মহাভারত ও গান্ধার : ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্তমান প্রবন্ধের শিরোনামে যে “মহাভারত” শব্দ, তা দুই অর্থে ব্যবহার করছি l কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মহাকাব্য-ইতিহাস “জয়” (১.৫৬.১৯; ১৮.৫.৪৬)[১] বা “ভারত” (১.১.৬১) এবং তার বৃহৎ রূপ “মহাভারত” (১.৫৬.৩১; ১.১.২০৯)l[২] আবার “মহাভারত” হল মহা-ভারত বা বৃহত্তর ভারত বা অখণ্ড ভারত বা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির প্রভাবিত অঞ্চল, যদিও সবসময় সরাসরি রাজনৈতিক ঐক্যের তাৎপর্যবাহী নয় । অখণ্ড ভারত বা বৃহত্তর ভারতের রাজনৈতিক ধারণা এবং আদর্শ, আমার মত, আধুনিক প্রেক্ষাপটে অযৌক্তিক। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক বোধ-অনুভূতির বহু শতাব্দীর ঐতিহাসিকতা এবং বাস্তবতা নিয়ে সংশয় নেই। এই প্রভাব দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে আজও অনুভূত ।
“ভারতবর্ষ” – এই ধারণা ও আদর্শের মুখ্য ভূমিকা মহাভারতের । বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন ঐতিহ্যে, “জম্বুদ্বীপ” হল মহাদেশ, যার অন্তর্গত হল ভারতবর্ষ । আবার ওই সমস্ত ঐতিহ্যেই, বিশেষ করে বৈদিক ও জৈন ঐতিহ্যে, “অংশকে পূর্ণর নামে অভিহিত” করার রীতিতে, জম্বুদ্বীপ এবং ভারতবর্ষ সমার্থক । বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনা করবো, মহাভারত গ্রন্থের জন্ম, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে কিভাবে গান্ধার সম্পৃক্ত l
গান্ধার নিয়ে আলোচনা করছি কেন?
সত্যি বলতে, আফগানিস্তানের বর্তমান ঘটনা প্রবাহর কারণে । “সহযোগী স্মৃতির” (associative memory) নিয়ম, আমি তার ব্যতিক্রম নই । আফগানিস্তান যে কোনো ইতিহাস সচেতন ও সংস্কৃতি সচেতন ভারতীয়কেই মনে পড়াবে “গান্ধার” l অধুনা আফগানিস্তানের উত্তরপূর্ব ও অধুনা পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিম অংশে কাবুল ও সোয়াত নদীর তীরে ছিল বিস্তৃত প্রাচীন গান্ধার l যা আমাদের বিস্মিত করে তা হল প্রাচীন ভারতে, বিশেষ করে, গান্ধার-কুরু এবং গান্ধার-মগধ অক্ষ, যা আজকের মানচিত্রে বোঝানোর সুবিধার্থে, মোটামুটিভাবে কাবুল-দিল্লি এবং কাবুল-পাটনা সংযোগকে বোঝায়।
আফগানিস্তান আজ নতুন করে খবরে l কারণটি খুব গৌরবজনক বা আনন্দদায়ক নয় l সৌজন্যে রিলিজিওনের নামে ও ইসলামের নামে মৌলবাদী শক্তি তালিবান । রেলিজিওনের শোষণকারী মাত্রা বিষয়ে, কার্ল মার্ক্সের বহু- ব্যবহৃত বানী আবার প্রাসঙ্গিক । আমাদের প্রতিবেশী এবং বাঙালি জাতির এক অংশের ইসলামী রাষ্ট্র বাংলাদেশে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা l সেখানে আফগানিস্তানে তালিবানের বিশ্বাস যে নারী কেবল প্রজনন যন্ত্র । তাদের ফতোয়া, নারী প্রশাসনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না । নারীর শিক্ষাতেও বাধা । আমরা কেবল অসহায়ত্ব নিয়েই আশ্চর্য হতে পারি যে, একবিংশ শতাব্দীতেও এই ধরনের মতামত সম্ভব এবং তার বাস্তব অস্তিত্বও রয়েছে !
আফগানিস্তান অবধারিতভাবে মনে পড়ায় রবীন্দ্রনাথের “কাবুলিওয়ালা” l পিতা ও কন্যার মর্মস্পর্শী কাহিনী আজকের আফগানিস্তানে সাধারণ নারীর অসহায় অবস্থার বৈপরীত্যে আরো গভীর করুণরসে সিক্ত l সমসাময়িক সাহিত্যে গান্ধার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯৬৩-২০১৩) আত্মজীবনী “কবুলিওয়ালার বাঙালি বউ” (১৯৯৭) । তিনি একজন আফগানকে বিয়ে করেছিলেন । গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে, তালিবান শাসনের প্রথম অধ্যায়ে, তিনি আফগানিস্তান থেকে ভারতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি আবার আফগানিস্তানে ফিরে যান এবং তালিবান তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে !
ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের ইতিহাসে গান্ধারের তাৎপর্য ও তার বর্তমান অবস্থা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের কাছেই বেদনার কারণ হবেl অবশ্য এও ঠিক, সময় তার নিজস্ব নিয়মে বয়ে চলে l বিজয়ীরা ইতিহাস লেখে, কিন্তু আমরা বাঁচি গতিশীল ইতিহাসের স্রোতে l অতীতের গরিমা কল্পলোক আলোকিত করে, কিন্তু বর্তমানকে বাস্তব মাটিতে দাঁড়িয়ে তার নিজের আলো নিজেকেই খুঁজতে হবে l গান্ধার নিয়ে এই বর্তমান সাংস্কৃতিক স্মৃতিচারণ ঘোর বাস্তবকে মাথায় রেখেই, অতীত মহিমার স্মৃতির “আফিমে” নেশাগ্রস্ত হবার জন্য নয় ।
বৌদ্ধ প্রভাবের সময়, গান্ধার প্রাচীন ভারতের ১৬টি মহাজনপদের মধ্যে একটি ছিল।
গান্ধারের বুকে বহু সভ্যতার অবদান আছে l এক সময় ধ্বনিত হয়েছে বৈদিক মন্ত্র, এক সময় ধ্বনিত হয়েছে পারস্য জরাথুষ্ট্রর গাথা, এক সময় শোনা গেছে গৌতম বুদ্ধের বাণী, শোনা গেছে “বুদ্ধম স্মরণম গচ্ছামি”, এক সময় শোনা গেছে মৌর্য সম্রাট অশোকের ধর্মবাণীl বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের সাথে, গান্ধার, ইতিহাসের এক পর্যায়ে বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী হয়ে ওঠে l
কালনদীর স্রোতে সেই সংস্কৃতি বয়ে গেছে l এসেছে ইসলাম l গান্ধারে ধ্বনিত হয়েছে আজান l তারপর আরো জল বয়ে গেছে সিন্ধুনদে l পারস্য, হিন্দুশাহী ও ইসলামিশাহীর যুগ পেরিয়ে, আফগানিস্তান আবার নজরে এসেছে ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির l এক সময় গ্রীক আলেক্সান্ডারের বাহিনীর পদাঘাতের ধুলায় মিশেছে ইউরোপিয় শিল্প বিপ্লবজাত গুলিবারুদের ধোঁয়া l
ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময়, অখণ্ড ভারতীয় সংস্কৃতিকে মূলতঃ রিলিজিওন ভিত্তিক বিভাজন করে দিয়ে গেছে l
তারপর রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসে। প্রথম ক্ষেত্রে, ঘোষিত আদর্শ হল কমিউনিজম, অন্য ক্ষেত্রে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ নির্মূল এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা । নিজস্ব জাতীয় “ধোঁয়া-কর্মসূচি” অনুসরণ করে, বর্তমানে তালিকায় নতুন প্রবেশকারী হলো চীন ও পাকিস্তান। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ – তা ভৌগোলিক, ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক যে কোন নাম এবং রূপে হোক – যখন অন্য একটি জাতির জীবনের নিজস্বতা নিয়ে টানাপোড়েন করে, তখন কী হয়, মৌলবাদী তালিবানের উত্থান তার একটি চূড়ান্ত প্রমাণ । বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়ে আর বেশী কিছু বলার নেই ।
এই প্রবন্ধে, আমরা সাংস্কৃতিক স্মৃতির সরণি বেয়ে ফিরে যাব খ্রীষ্টের জন্মের আগে যুগে, অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব সময়কালে l বর্তমান প্রবন্ধর আলোচ্য বিষয় সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে ।
প্রাচীন গান্ধারে, পুষ্কলাবতী, তক্ষশীলা এবং পুরুষপুরা (পেশোয়ার), গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল l তক্ষশীলা ছিল গান্ধারের প্রাণ -কেন্দ্র l বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল তক্ষশীলার বিশ্ববিদ্যালয় l তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে, উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রগুলো ছিল পুরুষার্থের সকল মাত্রায় বিস্তৃত l
তক্ষশীলা অধুনা পাকিস্তানের পাঞ্জাবে অবস্থিত l প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধানে, এখানে প্পারস্য আকেমেনিড (Achaemenid) সাম্রাজ্য (খ্রিষ্ট পূর্ব ৬০০), মৌর্য সাম্রাজ্য, ইন্দোগ্রীক, ইন্দো-সিথিয়ান ও কুষান সাম্রাজ্যের প্রভাব পাওয়া গেছে l বর্তমান আফগানিস্তানের কান্দাহার নামের উৎপত্তি আলেক্সান্ডার নাম থেকে l পাশাপাশি মত, গান্ধার থেকেই কান্দাহার ।গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (খ্রিষ্ট পূর্ব ৪৮৪-৪২৫) গান্ধারকে অচেমেনিড সাম্রাজ্যের বিশতম স্যাট্রাপি বা প্রদেশ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, যা সবচেয়ে জনবহুল এবং ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য ।
ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে কিছু নমস্য অবদানকারীর গান্ধার সংযোগ রয়েছে, যেমন পাণিনি (ব্যাকরণবিদ, অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণের রচয়িতা), চরক (চিকিৎসক, চরকসংহিতা নামক আয়ুর্বেদ-গ্রন্থের রচয়িতা), জীবক (শল্য চিকিৎসক), চাণক্য, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক প্রভৃতি l
উপনিষদী বা বেদান্ত দর্শনে, পুরুষার্থঃ বলতে বোঝায় ধর্ম অর্থ কাম; এবং এই তিনের ভারসাম্য মানুষকে নিয়ে যায় আরো উচ্চ জীবনে l সেই চতুর্থ পুরুষার্থঃ হল মোক্ষ l[৩] ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি ধৃ ধাতু থেকে, যার তাৎপর্য “যা ধারণ করে”। সুতরাং, অন্যান্য তাৎপর্যের সমান্তরাল, ধর্মর তাৎপর্য মানুষের সংস্কৃতি বা কৃষ্টি, কারণ তা সামাজিক মানুষকে ধারণ করে । “রাজনীতি” বা “রাজনৈতিক চেতনা” সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ ।
ভারতীয় ঐতিহ্যে, প্রতিটি পুরুষার্থর পৃথক শাস্ত্র আছে; ধর্মে আলোচনার জন্য ধর্মশাস্ত্র; অর্থের জন্য অর্থশাস্ত্র; কামের জন্য কামশাস্ত্র; মোক্ষের জন্য মোক্ষশাস্ত্র। মহাভারতের বৈশিষ্ট, তাতে এই চারটি বিষয়ই আলোচিত, বিশেষ করে মহাভারতের শান্তি ও অনুশাসন পর্বে ।
মহাভারত মহাকাব্য এবং ইতিহাস হিসেবে পরিচিত। ইতিহাস এবং history আজকাল সমার্থক হিসাবে অনুবাদ করা হয়, কিন্তু তাদের তাৎপর্য এবং ব্যুৎপত্তি ভিন্ন। ভারতীয় ইতিহাসকে ভারতীয় ঐতিহ্যে ইতিহাসের সংজ্ঞা মাথায় রেখেই দেখতে হবে । কৌটিল্য বলেছেন যে ধর্মশাস্ত্র এবং অর্থশাস্ত্র ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ (১.৫.১৪)। কলহন তাঁর “রাজতরঙ্গিনী” গ্রন্থে (খ্রিষ্টাব্দ ১১৪৮-৯), পুরুষার্থর বিষয় আলোচনাকে ইতিহাসের অন্যতম লক্ষণ বলেছেন । সুতরাং, “ইতিহাস” শব্দ বহুমাত্রিক ।History বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তার থেকে “ইতিহাস” অধিক মাত্রার ।উত্তর আধুনিক ভাবনায়, history বলে চূড়ান্ত কিছু নেই; history আসলে “গল্প” (narrative) যার বিনির্মাণ সম্ভব ।আবার “উত্তর সত্য” (post-truth) ভাবনায়, যার তাৎপর্য মোটামুটিভাবে “সত্যের বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ডর বিলুপ্তি”, যে কোনও সত্যই প্রতীয়মান সত্য বা আপেক্ষিক সত্য যাকে ব্যক্তি চূড়ান্ত সত্য মনে করে, বা অন্য কেউ তাকে মনে করাতে পারে ।
আমার মতে, “উত্তর আধুনিক” ও “উত্তর সত্য” – এই দার্শনিক মতগুলি আধুনিক পরিভাষায় এসেছে বটে, কিন্তু তাদের বক্তব্য নতুন কিছু নয় । মহাভারতের প্রমাণেই বলি, মহাভারতে কোনও “বৃহৎ গল্প” (grand narrative) নেই; অধিকাংশ কাহিনীর অন্য কাহিনী মহাভারতেই আছে ।এমনকি, “ধর্ম” বিষয়েও নানা আপেক্ষিক মত আছে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে । অর্থাৎ, “ইহাই ধর্ম ইহাই সত্য” – এ কথা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা নেই । গীতা উপদেশের শেষে, কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, “যথেচ্ছসি তথা কুরু” (গীতা ১৮/৬৩), অর্থাৎ “আমি আমার কথা বললাম, এবার তুমি তোমার স্বভাব অনুযায়ী নিজ ধর্ম নিজ সত্য খুঁজে নাও”।ভারতীয় ঐতিহ্যে, এই চেতনা জাগ্রত করার কথকতা ও গ্রন্থই “ইতিহাস” । (বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৫)
বর্তমান প্রবন্ধে, গান্ধার-কেন্দ্রিক আলোচনায়, বিশেষ উদ্দেশ্য হল, এই তুলে ধরা যে ভারতীয় ঐতিহ্যে, পুরুষার্থঃ বিষয়ক প্রতিটি শাস্ত্র এবং তাদের অন্যতম প্রাণপুরুষরা, কোন না কোন ভাবে গান্ধার অঞ্চলের সাথে জন্মসূত্রে অথবা কর্মসূত্রে যুক্ত; অন্তত গান্ধার তাঁদের চেতনায় প্রাসঙ্গিক হয়েছে । গান্ধার তাই “ধর্ম” ও “ইতিহাস” আলোচনায় অপরিহার্য ।
১. ঋগ্বেদে এবং বৈদিক গ্রন্থে গান্ধার
গান্ধার শব্দ প্রথম পাওয়া যায় ঋগ্বেদে (ঋষি দীর্ঘতমা: ১.১২৬.৭)l এক আত্মবিশ্বাসী ও যৌন-স্বাধীন নারী বলছেন, তাঁর গায়ের লোম গান্ধারের ভেড়ার মতো l কাব্যিক অতিকথন ও যৌনমাত্রা বাদ দিলে, এ থেকে বৈদিক যুগে যেমন নারীর নিজ দেহ-ভূমি নিয়ে অসঙ্কোচ আত্মবিশ্বাসের চিত্র পাওয়া যায়, তেমনি গান্ধারের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া যায় l গান্ধার নামের প্রাচীনত্ত্ব বিষয়েও নিঃসন্দেহ হওয়া যায় l
বৈদিক সভ্যতার অন্য অংশ, অর্থাৎ প্রাচীন পারস্য সভ্যতা বা আবেস্তান সভ্যতায় গান্ধার ছিল অন্যতম পবিত্র স্থান l জরাথুস্ট্রীয় আবেস্তায়, ভেন্ডিডাদ (Vendidad) প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছে ভায়করতা (Vaēkərəta) এবং ‘হপ্ত হিন্দু’ আহুরা মজদা দ্বারা নির্মিত ষোলটি স্থানের মধ্যে দুটি। Vaēkərəta হল গান্ধার, যা পৃথিবীর ষষ্ঠ সবচেয়ে সুন্দর জায়গা l স্থান বোঝাতে, ‘হিন্দু’ শব্দের প্রাচীনতম উল্লেখগুলির মধ্যে এইটি অন্যতম ।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ আছে গান্ধার রাজা নগ্নজিতের নাম (৭.৩৪)। এই অংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ নগ্নজিতের পাশাপাশি এতে রাম মার্গবেয়, বিধর্বের রাজা ভীম, জনমেজয় পরিক্ষিত, নারদ এবং পর্বত, পাঞ্চাল রাজা সোমক সহদেব্য এবং সহদেব শ্রীঞ্জয়ের উল্লেখ রয়েছে। গান্ধার রাজার সংস্কৃত নাম সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে গান্ধার একটি বৈদিক কেন্দ্র ছিল।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এই অংশে উল্লিখিত অনেক চরিত্রকে মহাভারতে পাওয়া যায় l তাঁদের মধ্যে, জনমেজয় পরিক্ষিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ l তিনি অর্জুনের প্রপৌত্র, এবং বলা যায় বর্তমান মহাভারত গ্রন্থ প্রচারে তাঁরই মুখ্য ভূমিকা l
মহাভারতে আদি পর্বে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে যে বেদব্যাসের মুখে মুখে রচনা গণেশ লিপিবদ্ধ করেন । গণেশ শব্দের উৎপত্তি গণ + ঈশ, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ঈশ্বর বা নেতা বা রাজা । আমার ধারনা, গণেশ ও ব্যাসের কাহিনী রূপকার্থে বলেছে যে রাজা পরিক্ষিত লিখিত মহাভারতের প্রবর্তক, অথবা তাঁর আমলেই মহাভারত লিখিত গ্রন্থ রূপ পায় । পিটার ব্রুক তাঁর “মহাভারত” নাট্য–চিত্রে গণেশকে রূপকার্থে দেখিয়েছেন ।
২. বাল্মীকি রামায়ণ ও গান্ধার
বাল্মীকি রামায়ণের মতে, গন্ধর্ব থেকেই গান্ধার নাম (৭.৯১.১০)l দাশরথি রামের ভাই ভরত রামের নির্দেশে জয় করেছিলেন এই গন্ধর্বদের দেশ l তারপর তিনি স্বপুত্র তক্ষ ও পুষ্করের নামে দুটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন – তক্ষশীলা ও পুষ্করাবতী (৭.৯১.৯)l দাশরথি রামের কথা বৌদ্ধ জাতকে এবং জৈন সাহিত্যেও পাওয়া যায় ।
অন্যত্র এই মতও আছে যে নাগ তক্ষকের ক্ষেত্র ছিল বলে, তক্ষশীলা নাম প্রাপ্তি l
৩. উদ্দালক আরুণী, শ্বেতকেতু ও উপনিষদে গান্ধার
ভারতীয় বৈদিক দর্শনের নির্যাস উপনিষদ বা বেদান্ত l খুবই কৌতূহলোদ্দিক বিষয়, বেদান্ত আলোচনায় অন্তত একবার গান্ধার স্মরণ অপরিহার্য ! উপনিষদের বিখ্যাত পিতা পুত্র জুটি উদ্দালক ও শ্বেতকেতুর সৌজন্যে, বেদান্তে ‘গান্ধার’ শোনা যায় l
উদ্দালকের প্রভাব বৌদ্ধ এবং জৈন মতে আছে, এবং উভয় সম্প্রদায়ের পবিত্র গ্রন্থে স্মরণ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, জৈন পবিত্র “ঋষিভাষিত'” গ্রন্থে তাঁকে উল্লেখ করেছে মহাশালপুত্র অরুণ নামে ।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে (মন্ত্র ৩.৭; ৬.২) উদ্দালক আরুণীর উল্লেখ আছে l ছান্দোগ্য উপনিষদে (মন্ত্র ৫.৩; ৬.১-১৬), উদ্দালক ও শ্বেতকেতুর আত্মা ও ব্রহ্ম বিষয়ক কথোপকথন আছে, যা বেদান্ত দর্শনের অন্যতম ভিত্তি l কৌশিতকি উপনিষদে (মন্ত্র ১.১) জানা যায়, উদ্দালকের সম্পূর্ণ পরিচয় উদ্দালক আরুণী গৌতম l কঠ উপনিষদেও (মন্ত্র ১.১১), ঔদ্দালকি আরুণীর উল্লেখ আছে l তিনি গৌতম নামে পরিচিত (মন্ত্র ৪.১৫)l এখানেও আলোচ্য বিষয় আত্মা ও ব্রহ্ম l
উদ্দালক ছিলেন চারণ বা চারক, অর্থাৎ যিনি বিভিন্ন স্থানে ভ্ৰমণ করে বেড়াতেন l এই “চরৈবেতি”র আদর্শ হল গতিশীলতার আদর্শ l
যদি ‘হিন্দু’ শব্দ ‘সিন্ধু’ থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে লক্ষ্য করা যাক, ‘সিন্ধু’ শব্দের উৎপত্তি “সিদ্” ধাতু থেকে (Monier Williams), এবং “সিদ্”-এর তাৎপর্য হল গতিশীলতা l
পৌরাণিক যুগ-তত্ত্বর (অর্থাৎ চারটি যুগ চক্রাকারে আসে) থেকেও প্রাচীন আর একটি যুগ-তত্ত্ব ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পাওয়া যায় l এই মতে, গতিশীলতাই সত্যযুগ বা কৃতযুগ, আর অলসতা বা তামসিকতা হল কলিযুগ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৭.১৫)l এই গতিশীলতা, “ব্রাহ্মণ” শব্দের নিরুক্তগত আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত l “ব্রাহ্মণ” শব্দের উৎপত্তি “বৃহ” ধাতু থেকে, যার তাৎপর্য “বৃদ্ধি, বৃহৎ হওয়া ও বিবর্তন”l সোজা কথায়, যে ব্যক্তি গতিশীল (dynamic) এবং বিবর্তিত হবার গুণসম্পন্ন, তিনিই ব্রাহ্মণ l
ব্রাহ্মণের এই আদর্শগত তাৎপর্য গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর গ্রহণ করেছেন l তাঁরাও চারণ বা চারক ছিলেন । গৌতম বুদ্ধ গান্ধার গিয়েছিলেন, বৌদ্ধ-মতে সে কাহিনী আছে ।
গৌতম এবং মহাবীর উভয়েই “বুদ্ধ” ও “তথাগত” নামে সমাদৃত ছিলেন (জৈন সূত্রকৃতাঙ্গ ১.১১)। গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর নিজেদের “ব্রাহ্মণ’ বলেছেন । গৌতম বুদ্ধ “ব্রাহ্মণ” ও “বুদ্ধত্ব” সমার্থক বলেছেন ।(উদাহরণ: বৌদ্ধ সূত্রনিপাত ৩.৪, সুন্দরিকা ভরদ্বাজ সূত্র l ধম্মপদ, ২৬. ব্রাহ্মণবগগো l জৈন সূত্রকৃতাঙ্গ ১.৯) l
“ব্রাহ্মণ” আদর্শর গুণ কর্মভিত্তিক অবস্থান থেকে জন্মগত বর্ণ বা জাত (caste) ও জন্মভিত্তিক সামাজিক পরিচয় হয়ে ওঠা ক্ষমতাতন্ত্র-কৃত এক অবক্ষয়ের নমুনা । এ আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না ।
মহাভারতের মতে, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান শ্বেতকেতুর সৃষ্টি l নারীকে ধর্ষণের থেকে বাঁচাতে, এবং যাতে কোনো কামুক পুরুষ নিছক যৌনতৃপ্তির জন্য গবাদিপশুর মত নারীকে ব্যবহার না করে, শ্বেতকেতু বিবাহ নামক স্থায়ী সম্পর্কের প্রতিষ্ঠান বিধান করেন l এই তথ্য পাণ্ডু বলেছেন কুন্তীকে (১.১১৩) l
বাৎস্যায়ন তাঁর কামশাস্ত্র “কামসূত্রে”, উদ্দালক শ্বেতকেতুকে স্মরণ করেছেন কামশাস্ত্রের এক অন্যতম প্রাচীন প্রবক্তা রূপে (অধ্যায় ১, ৪, ও ৬)l বাৎস্যায়ন বলেছেন কামসূত্রের জনক হলেন পাঞ্চাল নামক ব্যক্তি (অধ্যায় ২)l
মহাভারতে পাঞ্চাল হল দ্রুপদের রাজ্য, যার অর্দ্ধেক দ্রোণ দখল করেন l এই পাঞ্চাল থেকেই দ্রুপদ কন্যা দ্রৌপদীর আর এক নাম পাঞ্চালি l
উদ্দালক কুরুপাঞ্চালের বাসিন্দা ছিলেন (শতপথ ব্রাহ্মণ, ১১.৪.১.২) l বহুস্থানে বহু গুরুর কাছে তিনি শিক্ষালাভ করেন l মদ্র ভ্ৰমণ করে তিনি যজ্ঞর তাৎপর্য শেখেন পতঞ্চল কাপ্যর কাছে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৩.৭.১) l
উদ্দালক, রাজা গাঙ্গপুত্র চিত্রের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন, যেমন, লোকতত্ত্ব, বেদের প্রকৃত তাৎপর্য (অর্থাৎ বেদ নিছক গ্রন্থ, অক্ষর বা শব্দসমষ্টি নয়; বেদ হল জ্ঞান এবং উপলব্ধি), ধর্ম কি, সত্য কি, আত্মার পুনঃ দেহপ্রাপ্তি প্রভৃতি (কৌশিতকি উপনিষদ) l
বৈদিক হিন্দু ধর্মে, বৌদ্ধ এবং জৈন মতে, এই তত্ত্বগুলির গুরুত্ব আলোচনার অপেক্ষা রাখে না l ধর্ম, সত্য ও বেদের প্রকৃত তাৎপর্যর এই তত্ত্ব, গৌতমবুদ্ধ ও মহাবীর উভয়েই গ্রহণ করেছিলেন (উদাহরণ: বৌদ্ধ সংযুক্ত নিকয়ের লোহিচ্চসূত্র ও নগরসূত্র l বৌদ্ধ শ্বেতকেতু জাতক l জৈন কল্পসূত্র)l
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, গ্রীক দার্শনিক পিথাগোরাসের (খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৭০-৪৯৫) দর্শনে আত্মার জন্মান্তরতত্ত্ব আছে l
গ্রীক ও রোমান ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পিথাগোরাস বহু বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন ও জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়েছিলেন ভারতীয় জ্ঞানীদের ও ব্রাহ্মণদের থেকে l এ তথ্য পাওয়া যায় আলেক্সান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্টের “স্ট্রোমাটা” গ্রন্থ থেকে (খ্রিষ্টাব্দ ২য় শতাব্দী) l কথিত আছে, পিথাগোরাস ইজিপ্ট ও ভারতেও ভ্ৰমণ করেন l
পিথাগোরাসের যে ত্রিভূজ বিষয়ক উপপাদ্য, যা ইউক্লিড (খ্রিষ্ট পূর্ব ৩০০) জ্যামিতির প্রতিপাদ্য, তা তারও আগে পাওয়া যায় কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত বৌদ্ধায়ন শুল্ব সূত্রে (খ্রিষ্ট পূর্ব ৮০০)l
প্রাচীন ভারত ও গ্রীসের এই যোগাযোগে গান্ধারের ভূমিকা বিরাট l আলেক্সান্ডারের গান্ধার জয়ের পর, গান্ধার-পথে এই যোগাযোগ আরো দৃঢ় হয় l মেগাস্থেনেসের “ইন্ডিকা” গ্রন্থ থেকে বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় মৌর্য বংশ সম্পর্কে এবং সেই সময়কার ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা বিষয়ে l [মূল “ইন্ডিকা” গ্রন্থ পাওয়া যায়না, গ্রিক ও রোমান লেখকদের লেখায় তার নানা অংশ পাওয়া যায় ।]
উদ্দালক আরুণী, উদীচ্য বা উত্তরপথ ভ্ৰমণ করেছিলেন (শতপথ ব্রাহ্মণ, ১১.৪.১.১) l প্রাচীন ভারতে উত্তরপথ বোঝাতো বিস্তীর্ণ অঞ্চল, গান্ধার যার অন্তর্গত l
বর্তমান প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ, উদ্দালকের গান্ধারের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬.১৪.১-২) l উদ্দালক মোক্ষপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তুলনা করেছেন গান্ধারনিবাসী ব্যক্তির সাথে যিনি চোখ বাঁধা অবস্থায় পথভ্রষ্ট হয়েছেন, কিন্তু চোখের বন্ধন খোলা অবস্থায়, গুরুর সঠিক উপদেশে এবং নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে শেষে গান্ধার পৌঁছেছেন l
বৈদিক হিন্দু ধর্মে, আত্মার মোক্ষ সর্বোচ্চ পুরুষার্থঃ l উদ্দালক মোক্ষে পৌঁছানো তুলনা করেছেন গান্ধার পৌঁছানোর সাথে l উপনিষদ বা বেদান্তে, গান্ধারের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার এর চেয়ে বড় প্রমাণ হয়না l
ছান্দোগ্য উপনিষদে, উদ্দালক, পুত্র শ্বেতকেতুকে পনেরো দিন ক্ষুধার্ত রেখে শিক্ষা দিয়েছেন অন্ন ও খাদ্য সর্বপ্রধান (৬.৭-৮), কারণ কেউ খালি ও ক্ষুধার্ত পেটে দর্শন চিন্তা করতে পারে না বা ব্রহ্ম বিষয় ভাবতে পারে না। উদ্দালকের শিক্ষার মূল বিষয় হল মৌলিক চাহিদার পূর্ণতা প্রাথমিক, ব্রহ্ম নিয়ে জল্পনা-কল্পনা পরে আসে। মানুষের প্রাথমিক ও জৈবিক চাহিদা পূরণ না হলে বেদজ্ঞান লাভের সম্ভাবনা নেইl
বিবেকানন্দ এই শিক্ষা ও বাণীকে সহজ করে বলেছেন “খালি পেটে ধর্ম হয় না”l
উদ্দালক বস্তুবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা l একই সঙ্গে তিনি শিখিয়েছেন, মানুষের অন্নখাদ্যের প্রাথমিক চাহিদা মিটলে, তখনই সে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়, এবং তখন সে “তত্ত্বমসি” (তুমিই তিনি, বা আত্মাই পরমাত্মা) উপলব্ধির উপযুক্ত হয় l
উদ্দালকের গান্ধার ভ্রমণের দ্বিতীয় অন্যতম প্রমাণ বৌদ্ধ জাতক l
৪. বৌদ্ধ জাতকে উদ্দালক, শ্বেতকেতু ও গান্ধার
উদ্দালক জাতকে (নং ৪৮৭), গৌতম বুদ্ধ বলেছেন তিনি পূর্বের এক জন্মে বোধিসত্ত্ব উদ্দালক ছিলেন এবং তক্ষশীলায়, তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অধ্যাপকদের কাছে শিক্ষা সম্পন্ন করেন l
বৌদ্ধ ইতিহাস চেতনায় উদ্দালক, তক্ষশীলা, ও বুদ্ধ এইভাবে যুক্ত হয়েছেন l বৌদ্ধ মত যখন তক্ষশীলায় বিস্তৃত হতে চেয়েছে, সেই সময়ে সেখানে উদ্দালকের বেদান্ত দর্শন নিশ্চয় প্রভাবশালী ছিল l তাই এই আত্মীকরণ l
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আন্যান্য জাতকের কাহিনীতে বুদ্ধ বলেছেন তিনি পূর্বের বিভিন্ন জন্মে দাশরথি রাম (দশরথ জাতক, নং ৪৬১), বিদুর (ধুমকারী জাতক, নং ৪১৩; দশ ব্রাহ্মণ জাতক, নং ৪৯৫), এবং কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস ছিলেন (কানহা দীপায়ন জাতক, নং ৪৪৪) ছিলেন l
উদ্দালকের মতো শ্বেতকেতুও বৌদ্ধ জাতকে আছেন এবং এখানেও তক্ষশীলা যোগ আছে l বুদ্ধ পূর্বের এক জন্মে এক ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্ব ছিলেন l শ্বেতকেতু সেই ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্বর সমসাময়িক, তিনি তক্ষশীলায় শিক্ষা সম্পন্ন করেন (শ্বেতকেতু জাতক, নং ৩৭৭)l
গৌতম ঋগ্বেদের ঋষি l উদ্দালকও গৌতম l বুদ্ধ একই গোত্রের l সুতরাং বৌদ্ধ জাতকে, গৌতম উদ্দালককে আত্মীকরণের চেষ্টা স্বাভাবিক l
গান্ধার ও তক্ষশীলা নামেই দুটি জাতকের কাহিনী আছে, যা থেকে বোঝা যায়, বৌদ্ধ মত প্রচারে ও প্রসারে ঐ অঞ্চল কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল l
তেলপত্ত জাতক বা তক্ষশীলা জাতকে (নং ৯৬), পূর্বের এক জন্মে বোধিসত্ত্ব বেনারসের কনিষ্ঠ রাজপুত্র ছিলেন l এক পচেকবুদ্ধ[৪] ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তিনি গান্ধারের তক্ষশীলার রাজা হবেন, যদি তিনি এক রাক্ষসীর মোহ উপেক্ষা করে তক্ষশীলা পৌঁছতে পারেন l তখন বোধিসত্ত্ব পাঁচ সঙ্গী নিয়ে তক্ষশীলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন l পথিমধ্যে, সেই রাক্ষসী পাঁচ সঙ্গিকে মোহগ্রস্ত করে খেয়ে ফেলে l বোধিসত্ত্ব একাকী তক্ষশীলা পৌঁছে, রাজদ্বারে রাজাকে রাক্ষসী বিষয়ে সাবধান করে দেন l কিন্তু রাজা তা উপেক্ষা করে রাক্ষসীকে প্রাসাদে নিয়ে যান ও প্রাণ হারান l জনসাধারণ তখন বোধিসত্ত্বকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন l
গান্ধার জাতকে (নং ৪০৬), গৌতম বুদ্ধ পূর্ব এক জন্মে গান্ধার রাজপুত্র ও রাজা ছিলেন l এই জাতকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, গান্ধার ছিল কাশ্মীরের অন্তর্গত বা অংশ l
আফগানিস্তানে বৌদ্ধ প্রভাবের মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা “বামিয়ান বুদ্ধগণ” নামে পরিচিত, তা তালিবান ধ্বংস করে ২০০১ সালেl বৈরোচন বুদ্ধ ও গৌতম বুদ্ধের ঐ পাথরে খোদিত মূর্তি নির্মিত হয়েছিল খ্রিষ্টাব্দ পঞ্চম শতাব্দীতে l
৫. পাণিনি, মহাভারত ও গান্ধার
পাণিনি (খ্রিষ্ট পূর্ব ৯ম – ৫ম শতাব্দী)[৫] “বৈদিক আদি-সংস্কৃত”[৬] ভাষাকে সংস্কৃত করেন l তাঁকে ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার জনক বলা হয় l তাঁর অমর কীর্তি “অষ্টাধ্যায়ী”-তে তক্ষশীলার উল্লেখ আছে সিন্ধুর সাথে (সূত্র ৪.৩.৯৩) l
পাণিনির সময়ে যে “মহাভারত” গ্রন্থ ছিল, তার প্রমাণ একটি সূত্রে মহাভারতের উল্লেখ (৬.২.৩৮)l আবার তাঁর সময়ে যে “মহা-ভারত” বা ভারতবর্ষের ধারণা ছিল, তার প্রমাণ তাঁর “প্রাচ্যভারত” (২.৪.৬৬; ৪.২.১১৩; ৮.৩.৭৫) উল্লেখ l “প্রাচ্য” যেহেতু উল্লিখিত, সুতরাং অনুমেয়, উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের ধারণাও পাণিনির সময়ে ছিল l আবার তিনি যেহেতু গান্ধারবাসী ছিলেন, সুতরাং এমন অনুমান করা যেতে পারে, তাঁর সময়ে গান্ধারের ‘পশ্চিম ভারত’ মর্যাদা ছিল l
পাণিনিসূত্র ৪.১.১০৩-১১৭, ৪.৩.৯৫-১১৭, ও ৬.২.৩৪-৪২ যদি একত্রে দেখা হয়, তাহলে তিনি যে মহাভারত গ্রন্থর সাথে গভীর পরিচিত ছিলেন, তার রূপরেখা পাওয়া যায় l
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “কৃষ্ণচরিত্র” গ্রন্থে পাণিনিসূত্রে যুধিষ্ঠির, দ্রোণ, বাসুদেব, অর্জুন প্রভৃতি মহাভারতীয় চরিত্রদের উল্লেখ দেখিয়ে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা সিদ্ধ করতে চেয়েছেন l
পাণিনির বাসুদেব ও অর্জুনের উপাসনার উল্লেখ (৪.৩.৯৮)থেকে প্রমাণিত হয়, গান্ধারে কৃষ্ণ উপাসনা এমনকি অর্জুনের উপাসনাও প্রচলিত ছিল l
সংস্কৃত ব্যাকরণ আপাত শুষ্ক l কিন্তু মহাভারত চর্চায় পাণিনি অপরিহার্য l মহাভারত গ্রন্থ ও গান্ধারের যে অনবদ্য সম্পর্কের সুর (আলোচনা করবো), পাণিনি তাতে যেন “গান্ধার রাগ” প্রয়োগ করেছেন l
পরবর্তী কালে বৌদ্ধরা পাণিনিকে আত্মীকরণের চেষ্টা করেছেন, হিউয়েন সাং-এঁর (খ্রিষ্টাব্দ ৬০২-৬৬৪) লেখা তার প্রমাণ l হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, পাণিনি পরে মগধ চলে আসেন[৭] l অর্থাৎ পাণিনির মধ্যেও সেই গান্ধার-মগধ অক্ষ পাওয়া যায় ।
৬. কৌটিল্য, চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, মহাভারত ও গান্ধার
চানক্য (সময়কাল খ্রিষ্টাব্দ ৪র্থ-৩য় শতাব্দী) ভারতীয় ইতিহাসের এক অন্যতম চরিত্র এবং “অর্থশাস্ত্র” তাঁর অমর কীর্তি l কৌটিল্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত নামেও তিনি পরিচিত[৮] l কৌটিল্য সম্ভবত তাঁর গোত্র l
বৈদিক, বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে তাঁর বিষয়ে উল্লেখ আছে l
বৌদ্ধ গ্রন্থ “মহাবংশ”-র মতে তিনি তক্ষশীলার বাসিন্দা ছিলেন l এ ছাড়া, “পঞ্চতন্ত্র”, বিশাখদত্তর[৯] “মুদ্রারাক্ষস”, জৈন গ্রন্থ হেমচন্দ্রর “পরিশিষ্ট পর্ব”, একাদশ শতাব্দীর সোমদেবের “কথাসরিতসাগর” ও ক্ষেমেন্দ্রর “বৃহৎ কথামঞ্জরী” প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায় l ইতিহাসের ও ইতিহাস নির্মাণের নিয়মে তাঁর জীবনচরিতেও অনেক পৌরাণিক উপাদান ও কল্পকাহিনী (myth) মিশেছে l সে বিষয় আমাদের বর্তমান আলোচ্য নয় l আমাদের কৌতূহল উদপাদন করে, কৌটিল্যর গান্ধার-তক্ষশীলা যোগ এবং পরবর্তীকালে তাঁর মগধ আগমন l অর্থাৎ কৌটিল্যর মধ্য দিয়েও গান্ধার-মগধ যোগ অব্যাহত থেকেছে l এ ব্যাপারে, পাণিনির সাথে মিল লক্ষ্যণীয় l
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে মহাভারতের চরিত্রদের একাধিকবার স্মরণ করেছেন, যেমন, জনক (১.৬.৫, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন (১.৬.১০), যুধিষ্ঠির (৮.৩.৪৩), দুর্যোধন (১.৬.৮; ৮.৩.৪১), কৃষ্ণ ও কংস (১৪.৩.৪৪) ও জনমেজয় (১.৬.৬)।l তিনি দুর্যোধন যুধিষ্টিরের বিবাদ ও পাশাখেলার উল্লেখ করেছেন (৮.৩.৪১-৪৪)l অর্থাৎ সেই গান্ধাররাজ শকুনির স্মৃতিই ফিরে এসেছে l
নন্দ বংশের রাজত্ব অবসান ঘটিয়ে, কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে মগধের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন l
মৌর্য বংশের ইতিহাস যে প্রাচীন ভারতবর্ষের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না l চন্দ্রগুপ্তর পুত্র বিন্দুসার মহান রাজা ছিলেন l গ্রীক ঐতিহাসিক উপাদানে তিনি আমিত্রাঘাত নামে পরিচিত l
তবে মৌর্য বংশের সর্বাধিক বিখ্যাত সম্রাট অশোক । বর্তমান ভারতের সরকারি প্রতীক অশোকের স্তম্ভ থেকে নেয়া l মহাভারতে যে ঐক্যবদ্ধ বৃহৎ ভারতবর্ষ আদর্শ ও কল্পনা আছে, অশোকও তা বাস্তবায়িত করেছিলেন l
নন্দ বংশের মতই, মৌর্য বংশ ছিল শূদ্র বংশ l
কৌটিল্যের (চাণক্য) পৃষ্ঠপোষকতায় চন্দ্রগুপ্ত তক্ষশীলায় রাজত্বের পত্তন করেন। বিন্দুসারের সময়ে, বিন্দুসারে নির্দেশে যুবরাজ অশোক তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমন করেন । খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে অশোক রাজত্ব লাভ করেন। তখন মৌর্য রাজাদের রাজধানী ছিল পাটালীপুত্র।অশোক পাটালিপুত্র থেকে তক্ষশীলার পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেন।
গান্ধারে অশোকের দুটি শিলালিপি (খ্রিষ্ট পূর্ব ২৬০) পাওয়া গেছে – কান্দাহার দ্বিভাষিক শিলালিপি (“চেহেল জিনা এডিক্ট” নামেও পরিচিত), যা গ্রীক এবং আরামাইক ভাষায় লেখা, অন্যটি শুধুমাত্র গ্রীক ভাষায় কান্দাহার গ্রীক শিলালিপি।
এই শিলালিপির একটি ভাষাগত গুরুত্ব হল, অশোক “ধর্ম” শব্দের অনুবাদ করেছেন “eusebeia”,[১০] যার অর্থ, দেবতাদের প্রতি সঠিক কর্তব্য পালন, বা সঠিক ভাবে দেব উপাসনা করার রীতি l[১১] Eusebeia – এই বিমূর্ত ধারণার গ্রীক পৌরাণিক রূপ হল ইউসেবিয়া দেবী, যিনি শ্রদ্ধা-কর্তব্যর দেবী, যার স্বামী নমোস (Nomos) বা আইনের দেবতা, এবং যার কন্যা হলেন ডাইক (Dike) বা ন্যায়ের দেবী l[১২] (অন্য পৌরাণিক মতও আছে) l
অশোকের এই গান্ধার শিলালিপিতে, বুদ্ধের কোনো উল্লেখই নেই l[১৩] অর্থাৎ, অশোক যে ধর্ম প্রচার করেছেন, তা তাঁর নিজস্ব । বহু শতাব্দী পরে, মোঘল সম্রাট আকবর নিজে একটি ধর্ম প্রবর্তন করেন – দিন ঈ ঈলাহী ।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা বৈদিক “ধর্ম” শব্দ-ধারণা-আদর্শকে রিলিজিওন (religion) বানিয়েছে, যদিও দুয়ের নিরুক্ত এবং তাৎপর্য এক নয় l সুতরাং এ অনুবাদও সঠিক নয় l
তবে, যে বিষয়টি কৌতূহল উদ্রেক করে তা হল, “ধর্ম” শব্দকে অন্য ভাষায় অনুবাদ প্রচেষ্টা অশোকই সর্বপ্রথম করেন l এবং বর্তমান প্রবন্ধে বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক, এই অনুবাদের প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম গান্ধারেই হয় l
গৌতম বুদ্ধের পূর্বে এবং সমসময়ে অনেক “বুদ্ধ” ছিলেন l গৌতম বুদ্ধের বচনে, বিভিন্ন বৌদ্ধ সূত্রে, জাতক ও সাহিত্যে এই “বহু বুদ্ধ” স্বীকৃত (উদাহরণ – গরব সূত্র, সংযুক্ত নিকয় ৬.২ । মহাবস্তু ৫ম অধ্যায় । মহা কানহা জাতক, নং ৪৬৯)l জৈন মতের তীর্থঙ্কর মহাবীরও “বুদ্ধ” ছিলেন l উভয়ে, “জিন” নামেও পরিচিত ছিলেন ।[১৪]
হিন্দু পুরাণে বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে যে বুদ্ধর উল্লেখ আছে, তিনি গৌতম বুদ্ধ নন l কারণ, কোনো হিন্দু পুরাণে গৌতম বা সিদ্ধার্থ নামের উল্লেখ নেই l গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান অধুনা নেপালের লুম্বিনী, কিন্তু হিন্দু পুরাণের বুদ্ধের জন্ম ‘কিকট দেশে’ (ভগবৎ পুরাণ ১.৩.২৪), যা অনেক পণ্ডিতের মত, আধুনা বিহারের পাটনার কাছে l
অশোকের কোনো শিলালিপিতেও গৌতম বা সিদ্ধার্থ নাম নেই l যে বুদ্ধের প্রতি অশোক নাম করে শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন, তিনি “কনকমুনি বুদ্ধ” বা কোণাগমন বুদ্ধ (নিগালি সাগর শিলালিপি, নেপাল) l
গ্রীক ইতিহাস উৎসতেও শুধু “বুদ্ধ” উল্লেখ আছে, গৌতম বা সিদ্ধার্থ নাম নেই l আবার কুষান যুগের কনিষ্কর (খৃষ্টাব্দ ১২৭-১৫০) মুদ্রাতেও শুধু “বুদ্ধ” বা “শাক্যমুনি বুদ্ধ”।
বৌদ্ধ ইতিহাস উপাদান ও উপরোক্ত প্রমাণে সিদ্ধান্তে আসা যায়, প্রাচীন ভারতে বুদ্ধগণ উপাসিত হতেন বিমূর্ত ভাবে l এর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অশোক নির্মিত সাঁচীর স্তূপ l পাথরের ভাস্কর্যে দেখা যায়, বুদ্ধর আসন শূন্য (void)l অর্থাৎ শূন্যতাকে বুদ্ধরূপে উপাসনা l
এই বিমূর্ত বা নিরাকার বুদ্ধকে সাকার করা, বা বুদ্ধ মূর্তি পূজা মূলতঃ কুষান যুগে ঘটে l এবং তার প্রধান কেন্দ্র গান্ধার l ভারতীয় এবং গ্রীক ও রোমান শিল্পরীতির মিশ্রণে এক নিজস্ব ঘরাণার ভাস্কর্য শিল্পের উৎপত্তি হয় l একেই “গান্ধার শিল্প” বলা হয় l
বর্তমান প্রবন্ধে আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক তথ্য, গান্ধার শিল্পের অবদান “বিমূর্ত বুদ্ধ”-কে সাকার করা l
৭. গান্ধার পথে প্রাচীন ভারতের-গ্রীস-পারস্য-হিব্রু যোগাযোগ
গান্ধার পথে, প্রাচীন ভারতের সাথে প্রাচীন গ্রীস, প্রাচীন পারস্য ও প্রাচীনতম আব্রাহামিয় বিশেষ করে ইহুদি সভ্যতার যোগাযোগ ঘটেছিল l গান্ধার বিষয়ে আলোচনায়, তা উল্লেখ না করলেই নয় l বিস্তারিত আলোচনা নয়, কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক ও গ্রন্থ প্রমাণের রূপরেখা তুলে ধরবো l
আলেকক্সান্ডর আসার অনেক আগেই ভারত-গ্রীস যোগাযোগ ছিল l পাণিনি আলেক্সান্ডারের থেকে অন্তত দুই শতাব্দী পূর্বে l তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে “যবন” শব্দ আছে (৪.১.৪৯) l[১৫] খ্রিষ্টান রিলিজিওন ও ইসলাম রিলিজিওন জন্মের অনেক আগেই জেরুসালেমের সাথে বৈদিক ভারতের যোগ ছিল, তার গ্রন্থ প্রমাণ আছে l
মধ্যপ্রাচ্যে হিটাইট এবং মিতানি সভ্যতার[১৬] মধ্যে একটি ‘ঘোড়া-চুক্তি’র শিলালিপি (আ. খ্রিষ্ট পূর্ব ১৪০০) পাওয়া গেছে, যাতে বৈদিক দেবতাদের নাম আছে, যেমন ইন্দ্র, বরুণ, নাসত্য (অশ্বিনী) প্রভৃতি[১৭] l আব্রাহামিয় পুরাণে, এই সময়ের আশেপাশে ইহুদিদের নবী মোজেসের সময় । কৌতূহলের বিষয়, কৃষ্ণ, মোজেস এবং কর্ণের জীবনকাহিনীর মধ্যে সাদৃশ্য আছে।
ঐ সময়েরই, আর একটি ঘোড়ার পরিচর্যা ও ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক লিপি পাওয়া গেছে, যাতে বৈদিক সংখ্যা ও শব্দের উল্লেখ আছে l এর নাম কিক্কুলি অশ্ব প্রশিক্ষন নথি (Kikkuli’s horse training text)l
যেকোনো পৌরাণিক কাহিনী আগ্রহী ব্যক্তি লক্ষ্য করবেন, ব্রহ্ম এবং আব্রাহাম নামের মধ্যে মিল আছে। অব্রাহামের শুরুর “আ” শেষ পাঠালে হয়ে যায় “ব্রাহামা” l আবার আব্রাহামিক পুরাণে যেমন নোয়াহ (Noah) বা “নূহ” (Nuh), হিন্দু পুরাণে “মনু”। উভয়েই মহাপ্লাবন থেকে প্রাণীকুলকে বাঁচিয়ে ছিলেন l পুরাণে, ব্রহ্মার স্ত্রী “সরস্বতী”, ওদিকে, আব্রাহামের স্ত্রী “সারাহ”। সরস্বতী নদীর ঘাগরা নামে একটি উপনদী আছে, এবং সারাহ-র দাসী হগ্গার, যিনি পরবর্তীকালে আব্রাহামের স্ত্রী এবং ইস্মাইলের মাতা l ইস্মাইলের নাম মক্কা এবং কাবা নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত ।
স্বস্তিকা ছাড়াও আর একটি প্রাচীন পবিত্র চিহ্ন হল ষটকোণ বা হেক্সাগ্রাম l বৈদিক হিন্দু এবং ইহুদি উভয়েরই পবিত্র প্রতীক।[১৮] ইসরায়েলের পতাকায় হেক্সাগ্রাম রয়েছে, যা “ডেভিড তারা” (David’s Star) নামেও পরিচিত l এখানে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ নেই, কিন্তু মনে রাখা যাক, “৮” এবং “৩৩” এই দুই “মরমী সংখ্যা” (mystic number), বৈদিক এবং আব্রাহামিক উভয় সংস্কৃতিতেই ধৰ্মীয় তাৎপর্যমণ্ডিত l
ইতিহাসবিদ-ভ্রমণকারী ও পণ্ডিত আল বিরুনীর (খ্রিষ্টাব্দ ৯৭৩-১০৫০) মতে, ইজিপ্টে তখন শাসন করতেন হিন্দু রাজা আফ্রদিসিঅস (Aphrodisios) l সেই সময়কাল আব্রাহামিয় পুরাণের মহাপ্লাবনের ৯০০ বছর পরে l
বিশ্ব জুড়ে নানা সভ্যতায় মহাপ্লাবনের কাহিনী-পুরাণ আছে । সুতরাং, অতিকথন ও অলৌকিকতা বাদ দিলে, তার ঐতিহাসিকতা সম্ভাবনাময় l জেমস উসসারের কালক্রমে (James Ussher’s chronology[১৯]), এই মহাপ্লাবন ঘটেছিল খ্রিষ্ট পূর্ব ২৩৪৮ l
আল বিরুনীর বক্তব্য অনুযায়ী, তা থেকে ৯০০ বছর বাদ দিলে হয় খ্রিষ্ট পূর্ব ১৪৪৮ – অর্থাৎ মোটামুটি,মোজেসের জন্মের আগের সময়ে l
আলেক্সান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্ত (Clement of Alexandria (খ্রিষ্টাব্দ আ. ১৫০-২১৫) তাঁর রচনায় শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেছেন ব্রাহ্মণ শ্রমণ ও বুদ্ধের নাম (যদিও গৌতম বা সিদ্ধার্থ নাম উল্লেখ নেই)l তিনি মেগাস্থিনিসকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, সিরিয়ায় (Syria) যারা ইহুদি নামে পরিচিত ছিল, ভারতে তারা ব্রাহ্মণ l[২০] এনার মতে, পিথাগোরাস ভারতীয় ব্রাহ্মণদের কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন, তা আগেই উল্লেখ করেছি l
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর সোফিস্ট ফিলোস্ট্র্যাটাসেরও মত, পিথাগোরাস, মিশরীয়দের পাশাপাশি ভারতীয় দার্শনিকদের (gymnosophists) অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন।[২১]
আলেক্সান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্তের গ্রন্থে আরো জানা যায়, ক্লিয়ারছুস (Clearchus the Peripatetic) এমন একজন ইহুদিকে জানতেন যিনি অ্যারিস্টটলের (Aristotle) সান্নিধ্য পেয়েছিলেন l
জোসেফাস (Josephus) (খৃষ্টাব্দ আ. ৩৭-১০০) যিনি ছিলেন একজন রোমান-ইহুদি পণ্ডিত, তিনি ক্লিয়ারছুসের (Clearchus of Soli, (খ্রী পূ চতুর্থ- তৃতীয় শতাব্দী) সাথে অ্যারিস্টটলের কথোপকথন উল্লেখ করেছেন l এই কথোপকথনে, অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ইহুদিরা ভারতীয় দার্শনিকদের বংশধর l[২২]
এই তথ্যগুলির ঐতিহাসিকতা বিচার বর্তমান প্রবন্ধের সীমানার বাইরে । কিন্তু সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে ধরে রাখা কোনও কাহিনীই আকাশ থেকে পড়ে না । আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল এই গ্রীস-পারস্য-ইহুদি-ভারতীয় যোগের গ্রন্থ-প্রমাণ । এই সংস্কৃতির মিলনস্থল বা সংযোগ স্থলের মুখ্য ভূমিকায় যে গান্ধার অঞ্চল, তা বলাই বাহুল্য l
আলেক্সান্ডার মারা যান ৩২৩ খ্রিষ্ট পূর্ব-তে l আলেক্সান্ডারের পরে সেলিউসিড সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়, রাজা হন অ্যান্টিওকোসের পুত্র সেলুকাস l ফলে গ্রীক-বৈদিক যোগাযোগ আরো দৃঢ় হয় l ২৮১ খ্রিষ্ট পূর্বে, যখন সেলুকাস নিকেটর নিহত হন, তখন সে এক বিরাট সাম্রাজ্য এবং গান্ধার ছিল এর অংশ l পূর্বে গান্ধার এবং পশ্চিমে জেরুজালেম এক সময় সেলিউসিড সাম্রাজ্যর সীমানা ছিল l সেলিউসিড সাম্রাজ্য খ্রিষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরও জেরুসালেম ছিল তাদের দখলে l
এইবার আমরা এক চরিত্র পাচ্ছি l হেলিওডোরাস l তাঁকে ভারতে দ্যুত করে পাঠান ইন্দোগ্রীক রাজা অ্যান্টিয়ালসিডাস নাইকফোরোস (Antialcidas Nikephoros) l সময়কাল খ্রিষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি । তাঁর রাজ্য ছিল পাঞ্জাব অবধি l রাজধানী তক্ষশীলা l পাণিনি আমাদের বাসুদেব উপাসনার তথ্য দিয়েছেন; আবার এই তক্ষশীলা থেকে আগত হেলিওডোরাসও বাসুদেব উপাসক ছিলেন ।
হেলিওডোরাস নির্মাণ করেন গরুড়স্তম্ভ l অধুনা বিদিশার কাছে । স্তম্ভটি স্থানীয় মানুষদের কাছে খাম্বাবাবা নামে পরিচিত l
আবার আমরা পাচ্ছি হেলিওডোরাসকে অন্য ভূমিকায় l
ইহুদিদের “ম্যাক্কাবিস গ্রন্থ” (2য় শতাব্দী খ্রীপূ) হিব্রু বাইবেলে না থাকলেও, সেপটুয়াজিন্টে (Septuagint)[২৩] হিব্রু বাইবেলের সাথে একই পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় l সুতরাং তার ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য l ইহুদিদের ও জেরুসালেমের প্রাচীন ইতিহাস নির্মাণে এই গ্রন্থের বিরাট ভূমিকা l লেখক অজ্ঞাত l গ্রন্থে মূল বর্ণিত, কিভাবে ইহুদিরা সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধীনস্থা থেকে স্বাধীন হয়েছিল হাসমনিয়ান বংশের নেতৃত্বে, কিভাবে তারা জেরুসালেম পুনর্দখল করে (খ্রিষ্ট পূর্ব ১৬৪), জেরুসালেমে দ্বিতীয় মন্দির উৎসর্গ করে এবং ইহুদি পবিত্র দিবস হনূক্কার (Hanukkah) উৎপত্তি হয় l
এই “ম্যাক্কাবিস গ্রন্থে” (Book of Maccabees) বর্ণনা আছে ইহুদিরা সেলুসিড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন l ম্যাক্কাবিসের প্রথম বই বর্ণনা করছে খ্রিষ্ট পূর্ব ১৭৫-১৩৪-র ঘটনা, আর দ্বিতীয় বই বর্ণনা করছে খ্রিষ্ট পূর্ব ১৭৬-১৬১-র ঘটনা l ম্যাক্কাবিসের মতে, সেই সময়ে জেরুসালেমে ভারতীয় পদাতিক সেনাবাহিনী ও ভারতীয় হস্তিবাহিনী সেলুসিড সাম্রাজ্যের হয়ে লড়াই করেছে l অর্থাৎ জেরুসালেমে বৈদিক ভারতের কোনো রাজার বা রাজন্যগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছিল l
হেলিওডোরাস, সেলুসিড রাজার হয়ে জেরুসালেমের ইহুদিদের মন্দির লুঠ করতে গিয়েছিলেন l ম্যাক্কাবিসের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানা যায়, জিহভা তাকে বাধা দেন l প্রথমে ঘোড়ারসওয়ার রূপে স্বর্ণ-বর্ম পরিহিত ও অস্ত্রসজ্জিত যোদ্ধার রূপে । তারপর আরো দুটি সুদর্শন বালকরূপে, যাঁরা প্রচন্ড শক্তিমান ও অসাধারণ সুন্দর l সেই দুই বালক হেলিওডোরাসকে বাধা দেন এবং আঘাত করে মন্দির লুন্ঠনে বিরত করেন l তিনি জ্ঞান হারান l এরপরেই হেলিওডোরাসের ভাবান্তর আসে l তিনি ঈশ্বরের মহিমা অনুভব করেন l
বিবেচ্য বিষয়, জেরুসালেমের মন্দির লুন্ঠনপ্রয়াসী হেলিওডোরাসই ভাগবতভক্ত বিদিশার হেলিওডোরাস কিনা l তার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে l দুর্ভাগ্যর বিষয়, জেরুসালেমের হেলিওডোরাস এবং বিদিশার হেলিওডোরাস বিষয়ে আর কোনো তথ্য ঐতিহাসিকরা পাননি l তিনিই যদি তক্ষশীলা থেকে আগত বিদিশার হেলিওডোরাস হন, তাহলে এভাবে ইতিহাস নির্মাণ করা যায় যে, এরপরে হেলিওডোরাস ভারতে দ্যুত হয়ে আসেন, এবং অধুনা বিদিশায় কৃষ্ণ বাসুদেবের উদ্দেশ্যে গরুড়স্তম্ভ নির্মাণ করেন l
বৈষ্ণব ধৰ্মীয় বিশ্বাসী মতে, হেলিওডোরাস জেরুসালেমে যে ঘোড়ার সওয়ার দেখেছিলেন, তিনি বিষ্ণুর অবতার কল্কি l আর দুই বালকরূপে তাঁকে যারা দেখা দিয়েছিল, তাঁরা হলেন কৃষ্ণ ও বলরাম l
আমাদের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য হবে কাহিনীটি রূপকার্থে নেয়া l
৮. মহাভারতে গান্ধার
রামায়ণ, মহাভারত, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, প্রাচীন ভারতবর্ষের যে স্থান বা অনুরাষ্ট্রগুলি বা স্বাধীন জনপদগুলি প্রধান হিসাবে গণ্য হত, তার অন্যতম ছিল গান্ধার l
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে যে ভারতবর্ষের বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে কাশ্মীর, সিন্ধু, সৌবীর প্রদেশের সাথে গন্ধর্ব দেশের উল্লেখ আছে (৬.১০)।
বেদব্যাসের মহাভারতে গান্ধারের বিরাট ভূমিকা l বর্তমান মহাভারত গ্রন্থের জন্মবৃত্তান্তর সাথে তক্ষশীলা যুক্ত l মহাভারতে জানা যায়, অর্জুনের প্রপৌত্র জনমেজয় (পরিক্ষিতপুত্র) তক্ষশীলা জয় করেছিলেন (১.৩.১৭৯)। অর্জুনের পৌত্র পরিক্ষিতকে হত্যা করেন নাগ তক্ষক l পিতৃহত্যার প্রতিশোধ বাসনায়, জনমেজয় সর্পসত্র আয়োজন করেন তক্ষশীলায় (১৮.৫.২৯)। সেই যজ্ঞে, বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন মহাভারত শোনান l রাজা এবং সাধারণ মানুষের সামনে এটিই মহাভারতের প্রথম আবির্ভাব l
মনে রাখা প্রয়োজন, মহাভারত বললে রামায়ণও বোঝায় l কারণ, মহাভারতে একাধিকবার দাশরথি রামের উল্লেখ আছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে, এবং সম্পূর্ণ “রামকথা” আছে (যদিও বাল্মীকি রামায়ণের তুলনায় তা অনেক সংক্ষেপে) ঋষি মার্কণ্ডেয়র কথাকতায় (৩.২৫২-২৭৫)। বনবাসকালে, যুধিষ্ঠির তাঁর নিজ জীবনের সাথে রামের মিল পেয়েছেন l কৃষ্ণ দুইবার রামস্মরণ করেছেন (৯.৩০.১০; ১২.২৯.১-৫৫), এবং যুধিষ্ঠিরকে রামরাজ্যর আদলে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে উদ্দীপ্ত করেছেন l ব্যাস এইভাবে, রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই ঐতিহ্যকে একত্রে এনেছেন ।
বেদব্যাসকেও তাই রামায়ণের দ্বিতীয় রচয়িতা বলা যায় l
গান্ধার রাজকন্যা গান্ধারী হলেন ধৃতরাষ্ট্রের মহারানী এবং দুর্যোধন প্রভৃতি কৌরবদের মাতা l মহাভারতে কুরুপান্ডব দ্বন্দ্ব ও শত্রুতার যে কেন্দ্রীয় কাহিনী, তার অন্যতম ইন্ধনদাতা গান্ধাররাজ শকুনি l মূলতঃ শকুনির প্রভাবেই দুর্যোধন শৈশব থেকে পাণ্ডববিরোধী হয়ে ওঠেনl
মহাভারতেও, গান্ধার-মগধ অক্ষ আছে । জরাসন্ধ ছিলেন মগধের সম্রাট । তাঁর জীবিতাবস্থায়, গান্ধাররাজ শকুনি প্রভাবিত হস্তিনাপুর মগধের মিত্র ছিল; এমনকি দুর্যোধন, যাদব ও কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল (হরিবংশ)। জৈন ঐতিহ্যে, জরাসন্ধের “প্রতি-বাসুদেব” রূপে বড় ভূমিকা আছে (ত্রিষষ্টিশলাকাপুরুষ চরিত)।
মহাভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হল ধর্ম। ধর্ম শব্দটির তাৎপর্য বহুমাত্রিক । ব্যাস ধর্ম বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ দেখিয়েছেন । তাই, গান্ধাররাজ শকুনির ধর্মীয় বক্তব্যের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না । তাঁর বৈপরীত্যমূলক অবস্থানের মাধ্যমে, ব্যাস এবং কৃষ্ণের ধর্মর তাৎপর্য আলোকিত হয়েছে । এই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে, ধর্ম ধারণার বিবর্তনে গান্ধারের ভূমিকা রয়েছে l
ব্যাস এবং কৃষ্ণের ধর্মর বাস্তব প্রয়োগ করেছেন গান্ধারী । মহাভারতের আদি পর্বে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে মহাভারতের অন্যতম চরিত্র রূপে । বর্তমান মহিশুরের (Mysore) হেব্যা গ্রামে, গান্ধারীর মন্দির আছে ।[২৪]
মহাকাব্যের চেতনার একটি সত্য, কোন কিছুকেই চূড়ান্ত কালো এবং সাদা হিসাবে মেরুকরণ করা যায় না । মহাভারতেও কোনো চরিত্রকেই সাদা-কালো এই মেরুকরণে দেখা যায়না l বেদব্যাস সমস্ত চরিত্রের নিজস্বতা ও গুণ বর্ণনা করেছেন l সেই সাংস্কৃতিক স্মৃতি বহন করে “লোক-মহাভারত” (folk)l
ভারতবর্ষে এমন স্থান আছে যেখানে এই আধুনিক সময়েও শকুনি ও দুর্যোধনের দেবতা জ্ঞানে পূজা হয় l কেরালার কোল্লাম জেলায়, কোটটারাক্কারার কাছে পবিত্রেশ্বরমে শকুনির মন্দির আছে, যা “ময়ম কট্টুমলঞ্চরুবুমলনদ” মন্দির নামে পরিচিত l গান্ধার এবং কেরালার এই লোক সংযোগটিও কৌতূহলোদ্দীপক ।
যারা হিন্দু ধর্মকে একচেটিয়া সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে, যারা ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দুদের বহুত্ববাদী প্রকৃতি অস্বীকার করে, তাদের মনে রাখা উচিত গান্ধাররাজ শকুনির পূজা হিন্দুধর্মের অংশ l হিন্দুধর্মকে বুঝতে এ তথ্যও মাথায় রাখতে হবে l
ধৰ্মীয় বিশ্বাস সরিয়ে, যুক্তির চোখে বিষয়টি দেখলে, আমার মতে, শকুনির পূজা আসলে গান্ধারের সাংস্কৃতিক স্মৃতি বহনের লৌকিক ও প্রতীকী রূপ l বৈদিক হিন্দুধর্মে পূজা মানে নিছক আচাররীতি (rituals) নয়, পূজা হল শ্রদ্ধার প্রকাশিত প্রতীকী রূপ l গান্ধাররাজ শকুনি ছাড়া মহাভারত কল্পনা করা যায়না l সেই কুখ্যাত পাশাখেলা শকুনিই খেলেছিলেন যুধিষ্ঠিরের সাথে, ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞায় এবং দুর্যোধনের ইচ্ছায় l সেই পাশা-সভাতেই দ্রৌপদী চূড়ান্তভাবে অপমানিত হন l সেই পাশাখেলার পরিনাম পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর বনবাস, এবং তার পরিনাম কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ l শকুনি সেই যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন l কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর, যুধিষ্ঠির যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, তখন অর্জুন গান্ধারকে আবার করদরাজ্য করেন l মহাভারতের ঐতিহাসিকতা বর্তমান প্রবন্ধে আলোচ্য নয় l আমার কাছে, মহাভারতে গান্ধার সংক্রান্ত সমস্ত কাহিনী ও উল্লেখ তৎকালীন ভারতবর্ষে গান্ধারের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার অলঙ্ঘনীয় প্রমাণ l মহাভারতেই প্রথম ভারতবর্ষ নামক ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র বিষয়ক রাজনৈতিক ধারণা ও আদর্শ পাওয়া যায় l পরবর্তীকালে, হিন্দুপুরাণে, বৌদ্ধ ও জৈনসূত্র ও সাহিত্যে তা অনুসৃত হয়েছে l
কম্বোজ, মদ্র এবং বাহ্লিক গান্ধারের প্রতিবেশী ছিল। কুরুদের একটি শাখা বাহ্লিক শাসন করত। বাহ্লিক সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের হাতে নিহত হন। কর্ণ শাল্য সংলাপ (৮.৩০) থেকে জানা যায় যে বাহ্লিক এবং মদ্র অঞ্চলগুলি কুরু পাঞ্চাল ও মগধের সাপেক্ষে, অধার্মিক ও অনৈতিক বলে বিবেচিত হত। এটি অবশ্যই বৈদিক যুগের স্থানভিত্তিক অর্থোডক্সি অর্থোপ্রেক্সির দৃষ্টিকোণ । মহাভারতের সময়, কুরু এবং পাঞ্চাল ছিল বৈদিক কেন্দ্র। গান্ধার, যবন এবং কিরাতকে বলা হয়েছে ম্লেচ্ছ (১২.৬৫.১৩) l
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, “ম্লেচ্ছ”, “ব্রাত্য”, “অনার্য” – এই শব্দ-ধারণাগুলি কোন চূড়ান্ত বস্তুগত সত্তা বা অস্তিত্ব বোঝায় না; অর্থাৎ “বাইরের” বস্তুজগতে এদের ‘চূড়ান্ত’ সামাজিক পরিচয়ের অস্তিত্ব নেই l শব্দ-ধারণাগুলি বরং ব্যক্তিগত অথবা কোনো গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের ধারণা l অর্থাৎ এগুলি আপেক্ষিক, বলা যায় “লেবেল”, যা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় “অন্য”-র বিরুদ্ধে বা “অন্য”-সম্পর্কে ব্যবহার করতো । উদাহরণ, বৌদ্ধরাও যেকোনো অবৌদ্ধ সম্পর্কে “মিলখ্য” (ম্লেচ্ছ) শব্দ ব্যবহার করেছে্ন; জৈনরাও অজৈন সম্পর্কে করেছেন (সূত্র কৃতাঙ্গ ১.২.১৫, ১৬ l আচরাঙ্গ সূত্র ২.১১.১৭ l তত্ত্বর্থ সূত্র ৩.৩৬)l
ভারতীয় ঐতিহ্য মতে, পুরাণও বেদব্যাস বিরচিত ।
পুরাণেও গান্ধারের উল্লেখ আছে । লিঙ্গ পুরাণে গান্ধারের দুজন ঋষি মুনিসত্তমের কথা বলা হয়েছে – উশিকা এবং কুশিকা (১.৪.৬)। লিঙ্গ পুরাণে আরো বলা হয়েছে যে গান্ধারে মহাদেবের লীলা আছে (২.৫৪.২২) । মৎস পুরাণে গান্ধার, যবন, সিন্ধু, সৌভির এবং মদ্র একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে (১১৪.৪১)। বিষ্ণু পুরাণ বলছে গান্ধার গান্ধারের ধর্ম অনুসরণ করে (৪.১৭.৪) গরুড় পুরাণে গান্ধার, বাহ্লিক এবং মদ্র একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে (১.৫৫.১৯)।
৯. উপসংহার
যখন এমন খবর প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে যে তালিবান, শিল্পী এবং লোকশিল্পীদের হত্যা করছে, সঙ্গীতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তখন “গান্ধার” যেন এক হৃদয় বিদারক পরিহাস l
সঙ্গীতের সাত স্বর – সারেগামাপাধানি l এর তৃতীয় স্বর সংক্ষেপে “গা” আসলে “গান্ধার”-এর সংক্ষীপ্ত রূপ (মহাভারত ১২.১৭৭.৩৬) l
এখানেও মহাভারত !
তারপর আছে “গান্ধার রাগ” l গান্ধার “রাগ” রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, “নাম রেখেছি কোমল গান্ধার, মনে মনে।“[২৫]
ধ্রুপদী সঙ্গীতে গান্ধার শব্দের যে সুরব্যঞ্জনা, যা মনকে রঞ্জিত করে (“রাগ” শব্দ “রঞ্জ” ধাতু থেকে উৎপত্তি), আজ সেই “গান্ধার” আফগানিস্তান মনে পড়ায় এবং বেসুরো লাগে l
প্রবন্ধের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের “কাবুলিওয়ালা” মনে পড়েছে, শেষেও কবিগুরুকেই স্মরণ হয় l বর্তমান প্রবন্ধে “মহাভারত ও গান্ধার” বিষয়ে কিছু কথা বলেছি, সেই রবীন্দ্রনাথেই আবার মহাভারত, “মহা-ভারত” ও গান্ধার একসঙ্গে পেয়েছি l
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মহাত্মা গান্ধী’ শীর্ষক প্রবন্ধে[২৬] গান্ধার উল্লেখ করে প্রাচীন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখণ্ডতার কথা বলেছেন এবং সেই প্রসঙ্গে “মহাভারতের” গুরুত্বও তুলে ধরেছেন l
আবার তাঁর “শাপমোচন” স্মরণে আসে: “স্খলিত ছন্দ সুরসভার অভিশাপে/ গন্ধর্বের দেহশ্রী বিকৃত হয়ে গেল,/ অরুণেশ্বর নাম নিয়ে তার জন্ম হল/ গান্ধার-রাজগৃহে।“[২৭]
আজ আমরা অপেক্ষায়, আফগানিস্তানের শাপমোচন কবে হবে এবং কোমল গান্ধার শোনা যাবে l কবে গণতন্ত্র, নারীর অধিকার ও সুশাসন ফিরবে l
গান্ধার রাগের “রাগ” শব্দের উৎপত্তি যেমন রঞ্জ ধাতু থেকে, তেমনি রাজধর্ম বা রাজনীতি শব্দের “রাজ” (এবং “রাজা”) শব্দটিরও উৎপত্তি সেই একই রঞ্জ ধাতু থেকে l এ নিরুক্তও মহাভারতের (১২.২৯.১৩১; ১২.৫৯.১২৭) । গৌতম বুদ্ধ “রাজ” শব্দের একই ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন (অজ্ঞঞ সুতান্ত, দীঘ নিকয়, নং ২৭) ।
এটি একটি গভীর দর্শন যে রাজধর্ম এবং সঙ্গীত একই সুরে বাঁধা । সঙ্গীত হল জীবনের রূপক; স্বাভাবিক, কারণ আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস ছন্দে চলছে । গান্ধার যদি গন্ধর্ব থেকে উদ্ভূত হয়, এটা উপযুক্ত, কারণ “গান্ধর্ব” সঙ্গীতকে বোঝায় । গন্ধর্বরা বৈদিক গ্রন্থ অনুসারে সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন l অর্জুন গান্ধর্ব চিত্রসেনের কাছ থেকে সংগীত ও নৃত্য শিখেছিলেন। এবং গান্ধর্ব অবশ্যই জীবনের সঙ্গীত বোঝায়, কারণ প্রাচীন ভারতে বিবাহের একটি রূপ ছিল “গান্ধর্ব বিবাহ” l আধুনিক ভাষায় প্রেম বিবাহ l
যন্ত্রণা এবং নিপীড়ন, জীবনে যাই হোক না কেন, মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম চাবিকাঠি হল আশাবাদ এবং হাসি।
অদ্বিতীয় শিবরাম চক্রবর্তীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, মন হাল্কা করতে কিঞ্চিৎ pun-দোষে রঙিন হওয়ার চেষ্টা করে বলতে পারি, মহাভারতের গান্ধারীর গান্ধার আজ gun-ধারী আফগানিস্তান l
মনে পড়ছে, আফগান লোকসঙ্গীত শিল্পী ফাওয়াদ আন্দরবির কথা । ২০২১ সালের আগস্ট মাসে, তালিবানরা তাঁর বাসায় তাঁর সাথে দেখা করে, এক সাথে চা খায় এবং তারপর তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।[২৮]
মনে পড়ছে, জুলাই ২০২১-এ, তালিবানেরা আফগান কৌতুক অভিনেতা নজর মোহাম্মদকে হত্যা করে ।[২৯] যখন তালিবানেরা তাঁর মাথায় বন্দুক ধরছিল, তখনও তিনি হাসছিলেন ও কৌতুক করছিলেন ।
কোন শক্তি, কোন রাইফেল, কখনও সঙ্গীত এবং হাসি কেড়ে নিতে পারে না । “গান্ধার” সেই সত্যের প্রতীক হিসাবে রয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক খবর, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ ও বিশেষ করে নারীরা, রাস্তায় নামছেন, তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন । পঞ্জশির অঞ্চলে সামরিক প্রতিরোধ এখনও জীবিত আছে ।
দুর্যোধন যখন গান্ধারীর কাছে যুদ্ধ জয়ের আশির্বাদ চেয়েছিলেন, মাতা হওয়া সত্ত্বেও গান্ধারী পক্ষপাতিত্ব করেননি । তিনি বলেছিলেন, “যতো ধর্ম ততো জয়”, অর্থাৎ ধর্ম যেখানে জয় সেখানে ।
মহাভারতের এটিই সার-বানী । ব্যাস সেকথা দিয়েছেন গান্ধারীর মুখে ।
ধর্মর অর্থ religion নয়, ধর্মর এক তাৎপর্য নৈতিক শক্তি । রেলিজিওন নয়, এই তাৎপর্যই বজায় থাক ।
আজ গান্ধার আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এই নৈতিক শক্তিতেই জয়লাভ করুক ।
[এই প্রবন্ধে, ঋগ্বেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ও অর্থশাস্ত্রের ঋক ও শ্লোক সংখ্যা নেওয়া হয়েছে মূল সংস্কৃত ক্রিটিকাল এডিশন থেকে l GRETIL – Göttingen Register of Electronic Texts in Indian Languages. < http://gretil.sub.uni-goettingen.de/gretil.html>%5D
তথ্যপঞ্জী:-
[১] মহাভারত ও রামায়ণের সমস্ত শ্লোক সংখ্যা Bhandarkar Oriental Research Institute ‘Critical Edition’ থেকে নেওয়া।
[২] জয় বা ভারতের মোট শ্লোক সংখ্যা চব্বিশ হাজার l সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, গুপ্ত যুগ পর্যন্ত এক লাখ শ্লোকে বৃদ্ধি পেয়ে “ভারত” হয়েছে “মহাভারত” l এই বৃহত্তর ও বর্দ্ধিত মহাকাব্যটি মহাভারত নামে পরিচিত। এই তত্ত্বের সমস্যা, দুটি বহু প্রাচীন গ্রন্থে “মহাভারত” নাম আছে – পাণিনির “অষ্টাধ্যায়ী” এবং অশ্বলায়ন গৃহ্য সূত্র l
[৩] মোক্ষ শুধু পারমার্থিক নয়, তার ইহজাগতিক তাৎপর্য আছে l যে কোনো ধরনের অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে মুক্তিই হল মোক্ষ। মহাভারতে, মোক্ষ শব্দের 90০% ব্যবহার এই পার্থিব অর্থে। উদাহরণস্বরূপ, সাপের কুণ্ডলী থেকে মুক্তি হল মোক্ষ (১.২.৯৪; ১.১৩.২), শত্রুর কারাগার থেকে মুক্তি হল মোক্ষ (১.১.১১২; ১.২.৯৯)। বুদ্ধ মোক্ষকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন: “ইন্দ্রিয় কামনা ও দুঃখ – এই দুইকে পরিত্যাগ করা, অলসতা দূর করা, দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকা, সমতা-এবং-মননশীলতা, শুদ্ধ মানসিক গুণাবলীর পরিদর্শনে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া।” (অঙ্গুত্তর নিকয় ৩.৩৩, সারিপুত্ত সূত্র) ।
[৪] পচেক বুদ্ধ হলেন এমন ব্যক্তি যিনি বৌদ্ধত্ব লাভ করেছেন কিন্তু ধর্ম প্রচার করেন না বা সংগঠন বা সংঘ গঠন করেন না (মাজঝিমা নিকয় ১১৬, ঈশিগিলি সুত্ত l উদান, ৫. সোনাবগ্গ, ৩. কুৎঠি সুত্ত l এছাড়াও, দরিমুখ জাতক, সোনক জাতক প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ আছে)।
[৫] পাণিনির জন্ম সময় নিয়ে নানা মত আছে। Theodor Goldstücker (January 18, 1821 – March 6, 1872)-এর মত পাণিনি বুদ্ধ-পূর্ব; Martin Haug (January 30, 1827 – June 3, 1876)-এর মত খ্রী পূ ১০০০; A. B. Keith-এর মত, ৮-৬ শতাব্দী খ্রী পূ। পাণিনির ব্যাকরণে বুদ্ধ ও মহাবীরের উল্লেখ নেই । সুতরাং তিনি গৌতম বুদ্ধ-পূর্ব, এটিই আমার কাছে অধিক গ্রাহ্য মত ।
[৬] সেই ভাষার নাম কারো জানা নেই । তবে, ঋগ্বেদে, ‘সংস্কৃত’ শব্দ আছে (১.৩৮.১২; ৫.৭৬.২; ৬.২৮.৪; ৮.৩৩.৯; ৮.৭৭.১১)। আমি বলি, “বৈদিক সংস্কৃত”।
[৭] “But a great calamity overtook Taxila during the lifetime of Buddha. It was conquered by Darius, the Persian monarch who destroyed the dynasty founded by Cyrus, and kept a considerable portion of the North-Western India for a century under his control. Taxila lost its high position as the centre of learning, compelling eminent scholars like Panini, Varsa and Upavarsa to seek the eastern region as a field of work.”
[৮] তিনজন এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে একাডেমিক বিতর্ক আছে ।
[৯] সম্ভবত চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যর বা গুপ্ত বংশীয় চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়-র সমসাময়িক।
[১০] Thapar, Romila. 2003. The Penguin History of Early India: From the Origins to AD 1300. London: Penguin Books.
[১১] Barclay, William (2000). New Testament Words. Westminster John Knox Press. p. 107
[১২] “Eusebia: Greek goddess or spirit of piety, duty & filial respect.” Theoi Greek Mythology. ed. by Aaron J. Atsma. Accessed on 2007-12-11
[১৩] রোমিলা থাপার বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন l
[১৪] বৌদ্ধ মহাবগগ ১.৬.১
[১৫] অন্যভাবে দেখলে, ‘যবন’ অর্থে গ্রীক হতেই হবে, তা আবশ্যিক নয় ।
[১৬] D. Luckenbill. Hittite Treaties and Letters. The American Journal of Semitic Languages and Literatures, Vol. 37, No. 3 (Apr.,1921), pp. 161-211
JSTOR: Accessed: 30-06-2019 16:28 UTC
[১৭] D. D. Luckenbill. The Hittites. The American Journal of Theology, Vol. 18, No. 1 (Jan., 1914), pp. 24-58 JSTOR: Accessed: 30-06-2019 16:29 UTC
[১৮] হিন্দু রেলিজিওনে, ষটকোণ হল কার্তিকের প্রতীক
[১৯] Ussher, J, 1650. Annals of the World: James Ussher’s Classic Survey of World History ISBN 0-89051-360-0 (Modern English republication, ed. Larry and Marion Pierce, Green Forest, AR: Master Books, 2003)
[২০] On Indian Affairs: “All that was said about nature by the ancients is said also by those who philosophise beyond Greece: somethings by the Brahmins among the Indians, and others by those called Jews in Syria.”
[২১] Riedweg, Christoph (2005) [2002], Pythagoras: His Life, Teachings, and Influence, Ithaca, New York: Cornell University Press
[২২] “Jews are derived from the Indian philosophers*; they are named by the Indians Calami, and by the Syrians Judaei, and took their name from the country they inhabit, which is called Judea” [Josephus, Contra Apionem, I, 22.]
[২৩] হিব্রু বাইবেলের একটি গ্রীক সংস্করণ (বা ওল্ড টেস্টামেন্ট), অ্যাপোক্রিফা সহ । খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিশরে গ্রিকভাষী ইহুদিদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং খ্রিস্টান গীর্জা দ্বারা গৃহীত হয়েছিল
[২৪] https://web.archive.org/web/20081007090621/http://www.hindu.com/2008/06/20/stories/2008062057760200.htm
[২৫] পুনশ্চ | কোমল গান্ধার | রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড১৬ (বিশ্বভারতী, ১৩৫০) [বিচিত্রা: বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভার
< http://bichitra.jdvu.ac.in/index.php>
[২৬] মহাত্মা গান্ধী | রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ২৭ (বিশ্বভারতী, ১৩৭২) [বিচিত্রা: বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভার
< http://bichitra.jdvu.ac.in/index.php>%5D
[২৭] পুনশ্চ | শাপমোচন | রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৬ (বিশ্বভারতী, ১৩৫০) [বিচিত্রা: বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভার
< http://bichitra.jdvu.ac.in/index.php>%5D
[২৮] https://www.indiatoday.in/newsmo/video/afghan-folk-singer-shot-dead-by-the-taliban-1847622-2021-08-31
[২৯] https://www.indiatoday.in/programme/world-today/video/taiban-killing-comedian-nazar-mohammad-china-us-1835058-2021-07-31.
তথ্য সূত্র ও পাঠ
ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । ২০১৫। “মহাভারত কথা: পাণ্ডবজন্ম-রহস্যঃ । বর্ধ মান: এভেনেল প্রেস
“উপনিষদ” l অতুল চন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ ও মহেশ চন্দ্র ঘোষ অনূদিত ও সম্পাদিত অখণ্ড সংস্করণ l হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০০
“ঋগ্বেদ সংহিতা” l রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে l হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০০
কৌটিল্য l “অর্থশাস্ত্রম”l ডাঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত ও সম্পাদিত “কৌটিলীয়ম অর্থশাস্ত্রম” (সমগ্র) l সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ২০০২
দেবব্রত দত্ত. ২০১৫.সঙ্গীততত্ত্ব. কলকাতা: ব্রতী প্রকাশনী
“মহাভারতম” (সমগ্র)l হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ প্ৰনীত বঙ্গানুবাদ (স্বকৃত “ভারতকৌমুদী” টীকা এবং নীলকন্ঠ কৃত “ভারতভাবদীপ” টীকা সহ)l বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ
Al-Biruni. India (Abridged Edition). Print 1988. Trans. Dr. Edward C. Sachatus., Ed. Qeyamuddin Ahmad. National Book Trust India
Fǎxiǎn (337 – c. 422) or Fa-Hien, or Fa-hsien. “A record of Buddhistic kingdoms; being an account by the Chinese monk Fâ-Hien of his travels in India and Ceylon, A.D. 399-414, in search of the Buddhist books of discipline”
Haraprasād Śāstrī. Magadhan Literature (a course of six lectures delivered at Patna University in December 1920 and April 1921). Calcutta, Patna University, 1923
Hsüan-tsang or Xuanzang (fl. c. 602 – 664). Great Tang Records on the Western Regions. Taishō Volume 51, Number 2087. trans. Li Rongxi. BDK America, Inc. 1996
Joel P Brereton & Stephanie W. Jamison, 2014 (trans.). The ṚgVeda: The Earliest Religious Poetry of India. Volume Set. 1-3. Oxford University Press
Kauṭilya. Arthaśāstra. 1915. Trans. R. Shamasastry. Bangalore: Government Press
Kṛṣṇadvaipāyana Vyāsa. Mbh. Critical Edition. 1919-1966. Pune: Bhandarkar Oriental Research Institute. ‘The Machine-Readable Text of the Mbh’ Based on the Poona Critical Edition, Produced by Muneo Tokunaga, Kyoto, Japan
Louis Renou. 1971. Vedic India. (Trans. from French by Philip Spratt). Varanasi Delhi India: Indological Book House
Mahābhārata [1883-1896]. Trans. into English prose by Kisari Mohan Ganguli. Scanned at sacred-texts.com, 2003
Mahābhārata (Bengali). 1886. Trans. into Bengali prose by Kālīprasanna Siṃha.
Kolkata: Sahitya Tirtha Publishers, (reprint 14th Ed. 2018)
Monnier Williams. 2002 (reprint). A Dictionary of Sanskrit-English. New Delhi: Munshiram Manoharlal
R. T. H. Griffith. 1999 (reprint). Hymns of the ṚgVeda. Delhi: Munshiram Manoharlal
Thapar, Romila. 1990 (1966). A History of India, Vol 1. Penguin Books
WEBSITES
Internet Sacred Text Archive Home. < https://www.sacred-texts.com/> [বৈদিক গ্রন্থ, বৌদ্ধ জাতক এবং জৈন সূত্রের সমস্ত অনুবাদ এই সাইট থেকে নেওয়া হয়েছে]
Perseus Digital Library. < https://www.perseus.tufts.edu/hopper/>
[এই প্রবন্ধে উল্লেখিত সমস্ত গ্রীক গ্রন্থ এই সাইট থেকে নেওয়া হয়েছে]
[লেখক – সহযোগী অধ্যাপক, ইংরাজি বিভাগ, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ।]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story