরান তুরানের বর বাসর ঘরে নববধূর জুল্ফ্ দুটি পুরোপুরিই কেটে দিত। এর পর যে-নূতন চুল গজাত নববধূ সে চুল কানের পিছনে অন্য চুলের সঙ্গে মিলিয়ে দিত। জুল্ফে হক্ক কুমারীদের— ইরানে বলা হয় ‘দুখ্তর্’, সংস্কৃতে ‘দুহিতৃ’ স্পষ্ট বোঝা যায় একই শব্দ। আজকাল এই জুল্ফ্ কাটার রেওয়াজ যে-সব জায়গায় আছে সেখানেও বোধ হয় জুল্ফের শুধু ডগাগুলোই কেটে দেওয়া হয়।[৭]
আদ্যন্ত কাব্যিক প্রেমকাহিনীর মধ্যে মুজতবা আলী এভাবেই অচেনা এক জনজাতির নিজস্ব লোকাচারের অনুরণন সঞ্চারিত করে দিতে থাকেন, বাঙালির প্রেমের আখ্যান হয়ে ওঠে আফগানিস্তানের কৃষ্টি-সংস্কৃতির এক অনুপম অভিজ্ঞান।

বাংলা ভাষায় ভ্রমণ সাহিত্যের সংরূপটির ইতিহাস নেহাত ছোটো নয়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে সেই ধারা আজও বহমান। তবে সেই ভ্রমণ সাহিত্য যদি হয় কোনো ভূপর্যটকের বয়ানে তাহলে তার প্রসাদগুণ সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দেবে একথা বলাই বাহুল্য। ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করে এক সময় বাঙালি সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। রামনাথ বিশ্বাসের আফগানিস্তান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে তাঁর ‘আফগানিস্তান’ নামক ভ্রমণ বৃত্তান্তে। পরাধীন দেশের নাগরিক হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করার সুবাদে বারংবার তাঁর লেখায় স্বদেশের কথা, পরাধীনতার গ্লানি ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব ধারণার অযাচিত উপস্থাপনাও এই ভ্রমণ কাহিনীকে একাধিক জায়গায় রসভঙ্গ করেছে। আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে লেখকের ঔৎসুক্য ও মূল্যায়ন এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষণীয়—
রাত্রের অন্ধকারে কয়েকটি হিন্দু বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম এরা নির্জীবের মত দিন কাটিয়ে যাচ্ছে। এদের শরীরে তেজবীর্য আছে বলে মনে হয় না। প্রত্যেকের শরীর রুগ্ন এবং দেখলেই মনে হয় আয়েসি। ওরা আমাকে একটুও প্রীতির চক্ষে দেখলে না। তারা হয়ত এই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছিল যে আমি তাদের বাড়ীতে থাকতে গিয়েছি। একজন হিন্দুকে দেখে যারা শঙ্কিত হয়, অতিথি গ্রহণে ভীত হয়, তাদের বাড়ীতে থাকা পাগলের পাগলামি ছাড়া আর কি হতে পারে। . . . আমি গিয়েছিলাম, এখানকার হিন্দুরা কেমন করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে তা দেখতে। যদি দেশে গিয়ে বলতে পারি, নতুনের প্রতি সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে শুধু পুরাতন আচার-পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে থাকলে কি করে একটা জাত ধরাপৃষ্ঠ হতে বিলুপ্ত হতে থাকে, তাতে হিন্দুদের উপকার হতে পারে। এই হতভাগারা টাকার কুমীর, অথচ কৃপণ। ওরা নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্যও টাকা খরচ করে না, টাকা খরচ করে স্বর্গে যাবার জন্য। এদের মুখে হাসি নেই, এরা অতিথি দেখলে ভয় পায়। এদের এই অবস্থা মরবার পূর্বলক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়। সনাতনী হিন্দুরা নিজের ধ্বংসের কারণ না অন্বেষণ করে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েই সুখী হয়। আফগানিস্তানের শিয়া শ্রেণীর মুসলমানও মাইনরিটি, তারাও পাঠানদের পছন্দ করে না, কিন্তু তাদের সামাজিক রীতিনীতিতে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকায় পাঠানদের একটুও ভয় করে না। সনাতনী হিন্দুদের যদি গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকত, তবে কখনও পাঠানের ঘাড়ে সকল দোষ চাপিয়ে দিয়ে মুখ বুজে থাকত না।[৮]

রামনাথ বিশ্বাসের লেখনীতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস্তব অবস্থা এভাবেই ফুটে উঠেছে। সাইকেলে ভ্রমণ করলে যে কোনো অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটে, কিন্তু রামনাথ বিশ্বাসের লেখায় আফগানিস্তানের প্রকৃতি ততখানি ধরা পড়েনি যতটা সেখানকার মানুষের কথা ধরা পড়েছে। আফগানিস্তানের মানুষ ও তাদের ধর্মীয় পরিচয় রামনাথ বিশ্বাসের লেখার সিংহভাগ অংশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে তার মধ্যেও তাদের রীতি-নীতি, ভাষা ব্যবহার লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি—
. . . আফগানিস্তানে উর্দু ভাষার প্রচলন শুধু হিন্দুদের মাঝেই আবদ্ধ, কিন্তু অন্যান্যরা হিন্দুস্থানীই জানে এবং উর্দু মোটেই পছন্দ করে না। নমুনাস্বরূপ দু’একটি কথা বলতে পারি। মুসলমানরা বলে—তোমারা নাম কিয়া হায়? তুম কিদার যাওগে?‘তোমারা কাম বন্ যায়েগা। হিন্দুরা বলে,ইসমে সরীফ?আপকা দৈলতখানা? আপ কামইয়াব হো যাওগে। আফগানিস্থানে হিন্দুস্থানী এবং উর্দুর স্রোত ভারত হতে যায়নি, ইরান হতে এসেছে।ইরান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সীমানা নিয়ে ঝগড়া হয়; সেজন্যই পাঠানরা ইরানী শব্দ ব্যবহার পছন্দ করে না, তারা চায় পোস্ত শব্দ ব্যবহার করতে।[৯]

আফগানিস্তানের মানুষের রীতি-রেওয়াজের পাশাপাশি ইতিহাসের অনুষঙ্গও উঠে এসেছে রামনাথ বিশ্বাসের লেখায়। ইতিহাসের জয়-পরাজয়ের আলেখ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধের সামনে উপস্থিত হয়ে লেখক মুহূর্তের জন্য শিল্পকলার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছেন—
পাহাড়ের ওপর আছে একটি প্রকাণ্ড সমতল ভূমি। তারই ওপর পুরাতন একটা স্তম্ভ। স্তম্ভটি সুলতান মামুদ তাঁর জয়ের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ গড়েছিলেন। যুক্ত গাত্রে চিত্রকলার বহু নিদর্শন ছিল। চিত্র দেখে প্রাচীন দ্রাবিড় যুগের বলেই মনে হচ্ছিল। আরব সভ্যতার কোন ছাপ তাতে ছিল না। স্তম্ভটি দেখে মনে হল উন্নত শীর্ষে দাঁড়িয়ে থেকে এটি জয়ের বার্তাই ঘোষণা করছে।[১০]
বাঙালি ভূপর্যটকের লেখনীতে আফগানিস্তানের এই বিবরণ ঐতিহাসিকতার দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হলেও সাহিত্যরসের বিচারে নিতান্তই সাধারণ মানের, স্বাভাবিক কারণেই আজ এই গ্রন্থ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

পরবর্তী যে গ্রন্থটি আফগানিস্তান প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সেটি হল সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ (১৯৯৭)। এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৩ সালে বলিউডে তৈরি হয় ‘এস্কেপ ফ্রম তালিবান’ নামক সিনেমা, যার দৌলতে বহুল পরিচিতি পায় লেখাটি। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের জীবন অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাসে তালিবানি সন্ত্রাসের মর্মন্তুদ বর্ণনা পাঠককে শিহরিত করে। গত শতকের আটের দশকের শেষ ভাগের আফগানিস্তান এই উপন্যাসের পটভূমি—
আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন গোটা কাবুল শহর জুড়ে সদর্পে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে রাশিয়ার সৈন্য। আর শুনেছি সেই সময়, আঠারো থেকে আটত্রিশ বছর বয়সের দাড়িওয়ালা কোনও অচেনা যুবকই নাকি গ্রাম থেকে শহরে যেতে পারত না। কারণ, রাশিয়ানরা তাদের ধরে কয়েদখানায় ঢুকিয়ে দিত। পরে, সময় বুঝে তাদের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করত। ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয় হোক, সোভিয়েত সৈন্যদলে তাদের যোগ দিতেই হবে। তা না হলে তাঁদের দাঁড়াতে হত ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। . . . আর গ্রামে আছে মুজাহিদ— যারা ১৯৭৯ থেকে সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে চলছে। মুজাহিদরা সোভিয়েত সরকারকে ও তাদের হাতের পুতুল ডঃ নাজিবুল্লাকে দেশের চরম শত্রু বলে ভাবে। তাই ওরা সবাই “খাল্‌কি” অর্থাৎ দেশদ্রোহী। নাজিব নাকি দেশের মন্ত্রীর আসনে বসে দেশকে সোভিয়েতের কাছে তুলে দিচ্ছে।[১১]

উপন্যাসের শুরুতেই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থাকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন লেখিকা। এই রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকেই কাহিনী ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছে আফগান অন্তঃপুরে। এর আগে যে কয়েকটি লেখায় আমরা আফগান প্রসঙ্গ পেয়েছি সবই পুরুষের জবানিতে। কট্টর মৌলবাদী তালিবানি শাসনে সাধারণ আফগান মহিলাদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা প্রথম অবহিত হলাম সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। আফগান পুরুষদের বহুগামিতা, শরিয়তের নামে অন্যায় শাসন, মহিলাদের উপর সীমাহীন অত্যাচার, মনুষ্যত্বের অবমাননা— যেন এ সবকিছুই আফগানিস্তানের স্বাভাবিক রোজনামচা। পুরুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ‘অপরাধে’ গলা নলি কেটে আফগান মহিলাকে হত্যা, স্ত্রীর উপস্থিতিতে অন্য নারীর সঙ্গে অবাধ যৌনতা, জোর করে ধর্মান্তরিত করা— একের পর এক শিহরণ জাগানো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন সুস্মিতা তাঁর উপন্যাসে। সুস্মিতা আফগানিস্তানে মহিলাদের বন্দী জীবনের ছবি তুলে ধরেছেন নিজের জীবনের টুকরো টুকরো অনুভূতি দিয়ে—
আফগানিস্তানে মেয়েদের কোনো স্বপ্ন নেই। বিরাট কিছু পাওয়ার আশা নেই। এদেশে মেয়েরা বাবা-মার ব্যাঙ্ক ডিপোজিটের সার্টিফিকেট। আর একটু দৈহিক সুখের বিনিময়ে সারাজীবন স্বামীর বাড়িতে মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করতে হয়। . . . চোখ দুটো দিয়ে শুধুই যেন আগুন ঝরতে থাকে। শুধু প্রতীক্ষা, কবে আমি হিন্দুস্থানে পৌঁছব? . . . মাঝে মাঝে ভাবি, আমি পালিয়ে চলে যাচ্ছি আমেরিকায়। কল্পনায় সেখানে একটা নাটকের হল তৈরি করে নিই। আর নাটকের নায়িকা আমি।[১২]

অসহনীয় বন্দী জীবন থেকে মুক্তির উড়ান প্রত্যাশী এক নারীমনের অস্ফুট সংলাপ এ কাহিনীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও আফগানিস্তানের দুঃসহ জীবন নিয়ে সুস্মিতা একাধিক বই লিখেছেন। তাঁর ‘মোল্লা ওমর তালিবান ও আমি’, ‘তালিবান আফগান ও আমি’, ‘এক বর্ণ মিথ্যে নয়’ ইত্যাদি গ্রন্থে যেমন তৎকালীন আফগানিস্তানের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারা যায়, তেমনই পাওয়া যায় এক স্বাধীনচেতা নারীর দৃঢ় মানসিকতার সন্ধান।

পান্থজন রচিত ‘কাবুলের পথে পথে’ বইটি আমেরিকার হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠন কালের দলিল স্বরূপ। লেখক পান্থজন ওরফে ডা. অরূপ রতন বসু পেশায় শল্য চিকিৎসক। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ভারত সরকার প্রেরিত সাহায্যকারী দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে লেখক হাজির হন কাবুল শহরে। একজন চিকিৎসক হিসাবে পান্থজন প্রত্যক্ষ করেন আস্ত একটা দেশের সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অসহায় অবস্থা—
স্বাস্থ্যের অবস্থা চরম ভাবে খারাপ। বাচ্চাদের মধ্যে শতকরা চল্লিশ জনের হয় মা নয় বাবা মারা গেছে। বেশির ভাগই যুদ্ধের দরুন মৃতদেহ দেখেছে এবং জেনে গেছে, ওরাও একদিন এইভাবে মরে যাবে। পরিষ্কার বলে সে কথা। আড়াই কোটি আফগানির মধ্যে ষাট লক্ষের কোনও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই। পঁচিশ শতাংশ বাচ্চা পাঁচ বছর পেরোবার আগেই মারা যায়। মেয়েদের মধ্যে যুদ্ধের প্রভাব খুব বেশিভাবে পড়েছে। মোটামুটি তিন ভাগের একভাগ মেয়ের মানসিক উদ্বেগ এবং অসুখ আছে।[১৩]

নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি পান্থজন আফগানিস্তানের ইতিহাসকেও তুলে আনেন তাঁর লেখায়। কীভাবে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসলামিক মৌলবাদকে হাতিয়ার করে আমেরিকা তালিবানের জন্ম দেয়, সেই তালিবানের সঙ্গে আল কায়দা যোগে কীভাবে ৯/১১-র মত ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হয় আপামর বিশ্ববাসী— সেই ইতিহাসকে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেন পান্থজন। ইতিহাসের পাশাপাশি সমান তালে চলতে থাকে যুদ্ধ কবলিত এক জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী—
লাখপতিদের বাজার থেকে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমরা একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকানে ঢুকলাম। এই ধরনের দোকান ইদানীং হয়েছে এখানে। হিন্দি সিনেমার খুব চল। বেশির ভাগ লোকই একবর্ণ বুঝতে পারে না তবু হাঁ করে সেসব সিনেমা দেখে। কিছু লোক অবশ্য সেই সমস্ত সিনেমা দেখেই ভাঙা ভাঙা হিন্দি ও উর্দু শিখে গেছে। এখানকার প্রচুর লোক হিন্দুস্থান বলতে বম্বে আর বলিউডকেই জানে। অমিতাভ বচ্চনের ‘খুদাগাওয়া’ আর ধর্মেন্দরের ‘ধর্মাত্মা’ সিনেমার অনেক অংশ আফগানিস্তানে তোলা হয়েছিল। লম্বা চওড়া জাঁদরেল আফগানিরা সেইসব সিনেমার মারামারির সিনগুলো একেবারে মুখস্থ করে রেখেছে। তালিবানরা বিদায় হবার পরে আবার করে হিন্দি সিনেমা আর বলিউডের আক্রমণ হয়েছে কাবুলে। রাস্তায়, ফুটপাথে সিনেমার হিরো-হিরোয়িনদের ছবির ছড়াছড়ি।[১৪]

এরপর হালকা চালে পান্থজন বলিউডি সিনেমার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার কিঞ্চিৎ নমুনা তুলে ধরেছেন। বম্বেতে থাকার কথা শুনে আফগানদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, লেখক এবং তাঁর সঙ্গীরা কোনোমতে সেই ভালোবাসার অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পান। যুদ্ধ পরবর্তী আফগানিস্তানের বিভিন্ন ছোটোখাটো বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি এই বইয়ের অন্যতম সম্পদ অসংখ্য আলোকচিত্র। কাবুল সহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানের একাধিক ফটোগ্রাফ সেই দেশ সম্পর্কে পাঠককের আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

অমিতাভ রায়ের ‘কাবুলনামা’ (২০১০) এই ধারার আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।জাতীয় স্তরের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকল্প নিরীক্ষণের আধিকারিক অমিতাভ রায় পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে কাটিয়েছেন। ইউ.এন.ডি.পি নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ হিসেবে আফগানিস্তান সরকারের উপদেষ্টা হয়ে কাবুলে থাকাকালীন তাঁর যে বিপুল অভিজ্ঞতা হয় তারই প্রতিফলন ‘কাবুলনামা’। সরকারি আধিকারিক হিসাবে নির্মীয়মাণ একটি দেশের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনই কৌতূহলী পর্যটকের চোখ দিয়েও ধরা পড়েছে আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই গ্রন্থে পরিসংখ্যান সহযোগে নতুন ভাবে গড়ে ওঠা আফগানিস্তানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন লেখক। গল্পের মত করে বলা এই তথ্যগত সহযোজন পাঠককে আফগানিস্তান সম্পর্কে আরও সমৃদ্ধ করে। লেখক আফগানিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার নিদর্শন তুলে ধরেছেন এইভাবে—
কাবুলের অন্যতম সেরা বিদ্যালয় ‘লাইসি ইস্তিকলাল হাই স্কুল’-কে আমাদের দপ্তরের প্রতিবেশীই বলা চলে। . . . শহরের ব্যস্ততম এবং অভিজাত এলাকায় অবস্থিত ‘লাইসি ইস্তিকলাল’ ফরাসিদের উদ্যোগেই একসময় স্থাপিত হয়েছিল। এখনও নাকি ফরাসি অনুদান আসে। এবং এখানে নাকি ফরাসি ভাষা শেখার সুযোগ আছে। স্বভাবতই দেশের সেরা ছাত্র ও মাস্টারমশাইদের সমাহার, লাইসি ইস্তিকলাল। চমৎকার স্কুল বিল্ডিং, বিশাল খেলার মাঠ এবং অডিটোরিয়াম।
. . . সরকারি হিসেবে এখন সারা দেশে নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সাতান্ন লক্ষ। এর মধ্যে অন্তত পঁয়ত্রিশ শতাংশ ছাত্রী। একেবারে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তরের ছাত্রছাত্রীকে এই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়েছে। হাতে কলমে কাজ শেখার যেমন কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, মোটর মেকানিক, কার্পেট বয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও বাদ যায়নি। মেডিক্যাল এবং এডুকেশন ছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং ও কৃষিবিজ্ঞানের আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের চেয়ে একটু বেশি। প্রায় পৌনে তিন হাজার শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে এরা লেখাপড়া শিখছে।[১৫]
অপরিসীম দারিদ্র একটি দেশকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তান। অমিতাভ রায়ের কলমে সেই আফগানিস্তানই বারবার উঠে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগে আপন কৃষ্টি-সংস্কৃতি চাপা পড়তে থাকা একটা জাতির গুমরে মরা যন্ত্রণাও ‘কাবুলনামা’র পাতায় পাতায় গ্রথিত হয়ে আছে। নতুন নতুন সরকারি প্রকল্পের বর্ণনার মধ্যেও লেখক আফগান সংস্কৃতির কিছু কিছু ঝলক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন—
কাবুলি নাচেও কম যায় না। এদেশের নাচের নিজস্ব ঘরানা ‘আটান’ নামে পরিচিত। স্থান ভেদের জন্যে কখনও-সখনও নাচের মুদ্রায় ও পদছন্দে সামান্য পার্থক্য খুঁজে পেলেও নৃত্য পরিবেশনের ভঙ্গিতে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না। . . . নৃত্যশিল্পীদের পরনে শিলওয়ার-কামিজ, পায়ে লোহার নাল লাগানো একজোড়া ভারী বুটজুতো। মাথায় চাদর বা হিজাব খোঁজার চেষ্টা করতে হবে না; কারণ শিল্পীরা সকলেই পুরুষ। . . . কণ্ঠ নিঃসৃত দিগন্ত কাঁপানো গানে সুরসপ্তকের ব্যাকরণ মানা হয় কিনা তা বিচারের ভার সংগীতজ্ঞদের উপর ছেড়ে দিলে চোখের সামনে আন্দাজ করতে পারবেন যে কাবুলির আর্থিক দারিদ্র প্রবল হলেও শারীরিক ক্ষমতায় প্রাচুর্যের অভাব নেই।[১৬]

তীব্র আর্থিক দারিদ্র এবং প্রবল শারীরিক সক্ষমতা— এই নিয়েই যেন আবহমান কাল ধরে আফগানরা বেঁচে আছে, ভবিষ্যতে এই অবস্থার আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে কিনা তা আগামীই স্থির করবে। ‘কাবুলনামা’ শেষ হয়েছে তালিবানদের আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা ও সেই হামলায় লেখকের পরিচিত এক প্রাণোচ্ছল তরুণীর করুণ মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। এই আফগানিস্তান কত অনিশ্চিত, কত বিপদসংকুল এবং কতখানি নির্মম হতে পারে সেই কঠিন বাস্তবকেই উপলব্ধি করায় ‘কাবুলনামা’।

বাংলা সাহিত্যে আফগান প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনার শেষতম সংযোজন দেবশ্রী চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘আফগানিস্তান’। উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সব্যসাচী’ পত্রিকায়। তালিবানের উত্থান পর্ব থেকে এই সময়ের আফগানিস্তানের এক চলমান ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। বিশেষত নারী এবং শিশুদের করুণ পরিস্থিতি বর্ণনায় বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের মূল চরিত্র আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক বিবি আয়েশা ওরফে নাদিয়া, প্রথম জীবনে যে তালিবানদের হাতে নির্মম ভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। আমেরিকার পালক পিতার কাছে বেড়ে ওঠা নাদিয়া সাংবাদিক হয়ে আফগানিস্তানে ফিরে আসে। এই নাদিয়ার জবানিতেই পাঠকের সামনে আফগানিস্তানের কাবুল,কান্দাহার, গজনী শহর বাস্তব হয়ে ওঠে। লেখার গুণে বাদামবাগ জেল থেকে হুমা-করিমার অন্দরমহল— সর্বত্র পাঠক অনুভব করে আফগানিস্তানের একান্ত নিজস্ব সৌরভ।আদিরা,নাস্মা,আফ্রুন,জুনেদ, বালিকা নূর— একাধিক নারী চরিত্রের সমন্বয়ে এই উপন্যাস আফগানিস্তানের অন্দরমহলকে আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। ইতিহাসের ছাত্রী দেবশ্রী তাঁর লেখায় আফগানিস্তানের অনেক অকথিত ইতিহাসকে তুলে আনেন; তালিবানদের শত অত্যাচারের পরও সেখানকার গুরুদ্বার-মন্দিরের টিকে থাকার অজানা কাহিনী বয়ান করেন।

আসলে আফগানিস্তানের মত সকল অর্থে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটি দেশ সম্পর্কে বাঙালির চিরকালই এক অদম্য কৌতূহল রয়েছে। আর সৈয়দ মুজতবা আলীর সৌজন্যে ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি পাঠকের কাছে এই দেশ যেন মানস ভ্রমণের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। কাজেই বিশ্ব রাজনীতির দোলাচলতায় আফগানিস্তান যখনই খবরের শিরোনামে উঠে আসে বাঙালি তখনই নস্টালজিক হয়ে পড়ে। তাই গল্প-উপন্যাস-স্মৃতিকথা-ভ্রমণ সাহিত্য কিংবা রম্য রচনা— বাঙালির লেখনীতে বারেবারে ফিরে এসেছে আফগান প্রসঙ্গ। ভবিষ্যতে এই ধারা আরও পুষ্ট হবে এবং সমস্ত দুর্যোগ কাটিয়ে আফগানিস্তান আবার স্বমহিমায় ফিরবে এই আশা নিয়েই আমাদের আলোচনা সাঙ্গ করছি।

তথ্যসূত্র:- 
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, শ্রাবণ ১৪১০, পৃষ্ঠা ১১২
২. সৈয়দ মুজতবা আলী, দেশে বিদেশে, পৌষ ১৩৬৪, পৃষ্ঠা ৪৮
৩. ঐ, পৃষ্ঠা ৬১
৪. ঐ, পৃষ্ঠা ৭১
৫. ঐ, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০
৬. সৈয়দ মুজতবা আলী, শবনম, আগস্ট ২০০০, পৃষ্ঠা ৩৯
৭. ঐ, পৃষ্ঠা ৬৫
৮. রামনাথ বিশ্বাস, আফগানিস্তান, ১৯৪২, পৃষ্ঠা ১৪
৯. ঐ, পৃষ্ঠা ২২
১০. ঐ, পৃষ্ঠা ১৩৩
১১. সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৯-১০
১২. ঐ
১৩. পান্থজন, কাবুলের পথে পথে, পৃষ্ঠা ১৬
১৪. ঐ, পৃষ্ঠা ৩৮
১৫. অমিতাভ রায়, কাবুলনামা, পৃষ্ঠা ১০৮-১১০
১৬. ঐ, পৃষ্ঠা ১০৭

[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, তেহট্ট গভর্নমেন্ট কলেজ, নদীয়া।]

Facebook Comments

Leave a Reply