জনতার প্রতিরোধের মধ্যেই আফগানিস্তানে চলছে তালিবান জমানা : নিত্যানন্দ ঘোষ
আফগানিস্তানে চলছে তালিবান জমানা। এই অবস্থায় আফগানদের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন। তালিবানরা আফগানিস্তান দখল নেওয়ায় সে দেশের নাগরিক অধিকারও সবচেয়ে বিপর্যস্ত । দুই দশকেরও বেশি যুদ্ধে নারীদের দুর্ভোগ অতলস্পর্শী। মার্কিন সেনাদের সঙ্গে তালিবানদের যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিনরাই।যুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষতি স্বীকার করে বাইডেন প্রশাসন সে দেশ থেকে মার্কিন সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পথে । বিশেষজ্ঞদের অনুমান তালিবানদের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের লিখিত বা অলিখিত চুক্তি হয়েছে গত বছর দোহাতে। সেই চুক্তি মোতাবেক কেউ কারও সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে না। দেখাও যাচ্ছে তাই। বিমানবন্দর গুলিতে মার্কিন সেনারা মোতায়েন আছে এবং তাদের উপর কোনও হামলা তালিবানরা এ মুহূর্তে করছে না। আফগান প্রশ্নে ভারতীয় শাসকদের নীরবতাও চোখে পড়ার মতো । একদা দেশের বিদেশ সচিব গেরুয়া জমানায় কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রীত্বে পদোন্নীত জয়শঙ্কর আফগান প্রশ্নে কেন্দ্রের বিদেশ নীতি নিয়ে “স্পিকটি নট’। যে নরেন্দ্র মোদী ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিদেশ সফরে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তুলেছেন করোনার ভয়ে হোক বা অন্য কারণে তিনি এখন বিদেশ সফর স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু কূটনৈতিক বক্তব্য যিনি হামেশাই তাঁর বাণীর মাধ্যমে দেশবাসীকে বিতরণ করেন তিনিও অদ্ভুতভাবে নীরব! তা হলে কি এটি বুঝে নিতে হবে মোদীজীর মার্কিন দোসর সে দেশ থেকে হাত তুলে নেওয়ায় তিনি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মার্কিন আক্রমণে ও আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে ভারত সে দেশে পুনর্গঠনের কাজে বিরাটভাবে বিনিয়োগ করেছে এবং এটি মার্কিন অপরাধে প্রলেপ দিতেই মার্কিনদেরই পরামর্শে করেছিল কিনা সেই নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন আছে।
ভারত পার্লামেন্ট ভবন, নদী বাঁধ সহ একগুচ্ছ প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। মার্কিনরা ভারতের গেরুয়া শাসকদের প্রলোভন দেখিয়েছিল তারা (ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী) সে দেশে বিনিয়োগ করলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। বৃদ্ধি পাবে আফগানদের মধ্যে ভারতের প্রতিপত্তি। মোদীর জমানা হয়ত ভেবেছিল যে আমেরিকা সে দেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে এবং তালিবানদের ধ্বংস করেই তারা দেশে ফিরবে। কিন্তু মার্কিন শক্তি ক্ষয় যে ক্রমশ তাদের কোণঠাসা করে দিয়েছে সেই বোধ বা উপলব্ধি তাদের (ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী) হয়নি। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর ভারতের পক্ষে সে দেশে থাকা সম্ভব হবে না। কার্যত হয়ওনি। যে সমস্ত ভারতীয় সেখানে আটকে আছেন তাদের ফেরানোটাই এখন জরুরি।সেই কাজ তারা করছেও। আমেরিকার উপর বিশ্বস্ত থাকার জন্য কড়া মাশুল দিতে হচ্ছে ভারতীয়দের।
মোদীজী “ভোকাল পর লোকাল”, আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার কথা বললেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে তিনি টিকি বেঁধে রেখেছেন সে কথা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে কি দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়? আমেরিকা যে দেশে দেশে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করার প্রধান হোতা সে কথা কি মোদীজী জানেন না? আফগানিস্তান ইস্যুতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দল তাদের দলগত অবস্থান স্পষ্ট করেছে।সিপিআই(এম) দলও তাদের কেন্দ্রীয় মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসির সম্পাদকীয়তে বলেছে আফগানিস্তানে তালিবানদের দখলদারি গভীরভাবে উদ্বেগের। মার্কিন আঁতাতে ক্ষতি ভারতের। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে ২০২০-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি দোহাতে তালিবান ও মার্কিনদের মধ্যে চুক্তি হয়।তারা (মার্কিনেরা) জেলে বন্দী তালিবানদের ছেড়ে দেবে এবং মার্কিনরাও সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু উভয়পক্ষের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেই কথাও বলা হয়। এছাড়া লিবারেশন বলেছে সে দেশের ভাগ্য সেখানকার মানুষই ঠিক করুন, নির্বাচনের মাধ্যমে।এবং এই নির্বাচন হোক রাষ্ট্রপুঞ্জের তদারকিতে তাও তারা বলেছে। নারীদের উপর যে দমন পীড়ন, অত্যাচার চালাচ্ছে তালিবানরা তা বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছে তারা। এই পরিস্থিতিতে সে দেশে আটকে পড়া নাগরিকদের দেশে ফেরানোর কথাও তারা বলেছে। পিপলস ডেমোক্রেসি বলেছে ভারতের সঙ্গে আফগান জনগণের ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের নিরিখে যাঁরা শরণার্থী হিসাবে এ দেশে আসবেন তাদের আসার সুযোগ করে দিতে হবে। আফগান পরিস্থিতি খুবই জটিল, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপুঞ্জকেই সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।
এই নিবন্ধের দ্বিতীয় অংশে আফগান মহিলাদের দুর্গতির চিত্রটা একটু তুলে ধরা যাক। কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা আফগান যুদ্ধে মহিলারা ভুগছেন সবচেয়ে বেশি।তাঁদের বিরুদ্ধে হিংসা এবং তাঁদেরকে দমিয়ে রাখার যে অপচেষ্টা তালিবান জমানায় হয়েছে বা হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে নাগরিক অধিকার চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।বর্তমানে তালিবান জমানায়ও আগের ১৯৯৬-২০০১ জমানার মতো নারীদের অবদমিত করে রাখা হয়েছে। তালিবানরা নিদান দিয়েছে নারীদের অবগুণ্ঠনের মধ্যেই দিন কাটাতে হবে। তাঁরা স্কুল কলেজে যেতে পারবেন না, বাড়ির বাইরে বেরতে পারবেন না, বোরখা পরেই থাকতে হবে।এসবের অন্যথা হলেই তাদের প্রকাশ্য রাজপথে চাবুক মারা হবে, শারীরিক নিগ্রহও করা হবে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে।
আফগান নারীদের প্রতি (তালিবানদের) এই সহিংস, পুরুষতান্ত্রিক ও মধ্যযুগীয় আচরণের নিন্দা জানানো উচিত সমগ্র বিশ্বের।তিন কোটি চল্লিশ লক্ষ আফগান জনসংখ্যার মধ্যে এক কোটি বিয়াল্লিশ লক্ষ নারীদের জনসংখ্যা। প্রায় একটা প্রজন্ম (নারী) যাঁরা উকিল, আইন প্রণয়নকারী, ডাক্তার, সেবিকা (নার্স), শিক্ষক ও প্রশাসক তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত।ঐতিহাসিকভাবেই আফগানিস্তানে নারীদের অধিকারে ১৯৬৪ সালের সংবিধান মোতাবেক ওঠা-পড়া আছে।ওই সময়কার সংবিধানই নারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ও অফিস চালানোর অধিকার নিশ্চিত করেছিল। আশ্চর্যের হল ব্রিটিশদের মতোই ১৯১৯ থেকে আফগান নারীদেরও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার থাকলেও ১৯৫০ থেকে লিঙ্গ বৈষম্য/পৃথকীকরণে তা অবলুপ্ত করা হয়।গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে তৈরি হওয়া নয়া সংবিধান নারীদের রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিল।সত্তর পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই সমস্ত অধিকারে ভাটা এলো।কমিউনিস্ট জমানায় আফগান সরকার ও সোভিয়েতের সমর্থনে নারীদের অধিকার ফিরে এলো।পরে ১৯৯০-এর দশকে তা পুনরায় কেড়ে নেওয়া হল। এবং তালিবান শাসন নারীদের অস্তিত্বের পক্ষে ভয়াবহ হয়ে দেখা দিল।
তালিবান জমানায় একজন নারীর জীবনধারণ সহজ ছিল না।আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তাদের গৃহবন্দী করে রাখার বিষয়টি।শিক্ষা ও কাজের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত।মাত্র আট বছর বয়স থেকে এক জন আফগান বালিকাকে বোরখা পরতে হবে।একজন অসুস্থ ডাক্তারখানায় একা যেতে পারবেন না, সঙ্গে একজন পরিবারের পুরুষ মানুষ থাকতে হবে।উঁচু হিল সম্পন্ন জুতো তারা পরতে পারবেন না।কেউ এইসব অবজ্ঞা করলে প্রকাশ্যে তার শান্তি হবে, পাথর ছুঁড়ে তাকে মারাও হবে। ব্যভিচারের অভিযোগ এনে। পরিচয়পত্রে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত তারা পিতার নাম ব্যবহার করতে পারতেন।
তালিবানদের ২০০১-এ পতনের পর নারীরা তাদের পূর্বেকার অবস্থান ধীরে অথচ দৃঢ়ভাবে ফিরে পাচ্ছিলেন। গত দুই দশকে ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে পারতেন এবং সব জায়গায় চাকরিও করতে পারতেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে বালিকা ও নারীরা মিলিটারি ও পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, রাজনৈতিক অফিসে কাজ করেছেন এবং অলিম্পিকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কারিগরি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ও রোবট সংক্রান্ত দলেও তাঁরা থেকেছেন যা এক কথায় অসম্ভব ছিল। আফগানিস্তানে প্রায় ২০০ নারী বিচারক আছেন এবং ৪০০০ নারী আইন রক্ষা ও প্রণয়ন বিভাগে যুক্ত।
এসবের মধ্যেই নারীরাও যূথবদ্ধ হচ্ছেন, তালিবান জমানার বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন।যেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন পূর্বেকার জমানার সেনাদল।এই লেখা প্রেসে যাওয়ার মুখে জানা যাচ্ছে তিনটি জেলা তালিবান মুক্ত আছে।সেগুলি হল ‘পুল-ই-হেসার’, ‘দেহ-ই-শালা’ ও ‘বানো’ যেগুলির অবস্থান কাবুল থেকে ১৬০ কিলোমিটার উত্তরে।তুমুল লড়াই চলছে অন্যত্রও।এই মুহূর্তে প্রয়োজন রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণে সেই দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে উদ্যোগ গ্রহণ।
[লেখক – অবসরপ্রাপ্ত উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story