আজকের আফগানিস্তান এবং ভারতীয় রণকৌশল : আলিউল হক
গড়পড়তা ভারতীয় তথা আমাদের, বাঙালিদের আফগানিস্তানের সঙ্গে পরিচয় মূলত ঋক বেদ, অথর্ব বেদ অনুসারে গান্ধারীর দেশ হিসাবে; বামিয়ানে বৌদ্ধ ধর্মের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের হাত ধরে; নুরিস্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানের উদাহরণে; অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা রহমতের সূত্রে; প্রবল জাতীয়তাবাদী আবহে খান আবদুল গফফর খান বা সীমান্ত গান্ধীর উজ্জ্বল উপস্থিতিতে; সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশের বর্ণনায় এবং সাম্প্রতিক সূত্র হিসেবে সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ এর মাধ্যমে। কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে পরিণত হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ভূখন্ডগত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন হলেও প্রাচীন যুগ থেকেই ভারত-আফগানিস্তান যোগসূত্র অন্তঃসলিলা হলেও বরাবরই বহমান ছিল।
স্পষ্ট করে ভূগোলের ভাষায় বললে, বলতে হয় দক্ষিণ মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত স্থলবেষ্টিত একটি দেশ যার শরীরের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে নিষিদ্ধ পার্বত্য অঞ্চল, ঊষর মরুভূমি আর পশ্চিমাংশে সামান্য একটুখানি সমতল ভূমি নিয়ে ৬,৪৭,৫০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় চার কোটির মতো মানুষকে নিয়ে যে দেশটা বশ্যতা স্বীকার না করার কথা গোলকের ইজারাদারদের বারবার জানিয়েছে নিঃসন্দেহে সেই দেশটিই আফগানিস্তান। চারিপাশটা দেখলে দেখা যাবে দক্ষিণ-পূর্ব অংশজুড়ে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কিমেনিস্থান এবং উজবেকিস্তান, আর উত্তর-পূর্বে তাজিকিস্তান এবং চীন। দেশের মানুষগুলি বহু ‘এথনো লিঙ্গুইস্টিক’ গোষ্ঠীতে বিভক্ত। সহজ ভাষায় বললে বহুভাষা গোষ্ঠীতে বিভক্ত উপজাতি সমাজকে নিয়ে এই দেশটির সংসার। ধর্মীয় পরিচয়ে ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তারমধ্যে ৯০ শতাংশের কাছাকাছি সুন্নি হানাফী মুসলিম, ১০ শতাংশের কাছাকাছি শিয়া। প্রধান উপজাতিগুলি হল পাসতুন (৪০-৪২%), তাজিক (২৭-৩০%), হাজারে (৯%), আইমাক (৪%), তুর্কমেন (৩%), বালোচ (২%), অন্যান্য (৪%) প্রভৃতি। পাসতুনদের বসতি মূলত পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সংলগ্ন এলাকায় এবং এরা ধর্মীয় পরিচয়ে সুন্নি মুসলিম। উজবেক জনজাতি উজবেকিস্তান সংলগ্ন উত্তর অংশে এবং তাজিকরা তাজাকিস্তানের সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস করেন। এই দুটি জনজাতি ধর্মীয় পরিচয় শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এরকম স্বীকৃত উপজাতি গোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৪। প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দারি, পাস্তো, পাসায়ি, তুর্কমেন, উজবেক, নুরিস্তানি, আরবি, বালোচি, ইংরাজি। প্রথম দুটি ভাষা সরকারিভাবে স্বীকৃত এবং মোট জনসংখ্যার বেশীরভাগ মানুষই এই দুই ভাষায় কথা বলেন।
ভূস্বর্গের খুব কাছাকাছি হওয়ায় মনোরম পরিবেশ, প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য, আফিম, এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান এই দেশটির প্রতি বিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলিকে বারবার আকৃষ্ট করেছে কিন্তু এই দেশের পার্বত্য জনজাতিদের, অদম্য বেদুইনদের পরাজিত না হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে বারবার প্রতিহত হয়ে ফিরে গেছে তারা। ইতিহাসের ধূসর সাম্রাজ্যে কিছুটা পথ হেঁটে গেলে আমরা দেখতে পাবো সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত না হওয়া গর্বিত ব্রিটিশরা তিন তিন (১৮৩৮-৪২, ১৮৭৮-৮০, ১৯১৯-২১) বার আফগানীদের কাছে পরাজিত হয়ে আফগান অধিকারের বাসনা পরিত্যাগ করেছে। ক্লান্ত ব্রিটিশ সৈনিক রুগ্ন অর্থনীতি পকেটে নিয়ে যখন ইংল্যান্ডে পৌঁছল, ঠিক তখনই বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত লাল টুপি মাথায় রাশিয়া আফগানিস্তানের দুয়ারে এসে হাজির হলো। রাশিয়ার আনুকূল্যে ১৯৭৩ পর্যন্ত শিয়া রাজতন্ত্র আফগানিস্তান শাসন করল। আবার রাশিয়ার ইচ্ছাতেই ১৯৭৩ সালে আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটল, প্রজাতন্ত্র নেমে এলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে যে ঠাণ্ডা লড়াই যুদ্ধ আবহাওয়া তৈরি হয় এশিয়াতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ইউরোপীয় প্রেক্ষাপট এশিয়াতেও রচিত হতে থাকে। কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের সংকট তারই উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে দুর্ধর্ষ কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে জাঁকজমকপূর্ণ প্রবেশ ঘটে আমেরিকার। গোটা পৃথিবীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজের উপস্থিতি কে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার প্রয়াস শুরু করে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে। কেতাবি ঢঙে সেটা বললে বলতে হবে ট্রুম্যান ডকট্রিন এবং মার্শাল প্ল্যান এর মাধ্যমে। আফগানিস্তানের গুমোট দুর্ভেদ্য পর্বত অঞ্চলের মাটিতেও বইতে শুরু করে শীতল যুদ্ধের উষ্ণ বাতাস। আফগানিস্তানকে ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে রচিত হতে থাকে ‘এক ফুল দো মালি’র পট কথা।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধিতে এখানে বামপন্থার প্রসার এবং শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের মার্কিন বিদেশনীতির আমূল বদলের কারিগর হিসাবে স্বীকৃত, মার্কিন বিদেশনীতির এক্স ম্যান হিসেবে পরিচিত, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ঘরানায় বাস্তববাদী তত্ত্বের অন্যতম প্রয়োগকারী জর্জ কেনান-এর প্রেসক্রাইব করা কনটেইনমেন্ট পলিসি নিয়ে আমেরিকা সোভিয়েত প্রভাব এবং কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রসার রোধের কৌশল হিসাবে ইংল্যান্ড, সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের সহযোগিতায় এই অঞ্চলে রক্ষণশীল, মৌলবাদী, সোভিয়েত বিরোধী মূলত রেডিক্যাল ইসলামিক ওয়াহাবি এবং সালাফি ভাবধারাকে সামরিক এবং আর্থিক সুরক্ষায় ছড়িয়ে দিতে থাকে সমগ্র সত্তর এবং আশির দশক জুড়ে।
ভিয়েতনামের মতো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে হাত না পুড়িয়ে আমেরিকা এইক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে আড়ালে থেকে সোভিয়েত প্রতিরোধকে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিল। সৌদি আরবে উৎপাদিত, মার্কিনী অর্থসাহায্যে প্রসারিত এবং পাকিস্তানের চাষ করা এক ধর্মান্ধ ভাবধারার ফসল হিসাবে জন্ম নেওয়া মুজাহিদিনের প্রয়োজন তখন আমেরিকার কাছে অনিবার্য হয়। আফগানিস্তানের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ঊষর মরু গ্রামগুলিতে অনুরণিত হতে থাকে মুজাহিদিনের আস্ফালন, আর দৃঢ় হতে থাকে ঐ সমস্ত অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ। এমনিতেই পৃথিবী থেকে প্রায়ই ছিন্ন কঠোরভাবে জনজাতি জীবনধারায় অভ্যস্ত কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাসের আবর্তে চলমান সমাজগুলিতে প্রবেশ করে মৌলবাদের কঠোর অন্ধ অনুশাসন এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় ভক্তি মত্ততা। প্রাকৃতিক ভাবেই অলঙ্ঘনীয় বিচ্ছিন্নতায় অবস্থানকারী আফগানবাসীদের মধ্যে এই ভক্তিমত্ততা বিচ্ছিন্নতাকে স্থায়িত্ব প্রদান করে।
১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই মুজাহিদিনদের হাতেই আফগান শাসক খুন হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আফগানিস্তানে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেনি সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে এবার সরাসরি সোভিয়েত পোষিত সরকার গঠিত হয়। কমিউনিস্ট অপশাসনের ফলাফল হিসাবে বা মুজাহিদিনদের প্রভাব বৃদ্ধির কারণেই বা সম্মিলিত ভাবে আমেরিকা, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরব এবং ব্রিটেনের কৌশলগত (কনটেইনমেন্ট পলিসির) সাফল্যের কারণেই হোক কমিউনিস্টদের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বাড়ছিল। উপরন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক রুগ্নতা এবং বিশাল ভৌগলিক অঞ্চলে ইসলামিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিদ্রোহ আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানকে শিথিল করছিল।
অন্যদিকে মুজাহিদ মুজাহিদিনদের জন্য আমেরিকার আর্থিক সাহায্য কমে আসছিল ফলে মুজাহিদিনদের মধ্যেও একাধিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে যেমন আল-কায়েদার জন্ম হয়। এই পরিস্থিতিতে দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা উভয়ই একটি সমাধান রফা চাইছিল। সেইমতো ১৯৮৯ সালের জেনেভাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার প্রশ্নে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে সম্মত হয়। কিন্তু মুজাহিদিন এবং আল-কায়দা এই চুক্তি না মেনে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পাকিস্তান, আমেরিকা এবং সৌদি আরবের মদতপুষ্ট মুজাহিদিনদের একটি অংশ কাবুল দখল করে। ১৯৯৫ সালে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। তালিবান ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নাজিবুল্লাহকে নির্মমভাবে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করে এবং ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেয়। এরমধ্যে ২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর আল কায়েদা আমেরিকায় সন্ত্রাসবাদী আঘাত হানে টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগন আক্রমণ করে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ন্যাটোর যৌথবাহিনী অক্টোবর মাসে আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ডিসেম্বর মাসেই আমেরিকার পুতুল সরকার আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠিত হয় যা ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
তারপরেই আমরা দেখতেই পাচ্ছি তালিবানের নতুন ভ্যারিয়েন্ট। এই নতুন প্রজাতি ভারিয়ান্ট অফ কন্সার্ন কিনা এ নিয়ে বিস্তারিত বিতর্ক চলছে কিন্তু এই পরিস্থিতিতে নতুন আফগান ড্রামাতে যে সমস্ত কারকগুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে তাদের সম্পর্কে সংক্ষেপে না জেনে নিলে বর্তমান তালিবান শাসিত আফগানিস্তান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে না এই নতুন কারকগুলি হল আমেরিকা রাশিয়া চীন পাকিস্তান ইরান তুর্কি উজবেকিস্তন এবং তাজিকিস্তান। এই সমস্ত কারকগুলি কোন স্বার্থে কি ভূমিকা পালন করছে এইটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হলেই ভারতের রণকৌশল সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা বোঝা যাবে। এবার একে একে আমরা এই কারক গুলির গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করব।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকার তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যখন আমেরিকাকে আঘাত করলো তখন বিশ্বজুড়ে আমেরিকার শক্তি এবং গর্বকে ধরে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শ্লোগানের মাধ্যমে ইউরোপের বন্ধুবান্ধব আর ন্যাটো বাহিনী সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই আফগানিস্তানের শহরগুলিকে দখলে আনতে সমর্থ হয়। তবে আফগানিস্তানের মাটি থেকে আল কায়েদা এবং লাদেনকে মুছে ফেলতে আমেরিকার একদশক খরচ করে ফেলে। এরমধ্যে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতির মত আমেরিকার অর্থনীতি চরম সঙ্কটের মধ্যে পড়ে ২০০৮ সালে। কিন্তু তা সত্বেও আফগানিস্তান থেকে ফিরে যাওয়ার চিন্তা তখনো শুরু করতে পারেনি। তালিবানদের সঙ্গে আলোচনা এবং ধাপে ধাপে মার্কিন সেনাদের দেশে ফেরার পরিকল্পনা প্রথম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে। পরবর্তীকালে ট্রাম্প এই পথে কিছুটা এগিয়ে যান। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের হাত ধরে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পেছনে দুর্বল মার্কিন অর্থনীতি অবশ্যই একটি কারণ। দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করার মত সংস্থান বর্তমান মার্কিন অর্থনীতির কাছে যথেষ্ট চাপের। তাহলে আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণের উদ্দেশ্য কি সফল হয়নি? এককথায় হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর অসম্ভব, কারণ একদিকে যেমন আল-কায়দা কে প্রায়ই নিঃশেষ করে দেওয়া গেছে, লাদেনকে নিকাশ করা গেছে, কিন্তু দীর্ঘ কুড়ি বছরেও আফগানিস্তানে গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা যায়নি। শুধু কাবুল কেন্দ্রিক একটা ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বা ক্ষমতার ভাগাভাগিকে সেভাবে উৎসাহ দেয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সাধারণ আফগান নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। বহু ভাষা, ধর্ম সম্প্রদায় এবং জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত আফগানদের একটি সাধারণ জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলার মানসিকতা গঠন করা যায়নি। সীমাহীন দুর্নীতি সাধারণ মানুষের ব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরিতে বাধা দিয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য আমেরিকা বরাদ্দ করেছে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মাধ্যমে ঘুরপথে সেগুলি তালিবান সহ আরো অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলির প্রচার এবং প্রসার এর কাজে ব্যয় করা হয়েছে।
তিন সাড়ে তিন লক্ষ আফগান সৈন্যবাহিনীকে আমেরিকা শুধুমাত্র সন্ত্রাস বিরোধী বাহিনী হিসাবে তৈরি করেছে। তারা এমন সেনাবাহিনী তৈরি করতে চায়নি যারা সীমান্ত রক্ষা করবে বা সাধারণ মানুষকে রক্ষা করবে। তাদেরকে যথাযথ অস্ত্রশস্ত্র এবং উপকরণ, রণকৌশলের শিক্ষা প্রদান করেনি। এর ফলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আমেরিকার সঙ্গে তালেবানদের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, এই বিশাল সংখ্যার সেনাবাহিনীর মনোবল তখন ভেঙে পড়তে শুরু করে। এর সঙ্গে নিয়মিত বেতন না পাওয়া, দেশাত্মবোধের অভাব, এবং চরম দুর্নীতি আফগান সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে। বাস্তবে গ্রামাঞ্চলগুলি তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে শুরু করে এবং এই ভঙ্গুর সেনাবাহিনী এক মাসের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
কার্যত বিনা বাধায় তালিবানরা কাবুল দখল করে। এককথায় আমরা বলতে পারি মার্কিন আক্রমণের সময় আফগানিস্তান যাদের হাতে ছিল, মার্কিন সেনা দেশে ফিরে যাওয়ার সময় আফগানিস্তান তাদের হাতেই রইল। তবে এর মধ্যে বিশ্ব ব্যবস্থায় এবং বিশেষ করে মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় রাষ্ট্রশক্তিগুলির মধ্যেকার সমীকরণের আমূল বদল এসেছে। সেই অনুযায়ী বদল এসেছে মার্কিন বিদেশনীতিতেও। মার্কিন জনগণের বৃহত্তম অংশ এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতিকে সমর্থন করছে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা এখন আর সেইভাবে নেই। তবে ভূ-রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এই সিদ্ধান্ত আমেরিকাকে বিপদে ফেলবে। আগস্ট মাসে ৯৮ বছর বয়সী কিসিঞ্জার বলছেন সেনা প্রত্যাহারের তাড়াহুড়ো আমেরিকার বন্ধুদের অসন্তুষ্ট করবে, শত্রুদের করবে উৎসাহিত, আর পর্যবেক্ষকদের বিভ্রান্ত। অর্থাৎ এই সেনা প্রত্যাহার পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে পাল্টে দেবে।
কিন্তু বাইডেন প্রশাসন মনে করছেন বর্তমানে আফগানিস্তানে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখার চেয়ে চীন এবং রাশিয়াকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, এখন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যা এখন থেকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী পরিকল্পনার বাস্তবায়নকে আর মাটিতে সেনা নামিয়ে করবে না। বিকল্প আকাশপথ ব্যবহার করা হবে, কৃত্রিম উপগ্রহ এবং স্বয়ংক্রিয় ড্রোন সেখানে ব্যবহার করা হবে। গণতন্ত্র এবং জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সেনার বিকল্প পথ বেছে নিতে হবে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কৌশল হিসাবে আরও বেশি করে বিদেশনীতিতে অর্থনীতি এবং কূটনীতিককে ব্যবহার করতে হবে। আমেরিকার এই কৌশল সফল হবে, নাকি ব্যর্থ হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানই দিতে পারবে। তবে আমরা আবার দেখতে পেলাম ইংল্যান্ড এবং রাশিয়ার পর আমেরিকাও শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানকে বাগে আনতে না পেরে এই মাটি পরিত্যাগ করলো।
রাশিয়া এবং চীন
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকার পরে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারক হল নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র, রাশিয়া এবং চীন। ২০০১ সালে আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণে বেইজিং এবং মস্কো কেউই বিরোধিতা করেনি, কারণ আল-কায়েদা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে এই অঞ্চল থেকে উৎখাত করার আমেরিকার সেই তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ ছিল না। তবে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার পদচারণা তাদের মনে শঙ্কার বীজ বপন করেছিল। স্বাভাবিকভাবে বর্তমান আফগানিস্তানে মার্কিন মিশনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি মস্কো এবং বেইজিংয়ের কাছে মুচকি হাসার কারণ নিয়ে এসেছে। কারণ রাশিয়া আজও ভুলতে পারেনি যে গত শতাব্দীর আশির দশকে মার্কিন সমর্থিত জিহাদি অভ্যুত্থান কারণেই আফগানিস্তানে সোভিয়েত হেনস্থার শিকার হয় এবং শেষে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহার চীনের প্রশান্তিরও কারণ হতে পারে। বিশেষ করে এখন যখন আমেরিকা বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্ষয়িষ্ণু শক্তি, এবং চীন যখন পাশ্চাত্য মডেলের বিকল্প হিসাবে সবচেয়ে প্রতিভাবান শক্তি। সে এখন দ্রুত আমেরিকার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে পারছে। ট্রাইফেকটার (তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্রদের উপর গুলি চালনা-১৯৮৯, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন-১৯৯১, উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার জয় -১৯৯১)-এ চীন আমূল বদলে যেতে থাকে। সি চিন পিং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বললেন, চোখে পড়েনি এমন অনেক পরিবর্তন গত এক শতকে বিশ্বে ঘটেছে তবে এই পরিবর্তনের সময় ও গতি আমাদের পক্ষে। দুটি শক্তিই প্রথম থেকে নতুন তালিবানি শক্তিকে ভীষণভাবে বিশ্বাসের চোখে দেখছে। বারবার বিশ্বকে তালিবানদের সময় দেওয়ার কথা তুলে ধরেছে। সমগ্র আফগানিস্তানে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হলেও এই দুটি দেশের দূতাবাসের মধ্যে কোন হেলদোল চোখে পড়েনি এই চিত্র ই তালিবানদের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়ার ইঙ্গিত বহন করে।
ইরান
ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সংঘাত চীন এবং রাশিয়ার থেকেও পুরনো। তাই এই অঞ্চলে মার্কিন সেনার অপসারণ তেহরানকে অবশ্যই খুশি করবে।
পাকিস্তান
পাকিস্তান আমেরিকার পুরনো বন্ধু হলেও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে ইসলামাবাদও উল্লসিত। কারণ এর ফলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তান আরো বেশি করে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক কালে পাকিস্তানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু চীনকে আফগানিস্তানে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে কার্যকরী সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাতে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব অনেকাংশেই লঘু করা সম্ভব হবে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে আফগানিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আফগানিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পাকিস্তান যতটা দক্ষ, স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে ততটা কার্যকরী নয়। তবে আফগানিস্তানে নতুন সরকার গঠন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের আইএসআই এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্পষ্ট ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তুরস্ক
এই অঞ্চলে আফগান সমীকরণে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারক হল তুরস্ক। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর কাবুল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তুরস্ক। যদিও আমরা জানি আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণের অন্যতম সহযোগী ছিল তুরস্ক। কারজাই শাসনকালে আফগান সেনা এবং পুলিশের ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে তুরস্ক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে। আবার স্বাধীনভাবে মানব উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজকর্ম আফগানিস্তানে সে করেছে। এককথায় তুরস্ক পাশ্চাত্য শক্তি এবং তালিবানের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষম সম্পর্ক সমান্তরালভাবে রেখে চলেছে। তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই নিবিড় থেকেছে। এই সম্পর্ক বর্তমানে আরো দৃঢ় হয়েছে এরদোগান শাসনে। এরদোগানের মুসলিম জগত কে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা এই অঞ্চলের ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিকে একই ছাতার তলায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে চলেছে।
এই সূত্রেই আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকাকে ভালো চোখে দেখে না তুরস্ক। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মঞ্চে কাশ্মীর প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে সে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশে জামাতি ইসলামী নেতাদের ফাঁসির সাজাকে তুরস্ক নিন্দা করেছে। আবার রোহিঙ্গা সংকটে সে ঢাকার পাশে দাঁড়িয়েছে। আঙ্কারা বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের এই সার্বিক সক্রিয়তা ভারতের বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উঠে আসছে।
তবে তুরস্কের বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে সবসময় স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা গেছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য তবে তার স্বার্থের অনুকূলে না হলে ন্যাটো থেকেও বেরিয়ে আসতে দ্বিধা করে না। তার কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে গিয়ে জোটের সুবিধাকেও সে উৎসর্গ করতে রাজি। যে সোভিয়েত ভীতি থেকে তুরস্ক ন্যাটোতে যোগদান করেছিল, দুর্বল রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা উভয় কাজই সে এখন করতে প্রস্তুত।
তুরস্ক ছিল প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যে ইজরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, আবার বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করেই আরব দুনিয়ায় প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে সচেষ্ট। এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান দুটি দেশের সঙ্গেই তুরস্কের বর্তমানের নৈকট্য ভারতকে বিকল্প কূটনৈতিক পথ অনুসন্ধানে বাধ্য করছে।
বলা কথায় কূটনৈতিক সমীকরণ
যাইহোক ভারতের কূটনৈতিক রণকৌশল প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে আজকের আফগান পরিস্থিতিতে এই দেশগুলির রাজনৈতিক অবস্থানকে আমরা একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। তাৎক্ষণিক ভাবে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে মস্কো, বেইজিং, তেহরান এবং ইসলামাবাদ – সকলেই খুশি। তবে দীর্ঘকালীন বাস্তবতায় সকলের মনে উদ্বেগের মেঘ ঘোরাফেরা করছে। প্রত্যেকের কাছেই এটা স্পষ্ট যে এই সেনা প্রত্যাহারের ঘটনায় আফগানিস্তানে যে ক্ষমতা-শূন্যতা এবং তালিবানের পুনরুত্থান হল, তার ফলাফল সকলকেই সমানভাবে স্পর্শ করবে। মস্কো এবং বেজিং কেউই চায় না যে তালিবানের ছত্রছায়ায় আফগানিস্তান আবার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নার্সারি হয়ে উঠুক। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তালিবানদের সমর্থন পেতে পারে। তেহরান সুন্নি বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কিত সমস্যা, শিয়াদের অধিকার, এবং পার্সি ভাষাভাষী সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত। পাকিস্তান ডুরান্ড লাইনের ওপারের বিবাদের উপচে পড়া প্রভাব পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে পারবে না। শুধু তাই নয় পাকিস্তান হয়ে উঠতে পারে তেহরিক-ই-তালিবান-এর মত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির আশ্রয়দাতা। এই সকল কারণে আফগানিস্তানে যা ঘটমান বর্তমান, তা পাকিস্তানের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। অন্ততপক্ষে তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তানের তালিবান নৈকট্য এবং চীনের আর্থিক সচ্ছলতা বর্তমান আফগানিস্তানের রূপান্তরে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করছে তালিবানি শাসন কতটা বিভিন্ন আফগান উপজাতিদের সঙ্গে নিতে পারছে তার উপর, তা না হলে আফগানিস্তানে আবার নতুন গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে।
ভারতের রণকৌশল
বর্তমান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ জাতি গোষ্ঠীগত সমীকরণ, প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা, আঞ্চলিক শক্তিগুলির সক্রিয়তা, আন্তর্জাতিক কারকগুলির কার্যকারিতা – এই সমস্ত বিষয়গুলি ভারতের রণকৌশলের রাস্তাটিকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এগুলির পারস্পরিক ঘাত প্রতিঘাতের মাঝে দাঁড়িয়ে ভারতকে রিয়াক্ট করতে হবে শুধুমাত্র। প্রোএকটিভ পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ ভারতের কাছে নেই বললেই চলে। তালিবান-আমেরিকা আলোচনা শুরুর সময় থেকে আলোচনা প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা ভারত করেনি। পাকিস্তান এবং তুরস্কের মত দেশ আলোচনা প্রক্রিয়ায় ভারতের যুক্ত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে এটা সত্য, তবে এই বাধা কাটানোর সক্রিয় কোন বিকল্প কূটনীতিক পথ ভারতকে অনুসরণ করতে দেখা যায়নি।
ফলে আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরাসরি অংশগ্রহণ করার সুযোগ নষ্ট করেছে। গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে ভারত ভিশন উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে, তবে এই ভূমিকা আমেরিকার ছত্রছায়ায় থেকেই তারা পালন করেছে। আফগানিস্তানের মাটিতে ভারত আমেরিকার দীর্ঘ ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তোলার কোন প্রচেষ্টায় সচেষ্ট থাকেনি। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ জাতিগোষ্ঠী গত সমীকরণকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। এই অঞ্চলের ছোট কারকগুলি, যেমন উজবেকিস্থান, কাজাকিস্তান, কিরগিজিস্তান, যাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো, তাদের মাধ্যমে তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার রাস্তাটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেনি ভারত।
বর্তমানে আফগান পরিস্থিতিতে চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, কারোর সঙ্গেই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী জোট উপস্থাপন করতে পারেনি। বরং বলা যেতে পারে রাশিয়া অনেকটা চীনের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আমেরিকা আফগানিস্তানে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ন্যাটো তথা ইউরোপের জোট সঙ্গীদের মত ভারতকেও না জানিয়ে এককভাবে গ্রহণ করায় ভারতের সামনে কূটনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের সর্বপ্রথম যেটা করা প্রয়োজন তা হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির চক্রব্যূহে আমেরিকার ছায়া থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা।
তবেই ভারত তার নিজস্ব পরিচয়কে জোরালো ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। সমগ্র বিশ্বে তথা দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সামরিক শক্তি বলে যে আগ্রাসী আক্রমণাত্মক বিদেশনীতি প্রসার ঘটাচ্ছে তাকে প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে একে প্রতিরোধ করতে হবে। তুরস্কের বিদেশনীতির প্রতিরোধক হিসাবে তুরস্কের অপছন্দের দেশগুলির সঙ্গে যেমন ফ্রান্স, মিশর, সৌদি আরব এবং ইউ এ ই-র সক্রিয় সহযোগিতায় তুরস্ককে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। উদাহরণ হিসাবে ভূমধ্যসাগরে ভারত-গ্রীস যৌথ মহড়ায় কথা বলা যেতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব আফগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। আফগানিস্তানে বিভিন্ন পরিকল্পনায় ভারতের বিনিয়োগ যাতে পুরোপুরি নষ্ট না হয় তার জন্য দ্রুত কাজ শুরু করার এবং দূতাবাস খোলার চেষ্টা করতে হবে। কাশ্মীরের পরিস্থিতি আরো খারাপ যাতে না হয় তার জন্য আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আফগানিস্তানের সংকট কাশ্মীরের অস্থিরতার বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
সব দিক বিচার করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো বর্তমান আফগান পরিস্থিতিতে ভারতের বিদেশ নীতিকে খুব সন্তর্পণে পা ফেলতে হবে। অনুসরণ করতে হবে বিখ্যাত চৈনিক নীতি-“সময় না আসা পর্যন্ত নিজেকে আড়ালে রেখে অপেক্ষা করো।” সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিকে ব্যবহার করতে হবে, যাতে আফগানিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদের ভিত্তিভূমি তৈরি না হয়। মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত না হয়। ভাবতে হবে কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের এবং নারীর অধিকার কীভাবে সুনিশ্চিত করা যায়। এই কাজে ভারতকে Shanghai Cooperation Organisation, South Asian Association for Regional Cooperation, SQUAD, United Nations Security Council, United Nations Human Rights Council, United Nations Highcommissioner for Human Rights, G -7, এর মত মঞ্চগুলিকে সদর্থক ভাবে ব্যবহার করতে হবে। অবশ্যই বর্তমান আফগানিস্তানের শাসকদের আশ্বস্ত করতে হবে যে মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং মানবাধিকারের গঠনমূলক কাজকর্মে ভারত সর্বদাই আফগানিস্তানের পাশে থাকবে, যার ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন-এর মঞ্চ থেকে দিয়েছেন।
[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, চাকদহ কলেজ, চাকদহ, নদীয়া।]
Posted in: ARTICLE, September 2021 - Cover Story