তালিবানবিরোধী নারী জাগরণের কোলাজ : শঙ্কর রায়

কাবুল, কান্দাহার, হেরাট, হেলমান্ড ও আফগানিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা কালাশনিকভ রাইফেলসহ আধুনিক অস্ত্র কাঁধে নিয়ে তালিবান সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ আফগান যখন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, পালাতে চেষ্টা করছে, তখনই নিরস্ত্র নির্ভীক নারী শক্তি জাগরণের আদলে পথে নেমে পড়েছেন, আত্মপ্রকাশ করছে, তাঁদের মুখে ফুটে উঠেছে ভয়ের বিরুদ্ধে অভয়ের দীপ্ত চিহ্ন। সে সব খবর সর্বত্র প্রকাশিত হচ্ছে।

নব্য তালিবান কাবুলে এমিরেট শাহী ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে আগেকার চেয়ে এবারের তালিবান শাসন অনেক উদার হবে, যা শুনে আমাদের দেশেও কিছু আগুনখেকো অ্যাকাডেমিক বামপন্থীদের কেউ কেউ বলতে থাকেন এবারকার তালিবান বাস্তববাদী বলেই অনেকটা উদার হবে। তালিবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরে আসার জন্য মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় পুনরায় খোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এমিরেটের কর্মকর্তারা বলেছিলেন মৌলবাদী নীতির পুনর্প্রবর্তন করবে না নতুন সরকার, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার । কিন্তু গত বিশ বছরে তালিবানমুক্ত পরিপার্শ্বে গড়ে-ওঠা মহিলারা অচিরেই বুঝেছেন এই প্রতিশ্রুতি শূন্যগর্ভ। যদিও কিছু আফগান বালিকা লিঙ্গ-পৃথক শ্রেণীভিত্তিক ব্যবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরে এসেছে, অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মেয়েরা উদ্বিগ্ন, অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। কবে যে তাঁরা কোন না কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্তরে তাদের পড়াশোনা পুনরায় শুরু করতে পারবেন, তা নিয়ে অন্ধকারে। তালিবান নেতারা কেবল বিবৃতি দিয়েই খালাস। তাই তালিবানী দখলের পরে যে রাজধানী কাবুলের অধিকাংশ স্কুল বন্ধই রয়েছে, এতে তাদের হেলদোল নেই। মেয়েরা লেখাপড়া করছে বা করছে না, এ তাদের ভাবনাতেই নেই।

দীর্ঘকাল অপেক্ষা নিস্ফল জেনে আফগানিস্তানের সদ্য-অবলুপ্ত নারী মন্ত্রণালয়ের বাইরে প্রায় দুই ডজন মহিলা কর্মী বিক্ষোভে শামিল হয়ে সেই মন্ত্রণালয় খোলার দাবী করে। তালিবানেরা সেই মন্ত্রণালয় তুলে দিয়ে তালিবান জঙ্গিদের-পরিচালিত প্রচার ও নৈতিক পদস্খলন-বিরোধী কাজের মন্ত্রণালয় আগেকার মত (১৯৯৬-২০০১) ফিরিয়ে এনেছে, যার অর্থ তালিবান সরকার নারী কল্যাণে নিরুৎসাহী। তাই গত মাসে তালিবানদের দখল নেওয়ার পরে তাঁরা কয়েক সপ্তাহ ধরে মন্ত্রণালয়ে কাজে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাঁদের সাফ সাফ বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। তাঁরা দাবি করেন নারী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁদের প্রতিনিধি বাসিরা তাওয়ানা বলেন, “নারী মন্ত্রণালয়কে পুনরায় সক্রিয় করতে হবে। কারণ নারী অপসারণ মানে মানুষের অপসারণ।” অর্থাৎ নারী-পুরুষে অধিকার সমান (যা সাবেক আফগানিস্তানের গৃহীত বিধি ও নীতি।) বিবেচনা করতে হবে। একথা তারা বলছেন সঙ্গীন উত্তোলিত তালিবান জঙ্গীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই, এখন আফগানিস্তানে নির্ভীক নারীমুক্তিকামী প্রতিবাদীদের টুকরো টুকরো খবরের উল্লেখের সময়, বিশ্লেষণ নয় পরে হোক। যদিও এই প্রতিবাদ শহরাঞ্চল ও তার আশপাশেব সীমাবদ্ধ, সেই বিক্ষোভ-আগুনের আঁচ গ্রামে যে পৌঁছচ্ছে না, তা নয়। সেপ্টেম্বরের গোড়ায় ন্যু ইয়র্কার পত্রিকায় আনন্দ গোপাল-এর ১০০০০-শব্দাধিক রিপোর্ট পড়লে জানা যায়। তালিবানহীন বিশটি বছরে মার্কিনী প্রতাপ, দেশীয় সরকারে নানা দুর্নীতি সত্বেও নারী জাগরণের অঙ্কুরের ছায়াতপ গ্রামেও পৌঁছেছে সীমিতভাবে হলেও। নারীচেতনার উন্মেষ শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকে নি, ঐ লেখা পড়লে ঠাহর হয়। নারী স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছেন আফগান মহিলারা, যাঁরা রক্ষ্ণণশীল স্থানীয় উপগোষ্ঠী মোড়ল-জমিদার-ইস লামী মোল্লাতন্ত্রের বাইরে থেকেছেন, যারা প্রধানত শহুরে। ঠিক যেমন ভারতে ব্রিটিশ আমলে ঘটেছিল। কার্ল মার্ক্স ও রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর তাঁদের লেখায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ক্ষতিকর ও শোষণ মূলক দিকের কথা বললেও ব্রিটিশ শাসনে শিক্ষার প্রসারের কথা স্বীকার করেছিলেন। ঔপনিবেশিক দেশের উন্নতি সাধন হয় নি, তা কখনো বলেন নি – স্বয়ম্ভর শিল্প ধ্বংস করলেও।

সেই জাগরণের অলিন্দ বন্ধ করে দিতে চাইছে, এমন আশঙ্কা করছেন সর্বস্তরের মেয়েরা (কিশোরী থেকে প্রবীণা)। ১৯৯০ দশকের শেষার্ধের মত (২০০১ অব্দি) তালিবানদের সন্ত্রাসী হুকুমতে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, জীবিকা-মারফৎ অর্থোপার্জন ও শিক্ষালাভ থেকেও মহিলারা বঞ্চিত ছিলেন। তার বদলে ছিল তথাকথিত ইসলামী নৈতিক পুলিশ-নিপীড়ন যা শরিয়া-র ব্যাখ্যা ব্যাখ্যা করে পোষাকী কঠোরতা (কোড) বহাল ছিল, সহায়সম্বলহীন মেয়েদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড এবং বেত্রাঘাত করা হত।

নারীস্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াসের প্রতিবাদে রাস্তায় নামছেন যেখানে পারছেন । যেমন আফগান মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একটি ছোট দল মেয়েদের স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত রাখার তালিবান পদক্ষেপের নিন্দায় অনেকটা গেরিলা কারদায় পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত শহরে একটি বিক্ষোভ করেছে। তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮, তারা জমায়েত করেছিল হেরাতের উপকণ্ঠে একটি আবাসিক এলাকায় জড়ো হয়েছিল – এমন একটি এলাকায় যেখানে তালিবানদের উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু তাদের আমন্ত্রিত কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক সেই সমাবেশ কভার করেন। বিক্ষোভকারীরা স্কুলে ফিরতে চাওয়ার দাবিতে ব্যানার নিয়ে নেমে বলেছিল যে মেয়েদের শিক্ষায় বাধা দিলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, কারন জাতিটাই অশিক্ষিত হয়ে পড়বে। তাদের একজন নার্গিস জামশিদ বলেন, “আমরা তাদের (অর্থাৎ তালিবানদের) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের স্কুলগুলো খুলে দিতে বলি।” তিনি আরও বলেন, স্কুলে না যাওয়াটা মনে হয় যেন “আমরা পিছিয়েযাচ্ছি।” কতিপয় ক্লাসরুমে কিশোরী মেয়েরা অনুপস্থিত, যদিও পুরুষ সহপাঠীরা হাজির। তালিবান কর্তৃক জারি করা ডিক্রি অনুসারে পুরুষ ছাত্র এবং শিক্ষকদের উচ্চ বিদ্যালয় এবং ধর্মীয় সেমিনারে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছার শর্তে এক ২৪ বৎসর বয়স্কা ইংরাজী শিক্ষিকা রেডিও আজাদীর প্রতিনিধি ফ্রেড দেঝানকে তাঁর কর্মস্থলের বাইরে অবস্থানরত তালিবান জঙ্গীদের ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির কথা বলেছেন, “তিন সপ্তাহ বাড়িতে থাকার পর আমি কাজে যাওয়ার জন্য উৎসাহী ছিলাম। আমি ইসলামী পোশাক পরেছিলাম এবং কাজে গিয়েছিলাম, কিন্তু যখন আমি সেখানে পৌঁছলাম তখনই আমি প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা তালিবান জঙ্গীদের অপমান এবং চিৎকারের মুখোমুখি হলাম।”

তালিবান জঙ্গিরা বাণিজ্যিক ভবনটি পাহারা দিচ্ছিল যেখানে কাবুল শহরের একটি জনাকীর্ণ পাড়ায় বেশ কয়েকটি কোম্পানি এবং ও অন্যান্য অফিস রয়েছে।” যখন আমি আমার অফিসে প্রবেশের চেষ্টা করছিলাম, তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ আমি তাদের বলেছিলাম যে আমি এখানে কাজ করি।’ জঙ্গীরা তখন কুৎসিত ভাষায় তাকে “কাফের” বলে। এতে সেই ভাষা প্রশিক্ষক উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। জঙ্গীদের একজন বলেছিল “দ্যাখো , সে সেই জায়গায় কাজ করো যেখানে কাফেরদের ভাষা শেখায়, তাই সে কাফের। হ্যাঁ, তারা আমাকে কাফের বলেছিল যদিও আমি ইসলামী হিজাব পরিহিত ছিলাম”। বন্দুকধারী পুরুষদের মন্তব্যে আতঙ্কিত হয়ে তিনি অবিলম্বে কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। হয়রানি ও অপমানের ঘটনা তার পরেও ঘটেছে, বেশ কয়েকজন তালিবানী জঙ্গীর কাছ থেকে সাদারণের ভবনের বাইরে এবং মধ্য কাবুলের রাস্তায়। চলে যাবার সময় তাঁকে “রাস্তায়” থাকার জন্য তিরস্কার জুটে ছিল। তাকে চিৎকার করে বলেছিল, “কি করছ তুমি তোমার বাড়ির বাইরে একা হাঁটছো?”
তিতিবিরক্ত ঐ ইংরেজী শিক্ষিকা বলেন তালিবানদের প্রতিশ্রুতি ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বিশ্বাসকরেন না যে তালিবান সরকার “নারীদের কাজ করতে দিচ্ছে, তা ভূয়া আন্তর্জাতিক ঋণ দাতা সংস্থাগুলি থেকে সাহায্য পাওয়ার জন্য একটি ভুয়া প্রদর্শনী মাত্র। বাইরের দুনিয়া থেকে যা চায় তা পেয়ে গেলে আর এসবও উচ্চারণ করবে না।” তিনি আরো বলেন তাঁর গ্রুপের আরও তিনজন মহিলাও কাজে যাওয়ার চেষ্টা করায় তালেবানিদের কাছ থেকে একই ধরনের হামলার শিকার হয়েছিল। তারা সবাই হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।

তরুণী শিক্ষিকা তাঁর আগেকার আমলের সুখকর অভিজ্ঞতা বলছিলেন “আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম, কখনও কখনও আমি রাত আটটা পর্যন্ত অফিসে থাকতাম বা সপ্তাহান্তেও কাজ করতাম।” আমার সমস্ত প্রচেষ্টা, আমার সমস্ত পরিশ্রম, আমার শিক্ষা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল না।” তাঁর আশঙ্কা, আফগানিস্তানে তালিবানরা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন মেয়েরা জীবিকার কাজ করতে পারবে না অথবা রাস্তায় একা একা চলাফেরা করতে পারবে না।

গত মাসেই প্রতিবাদ উচ্চকিত আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলকারী জঙ্গি ইসলামপন্থী গোষ্ঠী তালিবানদেরকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বোল্ড প্ল্যাকার্ড এবং উচ্চস্বরের মাইক্রোফোন নিয়ে শত শত আফগান প্রতিদিন বড় বড় শহরের রাস্তায় ছুটে আসছে। এই অভিযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন নারীরা, যারা তাদের অধিকার, সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব এবং তিন কোটি আশি লক্ষ শান্তিপ্রিয় মানুষের দেশে তারা তালিবান হুমকি এবং সহিংসতার তোয়াক্কা করছেন না।

আফগানিস্তানে যখন ভীরুরা যখন এক দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়, অন্য দরজা থেকে নাটকীয়ভাবে ড্রাম-পিটিয়ে প্রবেশ করে একজন অসাধু এবং সুবিধাবাদী ক্ষুধার্ত অজানা লোকজন জমি, অর্থ, খনিজ, দেশবিরোধী চুক্তি এবংভ গরিবী-অধ্যূষিত আফগান জনগণ ঋণের ফাঁদ তৈরি হে চলেছে। সন্ত্রাসী- তালিবান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে , মনে করছেন আফগানিস্তানের বেশীর ভাগ মানুষ। কিন্তু তাদের অবৈধ কাজ প্রতিহত করার জন্য কোন আইন তালিবান অভিধানে নেই, তথাকথিত বৃহৎ শক্তিগুলি এখন দূর থেকে হাহাকার ছাড়া আর কিছু করছে না।

মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিশেষ প্রতিনিধি সুনে এঙ্গেল রাস্মুসেন (এখন আফগানিস্তানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন) তাঁর টুইটারে উদ্ধৃতি করেছেন কিশোরী শারারা সারোয়ারির উক্তি, “আমরা দাবি করছি যে সকল মেয়েদের তাদের স্কুলে ফিরতে হবে এবং সকল মহিলাদের তাদের কাজে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত।” তিনি আরেক কলমচি এম্মাজির উক্তি তুলে ধরেছেন। তালিবানি কর্তারা (যারা উগ্র পুরুষতন্ত্রী) জানিয়েছেন, তারা সবাইকে আগে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের দিকে আনতে চেষ্টা করবে, না পারলে সন্ত্রাসের পথ নেবে। চতুর্দশী ইয়ো নার্গেস রাস্মুসেনকে বলেছে, “আমি গত 8 বছরে এত কঠোর পরিশ্রম করেছি এবং আমি সবসময়ই আমার ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিলাম। আমি একজন ডাক্তার হতে চাই আমার অনেক বড় স্বপ্ন আছে। আমি তাদের ছেড়ে দিতে পারি না কিশোর আফগান মেয়েদের শনিবার স্কুলে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়নি কারণ গত মাসে তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো সারা দেশে ক্লাসরুম পুনরায় খোলা হয়েছিল, তাদের নতুন মৌলবাদী সরকার মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করবে এমন আশঙ্কা আছে।

সদ্য তালিবান অধিকৃত কাবুলের রাজপথেও মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে নারী প্রতিবাদ এভাবেই জারি আছে, তারা বোরখা পরে নয়, অনেকে হিজাবও পরেন নি। লক্ষ লক্ষ আফগান নারীর বিবেক এঁরাই। তারা সোচারে নারী পুরুষের সমান অধিকার (যা প্রাক-তালিবান আফগানিস্তানের সংবিধানের ২২ নং ধারায় সুরক্ষিত, যার মধ্যে ছিল শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার। তালিবানি প্রশাসনে, রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের দাবি (যা ১৫ অগাস্টের আগে ছিল) নিয়েও তালিবানদের মুখোমুখি তাঁরা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, কাজটা কঠিন। তাই নির্ভয়া প্রতিবাদদ্মুখর প্রধানত শিক্ষিত ও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েরা। তালিবানদের প্রতি অহিংস প্রতিরোধের অগ্রভাগে তরুণী ও মহিলা কর্মীরা । আফগান নারী অধিকার কর্মী সামিরা হামিদি বলেন,আফগান নারীরা দমন ও বৈষম্যের বিভীষিকাময় দিকে প্রত্যাবর্তন করতে প্রস্তুত নন।” “আজ আফগান নারীরা অধিক শিক্ষিত এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত।” কাবুল, হেরাত এবং উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার-ই-শরীফে তালিবানদের বিক্ষোভ এবং তাদের কঠোরতা সত্বেও উত্তরাঞ্চলীয় পারওয়ান ও কাপিসা প্রদেশ, ঘোর ও দাইকুন্ডির কেন্দ্রীয় প্রদেশ এবং দক্ষিণ -পশ্চিমাঞ্চলীয় নিমরোজ প্রদেশে ছোট ছোট প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে।

আরেক প্রতিবাদ গড়ে উঠছে বোরখা-হিজাবের বিরুদ্ধে, যা নাকি আফগান পোষাক সংস্কৃতি বিরোধী। এই প্রতিবাদ অন লাইনে হচ্ছে, যার উদ্গাতা আফগানিস্তানের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডঃ বাহার জালালি, যিনি টুইট করে এই প্রচার করছেন। ছাত্রীদের জন্য তালেবানদের চালু করা নতুন পোশাকনীতির প্রতিবাদে অনলাইনে একটি প্রতিবাদী প্রচার কার্যক্রমে শামিল হয়েছেন আফগান নারীরা। তাঁদের যোগাযোগের সামাজিক মাধ্যম ‘ডুনটটাচমাইক্লথস’ ও ‘আফগানিস্তানকালচার’ নামে হ্যাশট্যাগ । এই হ্যাশট্যাগের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী রঙিন পোশাকের ছবি জুড়ে দিয়ে তা শেয়ার করছেন তাঁরা। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে আফগান নারীদের এই অভিনব প্রতিবাদের কথা জানা যায়। সামাজিক মাধ্যমে এই প্রতিবাদী প্রচারাভিযান শুরু করেন বাহার জালালি। তিনি প্রতিবাদী প্রচারাভিযান শুরুর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জালালি বলেন,‘আফগানিস্তানের পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব আক্রমণের মুখে। এটি আমার সবচেয়ে বড় উদ্বেগের একটি কারণ।’সমস্ত আফগান নারীদেরও এই প্রতিবাদে শামিল হতে আহ্বান জানান। তাঁদের তিনি বিশ্বকে আফগানিস্তানের প্রকৃত চেহারা দেখানোর অনুরোধ জানান। তাঁর কথায়,‘আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, তারা গণমাধ্যমে যা দেখেছে, তা আমাদের সংস্কৃতি নয়, এটা আমাদেরপরিচিতি নয়।’

তাঁরা বলছেন, বোরখা-হিজাব কোনটাই আফগান পোষাকী ঐতিহ্য নয়। মার্কিন মুলুকের ভার্জিনিয়া থেকে টুইট করেছেন স্পযমে মাসিদ নামে এক মানবাধিকার কর্মী। তিনি লিখেছেন, “আমরা বহু শত বছর ধরেই একটি ইসলামিক দেশ এবং আমাদের দাদী-নানীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকই শালীনভাবে পরেছেন। আরবদের কালো বোরখা কিংবা এই নতুন তৈরি নীল ‘চাদারি’ তাদের পোশাক ছিল না। “আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং পাঁচ হাজার বছরের সংস্কৃতিকেই তুলে ধরে, যা নিয়ে প্রতিটি আফগান গর্বিত।” আফগানিস্তানের সবচেয়ে রক্ষণশীল অংশে যারা বাস করেন, তারাও বলছেন নারীদের তারা কখনো নিকাব (মুখ ঢাকা কালো কাপড়) পরতে দেখেন নি।

পিছিয়ে-পড়া দারিদ্র-পিস্ট আফগানিস্তানের নারী শক্তি জাগছে। আর অন্য পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে অনুপ্রাণিত করছে। অনেকের জানা নেই,পাশ্তুন মেয়েদের মুক্ত্যন্বেষা ফুটে ওঠে তাঁদের মুখে মুখে রচিত কবিতা- তাঁদের ব্যথিত অভিব্যক্তি। তাদের কাছে যেমন তালিবানেরা বিভীষিকা, তেমনি মার্কিন-ন্যাটো আধিপত্য-ইপ্সাও অবাঞ্ছিত। আফগান লোকসংস্কৃতিতে এই কাব্যাভ্যাস ল্যান্দে নামে পরিচিত। লোকপ্রিয়, সম্মানসূচক, ফার্সি, আরবি ও পাশ্তো ভাষায় লেখা হয়। তা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে । লোক-বাজনার তালে তালে ছড়িয়ে পড়ে ল্যান্দে, অংশ নেন যাঁরা তাদের বেশীর ভাগ নিরক্ষর। কিন্তু এভাবেই উপ্ত হয় সমাজ চেতনার বীজ। প্রত্যেক লান্দে-য় বাইশটি অক্ষর থাকেঃ প্রথম লাইনে নয়টি, দ্বিতীয়টিতে তেরোটি। কবিতাটি “মা” বা “না” শব্দ দিয়ে শেষ হয়। কখনও কখনও তারা ছড়াও । মাঝে মাঝেই ফুটে ওঠে নারী হয়ে জন্মানোর আর্তি। অভ্যন্তরীণভাবে শব্দ থেকে শব্দান্তরে উচ্চারণে তীক্ষ্ণতার আড়াল ভাঙ্গে এই ল্যান্দেগুলি । থাকে শুধু সৌন্দর্য, বিস্ময়তা কিন্তু বৌদ্ধিক নয়, যাতে তা মানুষের হৃদয় তন্ত্রী আলোড়িত করে । যুদ্ধ, বিচ্ছেদ, জন্মভূমি সেই মনোভাব। যেমন ফুটে উঠেছিল হেলমান্ড প্রদেশের কিশোরী রাহিলা মুসকার কাব্যপ্রয়াসে। মুস্কা মানে হাসি। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর বাবা তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেন এই আশঙ্কায় যে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী রাহিলাকে অপহরণ বা ধর্ষণ করতে পারে। তখন সবে মার্কিন দখলদার বাহিনী আফগানিস্তানে ঘাঁটি গড়ছে। রাহিলার জীবন কাহিনী বড়ই করুন। সে রেডিও থেকে জানতে পারে মিরমান বাহীর নামে এক নারী সাহিত্য গোষ্ঠীর কথা। সেই গোষ্ঠীর বৈঠক প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় কাবুলে হত, তারা টেলিফোন মারফৎও কাব্য-সৃজনী বিনিময় করত। যোগাযোগ করে। অনুকবিতা রচনা করে পাঠায়, বঞ্চনা ও যন্ত্রণার ফুটে ওঠে। কবিতাতেও এসে যায়। সবার প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্তরালে ছিল বাবা-মা-ভাইএর পরিবারে নিত্যবৃত্ত যাতনা বঞ্চনা। তাঁর একটির মুক্ত ভাষান্তরঃ ‘আব্বা, তুমি এক বুড়োর কাছে আমাকে বিক্রি করেছিলে / আল্লা যেন তোমার বাড়ী ধ্বংস করে দেয়, আমি তোমার মেয়ে। /. তোমার টাক মাথায় বাঁধা উষ্ণীশ / শুধু বয়স ঢাকার জন্যে। তুমি কি মৃতপ্রায়! বুড়ো পাঁঠা আমার ফোলা ঠোঁটে চুমু খেয়ে / ঠিক যেন উপবাসী কোন কুকুরের কাছ থেকে চর্বির টুকরো ছিঁড়ে নিয়েছে।’ আরেকটি যৌন যন্ত্রণার, ‘এমন বুড়োর সাথে প্রেম মানে / কোঁচকানো দোমড়ানো খড়ের টূকরোর সাথে রমণ’। এসব সে ফোনে শোনাতো, লিখে নয়। কারন সে জানত হয়ত তার বাবা এসব দেখলে পুড়িয়ে দেবে।

রাহিলার মত আরেক মহিলা কবি হেলমান্ড প্রদেশের সাঙ্গিন অঞ্চলের বাসবিবি। তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশকাল চেতনা। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ উইলিয়ম বুশ-কে অভিসম্পাত করে লিখলেনঃ ‘আল্লা যেন হোয়াইট হাউস ধ্বংস করে আর নিকেষ করে তাদের / যারা মার্কিনী ক্রুইস ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে আমার দেশ চূর্ণ করেছিল হে বুশ, তোমার সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে গর্ব কোরো না / দূর থেকে আমার রিমোট বোম তা গুঁড়িয়ে দেবা।’ তারই মত দক্ষিণ-পূর্বে পাক্তিয়া প্রদেশের যোরম্যাটে মার্কিন ড্রোনে নিহত ছেলের মা তালিবানদের অভিশাপ দিয়ে চাদানা লিখেছেনঃ ‘আল্লা যেন তালিবানদের ধ্বংস করে, যুদ্ধে শেষ হয় / তারাই আফগান মেয়েদের বিধবা করেছে আর পতিতা বানিয়েছে।’

তাই হয়েছিল। তবে সে কাহিনী করুণতর। সেটা ২০১০ সালের বসন্তদিনে। মুসকা কবিগোশঠীকে শহর কান্দাহারের একটি হাসপাতালের বিছানা থেকে ফোন করে বলল সে নিজেকে শরীরে আগুন দিয়েছেকবিতা লেখার পর তার ভাইরা তাকে মারধর করেছিল। প্রতিবাদে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলল। কবিতা – বিশেষ করে প্রেমের কবিতা – আফগানিস্তানের অনেক নারীর জন্য নিষিদ্ধ। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসকার প্রয়াণ। এ ঘটনা পোয়েট্রি ফাউন্ডেশ্যনের কাছে পৌঁছয়। তাদের উদ্যোগে কিছু সাংবাদিক-কবি কান্দাহারে চলে যান। জানতে পারেন রাহিলা ছদ্ম নাম। সামাজিক নিপীড়ণের সেই শহীদ গ্রাম্য কবির নাম জারমিনা। তার পারিবারিক যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে অনেক অনুকবিতায়। এমন একটা – ‘যখন বোনেরা একসাথে বসে / তারা ভাইদের তারিফ করে / ভাইরা এক সাথে হলে বোনেদের বেচে দেয়।’

তালিবানরা নিষিদ্ধ করেছিল ল্যান্দে সংস্কৃতি, যা উচ্চস্বরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গীত ঢোলকের বাজনার সাথ সাথে। কিন্তু তালিবানেরা থামাতে পারেনি লোকসংস্কৃতির সেই রূপ।

আগেই বলেছি, বোরখা-হিজাব সাবেক আফগান পোষাক রীতি নয়, অধ্যাপিকা ডঃ বাহার জালালি ঠিক সময়ে অর্থাৎ উদ্ভিদ্যমান নারী জাগরণ কালেই সে কথা আফগান নারীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

আজ তালিবানী সন্ত্রাসী কুশাসনের বিরুদ্ধে চারদিকে প্রতিবাদের সামাজিক ভিত্তি ও ঐতিহ্য আছে। আফগানিস্তানের বাইরে গোটা দুনিয়ায় উদ্ভিদ্যমান সংহতি গড়ে উঠছে/ এই প্রতিবাদ একদিন সূদূর পাহাড়ে-গ্রামে-জনপদে ধ্বনিত হবে, সেই অপেক্ষায়। তাদের কাছে যেমন মার্কিন প্রভুরা বিষাক্ত শত্রু, তেমন তালিবানেরাও ঘৃণিত ‘দিকু।

Facebook Comments

Leave a Reply