বাঙালী পাঠকের মননে – “আফগানিস্তান” : অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

কৈফিয়ত

আজ থেকে দশ বা বিশ বছর পরে, কোনও বাঙালী পাঠকের হাতে অধমের এই প্রবন্ধটি যদি সহসা এসে উপস্থিত হয় তাহলে তাঁর মনে এই প্রশ্ন আসতেই পারে, হঠাৎ “আফগানিস্তান” কেন? সেই পাঠককে উদ্দেশ্য করেই আমার আজকের এই কৈফিয়ত। আসলে আজকে যে সময়ে এই প্রবন্ধটি লেখা হচ্ছে সেই সময়ে বিশ্বের প্রতিটি ভাষার প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রেই “আফগানিস্তান” প্রত্যহ তার জায়গা করে নিচ্ছে। পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, আপনি কে? আফগানিস্তানের খবর আপনার কাছে শুনতে যাবো কেন? আপনি কি আফগানিস্তানে ছিলেন? না কি আফগান সাহিত্যের কেউ কেটা? অন্তত: ফারসি বা পশতু কোন ভাষায় পণ্ডিত আপনি? এই সকল পাঠককুলের কাছে হাতজোড় করে বলছি, আমি নিতান্তই একজন সাধারণ বাঙালী। বলতে পারেন “ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাইরের পৃথিবীর জন্য আমার, সর্বদা মন কেমন করে”। বাস্তবের দৌড় পশ্চিমে পাঠানকোট পেরিয়ে অমৃতসরের কাছে “ওয়াঘা বর্ডার” পর্যন্ত, যেখানে দাঁড়িয়ে মাইলস্টোনের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন লেখা আছে লাহোর ২৮ কিলোমিটার মাত্র।সেইখানে দাঁড়িয়েই পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের শেষ আভাটির সঙ্গে পাঠানভূমির যে বাতাসটুকুর গন্ধ এসে পৌঁছায়, আমার রক্তমাংসের তার সংযোগ সেইটুকুই।তবে আর পাঁচটা বাঙালীর মতন কল্পলোকের দৌড় কিন্তু বহুদূর, যার উপাদান হল সাহিত্য। আজকের প্রবন্ধে বাংলার সাহিত্য থেকে সংগৃহীত আফগানিস্তান সংক্রান্ত বিভিন্ন রশদগুলো নিয়েই দেশটাকে বোঝবার চেষ্টা করবো। তবে সে চেষ্টা নিতান্তই পরোক্ষ। যে মানুষগুলি প্রত্যক্ষভাবে সপ্তসিন্ধু অতিক্রম করে খাইবার পাসের বিপদকে অবহেলা করে আফগানিস্তানের পথে পথে ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা প্রণম্য।তাঁদের লিখে যাওয়া অভিজ্ঞতাই আমার সম্বল। ফলে কৈফিয়ত অংশে প্রারম্ভেই সেই সমস্ত মানুষজনের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে এই প্রবন্ধে তাঁদের থেকে ঋণস্বীকার করে নিচ্ছি।

সংক্ষেপে আফগানিস্তান ঠিক কেমন?

১৯৪৯ সালে, যেবছর নিউ এজ পাবলিশার্স থেকে সৈয়দ মুজতবা আলীর “দেশে বিদেশে” গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়, ঠিক সেই বছরেই কলকাতায় এউ. এন. ধর এণ্ড কোং থেকে প্রকাশিত “মোসলেম জগৎ” বইতে শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় আফগানিস্তান সম্পর্কে আলোচনা শুরু করতে গিয়ে প্রস্তাবনা অংশে দুটি ঘটনার উল্লেখ করেন। আফগানিস্তানকে দু-এক কথায় জানতে গেলে বা সেখানকার সংস্কৃতিকে অনুধাবন করতে গেলে ঘটনা দুটিকে মনে রাখা আবশ্যিক।

তিনি যা বলেছেন তার মর্মার্থ অনেকটা এইরকম যে, প্রথমত: পৃথিবীর বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শিশু জন্মালে তাঁকে অভিনন্দন জানাবার বিভিন্ন প্রথা যেমন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাঙালীরা নবজাতক বা নবজাতিকার জিভে ও কানে মধু দেয়, কেউ হয়তো দই বা চন্দনের ফোঁটা দেয়।কিন্তু আফগানিস্তানের রীতি ভিন্ন। লেখক বলছেন, আফগান শিশু যে মুহূর্তে প্রথম ভূমি স্পর্শ করে, তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য শাঁখ বা কোনও বাজনা নয়– বন্দুক ডেকে ওঠে। বন্দুকের গুলির শব্দেই আফগান-শিশুর জন্ম। শিশুকন্যা হলে পাঁচ কিংবা সাতবার বন্ধুক ছোড়া হয় আর শিশুপুত্র হলে চোদ্দবার। অর্থাৎ ধনীর প্রাসাদ থেকে শুরু করে দরিদ্রের কুটীরে, দিনে বা রাত্রে যখনই কোন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বন্দুকের শব্দ শোনা যাবেই।

দ্বিতীয়ত: শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন যে মায়ের স্তনে সদ্যোজাত শিশুর পুষ্টির অনুরূপ দুগ্ধ না থাকলে যদি ধাত্রীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়, তাহলে সমস্ত দেশেই সাধারণ সুস্বাস্থবতী ও সচ্চরিত্রা নারীরই সন্ধান করা হয়ে থাকে। কিন্তু আফগানিস্তানে সে আচারের কিছুটা পার্থক্য আছে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এইটা সত্যি যে, ধাত্রীর স্বামী যদি কাপুরুষ অথবা শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন দুর্বল-ব্যক্তি হন, অথবা সে কোনও যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, এ সংবাদ পাওয়া যা, তাহলে সেই নারী সুস্বাস্থ্যবতী কিংবা সচ্চরিত্রা হলেও তাকে ধাত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় না [১]।

“আফগানিস্তান” নামটার একটা উৎপত্তির একটা সূক্ষ্ম দিশা দিয়েছেন মুজতবা আলী স্বয়ং। তিনি বলেছেন, ইহুদিদের হারিয়ে যাওয়া বারো উপজাতির একটা পাঠানরা যখন দেখলো যে তাদের ভাগ্যে শুকনো, মরা একটা দেশ পড়েছে তখন তারা কেঁদে উঠেছিল–ফারসি ভাষায় যাকে বলে “ফগান” করে উঠেছিল – সেই থেকে দেশের নাম আফগানিস্তান। তবে মুজতবা আলী যখন কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে চাকরী নিয়ে গিয়েছিলেন (১৯২৪ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ) সেই সময়টা ছিল আমানুল্লাহ্‍’র রাজত্বকালের অবশিষ্ট কিছু বছর। গাজী আমানুলাহ্‍ খান ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত সার্বভৌম আফগানিস্তানের আমির ও বাদশাহ্‍ ছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী, বাদশাহ আমানুল্লহ্‍’র আধুনিক আফগানিস্তান নির্মাণে সহযোগিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইংরেজি ও ফার্সি ভাষার শিক্ষক হিসেবে আফগানিস্তানে আসেন। সেই সময়ে আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় বাদশাহ্‍ আমানুলাহ্‍’র নেতৃত্বে ইসলামিয়া কলেজের (মুজতবা আলীর ভাষায় “আধক্ষ্যাপা”) পাঠান অধ্যাপক খুদাবখ্‌শ আফগানিস্তান নামের উৎপত্তির সেই তত্ত্ব মানেন না। অধ্যাপকের ভাষায়,

“ত্রিশ বৎসর আগে এ কথা বললে [ফারসি “ফগান” থেকে আফগানিস্তান শব্দের উৎপত্তি] আপনাকে আমরা শাবাশি দিতুম, এখন ওসব বদলে গিয়েছে। তখনো আমরা জানতুম না যে, দুনিয়ার বড়ো বড়ো জাতেরা নিজেদের “আর্য” বলে গৌরব অনুভব করছে। তখনো রেওয়াজ ছিল খানদানি হতে হলে বাইবেলের ইহুদি চিড়িয়াখানার কোনো না কোনো খাঁচায় সিংহ বাঁদর কিছু না কিছু একটা হতেই হবে। এখন সে সব দিন গিয়েছে – এখন আমরা সবাই “আর্য”। বেদ-ফেদ কী সব আছে না? – সেগুলো আমরাই আউড়েছি। সিকন্দর শাহকে লড়াইয়ে আমরাই হারিয়েছি আর গান্ধার ভাস্কর্য আমাদেরই কাঁচা হাত মকশোর নমুনা।“গান্ধার” আর “কান্দাহার” একই শব্দ। আরবি ভাষায় “গ” অক্ষর নেই বলে আরব ভৌগোলিকরা “ক” ব্যবহার করেছেন।”

“কাবুলের পথে পথে” গ্রন্থের লেখক পান্থজন এক পুরনো মুজাহিদ উপকথার উল্লেখ করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে আল্লা যখন সারা পৃথিবী তওরী করলেন, তখন দেখলেন একরাশ ভাঙা টুকরোটাকরা জঞ্জাল এদিকওদিক পড়ে আছে; সেগুলো কোথাও কোনও কাজে লাগছে না। তিনি সেসব তুলে ছুড়ে দিলেন পৃথিবীর উপর। জন্ম নিলো আফগানিস্তান।

পাঠককে স্মরণে রাখতে বলবো পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জনজাতি নিজেদের সৃষ্টির পশ্চাতে দৈব উৎপত্তির তত্ত্ব খাড়া করে থাকে সাধারণত নিজের শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রচার করবার জন্য। কিন্তু আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই উল্টো।তবে মনে রাখতে হবে যে, আধুনিক যুগে আফগানরা যখন এই দেশের শাসন-কর্তৃত্ব অধিকার করে, তখন থেকেই প্রকৃতপক্ষে এই দেশের নাম “আফগানিস্তান” হয়েছে। এর পূর্বে এই দেশের এক অংশ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সেই সময়ে মুঘল দস্তাবেজে আফগানিস্তানকে ভারতবর্ষের একটি অংশ বলেই গণ্য করা হতো। সেই সময়ে বিভিন্ন প্রদেশের নামে এই দেশ পরিচিত ছিল যেমন – হেরাত প্রদেশ, কান্দাহার প্রদেশ ইত্যাদি। ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায় যে গজনি আর কান্দাহার অঞ্চল পরিচিত ছিল আরাকোসিয়া নামে। মুঘল যুগের পূর্বে ইরানের পূর্ব থেকে উত্তর-ভারত পর্যন্ত এই এলাকাটি মধ্য-এশিয়ার মালভূমি নামেই পরিচিত ছিল। জরথ্রুষ্ট্রের প্রচারিত “আবেস্তা” ধ্বনি কিংবা পরবর্তীতে সম্রাট আশোকের প্রচারিত বুদ্ধ বাণীর ও পরবর্তীতে কুষাণ যুগের সাংস্কৃতিক মণ্ডলের পটভূমিকায় যুগযুগ ধরেই পশ্চিমের আক্রমণকারী ও ব্যবসায়ীদের কাছে আফগানিস্তান হয়ে ছিল ভারতবর্ষে প্রবেশের রাস্তা। সপ্তম শতাব্দী থেকে আরবদেশের সৈন্যরা দলে দলে আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে ঢুকতে শুরু করে এবং তখন থেকে শুরু হয় সে দেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার। এরপর চেঙ্গিস খান, সমরখন্দ থেকে তৈমুর লঙ, পরবর্তীতে তাঁর বংশধর জাহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর থেকে শুরু করে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজীব, সকলের ভারই গ্রহণ করেছে এই আফগানিস্তানের ভূমি। ইতিহাস এখানেই শেষ নয়, নাদির শাহ থেকে শুরু করে আহমেদ শাহ দুরানি এবং ব্রিটিশ ও রুশ দেশের সাম্রাজ্য বিস্তারের মাঝে আবদুর রহমানের সময়ে ডুরাণ্ড লাইন এবং পরবর্তীতে আমানুল্লা থেকে শুরু করে কান্দাহারের মুল্লা উমরের তৈরি ধর্মীয় ছাত্র দল “তালিব” এবং সেই থেকে তালিবানের উত্থান-পতন-পুনরুত্থান সবকিছুই দেখছে এই ভূমি। আফগানিস্তানের ইতিহাস নানা রঙে ও নানা ষড়যন্ত্রে রঙিন। তবে ভৌগোলিক দিক থেকে বা নৃ-তত্ত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে আফগানিস্তানকে একদেশ বলা চলে না কখনই। বরং একে মূল জাতি (race) এবং কৌম (tribe)-এর সমষ্টি বলা যেতে পারে। এদের বর্তমান ধর্ম ইসমাল এবং দুরানী আফগানদের এক শাখা বারাকজাইস্‌দের (Barakzais) নেতৃত্বে ১৭৪৭ সালের জুন মাসের পর থেকে এরা একত্রিত বা পরস্পর আবদ্ধ হয়। গবেষকরা বলেন যে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত অটোম্যান সাম্রাজ্যের পর আফগানিস্তানের দুরানি সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য [২]। মূলত: আফগানিস্তানের অধিবাসীদের নিম্নলিখিত চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায় –
১) পশতু ভাষা-ভাষী আফগান বা পাঠান,
২) পার্সি ভাষা-ভাষী তাজিক (Tadjiks), মঙ্গোলীয়“হাজারা” (Hazarah), “চাহার-একম্যাক” (ChaharAimaks) ইত্যাদি,
৩) আফগান-তুর্কীস্থানবাদী তুর্কীভাষা-ভাষী উজবেক,
৪) কাফির প্রভৃতি একজাতীয় আর্যভাষা-ভাষী হিন্দুকুশ কৌম, যে সমস্ত ভাষা মূলত: পৈশাচী প্রাকৃতের অন্তর্গত।
বর্তমান আফগানিস্তানের পূর্বাংশ ভারতবর্ষ এবং পশ্চিমাংশের সঙ্গে ইরানের যোগাযোগ কিছুকাল পূর্বে পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু আজ সবই অস্তমিত। পৃথিবীর মধ্যে বিতর্কিত ও বিচ্ছিন্ন একটি দেশ হয়ে অবস্থান করছে “আফগানিস্তান”।

বাঙালীর দৃষ্টিতে আফগানিস্তানের সমাজ –

একথা একবাক্যে স্বীকার্য যে, প্রায় সমগ্র বাঙালীজাতিই আফগানিস্তানকে চিনেছে মুজতবা আলীর লেখা পড়েই। পাঠান দেশের অদ্ভুত বর্ণনা সেই আমলে মুজতবা আলীর লেখায় বাঙালীরা পড়ে যেমন বিস্মিত হয়েছিল, ঠিক তেমনই কিছুকাল মাত্র পূর্বে প্রকাশিত, অর্থাৎ আমেরিকা আক্রমণের পরবর্তীতে মিলিটারি ডাক্তার পান্থজনের লেখা পড়েও শিহরিত ও চমকিত হয়েছে।

মুজতবা আলী লিখছেন যে “পেশাওয়ার”-এর ছ-ফুটি পাঠান শেখ আহমদ আলি তাঁকে পাঠান মুলুকে আফ্রিদিদের হাত থেকে বাঁচতে খুদাতালার “খাবসুতৎ” আসমানের দিকে না তাকিয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়বার কায়দা শিখিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। অবশিষ্ট সত্যটুকু শিখিয়ে দিয়েছিলেন জালালাবাদের মাইল খানেক আগে সরাইওয়ালার সতর্কবার্তা, “সরাই যদি রাত্রিকালে দস্যুদ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে হে যাত্রীদল, আপন আপন মাল-জান বাঁচাবার জিম্মাদারি তোমাদের নিজের।” লেখক লিখেছেন, আফগানিস্তানে জান সস্তা, মালের দাম ঢের বেশি। তাই “মাল-জান”। বাংলায় তর্জমাটি করলে হয় “ধনে-প্রাণে” মেরো না। “প্রাণে-ধনে” মেরো না কথাটা বাস্তবিকই আফগানিস্তানের জন্যই প্রযোজ্য। প্রাণ তুচ্ছ জিনিষ। খেলায় খেলায় প্রাণ চলে যায় সেখানে। খাইবার পাস দিয়ে যাওয়ার সময় আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগে মুজতবা আলী লক্ষ্য করেছিলেন যে কাবুলি ব্যবসায়ীরা পেশোয়ার থেকে সিগারেট, গ্রামোফোন-রেকর্ড, প্লেট-বাসন, ঝাড় লণ্ঠন, ফুটবল, বিজলি-বাতির সাজসরঞ্জাম, কেতাব-পুথি, এককথায় দুনিয়ার সব জিনিস কিনে নিয়ে যায়। কারণ আফগানিস্তানের শিল্প প্রস্তুত করে মাত্র তিনটি বস্তু – বন্দুক, গোলাগুলি আর শীতের কাপড়। আর সব কিছুই সে সময়ে আমদানি করা হতো নয় হিন্দুস্থান থেকে কিংবা রুশ থেকে। অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি একথাও বলেছেন যে এই সব তথ্য জানবার জন্য আফগান সরকারের বাণিজ্য-প্রতিবেদন পড়তে হয় না, কাবুল শহরে একটা চক্কর মারলেই যে কোনও ব্যক্তিই সেটা বুঝতে পারবেন [৩]। মুজতবা আলীর প্রতিবেদনের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে আর্মির ডাক্তার পান্থজনের বৃত্তান্তটি স্মরণ করতে বলবো যেখানে তিনি তাঁদের মিনিবাসের ড্রাইভার তৈরালাকে আমাদের পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সে রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লার সময়ে পুলিশে চাকরী করতো। কিন্তু পরে তালিবান সরকারের হাতে সে গ্রেপ্তার হয় আর প্রায় একবছরেরও বেশী সময় ধরে তালিবানের অত্যাচার সহ্য করে সে। তালিবান কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় খুব আনন্দ। সগর্বের জানিয়েছিল যে সে ছ’টা তালিবানকে মেরেছিল “এ-কে ৪৭” দিয়ে। ১০০ ডলারে সে “এ-কে ৪৭” কিনেছিল। তবে এখন দাম কমে গিয়েছে। তিরিশ ডলার দিলে পান্থজনের জন্য সেকেন্ড হ্যান্ড একটা “এ-কে ৪৭” আর মুফতে দুটো ম্যাগাজিন সে দিয়ে দিতে রাজি। ভারতীয় ডাক্তার দলের পাছে “এ-কে ৪৭” নিয়ে সঞ্জয় দত্তের মতন অবস্থা হয় সেই ভয়ে সকলে হাঁইমাই করে ওঠে।

আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানীদের অপেক্ষায় আজও ভারতবর্ষের মানুষকে বিশ্বাস করে বেশী। কিন্তু রপ্তানি ব্যবসার জন্য পাকিস্তানকে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই তাদের। জালালাবাদ অঞ্চলে পাকিস্তানী টাকা আজও ভালোভাবেই চলে সেখানে। আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে মুজতবা আলী জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে জনপদবাসী আফগান উপজাতিদের নিয়ে, অথচ তাদের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যা বা শাসন প্রণালী বা আচার-ব্যবহার নিয়ে আজও সেইভাবে গবেষক মহলে চর্চা হয়নি। তিনি সে সময়ে লক্ষ্য করেছিলেন যে কাবুলের গ্রামগুলিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে প্রায় নেই বললেই চলে। মুজতবা আলীর জবানীতে, “কতগুলো ছেলে সকালবেলা গাঁয়ের মসজিদে জড়ো হয়ে গলা ফাটিয়ে আমপারা (কোরানের শেষ অধ্যায়) মুখস্থ করে – এই হল বিদ্যাচর্চা। তাদের তদারক করনেওয়ালা মোল্লাই গাঁয়ের ডাক্তার। অসুখবিসুখে তাবিজ-কবচ তিনিই লিখে দেন। ব্যামো শক্ত হলে পানি-পড়ার বন্দোবস্ত, আর মরে গেলে তিনিই তাকে নাইয়ে ধুইয়ে গোর দেন। মোল্লাকে পোষে গাঁয়ের লোক (দেশে বিদেশে, পৃ. ১৩০)।”

তাই দেশময় অশান্তি হলে আফগানিস্তানের গ্রামগুলিও কোনও রকম আর্থিক ক্ষতি হয় না— বরং বলা যেতে পারে সেইটাই তাদের প্রকৃত রোজগারের সময়। রাইফেল কাঁধে নিয়ে আফগান জোয়ানরা যুদ্ধের মরশুমে তখন লুণ্ঠনে বেরোয়। বাদশাহ কাবুল শহরে বসে প্রধান কর্মটি করেন, সেইটা হল আফগান উপজাতিগুলির লুণ্ঠন প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখা আর সেইজন্যই তিনি সৈন্য পোষেন আর তাদের গোলাগুলিতে খাজনার টাকা ব্যয় করেন।এ যেন এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। খাজনা তোলার জন্য যেমন সিপাই দরকার, তেমনই সেপাই পোষার জন্য খাজনার দরকার।মুজতবা আলী সরসভাবে বলেছেন, “এ-চক্র যিনি ভেদ করতে পারেন তিনিই যোগীবর, তিনিই আফগানিস্তানের বাদশাহ। তিনি মহাপুরুষ সন্দেহ নেই; যে আফগানের দাঁতের গোড়া ভাঙবার জন্য তিনি শিলনোড়া কিনতে চান সেই আফগানের কাছ থেকেই তিনি সে পয়সা আদায় করে নেন। ঘানি থেকে যে তেল বেরোয়, সেই ঘানি সচল রাখার জন্য সেইটুকু ওই ঘানিতেই ঢেলে দেন (ঐ, পৃ. ১৩১)।”

ফলে স্বাভাবিকভাবে নতুন শিল্প বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে নির্মাণ করা যায় না বলেই, উচ্চশিক্ষিত কিছু থাকলেও সেই আমলে কাবুলে শিক্ষিত সম্প্রদায় প্রায় ছিলো না বললেই চলে।তবে অশিক্ষিত বর্বর নন, কারণ সেখানকার মোল্লা সম্প্রদায় অধিকাংশই ভারত থেকে শিক্ষিত। মুজতবা আলী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “গ্রামের অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের উপর এদের [ভারতে শিক্ষিত মোল্লাদের] প্রভাব অপরিসীম এবং গ্রামের মোল্লাই আফগান জাতির দৈনন্দিন জীবনের চক্রবর্তী (ঐ, ১৩২)।” তাই আমান উল্লার পূর্ববর্তী কেউই শিল্প-কারখানা তৈরি করবার কথা ভাবেননি আফগানিস্তানে, কারণ তাতে যে পুঁজি লাগে আফগানিস্তানের কাছে তা ছিল না, আবার বিদেশীদের হাতেও ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ায় তৎকালীন বাদশাহ্‍ আমান উল্লার মত ছিল না। শোনা যায় আমান উল্লার পিতামহ আবদুর রহমান খান (১৮৪০বা ৪৪ – ১লা অক্টোবর, ১৯০১) বলেছিলেন “আফগানিস্তান সেইদিনই রেলগাড়ি চালাবে যেদিন সে নিজে হাতে রেলগাড়ি তৈরি করতে পারবে।” আমান উল্লার পিতা হবিব উল্লা তাঁর পিতাকে পুরোপুরি অনুসরণ করেননি, কাবুলে ইলেকট্রিক লাইন আনবার জন্য কাবুলি টাকায় কিছু যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন। কিন্তু পান্থজনের লেখায় পাই, আফগানিস্তানের উপর আমেরিকার বোমা বর্ষণের পরে সেগুলোর অনেক ক্ষতি হয়েছে।

আফগানিস্তানের অধিকাংশ সাধারণ মানুষই যে তালিবানকে অত্যন্ত অপছন্দ করে পরিচয় আপনি বিশেষত: ভারতীয় হলে সেখানকার মাটিতে পা দেওয়ার পরে পরেই বুঝতে পারবেন। তার কারণ পান্থজনের লেখায় সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তারা যখন নিংহারা প্রদেশের রাজধানী জালালাবাদে বেড়াতে গিয়েছিলেন তখন সেখানকার বড় সর্দার সন্তোখ শিং জানিয়েছিলেন যে রুশ-আফগান যুদ্ধের সময়ে মুসলমানদের সশস্ত্র একটি গেরিলা বাহিনী যারা নিজেদেরকে আফগান মুজাহিদ্দিন বলে পরিচয় দিত তারা লড়াই সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। রুশ সরকারের হাতের পুতুল আফগান সরকারের পতন ঘটলে এই সব মুজাহিদ্দিনদের প্রভাব বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই সব মুজাহিদ্দিন সৈনিকদের অত্যাচারে আফগানিস্তানের শান্তিপ্রিয় লোকেরা বেশ বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। তার সব লোকেদের লুট করত। দোকানদারদের কাছে পয়সা নিত, এমন কি যাকে-তাকে তুলেও নিয়ে যেত। একেবারে চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। পান্থজনের ভাষায় জালালাবাদের সর্দার সন্তোখ সিং-এর জবানীতে,
“পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে তালিবানরা যখন জালালাবাদে ঢুকল তখন সাধারণ লোকেরা তাদের আফগানি ও পাকিস্তানি টাকা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। রাস্তায় আফগানির বৃষ্টি হয়েছিল। তালিবানরা আসামাত্রই মুজাহিদ্দিনদের উপর ওদের নিজস্ব শত্রুতার আক্রোশ দেখিয়েছিল। বহু সৈনিক মারা গিয়েছিল। পরে অবশ্য তালিবানরা মুজাহিদ্দিনদের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে গিয়েছিল (কাবুলের পথে পথে, পৃ. ৯৩)।”

তালিবানদের অত্যাচারের বীভৎসতা পান্থজনের লেখা “কাবুলের পথে পথে” –এর মতন আকরগ্রন্থগুলির স্থানে স্থানে ছড়িয়ে আছে, যার অনেক অংশ টিভি বা মিডিয়ার মাধ্যমে আমরাও এখন জেনে গিয়েছি।

ধর্মের নাম নিয়ে তালিবানরা সাধারণ লোকেদের উপর জোর-জবরদস্তি করতো। দোকানপাট কিংবা বাজারহাট থেকে লোকেদেরকে টেনে এনে নমাজ পড়াত। এই নিয়মানুবর্তিতা বা জোরজবরদস্তিটা স্বাধীনচেতা আফগানীরা একেবারেই পছন্দ করতেন না। শৃঙ্খলায় বাঁধা পড়তে এরা একেবারেই নারাজ। স্বেচ্ছাতেই হয়তো তারা নমাজ পড়তেন কিন্তু তালিবানদের উগ্রতায় সবকিছু ভারসাম্য গেল বিগরে। এক মধ্যযুগীয় শাসন-ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানে। মেয়েদের ব্যাপারে বলত, “জনানির জায়গা হচ্ছে কামরার ভেতরে, নয়তো কবরের মধ্যে।”[৪] আর আল-কায়দার লোকেদের তালিবানরাও নাকি খুব ভয় পেত। আল কায়দার বেশির ভাগ লোকেরাই নাকি ছিল আফগানিস্তানের বাইরের, হয় আরব, বা চেচনিয়া বা সুদান বা ফিলিস্তিনের। পাঠানদের থেকেও না কি তারা ছিলেন ভীষণদর্শন।

২১শে মার্চ “নওরোজ” অর্থাৎ আফগানিস্তানের নতুন বছর যেদিন শুরু হয় সেই সময়ে কাবুলের ইদগাহ মসজিদের পাশে বিখ্যার ফুটবল স্টেডিয়ামে যেখানে একসময়ে তালিবানদের সময়ে লোকেদের বিচারের শাস্তি দেওয়া হতো সেখানেই আর্মির ডাক্তার পান্থজন গিয়েছিলেন আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে। তাঁর বিবৃতিতে আছে কীভাবে তালিবান সেই এক স্টেডিয়াম দর্শকের মধ্যে প্রাচীন শরিয়ত আইনকে অনুসরণ করে শাস্তি দিত। চুরি করলে হাত কেটে দেওয়া, খুনখারাপি করলে গুলি করে মারা বা মেয়েরা দোষ করলে পাথর ছুড়ে মারা – এ সবই এই স্টেডিয়ামে প্রকাশ্য দিবালোকে অনুষ্ঠিত হতো। এ যেন রোম্যান কলোসিয়ামে বসে গ্ল্যাডিয়েটারের মারামারি দেখবার মতন। তালিবানের উচ্ছেদের পর সেই স্টেডিয়াম যে আর শাস্তির জন্য ব্যবহার হবে না এই ভেবেই জনগণ সেখানে আনন্দিত।

তালিব অর্থনীতির উৎস

পান্থজন তাঁর বিবৃতিতে পাবেন সন্তোখ সিং-এর কথা। জালালাবাদের আম, বেদানার গাছের মনোরম সৌন্দর্যের দৃশ্যের আড়ালে অন্য গল্পের খবর পাবেন আপনি। সেই সব ক্ষেত আর গাছগাছালির শ্যামলিমার পিছনে আফিমের চাষ। বিশেষজ্ঞের মতন সে তাদেরকে বুঝিয়েছিলেন কীভাবে আফিম গাছের ফুলের গা থেকে রস বার করে শুকিয়ে আফিমের বড়ি তৈরি করতে হয়। বলেছিলেন, “তালিবানরা আফিম, চরস, গাঁজা সবকিছুরই চাষ করত। আফগানিস্তানে এসব খেতে দিত না কাউকে। সবকিছু চালান করত বিদেশে – তাজিকিস্তান আর উজবেকিস্তানের সীমানা পার করে। পাকিস্তান হয়ে করাচী দিয়েও এসব চালান হত। সারা পৃথিবীর ড্রাগস-এর আড়র ছিল এইসব এলাকা, আর এইসব থেকেই তালিবানদের কাছে পয়সা আসত (কাবুলের পথে পথে, পৃ. ৯৫)।”
ইসলামে মদ্য নিষিদ্ধ হলেও আরও ভয়ঙ্কর মাদকদ্রব্যের কারবারি করে পয়সা রোজকার করে এইসব ইসলামের যমদূতেরা ইসলামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের উপর অত্যাচার করতো।

পানশিরের (পাঞ্জীর) কথা

সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগান পরিচালক হবফুন মৌলা আবদুর রহমান সকল কাজের কাজি (রান্না করা থেকে খুন করা)। তার বর্ণনা অনুসরণ করে সব ধরনের তুষারপাত তিনি দেখলেন- কখনো পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো কখনো গাদা গাদা,কখনো ঘূর্ণিবায়ুর চক্কর খেয়ে দশদিক অন্ধকার করে নেমে আসে – কিন্তু তারপরও এ বরফ সে বরফ নয়, আবদুর রহমানের আর্তস্বর – “না হুজুর, কাবুলের এ বরফ ঠিক বরফ নয়। এ শহুরে বরফ বাবুয়ানি বরফ। সত্যিকার বরফ পড়ে পানশিরে। চেয়ে দেখুন বরফের চাপে এখনো গেট বন্ধ হয়নি। মানুষ এখনো দিব্যি চলা ফেরা করছে, ফেঁসে যাচ্ছে না।”
সৈয়দ মুজতবা আলীকে বোকা পেয়ে কোনো আফগান না আবার তাঁকে ভেজাল বরফের গছিয়ে দেয়, এ আশঙ্কা তাঁর-“নিতান্তই যদি কিনতে হয় তবে যেন আমি কিনি আসল, খাটি মাল, মেড ইন পানশির।”
উত্তর আফগানিস্তানে অবস্থিত পানশিরের কথায় আবদুর রহমান নস্টালজিক হয়, মনে হয়তো অলস কবিত্ব জেগে ওঠে বলে, “শীতকালে সে কী বরফ পড়ে। মাঠ পথ পাহাড় নদী গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যায়, ক্ষেত খামারের কাজ বন্ধ, বরফের তলায় রাস্তা চাপা পড়ে গেছে, কোনো কাজ নেই, বাড়ি থেকে বেরোনোর কথাই ওঠে না। আহা কী আরাম। লোহার বারকোশে আঙার জ্বালিয়ে তার উপরে ছাই ঢাকা দিয়ে কম্বলের তলায় চাপা দিয়ে বসবেন গিয়ে জানলার ধারে। বাইরে দেখবেন বরফ পড়ছে, বরফ পড়ছে, পড়ছে, পড়ছে – দুদিন, তিনদিন, পাঁচদিন, সাতদিন ধরে। আপনি বসেই আছেন, বসেই আছেন, আর দেখছেন চে তৌর বর্ফ ববারদ-কী রকম বরফ পড়ে।”
আজ ২০২১-এর তালিবানরা গোটা আফগানিস্তান মুঠোর মধ্যে নিয়ে এলেও আবদুর রহমানের সুপারিশ করা পানশিরের পতন হল সবে। তালেবানরা মাত্র ক’দিন আগে পানশির তাদের দখলে নিতে পারল। কুড়ি বছর আগেও পানশির ছিল অজেয়। আজকের দিনে সেই আবদুর রহমানের পানশিরে তার নাতি-নাতনীর খবর পেতে ইচ্ছে করে আমার মতন বহু বাঙালীর।

বাঙালীর পাঠকের মননে আফগানিস্তান –
বাঙালী পাঠক মাত্রই আফগানিস্তানকে চিনেছেন সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখার মাধ্যমে। তিনি ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালে আমানউল্লাহ্‍’র পতন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ছিলেন।এই বছরেরই শেষের দিকে তিনি হামবোল্ডট বৃত্তি নিয়ে বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবার জন্য আফগানিস্তান ছেড়েছিলেন। ১৯২৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি হাবিবুল্লাহ খানখানি ওরফে বাচ্চা সাকাও নামের এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন আমানউল্লাহ। সৈয়দ মুজতবা আলীর “দেশে বিদেশে” আমানউল্লাহ ও বাচ্চা সাকাওর কালের জীবন্ত ইতিহাস। আফগানিস্তান সম্পর্কে বাংলায় লেখা বইগুলো পড়লে প্রথমেই মনে হয় একটা রুক্ষ পাহাড় বেষ্টিত একটা বহু ভাষা-ভাষী ও বহু জনগোষ্ঠীর একটি দেশ যাঁরা এখনও পর্যন্ত কোনও জাতি গঠন করে একত্রিত হতে পারেনি। সেই দেশের জনগণ অত্যন্ত কর্মঠ। সৈয়দ মুজতবা আলীর “দেশে বিদেশে” কিংবা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কাবুলিওয়ার বাঙালী বউ” পড়ে জানতে পারি কর্মঠ সেই জনজাতির দেশে রোগ-ভোগ নিতান্তই কম। হয়তো দেশের আবহাওয়া তার কারণ। পানশিরের জল খেলে যে কতোখানি উপকার হয় সে লিস্ট আবদুর রহমান স্বয়ং দিয়েছেন। মূলত: যেকোনো দেশেই তার জনগণের মানসিকতা ভালোমন্দ মিশিয়েই তৈরি হয়। মুজতবা আলী বলেছিলেন যে পেশোয়ার দিনে ইংরেজের কিন্তু রাতে পাঠানদের। স্বাধীনচেতা পাঠানরা তখন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে দেখতে পাই যে যখনই এই স্বাধীনচেতা অথচ অসংখ্য জনগোষ্ঠীর আধার এই দেশটিতে কোনও শক্তি বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতা ফলানোর প্রচেষ্টা করেছে, তখনই তারা কিছুদিনের জন্য পুরাতনকে ঠেলে ফেলে নতুনভাবে সাজতে চাইলেও পুরাতন এসে তাকে আবার গ্রাস করে নিয়েছে। বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে চীনও যখন তাকে সাহায্য করছে, সুদূর ভবিষ্যতে তার পরিস্থিতিও হয়তো তাই হবে। কারণ শারীরিকভাবে অত্যন্ত সক্ষম স্বাধীনচেতা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই জাতির উপর জোর করে বন্দুকের নলের সাহায্যে কিছু চাপিয়ে দিলেও তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেই দেশকে সেই দেশের মতনই পতনোভ্যুত্থানের পন্থা অতিক্রম করে চলতে দিতে হবে। পুরাতনকে রীতিনীতিকে নতুনের সঙ্গে মেলাতে হবে। নিজেদের মধ্যে অসংখ্য ভাষাভাষীদের নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব মিটিতে একজাতিতে পরিণত হতে হবে, নচেৎ বাইরের শক্তি বারে বারে দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও পুরাতন সংস্কার তাকে পিছনে টানবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, একটি শিশুকে যদি সব সময় শিশুকাল থেকে প্রহার করা হয়, সে যেমন ভয়হীন হয়ে যায়, আজকের আফগানিস্তানের অবস্থা তাই। ভয়হীন এক বহুজাতিক দেশ যারা এখনও অন্তর্কলহ মিটিয়ে উঠতে পারেনি, অথচ বাইরের দেশের হস্তক্ষেপে যারা বারংবার নিজেকে হারিয়ে ফেলছে আর ইতিহাসের পুনরাবর্তন ঘটছে।

 

 

গ্রন্থ সূত্র:-
[১] চট্টোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ। ১৯৪৯। মোসলেম জগৎ। ইউ. এন. ধর এন্ড কোং: কলকাতা।
[২] সৈয়দ মুজতবা আলী। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ। দেশে বিদেশে। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড: কলকাতা।
[৩] বন্দ্যোপাধ্যায়, সুস্মিতা।১৯৯৮।কাবুলীওয়ার বাঙালী বউ। ভাষা ও সাহিত্য: কলকাতা।
[৪] পান্থজন। ২০০৯। কাবুলের পথে পথে। আনন্দ পাবলিশার্স: কলকাতা।]


তথ্যসূত্র:-
[১] চট্টোপাধ্যায় ১৯৪৯, পৃ. ৪৯-৫০
[২] দেশে বিদেশে, পৃ. ৩৬
[৩] “The Durrani dynasty”।Luis Dupree, Nancy Hatch Dupree and others। Encyclopaedia Britannica Online।২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-২০
[৪] দেশে বিদেশে, পৃ. ৪৫-৬

 

 

[লেখক – সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান, সংস্কৃত বিভাগ, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়।]

Facebook Comments

Leave a Reply