পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২, অথবা, ভূমিহীনদের যেভাবে খাসজমি থেকে পুনঃপুনঃ উচ্ছেদ করার ক্ষমতা আইন যেভাবে রাষ্ট্রকে দিচ্ছে : অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
ভূমিকা
ধরুণ, একটি ছিন্নমূল পরিবার। তাঁদের নিজের নামে কোনো জমি নেই। বাসা খাসজমিতে। ৩০-৪০—৫০ বচ্ছর ধরে সেখানেই বাস করেছেন সেই পরিবার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে আগে অন্য কোনো প্রকল্পের কারণে অন্য কোথাও থেকে উচ্ছেদ হয়ে সেইখানে চলে এসেছেন সেই পরিবারের সদ্যস্যরা। সঙ্গে এসেছেন একই ভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া আরো কিছু ঘর পরিবার। জিডিপিমুখি তথা শিল্পায়িত নগরকেন্দ্রিক বিকাশের তরবারি জল জঙ্গল জমিন থেকে এইভাবে কোপে কোপে বহু মানুষের শিকড় ছিঁড়েছে আমাদের পোড়া উপমহাদেশে যবে থেকে উপনিবেশ ও তার হাত ধরে শিল্পবিপ্লব এসেছে। আজকে তাই উপমহাদেশের পথে পথে ছিন্নমূল মানুষের ঢল যা সহজেই আপনার চোখের আড়াল করেছে ক্ষমতায়িত প্রেক্ষণপদ্ধতি তথা মিডিয়াদি। স্বীয় স্বার্থকারণে মূলধারার মর্যালিটি তা মেনে নিয়েছে। তিনটি দেশের তিনটি সংবিধানের ‘কনস্টিটিউশনাল মর্যালিটি’ ও শেষোক্ত ‘মর্যালিটি’-র অভিভাবক তথা ন্যায়বিচারব্যবস্থা এই বিষয়ে অদ্যবধি নিশ্চুপ।
ভূমিহীন মানুষ বা ভূমিহীন মানুষদের উৎখাত – এই দুইই যবে থেকে সম্পত্তির ধারণে মানুষের চৈতন্যে উদয় হয়েছে ইতিহাসের কোনো অচিন ঊষায়, – তবে থেকেই বিশ্ব, বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বে প্রকট, ঘটমান ও বিদ্যমান বাস্তব। বাকি বিশ্বেও যখন শ্বেতসভ্যতার রথ পৌঁছায়, তখন কী হারে উচ্ছেদ হয় তা আপনারা দুই আমেরিকা ও আফ্রিকায় ইউরোপের উপনিবেশপত্তনের ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন। সেই ইতিহাস এই লেখার প্রসঙ্গ নয়।
বাস্তব
এই উপমহাদেশেরই এক দেশ ভারতবর্ষ। যেহেতু এই লিখনের ভাষা বাংলা, সেহেতু আমরা দেখবো এই ভারতবর্ষের এক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কী ভাবে আইনি পদ্ধতির মাধ্যমে খাসজমি থেকে উচ্ছেদ করা হয় সেই ধরণের ভূমিহীন মানুষ ও পরিবারদের। তার আগে, আসুন, উঁকি মারি বাস্তব পরিস্থিতির দিকে।
রাষ্ট্রের হিসেবে সেই পরিবারের সদস্যরা, এমন কি কিছু পাড়াপড়শীও হয়তো – খাস জমিতে থাকছেন – তাই তাঁরা এনক্রোচার বা, আইনের ভাষায়, ‘অননুমোদিত দখলদার’। তাঁদের সরকারি উচ্ছেদ নোটিশ বাস্তবে আসতেই থাকে অহরহ।
যেমন, গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গ উপত্যকার যাঁরা বাসিন্দা, তাঁদের মধ্যে অনেকে যাঁরা খালপাড়, নদী বা খালপার বা বহতা ওয়াটার-চ্যানেল বা সেচনালা সংলগ্ন অঞ্চলে থাকেন, তাঁদের অনেকেরই জীবনে এই উপদ্রুত নতুন নয়।
এমনও পরিস্থিতি দেখেছি যেখানে চৌদ্দদিনের নোটিশে উঠে যেতে বলে হয়েছে আঞ্চলিক মানুষদের – নোটিশ পাঠিয়েছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বিভাগ – হয়তো নোটিশ-দর্শিত কারণগুলিও আপাতচোখে উদার ও ওয়েলফেয়ার-মণ্ডিত – সেচের জল সরবরাহ, বন্যা-মোকাবিলার অবকাঠামো যেমন বাঁধ সংস্কার ইত্যাদি – বা আরও কিছু অবশ্যই জরুরি প্রয়োগ। কিন্তু সেই জরুরৎ-এর প্রকোপে যে মানুষগুলো উচ্ছেদ হয়ে যেতে চলেছে – তাদের মূলধারা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসেবে দ্যাখে।
মূলধারার হোতাদের যদি গাড়ি-বাড়ি-জমিতে টান পরতো, তাহলে তাঁরা নিজেদের অমন শব্দে নিজেদের চিহ্নিত করতেন না যদিও। ফেসবুকে কঠোর প্রতিবাদ করতেন তার বদলে। কিন্তু ভূমিহীনদের মানুষদের উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার মামলা আদালত অবধি নিয়ে যাওয়াই বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যায় না। কেন যায় না তার কারণগুলি অন্যত্র আলোচিত। তবে, এই অপারকতার কথা মাথায় রেখেই আমাদের গড়ে নিতে হবে কেজো আইনি রণনীতি।
সুপ্রীম কোর্ট কী বলছে?
চোখ রাখা যাক সুপ্রীম কোর্টের একটি আদেশের পাতায়। আদেশের নাম – জোগিন্দর এবং একজন অন্য বনাম হরিয়ানা রাজ্য এবং অন্যান্যরা। তথ্যের পথে হেটে লিখনের বপু-বৃদ্ধি এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আসুন, এই সুপ্রীম কোর্ট দ্বিজাজবেঞ্চ তথা ডিভিশন-বেঞ্চ প্রণীত আদেশ তাং ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১, প্রকরণ-প্রকার ও প্রকারণ ক্রমাঙ্ক যথাক্রমে স্পেশাল লীভ পিটিশান (এস এল পি), নং ১৮২৯/ ২০২১ এর কার্যকরি অনুচ্ছেদ নং ৮-টি দেখে নি। অনুচ্ছেদটি এই প্রসঙ্গে জরুরি, তাই পুরোটাই অনুবাদ করে দিলাম অপটু হাতে –
“এটা নোট করা জরুরি যে যে সকল ব্যক্তি অবৈধভাবে সরকারি জমি/ পঞ্চায়েতের জমির উপর অবৈধ ভাবে বসবাস করছেন তাঁদের (তেমন বাসিন্দা হিসেবে) নিয়মিতকরণ (‘রেগ্যুলারাইসেশন’)-এর জন্য দাবী রাখার অধিকার নেই। এই ধরণের অবৈধ দখলদারদের নিয়মিতকরণ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পলিসি এবং র্যুল (নিয়ম)-এর উপর। (বিঃদ্রঃ এ’খানে রুল বলতে পাঞ্জাব-হরিয়ানায় প্রযোজ্য পাঞ্জাব কমোন ল্যাণ্ডস রেগ্যুলেশন র্যুলস, ১৯৬৪, বিশেষতঃ এই ১৯৬৪ নিয়মাবলীর র্যুল নং ১২(৪) এর কথা বলা হয়েছে। তবে, সুপ্রীম কোর্ট জজমেন্ট হওয়ার সুবাদে, মৌলিক বিষয় ও প্রসঙ্গটি সর্বভারতীয় স্তরে গুরুত্ববাহী হয়ে উঠছে) যদি এমন দেখা যায় যে নিয়মিতকরণের সেই নিয়ম বা শর্তাবলী পালন করা হচ্ছে না (উচ্ছেদ-উপদ্রুত অঞ্চলের বাসিন্দাদের তরফ থেকে) ,তখন এই নিয়মিতকরণ সম্ভব নয়। এই আদালত সাম্প্রতিক কালে ওড়িশা রাজ্য বনাম বিচিত্রানন্দ দাস (২০২০) ১২ সুপ্রীম কোর্ট কেসেস ৬৪৯ মামলায় পর্বেক্ষণ (অবসার্ভ) করেছিলো যে, যদি কোনো আবেদক এই ধরণের কোনো নিয়মিতকরণ পলিসির সুবিধা ভোগ করতে চান, তাহলে তাঁকে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী পালন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে পাঞ্জাব রাজ্যসরকার ১৯৬৪ সালে নিয়মাবলী বানায়। সেই নিয়মাবলি এই (নিয়মিতকরণের) প্রসঙ্গে রাজ্যসরকারের নেওয়া পলিসির ফলাফল। (পাঞ্জাব হরিয়ানায়) অনধিক ২০০ গজ (১ গজ = ১ স্কোয়্যার ইয়ার্ড) অবৈধ/ অননুমোদিত (‘ইল্লিগাল/ ‘আন-অথরাইসড’) দখলভিটা (‘অক্যুপেশন’) নিয়মিতকরণের জন্য বিক্রি করা যায় আলোচ্য ১৯৬৪ নিয়মাবলীর নিয়ম নং ১২(৪) অনুসারে। বর্তমান মামলার আবেদনকারীদের অবৈধ দখলে ২০০ স্কোয়্যার ইয়ার্ডের বেশী জমি আছে। অর্থাৎ উক্ত নিয়ম নং ১২(৪) অনুসারে প্রযোজ্য শর্তাবলীর একটি পালিত থাকছে না। আবেদনকারীদের এই ১৯৬৪ নিয়মাবলীর নিয়ম নং ১২ (৪) অনুসারে এই সুবিধা (‘বেনিফিট’) প্রাপ্য নয়। ফলে, হাই কোর্ট এবং (হাইকোর্টের নীচের) সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের আদালত এই বিষয়ে যা ধার্য্য করেছে তা সঠিক, অতএব বলবৎ রইলো।”
পশ্চিমবঙ্গের খাসজমি দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ কী বলছে?
পাঞ্জাবে যেমন রয়েছে পাঞ্জাব কমোন ল্যাণ্ডস রেগ্যুলেশন র্যুলস, ১৯৬৪, পশ্চিমবঙ্গে তেমন রয়েছে দ্যা ওয়েস্ট বেঙ্গল পাব্লিক ল্যাণ্ড (এভিকশন অফ আনঅথরাইসড অক্যুপ্যন্টস) আইন, ১৯৬২। অর্থাৎ, এই রাজ্যে নিয়মিতকরণের বালাই নেই, সরাসরি উচ্ছেদ। এটা ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের সেই ঘৃণ্য এন-আর-সি, সি-এ-এ-র জবাবে এই রাজ্যের বিভিন্ন রিফিউজি কলোনির রেগ্যলারাইস করেছেন। কিন্তু খাসজমি থেকে যারা উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছেন নিয়ত, সেই সকল ভূমিহীন ও ছিন্নমূল মানুষদের সকলেই যে রিফিউজি তা তো নন। আইনের চোখে ‘রিফিউজি’ মানে এখনো এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়া স্মরণার্থী। ল্যান্ড-রিফিউজি বলে আইনের চোখে কিছু হয় না।
উপরে একবার উঠে এলো ওয়েস্ট বেঙ্গল পাব্লিক ল্যাণ্ড (এভিকশন অফ আনঅথরাইসড অক্যুপ্যন্টস) আইন, ১৯৬২-র প্রসঙ্গ। খাসজমি থেকে ভূমিহীন মানুষদের দখল হঠানো – এককথায়, আইনস্বীকৃত সরাসরি উচ্ছেদের পন্থা। কি সেই পন্থা? কী ভাবে বাঁচবেন এই পন্থার খপ্পর থেকে? দেখে নেওয়া যাক তবে –
এবারে তাই আলোচনা হোক দ্যা ওয়েস্ট বেঙ্গল পাব্লিক ল্যাণ্ড (এভিকশন অফ আনঅথরাইসড অক্যুপ্যন্টস) আইন, ১৯৬২ নিয়ে। আইনটর বাংলা করলে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি (অননুমোদিত দখলকারদের উচ্ছেদ) আইন, ১৯৬২। এ’বিষয়ে এই আইনের আওতায় র্যুলস বা নিয়মাবলিও এনেছিলো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসরকার। অনেক মানুষের ও পরিবারের নামে নোটিশ যায় এই মর্মে যে হাইওয়ে চওড়া করার বা বন্যানিয়ন্ত্রণে অথবা সেচ-উন্নয়নে খাল সংস্কারের, অথবা নিছক কারখানা, এস ই জেড, হাউসিং প্রকল্প, মাইন বা অন্য কোনো প্রকল্পের কারণে খাসজমির দখলদারি ছেড়ে দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সেই উচ্ছেদগুলির আইনি ভিত্তি হলো এই ১৯৬২ আইন ও ১৯৬৪ নিয়মাবলি। তাই, আমাদের এইবারের খোঁজ এই আইন ও নিয়মাবলির দিকে।
কবে এলো এই আইন?
৫ই নভেম্বর ১৯৬২। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার চলমান সেশনে পেশ হলো এই পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি (অননুমোদিত দখলকার উচ্ছেদ) আইনের খসড়া। খসড়া চুড়ান্ত হলো তার ঠিক ১৫ দিনের মাথায়। তারপর, রাজ্যপালের সই-সীলে অশোকস্তম্ভিত তথা রাজাশিসধন্য সেই খসড়া রাজ্যের প্রণীত আইন হয়ে গ্যালো ১৯৬২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। তারপরে সেই খসড়ার সংশোধনী আইন বেরোলো ১৯৬৩ সালে এবং ১৯৭৬ সালে। মূল খসড়া ও তার দুই সংশোধনীর ফলে তার আজকের রূপ পেয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের খাসজমি দখল-উচ্ছেদ আইন। কী জানাচ্ছে এই আইন?
এই আইনে উচ্ছেদ-কর্তৃপক্ষ কে বা কারা?
পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ অনুসারে উচ্ছেদ কর্তৃপক্ষ হলেন কালেকটর। এখানে কালেকটর অর্থে, খাস কলকাতার ক্ষেত্রে, কলিকাতা ভূমি অধিগ্রহণ কমিশনার। তবে, অন্যান্য অঞ্চলে স্থানীয় জেলা রাজস্ব প্রশাসনের মুখ্য আধিকারিক যিনি, তাঁরই উপর ন্যাস্ত থাকে খাসজমি থেকে ‘দখলদার’, অর্থাৎ, ভূমিহীন ঘরপরিবারদের ভিটামাটি উচ্ছেদের আইনি ক্ষমতা। তিনি হতে পারেন জেলাশাসক বা অতিরিক্ত জেলাশাসক স্তরের কোনো আপিসার, বা মহকুমাশাসক স্তরের কোনো অফিসার কোনো এক্সিকিউটিভ-গেজেটেড শ্রেণীবদ্ধ কোনো ভূ-রাজস্ব-প্রশাসনের সাথে জড়িত রাজ্যসরকারের অফিসার।
এই ১৯৬২ সালের আইনেরই ধারা ২ উপধারা ৪ খণ্ডধারা ‘ক’ ও ‘খ’ স্পষ্ট করেছে যে এখানে জমির মালিক (আইনের ইংরাজি বয়ানে – ‘ওনার’) কিন্তু যথাক্রমে রাষ্ট্র বা কোম্পানি এই দুয়েরই কেউ হবে আইন আইনের আওতায়। সেই জমিমালিকদের প্রয়োজন সিদ্ধ করতেই উচ্ছেদের নোটিশ যাবে জমির দখলদারদের কাছে।
উচ্ছেদ কারা হবেন?
এটা বুঝতে হলে দেখতে হবে পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২, ধারা ২, উপধারা ৫। সেই উপধারা স্পষ্ট করছে যে ‘পার্সন্স কনসার্ন্ড’, অর্থাৎ যে সকল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে উচ্ছেদের নোটিশ যাবে, তাঁরা হলেন যাঁরা সেই খাসজমির ব্যবহার করছেন বা তাতে থাকছেন – ইংরেজিতে – ‘ইন দ্য ইউস অর অক্যুপেশন’।
‘খাসজমি’ ও খাসজমিতে ‘অননুমোদিত দখলদারি’ কি, তার ব্যখ্যা করছে পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ২ উপধারা যথাক্রমে ৭ এবং ৮।
খাসজমি কী?
আলোচ্য এই ১৯৬২ আইনের ধারা ২ উপধারা ৭ জানাচ্ছে খাসজমি বা ‘পাব্লিক ল্যান্ড’ কি। এই উপধারার ব্যখ্যা বা সংজ্ঞা অনুসারে, খাসজমি হলো সেই জমি যার মালিক সরকার অথবা যে জমি সরকার ইজারা (ইংরেজিতে – ‘লীজ’) মারফৎ নিয়েছে। এখানে সরকার বলতে রাজ্যসরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় অথবা রাজ্য সরকারের মালিকানার অধীন অথবা নিয়ন্ত্রিত (আলোচ্য আইনের ইংরেজি বয়ানে – ‘ওনড অর কন্ট্রোলড’) কোনো সরকারি কোম্পানি অথবা নিবন্ধিত কর্পোরেশন (রাজতন্ত্রের নিয়ামক ভাষায় যা – ‘নিগম’), তেমন জমি হতে পারে। আবার তা হতে পারে এমন কোনো জমি যা রাজ্যসরকার চেয়েছে – আইনের ইংরাজি বয়ানে যা ‘রিক্যুইসিশন’, অর্থাৎ, সরকারি তরফে জমি চাওয়া।
সরকারি রাস্তার কারণে খাসকজমি থেকে উচ্ছেদ হলে এই আইন বলবৎ নয়
তবে, সরকারি রাস্তা তথা রাজপথ বিষয়ক আইন, যেমন, পশ্চিমবঙ্গ রাজপথ আইন ১৯২৫ অনুসারে রাজপথ বানানোর বা প্রসারিত করার কারণে উচ্ছেদ হলে তা এই ১৯৬২ সালের আইনের আওতায় হবে না, যা স্পষ্ট করছে পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২, ধারা ২, উপধারা ৭।
আইনটির চোখে, দখলদার কারা?
আলোচ্য এই একই আইনের একই ধারার উপধারা ৮ ব্যখ্যা করছে ‘অননুমোদিত দখলদার’ কারা। শান্ত চোখে পড়বেন। রাষ্ট্র আইনের চশমায় ভূমিহীনদের কোন চোখে দেখছে তা বুঝতে এই পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২, ধারা ২, উপধারা ৮ ঝটপট পড়ে ফেলাই বাঞ্ছনীয় –
সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া, বা তেমন লিখিত অনুমতির মেয়াদ শেষ যাওয়ার পর, যাঁরা কোনো খাসজমিতে বসবাস করছেন অথবা কোনো খাসজমির ব্যবহার করছেন, তাঁরা সেই খাসজমির অননুমোদিত দখলদার (ইংরেজিতে – ‘আনঅথরাইসড অক্যুপ্যান্টস’) হিসেবে এই আলোচ্য ১৯৬২ আইনের ধারা ২ উপধারা ৮ অনুসারে চিহ্নিত।
এই আইনে উচ্ছেদের পদ্ধতিটি কি?
আলোচ্য এই ১৯৬২ আইনবলে তথা বর্তমান সরকারি শাসনমলে খাসজমি থেকে ভূমিহীন মানুষদের উচ্ছেদ করার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় দুইটি ধাপে –
ধাপ ১ –
প্রথম ধাপে, উচ্ছেদের প্রথমিক নোটিশ যায় এই পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২-র ধারা ৩-বলে। এই নোটিশ হয় ‘কারণ দর্শাও’ বা ‘শো ক্যজ’-নোটিসের আকারে। এখানে সেই খাসজমিতে বাস করা বা সেই জমিতে চাষ-আবাদ করা মানুষদের সেই নোটিশের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে, প্রতি প্রভাবিত পরিবারের কাছেই যে সবসময় নোটিশ যায় তা নয়। সরকারি দায়ভার লাঘব করে এই আইনের ধারা ৩ উপধারা ২ ও ৩ একযোগে এই মর্মে বলে ওঠে যে এই আইনের ধারা ৩(১) অনুসারে দেয় নোটিশ প্রভাবিত অঞ্চলের মানুষদের সহজেই চোখে পড়বে এমন কোথাও লটকিয়ে দিলেই এবিষয়ে সরকারি দায়ভার খালাস।
ধাপ ২ –
১৫ দিনের মধ্যে ভূমিহীন স্থানীয় মানুষদের জবাব কতদূর কি এলো না এলো, তার পরেই সরকারের এই পশ্চিমবঙ্গ খাসজমি অননুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২-র ধারা ৪ অনুসারে ক্ষমতা এসে যাচ্ছে ‘এভিকশন নোটিস’ বা উচ্ছেদের চুড়ান্ত নোটিস প্রেরণ করার।
আইন তো বুঝছি, কিন্তু এ’সবের বাস্তব পরিণাম কী?
ধরুণ, আপনার পূর্বজ-পুরখ-গণের ভিটাবাড়ি খাসজমিতে। বা, আপনি জন্ম থেকে দেখে আসছেন যে একটুকরো খাসজমিতেই কিছু শস্য, আনাজ, উপজ, সবজি উগিয়ে আপনাদের পারিবারিক ক্ষুন্নিবৃত্তি তথা জীবিকা নির্বাহ হয়। এমন সময়, আপনি উচ্ছেদের নোটিস খেয়ে গেলেন ধারা ৪ অনুসারে। বুলডোজার আসবে আপনার ক্ষেতির উপর দিয়ে গড়গড়িয়ে আপনার কাঁচা বাড়ির দিকে। আপনি হনে হয়ে খুঁজবেন ইন্দিরা আওয়াস, রাজিব আওয়াস, অটল আওয়াস ইত্যাদি সরকারি যোজনা-পরিযোজনার সুবিধাগুলি। পাড়ার দাদারা ভোটের আগে আশ্বাসনবাক্য উচ্চ্বারণ করে ভোটের পরে হাওয়ায় মিলিয়েছেন। পাইয়ে দেওয়া রাজনীতির ফায়দাগুলিও একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। হয়তো ৩০ বা ৫০ আগে আপনার বাবামা আপনি ও আপনার সহোদরা-সহোদরদের নিয়ে শিশুকালে বা আপনার জন্মের আগের থেকেই উচ্ছেদ হয়ে চলে এসেছেন এই খাসজমিতে। ভারতের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে নির্ভর জি-ডি-পি মুখীন যে অপ-উন্নয়ন, তার বলি হয়ে একাধিকবার উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া শিকড় ছেঁড়া ভূমিহীন মানুষ অযুতে নিযুত অপর সেই ভারতবর্ষ যা সেই জিডিপিমুখীণ অপ-উন্নয়নের হাঁড়িকাঠে বলি হয়ে চলেছে দিবারাত্র।
কীভাবে এই আইনের পথে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বা হতে চলা মানুষদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার ক্ষমতা পাচ্ছে রাজ্যসরকার
ধরুণ, আপনি ও আপনার পরিবার ভূমিহীন ও খাসজমিতে বসবাস করেন। অথবা, আপনি ও আপনারা চাষ-আবাদ করে জীবিকা ও ক্ষুন্নিবৃত্তি পালন তথা যাপন করেন। অথবা, দুটোই।
এমন অবস্থায়, আপনি পেয়েছেন আলোচ্য পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৪ অনুসারে এভিকশন নোটিস। তখনো আইনের চোখ কিন্তু রোষকষয়ণে চেয়ে আপনাদের দিকে। এই যে এতদিন সেই খাসজমিতে থাকলেন, বা ওটাকে ভিত্তি করেই জীবিকা পেলো, শরীরে পুষ্টি ও আহার পেলো আপনার ঘর-পরিবার, এর ক্ষতিপূরণ আপনাদের থেকে চেয়ে বসতেই পারেন সরকারি কর্তৃপক্ষ এই ১৯৬২ আইনের ধারা ৪-ক-বলে।
কত অঙ্কের ক্ষতিপূরণ সরকার চাইতে পারে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বা হতে চলা ভূমিহীন মানুষ ও পরিবারদের থেকে তা পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৪-ক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার কী ভাবে নির্ণয় করবে
আলোচ্য ১৯৬২ আইনের এই ধারা ৪-ক আবার খণ্ড-ধারা ১ ও ২ – এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে জানান দিচ্ছে কত অঙ্কের বা পরিমাণের ক্ষতিপূরণ ভূমিহীন তথা, আইনের চোখে ‘খাসজমির অননুমোদিত দখলদার’ হওয়ার সিভিল অপরাধে বাংলার শিকড়-ছেঁড়া ঘরপরিবারগুলির থেকে।
১ – খাসজমিতে চাষ আবাদ করলে বছরে গড় যা আসে পরিবারে শস্য-আনাজপাতির বর্তমান (মানে, যে সময়ে উচ্ছেদের নোটিস এসেছে সেই সময়ের) দামের হিসেবে তার ২৫ শতাংশ
২ – বাস্তু বা চাষ ছাড়া অন্য কাজে সেই খাসজমি ব্যবহৃত হলে ব্যবহারকারি ‘অননুমোদিত দখলদার’কে দিতে হতে পারে সেই জমির বর্তমান অর্থাৎ নোটিস-কালীন বাজরদরের ১০ শতাংশ – যদি কর্তৃপক্ষ তা দাবী করে
ভূমিহীন মানুষ খাসজমির ‘অননুমোদিত দখলদার’ হওয়ার ‘অপরাধে’ আর কি কি শাস্তি পেতে পারেন এই আইনের আওতায়?
১ – আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে ‘অ্যাস মাচ ফোর্স অ্যাস মে বি নেসেসারি’
ধরুণ আপনি ভূমিহীন ও সরকারের চোখে ‘অননুমদিত দখলাদর’ হিসাবে উচ্ছেদ হতে চলা মানুষ। আপনি যদি উপরে বর্ণিত দ্বিতীয় ধাপ হয়ে যাওয়ার পরেও আপনার ও আপনার পরিবারের উচ্ছেদের বিরোধিতা করেন, তাহলে কালেক্টর তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আপনার বিরুদ্ধে যথাযথা পদক্ষেপ নিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আলোচ্য ১৯৬২ আইনের ধারা ৫-বলে সরকারের হাতে ক্ষমতে আছে জোর করে আপনাকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার। আইনের এই ধারা ৫ উপধারা ১-এর ভাষায় – ‘ইউস সাচ ফোর্স অ্যাস মে বী নেসেসারি’
১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কোয়্যারে গুলি-গোলা চলেছিলো ছাত্রদের উপর। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের মতো মুনাফাবৃত্তি ও যুদ্ধজীবি রাষ্ট্র বা ভারতের মতো পরগাছাজীবি রাষ্ট্রের শিশুরা তাই ইস্কুলের পাঠ্য সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পাঠ করে সেকথা। কোথাও আবার পাঠ ও জ্ঞাপন হয় যে সেদিনের শেল-বোমা-বুলেটের খরচা বাবদ নাকি চিনা সরকার নোটিশ পাঠিয়েছিলো নহত ও আহত ছাত্রদের পরিবারবর্গের কাছেই।
২ -আপনার বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের সরকারি খরচা আপনার থেকেই নেওয়া হবে
যেকথা কোথাও কোনো পাঠ্যে হয়তো নেই, কিন্তু পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৫ উপধারা ২-তে আছে তা হোলো এই যে, খাসজমিতে বাস বা চাষ করে ভূমিহীন মানুষদের উচ্ছেদ করা, বাড়িঘড় ভাঙা, শস্যশ্যামল খেতির উপর বুলডোজার চালানোর সরকারি আইনসিদ্ধ পদ্ধতিগত ক্রিয়াকল্পের জন্য যে সরকারি খাতায় খরচ হবে, সেই খরচও সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উঠিয়ে নিতে পারেন তেমন ভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষগুলির থেকেই। উক্ত আইনের উক্ত ধারা ৫ উপধারা ২ এবং ধারা ৬ এই ক্ষমতা দিচ্ছে
৩ – উচ্ছেদ নোটিসের ১৪-দিন-এর মধ্যে সেই খাসজমি থেকে আপনার স্থাবর-অস্থাবর বিষয়-সম্পত্তি আপনি সরিয়ে না নিলে কর্তৃপক্ষ তা নিলামে চড়াবে
সরকারকে তথা খাসজমির থেকে দখল হঠানোর সরকারি উদ্দেশ্যে নিবন্ধিত কর্তৃপক্ষকে। নিবন্ধন এখানেই থেমে নেই। এই একই ১৯৬২ আইনের ধারা ৬-ক বলছে কীভাবে উচ্ছেদ পরিবারের দখল থেকে আইনি প্রথায় কেড়ে নেওয়া সেই খাসজমি ও তার সাথে লেগে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিগুলি ধারা ৪-এর উচ্ছেদ নোটিশ আসার ১৪ দিনের মধ্যে নিলামে চড়িয়ে সেই নিলাম-বাবদ প্রাপ্ত অর্থ রাজকোষে জমা পড়ারও নিদান ও ক্ষমতা রয়েছে তেমন নিবন্ধিত সরকারি কতৃপক্ষের উপরেই। তবে, পুরোটা রাজকোষে চড়ালে হবে না। সেই খাসজমির সরকার তরফে যে বা যা মালিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থান, তাঁদের সেই জমির না-পাওয়া বা বকেয়া রেন্ট, উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া পরিবারের বাড়িঘর ভাঙা বা তাঁদের সাথে ধস্তাধস্তির কারণে জমির ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ – এই সব খরচাও দখলদার তথা ভূমিহীন পরিবারদের উচ্ছেদ নোটিস পাওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে জমির সাথে লাগোয়া বা ভারি যে সব স্বীয় সম্পত্তি সেই পরিবার সরিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম থাকছেন, তাঁদের সেই সব সম্পত্তি নিলামে হেকেই সেই সব খরচার পরিমাপ ও পরিমাণ উঠে নেবে সরকার যদি আপনার বাস্তু বা আবাদজমি আদতে খাসজমি হয় ও সেখানে থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সরে যাওয়ার জন্য পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৪(১) অনুসারে উচ্ছেদ নোটিশ পেয়ে থাকেন। তামাম দুনিয়ার ভূমিহীন মানুষদের দিবারাত্রির কাব্য আদপে ও আদতে অযুত তিয়ানানমেন পুতুলনাচের ইতিকথা।
৪ – এই আইনের ফৌজদারি পদ্ধতি, ক্ষমতা ও দণ্ডবিধি – অথবা, এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে আপনার জেল হবে
এইভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া যাঁরা পিঠ ঠেকিয়ে ঠেকানোর জন্য দাঁতে দাঁত চেপে সংগ্রামে লিপ্ত হতে চেয়েছেন, তাঁদের জন্য সরকারি কাজে বাধাদানের ফৌজদারি শাস্তি নিদান করেছে পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৭-ক। জজ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ট্রায়াল হবে তেমন প্রতিরোধীর। দোষপ্রমাণে ১ বছরকাল মেয়াদ অবধি কারাদণ্ড অথবা ভারতীয় মুদ্রায় ২০০০ টাকা অবধি জরিমানা অথবা দুইই। এই অপরাধ জামিনযোগ্য – আলোচ্য আইনের আলোচ্য ধারা ৭-ক উপধারা ২ নিদান দিচ্ছে।
৫ – সরকার তরফের কেউ খাসজমি থেকে ‘অননুমোদিত দখলদার’-দের উচ্ছেদ করতে এসে ভাঙচুর মারপিট করলে এই ১৯৬২ আইন স্বীয় ‘ইন্ডেমনিটি ক্লজ’ মারফৎ তাঁদের যে ভাবে সুরক্ষিত রাখছে –
তবে, সরকারি পক্ষ থেকে যাঁরা খাসজমির দখল হঠাতে আসছেন, তাঁদের, প্রিয় পাঠক, উপরের আলোচনা স্মরণীয়, ‘অ্যাস মাচ ফোর্স অ্যাস মে বী নেসেসারি’-এর মর্মে দখলদারদের জানেমালে হানিসাধন করলেও সে বিষয়ে তেমন সরকারি পক্ষের কারুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না দেশের কোনো আইনব্যবস্থায়, যতক্ষণ না সেই শিকড়ছেঁড়া মানুষ বা পরিবারের হানিসাধন ঘটানো হচ্ছে এই ১৯৬২ আইনের আওতাবলে। সরকারি তরফের সকলকে এই উচ্ছেদের বিষয়ে সুরক্ষা দিচ্ছে আইনের যে ইংরেজি শব্দবন্ধণী, তা সরকারি কাজে বলপ্রয়োগকে সিদ্ধ করতে দেশের বিভিন্ন ফৌজদারি ও এমনকি প্রাশাসনিক, রাজস্ববিষয়ক বা এমনকি দেওয়ানি পদ্ধতিবিধিতেও দেখা যায় ভারত ও অন্যান্য কমোন ল্য দেশ তথা একদা ব্রিটেন শাসিত কমোনওয়েলথ দেশগুলিতে বা খোদ হার ম্যাজেস্টি মহারাণীর শাসনাধীন ব্রিটেনেও – ‘অ্যাক্টস ডান ইন গুড ফেইথ’ – অর্থাৎ, ভালো মনে, (বা, আইনের প্রাসঙ্গিক পরিসরে, সরকারি কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে) করা কাজে কোনো শাস্তি নেই সরকারি পক্ষের কাজি-কাজোয়ারদের।
তবে, বাস্তবে, সরকারি এই রক্ষাকবচও যাঁরা উঁচু পদের বড় আপিসে বসে আছেন সেই সকল সরকারি আধিকারিক যত না পাবেন পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৮ অনুসারে, ভূমিহীনদের বাস্তু গুঁড়িয়ে দিতে আসা বুলডোজার চালক – যিনি হয়তো আপনারই পাড়ার কোনো তরুণ যুবক – তিনি কি আর তত পাবেন যখন তাঁর সামনে প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে থাকবে তাঁরই হয়তো ভাই বোন বন্ধু পরিজন?
পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ অনুসারে মামলা-মোকদ্দমা ও আপীল-পদ্ধতি কী?
পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৮-ক সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছে যে এই আইনের বিষয়ে বা আওতায় পেশ করা বিভিন্ন অর্ডার চ্যলেঞ্জ কোনো দেওয়ানি প্রক্রিয়া (সিভিল স্যুট) আনতে পারবেন না উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বা হতে চলা কেউ। এই এক প্রকাণ্ড সুরক্ষাকবচ যা ভূমিহীন মানুষদের অননুমোদিত দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে খাসজমি থেকে উচ্ছেদ করে দিতে সরকারের সহজলভ্য। আপীল যা করার করতে হবে এ বিষয়ে এই আইনের ধারা ৭ অনুসারে গঠিত আপীল কর্তৃপক্ষের কাছে।
কতদিনের মধ্যে এবং কোথায় করতে হবে এই আইনের আওতায় আপীল?
উচ্ছেদ নোটিশ, অথবা অধিগ্রহণ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোনো নোটিশ তথা হুকুমনামা (‘অর্ডার’) জারি হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই আপীলটি করতে হবে। আপীল করতে একটু দেরি হলে সেই বিলম্ব মকুব করার কথাও যদিও জানাচ্ছে সে ধারা ৭ উপধারা ১। খাসজমিতে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ঘোষণা জারি হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে সেই আপীল যদি করতেই হয়ে উচ্ছেদ হতে চলা কোনো মানুষকে, তাহলে তিনি তা কী ভাবে করবেন?
পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ৭ উপধারা ১ জানাচ্ছে যে, তেমন ঘোষণা যদি এসে থাকে কলকাতা ভূমি অধিগ্রহণ কর্তৃপক্ষ অথবা সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক তথা এই আইনেরই ধারা ২ উপধারা ১ অনুসারে নির্দিষ্ট কোনো ‘কাল্কেটর’-এর তরফ থেকে, তখন সেই আপীল করতে হবে নির্দিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে। এক কথায়, যে সরকারি বাবুটির আছে এই ১৯৬২ আইনের ধারা ২ উপধারা ১ মাধ্যমে নির্দিষ্ট ‘কালেক্টর’-বাবুটি আইনি শাসন-প্রশাসনের ‘চেইন অফ কম্যান্ড’ অনুসারে জবাবদিহি করতে বাধ্য, সেই বিভাগিয় কমিশনারের কাছে নিয়ে যেতে হবে আপীল, তাও উচ্ছেদ নোটিশ ইত্যাদি পাওয়ার ১৪ দিনের মাথায়। তখন সেই শিকরছেঁড়া মানুষটি সেই খাসজমি থেকে স্বীয় জঙ্গম তথা অস্থাবর ও ভারি তল্পিতল্পাগুলি গুছাবেন গুঁটাবেন না সেই সদর বা মহকুমা টাউনে গিয়ে আপীল করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর আপনার আমার সুন্দর আরামময় ও নান্দনিক, তথা নাগরিক উদারজীবি যাপনের মৌলিক বুনিয়াদ তথা উপনিবেশতন্ত্র দ্বারা প্রেষিত ও পুষ্ট কোনো আইন দেয় না।
তবে, এখানে আরেকটু জানা দরকারি। পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ২ উপধারা ১ খণ্ডধারা খ জেলাশাসক তথা ডিএম তথা কালেক্টর কিছু অফিসার-শ্রেণীর পদাধিকারিবলের কথা বলেছেন। তাঁরা হলেন – অতিরিক্ত জেলাশাসক (এ-ডি-এম), মহকুমাশাসক (এস-ডি-এম) ও এগজিকিউটিভ অফিসার। এঁদের কারুর তরফ থেকে এই পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ অনুসারে দখল-হটাও তথা উচ্ছেদ নোটিশ অথবা এই আইনে আনীত অন্য কোনো আম-উদ্ঘোষণা ঘোষণা জারি করতে পারেন উপরে বিশদে আলোচিত পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ২ উপধারা ১ খণ্ডধারা খ প্রদত্ত আইনি ক্ষমতাবলে। এই আধিকারিকদের প্রদত্ত তেমন উচ্ছেদ-আদেশের আপীল যাবে কালেকটরের কাছে। সেটাও সেই উচ্ছেদ হতে চলা মানুষটিকে তল্পিতল্পা গোটানোর ফাঁকেই সেই জেলাসদরে ডি-এম কার্যালয়ে দিনমান হত্যে দিয়ে পরে থাকতে হবে। জেলাসদর আপিসের সাওনে কোনো বাঁধানো গাছের তলে ঘাম মুছতে মুছতে যাঁদের বসে থাকতে দেখেন বিবর্ণ মনে আপনার নিত্যদিনের চলার পথে, তাঁদের অনেকেও হয়তো তেমনই কোনো মানুষ।
উপরোক্ত আপীল বা আপীলের আপীল কী কলকাতা হাই কোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে করা সম্ভব?
হ্যাঁ, উচ্চ্বতর ডিভিশন আধিকারিকের দফতর থেকে খেটেখুটে ধরুণ আপীল নিয়ে যাওয়া হলো হাই কোর্ট-এ রিট পিটিশন আকারে। সেখানে থেকে সিভিল আপীল তথা স্পেশাল লীভ পিটিশন আকারে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৬-প্রদত্ত আইনি পদ্ধতিগত অধিকারবলে। তবে, কজন ভূমিহীন উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বা উচ্ছেদ হতে চলা – আগেও হয়তো কোথাও থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা ভূমিহীন ভাসমান মানুষেরা সুপ্রীম কোর্ট-এ পৌঁছতে পারেন, সেই বিষয়ে স্পেক্যুলেশন-মূলক আলোচনাটা নাহয় থাক। আমরা সাম্প্রতিক কলকাতা হাইকোর্টের এই ধরণের মামলায় কী ধরণের অবস্থান নিয়েছেন সাম্প্রতিক কালে, সেই দিকে নজর দিই। হাঁড়ির গোটা দুই চাল বা ভাত টিপলেই বোঝা যাবে চাল কেমন সিদ্ধ হয়েছে ও হচ্ছে।
সাম্প্রতিক কালে এই আইনের আওতায় আনীত উচ্ছেদ-বিরোধী মামলাগুলোতে কলকাতা হাই কোর্ট যা বলছে
অগস্ট ২২, ২০১৭। মামলার নাম ভাসমান এবং অন্যান্যরা বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মামলার নম্বর ২০১৭ সালেই কলিকাতা হাই কোর্টে দাখিল রিট পিটিশন ১৫০৯ (ডব্লিউ)। অধিগ্রহণের ঘোষণা এনেছেন মহকুমা শাসক। অথচ ঘোষণায় সীলমোহর পরে নি। সেই নিয়ে মামলা। মামলায় জাস্টিস হরিশ ট্যাণ্ডন এই মর্মে রায় দিলেন যে শীলমোহর একটি তুচ্ছ ব্যপার। সীলমোহর না পরে থাকলে সেই কারণে এই দখল হঠানো তথা উচ্ছেদ-কর্ম আলোচ্য ১৯৬২ আইনে সিদ্ধ।
এখন আবার ‘নিউ নর্মাল’-এর যুগ। অন্ধকার সরকারি কুঠুরির দেরাজে দেরাজে মুখ লুকিয়েছে ছাপ্পা সীলমোহর অশোকস্তম্ব গালা রবার-স্ট্যাম্পময় আমলাতান্ত্রিক অস্তিঃগন্ধঃ। তবে, জমি রেজিস্ট্রির আপিসে গেলে দেখা যায় কী ভাবে রমরমিয়ে চলে এস আর ও আপিসগুলি দেশজুড়ে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জমির কেনাবেচা তুঙ্গে উঠছে যেন ক্রমে। সে আলোচনা অন্যত্র হওয়ার হলে হবে।
এখন আলোচনা হোক এই পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ অনুসারে আনীত আরেকটি রিট পিটিশন। রাজেশ ঠাকুর এবং অন্যান্য বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই রিট পিটিশনটিও কলিকাতা হাইকোর্ট সমীপে আনা হয় ২০১৭ সালের। রিট পিটিশন নং ২২৯৮১ (ডব্লিউ)।
তারিখ – ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৭। সেইদিনের সেই কোর্টের নয় নম্বর শুনানী বাবদ চূড়ান্ত আদেশ জারি করলেন মাননীয় কলিকাতা উচ্চ্ব আদালত। ডোমজুড়ে রাস্তা বাড়াবেন মাননীয় পাব্লিক ওয়ার্কস ডীপার্টমেন্ট তথা পি ডব্লিউ ডি। আদালত অনেক ভেবে নিদান দিলেন যে, পঃবঃ খাসজমি অনঅনুমোদিত দখলদার উচ্ছেদ আইন ১৯৬২ ধারা ২ উপধারা ৭ অনুসারে স্পষ্টতঃই বলা আছে যে রাজ্যের হাইওয়ে আইন ১৯২৫ ও এই ১৯৬২-র উচ্ছেদ আইনের মধ্যে সংঘাত ঘটলে অগ্রাধিকার পাবে ১৯২৫-এর সেই আইনটিই। ১৯৬২-র এই আইনটি আনার দুই বছর পর নতুন পশ্চিমবঙ্গ হাইওয়ে আইন ১৯৬৪। হাওড়া জেলার ডোমজুড়ের পি ডব্লিউ ডি দ্বারা নির্মীয়মাণ প্রশস্ত সরকারি রাস্তাটি – তা স্টেট হাইওয়ে হিসেবে গণ্য ও বিবেচ্য রাজপথ হোক কি ন হোক, ১৯৬২-র দখল-উচ্ছেদ আইন নয়, ১৯৬৪-র রাজপথ আইন অনুসারেই ঘটবে উচ্ছেদের আইনসিদ্ধ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া।
কলিকাতা হাইকোর্ট প্রণীত যে দুটো আদেশের কথা হলো, একটার ক্ষেত্রেও কিন্তু সেই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত বিষয়ে ও প্রসঙ্গে আনা রিট-পিটিশন কলিকাতা হাই কোর্টের নজরে ধোপে টিঁকলো না। হাঁড়ির দুটো চাল টিপে ভাত কেমন সিদ্ধ হচ্ছে বোঝা গ্যালো সহজেই।
উপসংহার
এই লেখার কোনো উপসংহার হয় না। উচ্ছেদ ও ভূমিহীনতা সমানে চলেছে। ভুক্তভোগী হয়ে চলেছেন নিয়ত অগণন মানুষ। তাঁদের নিয়ে খবর হয় না। সাম্প্রতিক কালে ভারত দুইজন যথার্থ মহান উকিল দেখেছেন যাঁরা মানুষের ভূমিহীনতা নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করতেন। একজন অ্যাডভোকেট সুধা ভরদ্বাজ, অপরজন অ্যাডভোকেট সুরেন্দ্র গ্যাডলিং। দুজনেই ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ‘এন-আই-এ’ তদন্ত বলে ইউ-এ-পি-এ আইনের একাধিক ধারার অপরাধে অভিযুক্ত। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কাজ করতো দেশের বিভিন্ন অংশে এমন বেশ কিছু সংগঠনকে সম্প্রতি, এই ২০২১ সালের-ই গত অগাস্ট মাসের ২২ অথবা ২৩ তারিখ, এন-আই-এ সেই একই ভীমা কোরেগাঁও তথা এলগার পরিষদ মামলায় এন-আই-এ-র আওতাতেই গঠিত বিশেষ আদালতে পীঠাসীন ন্যামূর্তি মাননীয় শ্রীকোঠালিকার-সমক্ষে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে যাঁরা আশার আলো দিয়ে এই ধরণের আলোচনা শেষঠেশ হবে ভাবছেন তাঁরা চরচকে মলাটের শারদীয়া সংখ্যাগুলি পড়ুক। আমি শেষ করি এই দিয়ে, যে, উপরোক্ত সুধাজ্বি বলেছিলেন অমর শহীদ কমরেড শঙ্কর গুহনিয়োগীর একটি সহজ তত্ত্ব, যে, আন্দোলন দুই পায়ে চলে। এক পা হলো সড়কের লড়াই, আরেক পা হোলো কাগজের। সেই কথা ভেবেই এই লেখা।
[লেখক – পেশায় আইন- ও কলমজীবি।]
Posted in: ARTICLE, September 2021