লগ্নি পুঁজির আত্মকথা : বাদল দত্ত

১৯৪৫-এর ৩০ এপ্রিল হিটলার সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। ১৯৪৫-এর ৯ মে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে। হিটলারের মৃত্যু ও জার্মানির আত্মসমর্পণের সাথে সাথে ফ্যাসিবাদের পতন সুনিশ্চিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট হিরোশিমাতে ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে আমেরিকা পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো ইতিমধ্যেই শেষ। তাহলে এই বোমা নিক্ষেপ কেন? এই বোমা নিক্ষেপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অস্ত্র না। এটা পরবর্তীকালের নতুন যুদ্ধ-ঠাণ্ডা যুদ্ধ’র প্রথম অস্ত্র। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপদ ও দেশে দেশে কমিউনিস্ট অভ্যুদয় ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১৯৪৭-এর ১২ মার্চ ঘোষণা করেন ‘ট্রুম্যান ডক্ট্রিন’। ১৯৪৮-এর ৪ জুলাই তা আরও শক্তিশালী করা হয়। এই ডক্ট্রিন আমেরিকা বিদেশনীতির ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মধ্য দিয়ে সূচিত হয় ঠাণ্ডা যুদ্ধ’র নকশা। এখানে দু’টি পক্ষ। একদিকে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্ররা। দু’দিকে দু’টি মহা শক্তিধর দেশ। এটি ঠাণ্ডা যুদ্ধ এই জন্য যে, এই মহাশক্তিধর দেশ দু’টি পরস্পর নিজেদের মধ্যে বড় আকারে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিরোধ-সংঘর্ষগুলি ঘটে, তাতে তারা ইন্ধন কিংবা রসদ যোগায়। সোভিয়েতের বিপদ মোকাবিলায় আমেরিকা ১৯৪৯-এ তৈরি করে একটি সামরিক জোট-‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ (ন্যাটো)। এই জোটে শামিল হয় ১২টি দেশ। এর পাল্টা পোল্যান্ডের ওয়ার্শতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ৮টি সমাজতান্ত্রিক দেশ মিলিত হয়ে ১৯৫৫ সালের ১৪মে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়। তৈরি করে ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’। ‘ন্যাটো’ বনাম ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’। পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য দু’পক্ষই নিজেদের শক্তি বাড়াবার জন্য বিপুল আয়োজন ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যায়। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে অসংখ্য ছোট-বড় যুদ্ধ বা ‘প্রক্সি ওয়ার’। এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল।
১৯৯১-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ারশ প্যাক্ট এর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯১-এর ২৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। ভাবা হয় এবারে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটবে। সামরিক জোট ন্যাটো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। বাস্তবে তা হয়নি। উল্টোটাই হয়। ন্যাটো’র সদস্য দেশের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে হয় ৩০। ২০২০ সালে সামরিক খাতে ন্যাটো’র ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারে। ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপ বিস্তৃত হয় বিভিন্ন দেশে। বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকার সেনা ও সামরিক ঘাঁটি। সামরিক খাতে আমেরিকার খরচ পৌঁছে যায় গোটা বিশ্বের খরচের ৩৯শতাংশে।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পর তিন দশক পার হয়। যুদ্ধ তো শেষ হয়নি। এই তিন দশক জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভয়াবহ যুদ্ধ-সংঘর্ষ চলে। বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতিও হয়। মধ্যপ্রাচ্যে তা ভয়ঙ্কর চেহারা নেয়। আফগানিস্তান তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত। এর পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, ভূ-রাজনৈতিক নানাবিধ কারণ তো রয়েছেই। আসল কারণটা অর্থনৈতিক।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের শেষ পর্বে প্রায় একযোগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর মস্ত বড় প্রভাব ফেলে। প্রথমত, লগ্নি পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ ও তার প্রয়োজনে নয়া উদার অর্থনীতির অভিযান । দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব আবিষ্কার,বিশেষত্ব তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিস্ময়কর পরিবর্তন। তৃতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতন। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরবর্তী কালে রাজনৈতিক শক্তিগুলির সম্পর্কের ভারসাম্য আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির অনুকূলে চলে আসে। মুনাফা সর্বোচ্চকরণের অভিযান চলতে শুরু করে অবাধে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বিশ্বজুড়ে এই অভিযানে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যম এবং জবরদস্তি উভয় পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সক্ষম হয় আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি। পাশাপাশি ডেকে আনে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট। বিশ্বজুড়ে ধনী দেশ ও গরিব দেশের মধ্যে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে, তেমনই একই দেশের মধ্যে ধনী ও গরিবদের মধ্যে বাড়ে ব্যাপক বৈষম্য। বাড়ে বেকারি। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ কমে আসে। বাজারে চাহিদার সঙ্কট তৈরি হয়। একজন অন্যের ঘাড়ে সঙ্কটের বোঝা চালান করে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ হওয়ার সুবাদে এই সঙ্কট চালান করার শক্তি আমেরিকার সবচেয়ে বেশি। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সঙ্কট চালানের লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। আরও বেশি মুনাফা সুনিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি গড়ে তোলে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা।
সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানো, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সামরিক শক্তি বিন্যাসের পুনর্গঠন করে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করার লক্ষ্যে আমেরিকা ধাপে ধাপে অনেকটা অগ্রসর হয়। বিশ্ব অর্থনীতির সম্পদের উৎসগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পর নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি চালায় আমেরিকা। খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখা জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ আমেরিকার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে।
ডলার সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বের সম্পদের মাধ্যম। সম্পদ ধরে রাখার জন্য ডলারের স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। শক্তি যতই থাকুক আমেরিকার অর্থনীতিও সঙ্কটে। মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানহীনতা,ডলারের মূল্যমান ক্রমাগত হ্রাস সঙ্কটকে গভীর করে তোলে। আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আমেরিকাকে বিপুল ঘাটতি বজায় রাখতে হয়।২০২০সালে আমেরিকার মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধুমাত্র আর্থিক নীতির দ্বারা সম্ভব হয় না,সর্বোচ্চ ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপনও জরুরি হয়ে পড়ে।
আমেরিকার অর্থনীতিতে ‘মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। অস্ত্র বিক্রির বহর অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম পাঁচটি কোম্পানিই আমেরিকার : লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন, বোইং, নর্থপ গ্রুম্মান কর্পোরেশন, রেথিয়ন টেকনোলজিস কর্পোরেশন, জেনারেল ডায়নামিকস কর্পোরেশন।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এস আই পি আর আই)-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২০সালে আমেরিকার সামরিক খাতে ব্যয় ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। এটা আমেরিকার জিডিপির ৩.৭শতাংশ। বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের ৩৯শতাংশ। বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে আমেরিকার স্থান প্রথম। আমদানিকারক দেশগুলির মধ্যে প্রথম স্থান ভারতের।২০০৯-১৩ থেকে ২০১৪-১৮ এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রের সরবরাহ বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। ২০০৫-০৯এর তুলনায় ২০১৫-১৯এ অস্ত্র রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশ। আমেরিকার নীতি নির্ধারণে অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির ভূমিকা উপেক্ষা করার শক্তি রিপাবলিক কিংবা ডেমোক্র্যাট কোনো শাসকেরই নেই।
আমেরিকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য যে অর্থনৈতিক তত্ত্বের ওপর দাঁড়াতে হয় তা হল ‘মিলিটারি কেইনসিয়ানিজম’। এটা সকলেরই জানা, বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে বিশ্ব মন্দার কবল থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য অর্থনীতিবিদ কেইনস যে দাওয়াই দিয়েছিলেন তা ‘কেইনসীয় চাহিদা নির্বাহ কৌশল’ বা ‘কেইনসিয়ানিজম’ বলেই পরিচিত। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির দ্বারা জনগণের চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার অভাবজনিত সঙ্কটের সমাধান করার চেষ্টা হয়।
এখানেই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদের এক অভূতপূর্ব সাফল্য আসে। সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় খাতে, বিশেষত পরিকাঠামো ক্ষেত্রে, সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে সঙ্কট কাটাবার পদ্ধতির কথা কেইনস বলেন। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে সামরিক শিল্প ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটানোর অর্থনৈতিক নীতিকেই ‘মিলিটারি কেইনসিয়ানিজম ‘হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কল্যাণব্রতী(welfare) রাষ্ট্রের জায়গায় তৈরি হয় যুদ্ধব্রতী(warfare) রাষ্ট্র। প্রয়োজনীয় সামাজিক পণ্যের জায়গা কেড়ে নেয় যুদ্ধাস্ত্র। সন্দেহ নেই, অস্ত্র শিল্পে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হয়ে শিল্প বিকাশের গতিকে বাড়ায় ও বেকারির সমস্যাকে কিছুটা লাঘব করে। আবার অস্ত্র শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা তৈরির জন্য যুদ্ধ বা যুদ্ধোন্মাদনা তৈরি করাটাও জরুরি হয়ে পড়ে।
এইভাবে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি তার বিস্তারের প্রয়োজনে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অনিবার্য করে তোলে। বিশ্বযুদ্ধ না হোক, ঠাণ্ডা যুদ্ধ না হোক, নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র চাই। নতুন নতুন সংঘর্ষ চাই। নতুন নতুন শত্রুপক্ষ চাই। যুদ্ধ পণ্যের বাজার চাই। যে কোনো পণ্যের মতো যুদ্ধ পণ্যেরও তার বাজারকে সংহত করার জন্য ক্রেতার মনোজগতকে দখল করাটা প্রয়োজন। গড়ে তোলা দরকার উপযোগী সংস্কৃতি ও দর্শন। জীবনের অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ও চাহিদাগুলি থেকে সরিয়ে এনে মানুষকে যুদ্ধ পণ্যের উপযুক্ত খদ্দের হিসেবে গড়ে তোলাটা অত্যন্ত জরুরি। হিটলার বেঁচে নেই। কিন্তু ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধের মধ্যে মানুষ মহৎ হয়ে ওঠে।আর চিরন্তন শান্তি ডেকে আনবে ধ্বংস।’ হিটলারের এই আত্মকথা আজ আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির আত্মকথা হয়ে বিশ্ব চেতনাকে গ্রাস করতে উদ্যত।


[লেখক – সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজ, নদীয়া।] 

Facebook Comments

Leave a Reply