আফগানে সাবধানে : বিশ্ব-রাজনীতির নতুন আঙ্গিক – ড. প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়

ভূমিকা:

বিশ্ব রাজনীতি সুদীর্ঘকাল ধরে আবর্তিত হয়েছে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির ইচ্ছে অনিচ্ছার অঙ্গুলিহেলনে|দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গণতান্ত্রিকতার সাথে উপহার দিয়েছে কর্তৃত্ববাদী সুরক্ষা পরিষদ যেখানে চিরস্থায়ী পাঁচটি শক্তিধর রাষ্ট্র (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, সোভিয়েত রাশিয়া, ফ্রান্স) তাদের ভিটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের যে কোনো সিদ্ধান্তর ওপর স্থগিতাদেশ দিতে পারে| একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ৯/১১ সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রথম আঘাত হানে এই স্তরবিন্যস্ত আধিপত্য কায়েমি বিশ্ব-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর| সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘরে হামলা করার উদ্দেশে বেছে নেওয়া হয় আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলকে| আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা যাকে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে ‘আফ-পাক’ অঞ্চল বলে অভিহিত করেছিলো| সন্ত্রাসবাদীদের সামলাতে গিয়ে আফগানিস্তানে তালিবান জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হয় কারণ এই জনগোষ্ঠী মূলত সন্ত্রাসবাদীদের ‘যোগানদার’ ও ‘প্রশিক্ষক’ হিসেবে কাজ করে| দীর্ঘ দু-দশক(২০০১-২০২১) আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করে আমেরিকা এই তালিবানদের ঠেকিয়ে রেখেছিল ক্ষমতার অলিন্দ থেকে| কিন্তু জুলাই ২০২১ থেকে আমেরিকার সেনা সরানোর তোড়জোড় শুরু করতেই তালিবানরা নড়েচড়ে বসে এবং খুব মসৃণভাবে আফগানিস্তানের স্থিত সরকারকে সরিয়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৫ই আগস্ট ২০২১এ সম্পূর্ণভাবে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার মসনদে বসে| পৃথিবীর সর্বশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তালিবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রয়াস তো দূর-অস্ত, তাদেরকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেছে বা শর্তসাপেক্ষে মান্যতা দিয়েছে|তালিবানরা দেখিয়ে দিলো কি ভাবে হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসতে হয়, কি ভাবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে বশে আনতে হয়| তাই বলা যেতে পারে যে ২০২১-এর আফগানিস্তানের ঘটনাবলী বিশ্ব রাজনীতির এক নতুন আঙ্গিকের দিশা দিচ্ছে যেখানে ছোট বা কম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এমনকি সেই রাষ্ট্রের এক বিশেষ জনগোষ্ঠী বিশ্ব রাজনীতির স্তরবিন্যস্ত আধিপত্য কায়েমি ব্যবস্থাকে নতজানু করতে পারে|এই নিবন্ধ আলোচনা করবে বিশ্ব রাজনীতির এই নতুন আঙ্গিক যেখানে বিশ্বের তাবড় ক্ষমতাশালী জাতি-রাষ্ট্রগুলিকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কম গুরুত্বপূর্ণ জাতি-রাষ্ট্র বা একটি জাতি-রাষ্ট্রের বিশেষ জন-গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে|

এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস:

২০২১ সালে চর্চিত চর্বণের মতন শোনালেও মনে রাখা দরকার যে বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষকেরা একবিংশ শতাব্দীকে এশিয়ার শতাব্দী বলে অভিহিত করেছিলো|১৯৮৫ সালে চিনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি দেং জিয়াও পিং এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সর্বপ্রথম ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সাথে আলাপ আলোচনার সময়ে| পরবর্তীতে এই দাবি বিশ্ব-রাজনৈতিক মহল মেনে নেয় দুটি কারণে – একদিকে এশিয়ার জনসংখ্যার বিশাল বৃদ্ধি ও তৎসহ অর্থনৈতিক বাজারের ব্যাপ্তির ইঙ্গিত আর অন্যদিকে ভারত ও চিনের বিশ্ব রাজনৈতিক মহলে জোরালো উপস্থিতির প্রমাণের ওপর| কিন্তু বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিশ্ব-রাজনীতির ক্ষেত্র হিসাবে – একদিকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে তৈরি হওয়া চতুর্দেশীয় অক্ষ বা কোয়াড এবং দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের সার্বভৌম উপস্থিতির জোরালো প্রয়াস আর অন্যদিকে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় চলছে আফগানিস্তানকে ঘিরে চুপিসারে আরেক ধরনের চতুর্দেশীয় অক্ষ গড়ে তোলার প্রয়াস যেখানে রয়েছে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান| দক্ষিণ এশিয়ার সাথে বিস্তীর্ণ মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক যোগাযোগের দ্বার হলো আফগানিস্তান| তাই আফগানিস্তানকে শান্ত, গণতান্ত্রিক এবং বহুত্ববাদের দর্শনে প্রভাবিত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করা হয়| কিন্তু এই ভাবনা যখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পোষণ করে এবং ভারত প্রশান্ত মহাসাগরের কোয়াড গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলো তাতে সমর্থন করে, ঠিক সেই সময়ে চিন তার সুবিশাল ভূ-অর্থনৈতিক বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বি.আর.আই) নিয়ে উপস্থিত সমগ্র এশিয়াকে চিনের নেতৃত্বে এক অর্থনৈতিক অঞ্চলে বেধে রাখতে| এই বি.আর.আই উদ্যোগের ফলে চিন আফগানিস্তানের এবং ইরানের অর্থনীতিতে নিজেদের জোরালো উপস্থিতি তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে| এই প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে বুঝতে হবে|আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যখন অগাস্ট ২০২১ আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর সময়সীমা বলে ঘোষণা করে এবং তালিবানের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে ফেব্রুয়ারি ২০২১এ তখন থেকেই চিন তৎপর হয়ে ওঠে আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে চিনের প্রভাব বিস্তার করতে| এই ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে চিন পাশে পেয়ে যায় পাকিস্তান ও রাশিয়া|আমেরিকা অধিক চিন হলো পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্র এবং চিনের উপস্থিতি আফগানিস্তানে জোরালো হলে ভারতের বিরুদ্ধে আফগান জমি ব্যবহার পাকিস্তানের পক্ষে সহজ হবে| অন্যদিকে রাশিয়া চেয়েছিল মধ্য এশিয়ার বাইরে দক্ষিণ এশিয়াতেও পুরনো দিনের মতন নিজের প্রভাব রাখতে| কিন্তু ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময়ের মতন শক্তিশালী না থাকার ফলে রাশিয়াকে চিনও পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে হৃত জমি পুনরুদ্ধারের জন্য| তাই আফগানিস্তান নিয়ে রাশিয়া খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছে| এমনকি রাশিয়ার নেতৃত্বে ২০২১ সালের জুলাই মাসেই বসে একটি বৈঠক যেখানে পাকিস্তান, চিন, রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবান ও তৎকালীন আফগান সরকারের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলো| এই বৈঠকের পরেই তালিবান ক্ষমতা দখলের অভিযানে নামে এবং সফলতা লাভ করে| বলাই বাহুল্য উল্লেখিত বৈঠকটি ছিলো চুপিসারে আফগানিস্তানে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বৈঠক| ঐ বৈঠকে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত না করার মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে বর্তমানে এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস দ্বিমুখী – একদিকে রাশিয়া-চিন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান অন্যদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়া|

তালিবান ক্ষমতায় আসার পরে:

আফগানিস্তানের বর্তমান ঘটনাক্রমে সবথেকে যারা অবাক করেছে তারা হলো তালিবান নিজেরাই|প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রের নেতারা ভেবেছিলো তালিবান মানেই আবার ধর্মান্ধতা স্বৈরচারী শাসন এবং জনসমক্ষে বিরোধীদের মেরে ফেলা যাকে টার্গেট কিলিং বলে| কিন্তু তালিবানরা এবারে অনেক প্রস্তুত আধুনিক ভাবে ক্ষমতা অর্জনের জন্য| তারা আলোচনায় বসছে ক্ষমতাশালী জাতিরাষ্ট্রের সাথে , তারা তৈরি করছে পরিচালন পর্ষদ বিদ্রোহী এবং বিরোধীদের নিয়েই, যাতে করে সাধারণ আফগান জনতা মনে না করে যে তালিবান তাদের ওপর নিজেদের শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে| তালিবান খুবই উদগ্রীব অন্তত বহিরঙ্গে তাদের বদলটা সর্বসমক্ষে আনতে| সেই জন্য তারা ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই সমস্ত আঞ্চলিক এবং বিশ্বজনীন দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক স্তরে সুসম্পর্ক রাখার কথা বলে চলেছে| এহেন তালিবান ক্ষমতায় আসীন হলো বিশ্বজনীন চিহ্নিত সন্ত্রাসবাদীদের সরকারী পদে রেখে| এবং এখান থেকেই চিন এবং রাশিয়ার মতন বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলিও থমকে গেলো তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে| পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং তাজাখিস্তান সর্বগরে স্বীকৃতি দিল তালিবান সরকারকে| রাশিয়ার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি এবং চিন শর্তসাপেক্ষে তালিবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছে| এই শর্তটি আসলে সমস্ত দেশ চাইছে – সন্ত্রাসবাদকে মদত না দেওয়া| এবং এখানেই চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ভারত, ইউরোপীয় দেশগুলির স্বার্থ মিলে যাচ্ছে| পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলো এই ধরনের মন্তব্য করেও যখন আফগান শরণার্থীরা পাকিস্তানে যেতে চাইছে তখন আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার| আসলে পাকিস্তান চাইছে যাতে আফগানরা তালিবান শাসিত আফগানিস্তানেই থাকে| এমতাবস্থায় তালিবান গোষ্ঠী কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রিত আচরণে| তালিবান শাসন যে শরিয়ত আইনের ভিত্তিতে হবে সেটা সবারই জানা কিন্তু সেই শাসনে মানবাধিকার লুণ্ঠিত হবে না, টার্গেট কিলিং হবে না, বোমারাজ চলবে না, এগুলো জানা ছিলো না| এই নতুন তালিবান সরকার সেগুলো জানাচ্ছে| এই নতুন তালিবান সরকার প্রত্যেক রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে| এরা কাবুল বিমানবন্দরে বিস্ফোরণের দায় নেয় না| সেই দায় নিয়ে এগিয়ে আসে নতুন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আই.এস (ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসান)| এই আই.এস গোষ্ঠী যেন পুরনো দিনের তালিবান যারা ধর্মান্ধতার সাথে হিংসাকে মিশিয়ে সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে সিদ্ধহস্ত| আজকের তালিবানদের অন্তরে যাই থাক বহিরঙ্গে কিন্তু তারা একেবারেই নতুনভাবে আধুনিক সাজে এবং আধুনিক ক্ষমতা ও আধুনিক কূটনীতির ভাষা ব্যবহার করতে শিখে গেছে যারা সরাসরি ‘না’ বলে না, কিন্তু ক্রমশ কাউকে শিখণ্ডী রেখে কাজটা করেই ফেলে| যেমন আগামী দিনে এই আই.এস গোষ্ঠীকেই প্রকারান্তরে মদত দিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাবে তালিবানরা কিন্তু কখনই নিজেদের নামকে সামনে আসতে দেবে না| তাই তালিবানরা এহেন নব রূপে ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এবং ভূ-অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসতে চলেছে সেটা অনেকেই বলেন কিন্তু শক্তিধর জাতিরাষ্ট্রগুলোর ব্যবহারিক পরিবর্তন আসন্ন আফগানিস্তানের পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটে কিনা এবং সেটাই আলোচনার মূল বিষয় হওয়া উচিত|

বদলালো তালিবান, বদলাবে কি বিশ্বের রাজনৈতিক আচার-আচরণ?

বিশ্ব রাজনীতির আচার আচরণ নির্ভর করে বিশ্ব রাজনীতির কাঠামোর ক্রীড়কদের ব্যবহার দ্বারা অর্থাৎ জাতি-রাষ্ট্র বা অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মসূচি এবং নীতি বদলের মাধ্যমে| আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল তালিবানদের দ্বারা হয়েছে এবং তালিবানরা কিছুটা হলেও তাদের আচার আচরণ মধ্যযুগীয় থেকে আধুনিক যুগীয় করে তুলেছে| কিন্তু বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি কি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে? এখনো অবধি অভিজ্ঞতায় বোঝা যায় যে তারা বদলায়নি| আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ দু দশকের সময়কালে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন স্বপক্ষে বলেছিল তারা সে দেশে জাতি-রাষ্ট্র গঠন, সরকারকে দৃঢ়চেতা করা এবং আফগান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে| কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যখন বুঝল যে আফগানিস্তানের সময় ব্যয় করার ফলে ভারত প্রশান্ত মহাসাগর ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে চিন তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে এবং সমগ্র এশিয়া জুড়ে অর্থনৈতিক জালের বিস্তার ঘটাচ্ছে তখনি সে চিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আফগানিস্তান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে কোয়াড গোষ্ঠীর মাধ্যমে নিজের উপস্থিত জাহির করতে ব্যস্ত হে উঠলো|আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সেনা চলে যাওয়ার পর তালিবানরা দেখল যে ফেলে যাওয়া অস্ত্র বা যুদ্ধবিমানগুলি অকেজো এবং পুরনো| তাই বোঝায় যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় অবধি আফগান মাটিতে ছিলো যতক্ষণ তারা তালিবানের অল্টার ইগো বা ছায়া না দেখতে পেলো (আই.এস)| অর্থাৎ তাদের প্রাথমিক জাতীয় স্বার্থ সংক্রান্ত লক্ষ্য ছিলো তালিবান যেন সন্ত্রাসবাদী হামলায় তাদের আর বিদ্ধ না করে| আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তালিবানদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়ত সেই দিকের একটি দেনাপাওনা – একদিকে তালিবানদের আশ্বাস সন্ত্রাসবাদী হামলায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে বিদ্ধ না করা অন্যদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস তালিবান সরকারকে বিব্রত না করার| তাই তো আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি বিডেনের আমলে আফগান পরিস্থিতি থেকে প্রায় হাত ধুয়ে নিলো কারণ জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করার আশ্বাস পাওয়া হয়ে গেছে! অন্যদিকে চিন বিগত দু দশকে আফগানিস্তানে বিশেষ কিছু করতে পারেনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির ফলে| তাই চিন আফগানিস্তান পেরিয়ে ইরানে বন্দর তৈরিতে উদ্যোগী হয় এবং বি.আর.আই কর্মসূচি বা অর্থনৈতিক সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করে সমগ্র এশিয়া জুড়ে| কিন্তু যখনি চিন প্রত্যক্ষ করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে উপস্থিতি(২০২১এর মার্চে কোয়াড গোষ্ঠীর আন্তর্জালিক সম্মেলন হয় রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে) তখনি পাকিস্তানের সাহায্যে তলায় তলায় তালিবানদের উৎসাহ প্রদান করে অস্ত্র ও অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অভ্যুত্থানের জন্য| সেই মতো ক্রমপর্যায়ে ঘটনা এগোয়| অন্যদিকে রাশিয়া যখন ১৯৭০এর দশকে আফগানে আক্রমণ করে তখন তাদের যে বিরোধী পক্ষকে(মুজাহিদিন) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করেছিলো আজ তারাই তালিবান|কালের পাকপ্রণালীতে আজ রাশিয়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা দিতে সেই তালিবানদের ওপরেই ভরসা করছে| ফলে বোঝা যাচ্ছে চিনও রাশিয়া তাদের মতাদর্শগত, ভূ-রাজনৈতিক এবং জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এবং তালিবানদের সপক্ষে দাঁড়িয়েছে| পাকিস্তান এই সমগ্র ক্ষমতার ক্রীড়ায় সবথেকে কম প্রভাব খাটিয়ে সবথেকে বেশি লাভবান হয়েছে কারণ এই তালিবান নেতৃত্ব অধিকাংশ পাকিস্তান থেকেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষিত| তালিবান ক্ষমতায় আসা মানে পাকিস্তানের বন্ধু শক্তি প্রতিবেশী আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসা যাদের সময়ে সময়ে পাকিস্তানের পরম শত্রু ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে| তালিবান সরকার ঘটনার আগেই তালিবানরা কাশ্মীর প্রদেশকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতে রাজি নয় বলে জানিয়েছে| তাই বোঝা যাচ্ছে বিনা শ্রমে পাকিস্তান তার জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করার জায়গায় এসে গেছে আফগানে রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে|বিশ্বের জনমতের ভিত্তিতে আশা করা গেছিলো তালিবানি অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করতে বিশ্বের সব দেশ একজোট হবে কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো| তাই বলা যেতে পারে যে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের দোরগোড়াতে দাড়িয়েও জাতীয় স্বার্থই বড় হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক স্বার্থর থেকে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির আচরণে|

আফগানে তালিবান তাই দক্ষিণ এশিয়ার নাকি শিরে সংক্রান্তি?

অন্তর্জাল, পত্রপত্রিকা, বিশেষজ্ঞদের মতামত, সবজায়গায় এক সুর, আফগানে তালিবান আবার এলো দুনিয়ার শান্তি এবং সর্বোপরি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি, ভূ-অর্থনীতি এবং শান্তি সমস্তই বিনষ্ট হওয়ার মুখে| তালিবান সহযোগে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রে নাকি তৈরি হবে জিহাদি গোষ্ঠী এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে চেয়ে যাবে দক্ষিণ এশিয়া! বিনীত নিবেদন হলো বিগত দু দশক তালিবানরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল উপস্থিতিতে গুটিয়ে ছিলো দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও ভূ-রাজনৈতিক স্বকীয়তা কি বজায় থেকেছিল? না| তার কারণ দক্ষিণ এশিয়ার জাতি-রাষ্ট্রগুলিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এতটাই সমূলে দৃঢ় প্রথিত যে ধর্মান্ধতা এবং হিংসা রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে ঢুকে গেছে তা সে মালদিভ হোক বা শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ হোক বা পাকিস্তান|গণতন্ত্রের মোড়কে থাকলেও ভারতেও সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা অবিরাম চলেছে| তালিবান মানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন? তাহলে এতদিন চিনের অভ্যন্তরে কি হলো বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড মারা গেলো কেন আর ভারতে খাপ পঞ্চায়েত কি করলো? আবার বাংলাদেশের চাকমা বা মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে কি হলো? আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন সব দেশেই চলছে| কিন্তু তালিবানদের অতীত অভিজ্ঞতা যেহেতু জনসমক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘন সেরকমটা আর কোথাও দেখা যায় না এই যা পার্থক্য| আবার মহিলাদের শরিয়ত আইনের আওতায় এনে তাদের স্বাধীন জীবনযাপনে ব্যাঘাত নিয়ে যারা ভাবছেন তারা আগামী দিনে ভারতে বর্তমান শাসকগণের মহিলা সংক্রান্ত ভাবনার দিকেও নজর রাখবেন – হয়ত দেখলেন ভারতবর্ষে সব মেয়েদের উচ্চস্তরীয় পড়াশোনার একটি বিধি হলো বিবাহিত হওয়া| তালিবান সত্যি খারাপ, ধর্মান্ধ, মধ্য যুগিয় বিচার সম্পন্ন কিন্তু যখন তাকে প্রতিহত করতে কেউ একজোট হচ্ছে না তখন তাকে অস্বীকার করা বা স্বীকার করার মধ্যে কিছু এসে যায় কি? তালিবান থাকবে আফগানিস্তানে আর দক্ষিণ এশিয়া থাকবে দক্ষিণ এশিয়াতেই!

অত:কিম?

আফগানিস্তানে তালিবান শাসন শুরু হওয়ার মধ্যে দিয়ে কিছু কি আশার আলো আছে? এই নিবন্ধ মনে করে আছে আর তা হলো কমিটমেন্ট বা সহযোগী হওয়ার উপায়| মানবাধিকার রক্ষার বিধি, আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন মেনে চলা, সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতা, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা, অর্থনৈতিক কূটনীতি – এই পাঁচটি ক্ষেত্রে তালিবানকে চাপে রাখার জন্য এবং তালিবানকে স্বীকার করার ক্ষেত্রে তালিবানের থেকে মুচলেকা আদায় করার লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র এবং বিশেষ করে পাকিস্তান সহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র যদি একজোট হয় তবেই নতুন দিশা দেখবে বিশ্ব রাজনীতি| নয়তো বিভিন্ন মঞ্চে আফগানের তালিবান সরকারকে যতো উপেক্ষিত করা হবে(সম্প্রতি ভারত সাংহাই জোটবদ্ধ সংগঠনে বলেছে অনির্বাচিত এবং মহিলা প্রতিনিধিহীন তালিবান সরকারকে মান্যতা দেওয়া উচিত নয় আবার সার্ক এর বৈঠকে পাকিস্তানের প্রস্তাব মতন আফগানিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তালিবানকে মেনে না নেওয়ায় সার্ক এর বৈঠকও ভেস্তে গেছে)ততই তালিবান থেকে যাবে লোকচক্ষুর আড়ালে এবং নিজেদের খেয়ালখুশি মতো দেশ চালাতে শুরু করবে এবং আন্তর্জাতিক পরিসর ব্যবহার করবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য| তাই বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিকে এবং ভারতকে(বর্তমানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি)সাবধানে পদক্ষেপ নিতে হবে| হয় সাদ্দামহীন ইরাক করার মতন তালিবানহীন আফগানিস্তান করতে একজোটে উদ্যত হোক নইলে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে আলোচনার মধ্যে নেওয়া হোক সমস্ত মঞ্চে| ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের জাতীয় স্বার্থভিত্তিক কূটনীতি অন্তত তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুল কূটনীতি| এই বোধ যত সহজে উপলব্ধ হয় ততই বিশ্ব ভূ-রাজনীতির মঙ্গল| তাই আফগানে সাবধানে|

[লেখক – কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।]

Facebook Comments

Leave a Reply