আফগ়ানিস্তানে আমিরশাহির পত্তন তথা বৌদ্ধিক সংস্কৃতির পতন: চলচ্চিত্র থেকে রঙ্গমঞ্চ – অনির্বাণ দে

“শোনো তালিবান, তালিবান,
আমি তোমার দলেতে নেই।
আমি ধর্মে মুসলমান,
আছি কবীরের সঙ্গেই।”
—কবীর সুমনের এই গানটি মনে পড়ে? সুমন চট্টোপাধ্যায় তখন সবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কবীর সুমন হয়েছেন। ইসলাম মানেই যে তালিবান নয়, সেটা বিশ্বব্যাপী বাঙালিকে মনে করিয়ে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আমরা যারা গত শতাব্দীর নয়ের দশকে কৈশোর কাটিয়ে বয়ঃপ্রাপ্তির দিকে এগোচ্ছি তাদের কাছে এ-স্মৃতি চিরজাজ্জ্বল্যমান। ‘তালিবান’ শব্দটি তখন বিশ্বের প্রায় সমস্ত আধুনিক ভাষার মতো বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারেও ঢুকে পড়েছে এক বিশেষ অর্থ (connotation) নিয়ে। ‘তালিবান’ শব্দটি তখন আর শুধু বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীকে বোঝাচ্ছে না; বিশ্বের আপামর ধর্মীয় মৌলবাদীদের জন্যই ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে শব্দটি। কারণ কী? ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তালিবান নামধারী এক মৌলবাদী ইসলামিক গোষ্ঠী দখল নিয়েছিল প্রায় কুড়ি বছরের সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র আফগ়ানিস্তানের। তারা আফগ়ানিস্তানের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে প্রায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল। হরণ করেছিল নারীদের সমস্ত সামাজিক অধিকার ও সাম্য। এভাবেই ‘তালিবান’ শব্দটি মৌলবাদী আতঙ্কের প্রতিশব্দের চেহারা নিয়েছিল। অবশেষে পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০০১ সালে, মার্কিন সেনার হাতে পতন হয় তালিবান সরকারের। মার্কিন সরকারের তত্ত্বাবধানে হামিদ কারজ়াইয়ের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থা চালু হয়। অবশেষে ২০০৪ সালে পাকাপাকিভাবে হামিদ কারজ়াই গঠন করেন ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। তিনি সমস্ত দিক থেকে আফগ়ানিস্তানকে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। আফগ়ানিস্তানের ইতিহাসে প্রথম বার গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন তাঁর আমলেই হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের মানুষের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আশরফ় গ়নি।

কিন্তু তালিবান চুপ করে বসে ছিল না। তলেতলে তারা গত কুড়ি বছর ধরে আবার সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। আর অন্যদিকে আফগ়ানিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির পরিবর্তে বড্ডো বেশি করে মার্কিন সামরিক বাহিনীর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল। তাই মাত্র কয়েক মাসের চেষ্টায় ২০২১ সালের ১৫ অগস্ট তালিবান আবার দখল নিল আফগ়ানিস্তানের রাজধানী কাবুলের। প্রজাতান্ত্রিক আফগ়ানিস্তান আবার পরিণত হয়েছে তালিবান-নেতৃত্বাধীন ইসলামিক আমিরশাহিতে। আমরা যারা কুড়ি বছর আগেকার তালিবানকে দেখেছি তারা শিউড়ে উঠছি এই নবগঠিত আফগ়ানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিল্পসংস্কৃতির ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে। মনে রাখতে হবে, এই শাসক ধর্মীয় উদারনৈতিকতায় বিশ্বাস করে না; ‘নারীস্বাধীনতা’ শব্দটার উচ্চারণই এদের কাছে ঘোরতর দণ্ডনীয় অপরাধ; বিশ্বখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দিতেও এতেও হাত কাঁপে না।

সংবাদমাধমে দেখতে পাচ্ছি, এই নয়া তালিবান নাকি অনেক ‘আধুনিকমনস্ক’ প্রজন্মের তালিবান। হতে পারে তারা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে অনেকটা প্রযুক্তিনির্ভর বা tech-savvy। কিন্তু ঘরপোড়া আফগ়ানরা জানে, এ কেবল বহিরঙ্গের আধুনিকতা, অন্তরঙ্গে তারা সেই মধ্যযুগীয় বর্বরই রয়ে গেছে। তাই মার্কিন সেনা সরার আগেই যাত্রীবাহী বিমানের ডানায় চেপে দেশত্যাগের চেষ্টায় আকাশ থেকে ভূতলে পড়ে প্রাণ দিতে হয় প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে। সে-চিত্র দেখে শিউড়ে উঠেছে গোটা বিশ্ব। আর তার কয়েক ঘণ্টা আগেই এক আতঙ্কিত মহিলা চিত্রপরিচালকের অভিজ্ঞতা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। এই তথাকথিত ‘আধুনিক’ তালিবান সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছে, তারা মহিলাদের সমাজের অর্ধেক অংশ মনে করে না; নারীদের একমাত্র কাজ সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং পুরুষের সেবা করা। শুধু তাই নয়, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক—সাহিত্যসংস্কৃতির সমস্ত ক্ষেত্রেই নেমে আসবে খাঁড়া। এটাই কি আফগ়ানিস্তানের ঐতিহ্য? জানতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রাচীন যুগে।

আফগ়ানিস্তানে তালিবানদের প্রিয় জায়গা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ক়ন্দহার (Kandahar)। এই পশতো ‘ক়ন্দহার’ তথা উর্দু ‘কন্ধার’ নামটিকে সংস্কৃত ‘গন্ধার’ (না, ‘গান্ধার’ নয় মোটেই)-এর অপভ্রংশ বলেই মনে করা হয়, যদিও প্রাচীন হিন্দু–বৌদ্ধ রাজ্য গন্ধারের এলাকার মধ্যে এখনকার এই ক়ন্দহার শহরের অবস্থান নয়। গন্ধার মানে মহাভারতের রাজমাতা গান্ধারীর বাপের বাড়ি। তার চেয়েও বড়ো কথা, এই অঞ্চল জন্ম দিয়েছিল সুবিখ্যাত গন্ধার শিল্পকলা (Gandhara art)-র। আর পুরাণের সেই সংগীতপ্রিয় উপজাতি গন্ধর্বরাও তো এই গন্ধারেরই বাসিন্দা ছিল। এই গন্ধার রাজ্যের মধ্যেই ছিল তক্ষশিলা ও পুরুষপুর (বর্তমান পেশোয়ার) শহর। বিস্তারিত আলোচনায় না-গিয়েও অনুমান করা যায়, শিক্ষা ও শিল্পকলার সমস্ত দিক আলোকিত করে ছিল হিন্দুকুশ পর্বত-সংলগ্ন এই মহাজনপদ। ২০০১ সালে তালিবান সন্ত্রাসবাদীরা মধ্য আফগ়ানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় নির্মমভাবে ষষ্ঠ শতকের যে-দুটি বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছিল সেগুলি ছিল গন্ধার শিল্পকলার এক অপরূপ নিদর্শন। শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দেখিয়ে এই নতুন তালিবান সরকার যে আরও কত এরকম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তা ভাবলে মন এক অজানা আশঙ্কায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে।

কিছুক্ষণ আগে প্রসঙ্গক্রমে বলছিলাম আফগ়ানিস্তানের এক আতঙ্কগ্রস্ত তরুণী চলচ্চিত্রপরিচালকের কথা। তিনি আর কেউ নন, আফগ়ান চলচ্চিত্র-সংস্থা (Afghan Film Organization)-এর প্রথম মহিলা প্রধান ড. সহরা করিমি (Dr Sahraa Karimi)। তিনি স্লোভাক প্রজাতন্ত্র থেকে চলচ্চিত্রে গবেষণা শেষ করে অনেক আশা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন তাঁর মাতৃভূমি আফগ়ানিস্তানে। তাঁর নির্মিত তিনটি তথ্যচিত্রের মধ্যে অন্যতম হল Afghan Women behind the Wheel (২০০৯), যেটি বিশ্ব জুড়ে প্রচুর উৎসবে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু নিজের দেশে বসে আগামী দিনে চলচ্চিত্রনির্মাণের যে-স্বপ্ন নিয়ে তিনি এসেছিলেন তা সম্পূর্ণ রূপ পাবার আগেই তাঁকে কাবুল ছেড়ে ইউক্রেনের কিয়েভে আশ্রয় নিতে হল।

আফগ়ানিস্তানের চলচ্চিত্রের ইতিহাস কিন্তু খুব নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আফগ়ানিস্তানের আমির হবিবুল্লাহ্ খান তাঁর রাজদরবারের সদস্যদের জন্য চলচ্চিত্র-প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন। আরও কিছু বছর পর রাজধানীসংলগ্ন পগ়মান শহরে জনসাধারণের জন্য জাদুলন্ঠন (magic lantern)-এর সাহায্যে নির্বাক চলচ্চিত্র দেখানো শুরু হয়। তবে আফগ়ানিস্তানের প্রথম নিজস্ব ছায়াছবি হল পশতো ভাষায় ১৯৪৬ সালে রশিদ লতিফ-পরিচালিত সংগীতময় ফিল্ম ইশ্ক ব দোস্তী (ইংরেজি নাম: Love and Friendship)। এই প্রথম ছবিটির কাহিনি কিন্তু খুব মিষ্টি: এক কবি আর এক স্বাধীন নারী ছিলেন পরস্পরের প্রিয় বন্ধু। অথচ আজকের এই তালিবানিস্তানে এই ধরনের আধুনিক ছবির নির্মাণ দূরের কথা, প্রদর্শনও দূর অস্ত্।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগ়ানিস্তানের চলচ্চিত্র হয়তো ইরানি চলচ্চিত্রের মতো ধারাবাহিকভাবে বিশ্বজয়ের ইতিহাস তৈরি করতে পারেনি, তবু কিছু নির্দেশক ও অভিনেতা বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বেশকিছু দাগ রেখেছেন চলচ্চিত্রশিল্পে। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে পূর্বতন তালিবান আমলে নারীদের নিয়ে নির্মিত বহুলপ্রশংসিত ছবি ওসামা (২০০৩)-র কথা। আফগ়ানিস্তান-সহ পাঁচটি দেশের যৌথ উদ্যোগে প্রযোজিত এই ছবির নির্দেশক ছিলেন ছিলেন হার-না-মানা পঞ্জশির প্রদেশের ভূমিপুত্র সিদ্দিক় বরমক (Siddiq Barmak)। এই ছবিতে দেখানো হয়েছে ওসামা ছদ্মনামের আড়ালে-থাকা এক কিশোরীর জীবনযাপনের কাহিনি। নামভূমিকায় অভিনয় করে বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিলেন অভিনেত্রী মারিনা গোলবাহারি (Marina Golbahari)। এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই, এই আন্তর্জাতিক-খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রীকেও শেষপর্যন্ত ধর্মীয় মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুর শিকার হতে হয়েছে। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার পুশানে মাথায় হিজাব না-দিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর শাস্তিস্বরূপ ইসলামি মৌলবাদীরা এই তরুণী পরিচালককে ‘বেশ্যা’ তকমা দিয়ে সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে; দেশে ফিরলেই তাঁকে মৃত্যদণ্ডের হুমকি দেয় তালিবানরা (অথচ ক্ষমতায় তখনও ‘গণতান্ত্রিক’ আফগ়ান সরকার)। শেষপর্যন্ত তাঁর স্বামী নুরুল্লাহ্ আজ়িজ়ি-র সঙ্গে তাঁকে লোকচক্ষুর অন্তরালে এক মানসিক চিকিৎসালয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এতেই স্পষ্ট যে, আমেরিকার হাতে-তৈরি পুতুল-সরকারের অধীনে থেকে নিজেদের আরও হীনবল করে ফেলেছিল আফগ়ানিস্তানের সদ্যবিতারিত ‘উদারনৈতিক’ সরকার। আশরফ় গ়নির আড়ালে সবার অজান্তে গোকুলে বেড়ে উঠছিলেন মোল্লা আবদুল গ়নি বরাদর।

খোদ আফগ়ানিস্তানে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কোনো ছবি তৈরি হয়নি। শুধু তাই নয়, এই সময়ে বহু পুরোনো ফিল্ম পুড়িয়ে নষ্ট করা থেকে শুরু করে প্রেক্ষাগৃহ ধ্বংস করে ফেলার কাজও যথাসম্ভব সুচারুভাবে করার চেষ্টা করেছে তালিবান সরকার। তার মধ্যেই হবিবুল্লাহ্ আলির মতো কিছু চলচ্চিত্রপ্রেমী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাটির নীচে কিংবা গোপন কক্ষে বহু ফিল্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন বলেই হয়তো তালিবানি ধ্বংসলীলার হাত থেকে তারা রক্ষা পেয়েছিল। তবে প্রযোজিত চলচ্চিত্রের বাইরেও আরও বেশকিছু আন্তর্জাতিক মানের ছবি সেই সময়ে তৈরি হয়েছে যাদের কেন্দ্রীয় বিষয়ই হল আফগ়ানিস্তান। প্রখ্যাত ইরানি পরিচালক মোহসেন মখমলবাফ (Mohsen Makhmalbaf)-এর ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি সফ়র-এ গন্দেহার (ইংরেজি নাম: Kandahar) তো রীতিমতো বহুপুরস্কৃত ছবি। এই ছবির অধিকাংশটাই ইরানে তোলা হলেও আফগ়ানিস্তানেও গোপনভাবে বেশকিছু অংশ তোলা হয়েছে। এই ছবির ভাষা কিন্তু দরি বা আফগ়ান ফারসি, যা আফগ়ানিস্তানের একটি প্রধান সরকারি ভাষা। ২০০৩ সালে ছোটোপর্দায় মুক্তি পায় ডেনমার্কের পরিচালক ক্যামিলা নিয়েলসন (Camilla Nielsson)-এর পশতো তথ্যচিত্র Good Morning Afghanistan।

২০০৭ সালে হলিউডে নির্মিত একটি ছায়াছবির নাম না-করলে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিখ্যাত আফগ়ান–মার্কিন সাহিত্যিক খালেদ হোসেইনি (Khaled Hosseini)-র The Kite Runner উপন্যাস-অবলম্বনে জার্মান–সুইস পরিচালক মার্ক ফর্স্টার (Marc Forster)-এর একই নামের ফিল্মের মূল কথোপকথন দরি হলেও এতে ইংরেজি, পশতো ও উর্দু ভাষাও ব্যবহৃত হয়েছে বেশকিছু অংশে। আফগ়ানিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস এই কাহিনিতে তুলে ধরা হয়েছে।

এবার বলি আফগ়ানিস্তানের প্রথম মহিলা চিত্রপরিচালকের কথা। তাঁর নাম সাবা সহর (Saba Sahar)। নামটা শুনে অনেকেরই মনে পড়তে পারে যে, সাবার গাড়ি লক্ষ্য করে এক অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজ গুলি ছোড়ে ২০২০ সালের অগস্ট মাসে, অর্থাৎ এই নতুন তালিবান-জমানা শুরু হবার ঠিক এক বছর আগে। প্রাণে বেঁচে গেলেও এই বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নির্দেশকের ওপর ভবিষ্যতেও আক্রমণ হতে পারে শুধু এই কারণে যে, তিনি আফগ়ানিস্তানের নারীদের ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠে সরব। তাঁর পরিচালিত The Law (২০০৪) ছবিটি যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছিল। ২০০৮ সালে Passing the Rainbow নামে দরি ভাষার একটি তথ্যচিত্রে পুলিস অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেন সাবা। এই তথ্যচিত্রের নির্দেশক ছিলেন দুই জার্মান পরিচালক এল্ফ় ব্র্যান্ডেনবার্গার (Elfe Brandenburger) ও সান্দ্রা শ্যাফ়ার (Sandra Schäfer)।

চলচ্চিত্র থেকে এবার বরং একটু আফগ়ানিস্তানের নাট্যকলা বা রঙ্গমঞ্চের দিকে একটু তাকানো যাক। এই শিল্প পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল আমির আমানুল্লাহ্ খানের রাজদরবারে। ঠিক যেমন তাঁর বাবা হবিবুল্লাহের আনুকূল্যে রাজদরবারে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হত, একইভাবে আমানুল্লাহের হাত ধরে বিদেশি নাটকের প্রদর্শন শুরু হয়েছিল আফগ়ান রাজদরবারে। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমদানি করে দেশকে আধুনিক করতে চাওয়ার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল যখন আফগ়ান গৃহযুদ্ধের ফলে ১৯২৯ সালে তাঁকে অপসারিত হতে হল। আফগ়ানিস্তানের শেষ রাজা মোহাম্মদ জ়াহির শাহ্ যখন ১৯৫০ সালে নতুন সংবিধান রচনা করে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন তখন তিনিও পশ্চিমি ভাবধারায় দেশকে আধুনিক করার চেষ্টা করলেন। তাঁর আমলেই তুরস্কের নাট্যব্যক্তিত্ব ফ়ারুক আফ়ান্দি আফগ়ানিস্তানে এসে নাট্যকলার বিভিন্ন কায়দাকানুন শেখাতে আরম্ভ করেন। আফগ়ানিস্তানের নিজস্ব নাটক প্রযোজিত ও মঞ্চায়িত হতে শুরু করে রশিদ লতিফ়, জালিয়া, নেগাহ্, বশিদ, প্রমুখ নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে। এই সময়েই নাট্যকর্মী ড. ফ়ারহান ও খাই জ়োদা যথাক্রমে জার্মানি ও আমেরিকায় যান নাট্যশিক্ষার উদ্দেশ্যে। তাঁরা দেশে ফিরে নিজেদের উদ্যোগে বহু নাট্যশিল্পী তৈরি করলেও তখন কোনো নাট্যবিদ্যালয় ছিল না। পরে ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয় কাবুল জাতীয় নাট্যশালা (Kabul National Theatre), যা দরি ভাষায় কাবুল নান্দারি নামে পরিচিত। রাজতন্ত্রের অবসানের পর যখন ড. মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহের নেতৃত্বে বামপন্থী সরকার গঠিত হল তখন এই নাট্যশালা পরিণত হয় সংস্কৃতির পীঠস্থানে। দেশবিদেশের শিল্পীরা এই আধুনিক সংস্কৃতির টানে আফগ়ানিস্তানে নিজেদের শিল্পকলার প্রদর্শন করতে লাগলেন। এই কমিউনিস্ট জমানায় মহিলারা অত্যাধুনিক পশ্চিমি পোশাকেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন। পুরুষ ও মহিলা শিল্পীরা একই মঞ্চে পাশাপাশি অভিনয় করতেন, গান গাইতেন, নাচতেন। জাতীয় নাট্যশালার নিজস্ব থিয়েটার কোম্পানির প্রযোজনায় শেক্সপিয়ার, চেখভ ও ব্রেখ়টের নাটকের আফগ়ানীকৃত সংস্করণ মঞ্চস্থ হতে লাগল স্থানীয় ভাষায়। কিন্তু মুজাহিদিনরা যখন তাঁকে অপসারণ করল তখন এই নাট্যশালারও পতন হল। তালিবানরা ১৯৯৬ সালে যখন দেশ দখল করল তখন আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হবার ‘অপরাধে’ ড. নাজিবকে হত্যা করে প্রকাশ্য রাজপথে ল্যাম্প পোস্ট থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য সংস্কৃতির মতো নাট্যচর্চারও আর কোনো ‘প্রয়োজনীয়তা’ থাকল না তালিবান-শাসিত আফগ়ানিস্তানে।

২০০২ সালে তালিবান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে জাতীয় নাট্যশালার সেই থিয়েটার কোম্পানি পুনরুজ্জীবিত হলেও উপযুক্ত প্রেক্ষাগৃহ ও মঞ্চের অভাবে খুব ছোটো আকারে একাঙ্ক নাটক, একক অভিনয়, ইত্যাদিই বেশি প্রদর্শিত হত। মূলত নীতিকথামূলক নাটকই এই সময়ে মঞ্চস্থ হত, আফগ়ানিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন প্রাদেশিক থিয়েটার কোম্পানিগুলোতেও নাট্যপ্রদর্শন হতে লাগল।

বিগত তালিবান-পরবর্তী সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলে আমার এই আলোচনায় ইতি টানতে চাই, কারণ তার মধ্যে ছিল এক আলোকোজ্জ্বল সম্ভাবনার দিশা। ২০০৫ সালে আফগ়ান লেখক ও সাংবাদিক ক়াইস আকবর ওমর (Qais Akbar Omar) এবং মার্কিন সাংবাদিক স্টিফেন ল্যানড্রিগান (Stephen Landrigan)-এর উদ্যোগে আফগ়ানিস্তানের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে দরি ভাষায় নির্মিত হয় শেক্সপিয়ারের কমেডি Love’s Labour’s Lost। এই নাটকে পুরুষ ও নারী চরিত্রের সংখ্যা প্রায় সমান। রুমি ও ওমর খ়ৈয়ামের কবিতাও ব্যবহার করা হয়েছিল এই কাব্যময় নাট্যরূপান্তরে। আফগ়ানিস্তানের একাধিক উদ্যানের উন্মুক্ত পরিবেশে প্রদর্শিত এই নাটক দেখতে দেশবিদেশের সাংবাদিকরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আফগানিস্তানের সাধারণ দর্শক। প্রায় ৩৫ বছর পর আবার শেক্সপিয়ারের কোনো নাটক আফগ়ানিস্তানের মাটিতে প্রযোজিত ও প্রদর্শিত হল। আফগ়ানিস্তানের মানুষ বাস্তব জীবনের ট্র্যাজেডি দেখতে অভ্যস্থ বলেই একটি কমেডি বাছা হয়েছিল—এ-কথা বলাই বাহুল্য। জনগণের বিপুল সারা পেয়েছিল এই প্রযোজনাটি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই নাটকের কুশীলবদের মধ্যে ছিলেন এমন দুজন যাঁদের কথা আমরা আগেই বলেছি। এঁরা দুজন হলেন সাবা সহর ও মারিনা গোলবাহারি। এই সম্পূর্ণ প্রযোজনার বিস্তারিত নির্মাণকাহিনি নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন সাংবাদিকদ্বয়। উৎসুক পাঠক ইচ্ছে করলে পড়ে দেখতেই পারেন তাঁদের এই Shakespeare in Kabul বইটি। বলা বাহুল্য, এই বইটিও দেশদিদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

কিন্তু আবার আফগ়ানিস্তান ফেরত চলে গেছে তালিবানের দখলে। আবার কবে আফগ়ানিস্তান এই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে আলোয় ফিরতে পারবে, আমরা জানি না। আফগ়ান শিল্পীদের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হবে, তাও আমাদের ধারণার বাইরে। এক অজানা আশঙ্কায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে প্রতিমুহূর্তে। যদিও আমার এই আলোচনা আমি মূলত সীমাবদ্ধ রাখলাম অভিনয়যোগ্য শিল্পকলায় (অর্থাৎ চলচ্চিত্রশিল্প ও নাট্যকলায়), প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির অন্যান্য মাধ্যমের অবস্থাও সহজেই অনুমেয়।

উপসংহারে রইল একটি সতর্কতাবাণী: আফগ়ানিস্তান শুধু নয়, সারা বিশ্বই আজ ধর্মীয় মৌলবাদের রক্তচক্ষুর কড়া নজরে। আগেই বলেছি, ‘তালিবান’ শব্দটি শুধু আফগ়ানিস্তানের বিশেষ জনগোষ্ঠীকে বোঝায় না, বরং এর বিস্তৃত অর্থ সমস্ত ধর্মের সমস্ত মৌলবাদীদের নির্দেশ করে। ইসলামিক মৌলবাদ যেমন আমাদের প্রতিবেশী দেশের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছে, হিন্দু মৌলবাদের রক্তচক্ষুও কি একই পথে আমাদের দেশকে চালিত করছে না?

ভাবার সময় এসে গেছে। ভাবুন। ভাবা অভ্যাস করুন।

[লেখক – শিক্ষাগত ভাবে বৈদ্যুতিন ও দূরসংযোগ প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক (B.E.) এবং বিপণনবিদ্যায় স্নাতকোত্তর (MBA) হলেও বর্তমানে পেশাগত ভাবে একটি সর্বভারতীয় প্রকাশনালয়ের বিজ্ঞান-সম্পাদক।নেশায় একজন নাট্যকর্মী, পত্রিকা-সম্পাদক ও সাহিত্যসেবক।]

Facebook Comments

1 thought on “আফগ়ানিস্তানে আমিরশাহির পত্তন তথা বৌদ্ধিক সংস্কৃতির পতন: চলচ্চিত্র থেকে রঙ্গমঞ্চ – অনির্বাণ দে Leave a comment

Leave a Reply