আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা: আলো-আঁধারির এক ইতিহাস : ডঃ রাজীব সাহা
“শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে মুক্তি।” অজানাকে জানা, সৃষ্টির রহস্যকে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে রহস্যের উদ্ঘাটন করা মানব প্রকৃতির এক নিরবচ্ছিন্ন অভ্যাস। আসলে অজ্ঞানতার অন্ধকার কে দূর করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোর উৎস হলো শিক্ষা। আদিম যুগ থেকে বর্তমান-আধুনিক যুগ, যেদিকেই তাকাই না কেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার জন্য, মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে মনকে কুসংস্কার মুক্ত করার জন্য, সর্বোপরি সমাজবদ্ধ মানুষের সমাজকে আলোর পথে চালিত করার জন্য শিক্ষার বিকল্প আর কিছু হয় বলে মনে হয় না। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু সন্ধিক্ষণ আসে, যেখানে শিক্ষা তার আলোকরশ্মি প্রয়োগের চেষ্টা করার পরেও সমাজকে যথাযথ আলোকিত করতে পারে না। সে সময় তার নিজের নিয়মে বাঁধা পড়ে বঞ্চিত হয় শিক্ষার আলোকরশ্মি থেকে। উপরন্তু কিছু সময় ও সুযোগসন্ধানী মানুষ থাকেন সেই সন্ধিক্ষণে যারা সুযোগ পেলেই শিক্ষার আলোকরশ্মির সামনে প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল তুলে সমাজের উপরে তো আলোকচ্ছটা পড়তে বাধা দিয়েছেন, শিক্ষার নিজের অহংকার কেও কখনো কখনো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। এমনই কিছু ঘটনার (দুর্ঘটনার) কবলে বারবার পড়েছে আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা। যেখানে শিক্ষার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে নিরবচ্ছিন্ন আলো পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে সে প্রত্যাশা না করাই ভালো। বরং আমরা যদি দেশটির ইতিহাসের উপর আলোকপাত করি, আমরা দেখতে পাবো বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে আফগানিস্তানের শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষানীতি কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, কিভাবে আক্রান্ত হয়েছে, এবং কিভাবে মাঝে মাঝেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে আফগানিস্তানে এখন ৯৯.৭ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলাম শাসন প্রবেশ করার আগে আফগানিস্তান মূলত: যোরোস্ট্রিয়ান, হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্মের মানুষের বাসভূমি ছিল। সেই সময়কার আফগানিস্তানের সমাজব্যবস্থার সাথে যেমন পশ্চিম ভারতের সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির মিল পাওয়া যায়, তৎকালীন আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাতেও সমকালীন পশ্চিম ভারতীয় শিক্ষার প্রভাব মেলে। বিজ্ঞানশিক্ষা তখনও আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এমন নয় যে মুসলমান শাসকরা শাসন শুরু করার সাথে সাথেই আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চলে আসে। এটা ঠিক যে মুসলমান শাসকরা তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষার সাথে বিজ্ঞান শিক্ষাকে কখনই তারা বিপরীতধর্মী বলে মনে করেননি।বরং আবু নাসের আল ফারাবি, ইবনে সিনা, আবু রায়হান আল বিরুনিরা খ্রিস্টীয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্যমাত্রা দিয়েছিলেন।
কিন্তু তার পরের ইতিহাস কিছুটা হতাশাজনক। ১৮৭৫ সালের আগে অব্ধি আফগানিস্তানে কোন প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Formal Education Institution) ছিল না। আফগানিস্তানের তৎকালীন শাসক আমির শের আলী খান (১৮৬৮-৭৯) ১৮৭৫ সালে আফগানিস্তানের ইতিহাসে প্রথম দু’টি প্রথাগত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুল দুটির প্রতিষ্ঠাকে আফগানিস্তানের আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তন হিসেবে ধরা যেতে পারে। দুটি বিদ্যালয়ের একটি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য এবং আরেকটি ছিল মিলিটারি স্কুল। পরবর্তীকালে কিং হাবিবুল্লা খানের সময় (১৯০১-১৯) আফগানিস্তানে আরো দুটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এই দুটি বিদ্যালয়ও তৎকালীন আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সমতুল্য ছিল। মাত্র ১০ জন আফগান ও ভারতীয় শিক্ষকদের নিয়ে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৯০৩ সালে। যার নাম “লিসা হাবিবিয়া”(হাবিবিয়া হাই স্কুল)। দ্বিতীয় স্কুলটি ছিল ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মক্তব-ই-হরবিয়া। কিন্তু হতাশার বিষয় হল ১৮৭৫ সালে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন হলেও ১৯১৯ সাল অব্ধি মোট স্কুলের সংখ্যা ছিল মাত্র চার।
এরপর ক্ষমতায় আসেন গাজী আমানুল্লাহ খান (১৯১৯-২৯)। তাঁর সময় আফগান শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আগের দু’বার দুটি করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরে গাজী আমানুল্লাহ খানের সময় শিক্ষায় তৃতীয় এবং সর্ববৃহৎ উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। সর্বোপরি এই সময়ে প্রথম আফগান শিক্ষার প্রসার ও উন্নতির উদ্দেশ্যে আফগানিস্তান সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত আমানুল্লাহ খান তাঁর দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেন। হাই স্কুলের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পায়। জার্মানি এবং ফ্রান্স থেকে শিক্ষকদের নিয়ে এসে কাবুলের স্কুলগুলিতে শিক্ষকতার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁদের সাথে সাথে আফগানিস্তানে আধুনিক শিক্ষা প্রসারের দায়িত্ব পান আফগানিস্তানের স্থানীয় শিক্ষকরাও। আমানুল্লাহ খানের সময়েই আফগানিস্তানে শিক্ষক রূপে কাজে যোগদান করেন সৈয়দ মুজতবা আলি। বাদশাহ আমানুল্লাহর আধুনিক আফগানিস্তান নির্মাণে সহযোগিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইংরাজি ও ফার্সি ভাষার শিক্ষক হিসাবে আফগানিস্তানে আসেন। আমরা তাঁর লেখা “দেশে-বিদেশে” থেকে তৎকালীন গাজী আমানুল্লাহ খানের আফগানিস্তানের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারি। গাজী আমানুল্লাহ খানের সময়ই সর্বপ্রথম রাজধানী কাবুলের বাইরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩২২ এ পৌঁছায়।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা নয়, এই সময়ে আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা উন্নতি লাভ করেছিল তা লক্ষ্য করা যায় শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রেও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শতশত শিক্ষার্থীদের তখন রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো শুরু হয়। আফগানিস্তানে নারীশিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসারে গাজী আমানুল্লাহ খানের ভূমিকা সবথেকে উল্লেখযোগ্য। আধুনিক আফগানিস্তান গঠনের লক্ষ্যে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আফগানিস্তানে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। আফগানিস্তানের শিক্ষার ইতিহাসে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯২১ সালে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সাথে সাথে আফগান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কিছুসংখ্যক আফগান মহিলাকে উচ্চশিক্ষার জন্যও তুরস্কে পাঠানো হয়। এসময়ই ৫০ জন আফগান নারীকে চিকিৎসক তৈরির উদ্দেশ্যে বহির্দেশে পাঠানো হয়।
যখন সারা বিশ্ব আমানুল্লাহ কে আফগানদের মুক্তিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেছে, তখন তাঁরই ধর্মান্ধ স্বদেশী নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত আমানুল্লাহ খান যখন শিক্ষার প্রসার ঘটাতে ঘটাতে কাবুলও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন এবং কিছু সংখ্যক মহিলাকে তুরস্কে পড়াশোনার জন্য পাঠালেন তখন থেকেই একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ বিশেষত: মোল্লারা আমানুল্লাহ খানের বিরোধিতা শুরু করলেন। তারা শরিয়া আইন উল্লেখ করে মূলত: আমানুল্লাহ খানের নারী শিক্ষার প্রসারের বিরোধিতা শুরু করতে থাকেন। তাদের মত অনুযায়ী নারীরা শুধুমাত্র তাদের ঘনিষ্ঠ লোকজনের দ্বারা তাদের বাড়িতেই শিক্ষা লাভ করতে পারে। তারা আমানুল্লাহ খানকে অনুরোধ করলেন বালিকা বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। মহিলারা শিক্ষালাভের জন্য কখনোই বাড়ির বাইরে যেতে পারে না। আমানুল্লাহ খান অনেক চেষ্টা করেছিলেন বোঝানোর। তিনি বিভিন্ন ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছিলেন ইসলামে নারী শিক্ষা কখনোই বর্জিত নয়। তিনি এক্ষেত্রে মক্কা-মদিনা, মিশর, দামাস্কাস, বাগদাদ এমনকি ভারতের উদাহরণ দেন যেখানে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মেয়েরা বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু তার সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা যায়। ফলস্বরূপ, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সমস্ত বালিকা বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং কিছু মেয়েদের তুরস্কে পড়াশোনা করতে পাঠানোর অপরাধে গাজী আমানুল্লাহ খান ১৯২৯ সালের ১৪ জানুয়ারি “দুর্ধর্ষ ডাকাত” হাবিবুল্লাহ খানখানি ওরফে বাচ্চায়ে সকান্ত এর অভ্যুত্থানে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ধর্মীয় গোঁড়াবাদী গোষ্ঠীগুলির উস্কানিতে এবং বাচ্চায়ে সকান্ত এর নেতৃত্বে মোল্লাদের বাহিনী চারদিক থেকে কাবুল ঘিরে ফেলে। পরে পুনরায় সেনা নিয়ে আফগানিস্তান প্রবেশ করলেও আর সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।
১৯২৯ সালে হাবিবুল্লাহ খানাখানিতার মাত্র নয় মাসের শাসনকালের মধ্যেই সমস্ত বালিকা বিদ্যালয় বন্ধ করেছিলেন। তার সাথে সাথে যে সমস্ত মেয়েদের বিদেশে পড়তে পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। শুধু বালিকা বিদ্যালয় বন্ধ করাই নয়, জার্মানি, ফ্রান্স বা অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় যে সমস্ত স্কুলগুলি তখনও আফগানিস্তানে চলছিল সবকটি স্কুল বন্ধ করে দিয়ে আদতে তিনি আফগানিস্তানে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের রাস্তা আলোকহীন করার প্রয়াস করেন।
এরপর সিংহাসনে আসীন হন নাদির শাহ্ (১৯২৯-৩৩)। নাদির শাহ তাঁর শাসনকালে আফগানিস্তানে বালিকা বিদ্যালয়গুলি পুনরায় চালু করেন। সেই সাথে সাথে আরো কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন সারা দেশজুড়ে। নাদির শাহ্এর সময়ে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটাতে ১৯৩২ সালে “কাবুল মেডিকেল ফ্যাকাল্টি” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মেডিকেল ফ্যাকাল্টির প্রথম ডিন ছিলেন তুর্কি প্রফেসর ডঃ রিফকি কামিল। পরের বছর আরও কয়েকজন তুর্কি প্রফেসর কাবুল মেডিকেল ফ্যাকাল্টিতে যোগদান করেন। এই মেডিকেল ফ্যাকাল্টি এবং আরও পাঁচটি এমন ফ্যাকাল্টি আফগানিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এরপর ক্ষমতায় আসীন হন নাদির শাহ পুত্র জাহির শাহ্। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর (১৯৩৩-৭৩) আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়ে ধীরগতিতে হলেও আফগানিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি এবং প্রশিক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। এই সময়েই অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, আরও অন্যান্য দেশে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এছাড়াও আফগানিস্তান জুড়ে এই সময় অনেকগুলি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ক্ষমতায় আসার ১৩ বছরের মধ্যেই ১৯৪৬ সালে আফগানিস্তানের কাবুলে প্রতিষ্ঠিত হয় “কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়”। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পরই আফগানিস্তানে আরও অনেকগুলি ফ্যাকাল্টি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬৪ সালে আফগানিস্তানে গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয়। ১৯৬৫ সালের ১ জানুয়ারি দ্য মার্ক্সিস্ট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) তাদের প্রথম সম্মেলন করে। ১৯৭৩ সালে মিলিটারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোহাম্মদ জাহির শাহএর পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসীন হন মোহাম্মদ দাউদ খান। তিনি আফগানিস্তানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১৯৭৮ সালে পিডিপিএপন্থী সেনারা আফগান প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস আক্রমণ করে মোহাম্মদ দাউদ খান এবং তার পরিবারকে হত্যা করে। ১ মে পিডিপিএ নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকি আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার নেন। কিন্তু তার শাসনকাল খুব মসৃণ ছিল না। খুব শীঘ্রই জুলাই মাসেই নুরিস্তান প্রদেশে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা হয়। ফলস্বরূপ ৫ই ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আফগান সরকারের অনুরোধে সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে পদার্পণ করে। ১৯৭৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হাফিজউল্লাহ আমিনের সর্মথকরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি তারাকিও কে হত্যা করে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পদার্পণের সময় থেকে ১৯৮৯ সালে তাদের চলে যাওয়ার পরে ১৯৯২ সালে আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারের পতন হয়।
কিন্তু এই সময়কালের চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রশিক্ষণ সাধারণভাবে খুব বেশি ব্যাহত হয়নি। বরং শিক্ষার প্রগতির যে ধারা ১৯১৯ সালে আমানুল্লাহ খানের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তা এক নির্দিষ্ট ছন্দে প্রবহমান ছিল তখনও। তবে এই সময় শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র সেই সব প্রদেশগুলোতে চালু ছিল যেখানে আফগান কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল। যেসমস্ত প্রদেশগুলোতে বা শহরগুলিতে আফগান কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, সেখানে প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও চালু ছিল না। সেই সময় পাকিস্তান ও ইরানে থাকা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ আফগান শরণার্থী এবং সরকার বিরোধী কিছু আফগান মানুষ নিজের মত করে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
তারপর ১৯৯৬ সালে আসে আফগানিস্তানের ইতিহাসের সম্ভবত: সব থেকে কালো অধ্যায়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নাজিমুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিষ্ট তালিবানরা ওরফে মোল্লারা। তালিবানদের ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে শুধুমাত্র আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে ভয়ঙ্কর পটপরিবর্তন হয় তা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষা হয়ে ওঠে ধর্মান্ধ তৈরির হাতিয়ার। আফগান শিক্ষাব্যবস্থা তালিবানদের এই করাল ছায়া এড়িয়ে যেতে পারেনি। বরং শিক্ষাব্যবস্থার উপরে তালিবানদের আক্রমণ বিশেষত: নারীশিক্ষার ওপর আক্রমণ সারা পৃথিবীতে তুলনাহীন হয়ে ওঠে।
তালিবান শাসনকালে সবথেকে বেশি আক্রমণ নেমে আসে আফগান মহিলাদের ওপরে। যথারীতি সে আক্রমণ প্রসারিত হয় আফগানিস্তানের সমস্ত বালিকা বিদ্যালয়গুলির ওপরেও। তালিবানরা ক্ষমতায় এসেই বন্ধ করে দেয় আফগানিস্তানের সমস্ত বালিকা বিদ্যালয়। বন্ধ হয় নারীশিক্ষার সমস্ত দরজা। তাদের ভবিষ্যৎ ঢাকা পড়ে যায় কালো বোরখার অন্ধকারে। তালিবানরা শুধুমাত্র কাবুল মেডিকেল ফ্যাকাল্টি তখনও চালু রেখেছিল। কিন্তু এই চালু রাখার কারণ কোথাও তাদের মধ্যে উদারতার বহিঃপ্রকাশ নয়।বরং তাদের গোঁড়া মানসিক তার ফসল। এই মেডিকেল ফ্যাকাল্টি চালু রাখার মাধ্যমে তারা চেয়েছিলেন আফগান মহিলাদের মহিলা চিকিৎসক ও নার্সের দ্বারা চিকিৎসা করাতে। তালিবান শাসকদের আমলে আফগান মহিলাদের কোন পুরুষ চিকিৎসকের দ্বারা চিকিৎসা সম্ভব ছিল না।
ফলস্বরূপ সারা আফগানিস্তান জুড়ে মহিলাদের শুধুমাত্র ডাক্তারি এবং নার্সের পেশায় থাকার অনুমতি মিললেও বাকি সমস্ত পেশাতে মহিলাদের যোগদানের ওপর প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়।তালিবান শাসনকালে তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা প্রবর্তনের নামে প্রচুর মাদ্রাসা আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, এই মাদ্রাসাগুলিতে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অনেক বেশি গুরুত্ব পেত। যদিও তালিবানরা এই সময় তাদের শিক্ষানীতি প্রবর্তন করে তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানায় শিক্ষার অধিকার প্রত্যেক আফগান নাগরিকের সমান অধিকার। কিন্তু শিক্ষানীতির তৃতীয় অধ্যায়ে এই তালিবানরাই শরিয়া আইন উল্লেখ করে নিশ্চিত করে যে শরিয়া আইনানুসারে একটি বিশেষ আইনের দ্বারা আফগানিস্তানের নারীশিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হবে। কিন্তু তার পরেও কোন বিশেষ আইন নারীশিক্ষার প্রবর্তন এবং প্রসারে তালিবান শাসনকালে প্রয়োগ হয়নি। ১৯৯০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আফগানিস্তানের চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ইউনিসেফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক এনজিওরা আফগানিস্তানের বাইরে থাকা আফগান শিশুদের শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সময় আফগানিস্তানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেদের নথিভুক্তির হার ছিল মাত্র ৩৯ শতাংশ এবং মেয়েদের নথিভুক্তির হার মাত্র ৩ শতাংশ।
আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার আলো-আঁধারির ইতিহাসে তালিবানদের শাসনকালে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অব্ধি চরম অন্ধকারময় যুগ। তালিবানদের চরমপন্থি শাসনে সাধারণ মানুষের কাছে তখন দুবেলা খেতে পেয়ে জীবন নির্ধারণ দৈনন্দিন লড়াইয়ে দাঁড়িয়েছিল। বেঁচে থাকা তখন এক চরম অনিশ্চয়তা। সেখানে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার লড়াই অলীক কল্পনা মাত্র। কিন্তু এই অলীক কল্পনায় অন্ধকারের বুক চিরে আলোর পথ দেখে যখন ২০০১ সালে আমেরিকান সেনার সহযোগিতায় আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে বসলেন হামিদ কারজাই। হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে সরকার অনুভব করে সারাদেশে আধুনিক শিক্ষার প্রসার আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও উন্নতির একমাত্র রাস্তা। আমেরিকাসহ আরও অনেক প্রগতিশীল দেশ আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
শিক্ষাব্যবস্থা ও আফগানিস্তানের পুনর্গঠন কে লক্ষ্যমাত্রা করে ইউনিসেফের সহায়তায় আফগানিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় “ব্যাক টু স্কুল” পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় তারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলে। আফগানিস্তানে নতুন বর্ষ শুরু হয় মার্চের ২১ তারিখ। এবং সেই দিনই আফগানিস্তানের নতুন শিক্ষাবর্ষও শুরু হয়। হামিদ কারজাইয়ের শাসনকালে আফগানিস্তানের ৩২টির মধ্যে কুড়িটি প্রদেশে প্রায় তিন হাজারের বেশি স্কুল সক্রিয় হয় আধুনিক শিক্ষা প্রসারে।
২০০২ সালের “Paishraft” (Progress)এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী আফগানিস্তানে প্রায় সতেরো লক্ষ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত ছিল। এই সংখ্যা প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ষাট শতাংশ বেশি। পরবর্তীকালে ইউনিসেফও আফগান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় প্রকাশিত হয় যে প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের নথিভুক্তিকরণ নব্বই শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে নথিভুক্তিকরণ লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক বেশি হয়। লক্ষণীয় বিষয়, কিছুদিনের মধ্যেই আফগানিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত শিশুদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়েদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান এসে দাঁড়ায়। কান্দাহারের মত জায়গা যেখানে তালিবান শাসনকালে মেয়েদের বেঁচে থাকা এক অনিশ্চিত লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে সমগ্র জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মেয়েরা স্কুলে নথিভুক্তিকরণ করে।
উপরোক্ত সমীক্ষায় আরও প্রকাশিত হয় যে প্রায়ই কুড়িটি প্রদেশ ২৭০০০ শিক্ষক-শিক্ষিকা আধুনিক শিক্ষায় আফগানিস্তানের শিশুদের শিক্ষিত করার কাজে ব্রতী ছিলেন। আরও লক্ষণীয় এই ২৭০০০ শিক্ষক-শিক্ষিকার ৩৬ শতাংশ শিক্ষিকা। শুধু কাবুলকে যদি হিসেবের মধ্যে আনা যায় তাহলে দেখা যায় হামিদ কারজাই শাসনকালে শিক্ষিকার সংখ্যা শিক্ষকদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছিল।ইউনিসেফ এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন পাকিস্তান ও ইরানের মতো দেশগুলো থেকে শরণার্থীদের দেশে ফেরার ফলে বিদ্যালয়গুলিতে নথিভুক্তিকরণের সংখ্যা লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
কিন্তু এমন আলোকিত সময়ে সমগ্র আফগানিস্তান জুড়েই শিক্ষার যে ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল তা নয়। আফগানিস্তান আসলে বহু গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি ভিন্ন মতবাদের দেশ। একদিকে দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দীর্ঘকালীন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং অন্যদিকে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা আফগানিস্তানের প্রগতির পথে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে।বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে তখনও নারী শিক্ষা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত রক্ষণশীল মতামত ছিল।পুরুষতান্ত্রিক আফগান সমাজে সাধারণত: শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন শিশুদের পিতা। আশি শতাংশের বেশি আফগান মানুষ গ্রামে বাস করে। দারিদ্র্য এবং স্বল্প সামর্থ্যের সংসারে সকলকে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসার মত সামর্থ্য সেই সমস্ত পিতাদের ছিল না।
তার ফলস্বরূপ আফগানিস্তানের একটা বড় অংশে নারীশিক্ষা ব্রাত্যই থেকে যায়। পিতৃতান্ত্রিক আফগান সমাজে তারা তাদের পুত্রসন্তানদের শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। উপরন্তু বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বাড়ির সম্মানহানি হিসেবে দেখা হয় এখনও। তবে কিছু মানুষ ছিলেন বা আছেন যারা তাদের মেয়েদের শিক্ষিত করার কাজে খুব উৎসাহী এবং দৃপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অন্যান্য এনজিওর সহায়তায় আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি গত দুই দশকে লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন দেশ আফগানিস্তানের পরিকাঠামোগত উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষার উন্নতির ক্ষেত্রে যথাসাধ্য সাহায্য করেছে। ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম।
পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবে বিগত কুড়ি বছরেও আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে নি। শিক্ষাঙ্গনের অভাব এবং সর্বোপরি শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবে একই দিনে তিনটি আলাদা আলাদা স্লটে খুব স্বল্প সময়ের জন্য তিন ধরনের ক্লাসে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। তার ফলে শিশুরা আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজনীয় সময় বিদ্যালয় কাটাতে পারে না। বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামোগত ঘাটতি, যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষণ সহায়ক উপকরণের অভাবে বিগত বছরগুলিতে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে বড় সংখ্যক বিশেষভাবে সক্ষম শিশুর সৃষ্টি হয়। সেইসাথে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য পথশিশু। বিশেষভাবে সক্ষম ও পথ শিশুদের শিক্ষার আঙিনায় আনার মতো পরিকাঠামো বিগত কুড়ি বছরের আফগানিস্তানে পর্যাপ্ত পরিমাণ তৈরি হয়নি।
এত প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই করেও যখন আফগান শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিক সেই সময় ২০২০ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালিবানদের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমেরিকা এই শর্তে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয় যে তালিবানরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে না এবং শিক্ষার অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত করবে না। শুরু হয় আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার। আফগানিস্তান জুড়ে বাড়তে থাকে তালিবানদের প্রভাব। অবশেষে আমেরিকা সম্পূর্ণরূপে সেনা প্রত্যাহারের আগেই ১৫ ই আগস্ট ২০২১ তালিবানরা রাজধানী কাবুল ঘিরে ফেলে। দুপুরের মধ্যে তারা কাবুলের দখল নেয় এবং আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করেন। সাথে সাথে শুরু হয় আফগানিস্তানে তালিবান রাজের দ্বিতীয় অধ্যায়। আফগানিস্তানের তালিবান নিয়ন্ত্রিত নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯ আগস্ট ২০২১ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তান। ৭ ই সেপ্টেম্বর ২০২১, ৩৩ সদস্যের এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় তালিবান নিয়ন্ত্রিত নতুন আফগানিস্তানে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোল্লা মহম্মদ হাসান। অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রিত্বে আসীন হয়েছে ভয়ঙ্কর হাক্কানি গোষ্ঠীর নেতা এবং ঘোষিত “সন্ত্রাসবাদী” সিরাজুদ্দিন হাক্কানি।যদিও বিশ্বের কয়েকটি দেশ ছাড়া এই নতুন সরকারকে কেও মান্যতা দেয়নি। এবারে আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর শুরুর দিকে তালিবানরা বলতে শুরু করেন যে তারা এবারে অন্যরকমের শাসনব্যবস্থা চালাবে আধুনিক আফগানিস্তান গঠনের লক্ষ্যে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না। নারীর অধিকার ও শিক্ষার অধিকারও লঙ্ঘিত হবে না। কিন্তু সময় যত এগিয়ে চলছে তালিবানরা তাদের নব্বই এর দশকের অন্ধকারময় সময়কে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন শেখ মৌলবি নুরুল্লাহ মুনির। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে তাকে উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখা গেছে। তার নিজের ভাষায়, “আজকের আফগানিস্তানে কোন পিএইচডি বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনারা দেখছেন, যে মোল্লা এবং তালিবানরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের কোন পিএইচডিও নেই, এমএও নেই, এমনকি হাই স্কুল ডিগ্রিও নেই। কিন্তু তাঁরাই সবার সেরা।” নতুন শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য আফগান শিক্ষা ব্যবস্থায় এক চরম অশনি সংকেত।
মালালার অঞ্চল যখন ২০০৮ সালে তালিবানদের দখলে চলে যায়, স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয় মালালা ইউসুফজাই ও তাঁর মত অনেক মেয়েরা। শিক্ষার অধিকার নিয়ে তাঁর লড়াই থামিয়ে দেওয়ার জন্য ২০১২ সালে স্কুল বাসে উঠে তাঁকে খুঁজে তাঁর মাথার বা দিকে গুলি চালায়। তাঁর ইতিহাস আজ সাড়া পৃথিবীর কাছে পরিচিত। কিন্তু যে তালিবানরা নব্বই এর দশকের শেষে তাঁদের পাঁচ বছরের শাসনে আফগানিস্তানে এক অন্ধকার যুগের উদাহরণ রেখে গেছে, যে তালিবানরা ২০০৮-১২ এসময়েও নারীশিক্ষার চরম বিরোধিতা করে মালালার মাথায় গুলি চালিয়েছে, তাদের হাতে আগামীর আফগান শিক্ষাব্যবস্থা কতটা আলোকোজ্জ্বল থাকবে তা সময় বলবে। তবে প্রত্যাশার তুলনায় আশঙ্কা অনেক বেশি। প্রত্যাশার পরিমাণ প্রায় শূন্য। আতঙ্ক ও আশঙ্কা অসীম। সেই আতঙ্কে ও আশঙ্কায় হাজার হাজার মানুষকে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে যে কোন মূল্যে। কাজ হারিয়েছে বহু মানুষ। অভাব অনটনে জীবন নির্ধারণ আবারও এক লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো শিক্ষা এখানে সত্যিই বিলাসিতা হায়ে উঠবে! আশার কথা, এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে খুব কম সংখ্যক হলেও নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে পথে নেমেছে আফগান নারীরাও। মালালা বলেছেন, “আমার গল্প অনন্য বলেই আমি সবাইকে আমার গল্প বলি, তা নয়। আমি এই গল্প বলি কারণ এই গল্প আমার মত আরও অনেক মেয়ের”।
আলো-আঁধারির আফগান শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস আরও একবার আতঙ্কের অন্ধকারের সম্মুখীন হয়ত। অন্তত: ইতিহাস তাই বলে। বারবার আক্রান্ত হতে হতে আফগান শিক্ষা তাঁর পূর্ণ ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আফগান সমাজকে আলোকিত করতে কবে সক্ষম হবে, বা আদৌ হবে কিনা, তা সময়ই বলবে। আপাতত শুভেচ্ছা থাক অধিকারের জন্য লড়াইরত প্রগতিশীল আফগানদের জন্য।
তথ্যপঞ্জি:-
সৈয়দ মুজতবা আলীর “দেশে বিদেশে”
হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ এর “ইউ হ্যাভ নো রাইট্স টু কমপ্লেইন” শীর্ষক রিপোর্ট ২০২০
হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ এর “আই ওন্ত বি এ ডক্টর, অ্যান্ড ওয়ান ডে ইউ উইল বি সিক” শীর্ষক রিপোর্ট ২০১৭
Khwajamir. M. (2016). “History and Problems of Education in Afghanistan “. SHS Web Conferences. 26,01124, DOI: 10.1051/shsconf/20162601124
Sultani. T. (2017). “The Current Situation of Basic Education in Afghanistan”. Japan https://www.criced.tsukuba.ac.jp/pdf/04_Afghanistan_Sultani.pdf
Malala’s Story. Malala Fund. https://malala.org/malalas-story Retrieved on 15.09.2021
এছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্র, সামাজিক মাধ্যম, এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার খবর ব্যাবহার করা হয়েছে।
[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষক শিক্ষণ বিভাগ, দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টিচার্স ট্রেনিং, এডুকেশন প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story
Dr. Saha has skillfully sketched a long historical periods with its twist & turns of education in Aphgan context. The article is informative enough. But the readers are hungry to have more indepth analysis from socio political angle. Hope Dr. Saha will try pen a second series with more analytical input.