অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত-র কবিতা

যাপন দুই

এক : গরল

আসা যাওয়ার পথে কাঁটাতার জড়িয়ে
শুয়ে আছে নাম দুটো
সংশয়ী বৃষ্টিপাতে ভিজে গেছে ওদের ভিতু শরীর, নিরাপদে থাকা যাপন
অনুভব শুঁকছে গরল বাতাস।
ওই তো ওরা হাঁটবে বলেই উঠে বসল।
পথ কী মুর্শেদ? কোথায় যাবে?
আগুন চেয়েছে জোৎস্না কফিন আর তেওরির ফুল
না পেলে পিঠে এঁকে নেব মেরুদন্ড….

দুই : এলেবেলে

সকাল সকাল সংসারের চৌদ্দগুষ্টি চটকে সে মাথা তুলে দাঁড়ালো। নাহ্, এখানে বড়ো মনান্তর, ফোরণবাজি। আটকুঁড়ে বারফাট্টাই তার সমস্ত ভালোবাসাজুড়ে বিষঘুম এনেছে শতাব্দী আগেই। এখন যে আছে, সে নিছক মমি বই আর কিছুই না। সে নিজেও জানে সে কথা। তাই ঢেউ উঠলে কোনো প্রতিরোধ করে না। কেবল স্রোতের ওঠানামার সঙ্গে মিশে যায়। প্রবাহিত হয়। সকাল থেকে রাত গন্তব্যহীন যাতায়াত। প্রতিদিন ফিরে আসা, আশপাশ সামটে সুমটে আবার ভেসে যাওয়া সকাল সকাল। সে এসব চলাচল নিয়েই বাঁচে। বাঁচতে চায়। সহজ, নিপাট অভ্যস্ত আঁকড়ে লাবডুব লাবডুব। ওকে বলেওছে সে কথা। শুনে মুচকি হেসে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল কাল রাতে। তখন ঘড়িতে ঠিক বারোটা এক।

এখন বারান্দা জুড়ে সার সার নগ্ন দেহ, মৃতবৎ .. বরফ ঠান্ডা। গতরাতে বৃষ্টি এসেছিল, সে শুনেছে। সবাই ভিজতে ভিজতেই এগিয়ে যাচ্ছিল, ঘিরে ধরেছিল, ব্যারিকেড করেছিল। এখন লাশ হয়ে দাঁড়িয়ে। সে ছুঁয়ে দেখতে চায়। সে শীতলতা যাচনা করে। শরীর জুড়ে এখনও উত্তাপ খেলা করে, সে টের পেয়েছে। তার যে আগুনে বড়ো ভয়। সে জড়িয়ে ধরে। ঠাণ্ডা মাংসের গন্ধ, ভ্যাদভেদে আঠাআঠা। সেও মিলেমিশে যায়, আর একজন মরা মানুষ। নগ্ন। বরফ ঠান্ডা। বুক পাছা নিঃসাড়, নির্জন ত্রিভুজে সমকোণী সুখ। সে সুখী হতে চায়। ওকে বলেছিল সেকথা। ও আগুন চিনিয়েছে। পুড়ে যেতে যেতে আরেকবার বৃষ্টিভেজা হলে কেমন হয়! সে ভাবে, আধপোড়া কালো কাঠের মত ঝলসানো মাংসে কি বড়ো স্বাদ? লঙ্কা দিয়ে মেখে খেলে অমৃতসমান। ও’র ঢেঁকুরের শব্দে ব্যঞ্জন খেলা করে। উদ্বাস্তু জীবন, খুঁড়ে আনা বিষয়আশয় … সে দুই হাত ছেড়ে দেয়।

একজন কথা দিয়েছিল উড়িয়ে দেবে। সেইমত ডানা পাখলা, আবর জাবর। যাবতীয় রকমসকম আর বায়নাক্কা নিয়ে পাখিজন্মে চুমুক দেওয়ার চেষ্টা। একবার এক রাজকুমারীর গল্প পড়েছিল সে, আর ছোট্ট একটি পাখি; রাজকুমারীর জন্য গান গাইত। ভালোবাসার স্বত্ত্ববিলোপে পাখিটি সোনার খাঁচায় বন্দী হলো, যা চাইবে মিলবে তৎক্ষণাৎ, বিনিময়ে শুধু অধীনযাপন। অথচ পাখি উড়তে চেয়েছিল, খোলা আকাশ জুড়ে ভ্রমনিয়া ইচ্ছাপূরণ ছেঁচে দ্রাঘিমাবিলাস … সে জেনেছিল পাখিরা বড়ো নরমসরম, তবুও পরিযায়ী হয় প্রজন্মে। সে প্রস্তুত হয়, খিল ভেঙে ঠিক উড়াল দেবে মোহনায়। রাস্তায় যদি দেখা হয় কোনো সুখী রাজপুত্রের, তার জন্য থামতে চাইবে। একটা রাত্রি অচেনা শহরে ফোঁটা ফোঁটা সহবাস দুখ-জাগানিয়া সুরে বিলাপ অভিসার; শীতলতম রাত্রির ওম মেখে সে ঘুমিয়ে পড়বে ..

এসব আহ্লাদকথা। অথচ একচালা ঘরে আলো ঢোকে না। ভীতু ভীতু অজুহাত বসতব্যাকুল কূটকচালি জানে। মাঝে মধ্যে আঠার মতন লেগে থাকা, গা জোয়ারী বসবাস … সে বসে বসে ভাবে। দূরে কলতলা জুড়ে সংসার এসে জুটেছে, হিংস্র উপোষী ভিড়ে হারানের বাপ মেয়েটাকে খুঁজতে আসে প্রতিদিন। বিলাসী তখন বাদাম খুঁটে খাচ্ছিল নদী ঘাটে। সে এবার গা ঝাড়া দেয়। বেরোতে হবে। ডানা দুটো খুঁজতে থাকে। সেই কবে ও’র হাতেই খুলে নেওয়া অযত্নে রাখা আছে কুলুঙ্গিতে, সে অন্ধকারে হাতড়ায়। পায় না। সে খোঁজে। কিছু এলোমেলো পালক অবশেষ … সে মন্ত্র পড়ে।

এবার বেরিয়ে পড়। শিকড়বাকর উপড়ে নাও। পুড়ে যাও নির্নিমেষ … শরীর জুড়ে নাছোড় বিষাদ বিনিময় করে সাফসুতরো লাভডুবকি, অনৃত পরিযান। উড়ে যাও …

তবে এসব এলোমেলো গল্পসল্প। আটপৌরে ঘর গেরস্থালির কথা। জলজ ইতিহাস পিষে অলস অভিযোজন। আত্মদহন ভুলভাল

বাদ দিন। এসব এলেবেলে …

Facebook Comments

1 thought on “অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত-র কবিতা Leave a comment

  1. খুব ভালো লাগল। বিশেষ করে দ্বিতীয়টা খুবই ভালো।

Leave a Reply