লাভ রিঅ্যাক্টস অনলি : প্রত্যয় চৌধুরী
আমরা প্রত্যেকে এক একটা অ্যান্ড্রয়েড হয়ে গিয়েছি। এই ব্যাপারটা যবে অনুভব করলাম তখন অনেকখানি দেরী হয়ে গিয়েছে। তার অনেক আগে আমার মা আমার ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলেছেন। ভবিষ্যদ্বাণীতে কোনওদিনই আমার বিশ্বাস ছিল না। সেও এক সময়ের কথা যা এখন অতীত। এখন যেকোনও অবিশ্বাসেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমার মতো বাকি যারা আছে/ছিল, তাদের হারিয়ে ফেলেছি প্রায় অনেকদিনই হল। মাঝে মাঝে দু’একজনের সাথে দেখা হলে দূর থেকেই কথা হয়। সেই এক প্রশ্ন- “কেমন আছি? এখন কী করছি?” আর তার গতে বাঁধা উত্তর- “ঐ চলছে…”
যে জিজ্ঞেস করে তার পরিশ্রমে অনীহা আর যে উত্তর দেয়, তার প্রশ্ন করার ক্ষমতা অনেকদিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে। ফলত সে উত্তরেই বুঝিয়ে দেয় যে সে কতটা ক্লান্ত।
আমার ঝাপসা স্মৃতি বলে ১৯৯৭-২০০৫/০৬ পর্যন্তও ঋতুচক্রের ঋতু পর্যায় খুব স্পষ্ট ছিল। মানে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, শরত, বসন্ত উপভোগ করা যেত। আবছা আবছা এখনও মনে আছে পাড়ার মাঠে কালবৈশাখী এসেছিল গোল কালো জটলা পাকিয়ে, টিভিতে ইন্ডিয়ান আইডল শুরু হলে সবাই যেমন ডাগড় ডাগড় চোখে তাকিয়ে থাকত, আমরা ব্যাট বল ফেলে হাঁ করে থ্রিডি মোশন পিকচারের কালাজাদু গিলছিলাম। ব্যাস ওইটুকুই। আজও বারে বারে এই পোর্শানটুকুই ঘুরে ফিরে মাথায় আসে, আর ওই ঠান্ডা ভাবটা ক্ষণিকের জন্য অনুভূত হয়েই ফুরিয়ে যায়।
পালিয়ে যাওয়া থেকে মাথায় এল আমরা যারা অ্যান্ড্রয়েড জীবন কাটাচ্ছি তারা কি সত্যি সবকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি, নাকি পালিয়ে যাওয়া একটা কনসেপ্ট যা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের কাছে গ্র্যাঞ্জিয়রলি আরবানাইজ করা হয়েছে। (যন্তর মন্তর ঘরটা আসলে কোথায়?) The idea of a concept that does not exist in real that is dangerous. In the contrary the idea of realism is itself a concept. মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা প্রত্যেকে এক একটা কনসেপ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু না। আমাদের প্রাণ নেই, সত্তা নেই, অনুভূতি নেই, আবেগ নেই, রাগ নেই, ব্যথা নেই, কষ্ট নেই। বাট উই আর অ্যামালগ্যামেশান অফ আ কনসেপ্ট অনলি। মে বি কনসেপ্ট অফ নাথিংনেস। আ ভয়েড অর আ ডেপ্লোরেবল নাম্বনেস।
১৯৯৭-২০০৫/০৬ তখন সূর্যের আলো খুব অদ্ভুত ভাবে বারান্দায় এসে পড়ত। যাদের বাড়ি বারান্দা ছিল না, তারা আলো ছায়া দিয়ে একটা কাল্পনিক বারান্দা বানিয়ে নিতেন আর সেই বারান্দায় আরামকেদারা পেতে সুখ-দুঃখের লাগামছাড়া প্যারাগ্রাফ লেখা হতো। তীর্যক ভাবে এসে পড়া রোদের তাপ বেশি ছিল না কিন্তু অদ্ভুত মিঠেপনা ছিল, যাতে ঘাম শুকিয়ে, পোকেমন দেখা ছেড়ে, উইকেট-ব্যাট কাঁধে নিয়ে খেলতে ছুটতাম আমরা। ড্রেনে পড়া বল হাতের তালুতে আতিথেয়তার সাথে এমনভাবে মাখতাম, মনে হতো আমারাই আসল মাঠের মানুষ। তারপর বড় হয়েছি, থুরি বড় হতে হয়েছে, পাশ করে যেতে হয়েছে একে একে সব পরীক্ষা। আর সেই মাঠ নেই, ড্রেনে বল পড়লেও তোলার উপায় নেই। যবে থেকে অ্যান্ড্রয়েড এসেছে তবে থেকে দেখলাম মাঠ ঘাট নালা সব উঠে গিয়ে অ্যাপস-এ বদল হয়ে গেল। লে হালুয়া! ডিপ শিট ক্লিন করার জন্য দুবার থেকে তিনবার নির্দিষ্ট জায়গায় ট্যাপ করলেই হয়। এককালে কত নোংরা মেখে বেরিয়েছি কিন্তু কোনও শুচিবায়িতা ছিল না। আজকাল সব কিছুতেই অলস লাগে,ভারী ভারী লাগে। মনে হয় ‘ক্লিন ইয়োর ওন শিট’ বলে একটা অপশান থাকলে ভাল হতো।
এরপর আরেকটু বেড়ে উঠলাম; সন্দেহবাতিকতা নিরাভরণ গয়না হয়ে উঠল মনের। দেখলাম আশেপাশে যা ঘটছে, যা হচ্ছে তার কোন কিছুই আর মূলধারাতে নেই। বিকল্প পথটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। সবাই অসাধারণ, সবাই গুণী। যশোদার অষ্টম গর্ভের সন্তান সবাই। প্রডিজি। এত কবি, এত লেখক, এত পরিচালক, এত ফটোগ্রাফার, এত পেইন্টার, এত শিল্পী, এত বিপ্লবী যে দুদন্ড বসে চাল-ডাল-বেগুন টমাটো নিয়ে কথা বলব সেই সুযোগ হয় না কারও সাথে। অসাধারণ মানুষের এত ভিড়ে নিজেকে তাই কচুরীপানা মনে হয়। কচুরীপানা বলতে মনে পড়ে গেল গাছেদের প্রতি প্রেম নিবেদনের কথা। জীবনটা অ্যান্ড্রয়েড না হলে জানতেই পারতাম না এত মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী, গাছপ্রেমী। উদ্ভিদ জগতের ধারক, বাহক, পিতামহ হয়ে উঠতে চান কত কত মানুষ। অনেকেই রয়েছেন যারা বাড়ির পাশের নর্দমার শ্যাওলার খোঁজ পর্যন্ত রাখেন না, তারাও আজ গাছেদের ফটোজেনিক প্রেমে পড়েছেন। ফটোজেনিকই তো বটে। আমাদের ফিল্টার আমাদের ঐতিহ্য। চিরকাল নিভৃতে নীরবে থাকা গাছেদের বাসস্থান তাই প্রকৃতির মাটিতে নয়, ৫/৬ সেমির স্ক্রিণে স্থান পেয়েছে আজকাল।
আরেকটা অনুভূতি মাঝে মাঝেই কলিং বেল বাজায়। অদ্ভুত একটা টান(আকর্ষণ), কিন্তু কোন টান নেই। আবার আছেও। এ এক অদ্ভুত দ্বিচারিক অনুভূতি। চোখের সামনে যতক্ষণ দেখতে পাচ্ছি ততক্ষণ ভালবাসা জাগছে, প্রেম পাচ্ছে, সম্পর্কের আলতো সুতো টের পাচ্ছি, আর বাকি সময়টা নিজেদের স্লিপ মোডে রেখে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করছি। আদৌ ঘুমাই কিনা জানি না, হয়ত ঘুমানোর স্বপ্ন দেখি। আমার মতো আরও কয়েকজনের সাথে মাঝে মধ্যে আমার রাস্তাঘাটে দেখা হয় কখনও সখনও তাদের চোখ দেখলে বোঝা যায়, অ্যারিজোনা তে আছড়ে পড়া সর্ববৃহৎ উল্কার গর্তের মতো তাদের চোখের তলার অবস্থা। জার্মান এক্সপ্রেশানিস্ট পেইন্টিং-এ যে সমস্ত চরিত্র দেখা যায়, তাদের মুখ এর পরিমিত উদাহরণ। এই সব দেখতে দেখতে মাঝে মধ্যে মনে হয় সত্যি তো সবাই কি সুন্দর মিশে যাচ্ছি একে অপরের সাথে, পছন্দের অপছন্দের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনায়; যেখানে গাছ আছে, প্রাণী আছে, দুগ্ধপোষ্য শিশুর কসরত আছে, আছে নগ্নতা, চাপা যৌনতা। কিন্তু এই মিশে যাওয়ার কোন দৃঢ় শিকড় নেই। কোন নাড়ি নেই। এসবই শুধু আড়ম্বরপূর্ণ, মজবুত নয়। মিশে যেতে যেতে কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি পাশের জনের সাথে, শব্দ ব্যবহার করতে ভুলে যাচ্ছি। জিজ্ঞেস করছি না “দাদা কটা বাজে?” সম্পর্ক নেই এরকম অচেনা মানুষের দরজায় গিয়ে লাভ রিয়াক্ট করে চলে আসছি, আর নিজের বাড়িতে ঢুকে দেখছি জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অকারণ বোঝা মনে করে সেসব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি, চলে যাচ্ছি নিজস্ব স্পেসে… আরও ছোটো স্পেসে, যেখান থেকে নির্বিঘ্নে টিকটক করা যাবে মসৃণ সারফেসে। একটা মাছির হাইও নজর দিতে পারবে না। চলে যাচ্ছি বোকাবাক্সের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় যা গতানুগতিক কিন্তু অফুরন্ত। সেখানে পৌঁছেও কেউ কাউকে যখন জিজ্ঞেস করি কেমন আছ, কী করছ; উত্তর আসে – এই চলছে। এই চলা কেউ থামাতে পারেনি। কেউ থামাতে চায় বলেও মনে হয় না।
মেঠো পথ, বন, জংলা জমি, সাজানো বাগান, পাহাড়, মরুভূমি কতকাল ঘুরিনি মনে করলে শুয়ে শুয়েই আবার একটু ট্যাপ করে নিই। অদ্ভুত এক মায়াবী অলসতায় আমাদের হাত পা বাঁধা রয়েছে। কিন্তু এই পরাধীনতার বাঁধন এত ভালবেসে ফেলেছি যে প্রত্যেকটা দাগ, প্রত্যেকটা কালশিটে, প্রত্যেকটা রক্তজমাটে নেশা লেগে আছে। গতানুগতিকতার চোঁয়া ঢেকুর তুলেও মুখ গুঁজে ফেলছি গোরিলা গ্লাসের আলোতে। আমাদের নাক গেছে, কান গেছে, অন্ধ তো সেই কবে থেকেই ছিলাম। এত জাঁকজমকপূর্ণ দুরাবস্থা দেখলে মনে হয়, ভুল করে খবর নেওয়ার জন্য বাইরের গ্রহ থেকে এলিয়েন এলেও তাদের হাত না দেখিয়ে শীতঘুম দেব।
আমরা প্রত্যেকে এক একটা অ্যান্ড্রয়েড হয়ে গিয়েছি, এই ব্যাপারটা অনুভব করে যবে লেখা শুরু করব ভাবলাম ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবীরা নিজস্ব সংযম বলয় থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকারা অন্য কারও হাত ধরে খুঁজতে গিয়েছে চিরপরিচিত অমলিন সুখ। মফঃস্বলে ভোট শুরু হয়ে গিয়েছে। দুগ্ধপোষ্য শিশুর কাঁচাঘুম ভাঙার ভিডিও আপলোড হয়ে গিয়েছে। চলে এসেছে পরবর্তী ও.এস ভারসান আপগ্রেডের নোটিফিকেশন। এখন আর কেউ ভবিষ্যদ্ববাণীও করে না, ব্ল্যাকহোলের ছবি দেখিয়ে বলে দেয় পরের জন্মে এলিয়েন হবে না অ্যান্ড্রয়েড।
Posted in: PROSE, September 2021