‘শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ’-এ আফিমের ফুল: আফগানিস্তান, মাদক-অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতা : অর্যমা ঘোষ
‘যুদ্ধ যেমন চিরকাল চলতে পারে না, তেমন যুদ্ধ শেষের প্রক্রিয়াও চিরকাল চলতে পারে না।’ এই ভাবেই শেষ বক্তব্য রাখছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। সাম্রাজ্যের এহেন পরাজয়ের ঘোষণা আগে না হলেও, আফগান সীমান্ত চিরকালই, ‘শত শত সাম্রাজ্যের সমাধিতল’। কিন্তু আফগান যুদ্ধের এভাবেই কেন সমাপ্তি ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন? জানালেন, যুদ্ধ শেষ হলেও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। কিন্তু এ তো কথার কথা। প্রকৃতপক্ষে আফগান পলিসির ব্যর্থতাকেই স্বীকার করে নিলেন তিনি। বাইডেন জানিয়েছেন যে আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয় আমেরিকার, যা ক্রমাগত আর্থিক মন্দার সাথে যুঝতে থাকা একটি দেশের কাছে বিরাট ধাক্কা। কুড়ি বছর ধরে এই বিপুল খরচ হয়েছে। তার কথায়, ”আট লাখ মার্কিন আফগান যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রায় আড়াই হাজার সেনা মারা গেছেন। যার মধ্যে ১৩ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে বিমানবন্দরের শেষ বিস্ফোরণে। আমেরিকা তাদের ভুলবে না।” একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হতাশা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, বিপুল খরচ করে দীর্ঘদিন ধরে তিন লাখেরও বেশি আফগান সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় তারা ময়দানে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে পারল না। এই অংশটি থেকেই আমরা চেষ্টা করব সমস্যার চরিত্র নির্ধারণে। যখন বর্তমান রচনাটি চলছে সাবেক তালিবান ও তালিবান বিরোধী জোটের পঞ্জশির নিয়ে লড়াই জারী আছে। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে একটি সামরিক ও আর্থিক বলে বলীয়ান শক্তির সাথে আফগানিস্তানের মত ক্ষমতাহীন দেশের কিছু ‘non-state actor’ পেরে উঠছে কীভাবে?
সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের পশতুন সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। প্রকৃতপক্ষে রুক্ষ অঞ্চলের রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাস কোনদিনই সরল নয়। মূলতঃ অশ্বপালন, স্থলবাণিজ্য নির্ভর আধা যাযাবর নানা জ্ঞাতিগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত আফগান জনসমাজ যে কোন কেন্দ্রাতিগ রাষ্ট্রশক্তির অধীন থাকতে চাইবে না তা স্বাভাবিক। সপ্তদশ শতকের পশতুন কবি খোশাল খান খাট্টক সে দেশের স্বাধীনচেতা সত্তার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। খোশাল খান খাট্টকের দাদা সম্রাট আকবরের শাসনকালে খাট্টক সম্প্রদায়ের দলপতি ছিলেন। তার পিতা শাহবাজ খান খাট্টক সম্প্রদায়ের দলপতি নির্বাচিত হলে সম্রাট শাজাহানের আনুকূল্য-এ মানসবদার পদমর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু আফগান জনগণ কখনো মুঘলদের আধিপত্য সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। সেখানে খাট্টক, ইউসুফজাই, বারাকজাই, দুররানি সম্প্রদায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে বাইরের শক্তি আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করেছে।
মুঘল সুনির্দিষ্টতার চরিত্র হিসেবে এই প্রক্রিয়াটি আগে থেকেই ছিল। বাবর যখন সর-ই-পুলের যুদ্ধে উজবেক সর্দার শাহবানী খানের কাছে পরাজিত হন তখনই তাঁকে সমরখন্দের পুরুষানুক্রমিক সাম্রাজ্যের আশা ছেড়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হয়। বাবরও তাঁর সমকালীন ইউসুফজাই, হাজারা প্রভৃতি গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে কখনো বিবাহ, আবার কখনো মুঘল সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। যাইহোক সম্প্রদায়ের বিরোধের জেরে শাহবাজ খানের মৃত্যুর পর খোশাল খান খাট্টক নিজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে মুঘলরা তাঁকে খাট্টক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। তাঁর পুত্রকে ক্ষমতায় বসানোর পর খোশাল খান মুঘলদের বিরুদ্ধে পুরো পশতুন জাতিগোষ্ঠীর বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা শুরু করেন, যদিও মনে রাখা দরকার বহুধা বিভক্ত গোষ্ঠীসমূহের মাঝে ঐক্য ছিল দূরহ বিষয়। কবিতার মধ্য দিয়ে পশতুন জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে খোশাল খান অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে খোশাল খানের সময় মুঘল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রবণতা কোন দৃঢ় ভিত্তি লাভ করেনি, বা বলা যায় ব্যক্তিগত বৈরিতার পরিসরকে অতিক্রম করতে পারেনি, কিন্তু খোশাল খান ১৬৬৪ সালে রণথম্বর দুর্গে বন্দি হওয়ার পর মুক্ত হয়ে ১৬৭৩ সাল থেকে যে বিদ্রোহ শুরু করেন তাতে তাঁর পূর্বপুরুষদের মত তিনিও আর মুঘল রাজনীতিতে যোগদান করেননি।
মুঘল আফগান নীতির মূলরূপই ছিল পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীদের একে অপরের সাথে লড়িয়ে দুর্বল করে রাখা। খোশাল খান বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে আর কখনও অন্য পাখতুন গোষ্ঠীকে আক্রমণ করেননি। যাই হোক, খোশাল খানের সময় থেকে একপ্রকার দুর্বল দেশপ্রেমী চেতনা আফগান সমাজে স্থান লাভ করছিল যার তখনও ইসলামীকরণ হয়নি। সেই প্রেরণা পরবর্তী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগানদের প্রেরণাদায়ী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, অন্ততপক্ষে বেশ কিছু সময় পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে এই মানসিকতার জন্য দায়ী হল ভৌগলিক চরিত্র।
‘বাবরনামা’য় লিখিত বিবরণে আফগান সীমান্তের ভূ-রাজনৈতিক চরিত্র বোঝাতে গিয়ে বাবর সাংগার বা পর্বতের স্থানে স্থানে প্রতিরোধী সুরক্ষা দ্বারা বেষ্টিত প্রাকৃতিক দুর্গের কথা বলেছেন। অদ্ভুতভাবে ওসামা-বিন-লাদেনের বিরুদ্ধে লড়াইরত উত্তরীয় জোট এই একই প্রকার পার্বত্য সুড়ঙ্গের কথা বলেছেন যার মধ্যে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তৎকালীন আল-কায়েদা। অর্থাৎ সাম্রাজ্যের শক্তিকে কেবল আফগান যোদ্ধাদের সাথে লড়তে হয়নি, বরং প্রায় পাঁচশত বছর ধরে ওদের লড়তে হয়েছে গোটা আফগান দেশটির সাথে। আসলে খোশাল খান কোন দেশ তৈরি করতে সক্ষম হননি, কারণ গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। যে-কোন কেন্দ্রাতিগ রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত ছাড়া টিকে থাকতে পারে না কারণ আধুনিক রাষ্ট্র ও তার আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও যে প্রকার সমাজব্যবস্থার দরকার পরে তা আফগানিস্তানে কখনই গড়ে ওঠেনি।
ঊন বিংশ শতকে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এখানে ব্রিটিশ ও রাশিয়ার আধিপত্যের লড়াই চরম আকার ধারণ করে। আসলে ভারত দখলের পর থেকেই দীর্ঘ ইঙ্গ-ফরাসী দ্বৈরথের সময়ে ভারতে অবস্থানকারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভয় ছিল ‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’-এর সুরক্ষা নিয়ে। প্রথমে নেপোলিয়ন ইজিপ্ট হয়ে ভারত জয়ের পরিকল্পনা করলে এই ভীতি বাড়ে এবং পরে রাশিয়ার ক্ষমতায়নের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে সুরক্ষিত করার দিকে মন দেয়। ‘The Great Game’ নামে পরিচিত এই ঊনবিংশ শতকীয় দ্বৈরথ ছিল আর মুঘল পরবর্তী আক্রমণের সূত্রপাত। নিকটতম প্রতিবেশী আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সুযোগে আফগান নেতা দোস্ত মোহাম্মদকে সরিয়ে শাহ সুজাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার পর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। যদিও এর পরিকল্পনা চলেছিল বেশ কিছু সময় আগে থেকে। ওক্টারলোনি দিল্লীর রেসিডেন্ট থাকাকালীনই রাজপুত রাজ্যগুলিকে আফগান বিষয়টি নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন এবং নজর রাখা হচ্ছিল সীমান্তে আফগান গতিবিধির উপর। সিন্ধ অঞ্চল দখলের পর থেকে বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৮৩৯-৪২ সালে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশরা সেখানে আধিপত্য কায়েম করতে ব্যর্থ হয়, আফগান প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার পর শাহ সুজা নিহত হয় এবং দোস্ত মোহাম্মদ বুখারা থেকে ফিরে এসে পুনরায় মসনদে বসেন। এই যুদ্ধে পরাজয়ের সাথে মুঘল পরাজয়ের কিছু মিল আছে।
দোস্ত মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার তৃতীয় পুত্র শের আলী খান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিজরেইলি লর্ড লিটনকে ভারতের গর্ভনর নিযুক্ত করার পর তিনি আফগানিস্তানে রাশিয়ান প্রভাব ঠেকাতে কাবুলে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলে শের আলি খানের বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে দিল্লী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ভাইসরয় লর্ড লিটনের ভাষায়, আফগানিস্তান হচ্ছে ব্রিটিশ ও রাশিয়ার মত হেভি মেটালের মাঝখানে একটি মাটির পাত্র। কিন্তু সমস্যা হল যে ধাতুময় লৌহনিগঢ়তূল্য আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠন যে একটি কৃষিনির্ভর-কেন্দ্রীকৃত শাসন নির্ভর ঐতিহ্যযুক্ত সমাজে সম্ভব হলেও তা যে আফগান সমাজে প্রচলন করা যায় না তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বুঝতে পারেনি। তাই সেখানে রাশিয়ার প্রভাব থামিয়ে দিতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করার মধ্যে দিয়ে একটি সাময়িক বিজয় লাভ করলেও তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।
দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের কিছু পরেই আবার আফগান দখলের পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিন ধাপে আফগানিস্তান দখলে রাখার পরও ১৯১৯ সালে স্বাধীনতা প্রদানে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। এরপর আবার আফগানিস্তানের উপর অন্যতম বৃহত্তম আক্রমণ চালায় সোভিয়েত রাশিয়া। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সালে আরেকটি অভ্যুত্থানে নিষিদ্ধ বামপন্থি দল (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। এই দলের সাম্যবাদী শাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। তবে ইসলামবিদ্রোহী মুজাহিদিনরা এই শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। পিডিপিএকে সমর্থন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ পরিচালনা করে। খালেক গোষ্ঠী প্রথম দিকে এই বামপন্থী সরকারের প্রধান হয়। প্রথমেই পাখতুন সাম্প্রদায়িক আধিপত্য দমনে পুস্তু ও দারি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে উজবেকি, তুর্কমানি, বালুচি, নুরিস্থানী প্রভৃতি ভাষাকে গুরুত্ব দেয় নতুন সরকার।
এরপর বরবক গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসে মুঘল ও ব্রিটিশদের মতই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা বজায় রাখার কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু দ্রুত বোঝা যেতে থাকে সোভিয়েত সাহায্য ছাড়া কমিউনিস্ট সরকারের টিকে থাকে অসম্ভব। কিন্তু আফগানদের সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে কিছুদিন পরে একজন মধ্যপন্থি পিডিপিএ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়, যাতে মুজাহিদিনরা শান্ত হয়। এই সময় সরকারে থাকে কারমাল গোষ্ঠী। সোভিয়েত পরবর্তী আফগান রাজনীতিতে নিজের গুরুত্ব বজায় রাখতে আফগান সংখ্যালঘু নির্ভর রাজনীতির দিকে ঝোঁকে। কিন্তু মুজাহিদিনেরা সোভিয়েত দখলের বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। পিডিপিএ সরকার সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেত, অন্যদিকে মুজাহিদিনরা যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও কয়েকটি মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেত। ইতোমধ্যে আমেরিকার সহায়তায় পাকিস্তানে থাকে পাখতুন সংখ্যাগুরু মুজাহিদিন বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে ক্ষমতায় ফিরতে থাকে। যদিও অ-পাখতুন মুজাহিদিনরা এই সমস্যার কথা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তবুও সোভিয়েত পশ্চাদপসরণের পর তাদের আর বিশেষ কিছু করার ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে মূল গোষ্ঠীকে দুর্বল করে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বজায় রেখে যে প্রাধান্য বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তা ধোপে টেকেনি। এখনেই বরং প্রশ্ন ওঠে যে দীর্ঘ মুঘল আমল থেকে সোভিয়েত ও পরবর্তীকালের উত্তরীয় জোটের (NATO) সময় পর্যন্ত আফগান সমাজ মধ্যযুগীয় গোষ্ঠীতান্ত্রিকতা থেকে বের হতে পারল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আফগান সমস্যার বীজ। ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানের পার্বত্য কান্দাহারে গঠিত তালিবান গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে এবং পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে আমেরিকানদের দ্বারা অপসারিত হয়। তারপর বিগত কুড়ি বছর প্রতিরোধের পর ২০২১ সালে পুনর্বার তালিবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, যা সেখানে নতুন সংকটের সূচনা ঘটিয়েছে।
৯/১১-এর আত্মঘাতী হানার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ শুরু করে, তার পিছনে ছিল বৃহত্তম এবং সর্বাত্মক আন্তর্জাতিক সমর্থন। এই সার্বিক সমর্থনের কারণ ছিল সন্ত্রাসবাদের বিশ্বায়ন। আফগানিস্তানের পার্বত্য মনুষ্য বিরল অংশ থেকে খোদ আমেরিকার বুকের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা যা আমেরিকার অত্যাধুনিক National Counterterrorism Center-ও বুঝে উঠতে পারেনি; এই চিন্তাটিই বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ দমনের পরিকল্পনার সূত্রপাত করে। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া কোনও রাষ্ট্রের পিছনে এমন সমর্থন অভূতপূর্ব। নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটন ডি. সি. শহরের ভয়াবহ ছবি ২০০১ সালে আমেরিকার ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার পক্ষে এই নজিরবিহীন আন্তর্জাতিক সমর্থন এনে দিয়েছিল। কিন্তু লড়াই ছিল আফগানিস্তানের মাটিতে, যেটি দখল করতে যত না সময় লেগেছিল তার থেকেও বেশি সময় লেগেছিল উপযুক্ত কোন শাসনব্যবস্থার মধ্যে আফগানিস্তানকে আনতে। এমনকি ইরানের মতো দেশও সে সময়ে আমেরিকার এই সিদ্ধান্তকে পরোক্ষ ভাবে সমর্থন জানায়। সে সময় ন্যাটো থেকে চিন পর্যন্ত যে সমর্থনের ভিত আমেরিকা তৈরি করেছিল, আজ তালিবানদের আফগান রাজধানী কাবুল দখলের সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে।
কেন আফগানিস্তানে একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রগঠন সম্ভব নয়? সকল উত্তরের একটি হল ঐ আফিম। জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বে আফিম রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে আফগানিস্তান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে আফিমের ব্যাপক উৎপাদন হয়। এমনিতেই সন্ত্রাসবাদের সাথে মাদক চোরাচালানের এক সুদীর্ঘ সম্পর্ক আছে; তালিবান সন্ত্রাসবাদী অর্থনীতি তাকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তকমা পাওয়া তালিবানরা গত বিশ বছর ধরে এই খাত থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যয় সামলাত। জাতিসংঘ বলছে, তালিবানরা মাদকের ব্যবসা থেকে বছরে ৩০ কোটি থেকে ১৬০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় করত। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ২০ বছরে দেশটির আফিম উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। পপি চাষ বন্ধ করার জন্য চাষিদের নানা ধরনের বিকল্প পণ্য যেমন আনার ও জাফরান চাষের জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তার পরও এই অবস্থা। বস্তুত বোঝায় যাচ্ছে এটির উপরেই টিকে ছিল তালিবানি ক্ষমতা, ঠিক যেমন অশ্ববাণিজ্যের উপর দাঁড়িয়েছিল মধ্যযুগের আফগান অর্থনীতি। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধভাবে মাদক চোরাচালান আর চাঁদাবাজি। ঠিক যেভাবে লাতিন আমেরিকান ড্রাগ কার্টেলগুলি ওখানকার গেরিলা বিদ্রোহীদের অর্থসাহায্য করে থাকে, সেভাবেই চলে তালিবানের অর্থের যোগান।
তবে আফগানিস্তানে আগে থেকেই গোষ্ঠী ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বজায় থাকায় তালিবানি সহায়তা ও আফিম ব্যবসার উপর মুষ্টিমেয়ের দখল ভালোই চলেছে। এদিকে কাবুল দখলের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তালিবান নেতারা জানান, তারা মাদক উৎপাদন বন্ধ করবেন। তবে মাদকের বিকল্প কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও চেয়েছে তারা। এ প্রতিশ্রুতি আসলে কতটা রাখবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ গোষ্ঠীটি গত বিশ বছর অবৈধ মাদক ব্যবসা আর তোলাবাজির উপর টিকে ছিল। আসলে তাদের আয়ের একমাত্র পথ এটি। আর তাই মাদক নির্মূলে তাদের যে প্রতিশ্রুতি সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে আমেরিকা বা সোভিয়েত রাশিয়া কেন পারল না এই সন্ত্রাসবাদীপুষ্ট মাদক অর্থনীতির ধ্বংসসাধন করতে? গত ১৩ বছর ধরে, ইউএস কংগ্রেসের তৈরি করে দেওয়া একটা বিশেষ নজরদারি দল ‘দ্য স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন’, বা সংক্ষেপে ‘সিগার’ আফগানিস্তানে আমেরিকার সাফল্য ও ব্যর্থতা-সহ যাবতীয় কার্যকলাপেরই খতিয়ান রাখছে।
এই ‘সিগার’ তার রিপোর্টে অন্তত দশটা এমন প্রোজেক্টের কথা তুলে এনেছে যেগুলো সার্বিকভাবে ব্যর্থ এবং এই সব ক’টাতেই ব্যাপক অঙ্কের টাকা নষ্ট হয়েছে। ‘Counter-terrorism’ বা ‘Counter-insurgency’-এর নানা তত্ত্বে যে উন্নয়নের কথা বারবার বলা হয়েছে সে কথাকে মাথায় রেখেই সম্ভবতঃ বিপুল পরিমাণ অর্থকে বিনিয়োগ করেছিল আমেরিকান সরকার। ‘Hearts and Minds’ নামক তত্ত্বানুসারে উপযুক্ত উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা, ও গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো তৈরি করতে পারলেই সন্ত্রাসবাদ দমন সম্ভব। কিন্তু মুশকিল হল অর্থ প্রদানের পথটি; যেহেতু গোষ্ঠীর প্রাধান্য থেকে গেছিল তাই গোষ্ঠীপতিরাই তা প্রদানের নেটওয়ার্কটি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাদের কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এখনেই বেশ কিছু তাত্ত্বিক ‘Spoiler Theory’ এর কথা বলেছেন। এই তত্ত্বানুসারে দেশীয় বিদ্রোহীরা নিজেদের ইচ্ছামত বিদ্রোহের গতিমুখ পাল্টে অর্থের প্রদান ও পথটি নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলতঃ উন্নয়নের স্বার্থে ব্যয়িত অর্থ কোন ভাবেই বিদ্রোহী দমনে কাজে লাগে না।
পনেরো বছর ধরে প্রায় ৮.৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেও আমেরিকা এই মাদক-চক্রকে রুখতে পারেনি, বরং ২০১৭ সালে আফিমজাত মাদকের চাষ ও চোরাই কারবার রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পিছনে হয়তো এই কারণটিই দায়ী। ঠিক যে ভাবে বিশাল সংখ্যক আফগান সৈন্য প্রশিক্ষণের পরও তালিবান অগ্রগতি রোখার সময় কাউকেই পাওয়া যায়নি। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। যুদ্ধের বিপুল খরচ তাদের পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। যদিও আমেরিকা ভেবেছিল, আফিম চাষের বিপুল টাকা তাদের হাতে আসবে। কিছুটা টাকা পেলেও আশানুরূপ আফিমের লাভ আমেরিকার ঝুলিতে আসেনি অথচ বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এতদিনের লড়াইয়ে। আল-কায়দাকে শায়েস্তা করার একটা লক্ষ্য আমেরিকার ছিল। তা এত দিনে তাও পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, কারণ ‘Operation Geronimo’-এর পর ওসামা-বিন-লাদেনও আর নেই; আইমান-আল-জোয়াহিরিও আর নেই। তালিবানও আল-কায়দাকে সামনের সারিতে না আনার শর্তে রাজি হয়েছে। এর পর তো আর নতুন করে আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে কিছু পাওয়ার নেই।
তাই, দীর্ঘ লড়াই শেষে আফগানিস্তান রয়ে গেল আফগানিস্তানেই।
তথ্যসূত্র:
Anwar-ul-Haq Ahady, ‘The Decline of the Pashtuns in Afghanistan’, Asian Survey, vol. 35, no. 7, July 1995, 621-634.
Graham Ferrell & John Thorne, ‘Where have all the flowers gone?: evaluation of the Taliban crackdown against opium poppy cultivation in Afghanistan’, International Journal of Drug Policy, vol. 16, no. 2, 2005, 81-91.
Jonathan Goodhand, ‘Frontiers and Wars: the opium economy in Afghanistan’, Journal of Agrarian Changes, vol. 5, no. 2, 2005, 191-216.
Scott Gates & Kaushik Roy (ed.), War and State-Building in Afghanistan: Historical and Modern Perspective, New Delhi: Bloomsbury, 2015.
Shahbaz Khan & Himayatullah, ‘Understanding the anti-Mughal Struggle of Khusal Khan Khattak’, Pakistan Perspective, vol. 25, no. 1, January-June 2020, 69-85.
[লেখক – বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পিএইচডি গবেষণারত। পূর্বে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করেছেন। গবেষণার বিষয় মলূত সামরিক ইতিহাসকেন্দ্রিক পরিসর।]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story