আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা: প্রথমের পতন ও দ্বিতীয়র উত্থান পর্বে : ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল
১.১ আফগানিস্তানের চেহারা
প্রায় ৪ কোটি মানুষের দেশ আফগানিস্তানের বেশিরভাগ মানুষই এখনও দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। আফগানিস্তানে প্রায় কুড়িটিরও বেশী জাতিগোষ্ঠীর বাস। এই জাতিগোষ্ঠী আবার অসংখ্য উপজাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। প্রত্যেকটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে এটা এক বড় প্রতিবন্ধকতা। চারদিকে যে দেশগুলো আফগানিস্তানকে ঘিরে রেখেছে তারা হল পাকিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, চীন। যে জাতিগোষ্ঠী নিয়ে আফগানিস্তান গড়ে উঠেছে-“পাস্তুন-৪২%, তাজিক ও ফারসিওয়ান-২৭%, উজবেক-৯%, হাজারা-৯%, আইমাক-৪%, টারকোমান-৩%, বালুচ ও ব্রাহুই-২%, অন্যান্য-৪%”[১]। ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। পার্বত্য এলাকা হিসাবে পরিচিত। অধিকাংশ মানুষ কথা বলেন পাশতো অথবা দারি ভাষায়। “শিক্ষা ও সভ্যতার আলো থেকে আফগানিস্তানের অধিকাংশ মানুষ আজ বঞ্চিত… আমাদের দেশের শিশুরা সরস্বতীর কাছে হাতেখড়ি দিয়ে কলম ধরে. আর এ দেশের শিশুরা শপথ করে বন্দুক হাতে তুলে নেয়। দেশের অবস্থা খুবই শোচনীয়।”[২] প্রথম তালিবান সরকারের পতনের সময়ে (২০০১) আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল, আবার দ্বিতীয় তালিবান সরকারের উত্থান পর্বে (২০২১) অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন সেই সম্পর্কে আলোচনা ও পর্যালোচনা এই প্রবন্ধের প্রধান প্রতিপাদ্য।
১.২ আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা
অর্থনৈতিক অবস্থাকে যদি বিবেচনায় আনি, তাহলে এই মুহূর্তে গরিব দেশগুলোর অন্যতম প্রধান নামটি হল আফগানিস্তান। বছরের পর বছর যুদ্ধ, গৃহ যুদ্ধ চলেছে। আর তার পরিণামে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে দারিদ্র্যের রমরমা বেড়েছে। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। এই মুহূর্তে “রাষ্ট্রসংঘের মধ্যে আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। এখানে শিশু মৃত্যুর গড় হার সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার ৫০% বেকার, মুদ্রাস্ফীতি ৫০০%। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ গৃহহীন। প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষ ইরানে এবং ৯লক্ষ মানুষ পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। দেশের ৮৬৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ১০ লক্ষ ল্যান্ডমাইন পাতা আছে।”[৩] প্রথম তালিবান শাসনের (১৯৯৬-২০০১) শেষ পর্বে চেহারা ছিল- ২০০০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৬ শতাংশ মাত্র। মেয়েদের সাক্ষরতার হার মাত্র ২১ শতাংশ, ছেলেদের সাক্ষরতার হার ৫১ শতাংশ।
কৃষি নির্ভরতা
৮৫ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে জীবন যাপন করেন। যদিও অধিকাংশ আফগানদের খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। অথবা নির্ভর করতে হয় ত্রাণ সরবরাহকারীদের উপর। “আফগানিস্তানের সুস্থ কৃষি অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য অর্থ সাহায্যের আহ্বানে বিশ্বের শক্তিমান কোন রাষ্ট্রই এগিয়ে আসেনি। অথচ আফগানিস্তানের সভ্য, সুস্থ, বৈধ সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করার কাজটা তারাই করে চলেছে। তারাই সমগ্র মধ্য এশিয়াকে মারণ বিষে আসক্ত করেছে ধর্মযুদ্ধ আর হেরোইনের আঘাত। পপি চাষের কৃষিকাজকে তালিবান সরকারের যুদ্ধ অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি হিসেবে গড়ে দিয়েছিল এরাই”।[৪]
পরনির্ভরশীলতা
তবে সার্বিকভাবে এটা বলা যায় যে, আফগানিস্তানের অর্থনীতি অনেকটাই পরনির্ভরশীল। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বাণিজ্য, অর্থনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ওপর আফগানিস্তানের অর্থনীতির গতিপথ নিয়ন্ত্রিত হয়। শ্রম শক্তি নিয়ে যদি আলোচনা করতে হয় বলা যায় আফগানিস্তানের অধিকাংশ শ্রমশক্তিই স্বনিযুক্ত। এরা কৃষি অথবা ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য যুক্ত। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে গিয়ে ও নিজেদের দেশেও ঠিকা শ্রমিক হিসেবে অনেকে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
মাদক নির্ভর অর্থনীতি
আফিম সহ বেশকিছু মাদকদ্রব্যের অবাধ বাণিজ্য চলে এই দেশে। “তালিবান সরকার আফগান চাষিদের জন্য মৌলবি উলেমাদের ‘সুরা’, ধর্ম সম্মেলন বসিয়ে আফিম চাষের জন্য ‘ইসলামের অনুমোদন’ আনিয়ে নিয়েছে। যদিও কোরানে এই নেশা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।… আফিম চাষে খ্রিস্টীয় অনুমোদনটা এসেছিল আরো আগে। খোদ ওয়াশিংটন আর সিআইএ-র সদর দপ্তরের ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা দিয়েছিলেন সেটা। তবে শুধু কৃষিকাজের অনুমোদন। …. আফগানিস্তান শুধু কাঁচা কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র। শিল্পপণ্য হিসেবে তাকে রূপান্তর করে নেবে সিআইএ’র পুরনো কোনো ধর্মযোদ্ধা যারা খ্রিষ্টেও আছে ইসলামেও আছে..।”[৫] আফগানিস্তানের তদানীন্তন তালিবান এন্টি ড্রাগ কন্ট্রোল ফোর্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত আব্দুর রশিদ এর মতে, “আফিম চাষটা ইসলাম অনুমোদন করে। কেননা পশ্চিমের কাফেররা এটাতেই আসক্ত, মুসলিম কিংবা আফগানরা নয় “[৬]।
রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। তালিবানরা “সরাসরি ড্রাগকে ভিত্তি করে তার অর্থনীতি গড়ে তোলার পথে হেঁটে ছিল। রাজস্ব সংগ্রহের জন্য ড্রাগ কিংবা পপি চাষকেই সরকারি আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের কোনো রাখঢাকও ছিল না। ….. মার্কিন উপদেষ্টা মণ্ডলীর সুপরামর্শে তালিবান সরকার সমস্ত আফিম ডিলারদের কাছ থেকে ইসলামী ‘জাকৎ’ আদায় করার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল”[৭]। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য প্রণিধানযোগ্য যেটা পড়লে পরিষ্কার হবে কোন স্বার্থে মার্কিন দেশ এমন উপদেশ দিয়েছিলো। “ইউএনডিসিপির হিসেব অনুযায়ী আফিম চাষের অতিমুনাফার মাত্র ১ শতাংশ পেত আফগান চাষিরা। ২.৫ শতাংশ থাকতো আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের ডিলারদের কাছে। ধনতান্ত্রিক বিশ্বের মূল মাতব্বরদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মধ্যবর্তী দেশগুলির ড্রাগ রুট ব্যবহারের প্রয়োজনে ব্যয় হত ৫ শতাংশ। বাকী ৯২ শতাংশের কিছু বেশি মুনাফা নিংড়ে নিতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ড্রাগ মাফিয়ারা।”[৮]। কুড়ি বছর আমেরিকা শাসন করেছে আর শহরে পতিতাবৃত্তি বহু গুণ বেড়েছে, আসলে মার্কিনীরা যেখানে যায় তাই হয়।
মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ২০ বছরের সরকারের (২০০১-২১) অবদান
বাইরের দেশের আর্থিক সাহায্যের ওপরেই নির্ভর করে চলেছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি। “২০০৯ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ১০০ শতাংশের সমান ছিল আর্থিক সাহায্য। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব, আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ২০০৩-২০১২ এর মধ্যে ছিল ৯.৪ শতাংশ। ২০১৫-২০২০ এর মধ্যে এই গড় কমে দাঁড়ায় ২.৫ শতাংশ।… আফগানিস্তান থেকে আফিম ও আফিমজাত মাদকের রপ্তানি বছরে ২১০ কোটি ডলারের কাছাকাছি হয়ে গেছে। মার্কিন কংগ্রেসের গবেষণায় জানানো হয়েছে ৯০ শতাংশ মানুষের আয় দৈনিক ২ ডলারের কম। ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে। ২০ লক্ষ আফগান শিশু ক্ষুধার্ত।… আফগানিস্তানে মাত্র ৬০ লক্ষ শিশু স্কুলে যায়। দেশের স্কুলের সংখ্যা ১৭ হাজার, যার ৪১ শতাংশের কোন বাড়ি নেই। ২০২০ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৩ শতাংশ,মহিলাদের ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ।”[৯]।
সুতরাং পরিকাঠামোর বিপুল উন্নতির গল্পটিও কতটা অতিরঞ্জিত সেটাও সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। “দেশের ৩৫ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। এই বিদ্যুতের ৭০ শতাংশ আমদানিকৃত এবং বিপুল চড়া দামে কেনা। এই পরিকাঠামো নির্মাণের কাহিনীতেও লুকিয়ে আছে আফগানিস্তানের অনেক রহস্যই। কারণ অধিকাংশ প্রকল্পের বরাত পেয়েছে মার্কিন ও তাদের মিত্র দেশের ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা.”[১০]। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে তারা আফগানিস্তানের জন্যে দু’লক্ষ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। বাস্তবে এই ব্যয়ের বড় অংশই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাতা সংস্থার কাছে। নিরাপত্তাজনিত খাতে ব্যয় হয়েছে জিডিপির ২৮ শতাংশ, যদিও কম আয়ের দেশগুলোতে গড় ব্যয় ৩ শতাংশ। এই টাকায় বিশেষ করে আফগানিস্তানের বিপুল গ্রামীণ এলাকায় মানুষের উন্নতি করা যেত কারণ সেখানে কোন উন্নতি হয়নি।
এবার দেখা যাক আমেরিকা কুড়ি বছরের শাসনকালে কি রেখে গেল। মার্কিন মদতপুষ্ট গত কুড়ি বছরের সরকারের আমলে আফগানিস্তানে শান্তি সমৃদ্ধি গালিচা পাতা ছিল। বরং সকলেই একমত হয়েছেন যে বেকারত্ব নিরক্ষরতা অপুষ্টি দুর্নীতি একাধিক সমস্যায় জর্জরিত আফগানিস্তান। নীচের সারণীতে একটা চিত্র তুলে ধরা হল যেখানের থেকে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত সরকার কি অবস্থায় রেখে গেল আফগানিস্থানকে তার একটা অনুমান সচেতন পাঠক নিশ্চয় করতে পারবেন:
১.৩ তালিবানে আপত্তি কোথায়?
তালিবান ফিরে এসেছে আফগানিস্তানে। চারদিকে নাকে কান্না শুরু হয়েছে। আপত্তি কোথায়? ওরা মার্কিন দেশের থেকেও খারাপ নাকি? প্রথম দফার (১৯৯৬-২০০১) তালিবানদের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চয়ই নানা প্রশ্নের অবকাশ আছে। ওদের পশ্চাৎপদ মনোভাব নিশ্চয়ই পরিমার্জনের প্রয়োজন আছে। তাই বলে এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে, ‘শ্যাম বিনা গীত নাই’-এর মত মার্কিন দেশ ছাড়া আফগানিস্তানের কোন ভবিষ্যত নেই। তবে এটাও ঠিক যে, প্রথম তালিবান সরকারের আগমন ও পরিণতি প্রচুর সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। “সর্বত্যাগী নির্লোভ পরিত্রাতার ভাবমূর্তি নিয়ে শুরু হয়েছিল তালিবানদের অভিযান। ক্ষমতার প্রতি অনীহার খোলস ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছিল সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারীর মুখ। যারা কারো অংশীদারিত্ব স্বীকার করে না। ভিন্নমত গ্রহণ করে না। কোন বিতর্ক, আলোচনার অধিকার নির্মম ভাবে অস্বীকার করে। এমনকি ভিন্ন কারোর অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুমোদন করে না”।[১২]
তদানীন্তন প্রথম তালিবান সরকারের অর্থ, সামাজিক পরিষেবা, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা দপ্তরের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা ছিলেন কেউ আফিম ব্যবসায়ী, কেউ চোরাকারবারি, কেউ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর নেতা। তারা যেটা ভালো পারতেন বা শিখেছিলেন সেটা হল দেশজুড়ে আফিম চাষ আর সেই চোরাচালানকে কিভাবে বিভিন্ন দেশের সীমান্তে ড্রাগ মাফিয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। অর্থনীতির আর কোন বিষয়ে যথাযথ অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। এই যদি কোন সরকারের কাজের ধারা হয়, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবী রাখে না। কিন্তু সেই ভালোমন্দ মীমাংসার অধিকার তো একান্তভাবেই সেই দেশের মানুষের। কোন-না-কোন অজুহাত খাড়া করে উড়ে এসে জুড়ে বসে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বারবার মার্কিন দেশের মাতব্বরির ব্যাখ্যা কি? কথায় আছে নির্লজ্জের দু-কান কাটা।
২০ বছর আগে আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমেরিকা লাদেনকে খুঁজতে বেরিয়েছিল নিজ দায়িত্বে। সারা বিশ্বকে তারা ক্ষমতা দেখিয়েছিল – আইন-কানুন-আদালত-রাষ্ট্রসংঘ সব আমেরিকার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেমনটা হয়। তার দেশে টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কে হত্যা করেছে, তার শাস্তি কি সবকিছু ঠিক করে নিয়েছে নিজেরাই, কোথাও কোন প্রমাণ হাজির করার দায় নেই। তাই আফগানিস্তান দখল করে ২০ বছর ধরে সেখানে কয়েক লাখ নিরপরাধ মানুষের হত্যালীলা সাঙ্গ করে ওদেশের সম্পদ লুঠ করে বিচারের শাস্তি শেষ হল। দ্বিতীয়বার তালিবান এসে সাড়ে সর্বনাশের আশঙ্কা যারা করছেন, তাদের শুধু একটা কথাই বলব, ওই দেশটার সর্বনাশের আর কিছু বাকি রেখেছে মহান আমেরিকা (সারণী-১ দেখুন)!
আমেরিকা যদি ওদেশের মানুষকে সুখে রাখতো তাহলে এত সহজ হবার কথা ছিল না তালিবানের প্রত্যাবর্তনের। “বড় রকমের জনসমর্থন না থাকলে, অন্তত নীরব অনুমোদন না থাকলে আফগানিস্তানের মতো দেশে এমন ঝড়ের বেগে পট বদলাতে পারতো না। … একটা দখলদার বাহিনী এবং তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে জোর করে টিকে থাকা দুর্নীতিগ্রস্থ দেশি সরকার দেশের লোকের বিতৃষ্ণার পাত্র হয়ে উঠবে, আর তার সুযোগ নিয়ে তালিবানের মত একটা দৃঢ়মূল এবং সংগঠিত গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের পথে এগিয়ে আসবে, এটা অনুমান করার জন্য কোন অলৌকিক দূরদৃষ্টির দরকার হয় না”।[১৩] অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে স্থানীয় জনজাতির সমর্থন তালিবানের পক্ষে গেছে। যদিও পূর্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে মৌলবাদী তালিবানের ক্ষমতা দখল নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। সেই সময়ে তালিবান প্রশাসন সরকারিভাবে ঘোষণা করেছিল “জনগণের দায়িত্ব তাদের নয়, আল্লাই জীবন দিয়েছেন। তিনিই তা রক্ষা করবেন।”[১৪]
১.৪ আফগানিস্তানের মধু
আফগানিস্তানের মধু যা অন্যদের আকর্ষণ করে তা হল আফগানিস্তানের মাটির তলায় প্রচুর খনিজ পদার্থ, মূল্যবান রত্ন, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম আছে। “গত দুই দশকে আফগানিস্তানের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা শেষ। আফগানিস্তানের মাটির গভীরে জমে থাকা মহার্ঘ সম্পদের দিকে সবার নজর। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তামার আকরিক জমা রয়েছে আফগানিস্তানের মাটির গভীরে। এই দেশের মাটির নিচে জমা হয়ে রয়েছে বিপুল খনিজ সম্পদ। অনুমান করা হচ্ছে তিন লক্ষ কোটি ডলার সমমূল্যের খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার আফগানিস্তানের মাটির তলায় জমা রয়েছে। সোনা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস, নিকেল ছাড়াও লিথিয়াম, তামা আর কোবাল্ট এর মত মূল্যবান খনিজের আধার আফগানিস্তান। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩০ মিলিয়ন টন ব্যবহারযোগ্য তামার ভাণ্ডার মজুত রয়েছে। অনাবিষ্কৃত আরো ২৮ মিলিয়ন টন। যার মূল্য কয়েকশো বিলিয়ন ডলার। ২ বিলিয়ন টন লোহার আকরিক, ১.৪ মিলিয়ন টন রেয়ার আর্থ, ২৭০০ কেজি সোনা মজুদ আছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গজনীতে আছে অতি মূল্যবান খনিজ লিথিয়ামের বিশাল ভাণ্ডার।”[১৫]
১.৫ আফগানিস্তান এখন কীভাবে চলবে?
প্রশ্ন এখন আফগানিস্তান এখন কিভাবে চলবে? কারণ আফগানিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯০০ কোটি ডলার জমা রয়েছে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে। মার্কিন প্রশাসন ইতোমধ্যেই তার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পশ্চিমী ব্যাংকগুলো আফগানিস্তান থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছে। দেশের মুদ্রা আফগানির দাম হুহু করে কমছে।”[১৬] এছাড়াও আফগানিস্তানের সম্পদের বিপুল অংশ বিদেশে গচ্ছিত। এই সম্পদ আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের হাতে আসার সম্ভাবনা কতটা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আফগানিস্তান মূলত বিদেশের অর্থ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। সরকারের বাজেটের ৭৫% বিদেশি দান-খয়রাতের উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার জানিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে আফগানিস্তানে যে ৪৫ কোটি ডলার জমা আছে তা এখন ব্যবহার করা যাবে না। বিশ্ব ব্যাংক সাহায্য বন্ধ করেছে।
১.৬ আফগানিস্তান নিয়ে উৎকণ্ঠা
আফগানিস্তানে তালিবানের দখলের পর আন্তর্জাতিক মহলের নজরে রয়েছে বিশেষ করে দু’টি প্রশ্ন তালিবানরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এমন কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে জায়গা করে দেয় কিনা যারা আন্তর্জাতিকভাবে তৎপর। তেমন হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বৈধতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকটে পড়বে তালিবানের আগামী সরকার। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো তালিবানের প্রথম জমানায় মহিলাদের উপর ব্যাপক অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছিল সেই প্রশ্নে তালিবানরা কতদূর নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা।
পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মীদের অধিকাংশ মহিলা। বাড়ির বাইরে মেয়েদের বেরোনোর ব্যাপারে তালিবান যদি প্রথম বারের মত শর্ত আরোপ করতে শুরু করে, তবে অনেকের পক্ষেই কর্মজীবন বজায় রাখা কঠিন। আজকের দিনে ইন্টারনেট, টিভি এবং রেডিও বন্ধ হয়ে গেলে সমাজে তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কর্মীদের বিশেষত মহিলা কর্মীদের অনুপস্থিতিতে ব্যাংকের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। তার প্রভাব জনজীবনে পড়তে শুরু করেছে। আফগানিস্তানের বাজারের রোজ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে আফগান মুদ্রার দাম। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের সমস্যা আরো বাড়তে পারে। তিন থেকে ছয় মাস অনেকেই মাইনে পাননি, কবে নাগাদ পাওয়া যাবে জানা নেই। ব্যাংকগুলোতে অর্থের যোগান নেই। খোলা থাকলেও কর্মী ও নগদ এর অভাবে কোন কাজই কার্যত হচ্ছে না। তালিবান সরকার কি আফগানিস্তানের ১.৮ কোটি মেয়েকে অশিক্ষিত ও অন্ধকার দুনিয়ার বাসিন্দা বানাতে চেষ্টা শুরু করবে আগের মত এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই সময়ের।
উপসংহার
কুড়ি বছর ধরে মার্কিন মদতের পুতুল সরকারের শাসন চলল, রেখে গেল একটা বিধ্বস্ত, ক্ষুধার্ত দেশ মুক্তিদাতার অভিনয় করে। রেখে গেল এমন একটা দেশ যেখানে অধিকাংশ মানুষ হলো গরীব, যে দেশে বৈষম্যের শেষ নেই। যারা কথায় কথায় তুলনা করেন সোভিয়েত সেনাবাহিনীও তো ৫ বছর ওদেশের নাজিবুল্লার সরকারের সমর্থনে ছিল ওদেশের মাটিতে ছিল। তাদের জেনে রাখা দরকার, নাজিবুল্লাহ সরকার “ভূমি সংস্কার করে গরিবদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিল। ব্যক্তি জমির মালিকানাতে ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ব্যাপক নিরক্ষরতার নিরসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স বেঁধে দিয়েছিল। পণপ্রথা আইনত অপরাধ ঘোষণা করেছিল। জোর করে বিয়ে দেওয়া যাবে না বলেছিল। মেয়েদের পোশাক কিংবা ছেলেদের দাড়ি রাখা সহ একাধিক শরিয়া আইন কে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করেছিল। এছাড়াও মুজাহিদিনদের বিভিন্ন দল সহ সমস্ত জনজাতির অংশের সাথে বসে, সরকার পরিচালনায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চেয়েছিল”।[১৭]
সংবাদমাধ্যম যেমন পৃথিবীকে দেখার চোখ খুলে দেয়, তেমনিই আবার প্রয়োজনবোধে আমাদের চোখ ঢেকে দেয়। “মিডিয়া কেমন বোধ-ধারণা-দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে, কীভাবে গড়ে তুলেছে এবং কার স্বার্থে মিডিয়া প্রকাশ্যে-গোপনে এমন কাজ করে যায় সেটা বিচার-বিবেচনা করা জরুরি”।[১৮] তাই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদায়ের সংবাদ এবং তালিবানদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে সংবাদগুলো বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখা দরকার যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই রয়েছে সবচেয়ে দক্ষ মিডিয়া প্রচারণা হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার এর সাহায্যে তারা একদিকে সংবাদের সূচি ঠিক করে দেয়, নিজেদের স্বার্থের অনুকূল খবরগুলোকে সামনে ফেলে দেয় এবং অন্যদিকে ভিন্নমত প্রকাশকারী বক্তব্যগুলোকে কোণঠাসা করে দেয়। আমরা কি একবারও ভাববো না যে পেন্টাগন ও বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলা করে তালিবানরা ৩০০০ মানুষকে হত্যা করার জন্য যদি সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত হয়, তাহলে সব রকম আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে চালানো মার্কিন হামলাকেও সন্ত্রাসবাদ হিসাবে আখ্যায়িত করা যাবে না কেন?
পরিশেষে যেটা উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেটা হল আফগানিস্তানের ঘটনা ভারতের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে, যার পরিমাণ কম নয়। “প্রথমত ভারতের সাথে আফগানিস্তানে ব্যবসা বাণিজ্যের পরিমাণ খুব একটা কম নয়. ইতিমধ্যে কাবুল থেকে বাদাম, পেস্তা, কিসমিস প্রভৃতি আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে ভারত যে সমস্ত পণ্য আফগানিস্তানে রপ্তানি করে থাকে তাও ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, … বর্তমান সময়ে আফগানিস্তানে ভারতের আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সাহায্যে চার শতাধিক প্রকল্প চালু আছে।… এর মধ্যে রয়েছে নদী বন্দর নির্মাণ, জলাধার নির্মাণ, গতিসম্পন্ন সড়ক প্রভৃতি। এসব প্রকল্পে ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক ভারতীয় শ্রমিক কর্মরত.”[১৯] এছাড়াও মৌলবাদী তালিবান উত্থানের আরেকটা বিপদ হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের তৎপরতা বাড়তে পারে। এক মৌলবাদ আরেক মৌলবাদকে পুষ্ট করবে-এই সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।
মার্কিন দখলদারির বা বিশ্বের নানা প্রান্তে হামলার বৈধতা নিয়ে, অমানবিকতা নিয়ে একবারও প্রশ্ন তোলা হয় না। হবেই বা কেন? কর্পোরেট অধীনস্থ অগ্রসর পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়া এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে সব সময় নিজের মালিককে ক্ষমতাবানদের ভাষায় কথা বলে এবং ভিন্ন ভাষ্যকে দমিয়ে রাখে। তাই আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে ‘তালিবান’ ছাপ না দিয়ে ‘খোলা মনে’ গ্রহণ করা দরকার। একইসাথে সেই বার্তা সংশ্লিষ্ট সব মহলে পৌঁছে দেওয়াও দরকার।
তথ্যসূত্র:-
১) Thomas H. Johnson, Ludwig W. Adamec, Historical Dictionary of Afganisthan, Fifth Edition, Rowman & Littlefield, London etc., 2021, p. 281.
২) সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কাবুলিওয়ালার বাঙ্গালি বউ, ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ-২৮
৩) লালন ফকির, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে, দেশহিতৈষী, সিপিআই(এম),কলকাতা, ৫৯ বর্ষ, ২ সংখ্যা, ২০ আগস্ট, ২০২১, পৃ-১২
৪) দেবাশিস চক্রবর্তী, অধৃষ্য কুমার, স্বাতী বিশ্বাস (সম্পাদিত), আফগানিস্থান এবং সমসাময়িক বিশ্ব, এনবিএ, কলকাতা, ২০০২, পৃ-১০৫
৫) তদেব, পৃ-৯৮
৬) তদেব, পৃ-৯৯
৭) তদেব, পৃ-৯৯
৮) তদেব, পৃ-১০০
৯) গণশক্তি, ৩১ আগস্ট, ২০২১, সিপিআই(এম),কলকাতা,পৃ-৬
১০) তদেব, পৃ-৬
১১) The Hindu, ১৯ আগস্ট, ২০২১, পৃ-৭
১২) দেবাশিস চক্রবর্তী, অধৃষ্য কুমার, স্বাতী বিশ্বাস (সম্পাদিত), প্রাগুক্ত, পৃ-৮৮-৮৯
১৩) অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, অপ্রত্যাশিত?একেবারেই না, দেশ, 2 সেপ্টেম্বর, 2021, কলকাতা,পৃ-১৪-১৬
১৪) দেবাশিস চক্রবর্তী, অধৃষ্য কুমার, স্বাতী বিশ্বাস (সম্পাদিত), প্রাগুক্ত, পৃ-১০৭
১৫) অমিতাভ রায়, আফগানিস্তান: তালিবানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, দেশহিতৈষী, সিপিআই(এম),কলকাতা, ২৭ আগস্ট, ২০২১, ৫৯ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, পৃ-৭
১৬) তদেব, পৃ-৭
১৭) অর্চি নিয়োগী, কমিউনিস্ট বিরোধিতার গর্ভ থেকেই আফগান সংকট, গণশক্তি, সিপিআই(এম),কলকাতা, ২১ আগস্ট, ২০২১, পৃ-৪
১৮) ফাহমিদুল হক, আ-আল মামুন(সম্পাদিত), কর্পোরেট মিডিয়ার যুদ্ধ ও তথ্য বাণিজ্য, শ্রবণ প্রকাশনী , ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃ-১৬৫
১৯) লালন ফকির, আফগানিস্তানে পালাবদল ও ভারতে তার প্রভাব, দেশহিতৈষী, সিপিআই(এম), কলকাতা, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৫৯ বর্ষ, ৪ র্থ সংখ্যা, পৃ-১১-১২
[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, বাণিজ্য বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story