“দেশদ্রোহী” ফাদার স্ট্যান স্বামীর ‘হত্যা’, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নগ্ন করেছে : সুকুমার মিত্র
‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস/ বিদায় নেবার আগে তাই/ ডাক দিয়ে যাই–/ মানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’
‘এই আইনের ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে যা কোনও দায় ছাড়াই অপব্যবহার করা যায়। ইতিহাসে পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে ন্যূনতম অভিযুক্তই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। দোষী প্রমাণের হার অনেক কম।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছর পর ব্রিটিশ আমলের ‘ঔপনিবেশিক’ দেশদ্রোহিতা আইনের কি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? সম্প্রতি এই প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। স্ট্যান স্বামীর ‘হত্যা’র পর দেশের বেশ কয়েকটি হাইকোর্ট ও দেশের শীর্ষ আদালতের আলোচনা গণতন্ত্রের বিপন্নতা রক্ষার ক্ষেত্রে দিশা দেখাচ্ছে। অধিকার আন্দোলনকে স্বীকৃতি জানাচ্ছে।কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তি এই সবকে তোয়াক্কা না করে ক্রমশঃ বেপরোয়া হবে এতেও আশ্চর্যের কিছু নেই।
আর এই কারণে কণ্ঠহীন মানুষের প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠা মানুষগুলোকেই তাই কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার আক্রমণের লক্ষ্য করেছে। আর সেক্ষেত্রে দেশে এখন দিল্লির মসনদে বসে থাকা সরকারি দলের লোকেরাই একমাত্র দেশপ্রেমী। বাকি সকলেই তাদের চোখে দেশদ্রোহী। তা সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বা যে ব্যাক্তিই সরকারের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করবেন তিনি রাষ্ট্রের চোখে দেশদ্রোহী। এমনই “দেশদ্রোহী” জেলবন্দি ফাদার স্ট্যান স্বামী সারাটা জীবন আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য উৎসর্গীকৃত ছিলেন। অরণ্যের অধিকার নিয়ে লড়াই করছিলেন।
ফাদার স্ট্যান স্বামীর গ্রেফতার ও জেলবন্দি রাখার তীব্র প্রতিবাদ করেছিল গোটা দেশের মানবাধিকার কর্মী থেকে বুদ্ধিজীবী সহ নানা মহল। দাবি উঠেছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাঁর মৃত্যুর জন্য, সময় মতো যথাযথ চিকিৎসা না দেওয়া, শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য জবাবদিহি করুক।
২০১৭ সালে স্ট্যান স্বামী ঝাড়খণ্ড হাইকোর্টে সরকারের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। তফসিলি জাতি-উপজাতি শ্রেণির ৭২ জনকে দীর্ঘ কারাবাসের বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধে উগ্র বামপন্থার অভিযোগে ইউএপিএ ধারায় পশ্চিম সিংভুম জেলায় মামলা দায়ের করে রাজ্য সরকার। তার তিন বছর পর স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করে এনআইএ। ভীমা-কোরেগাঁও সংঘর্ষে মাওবাদী যোগের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা হয়। আট মাসেরও বেশি সময় ধরে ৮৪ বছরের এই যাজককে জেলবন্দি রাখা হয়। বারবার তাঁর জামিনের বিরোধিতা করা হয়। এন.আই.এ-তাঁকে গ্রেফতার করার আগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ফাদার। সওয়াল করেন, তাঁর অপরাধটা কী, তরুণ আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের বঞ্চনা এবং নিজেদের অধিকারের জন্য সরব হওয়াদের মাওবাদী তকমা দিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্যই তাঁকে নিশানা করছে সরকার। তামিলনাড়ুর ত্রিচির বাসিন্দা স্ট্যান স্বামী ঝাড়খণ্ডকেই নিজের ঘর বানিয়ে ফেলেন। কণ্ঠহীনদের জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। সাতের দশকে ফিলিপিন্সে পড়াশোনা করার সময়ও একাধিক বার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। দেশে ফিরে ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেন তিনি বেঙ্গালুরুতে। তারপর সেই কাজ ছেড়ে জামশেদপুরে চলে আসেন। এরপর চাইবাসাতে আদিবাসীদের সঙ্গে থেকে তাঁদের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেন।
জীবনভর আদিবাসী মানুষের ক্ষমতায়নের পক্ষে সওয়াল করা মানুষটি ১৯৯১ সালে বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউটের অধিকর্তার পদ থেকে অবসর নিয়ে চলে আসেন ঝাড়খণ্ডে। গরিব দলিত আদিবাসীদের ‘অতি বাম সংযোগ’ এর কারণ দেখিয়ে মিথ্যে মামলায় জর্জরিত হতে দেখে ফাদার ঝাড়খণ্ডের ‘বিচারাধীন নকশাল’দের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেখানে তিনি দেখান যে মাওবাদী বা মাওবাদীদের সহায়ক হিসেবে গ্রেফতার করা মানুষের মধ্যে ৯৭ শতাংশের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া ৯৬ শতাংশ মানুষের মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকার কম। কোনো কারণ না দেখিয়ে ইউ.এ.পি.এ-র মত দানবীয় আইনে ফাঁসানো হচ্ছে সাধারণ আদিবাসীদের। তিনি আরও দেখিয়েছেন কিভাবে ভারত রাষ্ট্র গরিব আদিবাসী বিচারাধীন বন্দিদের উপর নির্মম অত্যাচার করে চলেছে। মাওবাদী তকমা দেওয়া তিন হাজার আদিবাসীর মুক্তির জন্য তিনি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। বর্তমানে আর একজন রাজনৈতিক বন্দী সুধা ভরদ্বাজের সঙ্গে গঠন করেন বন্দিমুক্তি সংগঠন Persecuted Prisoners Solidarity Committee (PPSC)। মানবাধিকার সংগঠন People’s Union for Civil Liberties (PUCL) এর সহ সভাপতি ছিলেন স্ট্যান স্বামী।
ঝাড়খণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম-গ্রামান্তরে গিয়ে গিয়ে তিনি আদিবাসীদের সচেতন করতেন তাঁদের অধিকার বিষয়ে। সচেতন করতেন কিভাবে অবৈধ ভাবে বড়ো বড়ো খনন চলছে, বাঁধ, শহর তৈরি হচ্ছে তাঁদের অনুমতি ছাড়া। কিভাবে জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। PESA আইন অনুযায়ী পঞ্চম তফশীল অঞ্চল কিছু বিশেষ ক্ষমতা পায়। এই আইন জমি অধিগ্রহণ, খনন কাজ বা জমি লিজ নেওয়ার জন্য গ্রামসভার অনুমতিকে বাধ্যতামূলক করেছে। ফাদার ঝাড়খণ্ডে এই আইন চালু করার জন্য লড়াই করে গিয়েছেন। পঞ্চম তফশীল অনুসারে আদিবাসীদের সুরক্ষা ও উন্নতির জন্য তাঁদের নিয়েই যে ট্রাইবস অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল গঠিত হওয়ার কথা ছিল তা বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়েও তিনি বারবার প্রশ্ন তুলেছেন। বনাধিকার আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আন্দোলনেও তিনি সামনের সারিতে সব সময়ে ছিলেন। ছোটোনাগপুর টেন্যান্সি আইন, ১৯০৮ এবং সাঁওতাল পরগনা টেন্যান্সি আইন, ১৮৯৬ আদিবাসীদের জমির রক্ষাকবচ। ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার এই দুটি আইন সংশোধন করতে গেলে ফাদার তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। বিজেপি সরকার যখন জমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৩ সংশোধন করে ২১ একর জমি বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেয় তখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আদিবাসীদের পাত্থালগড়ি আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেন। তিনি দেখান স্বায়ত্তশাসনের জন্য আদিবাসীদের এই আন্দোলন সংবিধান-স্বীকৃত। এই প্রসঙ্গে একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য সরকার তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রুজু করে। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ফাদার কোনওদিন আদিবাসী মানুষের হয়ে কথা বলতে পিছিয়ে যাননি। তাঁর শরীরে ক্যান্সারের কারণে তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছে, হাত কাঁপতো, একা একা খেতে পারতেন না, চাও খেতেন স্ট্র দিয়ে। তবুও গণহত্যা, গণ পিটুনির প্রতিবাদে কাঁপা হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে পথে নেমেছেন। ফাদারের জীবন ছিল নিপীড়িত আদিবাসী জনগণের জন্য উৎসর্গীকৃত।
কেন্দ্রের বিজেপি শাসিত সরকার ৮১ বছরের ফাদার স্ট্যান স্বামীকে ৮ অক্টোবর,২০১৮ রাঁচিতে তাঁর আশ্রম বাগাইচা থেকে গ্রেফতার করে। তারপর তাঁকে এন.আই.এ মুম্বাই এর তালোজা জেলে নিয়ে যায়। দ্রুত ক্ষয় হচ্ছিল পার্কিনসনস রোগে জর্জরিত ফাদারের শরীর। বারবার খারিজ হতে থাকে জামিনের আবেদন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য বোতল থেকে জল খেতে পারছিলেন না। জেল কর্তৃপক্ষের কাছে স্ট্র বোতল চাওয়া হলে তা দেওয়া হয় প্রায় পঞ্চাশ দিন পর। ২০২১ সালের মে মাসে তিনি করোনাতে আক্রান্ত হন। কোর্ট তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির কথা বললে তিনি তাতে রাজি হননি। জীবনের শেষ বেলায় তিনি তাঁর নিজের হাতে সাজানো রাঁচির আশ্রমে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মুম্বাই-এর এক হাসপাতালেই মারা গেলেন ফাদার। সারা দেশের অগণিত মানুষ, বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিক, মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত এই মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যা বলে অভিহিত করেছেন। নিন্দা জানিয়েছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বাস্থের অবনতি জনিত কারণে জামিনের শুনানি চলাকালীন বম্বে হাইকোর্টের কাছে ফাদার স্ট্যানের হৃদয় বিদারক বক্তব্য আমরা ভুলি কি করে! যেখানে তিনি তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতির চলমান বিবরণ দিয়েছেন। আদালতকে বলেছিলেন যে, তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করেন নি শুধুমাত্র রাঁচির আশ্রমে তাঁর লোকদের মধ্যে মারা যাবেন এটাই তিনি আশা করেছিলেন। বিস্ময়কর যে এই জাতীয় অনুরোধটি আমাদের বিচার ব্যবস্থা ফাদার স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রে পূরণ করতে পারল না। প্রসঙ্গত, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ বম্বে হাইকোর্টে তাঁর শারিরীক অবস্থার অবনতির ঘটনা উল্লেখ করে জামিনের জন্য একটি রিট পিটিশন দাখিল করা হয়েছিল। সেই মামলার শুনানি চলাকালীন স্ট্যান স্বামী চলে গেলেন বা চলে যেতে বাধ্য করা হল।
ইউ.এ.পি.এ আইনের অধীনে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত দায়বদ্ধ। সুতরাং, স্ট্যান স্বামী দোষী হিসেবেই মারা গিয়েছেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি বিনা বিচারে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন। রাষ্ট্রের এই মৃত্যুকে ঘিরে তার অবস্থানের স্বচ্ছতা প্রমাণ করার পাশাপাশি কর্তব্যও রয়েছে। যদিও এটি বর্তমান রাষ্ট্রের পরিচালকদের ধারণার প্রকৃতিতে তারা কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়। মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার এখানে শুধুই কর্পোরেট লুঠেরাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আপামর দেশবাসীর জন্য নয়। আর এই অধিকার নিয়ে সচেতনতার কাজ করা সে তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। যেভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আরোপ করা হচ্ছে তাতে একদিন গোটা দেশবাসী রাষ্ট্রের চোখে হবেন রাষ্ট্রদ্রোহী। আর তার পরিণতিতে তথাকথিত দেশপ্রেমীদের করুণ দশা দেখার জন্য দীর্ঘ লাইন আমরা প্রত্যক্ষ করার হয়তো সুযোগ পাব।
সেন্ট স্টিফেন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ভালসন থাম্পুর কথায়, ‘সত্যটি হ’ল জীবন ও মৃত্যুর উপরে রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই।ভালভাবে ঘুমাও, ফাদার! স্ট্যান, আপনার লড়াই শেষ। বাকিটা আমাদের; আমরা ব্যতীত এটি অসম্পূর্ণ। আমাদের সংগ্রাম এখন কেবল আমাদের সাথে; বা, আমাদের আছেই বা কি?’ আমাদের কি রয়েছে তা স্ট্যান স্বামীই বলে গিয়েছেন। তালোজা জেল থেকে লেখা চিঠিতে ফাদার স্ট্যান স্বামী বলছেন, “অনেক বিচারাধীন বন্দিরা জানেনই না যে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী, অনেকে চার্জশিট দেখেননি, কোনও আইনি বা অন্য সহায়তা ছাড়াই বছরের পর বছর কারাগারেই আছেন।” স্ট্যান মানুষের লড়াই ও স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন। তাঁর মৃত্যু হল রাষ্ট্রীয় হত্যার পরিণাম। “তবু আমরা এখনও একসাথে গান গাইবো। খাঁচায় আটকানো পাখিরা এখনও গান গাইতে পারে।” স্বামীর হত্যার মধ্য দিয়ে সেই খাঁচায় আটকানো পাখিদের গান বন্ধ করা সহজ হবে না। বরং ফাদার স্ট্যান স্বামীর কণ্ঠের সেই গান আজ দেশজুড়ে মানুষের আবেগের যে তরঙ্গ তুলেছে সেই তরঙ্গের পর তরঙ্গে মানুষের প্রতিবাদ আরও প্রসারিত হবে। আর মানুষের হাতে ফ্যাসিস্ট সরকারের এই অমানবিক রাজনীতি ভীষণভাবে জব্দ হবেই। আর সেই দিনের জন্য ‘কণ্ঠহীন’ মানুষেরা আজ সোচ্চারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পথে নামতে শুরু করেছেন।
ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে গভীরভাবে দুঃখিত। আমাদের সিস্টেম এতো নিষ্ঠুর ও অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। গরীবদের জন্য উনি যা করেছেন, আমি মনে করি না তারপর এগুলো প্রাপ্য ছিল ওনার।”
সাংবাদিক রানা আয়ুব এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “ফাদার স্ট্যান স্বামী, দেশ হিসেবে আমরাই আপনাকে হত্যা করেছি। লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। শান্তিতে থাকুন ফাদার, হিরো, মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন।”
বিহার সরকার বনাম কেদারনাথ মামলার দূর্বলতার মধ্যে দিয়ে কিভাবে UAPA আইনের অপব্যবহার সমস্ত বিরোধী কন্ঠরোধ করার প্রক্রিয়া চলছে তা সকলেরই জানা। তবে সর্ষের মধ্যে ভুত লুকিয়ে থাকলে সেই সর্ষে দিয়ে ভুত তাড়ানোর মত হয়েছে আমাদের প্রতিবাদীদের একাংশের দশা। আমরা ইউ.এ.পি.এ বাতিলের দাবি তুলছি। আবার দেখছি সেই দাবি যাঁরা তুলছেন সেই তাঁদের পরিচালিত কেরালার বাম সরকার ১৫১টি ইউ.এ.পি.এ মামলা রুজু করেছে আগের পাঁচ বছর সময়কালে। এই তথ্যটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত। সম্প্রতি ৬৫ জন বন্দীর মুক্তি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আরও কয়েকজন এখনও এই মামলায় বন্দি রয়েছেন। ইউ.এ.পি.এ-র মত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত সকল বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। এই দাবি দেশজুড়ে তখনই সোচ্চার হতে পারে যেখানে প্রতিবাদকারী রাজনৈতিক শক্তি তাঁরা যেখানে যেখানে ক্ষমতায় রয়েছেন সেখানে তাদের অবস্থানে স্বচ্ছতা থাকলে। অ-বিজেপি সমস্ত রাজ্য সরকারগুলি এইসব ঔপনিবেশিক কালের আইনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যেসব আইন প্রণয়ন হয়েছে তা কার্যকরী তাদের রাজ্যে করা হবে না এই মর্মে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। সুপ্রিম কোর্ট তো সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছে। ভুলে গেলে চলবে না আইন থাকলে তার অপব্যবহার রাষ্ট্রের নানা এজেন্সির মাধ্যমে ক্ষমতাশীনরা করবেন। ফলে আইনের অপব্যবহার বন্ধ নয়, বাতিলের দাবি তুলতে হবে। নতুবা স্ট্যান স্বামীর ‘হত্যা’-র প্রতিবাদ ভাবের ঘরে চুরি করা হবে। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা বাকসর্বস্ব বিবৃতি বা ভাষণ দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রবন্ধে, কবিতায়, ছড়ায়, ছবিতে, চিঠিপত্রে নানা সৃষ্টিশীল মাধ্যমে তিনি যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনার উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন। শুধু সৃষ্টিশীল সাহিত্যে নয়, কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়েও তার ফ্যাসিবাদবিরোধী মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২২ সালে ইতালিতে সর্বপ্রথম ফ্যাসিজমের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৬ সালে ইতালি ভ্রমণকালে মুসোলিনীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ প্রতারিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সুইজারল্যান্ড সফরকালে ফ্যাসিস্ট নিপীড়িত লোকজনের কাছ থেকে এবং মনীষী রমাঁ রোল্যাঁর কাছ থেকে মুসোলিনী ও ফ্যাসিবাদ সম্পর্র্কের্ তার ধারণা পরিষ্কার হয়। ফ্যাসিজম ও মুসোলিনীর অপশাসন সম্পর্কে তিনি ইংল্যান্ডে কয়েকবার বিবৃতি দেন। ১৯২৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বারব্যুস ও রোল্যাঁর নেতৃত্বে যে প্রথম ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলন হয়, তার ঘোষণাপত্রে ভারতবর্ষ হতে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই স্বাক্ষর করে বারব্যুসকে চিঠি লিখেছিলেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সমস্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতার তকমা লাগানোর আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলি বাতিলের মাধ্যমে শুরু হোক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক বৃহত্তর মঞ্চ। সেই মঞ্চ থেকে আওয়াজ উঠুক কবীর সুমনের গানের সুরে-‘আমার ধর্ম তোমায় জানিয়ে যাই/ গানের দিব্যি আমি প্রতিশোধ চাই/ আমার বোধের হাতিয়ারে সান দিয়ে/ পুড়ছি আমিও তোমায় সঙ্গে নিয়ে।’
[লেখক – বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক।]
Posted in: ARTICLE, August 2021 - Cover Story