আফগান নারীর অধিকার : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ – অরিত্র ঘোষ

ভূমিকা

একটি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের অভিজ্ঞতা তার সংস্কৃতি। এই অভিজ্ঞতা বিশেষ জনগোষ্ঠী অর্জন করে তার জীবনযাপনের নানাবিধ উপাদানের মধ্য দিয়ে। এসব উপাদানের মাত্রা ব্যাপক। এই ব্যাপক মাত্রার উপাদান জনগোষ্ঠীর জীবনে সবসময় একরকম থাকে না। উপাদানের সঙ্গে নারী-পুরুষের সম্পর্কের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটে, তা বহুবিধ বঙ্কিম চেতনার জটিলতার স্রোতে প্রবাহিত হয়। ফলে তা হতে পারে দুর্বল, অসুস্থ; হতে পারে পরিশীলিত, রুচিশীল। এটি নির্ভর করে সেই জনগোষ্ঠী কিভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছে তার মৌল সত্যের উপর। মূল্যবোধ সংস্কৃতির অনেক উপাদানের একটি। মূল্যবোধের অবক্ষয় দুর্বল করে সাংস্কৃতিক চেতনা। দুর্বল সাংস্কৃতিক চেতনা পীড়িত করে জনগোষ্ঠীর মানবিক বোধ। মানবিক বোধের অভাবে নারী বেশি আক্রান্ত হয়। নারীর মূল্যবোধের চেতনায় শুভ ও কল্যাণের ধারণা পুরুষের চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে হিংস্র ও অমানবিক হয়ে ওঠায় তার শ্রেয়োবোধে বাধে। কেন-না মাতৃত্ব তার প্রাকৃতিক শক্তি, শিশু তার পার্থিব চৈতন্য- এই দুইয়ের মিলনে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ধারণা সমাজকে এগিয়ে দেয় বলেই সংস্কৃতিতে নারী একটি শক্তি।

সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য নারী ও পুরুষের যৌথ অনুশীলন প্রয়োজন। নারী এবং পুরুষের যৌথ উদ্যোগের ভেতর দিয়ে যে জীবনের শুরু সে জীবন সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন কোনো ধারা নয়, সেটাই সংস্কৃতির মূল স্রোত। কিন্তু এই মূল স্রোতকে পঙ্কিল করেছে পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা না করার মনোভাব। জীবনাচরণের এই শঠতা থেকে উদ্ভূত শূন্যতার কারণে আফগানিস্তানের সংস্কৃতিতে নারীর মূল্যায়ন যথাযথভাবে চিহ্নিত নয়। এক্ষেত্রে নারীকে জীবনযাপনের ধারাবাহিকতার রশি টানার মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। পিতৃতন্ত্রের দ্বারা সর্বত্রই নারীকে দমিত, অবহেলিত এবং নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আফগানিস্তানের মতো দেশে এই পিতৃতন্ত্র চরম রূপ লাভ করেছে। সেখানে নারীরা শুধু দমিত-অবহেলিত নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের সাথে পশুর মতোও আচরণ করা হয়ে থাকে। কৃতদাসের ক্ষেত্রে যেমন কোনো অধিকার থাকে না ঠিক তেমনি আফগান নারীরাও অধিকারহীন।

বর্তমান সময়ে আফগান নারীর অধিকারের অবক্ষয় :

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করার ফলে তালিবানরা আফগানিস্তানে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে আফগান সরকার এবং তালেবানদের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হলে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে পড়ে আফগান মহিলাদের অধিকার ও ভবিষ্যৎ। ২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে দোহায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা আফগান নারীদের ভবিষ্যতকে সম্পূর্ণভাবে তালেবানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। ২০২১সালের গ্রীষ্মের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র তালেবানদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছিল যে তালিবান সেনারা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের উপর কোনোরূপ সন্ত্রাসী হামলা চালাবে না বা তালেবানদের অধীনে থাকা অঞ্চলে কোনোরূপ জঙ্গি কার্যকলাপ করার অনুমতি দেবে না। আফগানিস্তানের নতুন শাসন ব্যবস্থা কেমন হবে তা সম্পূর্ণভাবে তালিবান এবং আফগানিস্তান সরকারের অন্তর্বর্তী বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এটা বিশ্বাস করার প্রবল কারণ আছে যে আফগান নারীদের ভাগ্য বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শহুরে আফগান নারী যারা ২০০১ সালের পরবর্তী আদেশ অনুযায়ী সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয়েছিল তাদের অবস্থা সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছবে। চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে নিয়ম ও সুযোগ সুবিধা আফগান নারীরা ভোগ করছিল তালিবান সরকার আসার সাথে সাথে সেই সুযোগ সুবিধা থেকেও নারীরা বঞ্চিত হয়।

প্রায় দুই দশক পূর্বে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ন্যায্যতা হিসেবে নারীর অধিকার এবং নারীর ক্ষমতায়নকে গ্রহণ করেছিল। বারাক ওবামা প্রশাসনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঘোষণা করেছিলেন যে তালেবানদের সাথে মার্কিন আলোচনার পূর্বশর্ত তালিবানদের আল-কায়েদা ত্যাগ, আফগান সংবিধানে সমতা রক্ষা এবং নারীর অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত। প্রায় দশ বছর পরেও আল-কায়েদার ত্যাগ এখনও স্পষ্টভাবে এবং প্রকাশ্যে করা হয়নি; সাংবিধানিক আদেশ এবং নারীর অধিকার এখনও আন্তঃ-আফগান আলোচনার বিষয়। কোভিড ১৯এর মধ্যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সহিংসতা কেবল তালিবানদের নিরলস ভাবে এবং ক্রমাগত আফগান বাহিনীকে আঘাত করার কারণে তীব্র হয়েছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আফগান সরকার এবং তালিবানদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। আফগান সরকার একটি একুশ সদস্যের আলোচনাকারী দল নিয়োগ করে যাতে পাঁচজন আফগান মহিলা রয়েছে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি আলোচনা পরিষদকে পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য একটি উচ্চ পরিষদও প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরিষদে ৪৬ জন সদস্য ছিল যার মধ্যে মাত্র ৯জন মহিলা। অন্যরা সবাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতা ভোগকারী পুরুষ। ২০০১ সালের পরবর্তীতে আফগানিস্তানে ক্ষমতা কাঠামো অনুযায়ী মহিলাদের যে সংরক্ষণ নীতি ছিল শুধুমাত্র সেই সংরক্ষিত স্থানেই মহিলাদের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এখন প্রশ্ন এই যে, আগামী দিনে তালিবানি শাসনে এই ক্ষমতা কাঠামো বা সংরক্ষণ নীতি কোনটিই অনুসরণ করা হচ্ছে না তবে আফগান নারীর ভবিষ্যৎ কি? আফগান নারীর মর্যাদার অবক্ষয় কি শুরু হয়ে গিয়েছে? কেন নারীদের মর্যাদা রক্ষার জন্য কোনোরকম চুক্তি স্বাক্ষরিত হল না?

আফগান সরকারে বেশ কিছু শিক্ষিত মহিলা সরকারি পদে নিযুক্ত ছিল। এমনকি সুশীল সমাজেও মহিলাদের লক্ষ্য করা যেত। এরা সকল আফগান নারীর প্রতিনিধিত্ব করত। এই মহিলারা ধারাবাহিকভাবে তালেবানদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং তালিবান শাসন ফিরে আসার তীব্র বিরোধিতা করেন। কারণ তারা জানেন তালিবান শাসন আফগান নারীদের অধিকারকে উল্লেখযোগ্য ভাবে দুর্বল করে দেবে। আফগান নারীরা জানে যে তালিবানরা আফগান সংবিধান এবং সামাজিক পরিবর্তনের বিরোধিতা করবে। গত দুই দশকে আফগান নারীদের প্রাপ্ত আনুষ্ঠানিক অধিকারকে তালিবানরা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস করবে। এই ক্ষেত্রে অধিকার বিষয়ে গ্রামীণ আফগান নারী এবং শহুরে আফগান নারীর মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ আফগান নারীর মধ্যে শিক্ষার অভাবে অধিকার বোধ প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায় না, তাই তালিবান সরকারের ক্ষেত্রে মহিলাদের অবস্থার অবনতি বিষয়ে এরা অবগত হয়। এটি গ্রামসির ‘hegemony’ ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অপরদিকে শহুরে আফগান শিক্ষিত নারী অধিকার বিষয়ে সচেতন এবং এরাই তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাই তালিবান শাসন ব্যবস্থায় নারীদের শিক্ষা থেকে দূরে রেখে দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, যাতে নারীদের কোনোরূপ অধিকারবোধ গড়ে না ওঠে। ফলে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা কখনই গর্জে উঠতে পারবে না।

পূর্বের দুই দশকে আফগান নারীর অবস্থার উন্নতি এবং ভবিষ্যৎ সংকট :

পূর্বের দুই দশক ধরে কিভাবে আফগান নারীর অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হয় তা ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। ১৯৯০ এর দশকে তালেবান শাসনের সময় নারীদের উপর বর্বর আচরণ করা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং চাকরিতে প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছিল। নারীদের কোনো পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাইরে বেরোতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছিল। তালেবান শাসন আফগান প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পোস্ত এবং আফিম চাষে কেবলমাত্র মহিলাদের অনুমতি দেওয়া হয়। এটি বাদে তালিবানরা আফগান মহিলাদের চাকরি করা থেকে বিরত রাখে। কিন্তু ২০০৪ সালে তালেবান পরবর্তী সংবিধান আফগান মহিলাদের সকল প্রকার অধিকার প্রদান করে এবং তালেবান পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এনে দেয় যা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি করে। পূর্বের তালিবান শাসনকালে স্বাস্থ্য পরিষেবা একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল। বিশেষ করে নারীদের জন্য কোনো চিকিৎসা পরিষেবাই ছিল না। তালেবান শাসনকালের পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ১৩১১৫টি কার্যকরী স্বাস্থ্য পরিষেবা তৈরি করা হয়, যা ৮৭% আফগান নাগরিককে ২ঘণ্টার মধ্যে একটি চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করত। এই সময় অন্য প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নারীরা বিশেষ মর্যাদা এবং সম্মান পেত। ২০০৩ সালে ১০ শতাংশেরও কম মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। ২০১৭ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল যা অগ্রগতিকে প্রকাশ করে। এই অগ্রগতি আরো এক জায়গায় লক্ষ্য করা যায় যেখানে ২০০৩ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় ৬ শতাংশ নারী ভর্তি হয়েছিল; অন্যদিকে ২০১৭ সালে ৩৯ শতাংশ নারী মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তি হয়েছিল। ফলে বোঝা যায় যে তালিবান শাসনের পরে আফগান শাসনকালে নারীদের কিছু মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুনরায় তালিবান শাসন ফিরে আসায় আফগান নারীদের অধিকার প্রশ্নের মুখে পড়ে।

আফগান শাসন চলার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে ৩.৫ মিলিয়ন মেয়েকে স্কুলে এবং ১ লক্ষ মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া মহিলাদের গড় আয়ু ২০০১ সালে ছিল ৫৬ বছর যা ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ বছর। ২০২০ সালে আফগানিস্তানে সরকারী কর্মীদের ২১ শতাংশ মহিলা কর্মচারী, ১৬ শতাংশ উচ্চ পদস্থ মহিলা কর্মী এবং ২৭ শতাংশ মহিলা আফগান পার্লামেন্টের সদস্য। অর্থাৎ মহিলাদের মর্যাদার উন্নয়নে আফগান সরকার বিশেষ ব্যবস্থা এবং সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করেছিল।

অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পরিবর্তে গ্রামীণ আফগান নারীরা শুধু পেয়েছে তালিবান এবং আফগান সরকারের যুদ্ধ। যেই যুদ্ধে কেউ হারিয়েছে স্বামী, কেউ হারিয়েছে ভাই, বাবা বা সন্তানকে। এটি শুধুমাত্র নারীর মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে না, তৈরি করে অস্তিত্বের সংকট। তালিবান শাসনে পরিবারের মধ্যে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বিধবা মা এবং সন্তানের জীবন অতিবাহিত করা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। শহুরে শিক্ষিত আফগান নারীরা সর্বদাই নারীর মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলন করেছে এবং সরাসরি তারা তালিবান শাসনের বিরোধিতা করেছে। এই মহিলারা দেশের যুদ্ধকালীন সময়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারণ এদের বেশিরভাগ বাড়ির লোক উচ্চ পদস্থ কর্মী বা রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রামের গরীব মেয়েরা। তাই তাদের কাছে নারীর অধিকারের থেকে বেশি বড় হয়ে দাঁড়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা বা শান্তি রক্ষা। কোন সরকার ক্ষমতায় এলে নারীর মর্যাদার উন্নতি ঘটাবে তার থেকে বেশি গুরুত্ব পায় একটি নির্দিষ্ট সরকার ক্ষমতায় থাকুক এবং কোনোরকম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়। তাই আফগান নারীর অধিকারের প্রশ্নে যে রাজনৈতিক বিতর্ক তা আফগান গ্রামীণ ও শহুরে নারী এবং তালিবান ও অতালিবান এই দুই ভাগে বিভক্ত। United Nations এর অধ্যয়ন থেকে জানা যায় যে ৮০ শতাংশ আফগান নারী গৃহস্থ হিংসার শিকার। ৫০ শতাংশ নারী কারাগারে বন্দী এবং যার মধ্যে ৯৫ শতাংশ ‘moral crime’ এর জন্য বন্দী। শুধুমাত্র তালিবান নয়, আফগান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিও খুব রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে, ফলে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

বর্তমানে নারীর অধিকার সম্পর্কে তালিবানদের চিন্তাধারা :

আফগান নারীর অধিকার কতটা বৃদ্ধি পাবে বা হ্রাস পাবে তা আফগানিস্তানে যুদ্ধের পরবর্তীতে আফগান সরকার তালিবানদের সঙ্গে কি ধরণের চুক্তি করে তার উপর নির্ভর করে। বর্তমান আফগান সরকারে তালিবানরাই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যতে তালিবানরাই সম্পূর্ণভাবে দেশ শাসন করবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তালিবান সরকার পরিচালনা করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে তালিবানরা বিভিন্ন অঞ্চল পরিচালনা করে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপরই নির্ভর করে নারীরা কতটা স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং কতটা করবে না। তাই তালিবানরাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে (যতদিন তালিবান শাসন চলবে) তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আফগান নারীর অধিকার এবং অস্তিত্বকে নির্ধারণ করবে।

বিভিন্ন তালিবান এবং তালিবানযুক্ত মানুষের সাক্ষাৎকারে জানা যায় তারা ১৯৯০ এর সময়ে ফেরত যেতে চান না। তারা মনে করেন যে, তালিবানরা নারীর সুরক্ষা এবং অধিকারের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। পূর্বে নারীদের উপর তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পরিবর্তন করে নতুন উদার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারীদের অধিকারের কথা তালিবানরা উল্লেখ করলেও বাস্তবে কতটা তার মিল পাওয়া যাবে তা ভবিষ্যতই দেখাবে। কিছু তালিবান সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছে যে, ভবিষ্যতে আফগানিস্তান সম্পূর্ণভাবে তালিবান নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং নারীরাও ক্ষমতা সমানভাবে অর্জন করবে। মহিলারা মন্ত্রীপদ লাভ করবে যদিও নারী কখনই সরকার বা রাষ্ট্রের প্রধান হবে না। নারীর অধিকার এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে তালিবানরা সৌদিআরবের শাসন ব্যবস্থাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুযোগ প্রদান করতে তালিবান সরকার বাধা প্রদান করে। তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই আফগান নারীর মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে যা পূর্বে তারা ভোগ করত। এখন দেখার বর্তমান তালিবান শাসনে আফগান নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার কি পথে কতটা অবক্ষয় ঘটে?

আফগানিস্তানে নারীর অধিকার উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় বিষয় :

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নিলেও নারীর অধিকারের উপর একটি শক্তিশালী নীতি বজায় রাখা উচিত, যা ন্যাটো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়তা বাহিনীর সময়কালে হয়েছিল। আফগানিস্তানে নারীরা শান্তি এবং অর্থনৈতিক প্রগতিতে সাহায্য করে তাই আফগান নারীর ক্ষমতায়ন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল। আফগান নারীদের সর্বাধিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আন্ত-তালিবান আলোচনায় প্রভাবিত করতে হবে এবং বোঝাতে হবে নারীর ক্ষমতায়ন সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করবে। দেশ থেকে আফগান নারীদের নির্বাসন দেশে স্থবিরতা এবং সহিংসতার গতিশীলতা বৃদ্ধি করবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নারীর অধিকারের ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ করা, নারীর অধিকার নির্ধারিত মানদণ্ডের নীচে থাকলে আফগান সরকার আন্তর্জাতিক স্তর থেকে কোনোরূপ অর্থনৈতিক সহায়তা পাবে না। আরো স্পষ্টভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইনগত ভাবে নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীদের প্রবেশাধিকার, পুরুষ আত্মীয় ছাড়া মহিলাদের বাড়ির বাইরে উপস্থিত হওয়া এবং চাকরির জন্য যোগ্য মহিলা প্রার্থীকে গ্রহণ না করলে আফগান সরকারকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো জোর দিতে হবে, যারা আফগান নারীদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে তাদের বিচারের আওতায় আনা, বিচার করা এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা।

সামরিক উপস্থিতি হ্রাস ঘটলেও আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা শক্তিহীন নয়। যুক্তরাষ্ট্র দেশকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করার জন্য তালেবানদের সাথে অন্যান্য সুবিধা বজায় রেখেছে। সেই কারণেই তালেবানরা গভীরভাবে সচেতন যে তাদের অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও কেবল আফগান জনগোষ্ঠীর পছন্দ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদাও পূরণ করতে হবে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর মার্কিন অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষতি চায় না। যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদের ইসলামী দেশগুলোতে নারীর স্বাধীনতা ভোগ করার দিকটি তুলে ধরে আফগান নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অগ্রগতির দিকটি উল্লেখ করেছে।

আফগানিস্তানে নারীর অধিকার রক্ষাকারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করা উচিত। NGO গুলিকে ব্যবহার করে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। আন্ত-আফগান শান্তি প্রক্রিয়া সহিংসতার মাত্রা, বন্দীদের মুক্তি এবং স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো বিষয়গুলির সাথে জড়িয়ে পড়বে, এখানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। আফগানিস্তানে নারীর অধিকার রক্ষা শুধুমাত্র দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়, ইন্টারনেটের যুগে সমগ্র বিশ্ব এখন একটি গ্রাম (Global Village)। এই বিশ্ব গ্রামে সকল নারীর প্রায় একই অধিকার থাকা প্রয়োজন। শুধুমাত্র দেশের সংবিধান অনুযায়ী এর তারতম্য ঘটে। তাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নির্দিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক মানব অধিকারের নিয়ম অনুযায়ী আফগান নারীর অধিকারকে সুনিশ্চিত করা এবং বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন করা। আন্তর্জাতিক স্তরে আফগান নারীর অধিকার রক্ষার দাবী উঠলে তালিবানরা কিছুটা হলেও পূর্বের অধিকারগুলো প্রদান করবে। চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ প্রভৃতি অধিকার প্রদান করলে ভবিষ্যতে আফগান নারীর অগ্রগতি ঘটবে যা দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে।

[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শ্রীরামপুর গার্লস কলেজ, হুগলী।]

Facebook Comments

Leave a Reply