আজকের কাবুল : অবশ্যম্ভাবীর স্বাভাবিক পরিণতি – অনির্বাণ সেন

কাবুলে তালিবানি আগ্রাসন নিয়ে যখন সারা পৃথিবী চিন্তিত সেই সময় কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার চেষ্টা করলাম। জ্ঞান-গম্মির যা জাহির হল সবই এদিক-ওদিক থেকে সংগৃহীত এবং তারপর নিজের মোটা মাথা কাজে লাগিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা মাত্র। মতের মিল হলে দলভারী হবার আনন্দে খুশী হব আর না হলে আপনার যুক্তিতে নিজেকে শুধরে নেবার চেষ্টা করব। চলুন; নির্দ্বিধায় সব ট্যাবু সরিয়ে আসুন একটু ছান-বিন করে নেওয়া যাক।

আফগানিস্তানের সমস্যা অনুধাবনের আগে প্রথমে দেশের ইতিহাস জানাটা বেশী প্রয়োজন। পটভূমি না জানলে ‘আকস্মিক’ আর ‘অবশ্যম্ভাবী’ গুলিয়ে যায়। তবে স্যর, পাতা ভর্তি করে ইতিহাস পড়বার আর লিখবার দিন কিন্তু শেষ। তাই কাগজ আর শব্দ বাঁচিয়ে কেবল না হয় ক্রনোলজিটুকুই খুঁজি- কি বলেন?

১৯২১ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয় এবং কাবুলে স্বাধীনতা লাভ। অর্থাৎ ভারত স্বাধীন হবার ২৬ বছর আগেই কাবুলে স্বাধীনতা আসে। পিছিয়ে পরা দেশ হলেও আমির আমিনুল্লাহ খান নিরন্তর চেষ্টা করেন আর্থ-সামাজিকভাবে অগ্রণী হবার।

১৯২৬ সালে আমিনুল্লাহ আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র ঘোষণা করেন যদিও অনেকে ভেবেছিলেন যে আফগানিস্তানে আমিরাত প্রতিষ্ঠা হবে। আমিনুল্লাহ কিন্তু চেয়েছিলেন সেই অতি পুরনো একটি জিনিস- একছত্র আধিপত্য। আর তাই বিরোধী লয়া জিরগার ক্ষমতা খর্ব করতে বেশ কিছু নিয়ম নীতি বলবত করবার চেষ্টা হয়। মানুষ অধৈর্য হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। রাজ পরিবার আফগানিস্তান ত্যাগ করে।

১৯৩৩ সালে জাহির শাহ আফগানের রাজা হন। এবং জাহির শাহ আফগানিস্তান পরিচালন ব্যবস্থায় একটি আপাত স্থিতাবস্থা আনতে সক্ষম হন। এবং এই স্থিতাবস্থা দীর্ঘ চল্লিশ বছর স্থায়ী হয়।

১৯৩৪ সালে আমেরিকা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আফগানিস্তানকে স্বীকার করে।

১৯৪৭ সালে জাতপাতের বঙ্গভঙ্গ এবং ভারতের স্বাধীনতা লাভ। আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের সীমানাবর্তী একটি দীর্ঘ অঞ্চল প্রহরাহীন, নিয়ন্ত্রণহীন মুক্তাঞ্চল হিসেবে বিরাজ করতে থাকে।

১৯৫৩ সালে সুলতানের নিকটাত্মীয় মহম্মদ দাউদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। দাউদ সচেষ্ট হন সোভিয়েত রাশিয়ার থেকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা গ্রহণের। রাশিয়ার সাথে কাবুলের হৃদ্যতা বাড়তে থাকে। কিছু আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আসে। মহিলারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো বেশী গুরুত্ব লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে রাশিয়ান প্রধান (Soviet Premiere) নিকিতা ক্রুশচেভ আফগানিস্তানকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এবং তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চালু হয়।

১৯৫৭ সালে দাউদের প্রচেষ্টায় বড় সামাজিক পরিবর্তন আসে। মহিলারা স্কুল-কলেজে যাবার অনুমোদন পায়, চাকরির দরজাও তাদের জন্য খোলা হয়।

১৯৬৫ সালে বারবেক কারমাল আর নূর মহঃ তারাকির নেতৃত্বে আফগানিস্তানে প্রথম কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় গোপনে।

১৯৭৩ সালে সুলতান জাহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে দাউদ খানের নেতৃত্বে সামরিক উত্থান। রাজতন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন দাউদ খান। তার দলের নাম- পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি। রাশিয়ার সাথে আরো দৃঢ় বন্ধুত্বের মাধ্যমে আফগানিস্তানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭৫-৭৭ সালের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা হয় যেখানে নারীদের আরো বেশী অধিকার দেওয়া এবং কম্যুনিস্ট দেশগুলির মতো শাসন ব্যবস্থার কথা বলা হয়। এবং একই সাথে দাউদ খানের সমালোচকদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়।

১৯৭৮ সালে দাউদকে হত্যা করে কম্যুনিস্টরা। কম্যুনিস্ট নেতা নূর মহম্মদ তারাকি প্রেসিডেন্ট এবং তার সহযোগী বাব্রাকি কার্মেল ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় এসেই প্রথমে রাশিয়ার প্রভাবমুক্তি ঘটাতে সচেষ্ট হয়। ঠিক হয় যে নতুন সরকার যে নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করবেন তা হবে ইসলামিক আইন মেনে, আফগান জাতীয়তাবোধকে সমর্থন করে এবং আফগান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে। তারাকি রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও অপর আফগান কম্যুনিস্ট নেতা হাফিজুল্লাহ আমিনের সাথে অন্তর্কলহ চলতেই থাকে। মৌলবাদী এবং প্রাচীনপন্থী কিছু আফগান নেতা যারা দাউদের সময়ে শক্তিমান ছিল তারা সকলে একত্রিত হয়। গ্রামগুলিতে বিপ্লবের আগুন জ্বলতে থাকে। এই বছরই ‘মুজাহিদ্দিন’ বলে একটি গেরিলাযুদ্ধের সূচনা হয় আফগানিস্তানে। মুজাহিদ্দিনের লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে রাশিয়ার প্রভাব এবং প্রসারের পুনর্নবিকরণ।

১৯৭৯ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এ্যাডলফ ডাফকে হত্যা করা হয়। আমেরিকা সমস্ত ধরনের সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে। এদিকে প্রেসিডেন্ট তারাকি এবং ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হাফিজুল্লাহর মধ্য বিরোধ শুরু হয়। ১৪ই সেপ্টেম্বর হাফিজুল্লাহ সমর্থকদের দ্বারা নিহত হন প্রেসিডেন্ট তারাকি। ২৪শে ডিসেম্বর রাশিয়া আফগানিস্তান আক্রমণ করে কম্যুনিজম পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ২৭শে ডিসেম্বর, আমিন এবং তার সমর্থকদের হত্যা করা হয়। ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার বাব্রাক কার্মেল প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন। দেশজুড়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৮০ সালে রাশিয়ান সৈন্য এবং তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে জঙ্গি আন্দোলন শুরু করে মুজাহিদ্দিন গোষ্ঠীর লোকেরা।

১৯৮২ সালে প্রায় ২৮ লাখ আফগান নাগরিক পাকিস্তানে পালিয়ে চলে আসে এবং প্রায় ১৫ লাখের মত মানুষ পালিয়ে যায় ইরানে। আফগানিস্তানে এক অদ্ভুত ক্ষমতার বিভাজন দেখা যায়; আফগান গরিলারা গ্রামাঞ্চল এবং রাশিয়ান সৈন্যরা শহরাঞ্চলে তাদের শাসন চালাতে থাকে।

১৯৮৪ সালে ওসামা বিন লাদেন এই প্রথমবার রাশিয়া বিরোধী মনোবল জোগাতে আফগানিস্তানে আসে। ইউনাইটেড নেশন এই প্রথম রিপোর্ট দেয় যে আফগানিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

১৯৮৬ সালে মুজাহিদ্দিনদের অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য শুরু করে আমেরিকা, চীন, ব্রিটেন এবং পাকিস্তান।

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর, ওসামা বিন লাদেন এবং সাথে আরো ১৫জন মৌলবাদী মিলে আল কায়দা স্থাপন করেন। আল কায়দা তৈরি হয় সোভিয়েত এবং অন্যান্য রাষ্ট্র যারা এই পৃথিবীকে মুসলমান দুনিয়া হিসেবে গড়ে তুলবার পথে বাঁধা, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য। আল কায়দা মনে করে কাবুলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিমণ্ডলের জন্য রাশিয়া দায়ী। তবে তাদের বিরোধিতার অভিমুখ ক্রমে রাশিয়া থেকে আমেরিকার দিকে সরতে থাকে। কারণ আমেরিকা এবং রাশিয়া – দুই সুপার পাওয়ার; ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের মূল বিরোধী।

১৯৯২ সালে মুজাহিদ্দিন, আরো কিছু জঙ্গি গোষ্ঠী এবং সরকার বিরোধী কিছু সরকারী বাহিনী একত্রে কাবুল তছনছ করে নাজবুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় গেরিলা নেতা আহম্মদ শাহ মাসুদ। নিজবুল্লাহর পাশে দাঁড়ায় আমেরিকা। মুজাহিদ্দিনের জিহাদ চলতে থাকে। একটি বৃহৎ ইসলামিক রাষ্ট্র স্থাপন তৈরির উদ্দেশ্যে, যার প্রেসিডেন্ট হবেন প্রফেসর বুঢ়ানুদ্দিন নূরানি!

১৯৯৫ সালে নতুন একটি ইসলামিক জিহাদি দল- তালিবান; দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ, খরা, দুর্ভিক্ষ আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল এই সময়ে তালিবানদের শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবী বিপুল সাড়া ফেলে জনমানসে। তালিবানেরা অবৈধভাবে আফিম, গাঁজার চাষ শুরু করে। দেশে অপরাধের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। দেশে শিক্ষার প্রসার এবং চর্চা কমতে থাকে। শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে মহিলাদের ব্রাত্য করা হয়। মহিলাদের জন্য বোরখা এবং বাড়ির বাইরে না বেরোনোর ফতোয়া জারি হয়। প্রকাশ্যে শাস্তিদান এবং অঙ্গচ্ছেদ ইত্যাদি ইসলামী আইনের পুনর্প্রয়োগ শুরু হয়। তালিবান শাসন অস্বীকার করে আমেরিকা।

১৯৯৫-১৯৯৯ সালে এই চার বছর ক্রমাগত দুর্ভিক্ষ আফগানিস্তানকে খাঁদের ধারে দাঁড় করিয়ে দেয়। বহু গ্রাম বসতি হীন হয়ে পরে। ১০ লক্ষের উপরে আফগান মানুষ পাকিস্তানে পালিয়ে চলে আসে।

১৯৯৭ সালে নাজিবুল্লাহকে জনসমক্ষে হত্যা করে তালিবানেরা। মাসুদের সঙ্গী বা সমর্থকেরা উত্তর থেকে এবং দক্ষিণ থেকে হামিদ কারজাইয়ের মদত পুষ্ট দলগুলি তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়।

১৯৯৮ সালে আফ্রিকাতে আমেরিকান এ্যাম্বাসির উপর আল কায়দা বোমা বর্ষণ করে। ফলস্বরূপ ক্লিন্টন হুকুম দেন এবং আফগানিস্তানে থাকা আল-কায়দার জঙ্গিঘাটিগুলি উড়িয়ে দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এই মিসাইল আক্রমণ থেকে বেঁচে যান সৌদিসহ আরো বেশ কিছু জঙ্গি নেতা।

আতঙ্কবাদী হিসেবে ওসামার নাম ছড়িয়ে পড়েছে তখন সারা বিশ্বে। সেই সময় মনে করা হোত যে লাদেন আফগানিস্তানেই লুকিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির চালাচ্ছেন। আমেরিকা ওসামাকে বিচারের জন্য তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। তালিবানেরা অস্বীকার করে। আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং ইউনাইটেড নেশন থেকে যে অনুদান আসত- তাদের পায়ে বেড়ি পরে।

২০০১, মার্চ- এতকিছুর পরও তালিবানেরা ভ্রক্ষেপহীন। তারা বামিয়ানের বুদ্ধের মূর্তি এবং স্থাপত্য বিনাশের হুমকি দেয়। কারণ ইসলাম মূর্তি পুজোয় বিশ্বাস করে না।

২০০১, ৪ সেপ্টেম্বর- তালিবানি আইনে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা মৃত্যু শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আটজন খৃষ্টান ধর্ম যাজককে তাদের এই অপরাধে বন্দী করে দোষী সাব্যস্ত করে। এবং আফগানের নানা জেল ঘুরিয়ে শেষে নভেম্বর মাসে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

২০০১, ৯ সেপ্টেম্বর- উত্তর আফগানিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মূল মাথা – মাসুদকে হত্যা করা হয় সাংবাদিকের ছদ্মবেশে।

২০০১, ১১ সেপ্টেম্বর- আমেরিকার চারটি মালবাহী বিমান ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ওয়াশিংটন ডিসির বহির্ভাগে পেন্টাগন এবং পেনিন্সিলিভিয়ার জমিতে প্রায় হাজার খানেক নিরীহ মজদুরকে হত্যা করা হয়। আমেরিকা লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়দাকে এই সমস্ত ঘটনার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। বলা হয়, লাদেন আফগানিস্তানে লুকিয়ে রয়েছে।

২০০১, ৭ অক্টোবর- আমেরিকান যুদ্ধ-বিমান হানা দেয় আফগানিস্তানে। আল-কায়দার জঙ্গি ঘাটিগুলি চিহ্নিত করে বোমা বর্ষণের কাজ চলে। আল-কায়দা ঘোষণা করে তারা জিহাদের জন্য প্রস্তুত!

২০০১, ১৩ নভেম্বর- দীর্ঘ যুদ্ধের পর উত্তর সংযুক্ত মোর্চা কাবুলে প্রবেশ করে। তালিবানেরা দক্ষিণে কান্দাহারের দিকে পালিয়ে যায়।

২০০১, ৭ ডিসেম্বর- কান্দাহার থেকে তালিবানদের পরাজয় এবং পলায়ন। পাকিস্তান থেকে খবর প্রকাশ করা হয় যে তালিবানদের জমানা শেষ হল।

২০০১, ২২ ডিসেম্বর- আমেরিকার আশীর্বাদধন্য হামিদ করজাই আফগানিস্তানের নেতা হিসেবে শপথ নেন। দীর্ঘদিন পাকিস্তানে আত্মগোপন করে থাকবার পর করজাই আফগানিস্তানে ফিরে আসেন। এবং ইউনাইটেড নেশন আয়োজিত কনফারেন্সে আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এই অশান্ত অন্তর্বতী সময়ে ছয় মাসের জন্য দেশের দায়িত্ব নেন।

২০০২, জুন। হামিদ করজাই সাধারণ পরিষদ (লয়া ঝিরগা) দ্বারা ২০০৪ পর্যন্ত আফগানিস্তানের নেতা নির্বাচিত হন। নতুন সরকার চালাবার জন্য করজাই এমন সকলকে সাথে নেন যারা ২০০৪ পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

২০০৩, অগাস্ট। দেশে ক্রমবর্ধমান হিংসার কারণে ন্যাটো (NATO) আফগানিস্তানের সুরক্ষার দায়িত্ব নেয়। এই প্রথম ন্যাটো নিজের দেশের বাইরে কোন দেশের সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করল।

২০০৪, জানুয়ারি। দেশের বিভিন্ন এমন কি প্রত্যন্ত প্রান্তর থেকে প্রায় প্রায় ৫ লক্ষ কেষ্টবিষ্টু গোছের আফগানের মতামত গ্রহণের পর লয়া ঝিরগা দেশের একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। এই সংবিধানে একজন রাষ্ট্রপতি এবং দুইজন উপরাষ্ট্রপতির কথা বলা হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রণালয়কে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়। দরি ও পাস্তোকে সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এবং নারীদের সমান অধিকারের কথা বলা হয়।

২০০৪, অক্টোবর। আফগানিস্তানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। প্রায় সাড়ে দশ কোটির মত আফগান ১৮ জন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর মধ্য নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্ট খুঁজে নেন। এবং করজাই প্রায় ৫৫% ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

২০০৫, ডিসেম্বর। প্রায় তিরিশ বছর পর দেশব্যাপী এই প্রথম শান্তিপূর্ণভাবে সাংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচিত সাংসদেরা তাদের প্রথম সংসদীয় সভা করেন ডিসেম্বর মাসে।

২০০৬ সাল। তালিবান আর আল-কায়দা একত্রিত ভাবে লড়ে চলেছে সরকারী প্রতিরোধ বাহিনীর সাথে। শান্তিস্থাপনে আফগানিস্তানের দক্ষিণপ্রান্তে ন্যাটো অভিযান চালালো। তালিবান এবং আল-কায়দা আত্মহত্যাকারী গুপ্ত বাহিনী বানিয়ে বারবার সরকারকে আঘাত করে অস্তিত্ব জানান দিতে থাকল।

২০০৬ সাল। ন্যাটো এবং আফগান সরকার জানালো যে তালিবান নেতা মোল্লা দাদুল্লাহ নিহত হয়েছেন ন্যাটোর দাক্ষিণাত্য শান্তিস্থাপনে চেষ্টায়।

২০০৮ সালে দি ইন্টারন্যাশনাল কম্যুনিটি তাদের প্যারিস সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি হামিদ করজাইয়ের হাতে আফগানিস্তানের উন্নয়নের স্বার্থে দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশী সাহায্য প্রদান করে।

২০০৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রিচার্ড হোলব্রুককে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেন পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের জন্য। এই দুই দেশের উগ্রপন্থী কার্যকলাপ রদ করবার উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করা হয়। আফগানিস্তানে আরো বেশী করে যুদ্ধ প্রশিক্ষক পাঠানো হয় যারা কেবল সেনাবাহিনীকেই নয় সাধারণ মানুষকেও আত্মরক্ষায় পারদর্শী করে তুলবার চেষ্টা করে। তাছাড়া ১৭ হাজার আমেরিকান সেনা পাঠানো হয় উগ্রপন্থী দমনের উদ্দেশ্যে।

২০১০ সালে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক অধিকর্তা পদ থেকে জেনারেল ম্যাক ক্রিশটালের পদত্যাগ এবং তার স্থানে জেনারেল ডেভিড পেট্রিয়সের যোগদান।

২০১১ সালে পাকিস্তানের আব্যেটাবাদে আল-কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে আমেরিকার সেনা।

২০১২ সালে আমেরিকার সেনা আফগানিস্তানের একটি গ্রামে এক পরিবারের ১৬ জনকে হত্যা করে। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হামিদ করজাই আমেরিকান সেনাকে আফগানিস্তানের গ্রামে না ঢুকে তাদের বেস-এ থাকতে বলেন।

২০১৩ সালে আফগান সেনাবাহিনী ন্যাটো বাহিনীর কাছ থেকে সামগ্রিক সামরিক ও নিরাপত্তা কার্যক্রম গ্রহণ করে।

২০১৪, মে। ওবামা ঘোষণা করেন ২০১৬ সালের মধ্য আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য ভাবে মার্কিন সেনা হ্রাস করবেন।

২০১৪, সেপ্টেম্বর। দুই দফার ভোট, নির্বাচনী জালিয়াতির দাবি এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তির পর সেপ্টেম্বরে আশরাফ ঘানি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।

২০১৪, ডিসেম্বর। ন্যাটো আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে তার যুদ্ধ মিশন শেষ করেছে বলে ঘোষণা করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সৈন্য কেবল আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিতে থাকে।

২০১৫, ১৫ অক্টোবর। ওবামা তার রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ লগ্নে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন এবং ২০১৭ সালে অফিস ছাড়ার পর আফগানিস্তানে ৫,৫০০ সেনা রাখবার কথা ঘোষণা করেন।

২০১৭, ২১ অগাস্ট। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ শূন্য করতে প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্প আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখবার কথা ঘোষণা করেন।

২০১৯, ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবান একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যে ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের হাত সরিয়ে নেবে।

২০১৯, সেপ্টেম্বর। তালিবান হানায় মার্কিন সেনা হত্যার পর ট্রাম্প শান্তি চুক্তি বাতিলের ঘোষণা করেন।

২০২০, নভেম্বর। জো বাইডেনের শপথ গ্রহণের আগের দিন আমেরিকা ঘোষণা করে ২০২১এর জানুয়ারির মধ্য আফগানিস্তানে তাদের সেনা অর্ধেক কমিয়ে ২৫০০-এর মধ্য নিয়ে আসবে।

২০২১, এপ্রিল। বাইডেন ঘোষণা করেন যে ৯ই সেপ্টেম্বরের মধ্য তারা আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করবে।

২০২১, ১৫ জুলাই। নতুন আফগান কমান্ডারকে না জানিয়েই মার্কিন সেনা বাগ্রাম বিমানবন্দর ত্যাগ করে।
২০২১, ১০অগাস্ট। আমেরিকা দাবি করে যে মার্কিন সেনা দেশ ছাড়লো মানেই আফগানিস্তান তালিবানদের দখলে চলে যাবে- এমনটা নাও হতে পারে।

২০২১, ১৫ অগাস্ট। আফগানিস্তান তালিবানদের দখলে আসে।

২০২১, ২৬ অগাস্ট। তালিবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর যখন হাজার হাজার আফগান দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল তখন কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় কমপক্ষে ১৬৯ আফগান এবং ১৩ মার্কিন সেনা নিহত হয়। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএস-এর সহযোগী চরমপন্থী গোষ্ঠী আইএসআইএস-কে, যারা আফগানিস্তান, খোরাসানের পুরনো নাম উল্লেখ করতে “কে” ব্যবহার করে, বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে। এই দলটি প্রথম আফগানিস্তানে ২০১৪ সালের শেষের দিকে হাজির হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউস থেকে হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন- আমেরিকা এই ঘটনা ভুলবে না। আমেরিকা এর প্রতিশোধ নেবে।

২০২১, ৩০ অগাস্ট। কাবুল বিমানবন্দর থেকে মার্কিন সেনাদের চূড়ান্ত দল ফেরত চলে আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান ঘটে। পেন্টাগন বলছে, কিছু আমেরিকান চলে যেতে পারছে না এবং দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের “কূটনৈতিক চ্যানেলের” উপর নির্ভর করতে হবে।

এর পরের অংশ নিশ্চয়ই আমাদের নজরে, বিভিন্ন খবরের কাগজ, টিভি ইত্যাদির থেকে পেয়ে আসছি। কিছু প্রশ্ন যে মগজে উঁকি মারছে:-

আজকে তালিবানদের হাতে আধুনিক অস্ত্র এলো কিভাবে?

বিবিসির খবর অনুসারে আমেরিকান সেনাদের ফেলে আসা হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে, জিপ, মোটর সাইকেল, রাইফেল, মেশিনগান, প্লেন সবই এখন তালিবানদের দখলে। উপরে আরেকবার তাকিয়ে দেখুন, ২০১৪ সালে আমেরিকা প্রথম যুদ্ধ শেষ বলে ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীকালে ২০২১-এর এপ্রিলে ওবামা ৯/১১র দিনক্ষণ ঠিক করে বলেন যে এরপর আর সন্ত্রাস সহ্য করা হবে না।

আমেরিকা তাদের উপনিবেশ (ভালো নাম- আতঙ্কবাদ দমন) তুলে নিয়ে যাবার সময় প্লেন, হেলিকপ্টার ইত্যাদি যাবতীয় যুদ্ধাস্ত্র আফগানিস্তানে ফেলে এলো কেন? তাদের ফেলে আসা যুদ্ধাস্ত্রর দখল যে তালিবানেরা নেবে তা কি তারা জানতো না?

নিশ্চয়ই জানতো। দেশে ফিরিয়ে আনতে অসুবিধা হলে সেগুলি যাতে কেউ ব্যবহার না করতে পারে সেভাবে সেগুলিকে নষ্ট করে ফেলা উচিৎ (যেমন আমরা জল খেয়ে প্লাস্টিকের বোতল দুমড়ে ফেলি) কিন্তু আমেরিকা তা করেনি; বরং ইচ্ছে করে সেগুলিকে সম্পূর্ণ ব্যবহার অবস্থায় সেখানে ফেলে রেখে এসেছে। যেমন এর আগে রাশিয়া করেছিল।

সুপার পাওয়াররা কি সত্যিই আতঙ্কবাদ শেষ করতে চায়?

না। বরং তাদের শাসন বা রাজ কায়েম করবার জন্য তারা সবসময় চায় দুর্বল দেশটি যেন বরাবর দুর্বলই থাকে। আর জাতিভেদ, ধর্মভেদ, আতঙ্কবাদ- বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে শতাব্দী প্রাচীন এবং ফলপ্রসূ। সুপার পাওয়ারেরা একই অস্ত্র বারবার ব্যবহার করে কিন্তু প্রতিবারের মোড়কটি থাকে ভিন্ন।

আফগানিস্তানের প্রধান শত্রু কি আতঙ্কবাদ?

না। আফগানিস্তানের প্রধান শত্রু অশিক্ষা। রাশিয়া এবং আমেরিকা বহু বছর ধরে এই দেশের শাসন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবার পরও আজকের দিনে আফগানিস্তানে শিক্ষার হার ৩১.৪৫%, যা পৃথিবীর মধ্য প্রায় সর্ব নিম্ন। এবং শিক্ষা বৃদ্ধির হারও খুব ক্ষীণ। ১৯৭৯ সাল থেকে আজ অবধি শিক্ষার হার বেড়েছে মাত্র ১৩.২৯%। এবং এই অশিক্ষার হাত ধরে যুগযুগান্ত ধরে উগ্রবাদ, আতঙ্কবাদ, নারী নির্যাতন ইত্যাদি ক্রমবর্ধমান আফগানিস্তানে।

আফগানিস্তানে চাষাবাদ কেমন?

আফগানিস্তানে কেবল মাটির নীচে সোনা নেই, মাটির উপরেও আছে। ১.৫ মিলিয়ন টন ফল প্রতি বছর এখানে উৎপাদিত হয়। বেদানা, আঙুর ইত্যাদি দামী ফল ছাড়াও আফগানে অসাধারণ মানের পোস্ত, আখরোট, বাদাম, খেজুর ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। আফগান ড্রাইফ্রুটস সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। এছাড়া আফগানিস্তানে গাঁজার চাষ হয়; যা ২০২০তে গত বছরের তুলনায় ৩৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৬৩০০টন গাঁজা এখানে তৈরি হয় প্রতি বছর, যা পৃথিবীর বৃহত্তম।

এতো গাঁজা খায় কে?

আফগানরা না। এই দেশে তৈরি গাঁজা স্মাগল হয়। দুদিন আগেও তালিবানেরা ১০% ট্যাক্স নিত গাঁজা চাষি এবং ল্যাবগুলোর কাছ থেকে। ল্যাব মানে যারা গাঁজা, আফিম থেকে বিভিন্ন ড্রাগ যেমন এলএসডি, ব্রাউন সুগার, হেরোইন ইত্যাদি মহার্ঘ নেশা দ্রব্য বানায়। ইউরোপের বাজারের ৯৫% হেরোইন আসে আফগানিস্তান থেকে।

আমেরিকা জানতে পারে লাদেন পাকিস্তানের কোন প্রদেশের কোন বাড়িতে কোথায় লুকিয়ে আছে কিন্তু যে দেশে তাদের এতো বছরের ঔপনিবেশ, সেদেশের কোথায় গাঁজা, পোস্তর চাষ হচ্ছে, এবং তার থেকে কত হেরোইন তৈরি হচ্ছে- আমেরিকা কি জানে না?

জানি না স্যর। আমেরিকা বলছে তারা বলে খুউউউব চেষ্টা করেছে গাঁজা উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করে ধ্বংস করে দেবার আর তালিবানেরা বার বার তাদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। কি কষ্ট বলুন তো!

তাহলে এখন এই দুষ্টু তালিবানদের শক্তির রহস্য কি? কারা ওদের সমর্থন করছে?

অবশ্যই পাকিস্তান এবং চীন।
চীন শুনে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। এই তো সেদিন সারা বিশ্বে দাদা গিরি করত রাশিয়া এবং আমেরিকা। রাশিয়া এখন কিছুটা ব্যাক ফুটে আর সেই জায়গায় তরতর করে উঠে আসছে চীন। আজকে চীন যেটুকু নিজের পকেটে নেয় তা মূলত নেবে আমেরিকার পকেট কেটে। তাই মারণরোগ ছড়ানো থেকে শুরু করে আফগানিস্তানে তালিবানদের প্রশ্রয়… আমেরিকার গান পয়েন্ট সবসময় চীনের দিকেই ঘোরানো থাকে।

তাহলে তালিবানরা কি ভালো?

যে লোকগুলো খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজকে পুড়িয়ে মারে, অকারণে অন্যের ধর্মস্থান গুড়িয়ে দেয়, মহিলাদের অধিকারদান অস্বীকার করে- তারা ভাল হয় না। তবে আপনি মনে হয় ধন্দে পরেছেন। এখানে যদিও আমি তালিবানদের কথাই বলেছি তবে আপনি যা ভাবছেন সেটাও ভুল নয়। আমার দেশ বা আফগানিস্তান- মৌলবাদীদের মূল চেহারা সব জায়গাতেই এক।

১৯৪৭এর আগে ব্রিটিশরা প্রায় দুশো বছর এই দেশে উপনিবেশ চালিয়েছে। আফগানিস্তানে সেই তুলনায় কিছুটা কম দিন শাসন চালিয়েছে রাশিয়া আর আমেরিকা। আসলে অন্তর্কলহ এবং অশিক্ষা যখনই কোন দেশকে গ্রাস করে, সেই দেশে যদি প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য এবং অন্য লোভনীয় উপাদানে সমৃদ্ধ হয় তবে শক্তিধরেরা তা লুট করতে আসে… বারবার আসে। এই দেশে যেমন শক, হূন, পাঠান, মোগল, ইংরেজ এসেছে, আফগানিস্তানেও তেমনি রাশিয়া, আমেরিকা উভয়ই এসেছে। দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে, দেশের মসনদে কে বসবে- সব বিষয় তারাই ঠিক করে দিয়েছে। আমাদের দেশ কিভাবে ভাগ হবে- ইংরেজরাই ঠিক করেছিল। আবার অপর দিকে দেখুন রাশিয়া যখন কাস্ত্রোর কিউবাতে পারমাণবিক ঘাটি বানালো তখন এই আমেরিকাই গেল গেল রব তুলে কিউবাকে ঘর বন্দী করল। আর তারপর? কিউবাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ যখন লেগে গেল, লেগে গেল এমন একটা ভাব তখন রাশিয়া আর আমেরিকা কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে টেবিলে বসে সমঝোতা করল। কাকে নিয়ে সমঝোতা? কিউবাকে নিয়ে সমঝোতা। অথচ মজা দেখুন সেই গোপন বৈঠকে কিউবারই কেউ ছিল না। অর্থাৎ কিউবা জানতে পারল না তার ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে গেল। কাগজে ফলাও করে প্রকাশ পেল যেন গরীব কিউবার জন্য আমেরিকা আর রাশিয়া গোপন বৈঠকে বসে যুদ্ধ এড়ালো। ভাবুন তো কত সংবেদনশীল এবং কত সহমর্মী এই সুপার পাওয়ারেরা। আসলে সুপার পাওয়ারেরা সব জানে। আপনার মাটির তলায় কতটা সোনা না কয়লা আছে। সরকারের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিচ্ছে কোন কিষানজী বা আইআইটিতে কতগুলো ছেলে ভাল বা আপনি ব্যাংক-পোস্ট অফিসে কত টাকা জমাচ্ছেন- সব!

ঝকঝকে আকাশচুম্বী অট্টালিকার জন্য বস্তি থাকাটা অবশ্যম্ভাবী। তাই সুপার পাওয়ারদের জন্য আফগানিস্তান তৈরি হয়। বন্দুকের আওয়াজ, গোলা-বারুদের গন্ধ, পরিবারে মেয়ে থাকলে তার উপর সেনার কামুক দৃষ্টি-এসব নিয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলে। দেশ অশিক্ষিত হলে তার ফায়দা প্রচুর। ভিতরের চিৎকার সহজে বাইরে যায় না। অশিক্ষিত মানুষের প্রতিবাদকে শিক্ষিত মস্তিষ্ক দিয়ে দাবিয়ে দেওয়াটা সবসময়ই সহজ কাজ। জানেন, এশিয়ার লাস ভেগাস বলে খ্যাত থাইল্যান্ডের পাটায়া ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার সৈন্যদের বিশ্রাম স্থল। চটজলদি কাঁচা টাকা আসত মুচমুচে ‘সেক্স’-এর বিনিময়ে। ভিয়েতনামের যুদ্ধ অনেকদিন আগেই শেষ হয়েছে কিন্তু আজও ‘সেক্স’ বেচাকেনার রীতি-রেওয়াজ থেকে থাইল্যান্ড বেরিয়ে আসতে পারল কই?
তাই আজকের তালিবানের হাতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় শস্ত্র, এয়ারপোর্টে সাধারণ মানুষের প্লেনের চাকা ধরে ঝুলেও দেশ ছাড়বার চেষ্টা- এসব চোখে জল আনলেও পরিণতি হিসেবে আফগানিস্তানের এই অবস্থা যে এমনই হবে তা অবশ্যম্ভাবী ছিল।

তবে সব যদি বাঁধা গতে চলে তবে ইতিহাস নতুন কিছু লিখবে কি করে? ইতিহাস বারবার বলে যে দীর্ঘ দিনের শোষণ, অশিক্ষা, নেশা বস্তুর রমরমা, অপর্যাপ্ত দারিদ্র এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা- এই সব শেকল ছেঁড়ার আগমন বার্তা বহন করে। মনে করে দেখুন চে গেভারা তার কর্মভূমি হিসেবে কিউবা, কঙ্গো এবং বলিভিয়া নির্বাচন করেছিলেন। কেন? মূলত শোষণ যন্ত্রণার বিরুদ্ধে সাধারণের রোষকে বিপ্লবের পথে চালিত করে দেশে সাধারণ মানুষের শাসন কায়েম করার জন্য। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আমরা এমনই একটা গণ বিপ্লব বা মানুষের অভ্যুত্থানের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে রয়েছি।

পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাথে আমাদের দেশের কথা বললাম বলে রাগ হোল? ভেবে দেখবেন স্যর, ক্রমাগত ধর্মের তরোয়াল দিয়ে মানুষের মধ্য বিভাজন, অশিক্ষিত, অযোগ্য মানুষকে অগ্রজ করবার প্রচেষ্টা, চুরি, ঘুষ, শিক্ষাকে ধর্মের বেড়াজালে ঘিরে ফেলা, কিছু পেটোয়াকে দিয়ে দেশের সম্পদ চুরি করানো… এসব কিন্তু আমার আপনার দেশেই হচ্ছে। কিন্তু বিপ্লব তো গাছের আপেল নয় যে পেকে গেলে মাটিতে পরবে। তাকে পাকাবার ব্যবস্থা করতে হয়। দুর্ভিক্ষ পীড়িত এই দেশগুলি সত্যি সেই উঁচু মগডালে ঝুলে থাকা আপেলের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। বিপ্লব স্পন্দিত বুকে তিনি কবে আসবে বলুন তো?

[লেখক – নদীয়া জেলার একটি মফঃস্বল শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা, পরে ডিপ্লোমা এম বি এ। দুটি বিখ্যাত মাল্টিন্যাশন্যালে প্রায় ১৬ বছরের বিপণনের কর্ম অভিজ্ঞতা। অক্ষরকর্মী হয়ে মূলত নাটক এবং চিত্রনাট্য নির্মাণে লিপ্ত।]

Facebook Comments

Leave a Reply