আফগানিস্তান – অতীত ও ভবিষ্যৎ : সংগ্রাম চক্রবর্তী
“আফগানিস্তান”- নামটি শুনলেই মানস পটে ভেসে ওঠে ফিওদর বন্দারচুকের “নাইথ কোম্পানি” সিনেমার একটি দৃশ্য. তাসখেন্দ থেকে বাগরামে আগত সোভিয়েত ইল ৭৬ বিমানের পেটের তলা খুলে যায় ও নবাগত সৈন্যদের ঘুম ভাঙ্গে এম.আই ১৭ সুপার হিন্দের রোটারের আওয়াজে। কুকুরের ডাক, ভারী বুটের আওয়াজ, একাধিক পেট্রোল হেলিকপ্টার মিলে দৃশ্যপটকে আরো ভারী করে তোলে। খোস্তে হিল ৩২৩৪ দখলের লড়াই নিয়ে এই সিনেমা নির্মিত যেখানে ৩৯ জন(কোম্পানি) সোভিয়েত সৈন্য ২০০ উপর মুজাহিদিন ও পাকিস্তান স্পেশাল ফোর্স “ব্ল্যাক স্ট্রোক” বাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করে পোস্টের দখল ধরে রাখে।
আফগানিস্তান বলতে আবার অনেকেরই স্মরণে আসবে ২৭৮টা মারামারি তাতে মোট ১০৮ জনের মৃত্যু নিয়ে মোস্ট ভায়োলেন্স ক্যাটাগরিতে নাম তোলা ‘র্যা ম্বো ৩’ সিনেমার নানা দৃশ্য যেখানে প্রকাশ্যেই দেখান হয়েছে আফগানিস্তানে সি.আই.এ কিভাবে র্যা৭ম্বো পৌঁছে দেয় সোভিয়েতের সাথে লড়তে। আর এই লড়াইয়ের ভেতর খুব কম জনই স্মরণ করবে কাবুলিওয়ালা সিনেমার সেই স্নেহপরশীল উদার ইমানদার ছবি বিশ্বাসকে। কারণ আফগানিস্তানকে ঘিরে একটার পর একটা ভার্সন নির্মাণ হয়েছে অর্ধ শতক জুড়ে, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় আফগানিস্তানের মাটি ইতিহাসের স্বর্ণ খনি কিন্তু আফগানরা গরীব, তারা ইতিহাসের আবিষ্কারের জন্যে নয়, কয়লা পাওয়ার আশায় মাটি খোঁড়ে।
ডিওডোরাস বা মিলিন্দের চরণ ধূলির খোজ এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়, আমরা বরং সেই মহান কবি ও যোদ্ধা বাদশা বাবরের কবর জিয়ারত করে মিডিয়া ও মিথ্যার সেই ভার্সন গুলোকে খণ্ডন করে, একদিকে মধ্য এশিয়া ও অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের নাট্যমঞ্চের দিকে তাকাই সেই বাবর বাদশার মতই।
আফগানিস্তান রাষ্ট্রের স্থাপন হয় ১৭৪৭ সালে আহমেদ শাহ দুরানীর হাত ধরে যার অন্তর্গত ছিল পাকতুনিস্তান, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, কাশ্মীর। পরবর্তীকালে শিখ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে সে অনেক এলাকা হারায়। আপনারা আজকের ম্যাপ দেখলেই বুঝতে পারবেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের পর ১৮৯৩ ডুরান্ড লাইনকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন। এরপর হবিবুল্লা ও আমানুল্লাহ পেরিয়ে আফগানিস্তানের শেষ রাজা
জাহির শাহ যিনি তারই প্রধানমন্ত্রী দাউদ খানের দ্বারা ক্যু-তে ১৯৭৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন। আর এরপর থেকেই খোঁকি ও তার বন্ধু কাবুলিওয়ালারা হারিয়ে গিয়ে রঙ্গ মঞ্চে নতুন কুশীলবরা নতুন নতুন সংলাপ নিয়ে হাজির হয়। ১৯ শতকের মতই যুযুধান দুই সাম্রাজ্য আবারও আফগান ভূমিকে ছায়াযুদ্ধের কেন্দ্রে পরিণত করে।
আফগানিস্তানে আধুনিকতার জন্যে দরজা খোলে ১৯৫৩ সালে, যখন জাহির শাহ তার সবথেকে বিশ্বস্ত জেনারেল দাউদ খানকে নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করেন। আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তি, শিল্পকলা ও সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্যে কাবুল মূলত তিনটে দেশের দিকে তাকায় – আমেরিকা, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর বাইরেও খুব অল্প সংখ্যক সংযোগ স্থাপন হয় আব্দুল গামের নাসেরের মিশরের সাথে। নাসেরের তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও পার্সোনালিটি কাল্ট পলিটিক্স দাউদ খানকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু শাহের নিয়ম বিধিনিষেধে তার হাত বাঁধা। ফলে ১৯৬৮-র পর থেকেই দাউদ খান ও জাহির শাহের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নতুন যে আফগান সমাজ গড়ে ওঠে সেখানে উদার গণতান্ত্রিক চেতনার পাশাপাশি মার্ক্সীয় চিন্তা চেতনাও বাসা বাঁধে। কিন্তু শহরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন সমাজের টেকনোক্রাট ও আমলারা মূলত পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষায় শিক্ষিত ও অনুগত, আবার আফগান সামরিক বাহিনী সোভিয়েত শিক্ষায় শিক্ষিত ও মার্ক্সীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ। কাবুল জোট নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি বজায় রাখলেও স্বাভাবিক কারণেই আমেরিকার তুলনায় সোভিয়েতের সাহায্যের উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল ছিল। ১৯৭৩ সালে কাবুলে রাজতন্ত্রের পতন হলে বামপন্থী মহলে তার উপাধি হয় “রেড প্রিন্স” এবং এই বিপ্লবে কেজিবির উপস্থিতির কথাও শোনা যায়। বামপন্থীদের মধ্যে তুলনায় নরমপন্থী অংশ, পর্চমের অনেকেই দাউদের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পায়।
কিন্তু মস্কো ততদিনে বিশ্বে বিপ্লবের ফর্মুলা বানিয়ে ফেলেছে, একদম রুশ বিপ্লবের ছকে। আর এক্ষেত্রে কাবুলের রাজনৈতিক ঘটনাক্রমে একদম ছক মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে যে প্রথমে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতন ও তারপর এসে বলশেভিক বিপ্লব অর্থাৎ সুর রেভোলিউশান। ১৯৭৮-এর এপ্রিলে এসে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ শোনা গেল নুর মহম্মদ তারাকি ও শাহনাওয়াজ টানাই-এর কণ্ঠে। অচিরেই সেই আওয়াজে আকৃষ্ট হলেন লাহোর ও ওয়াশিংটনের শকুনেরা—শুরু হল অন্তহীন যুদ্ধ ও মিথ্যার নির্মাণ।
প্রথম মিথ্যা হল “আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ” এবং প্রচলিত ধারণা যে আমেরিকার সাহায্যে মুজাহিদিনদের হাতে সোভিয়েত বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের ফলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। কিন্তু সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে পৌছায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আফগান সরকারের আমন্ত্রণে, তাও ১২ বার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ ডিসেম্বরে পলিটব্যুরো এই ইস্যুতে সম্মতি দেয়। অথচ হাফিজুল্লা আমিন ১৯৭৮-এর মে মাস থেকেই ক্রমাগত অনুরোধ করে গেছে সেনা পাঠানর। আর ১৯৭৮-এর জুলাই মাসে জিমি কার্টার মুজাহিদিনদের বছরে ৫০ মিলিয়ন অর্থ সাহায্য (অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ আলাদা) দেওয়ার গোপন নির্দেশ দেয় সি.আই.এ-কে। এই সংস্থার প্রাক্তন ডিরেক্টর রবার্ট গেটসের ভাষায় – “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে এমন একটা ফাঁদ নির্মাণ করা যাতে সোভিয়েত এসে আটকে যায়, আর আমরা ভিয়েতনামের প্রতিশোধ নিতে পারি”।
এই ফাঁদেরই আরেকটি সুতোয় টান দেয় নতুন নির্বাচিত কনার্জেটিভ প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন এসে। সোভিয়েতের প্রতি বছর আফগানিস্তানে খরচ হত ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার যা সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাছে ১৯৭৯ সালে কিছুই না। কারণ তেলের দর ছিল সমকালীন সময়ের সর্বোচ্চ। কিন্তু ১৯৮০ সালের নভেম্বরের পর থেকেই, যখন সৌদি আরব ব্যাপক তেল উৎপাদন করে বাজার ভাসিয়ে দেয়, তেলে দর ক্রমশ পড়তে থাকে। এটা চলে ১৯৮৬-র শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এই ক্ষতি সামলানও সম্ভব হত যদি না আরেক সি.আই.এ এজেন্ট (ব্যক্তিগত মত) গর্বাচেভ তার এলকোহল বিরোধী যুদ্ধ শুরু না করত। কারণ শুধুমাত্র সোভিয়েতের আভ্যন্তরীণ বাজারেই ভদকা বেচে এই টাকা অনায়াসে উঠে আসত।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলেও দেখব এই গোটা পর্বে শহর দুরে থাক বরং একটাও সোভিয়েত পোস্টেরও দখল নিতে পারে নি মুজাহিদিনরা। বরং ১৯৮৫-র পর মুজাহিদিনদের অবস্থা এমন হয়ে ওঠে যে তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। সোভিয়েত ৪০তম আর্মির কম্যান্ডার বরিস গ্রোমভের মতে এটা ছিল একটা নিচু স্তরের সংঘর্ষ যেখানে আমরা লড়ছিলাম গেরিলাদের অনিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে, যেখানে কোন পক্ষেই নির্ণায়ক জয় বা পরাজয় সম্ভব নয়।
এমন কি যুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৪০তম আর্মির সেনা সংখ্যা ছিল ১০৮০০, অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে আকারে অনেক ছোট ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনা ছিল এর পাঁচ গুণ। এমন কি ন্যাটো অপারেশন ২০০৯-১০ সালে ২৫০০০০-র অধিক সেনা ব্যবহার করতে হয়। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয় যার গ্যারান্টার ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত সেনা সরে আসার পরও দুবছর পর্যন্ত নাজিবুল্লা সরকার টিকে ছিল, পতন হয় নি আশরাফ ঘানির মত। কিন্তু তার পরেও সোভিয়েতের উপস্থিতিতে আমেরিকার হাতে যে প্যান্ডোরার বক্স খুলে যায় তার থেকে একে একে গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার থেকে শুরু করে ইসলাম খান, রশিদ দস্তুমরা বেরোতে থাকে। প্রাক্তন সোভিয়েত প্রধান আন্দ্রোপভের ভাষায় “আমরা এটা করতে চাই না, কিন্তু এটা আমাদের করতেই হবে”
দ্বিতীয় মিথ্যা অপারেশন এন্ডিওরিং ফ্রিডম। মানবেতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণিত বর্বর ও মানবতা বিরোধী শক্তি হল এ্যাঙ্গলো স্যাক্সন সাম্রাজ্যবাদ। যে ব্রিটিশ একদা সভ্যতা শেখানোর জন্যে আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকায় গণহত্যা চালিয়েছে, তাদেরই উত্তরসূরি এই মার্কিনীরা দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে গণহত্যা চালাচ্ছে। আর তারই আরেকটি নাম হল “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”। ৯/১১ হামলাকারীদের কোন পাসপোর্ট পাওয়া গেছে যেখানে প্রমাণ হয়েছে তারা আফগান নাগরিক? হামলাকারীদের সাথে তৎকালীন কাবুল সরকারের কোন যোগাযোগ পাওয়া গেছে? উভয় প্রশ্নেরই উত্তর হল “না”। তবু এই অজুহাতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ শুরু হল কোথায়? আফগানিস্তানে। আর এর সহযোগী হল কে? গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার। যুদ্ধবাজ এই পাখতুন নেতা ১৯৯২ সালে নতুন সরকারে ক্ষমতার ভাগ না পেয়ে কাবুল অবরোধ করে ও রকেট হামলা চালায় যাতে বহু অসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়। ১৯৯৬ সালে তালিবান আসার আগ পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে এই হামলা চলে। উজবেক নেতা আব্দুল রশিদ দস্তুম যিনি একদা ছিলেন নাজিবুল্লা সরকারের নির্ভরযোগ্য জেনারেল ও আমেরিকার ভাষায় “যুদ্ধাপরাধী”। ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও শিশুহত্যার কাহিনী না হয় নারী স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কার্পেটে ঢেকে রাখলাম। আসলে মিথ্যা দিয়ে যার শুরু তার শেষ হল ল্যান্ডিং গিয়ার থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়া।
আশ্রিতকে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া হারাম, উপজাতীয় প্রাচীন এই নীতি বোধ আজকের কর্পোরেট পুঁজি নির্ভর রাজনীতিকরা বুঝতে পারবে না, তাই তারা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন যে তালিবানের এই বিজয়কে কিভাবে দেখবে।
এখন প্রশ্ন হল তালিবানের বিজয় কে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এই দেখাটাও মূলত নির্ভর করে আমরা কোন রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি তার উপর। আমাদের দেখার মাধ্যমগুলোর উপর। তবে এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে ১৯৮৯-তে সোভিয়েত ফৌজ হঠে যাওয়ার পরে কাশ্মীরে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি হবে না। এর কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সফল ও শক্তিশালী মোদীজীর ভারত সরকার নয়। এর মুল কারণ এবার মধ্যপ্রাচ্যে ও উত্তর আফ্রিকায় অনেকগুলো ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে আছে কর্মহীন মুজাহিদিনদের জন্যে। বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়া। কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করতে, বিভ্রান্ত করতে যেমন লস্কর-ই-তৈবা ও জয়েশ-ই-মহম্মদ নির্মিত হয়েছিল, সেই রকমই এবার ইরানকে চাপে রাখতে ইসলামিক স্টেট (খোরাসান), জাবাত-আল-নুসরা-কে তৈরি করা আছে। পরমাণু চুক্তির নতুন শর্ত যদি ইরান না মানে, গোলান হাইটসের থেকে যোদ্ধা না সরায় তাহলে আফগানিস্তানে সিরিয়ার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাব।
আফগানিস্তানে জয়-পরাজয়টা কোন ইস্যুই নয় মার্কিনীদের কাছে, আসল উদ্দেশ্য হল দেশে দেশে অস্থিরতা তৈরি করে অস্ত্র বিক্রি করা, সেনা ঘাঁটি বানানো এবং এই সামরিক উপস্থিতির বলে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ কে সুরক্ষিত করা। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ইরান সহ গোটা পারস্য উপসাগর অঞ্চল, বিশেষত হরমুজ প্রণালী ও মধ্য এশিয়ায় মার্কিন নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা। ইসলামিক স্টেট, আল কায়েদা, আল নুসরা, হায়াত-তাহরিক -ই-আল-শাম থেকে বোকো হারাম এগুলো আসলে সি.আই.এ এবং মোসাদেরই আরেকটি সংস্করণ। মার্কিন আধিপত্যবাদেরই আরেকটি বর্ধিত অংশ।
মধ্য প্রাচ্যে এই খেলাটা শুরু করে ইসলামিক স্টেটের নামে ২০১০ সালে মোক্তাদা আল সদর সমর্থিত ইরাকী সরকার ইরাক ছাড়ার জন্যে মার্কিন সরকারকে চাপ দেয় এবং ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের কুনার, জাবুল ও কুন্দুজে ইসলামিক স্টেটের সূচনা হয়। আমেরিকার এই কৌশলের গুরুত্ব বুঝেই ২০১৬ সালে রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান ও তালিবান মিলে এক জয়েন্ট কম্যান্ড গঠন করে আই.এস-কে মোকাবিলার জন্যে। তাই আজকে তালিবানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে রাশিয়া, চীন, ইরানের আমন্ত্রণ পাওয়া কোন অসংলগ্ন ঘটনা নয় অন্তত ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে দেখাতে চাইছে। উজবেকিস্তান ইসলামিক ফ্রন্ট, তাজিক ইসলামিক জোট বা পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টির নামে গোটা মধ্য এশিয়ায় আমেরিকা এই খেলাটা খেলে আসছে সোভিয়েতের পতনের পর থেকে। দাগেস্তান ও চেচেনিয়ার কথা না হয় বাদই থাকল। শেষমেশ ২০০৮ সালে উজবেকিস্তান থেকে আমেরিকা ঘাঁটি সরাতে বাধ্য হয় রাশিয়ার চাপে।
এরই সমান্তরালে একটু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আফগান শান্তি আলোচনার পর্যায় ও ঘটনাক্রমকে বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যাবে বৃহত্তর এশিয়া নাট্যমঞ্চের একটি অংশ মাত্র আফগানিস্তান। কাবুলে তালিবানের রাজনৈতিক বিজয় সুনিশ্চিত হয় ২০১০ সালে লন্ডন কনফারেন্সে এবং ২০১১ সালে ওবামার ভাষণে তালিবানকে একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের মধ্যেই সেনা সরানোর কথা বলা হয়—শুধুমাত্র চারটে গ্যারিসন থাকবে কাবুল, কান্দাহার, বাগরাম ও জালালাবাদে ট্রেনিং ও অন্যান্য টেকনিক্যাল সহায়তার জন্যে। কিন্তু তালিবান অনড় থাকে একজনও বিদেশী সৈন্য থাকা চলবে না এই শর্তে।
২০১১ থেকে ২০১৬ এই পর্যায়ে শান্তি আলোচনার নামে তালিবানকে আমেরিকা নির্ধারিত মুল স্রোতে ফেরানর চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু এর মুল উদ্দেশ্য ছিল তালিবানের ভেতর ভাঙন ধরানো, মোল্লা ওমরকে হাক্কানিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এই উদ্দেশ্যে তারা তেহরিক-ই-তালিবানও তৈরি করে, পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল (নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশ, ওয়াজিরস্তান) বালুচিস্তানে অস্থিরতা তৈরি করে—যাতে পাকিস্তানও আমেরিকার এই উদ্যোগে সামিল হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মার্কিন সরকারের বিবৃতিগুলোও এই আঙ্গিকেই পরিবেশিত হত। ঠিক এখানে যেমন দেখেন কৃষক আন্দোলন নিয়ে মোদী সরকার ও গদি মিডিয়ার খবর পরিবেশনে।
তালিবান কে মুল স্রোতে (?) ফেরানোর দ্বিতীয় আরেকটি কারণ ছিল যে আমেরিকা ততদিনে বুঝে গেছে আর যাইহোক “কুইসিলিং” সরকারকে দিয়ে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মার্কিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে সেবা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা কোনটিই তাদের নেই। হামিদ কারজাই ও আশরাফ ঘানি দুজনের কেউই কিন্তু আফগান নাগরিক নন, আমেরিকা থেকে আমদানি করা মার্কিন নাগরিক।
“কুইসিলিং” সরকারের প্রতি অনাস্থা থেকেই আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি তালিবানের সাথে আলোচনা শুরু করে প্রায় একই সময়ে, তিনি হলেন তাজিক নেতা ও আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি (১৯৯২-৯৬) বুরারুদ্দিন রব্বানী। আফগানিস্তানে ইসলামিক রাজনীতির অন্যতম স্থপতি তিনি এবং তারই জামাত ইসলাম দাউদ খানের সংস্কারের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালে প্রথম বিদ্রোহ করে। কিন্তু এই উদ্যোগের প্রারম্ভেই এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে তাকে হত্যা করা হয় ২০১১ সালে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও কাবুলের তৎকালীন রাজনৈতিক টানাপড়েনকে বিচার করলে সন্দেহের তীর অবশ্যই যায় মার্কিনীদের দিকেই। কারণ রব্বানী শান্তি আলোচনা শুরু করতে চাইছিলেন সরাসরি মোল্লা ওমরের সাথে। আর আমেরিকার (হামিদ কারজাই) শান্তি প্রক্রিয়া ছিল তালিবানের আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর সাথে পৃথক পৃথক ভাবে। এমন কি আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপন ও পুনর্গঠন আমেরিকার উদ্দেশ্য কখনই ছিল না, বোঝা যায়, ২০১৬ সালে তৎকালীন তালিবান প্রধান মনসুর আখতার বা মোল্লা মনসুরকে ড্রোন হামলায় হত্যার মধ্যে দিয়ে। আজকে কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানের যে রাজনৈতিক অফিস তার সূচনা হয় মোল্লা মনসুরের হাত ধরে এবং তিনিই হিবাতুল্লা আখুনজাদাকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করেন, তালিবানের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কম্যান্ডারদের শান্তি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধাবসানের পক্ষে নিয়ে আসেন। ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে তিনি ইসলামিক স্টেটের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে আবু বকর আল বাগদাদীকে চিঠি লিখে জানান যে আই.এস-এর কর্মকাণ্ডের ফলে আফগানিস্তান তথা গোটা বিশ্বে জেহাদি কার্যকলাপ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিয়া পন্থী যে ইরান প্রথম তালিবান সরকারের চূড়ান্ত বিরোধী ছিল, মোল্লা মনসুরের দীর্ঘ ইরান অবস্থান ও দৌত্য ইরান ও পাকিস্তানকে আফগান প্রশ্নে এক জায়গায় নিয়ে আসে। আর তাই ড্রোন হামলায় তার হত্যার পরে বারাক ওবামা বিবৃতি দেন যে এবার তালিবান আমাদের সাথে শান্তি আলোচনায় আসতে বাধ্য হবে—ফোর্জ টু ডু। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় আমেরিকার প্রকৃত উদ্দেশ্য। কিন্তু সিরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক হস্তক্ষেপ ও ট্রাম্পের আগমন গোটা পালার পট পরিবর্তন করে দেয়.
তালিবানকে বুঝতে আমাদের দুটো বিষয়কে অবশ্যই আলোচনায় আনতে হবে—প্রথমত: পাখতুন জাতীয়তাবাদ ও ডুরান্ড লাইন, দ্বিতিয়তঃ ক্যাসপিয়ান গ্যাস বেসিন।
আফগান জাতীয়তাবাদের মুল চালিকা শক্তিই হল পাখতুন জাতীয়তাবাদ (জনসংখ্যার ৪০%)। উত্তরে সিন্ধু ও দক্ষিণে আমুর দরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত পাখতুন ভূমি বা পাখতুনখোয়া, এর এক প্রান্ত পাঞ্জাব ও অপর প্রান্তটি বর্তমান উজবেকিস্তানের ফরগানা উপত্যকা, বাবুর বাদশাহের জন্মস্থান। পাখতুন জাতীয়তাবাদের জনক হলেন ষোড়শ শতকের পীর বায়োজিদ রোশন এবং সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত কবি ও যোদ্ধা খুশল খান আটক। ষোড়শ শতকে এসে পাখতুনখোয়া তৎকালীন দুই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ভেতর ভাগ হয়ে যায়-পুবে সাফানীদ ও পশ্চিমে মোঘল সাম্রাজ্য এবং পাখতুন জাতীয়তাবাদের ইতিহাস এই দুই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের ইতিহাস।
ধর্ম এই জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক শর্ত নয়। বরং উপজাতীয় প্রাচীন রীতিনীতি কোড বা “পাখতুনওয়ালী” হল এই জাতীয়তাবাদের চালিকাশক্তি। ধর্মই যদি অনুপ্রেরণা হত তাহলে শিয়া ইসলামী সাফানীদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হত, ১৭০৯ সালে কান্দাহারকে দক্ষিণ আফগানিস্তানে প্রথম স্বাধীন সরকার গড়ে উঠত না এবং এই রাজধানী ১৭৩৮ সালে মোঘল সেনা দ্বারা ধ্বংস ও লুণ্ঠিত হত না, গোঁড়া সুন্নী মতাবলম্বী ঔরঙ্গজেবের কারাগারে খুশল খানকে আটকে থাকতে হত না। এমন কি ১৭৪৭ সালে আহমেদ শাহ দুরানীর হাতে কাবুল কেন্দ্রিক যে আফগান রাষ্ট্রের স্থাপন হয় ধর্ম তার অনুপ্রেরণা ছিল না। শতাধিক বছর পরেও আফগান জাতীয়তাবাদের অন্য দুই আইকন হবিবুল্লা (১৯০১-১৯১৯) ও তার পুত্র আমানুল্লাহ খানের (১৯১৯-১৯২৯) আর যাই হোক ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ছিল না, বরং আমানুল্লাহ খান কে সিংহাসনচ্যুত হতে হয় গোঁড়া মোল্লাদের দ্বারা যার বর্ণনা আপনারা পাবেন সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশেবিদেশে। ১৯৪৭ সালে এসে একমাত্র রাষ্ট্র আফগানিস্তান যে রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে। সর্দার দাউদ খানের সময় অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছয় যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান যুদ্ধের উপক্রম হয়। ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরই বিরোধিতা করছে আরেকটি মুসলিম রাষ্ট্র- আর এর একমাত্র কারণ ডুরান্ড লাইন। ১৯৪৭-এ যে খণ্ডিত স্বাধীনতার দুই নতুন রাষ্ট্র তা আসলে এ্যাঙ্গলো স্যাক্সন সাম্রাজ্যবাদেরই উত্তরাধিকার ও অনুসরণকারী—এটা বুঝতে কাবুলের কোন অসুবিধা হয় নি। কারণ আর যাই হোক হবিবুল্লার হাতে একটি স্বাধীন জাতীয় বুর্জোয়া ব্যুরোক্র্যাট শ্রেণীর নির্মাণ হয়েছিল আফগানিস্তানে। ১৯১৯ সালে তৃতীয় আফগান যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রটেক্টরেট থেকে সার্বভৌমত্ব লাভ একে আরো পুষ্ট করে। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের সময়কালে ভারতে এসে কাবুল সরকার তার প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়ে বারবার সতর্ক করে যে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যেন আফগানিস্তান তথা পাখতুনখোয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু ডুরান্ড লাইনকেই নবগঠিত পাকিস্তানের পশ্চিম বর্ডার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, পাক-আফগানের মাঝে কালাতের স্বাধীন রাজ্যে পাক আর্মি অনুপ্রবেশ করে দখল নেয় কাশ্মীর ও জুনাগড়ের অজুহাত দিয়ে।
ডুরান্ড লাইম, ম্যাকমোহন লাইনের মতোই ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার ও গোটা ভারতীয় মহাদেশের জাতীয় চেতনার উপর এক কালো দাগ। ঠিক যেমন আমাদের বাংলাকে ভাগ করা হয়েছিল ১৯৪৭-এ, ঠিক একইভাবে পাখতুনদের ভূমিকেই ১৮৯৩ সালে দুইভাগে ভাগ করা হয়। আসলে ভাগ করো, শাসন করো—যে নীতি আজ মোদী নিয়ে চলেছে হিন্দু মুসলমানের নামে তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার, যেকোনো ধর্ম বা ভাষা বা বর্ণ নামে আর এই উপাদান যেখানে নেই সেখানে প্রয়োজনে যুদ্ধ করে এই সীমানা নির্মাণ করা হবে—এটাই সাম্রাজ্যবাদী কৌশল।
১৭৪৭ সালে যে স্বাধীন আফগান রাষ্ট্র গড়ে ওঠে তার পূর্ব সীমান্ত পাঞ্জাবে, পশ্চিমে আমুর, উত্তরে কাশ্মীর ও দক্ষিণে বেলুচিস্তান। প্রথমে রঞ্জিত সিং-এর শিখেদের কাছে তারা পেশোয়ার অঞ্চল ও কাশ্মীর হারায়। শিখেরা ব্রিটিশের কাছে পরাজিত হয়ে সেই অঞ্চলে ব্রিটিশকে হস্তান্তরিত করে ক্ষতিপূরণস্বরূপ। কিন্তু দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে আফগানিস্তান শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে ১৮৭৯ সালে সন্ধিতে কোয়েটা, কোহট, শিবি, পিশিন ব্রিটিশকে ছাড়তে বাধ্য হয়। ১৯ শতকে ব্রিটিশ ও রাশিয়ান সাম্রাজ্যের গ্রেট গেমের মাঝে পড়ে তার ভূমি আবার বিভক্ত হয় ১৮৯৩ সালে মর্টিম ডুরান্ডের হাতে। এই ডুরান্ড লাইন পাখতুনখোয়াকে বিভক্ত করে আমাদের বাংলা ভাগের মতোই। ওয়াজিরিস্তান, নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশ বা খাইবারস্তান, চিত্রল, সোয়াটকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভেতর নিয়ে আসে, অর্থাৎ আজকে পাকিস্তানের এক বড় অংশ আসলে স্বাধীন আফগান ভূমির অংশ যা জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া, যাকে পাখতুনরা কোনদিনই মেনে নেয় নি। ওয়াজিরিস্তান ও খাইবারে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারী থাকে গোটা ব্রিটিশ শাসনকাল জুড়ে, এমন কি পাকিস্তান গঠনের পরেও অব্যাহত গতিতে। কিন্তু এই লাইন আরো মারাত্মক যেটা করে সেটা হল উত্তর বালুচিস্তানকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতর নিয়ে এসে ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানকে আরব সাগর থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৪৬ সালের কাবুলের অন্যতম দাবিই ছিল উত্তর বালুচিস্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানের জন্যে আরব সাগরে পৌঁছানর জন্যে ব্যবস্থা করা। পাক-আফগান বিরোধের মুল কারণটাই এটা। পাকিস্তান কখনই চায় নি যে আফগানিস্তানে এক শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সরকার গড়ে উঠুক, বরং যখনই কাবুলে কোন স্বাধীন সরকার গড়ে উঠেছে সে যে ফর্মেই হোক পাকিস্তান অন্তর্ঘাতের চেষ্টা করেছে, কারণ খাইবারতুয়া ও বালুচিস্তানের এক বড় অংশ তাকে দিয়ে দিতে হবে। শুধু পাঞ্জাব আর সিন্ধ নিয়ে পাকিস্তানের তাহলে আর কোন অস্তিত্বই থাকবে না, অন্যদিকে ভারতের অন্যতম কৌশলই হল অখণ্ড পাখতুনিস্তানের দাবীকে হাওয়া দিয়ে শত্রুর পেছনে আরেকটা ফ্রন্ট খোলা, স্বাধীন বালুচিস্তানের দাবীকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানকে চাপে রাখা, পাখতুনখোয়ার পাক অংশে হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত তেহরীক-ই-তালিবানকে অনেকে “RAW”-এর কাজ বলে দাবী করে।
কিন্তু এই অবস্থাটার পুরো পরিবর্তন হয়ে যায় ১৯৭৯ সালে, যখন সোভিয়েত সেনা আমুর দরিয়া পেরোয়। নুর মহম্মদ তারাকীর আফগান সমাজ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখে পাকিস্তান শঙ্কিত হয় যে অচিরেই সেই পুরনো দাবী তুলবে কাবুল এবং আরব সাগর তথা ভারত মহাসাগরে পৌছাতে মস্কো এই সরকারকে ব্যবহার করে বালুচিস্তানকে দখল নেবে/মুক্ত করবে। তৎকালীন পাক বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী শ্রেণীর মধ্যে বালুচ ও পাঠানরা ছিল মস্কো পন্থী এবং সিন্ধ ও পাঞ্জাবী নেতৃবৃন্দ মূলত পিকিং পন্থী।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ আফগানিস্তানের উপজাতীয় সম্পর্কগুলোর মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। সি.আই.এ, এম.৬ পাঠানো অর্থ ও অস্ত্রের স্রোত ডুরান্ড লাইনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ইরানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানই হয়ে ওঠে পাঠান জাতীয়তাবাদের একমাত্র ঠিকানা—একদা শত্রু হয়ে ওঠে পরম মিত্র ও আশ্রয়দাতা। অর্থ ও অস্ত্রের স্রোতের পাশাপাশি আরেকটি দর্শনও আমদানি হয় এই অঞ্চলে ওয়াহাবীইজম। আফগান শরণার্থী শিবিরের শিশুদের লেখাপড়ার জন্যে সৌদি অর্থায়নে যে মাদ্রাসাগুলো গড়ে ওঠে তা হয়ে দাড়ায় ওয়াহাবীইজমের আখড়া। এই যে নতুন একটা ধারা যুক্ত হল তা কিন্তু প্রচলিত পাখতুন জাতীয়তাবাদী ধারার থেকে আলাদা। এরাই আজকের তালিবানের পিতৃপুরুষ। কিন্তু তালিবান শব্দটি তখনও আসে নি। তালিবান গঠিত হয় ১৯৯৪ সালে কান্দাহারে। ফার্সি এই শব্দটির অর্থ হল শিক্ষার্থী। মনে করে দেখুন এই সেই কান্দাহার যেখানে ১৭০৯ সালে পাখতুন জাতীয়তাবাদীরা সাফানীদদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন সরকার গঠন করে। কিন্তু কেন তালিবান—এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ক্যাসপিয়ান গ্যাস বেসিনে। আবার এখানেই আছে আজকের চীন তালিবান সম্পর্কের রসায়ন।
ক্যাসপিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস বেসিন আফগান রাজনীতিকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলেও, এর পরোক্ষ প্রভাব এই যুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্যাসপিয়ান সাগরের তলায় বিপুল পরিমাণ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চিত আছে, যার পরিমাণ ৯০বিলিয়ন কিউবিক মিটার ও তেলের সঞ্চয় আমেরিকা সৌদির মোট তেলের থেকেও বেশী। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য নয় মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের সঞ্চয় রয়েছে। কিন্তু এই তেল ও গ্যাস উত্তোলন ও পরিবহণের মুল দায়িত্বে রয়েছে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গ্যাসপ্রোনের হাতে। সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই অঞ্চলে মার্কিন কূটনীতির লক্ষ্যই হয়ে দাঁড়ায় মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলোকে (তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্থান, কিরঘিজস্তান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান) নিয়ে প্রভাব বলয়ে এনে রাশিয়াকে গ্যাস ও তেলের নিয়ন্ত্রণ থেকে বঞ্চিত করা। পুরনো সোভিয়েত পরিবহণ নেটওয়ার্ককে এড়িয়ে এই গ্যাস পরিবহণের বিকল্প লাইন তৈরি করা, কিন্তু সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার পর ক্যাসপিয়ান সাগরে প্রতিটা দেশের সীমা ও অধিকার নিয়ে সর্বসম্মত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন আইন ছিল না। ফলে মার্কিন হস্তক্ষেপ রাশিয়া ও ইরানের সাথে তার সংঘাত বাঁধিয়ে তুলতে পারে অচিরেই।
১৯৮৮ সালে মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনিকল আফগান-উজেবেক সীমান্তে তেলের সন্ধান পায়। কিন্তু তৎকালীন সময়ে উজবেকিস্থান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান থেকে তেল ও গ্যাস পরিবহণের সমস্ত লাইনই গ্যাসপ্রোন বা রুশ নিয়ন্ত্রণে, ফলে বিকল্প পরিবহণ লাইন তৈরির প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৯২ সালে চীনা পেট্রলিয়াম, মিৎসুবিসি মিলে পরিকল্পনা করে প্রায় ১৪০০ কিমি পাইপলাইন বানিয়ে চীনের জিংজিয়ানে এই গ্যাস নিয়ে যাওয়ার কিন্তু ভূপ্রকৃতির কারণে তা বাতিল করে। অন্যদিকে ইউনিকল পরিকল্পনা করে তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে হেরাট-কান্দাহার হয়ে পাকিস্তানের কোয়েটা-মুলাত পেরিয়ে পাইপলাইন আরব সাগরে গিয়ে পৌঁছাবে সেখান থেকে ট্যাংকারে ভারত জাপান কোরিয়া সহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে তা পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে এই পাইপলাইনের জন্যে আবশ্যিক শর্ত হল আফগানিস্তানের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু সোভিয়েত সেনা সরে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে সেটা একেবারেই ছিল না—বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী নিজের নিজের অঞ্চলের শাসনকর্তা হয়ে পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। আর এই শূন্যতা পূরণ করতেই “তালিবান” জন্ম হয়। মার্কিন প্রভুর স্বার্থসিদ্ধির পাশাপাশি পাকিস্তান যে অতিরিক্ত যে সুবিধাটা পায় তা হল “ডীপ স্টেট” কনসেপ্টকে রূপায়ণ করা, ভবিষ্যৎ ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় সে প্রয়োজনে পিছিয়ে এসে আফগান মাটি থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবে এবং কাবুলে পাক নিয়ন্ত্রিত কোন সরকার তার পশ্চিম সীমান্তকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করবে। বাস্তবে পাখতুন উপজাতি শুধু নিজের ভূমিকে ট্রেনিং ক্যাম্প হিসাবেই ব্যবহার করতে দিয়েছে তাই নয়, সে প্রয়োজনীয় লোকবলেরও যোগান দিয়েছে ভারতের সাথে ছায়া যুদ্ধে।
১৯৯৬ সালে কাবুলের মসনদ দখন করে তালিবান, এবং বিল ক্লিনটনের আমন্ত্রণে তালিবান প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন সফর করে। এর পরেই ১৯৯৭ সালে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্থান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান মিলে ২ বিলিয়ন ডলারের “সেন্ট গ্যাস” পাইপলাইন নির্মাণে সম্মত হয়, যার ৪৭% মালিকানা আমেরিকান ইউনিকল, ১৭% ডেল্টা অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরব), হুন্ডাই ও হিতাচির ১৯% শেয়ার, ৭% তুর্কমেন সরকার ও ৫% পাকিস্তান সরকারের মালিকানায় থাকবে। বাকি তালিবানের হাতে থাকবে। এরই পাশাপাশি ইউনিকলের প্রতিদ্বন্দ্বী কনসোর্টিয়াম আর্জেন্টিনার ব্রাইডাস পশ্চিম আফগানিস্তান হয়ে বিকল্প পাইন লাইন নির্মাণের অফার দেয় তালিবানকে যার ১৫% শেয়ার থাকবে আফগান সরকারের হাতে, পাশাপাশি গ্যাস পরিবহণ বাবদ বছরে ১ বিলিয়ন ডলার ট্রানজিট ফী, পাইন লাইনকে কেন্দ্র করে রাস্তা, প্রতি ২০ কিমি অন্তর পুলিশ পোস্ট, রেললাইন ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণ করা হবে যথেষ্ট পরিমাণে। পুলিশ বাহিনী সহ এর পুরো খরচও বহন করবে ব্রাইডাস।
ইউনিকলের সাথে মার্কিন ডেমোক্রেটদের সম্পর্ক অন্তত ভাল। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান জর্জ বুশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এলে এই পাইপলাইনের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলতে থাকে রিপাবলিকানরা। এমতাবস্থায় ১৯৯৮ সালে ইয়েমেনে আল কায়দা মার্কিন সেনা শিবিরে হামলা চালায়। পাল্টা মার্কিন সেনা সৌদিতে ওসামা বিন লাদেনের শিবিরে হামলা চালালে ইউনিকল সেন্ট গ্যাস প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে ১৯৯৯ সালে।
“এই যুদ্ধ অনেক সময় নেবে এবং সমাধান হবে”—প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবলু বুশ ঘোষণা করেছিলেন ১২ই সেপ্টেম্বর ২০০১—”এবং এখানে কোন ভুল নেই আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হব”। এর পরবর্তী দুই দশক মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতি এই দর্শনেই পরিচালিত হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে, মার্কিনীরা সরাসরি যুদ্ধ করে পুতুল সরকার বসিয়েছে। পাকিস্তান, সুদান, লিবিয়া, সিরিয়া সহ একাধিক দেশে বিমান হামলা চালিয়েছে। শুধু আমেরিকা একাই খরচ করেছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। গোটা বিশ্বেই নিরাপত্তা খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। বহু জিহাদি গোষ্ঠীর উদ্ভব যেমন হয়েছে ধ্বংসও হয়েছে অনেক। কিন্তু মুল প্রশ্নের উত্তরটাই থেকে গেছে অনুচ্চারিত—কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও জয়ী কে?
সোভিয়েত-পতন উত্তর বিশ্বে “ওয়ার অন টেরর” আসলে গোটা বিশ্বকে মার্কিন দখলে আনার এক মেগা প্রজেক্ট যার বলি হয়েছেন ৯০ লক্ষ মানুষ। আফগানিস্তানই কিন্তু প্রথম নয়, “ওয়ার অন টেরর” প্রজেক্টের প্রথম মহড়া হয় সোমালিয়ায়। তারপর যুগোস্লাভিয়ার সফল অভিজ্ঞতা পেরিয়ে হাল্লা রাজা ২০০১ সালে ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তারা এই যুদ্ধে জয়ী হবেন।
এই যুদ্ধে আমেরিকা কতটা সফল বা জয়ী তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আমরা এর সূত্র ধরে কি কি পরিবর্তন দেখলাম—প্রথমত: মানুষের মৌলিক চাহিদার স্থান নিলো এক কল্পিত সন্ত্রাসবাদের জুজু, দ্বিতীয়তঃ এই জুজু দেখিয়ে পুলিশি রাষ্ট্রের নির্মাণ, তৃতীয়ত পেশাগত পরিচয় হারিয়ে মানুষ আস্তে আস্তে ধর্মীয় বা ভাষাগত বা জাতিগত পরিচয়ে পরিচিত হতে লাগল, চতুর্থত বহুজাতিক বৃহৎ রাষ্ট্রের (সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া) বদলে উগ্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে ছোট ছোট রাষ্ট্রের নির্মাণ, এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭-০৮ অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে দেশে দেশে নরেন্দ্র মোদী, এরদোগানের উত্থান। আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে সংকট যা কিনা ক্রমান্বয়ে ফিরে ফিরে আসছে তার থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে পারে একমাত্র অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা নিশ্চিত করা। এই জন্যেই দেখবেন “ওয়ার অন টেরর” প্রজেক্ট শুধু একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই চালিয়েছে এমনটা নয়। বরং ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত থেকে শুরু করে মায় ফিলিপিন্সও তার তার নিজের মত করে নিজস্ব নামে এই যুদ্ধটাকে জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। মোজাম্বিক, ডিপি.আর কঙ্গো, রুয়ান্ডায় যে গৃহযুদ্ধ তা আসলে ই.ইউ-এর স্বার্থরক্ষায়। তেমনই দাগেস্তান ও চেচেনিয়া রুশ রাজনীতিতে পুতিনের ক্ষমতা সংহত করেছে, চিদাম্বরম বেরিয়েছে সবুজ শিকারে। স্থান কাল পাত্র মাত্রা ও নাম ভেদে পৃথক পৃথক হলেও এগুলো আসলে এই ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টেরই অংশ। এটাই এই প্রজেক্টের রাজনীতি। আর তাই তালিবানের হাতে কাবুলের পতন গোটা বিশ্বকে এত চমকিত ও শিহরিত করেছে। এই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে কাবুলের পালাবদলকে আপনি বুঝতে পারবেন না। আফ্রিকার শিঙের উপর অবস্থিত সোমালিয়া যেমন বিশ্ব নৌবাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে, আফগানিস্তানও বিশ্ব স্থলবাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। শুধু তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সবসময় এমন নয়। সেই স্থানের ভৌগলিক অবস্থান ও রাজনীতিতে গভীর ছাপ রাখে।
এখন আফগানিস্তানের তালিবানকে কেন্দ্র করে এক বিতর্কের জন্ম হয়েছে যার পোশাকি নাম “ভালো তালিবান, খারাপ তালিবান” বা “পরিবর্তিত তালিবান”। পরোক্ষে অনেকেই বলতে চাইছেন পূর্বের তালিবানের চেয়ে দ্বিতীয় তালিবান সরকার অনেক উদার ও আধুনিক। জীবিত তালিবানের শবব্যবচ্ছেদেও মেতেছে অনেকে। কিন্তু অহেতুক এই বিতর্কে না গিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ইসলামের শিকড় অনুসন্ধান করা উচিত। কারণ এই যে “ভাল তালিবান খারাপ তালিবান” এই তত্ত্বের জন্মদাতা আসলে জো বাইডেন তথা মার্কিন প্রচারমাধ্যম। সেনা প্রত্যাহার পর্বে কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পরপরই বাইডেনের বক্তব্য ছিল “আই.এস(কে) ইজ আওয়ার সোল এনিমি” অথচ দর্শনগত ভাবে ইসলামিক স্টেট ও তালিবানের ভেতর ফারাক নেই। আসলে এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে বাইডেন সাহেব এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন—তিনি মার্কিন রাজনৈতিক পরাজয়কে আড়াল করলেন, দ্বিতীয়ত পুনরায় আফগানিস্তানে ফিরে আসার সূত্র দিয়ে রাখলেন। ইসলামিক স্টেট যদি প্রকৃতই “সোল এনিমি” হত তাহলে আসাদ সরকারকে উৎখাত করতে উত্তর সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের গঠন কেন করেছিল আমেরিকা? আবার এই ইসলামিক স্টেটের পৃষ্ঠপোষক হলেন রিসেপ তাইপে এরদোগান—ইদলিবের শেষ জিহাদি ঘাঁটি উচ্ছেদে রুশ সিরিয়ান সামরিক আক্রমণকে প্রতিহত করতে যিনি সেনা পাঠিয়েছেন। আমাদের দেশে অনেকেই ওকে আজকাল মুসলিম বিশ্বের আদর্শ শাসক বা মুক্তিদাতা হিসাবে কল্পনা করেন। কিন্তু তারা এটা মাথায় রাখেন না যে মুসলিমের বেশ ধরেই আবু লুলু হযরত ওমরকে হত্যা করেছিল। হযরত আলীর হত্যাকারীও মুসলিম খরেজীরা। আর এই খরেজীদেরই উত্তরাধিকারী হল ওয়াহাবীজম ও সৌদিরা। আজ কে শরীয়া আইন প্রয়োগের যে যে অভিযোগে তালিবান বিদ্ধ সেই একই আইন সৌদি আরবেও বলবত আছে। কিন্তু সৌদি শাসকদের সাথে গলাগলি করতে ট্রাম্প বা হিন্দু সম্রাট মোদীরও দ্বিধা হয় না।
ইসলামের যে চারটি মাজহাব আছে তার ভেতর মালিকী মতবাদ থেকে ওয়াহাবীইজমের উদ্ভব। এর মুল কথাই হল শাসকের বিরুদ্ধে জেহাদের মাধ্যমে ইসলামের আদিতে ফিরে যাওয়া। মূলত কোরান ও সহী হাদিসই হল দর্শনের কেন্দ্রে। ইসলামের আদিতে ফিরতে চাওয়ায় অনেকে ওয়াহাবীদের সালাফিও বলে থাকেন। সালাফ-এর অর্থ পূর্ববর্তী কিন্তু আব্দুল ওয়াহাব অনুসারীদের কীর্তিকলাপে ক্ষুব্ধ হয়ে মালিকী সম্প্রদায় আব্দুল ওয়াহাব কে বহিষ্কার করে। তখন তিনি নজফের আমীর আমমেদ ইবন সৌদের সাথে হাত মিলিয়ে তৎকালীন আরবের শাসক অটোমানদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। এত বড় মুসলিম এরা যে শ্রদ্ধেয় সাহাবাদের কবর ধ্বংস করা বাদেও মক্কা ও মদিনার দখল নিয়ে ওয়াহাবীরা রাসুলের কবরও ক্ষতিগ্রস্ত করে, গণহত্যা চালায়, কারবালায় হযরত আলী ও ইমাম হাসানের কবরও এদের হাতে ধ্বংস হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে শিয়া পন্থী ইসলামিক বিপ্লবের পর, আরব ভূখণ্ডকে শিয়াপন্থা মোকাবিলা করতে সৌদিরা এই ওয়াহাবীইজমের কৌশলী ব্যবহার শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৯ সালে কাবুলে সোভিয়েত সেনার আগমন রিয়াধের সামনে এক তীরে দুই পাখি মারার সেই সুযোগ তৈরি করে। আবার এই একই সময়ে গোটা মুসলিম দুনিয়া আলোড়িত ছিল আরব জাতীয়তাবাদ ও বাথ সোশ্যালিজম নিয়ে। ফলে আমেরিকার কাছেও প্রয়োজন ছিল এক বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে দাঁড় করানোর। ১৭৭৪ সালে আব্দুল ওয়াহাবের সেই জেহাদ এ্যাঙ্গলো স্যাক্সন প্রভুর স্বার্থে ফণা তোলে, ঠিক যেমনটি তুলেছিল অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে অটোমানদের দুর্বল করার জন্যে।
কিন্তু জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নয়া অটোমান খলিফা এরদোগান সাহেবকে নামিয়েছে আমেরিকা আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থকে রক্ষা করতে। কাতারে অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তম মার্কিন সেনা ঘাঁটি এবং ৬টি পরমাণু বোমা সহ তুরস্কের মার্কিন ঘাঁটি বন্ধ করতেন এরদোগান সাহেব যদি তার ইমান সাফ হত। এমন কি ন্যাটো ছেড়েও বেরিয়ে আসতে পারতেন। অনেক এরদোগান সমর্থক হয়ত জানে না ইজিপ্টে মিলিটারি জুন্টার হাত থেকে বাঁচতে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে তুরস্ক। মহঃ মোরসীর পতন ও হত্যাও এত সহজ হত না মিলিটারি জুন্টার পক্ষে। একই কথা দোহার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই কথাগুলো বলার একটাই উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক ইসলাম নীতিগতভাবে যতই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক না কেন, গোটা ইতিহাস পর্বে তারা আসলে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারাই ব্যবহৃত হয়েছে। হাসান আল বান্না সহ ব্রাদারহুডের নেতা ও কর্মীদের সততা, দৃঢ় একাগ্রতা ও আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এই কথা বলছি যে তা আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই সেবা করে অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরের আঘাত তার পরিবর্তন না ঘটায়, যেমন হামাস। তালিবানের বদল আমরা এতটুকুই আশা করতে পারি। কিন্তু তারপরেও আমি বলব মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে তালিবান, লস্কর-ই-তৈবা থেকে শুরু করে আল শামস বিগ্রেড, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, বোকো হারাম—এরা সবাই মূলে গিয়ে একটা কমন ধারণা ধারণ করে তা হল ইসলামের আদিতে ফিরে যাওয়া। আর এই ফেরার পথে তারা মদিনা সদন, বায়তুল মাল, হযরত ওমরের পারসিয়ার কৃষি সংস্কার সহ অর্থনৈতিক অংশটা কে বাদ দিয়ে বসেন। ওয়াহাবী মতবাদের প্রভাবে ভারতে যে দারুল উলুম দেওবন্দী মাদ্রাসা, তার আফগান সংস্করণ হাক্কানি মাদ্রাসা—যে হাক্কানি নেটওয়ার্ক এত আলোচিত—তার ইতিহাস পাঠান ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস। বহু ওয়াহাবী সাহাদত বরণ করেছে এই লড়াইতে। মৌলানা মেহমুদ হাসান প্রাণ পর্যন্ত দিলেন ব্রিটিশ কারাগারে। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত কোন মৌলিক ছাপ রাখতে না পেরে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে গান্ধীবাদেরই আশ্রয় গ্রহণ করে কার সেবা করেছেন আজ ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই উত্তর উঠে আসবে। আবার বাংলায় যে ফরাজিরা একদা আরব থেকে আমদানি করা সহি ইসলাম শেখাতে তৎপর হয়েছিল ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার আঘাত তাদের বাধ্য করেছিল জমির প্রশ্ন, কৃষকের অধিকারের প্রশ্নকে তাদের প্রধান ইস্যু হিসাবে তুলে আনতে। এখন তালিবানের ক্ষেত্রেও দেখার যে চীনা পুঁজি কি পরিবর্তন আনে সেখানে।
[লেখক – কৃষক ও সমাজকর্মী।]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story