লৌকিক – অলৌকিক – অলীক মানুষ : উমাপদ কর
কবি ও গদ্যকার উমাপদ কর বছর আটেক আগে গল্প ও উপন্যাসকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনন্য উপন্যাস “অলীক মানুষ” নিয়ে চরিত্রভিত্তিক একটি দীর্ঘ আলোচনা তথা গদ্য লেখেন, যা প্রকাশ পায় “বিনির্মাণ” পত্রিকায়। সম্প্রতি অপরজন পত্রিকার তরফে সেই গদ্যটি প্রকাশ করতে চাইলে তিনি পূর্বোক্ত গদ্যটিকে সংযোজন-বিযোজন-বিবর্ধন ইত্যাদির মাধ্যমে পুনর্লিখিত করেন। গদ্যটি দীর্ঘ। লেখকের সম্মতিক্রমে আমরা বেশ কয়েকটি কিস্তিতে (৬-৭) আলোচনাটি প্রকাশ করব ধারাক্রমে প্রতিমাসে। এই সংখ্যায় তার ষষ্ঠ পর্ব।]
স্বাধীনবালা
স্বদেশী যামিনীবাবুর মেয়ে। মা সুনয়নী। শিক্ষিতা সুন্দরী যুবতী। বাবা শহীদ হন ইংরেজ স্ট্যানলি দ্বারা। কপর্দকশূন্য অবস্থায় বহরমপুর থেকে দেবনারায়ণ বাবুকে চিঠি লিখে আশ্রয় পায় ব্রহ্মপুরের ব্রাহ্ম আশ্রমে। একমাত্র ধ্যানজ্ঞান পিতৃহত্যার প্রতিশোধ। আশ্রমে থেকেও তাই পিস্তলের খোঁজ করে। স্বদেশী হাজারীলাল ওরফে হরিনারায়ণ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। মুসলমান জেনেও শফির সঙ্গে আলাপ করে নানাভাবে সে সখ্যতা গড়ে তোলে। প্রেম বিষয়ে এই যুবতী অন্যদের মতো নয়, কিছুটা হেঁয়ালি ভরা। শফির সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন কৌতুক ও হেঁয়ালি মিশ্রিত, তেমনি হরিনারায়ণের সঙ্গেও সম্পর্ক হেঁয়ালিপূর্ণ। বস্তুত তার লক্ষ্য পিতৃহত্যার প্রতিশোধ, তার জন্য পুরুষের প্রতি যেটুকু ও যেমন আচরণ প্রয়োজন এবং সম্পর্কের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা রাখা দরকার, শিক্ষিতা স্বাধীনবালা তাই করেছে। চমক হিসেবে স্ট্যানলি হত্যার পূর্বে সে নিজের তর্জনী কেটে রক্ততিলক পরিয়ে দেয়, যেন তারা যথেষ্ট উত্তেজিত থাকে। হত্যা বিষয়ক কার্যসিদ্ধির পর শফিকে প্রণাম করে, কৃতজ্ঞতা জানায় সারাজীবনের, ‘লক্ষ্মীটি’ বলে হাত ধরে। আবার উদাসীন হয়ে পড়ে। শফির সামান্য দুর্বলতা প্রকাশ পেলে জানিয়ে দেয়— ভগবান তাকে অনেককিছু দিলেও একটা জিনিস দেননি, আর সেটা হলো পুরুষের প্রতি প্রেম। আবার প্রবল বন্যায় হরিনারায়ণের মৃত্যু ঘটলে সেই স্বাধীনবালাই আশ্চর্যজনকভাবে হিন্দু রমণীর মতো সাদা থান পরতে শুরু করে। তবে কি তাদের বিয়ে হয়েছিল? তেমন কোনো আভাস উপন্যাসে নেই। নাকি এ বৈধব্য মানসিক, শারীরিক কিছুই নয়। শফির প্রতি তার দুর্বলতার কিছু চিহ্ন দেখা যায়। তবে কি মুসলমান বলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া? এসব নানা প্রশ্ন তার চরিত্রচিত্রণ থেকে উঠে আসে। সম্ভবত ঔপন্যাসিক এই চরিত্রটিকে হেঁয়ালিপূর্ণ করেই রাখতে চেয়েছেন। তাই নানারকমের স্ববিরোধিতা দেখা যায় তার চরিত্রে। চিরকাল স্বদেশীয়ানাতেই মাতোয়ারা সে। শেষে ইংরেজ নিধন করতে গিয়ে নিজেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তার চরিত্রের জটিলতা, স্ববিরোধিতা, হেঁয়ালিপনা সত্ত্বেও সেই সময়কালীন অবস্থানে সামাজিক ভূমিকায় তাকে যথেষ্ট অগ্রবর্তিনী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
রত্নময়ী
কৃষ্ণপুরের জমিদার কন্যা। আরবি ফারসি ইংরেজি শিক্ষিতা বিদূষী মহিলা। অত্যাচারী পিতার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণা। তাকে মায়ের হত্যাকারী মনে করে। পিতার নারী নিয়ে নানা কেচ্ছায় সে বীতশ্রদ্ধ। দাদা হরিনারায়ণ স্বদেশী। ফলে সে একাকী এবং মানসিক রোগগ্রস্তা, ফিটের ব্যামো, নিজ অভীষ্ট লক্ষ্যে খানিকটা যান্ত্রিক আচার আচরণ। জিনে ধরেছে বলে একবার তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বদুপিরের কাছে, সেখানে তাঁর সঙ্গে হয়েছিল তীব্র বাদানুবাদ। সাধারণে বিশ্বাস কিছুটা রোগমুক্তি হয়েছিল তার। কিন্তু হরিনারায়ণের বিশ্বাস, সে বেঁচে আছে সংবাদ পেয়ে রত্নময়ী কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। এটা ঠিক, দাদা হরিনারায়ণের প্রতি রত্নময়ীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। শফির সঙ্গে আলাপে রত্নময়ী বুঝতে পারে তার ভেতরের আগুন। সহজেই শফির সঙ্গে তার এক ধরনের ভালোলাগা জন্মায়। সে শফিকে চিঠি দেয়, নেমন্তন্ন করে, প্রণাম করে এবং অভীষ্টের কথা জানায়। আবার অজ্ঞান হয়েও যায়। অবদমিত ক্রোধ, নিরাপত্তাহীনতা, মার জন্য শোক, দাদার জন্য মানসিক চিন্তা, বাবার প্রতি বিদ্বেষ, ব্যক্তিজীবনে প্রায় প্রেমহীনতা সবমিলিয়ে চরিত্রটা জটিল। তৎকালীন যুগে তার রোগটিকে কেন্দ্র করে তাকে জিনে ধরা বা অলৌকিকতার দিকে ঠেলে দেওয়াই সামাজিক অবস্থান। আবার ‘জিন’ বিষয়টি লেখাপড়া জানা শিক্ষিতা রত্নময়ী নিজে কি বিশ্বাস করত, না তার মধ্যেও ‘জিন’ এই অলৌকিকের প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল, গোটা অবস্থানকেই একটা হেঁয়ালি ও ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছেন উপন্যাসকার। এতে চরিত্রটির মধ্যে নিজস্ব খানদানের প্রতি অনাগ্রহ জোরালো হয়ে একটা রহস্যের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু রোগটি যে হিস্টরিয়া তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। শফির জন্য তার আগ্রহ, কৌতুক ও উদ্বেলতা শফিকেও যথেষ্ট উত্তেজিত করে, আগ্রহী করে। পরিণতিতে পিতৃহন্তারক হতে পারে এমন একজনকে (শফি) প্রণাম করতেও তার বাধে না। হত্যার পর অবশ্য তাদের আর দেখা হয়নি। পরে শফির দণ্ডাজ্ঞা মকুবের জন্য নিজের মতো করে চেষ্টা করে। চিঠি পাঠায় পির বদিউজ্জামানকে। যা থেকে বোঝা যায় সে অকৃতজ্ঞ নয়। শফির সঙ্গে কোনোভাবে তার দেখা হলে কী হতো তা আর জানা বা বোঝা যায় না। একটা অমীমাংসার মধ্যেই রাখা হয়েছে তার চরিত্রটি।
মনিরুজ্জামান
মৌলানা বদিউজ্জামান ও সাইদা বেগমের মেজছেলে। জন্ম-প্রতিবন্ধী। মুখ দিয়ে লালা বেরোয়। পায়ে হেঁটে চলতে পারে না। নড়বড় করে পাছা ঘষটে চলে। প্রায় জড়বুদ্ধি। বদুপিরের পির-মাজার নিয়ে আপত্তি থাকায়, সাইদা তাঁকে না-জানিয়ে খোঁড়াপিরের মাজারে গিয়ে ছেলের জন্য সিন্নি চড়িয়েছিল। সাইদা মনে করে সেই থেকে মনিরুজ্জামানের খানিক হুঁশবুদ্ধি ফিরেছে। আবার এও মনে করা হয় কোবরেজ মশাইয়ের ওষুধের গুণেও তা হতে পারে। বয়সের গুণে বিকৃত কামুক সে। শফিউজ্জামান তার দাদার এই অশ্লীল কামুকতার পরিচয় পেয়েছে। “তারপর মনিভাইয়ের দিকে চোখ পড়ল। সে আমার দিকে তাকিয়েছিল। মুখে কেমন একটা হাসি। তারপর সে দুইহাতের আঙুল দিয়ে মিথুন-সংকেত দেখাতে লাগল।” দাদার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে শফির মন। শফি নাবালক থাকায়, বারিচাচার আপত্তিতে আর দরিয়াবানুর জেদাজিদি ও বদুপিরের সম্মতিতে দরিয়াবানুর যময দুই মেয়ে দিল আফরোজ বা রোজি এবং দিলরুখ তথা রুকুর বিয়ে ঠিক হয় যথাক্রমে নুরাজ্জামান ও মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। এই রুকুকেই ভালোবাসে শফি। তাই বাবা বদুপির যখন শফির সম্মতি আদায় করে শফি কোনো প্রতিবাদই করতে পারে না। কিন্তু সে হতাশ হয়। আর বিয়ের দিন আসার আগেই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে যায়। মনিরুজ্জামানের সঙ্গে রুকুর বিয়ে সে মন থেকে মানতে পারেনি। মনিরুজ্জামান এতসব জানে না, বিয়ের চিন্তায় সে আনন্দিত ও উত্তেজিত। বিয়ের পর অনেকটা বদলে যায় মনিরুজ্জামান। সে হাঁটার চেষ্টা করে, লালা মুছতে পারে, গোঙানিসহ দু-চারটে কথাও বলতে পারে। তবে রুকুর সঙ্গে আচরণে সে অস্বাভাবিক। “যখন-তখন একটা জন্তুমানুষের কামার্ত আক্রমণ, এমন-কি রজস্বলা অবস্থাতেও রেহাই নেই।” হ্যাঁ, রুকুর কাছে সে একটা জন্তুমানুষ। আর রুকু বাধ্যত চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চিপে অবশ শরীরটা দিয়েই চু্প, সবসময় চুপ; তার মন বলে আর কিছু নেই। সকালে সবাই উঠে গেলেও মনি রুকুকে ছাড়তে চায় না। সেই নিয়ে বাড়িতে একদিন প্রবল গণ্ডগোলও হয়। রাগে অন্ধ মনিরুজ্জামান সকালের খাবার ছুঁড়ে ফেলায় সাইদা তাকে ‘জানোয়ার, শয়তান’ বলে চটিপেটা করে আর কাঁদে। মনিও রাগে মাকে আক্রমণ করে। নুরুজ্জামান এসে থামায়। পরে মনিরুজ্জামান রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলে। রুকুকে যেমন ছাড়তে চায় না, সেই ঘটনার পর রুকুর ওপর অভিমানও করে। আজকাল সে মেয়েদের আব্রুর ব্যাপারটাও বুঝতে শিখেছে। বস্তুত সে মানুষে পরিণত হচ্ছে। মনিরুজ্জামান ও রুকুর সন্তানও এসেছে পৃথিবীতে। এটাকে সে তার কৃতিত্ব বলেই মনে করে। পিতা নুরপুরে থাকাকালীন তাকে এবাদতখানায় জীবন কাটাতে হয়েছে। এখানে তার সামনে উপস্থিত হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশজনিত রহস্যময় নৈঃশব্দ্য, কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গতায়, প্রতি মুহূর্তে সামনে রয়েছে বুজুর্গ পিতার নানা চিহ্ন। এসবই তার জড়তাগ্রস্ত চেতনাকে আঘাত করেছে, এবং তার মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তার জড়তাগ্রস্ত চেতনাকে গ্রাস করেছে এক পরাবাস্তবতা। একই সঙ্গে ততদিনে তার এই উপলব্ধিও জাগ্রত হয়েছে যে, তার সুন্দরী বিবি তাকে জন্তু হিসেবে গণ্য করে। তাই মনে জ্বালা জন্মে, অভিমান তৈরি হয়। তার মধ্যে একটা মেটামরফসিস ঘটে যায়। পিতা ফিরে আসায় সে বাড়ি ফেরে। কিন্তু এক পরিবর্তিত মনিরুজ্জামান। তার যৌনপ্রবৃত্তির আরও একটি দিক ঔপন্যাসিক এনেছেন এইভাবে— “পশুর তীব্র যৌনবোধ থেকে এই হতভাগ্য প্রতিবন্ধী নিষ্কৃতি পায়নি। সে স্বমৈথুনে অভ্যস্ত ছিল। এবাদতখানার পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে সে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে আসত। বাড়ি ফেরার পর… … সে পরাবাস্তবতাময় জীবনের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে তখনও সে হঠাৎ হঠাৎ কামনাজর্জর হত এবং পায়খানাঘরের ভেতর যৌনতা থেকে মুক্তি চেয়ে নিত। এইভাবেই রুকুকে বর্জনের চেষ্টা করত সে।” কামনা ও যৌনতামুক্ত নয় কোনো মানুষই, প্রতিবন্ধী হলেও না, আর যৌনমুক্তির স্বাভাবিকতা যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন তাকে অন্য পথ বেছে নিতে হয়, কামারুজ্জামান যেন তারই প্রতীক। এও বাস্তব, যে রুকুকে সে কাছছাড়া করত না, তার কাছ থেকে যথার্থ সহযোগিতার বদলে ঘৃণা পাওয়ায়, সেও তার পন্থাকে বদলায়। জড়বুদ্ধি মনিরুজ্জামান ঘৃণ্য প্রবৃত্তিতে জড়িয়েও যেন তাই অনেকটা মানুষের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। একসময় চিরকাল তাকে ঘৃণা করে আসা বিবি দিলরুখকে মন থেকে পরিত্যাগও করে। বদুপিরের মৃত্যুকালীন ইচ্ছানুসারে মনিরুজ্জামান তাঁর এবাদতখানার মালিক হয়। কিছু চাষের জমিও পায়। শিষ্যরা পিরসাহেবের মাজার বানিয়ে দিলে মনিরুজ্জামান সেখানেই থাকত। নজরানা সেলামি পেত সে। পরে সেই মাজারেই তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলে ডাকাতরা তাকে খুন করেছিল। যদিও দিলরুখ তা মানে না। সে মনে করে কালোজিন গলা টিপে মনিরুজ্জামানকে হত্যা করে। বদুপিরের সংসারে এমন একটি চরিত্র উঠে আসায় উপন্যাসে বাস্তবতার একটা ব্যালেন্স রক্ষা সম্ভব হয়। অর্থাৎ ধর্মপ্রাণ পরিবারে এমনটাও ঘটে। মানুষের জন্ম প্রতিবন্ধকতা শুধুমাত্র ধর্মাচরণের ওপর নির্ভর করে না, সেখানে স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক কারণ অস্বীকার করার উপায় নেই। আরেকটি কারণও উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসে একটা নাটকীয়তা ও ট্রাজিক দিক তুলে ধরতেও এই চরিত্রের অবতারণা। মনিরুজ্জামান যেন স্বাভাবিক চলমানতার পথে একটা কাঁটা, কিন্তু যাকে তুলে না-আনলে এই আখ্যান দাঁড়ায় না, কারণ আখ্যানের মূল নায়িকা কার্যকারণে তারই বিবি। একটি অনবদ্য চরিত্রচিত্রণ।
সিতারা
কেল্লাবাড়ির অস্বীকৃত ‘নবাব’দের মেয়ে। বাবা আতা বেগ ছিলেন এক দরজি। কাল্লু পাঠানের দ্বিতীয় স্ত্রী (বিড্ডুর মতে), আর বারিচাচার মতে— ‘কাল্লুর ছোটবউ সিতারা বিড্ডুর এক চাচির (কাকিমা) মেয়ে।’ কাল্লুপাঠান কেল্লাবাড়ির ঘর ছেড়ে জবরদখল করেছিল নহবতখানার কাছে সারবন্দি ঘরের একটি। সেখানে সিতারার স্থান হয় শাশুড়ি সহ। উর্দুভাষী, ভালো বাংলা বলতে পারে না। চেষ্টা করে। সুন্দরী, যৌবনচঞ্চলা। কাল্লু পাঠান, দেওয়ান বারিচাচার তথাকথিত সৈন্যদলের এক পাণ্ডা। কাল্লু পাঠানই প্রথমে একদিন তার বাড়িতে সিতারার সঙ্গে শফির পরিচয় করিয়ে দেয় ‘সৈয়দ’ বংশের এবং বুজুর্গ পিরের ছেলে হিসেবে। সেখান থেকেই শফির সঙ্গে সিতারার হেঁয়ালিপনা, গায়ে পড়া ভাব, ‘পুরা জওয়ান’ হওয়ার আহ্বান। সিতারা শিয়া মুসলমান, শফি সুন্নি। তাতে রসিকতাও করে। গঙ্গায় গোসল করতে গেলে শফিকে পাহারাদার রাখতে চায়। স্নান করতে করতে শফির কুর্তায় জল ছিটিয়ে দেয়, জলে নেমে তার সঙ্গে খেলার আহ্বান জানায়। দ্বিধাগ্রস্ত শফি আমল দিতে পারে না। কিন্তু কোনো এক টানে সিতারা তার ওপর রাগ করে আছে কিনা জানতে তার বাড়ি যায়, সিতারার বানানো চা খায়, আবার সিতারা হেসে হাত ধরলে রেগেও যায়। সিতারা জানায়, কাল্লু পাঠানের ‘বহু’ (বউ) বলে সে কামিনা নীচ লড়কি বা কসবি নয়, ‘উঁচা খানদানের খুন আছে’ তার গায়। এভাবে শফি জড়াতে থাকে। “সেই বসন্তকালে মৃতদের শহরে সিতারা আর আমি যেন একটা অদ্ভুত লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছিলাম।” সেই সিতারাই একসময় শফির কাছে পান্না পেশোয়ারি তার ওপর জোর-জুলুম করছে বলে অভিযোগ করে। সিতারা নিজে কেন চুল্লুকে (কাল্লু পাঠানের ভাই, যাকে পান্না সমঝে চলে) বা বারিচাচার কাছে অভিযোগ করছে না জানতে চাইলে, সে জানায় ‘আমার শরম বাজে।’ অবাক হয় শফি, কী চায় সিতারা? শেষে পান্না পেশোয়ারির আস্তানায় গিয়ে কয়েকহাত দূর থেকে তার মুখ লক্ষ্য করে একটা বড়ো ইট ছুঁড়ে মেরে তাকে জখম করে পালায়। সেই আঘাতই পান্নার মৃত্যুর কারণ হয়। বেশ কয়েকবছর পর আবার শফির (তখন ফেরার) সিতারাকে দেখার ইচ্ছে জাগলে, সিতারার কাছে ছুটে আসে। সিতারা তখন তিন সন্তানের জননী, একটি যার মারা গেছে। শীতল সিতারা। হেঁয়ালি নেই, কৌতুক নেই, হাসি নেই, কথা যথেষ্ট কম, শফিকে দেখেও উন্মাদনা নেই, বেশ কিছুটা শীর্ণ, শান্ত-উদাসীন-নির্লিপ্ত। সেই সিতারা আর নেই। কাল্লু পাঠান সরকারি সিপাহী হওয়ায় আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে, কিন্তু নির্বিকারিত্বও বেড়েছে সিতারার। শফি, পান্না পেশোয়ারিকে সিতারার জন্য খুন করেছে জেনে, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে; কিন্তু শফি এখন ‘পুরা জওয়ান’ হয়ে এসেছে স্মরণ করালেও তার মধ্যে কোনও ভাবান্তর নেই। বস্তুত সে এখন একজনের স্ত্রী, দুই জীবিত সন্তানের মা। সিতারার বাড়িতে রাতে একসঙ্গে শোওয়া ঘুমন্ত কাল্লু শফি দ্বারা নিহত। দেখা যাচ্ছে, সিতারার চরিত্রে দুটি রূপ, দুটি মানসিক অবস্থান। তার এমন পরিবর্তনের কারণ জানা যায় না। হতে পারে যৌবনকালে প্রেম ও শরীরের চাহিদায় সিতারা স্বামীকে শাশুড়িকে দাবিয়ে রাখত, সে সন্তুষ্ট ছিল না। সেই প্রেমানুভব ও শারীরিক চাহিদা সংসারের যাঁতাকলে ও লাগাতার সন্তান জন্ম দেওয়ার সুবাদে অন্তর্হিত হয়েছিল। শফির প্রতি তার অনুরাগ আর মোটেও ছিল না। অবাঙালী একটা নারী চরিত্র, যে প্রথমে নিজের কাম-প্রেম পূরণে সচেষ্ট এবং পরে এক সিপাহীর স্ত্রী এবং দুই জীবীত সন্তানের স্ত্রী, যার মধ্যে পূর্বের খোয়াসই মৃতপ্রায়। যেন এমনটাই এক স্বাভাবিক অবস্থান বা পরিণতি, তা বোঝাতেই চরিত্রটি এইভাবে সৃষ্ট।
খোকা ও কচি
এই উপন্যাসে চতুর্থ প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি। এদের আমরা উপন্যাসে দেখতে পাই, ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। মূলত দাদিজি তথা দাদিমা তথা ঠাকুরমা দিলরুখ বেগমের সঙ্গে কথোপকথনে তাদের উপস্থাপিত করা হয়েছে উপন্যাসে। তখন দেশ স্বাধীন। ভারত ও পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম) নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্র বাস্তবে। তখনও তারা মৌলাহাটে থাকে নিশ্চিতই, কিন্তু তা পরিবর্তিত মৌলাহাট। আমরা জেনেছি, মনিরুজ্জামান-দিলরুখের একমাত্র সন্তান রফিকুজ্জামান। আমাদের এ-ও জানা জুলেখা নামে এক মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হয় রফিকের। এই দুইয়ের সন্তান, খোকা (ছেলে) বড়ো, কচি (মেয়ে) ছোটো। উপন্যাসে এদের মা-বাবা নিয়ে বিশেষ কোনো কথা শোনা যায় না। দাদিজি দিলরুখের বয়স যখন প্রায় ৭২-৭৩ বছর, তখন এই তিনজনকে উপন্যাসে একসঙ্গে আনা হয়। এরা (বিশেষত কচি) বারবারই দাদিজির কাছে জানতে চায় পরিবারিক ইতিহাস। সেই সূত্রে ফ্ল্যাশব্যাকে উপন্যাসের কিছু কাহিনিও আমরা জানতে পারি। কচি ছোটো, স্কুলে পড়ে, কিছুদিনের মধ্যে টেসট পরীক্ষা দেবে, কিন্তু আগ্রহ তারই বেশি। সে দাদিমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শোনে, সাল-বর্ষের হিসাব করে, দাদিমার বার-তেরো বছর বয়সেই বিয়ে, পরের বছর সন্তান, ইত্যাদি সেকেলে কথা শুনে অবাক হয়। যেসব গল্প দাদিমা সহজে বলতে চায় না, সে তা শোনার জন্য পীড়াপীড়ি করে, আবার হঠাৎ করে উৎসাহ হারিয়েও ফেলে, ঘুম পাচ্ছে বলে। কখনো কখনো সে বিশ্বাস করতে চায় না, বলে— ‘ভ্যাট! বাজে গপ্প’। আবার কখনো অপ্রিয় প্রশ্ন করে দাদিমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। শফি সম্পর্কে তাদের জানা, দাদিমার মুখে শুনে আর কিছু রোজনামচা পড়ে। কচি দাদিমাকে নানাভাবে জিজ্ঞাসা করে শফির কথা — ‘ছোটোদাদাজি নাকি ডাকাত ছিল?’ বা ‘তাহলে বলো, ছোটোদাদাজি টেররিস্ট ছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বইতে ওঁর নাম থাকা উচিৎ ছিল! আশ্চর্য! কেন নেই?’ বোঝা যায় বয়সের কারণে সে একটু অস্থির মস্তিষ্ক। বস্তুত কচি তার ছোটোদাদাজিকে ‘হিরো’ মানে। দিলরুখের মতে কচি একদম ‘হিঁদু হয়ে গেছিস’। কচির হিন্দুয়ানা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কচি পরিবারের কথা দাদিমার মুখে গল্পে শুনে প্রায় সময়ই প্রতিক্রিয়া জানাতো। বাঁশিবাজানো রাখালছেলে ফজুকে বদুপির কুলগাছে বেঁধে জুতোপেটা করলে বা বাঁশি ভেঙে পুকুরের পানিতে ফেলে দিলে সে পরিস্কার জানায়— ‘শ্রদ্ধাভক্তি রইল না বাবা! ভ্যাট!’ আবার বড়ো আম্মা (সাইদা বেগম) বেপরদা হয়ে এবাদতখানায় ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলে সাবাশি জানায়— ‘অসাধারণ! বড়ো আম্মা, তোমার প্রতি হাজার-হাজার সেলাম!’ বোঝা যায় কচি সংস্কারমুক্ত এক কিশোরী, অলৌকিকত্বকে বুজরুগি বলে মনে করে। আবার সবকিছু সে জানে বোঝে তাও নয়, সে বয়স তার হয়নি। কৌতূহলে জানতে চায় বড়ো আব্বা ইকরাতনকে কেন তালাক দিয়েছিল? সে ‘ডাইন’ জানত না। দাদিমার কথায় ডাইন বৃত্তান্ত শুনে পুরো ‘বোগাস’ বলে উড়িয়ে দেয়। দিলরুখের মতে সে ‘ছোটোমুয়ে বড়ো বাত’ বলে। কারণ সে লক্ষ করেছে তার দাদিমা ‘স্বামী সম্পর্কে যখনই’ কথা বলে, তখন ‘বড্ড তুচ্ছতাচ্ছিল্য’ করে। সুতরাং এরইমধ্যে তার একটা পর্যবেক্ষণ করার ম্যাচুরিটি গড়ে উঠেছে। তবে হিজরি সন (যা দাদিমা বলে) ইংরেজি সন ঠিকমতো মেলাতে না-পারলে কামাল সারের কাছে জেনে নেওয়ার কথাও বলে। অর্থাৎ তার মধ্যে একটা সরলতাও আছে। দাদিমার অনেক কথাবার্তাকে সে সাম্প্রদায়িক মনে করে, এবং কথায়বার্তায় প্রমাণ করার চেষ্টা করে সব হিন্দুই মুসলমান বিদ্বেষী নয়। দিলরুখ তা মানতেও বাধ্য হন, কারণ তার ছেলে রফিকের অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল, যাদের সে ভালোই দেখেছিল। তাদের পরিবার দারিদ্র গ্রাস করেছে। বাড়ি-ঘর-দুয়ার ভগ্নপ্রায়, চারপাশের জঙ্গলে আবৃত। দিলরুখ ভয় পায়। মনে করে ‘কালা জিনের মুঠোয় আটকে পড়েছে বাড়িটা’। কচি আশ্বাস যোগায়, স্বপ্ন দেখে— ‘আমি পাস করে বেরুব। চাকরি করব। বাড়ি মেরামত করব।ব্যস!’ এইভাবে কচি এক সরল-সাদাসিধে সংস্কারমুক্ত স্বপ্নদেখা কিশোরী চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে উপন্যাসে।
খোকা লেখাপড়া শিখলেও, কমপ্লিট করেনি কিছু। ছেড়ে দেয়। কচির মতে ‘হাফ্-এজুকেটেড’। ‘নাইনে ফেল করা ছেলে’। কী যে করে, তা দিলরুখ বা কচি ততটা বোঝে না। যখনতখন বাড়ি থেকে এখানে সেখানে যায়, কিন্তু জানিয়ে যায় না, কোথায় যাচ্ছে। রাত-বিরেতে ঘরে ফেরে। দিলরুখ তার গতিবিধিতে ভয় পায়, সে যেন খোকার মধ্যে শফিউজ্জামানের স্বভাব-ছায়া দেখতে পায়। মনে করে ‘কবে না পুলিশ ওকে—’। খোকা দিলরুখকে দাদিজি বলে ডাকে, যাকে আবার কচি ‘ভূতের মুখে রামনাম’ বলে মনে করে। সে পরিবারের বিশেষত বদুপিরের অনেক লেখা এবং কথাকে ‘গুলতাপ্পি’ বলে মনে করে। অলৌকিকত্বে তার কোনো বিশ্বাসই ছিল না। বরং ছোটোদাদাজি বা শফিউজ্জামানের বিদ্যাবুদ্ধির ওপর তার অগাধ আস্থা। ছোটোদাদাজির মতো তারও বিশ্বাস— ‘ইস্রাফিলকে মুসলমানরা বাইবেল থেকে চুরি করেছে’, বা, ‘ইস্রাফিল স্বর্গের মিউজিশয়ান’। আবার সে এ-ও মনে করে— “ছোটেদাদাজি—আমার ধারণা, ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন না, বুঝলি কচি? উনি ছিলেন অ্যানারকিস্ট্। … যারা রাষ্ট্র বলে সরকার বলে কিছু মানে না। যারা বলে বর্ন্-ফ্রি।” এইসব নানা বিষয়ে ভাই-বোনের প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয়। কচি জানে তার দাদা পাঁচুবাবুর পাল্লায় পড়েছে, যে নাকি কোনো মতলবে মৌলাহাটে এসে জুটেছে। আবার খোকা জানে কচি কামালস্যারকে মানে। যাকে নিয়ে তার অভিমত— “প্রি-পার্টিশন তো লিগের লিডার ছিল। এখন ভোল বদলে কংগ্রেস কেন? গিরগিটির বাচ্চা! বহুরূপীর দল, গাছেরও খাবে, তলারও কুড়ুবে।” এইসমস্ত কথাবার্তায় ও মনোভাবে বোঝা যায় খোকা একজন দ্রোহী, সে কোনও বিপ্লবী দলের (তৎকালীন অবস্থানে ‘কম্যুনিষ্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া’ হতে পারে) সঙ্গে যুক্ত, যাকে যে-কোনোদিন পুলিশ ধরতে পারে বলে আশংকা। দিলরুখের মৃত্যুর পর দুই ভাই-বোন বিমূঢ় হয়ে পড়ে। ভীষণ কষ্ট পায় দুজনেই। দাদিমা বা দাদিজিকে তারা উভয়েই ভালোবাসত। সেকালের এক মূর্খ মহিলা, যার মনোভাব ও চিন্তার সঙ্গে তাদের কোনো মিলই ছিল না, তবু তাকে ভালোবাসত মনেপ্রাণে। তারা অনুভব করেছিল, এই মহিলার ওপর জীবীতকালে নানা ঝড়ঝাপ্টা গেছে। অবিচারও হয়েছে। কষ্ট সহ্য করেছে, কিন্তু বিরুদ্ধপনা করেনি। মানুষটি শেষ পর্যন্ত অনুগত, বংশের মান-সম্মান বজায় রাখায় প্রয়াসী। খোকা ও কচি চরিত্রদুটিকে উপন্যাসকার পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর তুলে এনেছেন যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে।
(আগামী পর্বে শেষ হবে)
Posted in: August 2021 - Serial, PROSE