সম্পাদকীয়
‘ময়লা ঢিলা কাপড় পরা, পাগড়ি মাথায়, ঝুলি ঘাড়ে, হাতে দুই-চার আঙুরের বাক্স’ ছিল সেদিনের ছোট্ট মিনি’র মনে। কাবুল থেকে আসা বলে ‘কাবুলিওয়ালা’র একটা ছবি। কাবুলিওয়ালার নাম ছিল রহমত। রহমতের ঝোলায় অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। রহমত মিনিকে বলিত ‘খোখী, তোমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না!’ ‘কাবুলি মেঘমন্দ্র স্বরে ভাঙ্গা বাংলায় স্বদেশের গল্প করিত আর ‘দুই ধারে বন্ধুর দুর্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রেণী, মধ্যে সঙ্কীর্ণ মরুপথ, বোঝাই করা উস্ট্রের শ্রেণী চলিয়াছে, পাগড়ি-পরা বণিক ও পথিকেরা কেহ বা উটের পরে, কেহ বা পদব্রজে, কাহারও হাতে বর্শা, কাহারও হাতে সেকেলে চকমকি-ঠোকা বন্দুক …’
রহমতদের নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল, সন্দেহ ছিল ‘কাহারও কি কখনও ছেলে চুরি যায় না। কাবুল দেশে কি দাসব্যবসায় প্রচলিত নাই। একজন প্রকাণ্ড কাবুলির পক্ষে একটি ছোট ছেলে চুরি করিয়া লইয়া যাওয়া একেবারেই কি অসম্ভব’ – ইত্যাকার নানা প্রশ্ন সন্দেহ ছিল ঠিক। তথাপি মিনি ‘কাবুলিওয়ালা ও কাবুলিওয়ালা করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া আসে এবং দুই অসমবয়সী বন্ধুর মধ্যে পুরাতন সরল পরিহাস চলিতে থাকে, তখন সমস্ত হৃদয় প্রসন্ন হইয়া উঠে”। আবার একদিন সেই “রহমতের গাত্রবস্ত্রে রক্ত চিহ্ন এবং একজন পাহারাওয়ালার হাতে রক্তাক্ত ছোরা’সহ ‘দুই পাহারাওয়ালার বাঁধিয়া লইয়া’ আসিবার পশ্চাদকাহিনি এক প্রতিবেশী “রামপুরী চাদরের জন্য রহমতের কাছে কিঞ্চিৎ ধারিত – মিথ্যাপূর্বক সেই দেনা অস্বীকার” আর যাই হোক মিথ্যাবাদীকে রহমত ক্ষমা করেনি। আইন হাতে তুলে নিয়েছে অপরাধে রহমত ‘শ্বশুরবাড়ি’ গেল। যখন সেখান থেকে ফিরল তখন আর সেই মিনি নেই। মিনির সেদিনের বেশ রহমতকে মনে করিয়ে দিয়েছিল “তাহার মেয়েটিও ইতিমধ্যে এইরূপ বড়ো হইয়াছে…” বুকের মাঝে রাখা ভুষো কালিতে শিশুর মলিনতর দু’হাতের সেই ছাপ বুকে লইয়া দেশে ফিরিতে মনস্থ করিল…
রবি ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোট গল্পটি সম্পর্কে মধ্যবিত্ত কমবেশি পরিচিত। তপন সিংহের পরিচালনায় রহমত-এর নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস এক অনবদ্য রূপায়ণ, আজও গেঁথে আছে অনেকের হৃদয়ে। জিজ্ঞাসা অনন্ত, থামে নি কোথাও। রবীন্দ্রনাথ আজ বেঁচে থাকলে আর সেই কাবুল আর কাবুলিওয়ালাকে হয়ত খুঁজে পেতেন না। তিনি রহমতকে আর তাহার ‘মিনি’কে ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। কারণ শিক্ষার অঙ্গন হইতে ফতোয়া বলে তাদের নির্বাসন ঘটেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ছবিটি আলবাত দুনিয়ার যেখানেই হোক তালিবানরা মহিলাদের পর্দায় ঢেকেছে এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বৈ অন্য কোনভাবে দেখে নি – এই দৃশ্য রবীন্দ্রনাথের নজর এড়াতো না।
তালিবানের দেশ আফগানিস্তান থেকে বাদাম পেস্তা আখরোট কিসমিস নয় তিন হাজার কিলোগ্রাম হেরোইন সদ্য এসে গুজরাটের ‘মুন্দ্রা’ নামাঙ্কিত বন্দরে যাহা রাষ্ট্রের পরম আত্মীয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন, খালাস হল, বাজারে যাহার অর্থমূল্য একুশ হাজার কোটি টাকার কম নয়, এটা কি তাঁর দৃষ্টির বাইরে থাকত?
আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ অঢেল সম্পদ, ১৪০০ ধরণের খনিজ রয়েছে যার মূল্য ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (৭,৩৮,৩৬,২০,০০,০০,০০০.০০ ভারতীয় টাকা)। দেশটিতে অমূল্য সব রত্ন, পাথর, রুবি, পান্না, টুরমালাইন এবং ল্যাপিস জুলি ছাড়াও লোহা, তামা, ব্যারাইট, লিথিয়াম, কোবাল্ট, কয়লা, সীসা, দস্তা, সল্ট, সালফার, বক্সাইট, পারদ, ইউরেনিয়াম এবং ক্রোমিয়াম এবং খনিজের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। দেশটি আফগানিস্তান, রাজধানী যার কাবুল, অঢেল সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দেশটি আজও কৃষিনির্ভর, লাভের লুঠের দাঁওপ্যাঁচে পঞ্চান্ন শতাংশ মানুষ গরিবি সীমার নিচে, বেয়নেটের মুখে বাস করে, মানব-সুচকে যার স্থান একশ সত্তরে! কারণ স্বাধীনতা সেখানে নাই, মানবতা ধর্ষিত, সম্পদ লুণ্ঠিত।
তবু সেই লুণ্ঠনের মুখেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আছে। যেমনটি পঞ্জশির করেছে, শেষ তক মাথা নোয়ায় নি, বেয়নেটের মুখে, ভয়ের মুখে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করেছে কাবুলের শিশু নারী পুরুষ। ইতিমধ্যেই তাঁরা জানান দিয়েছে কাবুলে কেবল তালিবান নাই, তারাও আছে। অন্যদিকে দুনিয়ার সমস্ত শক্তিমান দেশ এই তালিবানি ‘সরকার’কে ‘শর্তাধীন’ সমর্থন দিয়েছে যারা ‘শর্ত’ মোতাবেক এখনও সরকার গড়ে তুলতে পারল না অথচ রাষ্ট্রপুঞ্জে আসন দাবি করে বসেছে!! সকলেই নিজের দিকে ঝোল টাবার জন্য জল মাপছে…
এর মধ্যেই রহমত ও তার কন্যা এবং সমগ্র প্রেক্ষাপটকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে ‘অপরজন’ চেষ্টা চালিয়েছে। আফগানিস্তানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতি; প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল ও পরিবর্তন – রাজনীতি এবং অর্থনীতির আঁকবাঁক, ছাত্র পরিবর্তে জঙ্গি হয়ে ওঠার উপন্যাসের নানা চরিত্র নানান দিকে আলো ফেলবার চেষ্টা করেছে। যাঁরা এই কাজে সহায়তা করলেন তাঁরা প্রত্যেকেই মানবিকতার একটি দাবি পূরণ করতে চেষ্টা করলেন – তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কেবলমাত্র মামুলী নয় … কারণ ‘মিনি’রা অপেক্ষায় … মিনি’রা যেখানেই থাকুক একটা দেশ নির্মাণের দিকে, জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে… এই পদক্ষেপ সারা দুনিয়া জুড়ে চলছে যার প্রতি কেউ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না।
সেপ্টেম্বর, ২০২১
Posted in: EDITORIAL, September 2021