কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ
[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]
১৩
জেঠিমা দাঁড়িয়েছিলেন। বাবা মা আমি ও ভাইয়েরা সবাই জেঠিমাকে প্রণাম করলাম। জেঠিমা আমাকে তাঁর কাছে টেনে নিয়ে খুব আদর করতে করতে বললেন,- তোমার কথা মনে থাকবে। বাবাকে বললেন,- বেশি তো দূরে নয়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। ছুটি নিয়ে চলে আসবে, দুই তিন দিন থেকে না হয় আবার আগ্রাতে ফিরে যাবে।
জেঠিমার সঙ্গে সবসময় যিনি থাকতেন, তাঁকে সবাই লালির মা বলে জানে। মায়ের কাজের সাহায্যের জন্য জেঠিমা লালির মাকে পাঠিয়ে দিতেন প্রায়ই। সেই লালির মা আমাদের আগ্রা যাওয়ার ট্রাকে তুলে দিলেন খাবারের প্যাকেট। গত দুইদিন আগে কিনে রাখা মথুরার বাজার থেকে মায়ের জন্য কিনেছিলেন কাঁচের চুড়ির প্যাকেট, মায়ের হাতে তুলে দিলেন।
জেঠিমা বললেন,- সাবধানে নেবে, কাঁচের চুড়ি আছে। মথুরার কাঁচের চুড়ি খুব বিখ্যাত। আমি জানি, তুমি কাঁচের চুড়ি পড়তে খুব ভালোবাসো।
মা বললেন,- আপনি কি করে জানলেন?
আমার দিকে তাকিয়ে জেঠিমা বললেন,- ও বলেছে।
আমি জেঠিমার কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমার মাথার চুলে বিলি কাটছিলেন। কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছিল না। প্রতিদিনের মতোই আমাদের বাড়ির বারান্দায় কয়েকটি ময়ূর যেমন আসে, এসেছিল খাবারের সন্ধানে। মা তাই দেখে, আহা রে… বলে উঠলেন। জেঠিমা বললেন, চিন্তা কোরো না, কিছুক্ষণ পরেই ওরা আমার বারান্দায় চলে যাবে।
আমি বলে উঠলাম,- গতকাল বড় ময়ূরটিকে সাপ খেতে দেখেছি।
জেঠিমা বললেন,- ওরা চমৎকার সাপ খায়।
সান্যাল কাকুও দাঁড়িয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে অফিসের কিছু জরুরি কথা বলে নিচ্ছিলেন। বাবা বললেন,- কবে যাচ্ছেন? শুনেছি কানপুরের ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া আয়তনে অনেক বড়।
সান্যাল কাকু বললেন,- আগ্রা থেকে বড় নয়।
আমরা সবাই ট্রাকে উঠে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগে শিখ ড্রাইভার বাবার কাছ থেকে সব জেনে নিলেন। দক্ষিণ না উত্তরদিকের প্রান্ত কোয়ার্টার লাইন। বাবা বললেন,- অতশত জানিনা, নম্বর জানি।
ঘণ্টা দুয়েক লাগল। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম আগ্রা শহরের সেই বিখ্যাত তাজ রোড ধরে। ভারতবর্ষের কিছু বিখ্যাত রাস্তা আছে, তার মধ্যে তাজ রোড অন্যতম। তাজ রোডের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সামরিক বিভাগ। শুধু তাই নয় প্রশাসনিক দায়িত্বও সামরিক বাহিনীর হাতেই। চারধার সুন্দর পরিপাটি। নিপুণ বাদ্যযন্ত্রের মতো প্রতিটি গাছকে ট্র্রিম করা হয়েছে, সামান্য দূরে দূরে রাস্তার দুইধারে গোলাকার ফুলের বাগান। প্রতিটি বড় বড় গাছের গোড়াকে রঙ করা হয়েছে। সবুজ ঘাসের জমিতে ঘাসকাটার মেশিন দিয়ে কাজ চলছে। গাছের চারদিকে লোহার রেলিঙয়ের লতাপাতা মোঘল চরিত্রে। বাঁদিকে তাকালেই যমুনা নদীর রেখা। রেখার ওপারে আগ্রা ফোর্টের উঁচু উঁচু পাথরের গম্বুজ। আর সামনের দিকে আকাশের অহংকার সেই জগত বিখ্যাত দুধসাদা তাজমহলের মুগ্ধকর দৃশ্য। আকাশের শূন্যতায় একপ্রকার ধুঁয়োরেখা থাকে। তার সঙ্গে মিলেমিশে ঐতিহাসিক বিস্ময়।
আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখছিলাম। একটি শহর যাকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন। তখন কি জানি, কিন্তু বাবার কাছেই জানতে পারলাম, জীবন্ত গ্রহের অষ্টম আশ্চর্যের মধ্যে তাজমহলও একটি যে। মা নিস্পলক তাকিয়ে ছিলেন, তাজমহলের দিকে। বাবা বললেন,- ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুজির প্রিয় রাস্তা বাঁ সড়ক হল এই তাজ রোড। এই রাস্তা দিয়ে তিনি বহুবার যাতায়াত করেছেন।
আগ্রা শহরকে আমার স্মৃতিতে একমাত্র সম্মানিত করা যায়, হিন্দি সিনেমার (তাজমহল- ১৯৬৩) ছবির একটি গান দিয়ে, সাহির লুধিয়ানভি- র কথায় রোশনলাল নাগরথ সুরারোপিত- “পাও ছুঁ লেনে দো ফুলো কো ইনায়ত হোগি ইনায়ত হোগি… বরনা হমকো নহী ইনকো ভি শিকায়াত হোগি শিকায়াত হোগি… ভারতবর্ষের এই শহরের ব্যাখা এই শহর নিজেই রচনা করেছে। অদ্ভুত শহর, জীবনে প্রথম জেনেছিলাম, এই শহরের আসল পরিচয় হল, মহিলাদের ভীষণ শ্রদ্ধা করা। উর্দু ও হিন্দি ভাষায় আলোড়িত এই শহরের পিতলের ও শ্বেতপাথরের কাজের জুড়ি মেলা ভার। অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য গোটা শহর জুড়ে।
আমরা যাচ্ছি, বেঙ্গলি হোটেলের রাস্তা ধরে নিজেদের আস্তানার দিকে। যতই এগিয়ে যাচ্ছি, তাজমহলের উচ্চতা আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে। আগ্রা শহরের বেঙ্গলি হোটেল খুবই বিখ্যাত। ঠিক তার পূর্বদিকেই আমাদের, কোয়ার্টার। সারি সারি বড় বড় কোয়ার্টার। পিছনের দিকে বুনো ডালপালার জঙ্গল।
ট্রাক যখন থামল, কয়েকজন অর্ডলি দাঁড়িয়েছিলেন। ওনারাই ট্রাকের ভিতরে সব মালপত্তর ঘরের ভিতরে তুলে দিলেন। কোয়ার্টার ইনচার্জ বাবার হাতে ঘরের চাবি তুলে দিয়ে বললেন,- কোনো প্রকার অসুবিধে হলে আমাকে জানাবেন। আমার একটি বদ অভ্যাস আছে, কোথাও কোনো নতুন আস্তানায় গেলে সর্বপ্রথমে বাথরুমে ঢুকে, কল খুলে দিয়ে দেখে নিই, কলের জল সত্যি সত্যি বেঁচে আছে কি না। কলের জলের শব্দে নতুন বাড়িতে প্রাণ ফিরে আসে। নতুন আস্তানার স্নানঘরে রহস্য জড়িয়ে থাকে। আগে যারা বসবাস করতেন তাদের ফেলে যাওয়া সাবানের বাক্স, সাবানের কুঁচি, ব্যবহৃত টুথব্রাশ, জলের ভাঙ্গা মগ, খালি তেলের ও শ্যাম্পুর শিশি, কলের চারধারে শুকিয়ে ওঠা শ্যাওলা আর ব্লিচিং পাউডারের কৌটো এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে জেনে নিতাম যারা এখানে আমাদের আসার আগে ছিলেন আর যাই হোক তারা মৃত ছিলেন না জীবন্ত ছিলেন। অন্য সব ঘরগুলির ভিতরে কেমন হুম হুম করছে।
কোয়ার্টারের গেটের সামনে দাঁড়ালেই তাজমহলকে হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে ফেলা যাবে। বাবা হসতে হসতে মাকে বললেন,- তোমার জীবনে খুব ইচ্ছে ছিল, তাজমহলকে দেখবে। প্রাণ ভরে দেখে নাও।
মা বললেন, এমন নিঝুম জায়গায় আমি বেশিদিন থাকতে পারব না। চারদিকে তাকালেই শরীর কেমন ভারি হয়ে আসছে। কেমন হুম হুম, আর দেখ বাতাসে কেমন চারধারে জংলি তুলোর ফুল উড়ছে, থিক থিক করছে। কি রকম অদ্ভুত জায়গা। মনে হচ্ছে উটের মৃত্যুভূমি।
বাবা বুঝতে পারলেন, মায়ের জায়গাটি একদমই পছন্দ হয় নি।
মা বললেন,- খুবই আশা নিয়ে এসেছিলাম।
সব জায়গাই যে মনের মতো হয়না।
কেন জানি, একেবারেই ভালো লাগছে না। মনে মনে ভিতর থেকেই জায়গাটিকে মেনে নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে মথুরা, পানাগড়ে যা ছিল এখানে তা নেই। একবার পিছনের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখে এসো কেমন বিমর্ষ। সামনে থেকে তাজমহলের মাথা দেখতে যত সুন্দর লাগছে, পিছনের দিক থেকে, তাজমহলকে দেখতে কেমন জানি- মনে হচ্ছে সে খুব একা। দেখে মনের ভিতরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি হচ্ছে। কেন এমন মনে হচ্ছে? জানি না।
এতক্ষণ গাড়িতে এসেছ, জার্নির ধকল নিতে পারছ না। শরীরের সঙ্গে মনের তাল বেতাল আছে। দুটো একসাথে সঙ্গত না করলে কিছুই যে ভালো লাগেনা।
তাহলে বাড়ির সামনের দিকে এবং পিছনের দিকে এত তফাত কেন?
তোমার মন একসাথে সায় দিচ্ছে না। তোমার যখন ভালো লাগেনি, দেখি আগামীকাল জয়েন করার কয়েকদিন পরে কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কি না।
সেই করো।
আর তো মাত্র দুটো দিন। সামনেই বুদ্ধপূর্ণিমা।
তা হলে কি?
পরে বলব। সব জেনে আসি। চলো হাতে হাত লাগিয়ে সব গুছিয়ে নিই।
পাথরের নয়, সিমেন্টের বাঁধানো মেঝে। জানালাগুলি বড় বড়। জাল দেওয়া। মাঝে মাঝে জংলা জায়গা থেকে বনবিড়াল ঢুঁ দিয়ে যায়। লোমভর্তি। কালো বাদামি। প্রতিবেশী শিখ দম্পতির মহাশয় বললেন,- সিটি উলভ। ফল সবজি সাবধানে রাখবেন, ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়।
নতুন কোয়ার্টার। মা উনুন জ্বেলে চমৎকার রান্নার আয়োজন করছেন। উনুনকে উত্তরপ্রদেশে চুলা বলা হয়। বাঙ্গালিদের উনুন দেখে এখানকার স্থানীয়রা খুব হিংসে করে। বলে আমাদের চুলা থেকে আপনাদের চুলা অনেক সুন্দর। মা নতুন বালতি কাটিয়ে আনাতেন বাবাকে দিয়ে কামারশালা থেকে। দাঁড়িয়ে থেকে মাপ মতো উনুনের পকেট কাটিয়ে নিতেন বাবা। ঠিক মা যে ভাবে বলে দিতেন। আমিও বাবার সঙ্গে মথুরায় কামাশালায় গেছি। উনুনের পকেট কাটাতে। আর বলতেন, কলকাতার মতো মাটি নয়, কলকাতার মাটি মনের ও হাতের কথা শোনে। এ পাথুরে মাটি, ঝুর ঝুর করে। কাঁকড় মেশানো। কিন্তু এখানকার মাটির গুন হল শুকিয়ে গেলে একেবারে লোহার মতো হয়ে যায়। কলকাতার মাটি লজ্জাবতী মেয়ের কথার মতো কোমল। মথুরা থেকে আসার সময়ই মা খুঁজে খুঁজে মাটি সংগ্রহ করেছেন। তারপর উনুন তৈয়ার করেছেন। মা মাটি চেপে চেপে উনুনের শরীর গড়ে তুলতেন। আর তিনদিকের তিনটে জিভ, সবসুদ্ধ মনে হত আগুন জ্বলে উঠলে তাপের অভিধানের পাতা খোলা হয়েছে।
এই কোয়ার্টারে আগে কারা ছিলেন, জানিনা। তবুও উনুনের আগুন ও রান্নার শব্দে আমি মায়ের পাশেই ছিলাম। মা বলছিলেন, এটা সেটা এগিয়ে দিতে। টিণ্ডা টুকরো করে আলু স্লাইস করে, গোলমরিচের ঝোল আমাদের পরিবারে খুব প্রিয়। বাসনের আয়োজন অতি সামান্যই। কাঁসা পিতলের ভারি বাসনের বাক্স কলকাতায় কাকার বাড়িতেই রাখা আছে। এখানে মোরাদাবাদী দস্তার বাসনের খুব কদর ও জনপ্রিয়। বাসনের নামগুলিও অদ্ভুত যেমন বড় আকারের কাঁধ উঁচু থালাগুলিকে পরাত বলা হয়, বাটিকে কটোরি আর কাপড় কাচার ব্যাটকে বলা হয় পিটাই।
উনুনের সামনে মা পিড়ি পেতে বসে রান্না করছিলেন। যে ভাবে তিনি আয়োজন করেছেন, বুঝতে পারছিলাম অড়হরের ডাল, টিণ্ডা আলুর তরকারি ও রুটি। উনুনের আগুনে মায়ের মুখ লাল হয়ে গেছে। কপাল থেকে চুইয়ে চুইয়ে ঘাম পড়ছে, রন্ধনের সাথে সাথে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে গরিবখানার আয়োজনের এই মোঘল শহরে। আমি মাকে দেখছিলাম, নিস্পলক, একজন তিনি যিনি আমার গর্ভধারিণী উনুনের আগুনের সামনে বসে বসে দিনের পর দিন নিজেকে পুড়িয়ে ফেলছেন। সন্তানের শরীর ও আত্মার সন্তুষ্টির জন্য মায়েরা নিজেদের এই ভাবেই আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।
মা বললেন,- চায়ের কাপ প্লেটগুলি ধুয়ে দেবে?
কেন নয়? তুমি একবার বললেই।
দেখো, ভেঙ্গে ফেল না যেন। জানো তো, কিছু ভেঙ্গে গেলে তোমার বাবা আর সারাদিন কথা বলেনা। চুপ করে থাকে।
জানি।
বোঝোই তো।
তুমি বলতে একটি মেয়ের কথা। তোমার কপালে কন্যা হল না… হল না… হল না।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,- ভালোই হয়েছে। মেয়েদের জীবন খুব কষ্টের। পরাধীন হয়। মায়েরা মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। মায়েরা মেয়েদের মন বোঝে, মেয়েরা মায়েদের মন।
সে কেমন? আমি বুঝি তোমাকে বুঝি না?
বোঝো না। বুঝতে পারবে না।
কারণ…
কথা বাড়িও না। বুদ্ধ পূর্ণিমা কবে?
এই তো কাল বাদে শুক্রবার।
আমরা সবাই প্রথমবার তাজমহল দেখতে যাব।
[চলবে…]
Posted in: August 2021 - Serial, PROSE
বাঃ! খুব সুন্দর।