ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর রাজনীতির কবলে আফগানিস্তান : ড. শঙ্কর কুমার বিশ্বাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া- এই দুই বিবদমান শিবিরের ঠাণ্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আবর্তিত হয়েছিল। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের রাজনৈতিক পরিণতি হল দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তি শিবিরের আত্মপ্রকাশ, যা কখনো উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা উত্তেজনাহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছিল। ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রভাব অনুভূত হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং তা ঐ সব দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছিল। দ্বিমেরুপ্রবণ রাজনীতি যেসব আঞ্চলিক সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, তা হল কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবার সংকট, প্যালেস্টাইন সমস্যা, আফগানিস্তানের সংকট ও উপসাগরীয় যুদ্ধ ইত্যাদি। ১৯৭০ এর দশক থেকে উত্তেজনাপূর্ণ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হ্রাস পেতে থাকে, যা দাঁতাতের রাজনীতি বা উত্তেজনা প্রশমনের রাজনীতি নামে পরিচিত। আঞ্চলিক এই সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে দুই বিবদমান রাষ্ট্র নমনীয় সহাবস্থানমূলক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। নমুনা হিসেবে PTBT- 1963, NPT-1968, SALT-I-1972 বা SALT- II এর মতো পারমাণবিক অস্ত্র সংকোচন সংক্রান্ত চুক্তিগুলির কথা বলা যায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের সময়কালে (১৯৭৭-৮১) এই উত্তেজনাহীন প্রতিযোগিতার রাজনীতি ধাক্কা খায় এবং শুরু হয় মুক্ত কূটনীতির যুগ। এই যুগে কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কিন কূটনীতিক বিগনিউ ব্রেজইনস্কি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়াকে ‘অস্থিরতার ভরকেন্দ্র’ বলে ঘোষণা করেন। ১৯৭৮ সালে আফগান সংকটকে কেন্দ্র করে তা আরও অস্থির হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ঠাণ্ডা যুদ্ধের আদর্শগত ভিত্তি রচিত হয়।

ঠাণ্ডা যুদ্ধের এই চলমান দিনগুলিতে দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েনি ঠিকই, তবে প্রভাবাধীন বলয়ের বিস্তার ঘটাতে পরোক্ষভাবে একাধিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। এই সূত্রেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বিস্তার ঘটে। দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দুই শিবিরকেই খেসারত দিতে হয়েছিল। কোরিয়া, ভিয়েতনাম বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয় বা যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। ঠাণ্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের মতো আঞ্চলিক সংঘর্ষে দুই শিবিরের ব্যর্থতা বা লজ্জাজনক পরিস্থিতি একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে।

কোরিয়ার যুদ্ধ (১৯৫০-১৯৫৩) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ৩৮০ অক্ষরেখা বরাবর উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে কোরিয়া বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তর কোরিয়া সোভিয়েত ও দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন সেনার দখলে চলে যায় এবং শুরু হয় উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ। কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল এশীয় অঞ্চলে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বিস্তারের প্রথম নমুনা এবং ঠাণ্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে প্রথম আন্তর্জাতিক যুদ্ধ। টানা দুবছর যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে আমেরিকা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। মার্কিন সেনাপতি ডগলাস ম্যাকআর্থার এর নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য জাতিপুঞ্জের বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়। অন্যদিকে চিন এই যুদ্ধে যোগদান করলে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে যায়। বহু কোরিয়াবাসী ও মার্কিন সেনার মৃত্যু ঘটে। শেষপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। অতঃপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্যবাদ প্রতিরোধের জন্য সিয়েটোর (SEATO) মত সংস্থা গঠন করে।
ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রাম (১৯৫৪-১৯৭৫) : ভিয়েতনামের সমস্যা ঠাণ্ডা লড়াই ও উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের সংমিশ্রণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা লাভ করে। ফরাসী অধিকৃত ইন্দোচীনে উপনিবেশ বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভিয়েতনামের জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় এবং ক্রমে তা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের যুদ্ধ, জেনেভা চুক্তি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে। তবে জেনেভা চুক্তি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি। একটি সমস্যার সমাধান করে নতুন আর এক সমস্যার সূচনা করেছিল। ফ্রান্সের স্থলাভিষিক্ত হয় আমেরিকা। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইজেন হাওয়ারের (১৯৫৩-৬১) হাত ধরে ভিয়েতনামে ঠাণ্ডা লড়াই জমে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ পরোক্ষ ভূমিকা ছেড়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এগিয়ে আসে। অন্যদিকে ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট বা ভিয়েত কং ও উত্তর ভিয়েতনামী সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে আমেরিকান বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ১৯৭৫ সালে মার্কিন জেনারেল সায়গনে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। ভিয়েতনামে সাম্যবাদ প্রতিহত করার আমেরিকান স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। বিশ্বে আমেরিকার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। এশিয়া তথা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের কাছে ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রাম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হযে রয়ে যায়।

আফগান সংকট (১৯৭৯) : ভিয়েতনামের পর বিশ্বরাজনীতির ঝটিকা কেন্দ্র হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। ইতিহাসে একই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি। শুধু বদল ঘটে দেশ ও কালের। পাহাড় ঘেরা আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সোভিয়েত রাশিয়া। আফগানিস্তানে সোভিয়েত রশিয়া তার তাবেদার সরকার গড়তে গিয়ে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ে (১৯৭৯)। ভিয়েতনামে মার্কিন সেনার যে দশা হয়েছিল, আফগানিস্তানে রুশ বাহিনীরও একই দশা হয়। সারা বিশ্বে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব ও জেনেভা চুক্তির সাথে সাযুজ্য রেখে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ২০০১ সালে আমেরিকায় বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের উপর আল কায়দা গোষ্ঠীর আক্রমণ আফগানিস্তানে মার্কিন প্রবেশের পথ প্রশস্থ করে। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর এর ঘটনার প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে আমেরিকা আফগানিস্তানের উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর চীনের সামনে উন্মুক্ত ক্ষেত্র রেখে জো বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এশীয় ভূ-রাজনীতিতে বাইডেনের বিচক্ষণতার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তালিবানদের সামনে প্রচুর মার্কিন সৈন্য রেখে উদভ্রান্তের মতো মার্কিন প্রস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ কার্যক্রমের কথা। ১৯৪২ এ সিঙ্গাপুরের পতনের পর ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে জাপানি আক্রমণের মুখে ফেলে রেখে ব্রিটিশের প্রস্থান ঘটে। উইনস্টন চার্চিল এই ঘটনাকে ব্রিটিশ সামরিক ইতিহাসে ‘জঘন্যতম বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

(২)

পাহাড়-পর্বত ও গিরি-গুহা বেষ্টিত আফগানিস্তানের আসল পরিচয় ছিল উপজাতি সত্ত্বা। প্রায় ১৩-১৪টি উপজাতির সমন্বয়ে সমগ্র আফগানিস্তান গড়ে উঠেছে এবং যুগ যুগ ধরে এই উপজাতি গোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পাশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক ও বালুচ প্রভৃতি ছিল প্রধান। আহমদ শাহ আবদালির সময় থেকে আজ পর্যন্ত পাশতুন উপজাতি গোষ্ঠীর নেতারাই আফগানিস্তান দখল করে রেখেছে। যাইহোক, অর্ধযাযাবর উপজাতি সমাজের বড় অংশ ছিল কৃষক ও পশুপালক। মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হল পাশতুন। সুন্নি ধর্মাবলম্বী এই মুসলিমদের একটা বড় অংশ তালিব। তবে তালিব বিরোধীও তাদের মধ্যে আছে। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের মতো তালিবান বিরোধী পাশতুন যুদ্ধপতিদের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। পঞ্জশির উপত্যকাসহ গোটা উত্তর আফগানিস্তান, বাদাকশান ও পশ্চিম আফগানে বসবাস করে তালিব বিরোধী তাজিকরা। এদের উল্লেখযোগ্য নেতা হলেন আহমেদ মাসুদ। তার নেতৃত্বে নব্বইয়ের দশকে তাজিকরা তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য উত্তরের জোট গঠন করেছিলেন। উত্তর আফগানিস্তানের হাজারা, উজবেক ও বালুচিরা ছিল তালিব বিরোধী। তবে এরা আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বা আধা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো উপজাতি এই সমাজ কাঠামোকে ভাঙতে পারেনি। এমনকি ধ্রুপদী ইসলাম ও আফগানিস্তানে তার নিজস্ব সত্ত্বা বজায় রাখতে পারেনি। ইসলাম বা অন্যান্য ধর্ম সেখানে উপজাতি সমাজের সাথে আপোষ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে ইসলাম এখানে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়নি বা শক্ত ভিতের উপর দাড়াতে পারেনি। ইরানে রেজা শাহের আমলে যেমন উপজাতীয় সত্ত্বা ক্রমশ দুর্বল হয়েছে এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে তা কখনোই ঘটেনি। এখানকার উপজাতীয় সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজ গঠনে এগিয়ে আসেনি বা বিদেশীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে সামিল হতে পারেনি। তাই ধর্মযুদ্ধ নয়, জাতিদাঙ্গা বা জাতিগোষ্ঠীর লড়াই হল আফগানদের চিরাচরিত ঐতিহ্য।

মুঘল সম্রাট বাবরের সাম্রাজ্যের একটা বৃহত্তর অংশ ছিল সমগ্র আফগানিস্তান। এক সময় তা ইরানীয় সাম্রাজ্য ও নাদির শাহের খোরাসান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। নাদির শাহের সেনাপতি আহমদ শাহ আবদালি ইরান থেকে পৃথক করে স্বাধীন আফগানিস্তানের ঘোষণা করেন। আহমদ শাহ আবদালির নেতৃত্বেই আফগানে দুরানি বংশের শাসনের সূচনা ঘটে। দুরানি ও সাদোজাই বংশের শাসনের অবসানের সাথে সাথে আফগানিস্তান নানা সামন্তরাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। হেরাট, কাবুল, কান্দাহার ও পেশোয়ারের মতো প্রদেশগুলি এভাবেই সৃষ্টি হয়। পাঞ্জাব কেশরী মহারাজা রঞ্জিত সিংহ আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশে নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই অঞ্চলকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন। অতঃপর কাবুলের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন আমীর দোস্ত মহম্মদ খান (১৮২৬-৬৩)। তার আমলেই আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ ঘটে এবং তারা একটা সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয়। তাই আধুনিক আফগানিস্তানের স্থপতি হিসেবে দোস্ত মহম্মদ খানের নাম করতে হয়। আফগানিস্তানকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন আবদুর রহমান খান (১৮৮০-১৯০১), হবিবুল্লাহ খান (১৯০১-১৯১৯) বা আমানুল্লা খান প্রমুখ। আমানুল্লা খানের আমলে (১৯১৯-১৯২৯) ব্রিটিশ অধীনতা থেকে আফগানিস্তানের মুক্তি লাভ ঘটে। তাঁর আমলে আফগান সংবিধান প্রণীত হয় (১৯২৩) এবং অর্থনীতি ও কৃষির ক্ষেত্রে নানা সংস্কার সাধিত হয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাস অর্থাৎ রাজা জাহির শাহের আমল পর্যন্ত (১৯৩৩-৭৩) আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র বজায় ছিল। রাজা জাহির শাহের ইউরোপ সফরের সুযোগ নিয়ে কমিউনিস্টপন্থী দাউদ খান এক রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে জাহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটান এবং নিজেকে প্রজাতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।

১৯৬০ এর দশকের শেষার্ধ থেকে বিশ্বব্যাপী বামপন্থার প্রসারের যুগ শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে People’s Democratic Party of Afghanistan’ (PDPA) প্রতিষ্ঠা হয়। শীঘ্রই আফগান কমিউনিস্ট পার্টি নরমপন্থী ও চরমপন্থী এই দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দুবছরের মধ্যে ‘পর্চাম’ (চরমপন্থী) এবং ‘খালক্‌’ (নরমপন্থী)- কমিউনিস্ট পার্টির এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়। বারবাক কারমাল ছিলেন ‘পর্চাম’ গোষ্ঠীর নেতা, আর নূর মহম্মদ তারাকি হলেন ‘খালক্‌’ গোষ্ঠীর নেতা। ১৯৭৩ সালে পর্চাম গোষ্ঠীই মহম্মদ দাউদকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। PDP নেতা বারবাক কারমাল দাউদ মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। তবে দাউদের সঙ্গে শীঘ্রই বামপন্থীদের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ দাউদ মন্ত্রীসভা দেশের ধনী ও কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে আপোষের পথ গ্রহণ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণপন্থীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাছাড়া মন্ত্রীসভা থেকে কমিউনিস্টদের অপসারণ শুরু হয়। দাউদের স্বৈরাচারী শাসনের সূত্রধরে বহু কমিউনিস্টকে জেলে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। এমনকি কমিউনিস্টদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতেও দ্বিধা করেন নি। ১৯৭৬ সাল দাউদ তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আইনসঙ্গত বা বৈধকরণের উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় বিপ্লবী পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম করেন, পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়া সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ইরান ও আমেরিকার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আফগানিস্তানে দাউদ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলি শীঘ্রই একত্রিত হয়। ১৯৭৮ সালে ‘এপ্রিল অভ্যুত্থানের’ মধ্যে দিয়ে দাউদ ক্ষমতাচ্যুত হন। কাবুলের জনতা সামরিক বাহিনীর একাংশের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু করে এবং সর্বস্তরের মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। আফগানিস্তানে এই ‘এপ্রিল অভ্যুত্থান’ ‘সাউর বিপ্লব’ নামে পরিচিত। কারণ পুশতু ভাষায় সাউর (Saur) কথাটির অর্থ হল এপ্রিল। যাইহোক এই বিপ্লবের পর আফগানিস্তানকে গণসাধারণতন্ত্রী আফগানিস্তান রূপে ঘোষণা করা হয় এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন খালক্‌ গোষ্ঠীর নেতা নূর মহম্মদ তারাকি। তারাকির নেতৃত্বাধীন পি.ডি.পি.এ. সরকার নানা প্রগতিশীল সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করলেও, তাদের আভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। অতঃপর এক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নূর মহম্মদ তারাকিকে পদচ্যুত ও হত্যা করে হাফিজুল্লাহ আমিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। (১৯৭৯ এর সেপ্টেম্বর)। এ ঘটনায় প্রচ্ছন্ন মদত ছিল আমেরিকা ও প্রতিবেশী রক্ষণশীল মৌলবাদী শক্তিগুলির।

(৩)

আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ঠাণ্ডা লড়াই আবার জমে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি ও তার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা কমিউনিস্ট বিরোধী প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলিকে মদত দিতে থাকে। আমেরিকা তার গোয়েন্দা বিভাগের সাহায্যে অতি সূক্ষ্মভাবে একাজ করে চলে। অন্যদিকে হাফিজুল্লাহ্ আমিনের সময় থেকেই সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। হাফিজুল্লাহ্‌র সংস্কারবাদী ক্রিয়াকলাপ জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ইসলামের রীতিনীতির উপর তার হস্তক্ষেপ আফগানরা ভালোভাবে নেয়নি। কমিউনিস্ট সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ তলানিতে পৌঁছায়। হাফিজুল্লাহ আমিনের এই অদক্ষতার সাথে যুক্ত হয় মার্কিন প্রীতি- যা সোভিয়েত রাশিয়াকে আফগান দখলে প্ররোচিত করে। যাইহোক দীর্ঘ একবছর ধরে আফগানিস্তানে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পর রাশিয়া হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। শেখ বারবাক কারমালের নেতৃত্বে সোভিয়েতপন্থী সরকার গঠিত হয় (১৯৭৯)। আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের যুক্তি হিসেবে দক্ষিণ সোভিয়েতের বিস্তীর্ণ অংশে অবস্থিত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ও তাদের সাথে রুশবাসীর মতপার্থক্য, আফগানিস্তানে মুসলিম মৌলবাদীদের জেহাদি কার্যকলাপ ও ১৯৭৮ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামীয় বিপ্লব’ ইত্যাদির প্রেক্ষিতে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি ব্রেজনেভ তার বিস্তারধর্মী নীতি বা আগ্রাসন তত্ত্বের প্রকাশ ঘটান, যা ব্রেজনেভ তত্ত্ব নামে পরিচিত। ব্রেজনেভ তত্ত্বের মূলকথা হল, কমিউনিস্ট শাসিত দেশে সমাজতন্ত্র বিপন্ন হলে সোভিয়েত রশিয়া সেখানে হস্তক্ষেপ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অন্যায্য সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেই অর্থে কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। কারণ ভিয়েতনামের ট্রমা সে তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে দক্ষিণ পশ্চিম আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা ঘাঁটি স্থাপন করায়, আমেরিকা ইরান তথা উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই সূত্রেই পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরীগুলির আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। ঠাণ্ডা লড়াই নবরূপে জমে ওঠে।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনার উপস্থিতি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বাইরে এটাই ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার প্রথম ও শেষ সামরিক অভিযান। আফগানিস্তানে এই অপরিণামদর্শী অভিযান কোন দেশই ভালোভাবে নেয়নি। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সোভিয়েত সেনাবিরোধী বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগামী পাকিস্তান ইরান ও লিবিয়ার মত দেশগুলি আফগান মুজাহিদদের অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপকে মদত দিয়ে চলেছিল। মুজাহিদরা সোভিয়েত দখল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করতে প্রাণপণ লড়াই শুরু করে। একদিকে সোভিয়েত বিরোধী বিদ্রোহ মোকাবিলা, অন্যদিকে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন রাখার বিপুল খরচ সোভিয়েত অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে তোলে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব প্রতিহত করতে উঠে পড়ে লাগে। সোভিয়েত রাশিয়ার উপর সামরিক আধিপত্য কায়েম করতে উপগ্রহযুদ্ধের কথা ঘোষণা করে। ১৯৮০-৮৫ সালের মধ্যে প্রায় এক লক্ষ মুজাহিদ সেনা সংগ্রহ করা হয়। মার্কিন অর্থে তাদের প্রশিক্ষণ চলে। মার্কিন সাহায্যেই সৌদি আরবের ব্যবসায়ী ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ ঘটে। ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্ভাচেভ প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হবার পর আফগান বিড়ম্বনার প্রায়শ্চিত্ত করতে এগিয়ে আসেন। ১৯৮৮ সালের ১৪ই এপ্রিল গর্ভাচেভ ও রোনাল্ড রেগন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসে। অতঃপর রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব ও জেনেভা চুক্তি শর্ত মেনে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করে নেয় (১৯৮৯)।

আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারকালে মস্কোর প্রতি অনুগত নেতা নাজিবুল্লাহ আফগানিস্তানের নতুন শাসক মনোনীত হন। সোভিয়েতপন্থী নাজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটানো তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাড়ায়। ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি এবং নাজিবুল্লাহের একসময়ের সমর্থক রশিদ দোস্তম মুজাহিদদের পক্ষে চলে যাওয়ায় আমেরিকার পক্ষে তা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। সোভিয়েত ভাঙনের প্রাক্কালে উভয় দেশ আফগানিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধের শর্তে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরের মধ্যেই নাজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটে। পরে তালিবানরা নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে। ১৯৯২ সালে নাজিবুল্লাহের স্থলাভিষিক্ত হন বুরহান-উদ্দিন-রাব্বানি। ১৯৯২-৯৬ সাল পর্যন্ত কাবুলের দখল নিয়ে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে তীব্র গৃহযুদ্ধ চলে। এই সময় পর্বে তিনটি ইসলামিক সরকার পরপর ক্ষমতায় এসেছিল। শেষ সরকার ছিল বুরহানউদ্দিন রাব্বানি আর গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সমঝোতার সরকার। এই সরকারকে হটিয়েই প্রত্যক্ষ মার্কিন মদতপুষ্ট তালিবান সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে (১৯৯৬)।

তালিব বা তালিবান এই পুশতুন শব্দটির অর্থ হল ছাত্র, শিক্ষার্থী বা সত্যান্বেষী। সুন্নি মুসলমান মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নেতৃত্বে পাশতুন উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত একদল মানুষ পাক-আফগান সীমান্তে বিভিন্ন মাদ্রাসায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিত। ওসামা বিন লাদেনের সমর্থনে অস্ত্র প্রশিক্ষণরত এই মাদ্রাসার ছাত্ররাই তালিবান নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। তালিবানরা দেশে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন প্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের এই রক্ষণশীলতা ও মৌলবাদী অবস্থান রক্ষণশীলদের কাছে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। আল-কায়দা ছিল এরকম একটি রক্ষণশীল সংগঠন, যার নেতৃত্বে ছিলেন সৌদি আরব ব্যবসায়ী ওসামা বিন লাদেন। আল-কায়দার সম্পদের বেশিরভাগই এসেছিল আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের দেয় মার্কিন সাহায্য থেকে। আল কায়দার যোদ্ধাদের বেশিরভাগই আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের মধ্যে থেকে সংগৃহীত হয়েছে, যারা মার্কিন অর্থে লালিত হয়েছে। তবে আফগানিস্তানে তালিবানরা আমেরিকার আশা পূর্ণ করেনি। ইউনোক্যাল (Union Oil Company of California) নামে বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোগ্যাসের মার্কিন বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ওসামা বিন লাদেনের সাথে আমেরিকার বিবাদের সূচনা হয়। অতঃপর ১৯৯৬ সালে সৌদি আরবের দাহরানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে আলকায়দার হামলা, ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বা তানজানিয়ার রাজধানী দার-এস-সালেমের মার্কিন দূতাবাসে হামলা ইত্যাদি ঘটনা ক্রমশ লাদেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত করে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোল্লা ওমরের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তালিবানদের নেতিবাচক মনোভাব ও মার্কিন বিরোধী অবস্থান উভয়ের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তোলে।

আফগানিস্তানকে দ্বিতীয়বার শায়েস্তা করার সুযোগ আমেরিকা পেয়ে যায় বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র আক্রমণের ঘটনায় (১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১); ১১ই সেপ্টেম্বর চারটি বোয়িং বিমান যেন তারা খসার মতো আকাশ থেকে খসে পড়ল। এর মধ্যে দুটি বিমান নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার দুটি ধ্বংস করে দেয়। আর একটি বিমান ওয়াশিংটনের মার্কিন প্রতিরক্ষার সদর দপ্তর পেন্টাগনের উপর হানা দেয়। আর একটি হোয়াইট হাউস আক্রমণ করতে গিয়ে দিকভ্রষ্ট হয়ে পেনসিলভানিয়ার ফাঁকা মাঠে পতিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে জানা যায়, এই আক্রমণের নায়ক হল ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়দা। তালিবানি শাসনাধীন আফগানিস্তান ছিল তার জঙ্গি-সংগঠনের মূল ঘাঁটি। ৯/১১ এর এই ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হয় এবং সম্পত্তি নষ্ট হয়। আফগানিস্তানে আল-কায়দা জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা ও ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে সমর্পণ করার জন্য মার্কিন প্রশাসন চাপ সৃষ্টি করে। অতঃপর শুরু হয় আফগানিস্তানে মার্কিন বিমান হানা। তালিবান আস্তানা ও প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তবে মার্কিন সেনা মোল্লা ওমর ও ওসামা বিন লাদেনের হদিশ পেতে ব্যর্থ হলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন—- ‘আজ যে কোন দেশ হয় আমাদের বন্ধু, না হলে শত্রু।’ ৯/১১ এর ঘটনার ৬৩ দিনের মধ্যে কাবুলে তালিবান সরকারের পতন ঘটে এবং সেখানে মার্কিন তাবেদার সরকার গঠিত হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদ থেকে মার্কিন নৌবাহিনীর বিশেষ ফৌজ লাদেনের গোপন ডেরায় হানা দেয় এবং তাকে হত্যা করে।

‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বা ‘War on Terrorism’ হয়ে ওঠে মার্কিন বিদেশনীতির লক্ষ্য। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করে। সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে বা ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়দার জেহাদের প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সূচনা ঘটায়। মার্কিন এই বর্বরোচিত আক্রমণে অসংখ্য নিরীহ আফগানদের প্রাণ গিয়েছিল। সোভিয়েত ভাঙনের পর এক মেরু বিশ্বে এভাবেই আমেরিকা তার দম্ভ ও কর্তৃত্ব জারি রেখে ‘গ্লোবাল পুলিশম্যান’ বা বিশ্ব রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মানব বিধ্বংসী এই অভিযানকে সে ‘আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি’ বা ‘ন্যায্য হস্তক্ষেপের’ দাবী হিসেবে ঘোষণা করে দায় এড়াতে চেয়েছিল। তবে মার্কিন বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি হাত গুটিয়ে বসে ছিল না। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন নাগরিকদের উপর ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এভাবে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’, নামে আফগানিস্তানে ভয় ও আতঙ্কের ‘প্যান্ডোরা বক্স’ খুলে দিয়েই বাইডেন প্রশাসন আত্মসম্মান রক্ষা করেছে।

তবে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের এই প্রক্রিয়া হঠাৎ শুরু হয়নি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দোহাতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তালিবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আশরাফি ঘানি সরকার ও তালিবানদের মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ নিয়ে আন্তঃ আফগান আপসরফা ঘোষিত হয় (১০ই মার্চ, ২০২০)। তবে তা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কারণ তালিবানরা ক্ষমতার শীর্ষভাগ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে জর্জ বুশ নিজের অজান্তেই একটি জঙ্গি সংগঠনের ধ্বংস করতে গিয়ে ‘ইসলামিক স্টেটস’ নামে আর একটি সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। তালিবান মুক্ত আফগানিস্তান তৈরিই যাদের লক্ষ্য ছিল (২০০১), কুড়ি বছর পর তাদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে কাগুজে বাঘের রূপ ধারণ করেছে। আমেরিকার ছেড়ে যাওয়া এই অঞ্চলের দখল নিতে চাইছে সর্বগ্রাসী চিন। বিশ্ব দেখছে আর একবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটেনের জায়গা নিয়েছিল আমেরিকা। তারপর ট্রুম্যান ডকট্রিন, মার্শাল প্ল্যান বা ন্যাটোর মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় ঐক্যের রক্ষার নামে পুঁজিবাদী বিশ্বের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিল। পরের ইতিহাস সবার জানা। একবিংশ শতকে চিন নবরূপে ও সাজে আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়া শান্তিপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হতে চলেছে ‘চীন-রাশিয়া ও ইরান’ নামে নতুন অক্ষশক্তি।

তবে বর্তমানে ভারতবর্ষ কট্টর তালিবান বিরোধী অবস্থান বজায় রেখেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকে তালিবান সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তান ও চিনের প্রস্তাব মত আফগানিস্তানের নব নিযুক্ত তালিবান সরকারকে সার্ক ভুক্ত দেশের স্বীকৃতি দিতেও ভারত আপত্তি করেছে। ফলে সার্কের বৈঠক ভেস্তে গিয়েছে। ভারতের মতো আফগানিস্তানের আর এক প্রতিবেশী ইরানও উদ্বিগ্ন। নয়া দিল্লী-তেহরান কূটনৈতিক দৌত্য শুরু হয়েছে। কারণ অতি প্রাচীন কাল থেকেই আফগানিস্তানে ভারত ও ইরানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব সর্বজনবিদিত। আফগানিস্তানে বাণিজ্যের প্রশ্নে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১৮ কিমি দীর্ঘ জারাঞ্জ-ডেলারাম হাইওয়ে তৈরি হয়েছে। এতে ভারত-আফগানিস্তানের বাণিজ্যেরও গতি এসেছে। কিন্তু এই প্রকল্প তৈরির সময় তালিবানরা বিরোধিতা করেছিল। তাই তালিবানদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা কার্যক্রম নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। এদিকে পাকিস্তান ও চীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আফগানিস্তানের তথা তালিবানদের পক্ষ নিয়েছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস চীন বিরোধী দেশগুলিকে একত্রিত করতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে রত। তাই যে আমেরিকা একসময় তালিবানদের জঙ্গি হিসেবে ঘোষণা করেছিল, তাদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি ধুয়ো তুলেছেন বা কোন দেশের গৃহযুদ্ধ সামলানো আমেরিকার দায় নয়—- এই বলে দায়িত্ব সেরে বেরিয়ে এসেছে।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:
১. Peter Calvocorressi, World Politics Since 1945, Ninth edition, 2004, Pearson, London.
২. Wayne C. Mc Williams and Harry Piotrowski, The World Since 1945, 2009.
৩. Eric Hobsbawm, The Age of Extremes, Abacus, London, 1995.
৪. Siddhartha Guha Ray, World Politics Since 1945, A Concise History, Kolkata, 2018.
৫. Sammuel P. Huntington, The Clash of Civilization and the Remaking of World Order, New York, 1996
৬. দেবাশিস চক্রবর্তী, অধৃষ্য কুমার, স্বাতী বিশ্বাস (সম্পাদিত), আফগানিস্তান এবং সমসাময়িক বিশ্ব, কলকাতা, ২০০১।
৭. রাধারমন চক্রবর্তী (সম্পা.), সমকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কলকাতা, ১৯৯৯।
৮. অলক কুমার ঘোষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বর্তমান বিশ্ব, কলকাতা, ২০০৭।
৯. সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, সমকালীন বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কলকাতা, ২০১৭।
১০. সৌমিত্র শ্রীমানী, বিংশ শতকে পৃথিবী, কলকাতা, ২০১২।
১১. গৌরীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসের আলোয় সমকালীন বিশ্ব, ১৯৪৫-২০০৭, কলকাতা, ২০০৭।
১২. জয়ন্ত বৈদ্য, সমকালীন বিশ্বের ইতিহাস, নিউ দিল্লী, ২০১২।
১৩. অসিত কুমার মণ্ডল, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রূপরেখা, কলকাতা, ২০১৩।
১৪. অনীক চট্টোপাধ্যায়, ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কলকাতা, ২০১২।

পত্রপত্রিকা :
১. Frontline, September 10, 2021.
২. The Telegraph, August-September, 2021
৩. দেশ, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১।
৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ২০২১।

[লেখক – সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়।]

Facebook Comments

Leave a Reply