বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

ষষ্ঠ পর্ব

ভবভূতির রূপকে পৌঁছোবার আগে আমাদের ভাসের নামে পরিচিত এই ‘প্রতিমানাটকম’ এবং ভাস সম্পর্কেও আরো কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। সে কথা বলতে গিয়ে হয়তো সামান্য পুনরাবৃত্তি হবে; কিন্তু তা এড়ালে কথাগুলির অভিমুখ লক্ষ্যচ্যূত হবে।

এই নাটকের প্রথম অঙ্কের পরে দশরথের মৃত্যু হবে দ্বিতীয় অঙ্কে। রামের বনবাসের শোকে মৃত্যু হবে। তারপরেই আসবে আরেকটি অত্যন্ত নাটকীয় অঙ্ক। তৃতীয় অঙ্ক। সেখানে এক আশ্চর্য পদ্ধতি ব্যবহার করবেন নাটককার। এই অঙ্কে ভরত দীর্ঘদিন পরে ফিরছেন মাতুলালয় থেকে। সেই বারো বছর পর। অযোধ্যাতে রামের অভিষেক পর্ব, যা ভেস্তে গিয়েছে তাতে তিনি ছিলেন না। সে সব জানেনও না। রথে করে ফিরছিলেন। অযোধ্যার কাছাকাছি একটি মন্দির দেখেন। দেখে তাঁর মনে হয় খানিক বিশ্রামের কথা। এ বিশ্রাম যেমন তাঁর নিজের, তার চাইতেও বেশী করে অশ্বগুলির। তাদের পরিশ্রম ক্ষমতা অনুযায়ী বিশ্রাম না পেলে অশ্বের পক্ষে বাঁচা মুশকিল। তাই দীর্ঘ পথ চলায় বিশ্রাম খুব হিসেবের বিষয়ও ছিল। অশ্বের সারথীরও এক প্রকার বিশ্রাম হয় এতে।

মন্দিরের কাছে রথ থামিয়ে এই সব বিশ্রামের আয়োজন করে তিনি প্রবেশ করেছিলেন মন্দিরে। প্রবেশ করে দেখলেন কয়েকটি পাষাণ মূর্তি রাখা। দেবাকৃতি এঁরা যেন। মন্দির রক্ষকের কাছে জানলেন এঁরা কেউ দেবতা না। এঁরা সকলেই ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা। একে একে মূর্তিগুলির পরিচয় জানলেন। দিলীপ, রঘু এবং অজ- এঁরা তাঁরই পূর্বজ সকল। পরের অংশে যাবার আগে একটু কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলে নিই। প্রথমত, এই ইক্ষ্বাকু রাজাদের জন্য তৈরী হওয়া মন্দিরের কাহিনীটি প্রচলিত রামায়ণে কোথাও নেই। সম্পূর্ণতই নাটককারের সৃষ্টি। আমরা সামান্য অনুমানের চেষ্টা করতে পারি এই সৃষ্টির উৎস সম্পর্কে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে আমরা আছি, যখন মহাকাব্যের নায়কের নামে মন্দির গড়া তীব্র রাজনৈতিক এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এ দেশে। তাই এমন এক তথ্যকে আমরা অবহেলা করে যেতে পারি না।

আগেই আমরা বলেছি যদি এই নাটকের নাটককার ভাস নাও হয়ে থাকেন, তাহলেও এর প্রাচীনত্বের দাবী থাকছেই। কিন্তু এ দাবী নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি কেন? কারণ মন্দির প্রশ্নের উৎস অনুমানের দিকে যেতে হলে এর সময়কালের আনুমানিক হলেও চেহারা নির্ধারণ প্রয়োজন। আমরা যদি এই সময়কাল মেনে নিই নাটকগুলির ক্ষেত্রে তাহলে দেখব আলেক্সান্ডারের ভারত আক্রমণের পরে এ সকল নাটকের জন্ম। অর্থাৎ গ্রীক ও ভারতীয় সংস্কৃতির বহুধারার মিশ্রণ পর্ব শুরু হয়ে যাওয়ার পরের নাটক প্রতিমানাটকম-ও। এই সূত্রটি আমাদের একটি কৌতুহলজনক অনুমানের দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রয়াত রাজাদের জন্য মন্দিরের ভাবনার সঙ্গে ভরতের তাঁদের দেখে দেবতার আকৃতির মনে হওয়া প্রথমে, রাজাদের দেবতা হওয়ার প্রক্রিয়ার যেন এক পরোক্ষ ইঙ্গিত।

এর সঙ্গে আমরা যদি গ্রীক মিথোলজি চর্চাকে মেশাই তাহলে আমরা পাব ইউহেমেরাসকে, যিনি বিসি চতুর্থ শতকের শেষের দিকে গ্রীসে বসবাস করতেন। তিনি প্রথম দেবতার জন্মকে ইতিহাসের পরিসরে ধরার চেষ্টা করেন। এই কাজটা তিনি করেন গ্রীক দেবরাজ জিউস-কে দিয়েই। তাঁর বক্তব্য ছিল জিউস আসলে ক্রীটের একজন রাজা। তাঁর কবরও আছে ক্রীটে। সে কবরে খোদাই করা আছে তাঁর নাম। যদিও এই বক্তব্য ইউহেমেরাসের নিজস্ব নয়। কেন না আরো দুশো বছর আগে নাসোসের সেমি-মিথিকাল দার্শনিক-কবি এবং সন্ন্যাসী এপিমেনাইডস-এর সময়কালেই এ কথা ক্রীটে প্রচলিত ছিল। সেই জন্য এপিমেনাইডস ক্রীটবাসীদের মিথ্যুক এবং নাস্তিক বলতেন।

কিন্তু ইউহেমেরাস এমন কেন বলতেন? তিনি দেখেছিলেন কিছু কিছু মানুষকে, বিশেষ করে রাজা-টাজাদের গুণাগুণ, ক্ষমতা-টমতার সম্পর্কে কেমন করে গল্প বাড়ে। সে সব গল্প বাড়তে বাড়তে শেষে এমন আকার নেয় যে রাজাকে দেবতা বানিয়ে দেওয়া হয়। এই এপোথিওসিস বা ঐশ্বরিক পর্যায়ের গুণকীর্তনের উদাহরণ তিনি ইতিহাস থেকেই নিয়েছেন। যেমন সিসিলির অন্তর্ভূক্ত সিরাকিউসের একনায়ক ডাইওন অথবা গ্রীক সেলুসিড ডায়ানাস্টির জ্যান্ত-দেবতা হওয়া। অথবা দেখেছেন টলেমি বংশের ফারাও হয়ে দেবপুত্র-টুত্র হওয়া। এই সবই তাঁর মতামতকে প্রভাবিত করেছে।

এই ইউহেমেরাস কিন্তু ম্যাসিডনের রাজার দরবারে ছিলেন কমন এরা শুরুরও চার শতক আগে। অর্থাৎ ইউহেমেরাসের এই জিউস একজন রাজা আদপে, যিনি পরে দেবতা হয়েছেন, এই কাহিনীটি এ দেশে গ্রীকদের সঙ্গে এসে থাকতেই পারে। যদি আমরা একটু কষ্ট করে মনে রাখি যে আমাদের এই ভূখণ্ডে ধর্মীয় স্তম্ভের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন গরুড় স্তম্ভ কমন এরা শুরুর আন্দাজ একশো তেরো বছর আগে বানিয়েছিলেন একজন গ্রীক দূত হেলিওডোরাস, তাহলে ইউহেমেরাসের গল্প-ও যে এখানে এসে থাকতে পারে তা খুব একটা আশ্চর্য লাগার মত নয়। যদিও এই রাজাদের জন্য মন্দিরের অংশের সঙ্গে গ্রীক মিলটি নিতান্তই আমার কৌতুহল তৈরী করেছে বলে লেখা, একে ইতিহাস কখনোই বলবো না। ইতিহাস প্রমাণ সাপেক্ষ।

অনুমানের কৌতুহল ছেড়ে আমরা তাকাই নাটকের দিকেই আবার। নাটককার কেন আচমকা এমন মৃত রাজাদের মন্দিরের প্রসঙ্গ আনলেন? তিনি কি এমন কিছু তাঁর সময় প্রচলিত থাকতে দেখেছেন? আমরা জানি হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকেই উপাসনাস্থল স্থাপনের রীতি আছে এ ভূখণ্ডে। বস্তুত তার আগেরও প্রাগ্‌-ঐতিহাসিক উপাসনাস্থলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এ নাটক ভাসের নাটক ধরলে তাঁর সময়কালের আগে থেকেই বৌদ্ধ স্তুপ, চৈত ইত্যাদি শুরু হয়েছে গিয়েছে। জৈন উপাসনা স্থাপত্যও বাড়ছে। পাটলিপুত্র নগর যেমন কাঠের তৈরী ছিল, তেমনই পাশাপাশি কাঠের স্থাপত্যও বাড়ছে। তা বৌদ্ধ-জৈন ব্যতিরেকি স্থাপত্যও বটে। যদিও পাথরের আয়ু না থাকায় সে সকল আর অবশিষ্ট নেই, তবুও ভাবা চলে কী যে এমন মন্দির নাটককার দেখেছিলেন সত্যিই? এবং গান্ধার শিল্প পরবর্তী যুগে রাজাদের প্রস্তর মূর্তি ভাবাও তাঁর পক্ষে আর অসম্ভব ছিল না? সেই কারণেই মহাকাব্যের প্রচলিত বয়ানে না থাকা সত্ত্বেও তিনি এমন এক মন্দির ও মূর্তি কাহিনীকে নাট্যে গুরুত্বের জায়গা দিলেন? এ সব প্রশ্নের উত্তর এক্ষণি আমাদের হাতে নেই। তাই এইবারে ফিরে যাই ঐ তৃতীয় অঙ্কের বাকী অংশের দিকে।

সেখানে ভরত তাঁর তিন পূর্বজর মূর্তি দেখলেন। তিনি নিজেও তাঁদের অবয়ব অন্য কোনো মাধ্যম – যেমন চিত্র মাধ্যমেও দেখেননি আগে বোঝাই যাচ্ছে। চিত্রশিল্প তাহলে তখনো সে পর্যায়ে যেতে পারেনি এর আঁচও যেন পাচ্ছি। তাই রাজাদের প্রতিকৃতি চিত্রেও তার আগে ভরত দেখেননি বলে চিনতে হল মন্দির রক্ষকের সহায়তায়। এই চেনার পরে পরেই ভরত দেখলেন তাঁর পিতা রাজা দশরথের মূর্তি। জানতে চাইলেন জীবিতের প্রতিমা এখানে কেন? মন্দির রক্ষক তখনো জানেন না ভরত কে! যেমন ভরত জানেন না দশরথ মৃত। এইবারে জানলেন। মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। তৃতীয় অঙ্কের ঘটনা এখানেই শেষ না। এরপরে রাজমন্দিরে কৌশল্যা, সুমিত্রা এবং কৈকেয়ী আসবেন। ততক্ষণে ভরত শান্ত হয়ে পুরোহিতের কাছে শুনেছেন সব কথা। রাজমহিষীরা আসার পর ভরত কৌশল্যা, সুমিত্রাকে প্রণাম করে এবং কৈকেয়ীকে তিরস্কার করে রামকে বনবাস থেকে ফেরানোর জন্য নির্গত হবেন।

এই তৃতীয় অঙ্কেই নাটককারে অসামান্য রচনাকৌশল আমরা পর্যবেক্ষণ করি। সঙ্গে নাট্যবিষয়ক জ্ঞান, মনস্তত্ব, সামাজিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, সম্পদগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ অর্থাৎ নৈতিকতা বিষয়ক অবস্থান। ভরতকে মাতুলালয় থেকে আনতে যে সারথী গিয়েছিলেন তিনি সবই জানতেন। কিন্তু বলতে পারেননি। পিতার প্রাণত্যাগ, মায়ের সম্পদাভিলাস পুত্রস্বার্থে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বনগমন এ সব কথা বলা কি সহজ কাজ? ভরতের প্রতিক্রিয়া কী হবে কেউ জানে না! তার চাইতে তাঁকে নাটককার আগে পূর্বজদের সামনে দাঁড় করালেন। প্রতিমা এখানে শুধু ব্যক্তির অবয়বের সাদৃশ্য নয়, কীর্তিরও সাদৃশ্য বটে। নীরবেই ভরত সেই কীর্তির সম্মুখীন হলেন এবং পূর্বজদের নৈতিক ও নৈষ্ঠিক অবস্থানের কথা তাঁর স্মৃতিতে অবশ্যই এল। তাই না রাজাদের মূর্তি বসেছে। মন্দির হয়েছে। দশরথ একদিকে পুত্রকে নির্বাসন দিয়েছেন যেমন, তেমনই নিজ শপথ রক্ষা করেছেন। পুত্রের স্নেহে বিকল হয়ে শপথরক্ষার গুরু দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হ’ননি। ভরত যে কৈকেয়ীর আদায় মত সিংহাসন গ্রহণ করবেন না, তৎকালীন নৈতিকতার প্রমাণ হিসেবে রামকেই সিংহাসনে বসাতে আনতে যাবেন সে তাঁর পূর্বজদের এই ধরণের নৈতিক কাঠামোর উত্তরাধিকারও বটে।

দশরথের মূর্তি দর্শনের সময়ও এই নাটকীয়তা আছে। সে মূর্তি দেখে ভরত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বা’র হয়েই যাচ্ছিলেন। পুরোহিত তাঁর কাছে জানতে চাইলেন ‘যিনি পত্নীর পণরক্ষার জন্য নিজের প্রাণ ও রাজ্য বিসর্জন দিয়েছেন সেই দশরথ সম্পর্কে আপনি কিছু জানতে চাইলেন না কেন!’ এই জাতীয় নাটকীয়তার সঞ্চার মহাকাব্যের প্রচলিত বয়ানে নেই। দিলীপ, রঘু বা অজের ক্ষেত্রে যে সব অর্জনের কথা বলছেন পুরোহিত তা দশরথের ক্ষেত্রে বলছেন না। তিনি কতবড় যোদ্ধা, রাজ্যের কেমন শাসক সে সব কিচ্ছু না। পত্নীর পণরক্ষায় নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন এইটিই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই যদি বীরের পরিচয় হয় তাহলে পরোক্ষে তাঁকে স্ত্রৈণ আখ্যায়িত করাও হয়। এই সমাজে নারী তো পুরুষের অধীন। কৌশল্যা, সুমিত্রা এঁরা কেউ তো দশরথের উপর এই প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। বরং দশরথ অন্যত্র জানাচ্ছেন কৈকেয়ীর জন্য বা তাঁর ক্রোধের ভয়ে তিনি কৌশল্যার প্রতি যা করণীয় তা করতে পারেন না। তাহলে পুরুষকে নারী চালনা করে? এ কি সে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গৌরবের কথা?

এই নৈতিকতার ছায়ার মধ্যে দিয়ে দশরথের প্রয়াণকে এনেছেন নাটককার। সে কারণেই এখানে যখন মাতা কৈকেয়ীর সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছে, তিনি মাতাকে তিরস্কার করছেন। বলছেন, স্বভাবসংক্রান্ত দোষে স্নেহত্যাগ করে মাতা পুত্রকেও অপুত্র করে তোলেন। স্বামীর প্রতি বিদ্বেষাত্মক আচরণে মাতাও অমাতা হন। এই সব বলে জানাচ্ছেন, তিনি সংসারে নতুন ধর্ম স্থাপন করছেন। অর্থাৎ রামকে ফিরিয়ে এনে কৈকেয়ীর এ জাতীয় অপরাধের মীমাংসা করবেন। এই যে নতুন ধর্ম স্থাপনের প্রসঙ্গ এই হল মন্দিরে প্রয়াত রাজাদের মূর্তি দেখার ফলাফল। মূর্তির যোগ্য হতে হলে ওই সব পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম-নৈতিকতার প্রতিপালনও প্রয়োজন। ভরত সরাসরি রাজা হবেন না, কিন্তু আদর্শ পুত্র ও ভ্রাতার অন্য চেহারাটি তিনি স্থাপন করবেন। তবেই তাঁর কৃতিত্ব প্রকাশ পাবে। তবেই তিনি নায়কের পর্যায়ভূক্ত হবেন। রাম ছাড়াও, ভরতকে এমন ভাবে তাঁদের বংশের ঐতিহ্যের মধ্যে উপস্থাপন করার পাঠটি একেবারেই এই নাটককারের স্বকল্পিত।

যদিও এখানেই মহাকাব্যের প্রচলিত পাঠের থেকে ভিন্ন মার্গে গতায়াত শেষ হচ্ছে না। এরপরে চতুর্থ অঙ্কে ভরত পৌঁছচ্ছেন রাম-লক্ষ্মণের কাছে। বাইরে থেকে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন নির্দয়, কৃতঘ্ন, নীচ কিন্তু দুঃসাহসী বলে। সে কন্ঠ শুনে রাম বলছেন এ কন্ঠ কোনো অনাত্মীয়ের হতেই পারে না। নাটককার শুরুতেই যে আমাদের জানিয়েছিলেন ভরতের সঙ্গে তাঁর ভাইদের এবং ভ্রাতৃবধুদের সাক্ষাত বহুদিন ছিল না, তা এখানে এসে চরম নাটকীয়তায় পৌঁছচ্ছে। লক্ষ্মণ বাইরে বেরোলেন। ভরতকে দেখে এসে রামকে বর্ণনা দিলেন ভরতের। চাঁদের মত সুন্দর মুখ, যেন রামের ছায়া। দশরথের দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতচিহ্ন লাঞ্ছিত হওয়া যেমন বক্ষ, এঁর বক্ষও তেমনই উন্নত। এই প্রিয়দর্শন পুরুষ রাজা, না দেবরাজ, না স্বয়ং বিষ্ণু? অর্থাৎ দেবরাজের পাশাপাশি বিষ্ণু-মহিমা প্রকাশও সচেতনে শুরু হয়ে গেল দেখছি। এইবারে ভায়েদের পরিচয়ের পালা। সুমন্ত্র, দশরথের সারথী পরিচয় করাচ্ছেন তিন ভায়ের। এবং অবশ্যই সীতারও।

এ ভাবে প্রচলিত রামায়ণ এগোয়নি। আবার এর ঠিক পরেই নাটককার প্রচলিত কাহিনী ভঙ্গীমা গ্রহণ করছেন। ভরত পাদুকা রেখে রামের প্রতিনিধি হয়ে শাসন করবেন জানাবেন। রামকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করাবেন যে চোদ্দ বছর বনবাস থেকে ফিরে রাম রাজ্যভার গ্রহণ করবেন। এ সব হয়ে যাবার পরে আসছে পঞ্চম অঙ্ক, যেখানে দশরথের বাৎসরিক কেমন করে হবে বনবাসে তাই নিয়ে রাম চিন্তিত। সীতা বলছেন ভরত অযোধ্যাতে মহাসমারোহে বাৎসরিক করবেন। তাই রাম ফল আর জল দিয়ে পিতৃশ্রাদ্ধ করলেই হবে। ঠিক এইখানে রাবণের প্রবেশ। যদি খেয়াল করা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে শূর্পণখা প্রসঙ্গ আসছেই না। কোনোভাবেই আসছে না। তাহলে কি তখনকার প্রচলিত পাঠে ছিল না এই প্রসঙ্গ? নাকি নাটককার জেনেশুনেই একে বর্জন করেছেন? যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত জেনেশুনেই রামের প্রতি শূর্পণখার দৃশ্য-মুগ্ধতা ও কামকে বর্জন করেন এবং শূর্পণখার যাবতীয় প্রেম লক্ষ্মণের দিকেই বইয়ে দিয়েছিলেন জেনেশুনে? পত্রকাব্যটির মধ্যে নাক-কান কাটার বিভৎসতার স্থানই দেননি যেমন? কিন্তু তখনকার প্রচলিত পাঠটিতে ছিল না এ কথা সম্পূর্ণ রূপে ভাবাও যাচ্ছে না। কেন না এই দৃশ্যেই রাবণ মৃগের প্রসঙ্গ আনবেন।

রাবণ সর্বপ্রথম নিজেকে প্রবল শাস্ত্রজ্ঞ রূপে প্রতিষ্ঠা করবেন রামের কাছে। তারপরে রামের পিতৃশ্রাদ্ধের কথা শুনে বলবেন কাঞ্চনপার্শ্ব মৃগ দিয়ে তর্পণ করলে পিতৃপুরুষের আত্মার শান্তি হয়। সে মৃগ পাওয়া যায় হিমালয়ে। সে মৃগের বর্ণনাও অপরূপ। হিমালয়ের সপ্তম শিখরে সে থাকে। শিবের জটানির্গত গঙ্গাজল পান করে। তার পৃষ্ঠদেশ বৈদুর্যমণির মত শ্যামবর্ণ এবং সে বায়ুবেগে চলে।

কিন্তু মারীচের প্রসঙ্গ, রাবণের প্রতিশোধের প্রসঙ্গে এখানে আসছে না সেভাবে। নাটককার এ সব বাদ দিয়েই রচনা করছেন। হিমালয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে নিতে আশ্রমের কাছে স্বর্ণমৃগ দেখবেন রাম। ধরতে পশ্চাদ্‌ধাবন করবেন। এরপরে সীতা হরণ হবে। লক্ষ্মণ সে সময় অনুপস্থিত। তিনি গিয়েছেন কুলপতিকে আনতে। তাই গণ্ডী কাটার কাহিনীও নেই এখানে। সীতাহরণের কালে অবশ্যই জটায়ুর সঙ্গে যুদ্ধ আছে। আবার এখানে সীতা অলঙ্কার ছড়িয়ে যাচ্ছেন না পথে, বরং রাবণই নিজ পথের নিদর্শন রেখে যাচ্ছেন রামের অনুসরণের জন্য। তিনি গোপন করতে চাইছেন না নিজ কার্য। এভাবে প্রচলিত পাঠ থেকে নাটককার অনেক দূরে সরে আসছেন।

কিন্তু এতে এক সমস্যা দেখা দিচ্ছে! শূর্পণখার আখ্যান বাদ গেলে রাবণের সীতাহরণের কারণ গোলমেলে হয়ে যায়। কার্য-কারণ সূত্র থাকে না সেভাবে। ভিন্নপাঠ নিয়ে কথা বলতে হলেও নাট্যের দুর্বলতাকে অবহেলা করা চলে না। অন্যদিকে এখানে নাটককার বেশ কিছু বিষয়ে আরো মৌলিকতার ছাপ রাখছেন। রাবণ ছদ্মবেশে আসছেন রামের সম্মুখেই। লঙ্কাকাণ্ডের আগেই দুজনের দেখা হয়ে যাচ্ছে। এমনটা প্রচলিত পাঠ তো বটেই আর কোনো পাঠে নেই। রাম এখানে রাবণকে বিধিসম্মত ভাবে পূজাও করছেন। রাবণ যে শ্রাদ্ধকল্পশাস্ত্রে দক্ষ, তাতে তাঁর জ্ঞানী ও পণ্ডিত সত্ত্বাও প্রকাশ পাচ্ছে। আবার নাটককার কিন্তু প্রচলিত পাঠের মতন সীতার আব্দারে সোনার হরিণ ধরতে রামকে পাঠাচ্ছেন না।

যদিও সীতাই এই নাটকের শুরুতে নাট্যশালায় বল্কল পরে মানাচ্ছে কী না দেখার মতন লঘু কাজ করছিলেন। অর্থাৎ চরিত্রের রূপান্তর প্রক্রিয়া, সীতার প্রাজ্ঞতা বৃদ্ধি নতুন সংযোজন। রাবণ রামকে দশরথের তর্পণের জন্য হরিণের পেছনে পাঠাচ্ছেন, এর তির্যকতাও এক দেখার বিষয়। সীতা কথিত ফল ও জলের নীতি মানলে কিন্তু এই অবস্থা হয় না। ভেকধারী সাধুর কথা শুনে ধর্মীয় রীতি-নীতি মানতে গেলে আসলে দুরবস্থাই জন্মায় এও খানিক আড়ালে, কিন্তু নিশ্চিত ঠেসের মত রাখা আছে। তাছাড়াও রয়ে গেল নারীর পরামর্শ নারী হওয়ার কারণে না শোনার মত রামের পুরুষতান্ত্রিক দম্ভ। শুধু রাবণের সীতা হরণের কার্য-কারণ দুর্বল হয়ে পড়লো এখানে। এমন নয় যে প্রচলিত পাঠ নাটককার জানেন না। রামায়ণের ভাব-ভাষা তিনি বেশ কয়েকবার ধারও করছেন তাঁর নাটকে। তাহলে এমন হল কেন?

সে কথায় যাবার আগে আমরা পরের অঙ্কটিও দেখে নিই। সেই অঙ্কে আছে কৈকেয়ীর চরিত্রে মহত্ব আরোপ। বাল্মিকীর রামায়ণে কৈকেয়ী খল, ক্রুর, স্বার্থসর্বস্ব। এখানে নাটককার তাঁকে চিত্রিত করছেন ভিন্ন ভাবে। প্রচলিত রামায়ণ বলছে কৈকেয়ী রামের বনে যাওয়ার আগে জানতেনই না অন্ধমুনির দশরথের প্রতি অভিশাপের কাহিনী। রাম বনে গেলে সন্তপ্ত শোকাকুল দশরথ কৌশল্যার ঘরে গিয়েছেন। তখন কৌশল্যার তিরস্কারে তিনি অন্ধমুনির কথা বলেন। কিন্তু এই নাটকে কৈকেয়ী এ শাপের কথা আগেভাগেই জেনেছেন। কেমন করে জানলেন তা পরিস্কার নয়। এবং জেনেছেন বলে তিনি সেই শাপকে ফলবান করে তোলার জন্যই তিনি রামকে বনবাসে পাঠিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ কাজ করার জন্য বশিষ্ঠ এবং বামদেবের অনুমতি নিয়েছিলেন তিনি। তবে রামের বনবাসে যাবার কথা চোদ্দ দিনের জন্য। কৈকেয়ী মূহুর্তের উত্তেজনায় তা চোদ্দ বছর বলে ফেলেছেন। তাঁর মা যে স্বার্থপরতায় এ কাজ করেননি তা জেনে ভরত কৈকেয়ীকে ক্ষমা করতে পারলেন। এবং মাকে প্রণাম করে অপহৃত সীতা উদ্ধারে জন্য রামকে সাহায্য করতে অযোধ্যার সৈন্যবাহিনী সাজাতে উদ্যোগী হলেন।

কৈকেয়ীকে মহৎ করতে গিয়ে আবার কতগুলি সমস্যা নাটককার তুলে ফেলেছেন। কৈকেয়ী জানলেন কেমন করে শাপের কথা বাদ দিলেও, প্রশ্ন হচ্ছে বনবাসের ফলে দশরথের মৃত্যু হতে পারে জেনেও এ কাজ কেন করলেন? অন্ধমুনির শাপকে জেনেশুনে ফলবান করার কাজ তাঁর কেন হবে? তাহলে শাপের মহিমাই বা কেমন করে অক্ষুণ্ণ থাকলো? দৈবীকে মানবিক কার্যক্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার এ আয়োজন কেন? আর চোদ্দ দিনকে চোদ্দ বছর করে দেওয়া ভুল করে হলেও যে ক্ষতি তা তো অপূরণীয়! দশরথের মৃত্যু, দীর্ঘ বনবাস, সীতাহরণ এ সব তো এরই ফলাফল। তাহলে ভরত এর পরেও মা’কে ক্ষমা করবেন কেমন করে? কেমন করেই বা বশিষ্ঠ বা বামদেবকে কিছুই না বলে চললেন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে? এতে কৈকেয়ীর চরিত্র উন্নত হল? নাকি তিনি নিজেকে ভক্তিতে অন্ধ বলে প্রমাণ করলেন মাত্র? সঙ্গে নিজের কাঁধে এত এত ক্ষতি করার দায়িত্ব নিয়ে শাপকে সফল করে ভক্তির চূড়ান্ত দুর্বলতা প্রকাশ করলেন? এই কৈকেয়ীর মহত্ব রচনা কী নাটককারের আরেকটি দুর্বলতা?

নাটককার যে সময়কার মানুষ সেই সময় দৈবী বা জাদুক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্কটি যদি আমরা বুঝে নিতে পারি তাহলে এই কাজের নেপথ্য ভাবনাটি তত অস্পষ্ট থাকে না। এ প্রসঙ্গে আমরা লেভি স্ত্রাউস উল্লিখিত একটি ঘটনার কথা মনে আনতে পারি। স্ত্রাউস একটি ঘটনার উল্লেখ করছেন, যে ঘটনাটি ১৯০৫ সালে আমেরিকার জুনি (Zuni) ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে রিপোর্টে লিখেছিলেন স্টিভেনসন। একটি বয়ঃসন্ধিকালের বালক এক বারো বছরের বালিকার হাত ধরেছিল একদিন। বালিকাটির মুহূর্তের মধ্যে স্নায়বিক খিঁচুনি দেখা দেয়। জুনি ইন্ডিয়ানদের মধ্যে তখন নিয়ম ছিল যাদুবিদ্যার অধিকারী বলে কাউকে চিহ্নিত করা হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। অতএব ছেলেটিকে নিয়ে বিচার শুরু হল।

প্রথমবারের বিচারে ছেলেটি জানালো যে তার শিক্ষকেরা তাকে দুটি গাছের শিকড় দিয়েছেন। সেই শিকড়ের একটিতে মেয়েদের উন্মাদ করে দেওয়া যায়, অন্যটিতে তাদের উন্মাদনা সুস্থ করে দেওয়া যায়। ছেলেটিকে যখন সেই শিকড় আনতে বলা হল, সে নিয়ে এল। সঙ্গে সে এক বিচিত্র এবং জটিল কাণ্ডকারখানা করে-টরে প্রথম শিকড়টি নিজে খেল। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে যেন সম্মোহিত এবং উন্মত্ত এমন ভাব করল কিছুক্ষণ। তারপরে দ্বিতীয় গাছের শিকড়টি খেয়ে সে সুস্থ হয়ে যাওয়াও দেখালো। এরপরে সে মেয়েটিকে দ্বিতীয় গাছের শিকড়টি খেতে দিল। মেয়েটি খাবার পরে ছেলেটি ঘোষণা করল মেয়েটি এবারে সুস্থ হয়ে গেছে। সেদিন রাত হয়ে গেছে বলে এরপরের বিচার স্থগিত রাখা হল। যে যার ঘরে ফিরে গেল।

গণ্ডগোল করল ছেলেটি আবার। সে রাতারাতি পালালো। তাকে ধরেও আনা হল। এবারে যখন ধরা হল তার আগের বয়ান বিচারকেরা কিন্তু মানতে চাইল না। এবারে ছেলেটি নতুন বয়ান বানাল। সে বললো তার আত্মীয়-স্বজন এবং পূর্বজরা বহুযুগ ধরেই যাদুবিদ্যা জানে। বিপুল তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার। সে চাইলেই বেড়াল হয়ে যেতে পারে। চাইলেই মুখভর্তি করে ক্যাকটাসের কাঁটা নিয়ে দুটি শিশু, তিনটি মেয়ে এবং দুটি ছেলেকে হত্যা করতে পারে কাঁটা ছুঁড়ে। এই সব সে পারে যেহেতু তাদের পরিবারে যাদুশক্তি আছে, যে যাদুশক্তি আবার এসেছে তাদের কাছে রাখা এক পাখির পালক থেকে। এইবারে আরেকটু বাড়াবাড়ি করে বলে ফেলে যে সেই পালক গাঁথা আছে তাদের ঘরের দেওয়ালে।

বিচারকেরা তাকে চেপে ধরতে সে অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে কাটাতে চাইলেও শেষে দেওয়াল ভাঙতে শুরু করতে বাধ্য হয়। দেড়খানা মতন দেওয়াল ভেঙে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। বলে দু’বছর আগে দেওয়ালে গাঁথা হয়েছিল বলে তখন মনে পড়ছে না। কিন্তু বিচারকদের চাপে বাধ্য হয় বাকীটাও ভাঙতে। এমন ভাঙতে ভাঙতে ঘন্টাখানেক পরে দেওয়ালে সত্যিই সে একটি পালক পায়। উৎফুল্ল হয়ে বিচারকদের দেয় প্রমাণ হিসেবে। এবারে তাকে খোলা প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সে তার গল্পটা আবার বলে। এবারেও আরো নতুন কিছু বিষয় যোগ করে। এটা যতবার সে গল্পটা বলেছে ততবারই করেছে। স্থানাভাবে সম্পূর্ণ কাহিনীটিকে এখানে আনা গেল না, ফলত বহু তাৎপর্যপূর্ণ মনস্তাত্বিক বিষয় এখানে ঠাঁই পেল না। যাই হোক, শেষত সে দুঃখের সঙ্গে জানায় তার যাদুশক্তি আর নেই। এবারে বিচারকেরা তাকে মুক্তি দেন।

ছেলেটি কি আগাগোড়া মিথ্যে বলছিল? কাহিনীগুলো কেমন করে তৈরী হচ্ছিল? এ সম্পর্কে স্ত্রাউস তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন। প্রথমত ছেলেটির সামনে একটি ভয়াবহ পরিণতি ছিল, তা হল মৃত্যুদণ্ডের। তাহলে সে প্রথমেই মেয়েটির হাত ধরেছে এ কথা অস্বীকার করল না কেন? অস্বীকার করলে তার প্রতি যে শত্রুতা সে আরো যেত বেড়ে। তার বিচারকেরা, সে অস্বীকার করবে এমন পরিস্থিতিতে বিচার করতে বসেইনি। বরং তারা বসেছিল এমন একটি বিষয়কে বুঝতে যা সাধারণভাবে তাদের বোধগম্যতার বাইরে। হাত ধরলে স্নায়বিক খিঁচুনি হবে কেন তা তারা জানেই না। দুটোর মধ্যেকার সম্পর্ককে বোঝা তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল। এবারে ছেলেটির কাছেও এর কার্য-কারণ পরিস্কার নয়। সুতরাং তার পক্ষে যাদুশক্তি আছে মেনে নেওয়াটা প্রাথমিকভাবে সহজ রাস্তা। যাদুশক্তি বলে যে একটা বিষয় হয় তা তারও কৌমস্মৃতিতে (গল্প-গাছা ইত্যাদির মাধ্যমে) রয়েইছে। বাকীদেরও রয়েছে বলেই মৃত্যুদণ্ডের আইন ছিল। এবারে সে একেই কাজে লাগাতে শুরু করল।

তার কী প্রাণের ভয় ছিল না? স্ত্রাউসকে ধরেই একটু অন্যভাবে উত্তরে আসার চেষ্টা করা যাক। যুদ্ধ কেন হয়? কেউ বলতে পারেন যুদ্ধ আসলে জাতীয়তাবাদের অন্তিম কামড় যার মাধ্যমে সে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। কেউ বলতে পারেন যারা অস্ত্র বানায় তাদের অস্ত্র বেচার জন্য যুদ্ধ হয়। দুটো যুক্তির মধ্যে আপাত সম্পর্ক কাটাকুটি করার শুধু নয়। মানুষের মাথা যেভাবে কাজ করে তাতে এই দুটো যুক্তিকেই সে একত্রে রাখতে পারে। যখন যেটা প্রয়োজন সেটাকে কাজে লাগাতেও পারে। আফঘানিস্তানে তালিবানরা কাশ্মীর উদ্ধার করবে, এ কথা শুনলে তার জাতীয়তাবোধ (ভারতীয়/পাকিস্তানি/আফঘান বলে স্বাভাবিক কোনো জাতি না থাকলেও) বলতে পারে যুদ্ধ হোক। আবার কাশ্মীর সমস্যাকে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির ফন্দির জন্যই কর্পোরেটেরা দেশগুলোর নেপথ্য থেকে টিকিয়ে রাখছে এতেও একমত হতে পারে।

তারপরেও সে বুঝতে পারে এ দুটো ছাড়াও আরো কারণে যুদ্ধ হতে পারে। কিন্তু কারণগুলো আর স্পষ্ট নয় তার কাছে। তখন এই যে বৌদ্ধিক ধোঁয়াশা এ অসহ থাকে তার কাছে যতক্ষণ না সে একে একটা নির্দিষ্ট ধাঁচে ফেলতে পারে। যতক্ষণ না একটি গোষ্ঠীর ধারণার সঙ্গে সে যুক্ত হতে পারে ততক্ষণ তার অশান্তি থাকে। এই যোগদান, ভাবগত অবস্থার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে তার কাছে। যা সে ব্যক্ত করতে পারছিল না, যা সে প্রকাশ করতে পারছিল না সেই ধোঁয়া ধোঁয়া অঞ্চলটা এবারে একটা ব্যবস্থা পেল।

ছেলেটির ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা হয়েছে। যাদুশক্তির গুরুত্ব সে জানে এবং স্নায়বিক খিঁচুনির কোনো ব্যাখ্যা তার জানা নেই। এবারে যাদুশক্তির জন্য মৃত্যুদণ্ড সম্ভাব্য হলেও অন্তত একটা ব্যাখ্যা সে খাড়া করতে পারছে। আগের গাল-গল্প থেকে পাওয়া স্মৃতিভাণ্ডার তাকে জানাচ্ছে শেকড়-বাকড়, পাখির পালক ইত্যাদির যাদু-মাহাত্ম্য আছে। সেই মাহাত্ম্যকে সে এবারে কাজে লাগাতে শুরু করল। তার বিচারকেরাও এ সব মাহাত্ম্য জানে বলে দু’পক্ষের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার সাধারণ ক্ষেত্র তৈরী হতে লাগল। বিচারক যোদ্ধাদের হাল অবশেষে ঐ পাখির পালক দেখে হতভম্ব হওয়াতে দাঁড়ালো। তারাও বিচার করার সময় ঘটনা অস্বীকার তো আশা করছিল না। বরং ব্যাখ্যাই চাইছিল আসলে। এবারে যেন সব তাদের বোধগম্য হল।

ছেলেটি কি ইচ্ছে করেই শুধু মিথ্যে বলছিল? না। স্টিভেনসন জানাচ্ছেন যে যতই সে গল্পটা বলছিল, যতই সে নানা কাণ্ড করছিল ততই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। সে নিজেও আরো গল্পের মধ্যে আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। শ্রোতাদের উপর তার যে প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছিল তাতে আরো বেশী ক্ষমতার স্বাদ পাচ্ছিল। প্রাণদণ্ডের ভয়াবহ সম্ভাবনা উল্টোদিকে থাকা সত্ত্বেও সে ক্রমে নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। তার ফলে যত ঘটনা এগিয়েছে ততই সে নিশ্চিত হচ্ছিল নিজের শক্তি সম্পর্কে। তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন তো করছিলই, সে উদ্ভাবনও উন্নত হচ্ছিল ছোটখাট তথ্যের বর্ণনা নিপুণতায়। যে যাদুকর চরিত্রটা তার উপরে বিচারসভা শুরুতে আরোপ করেছিল, সে ধীরে ধীরে তাকেই আপন করে নিয়ে নিজেকে যাদুকর বানিয়ে নিচ্ছিল এভাবে। আর বিচারকেরা যে ছেলেটির বিচার করতে বসেছিল, সে ক্রমেই তাদের চোখের সামনে অপরাধী থেকে বিবর্তিত হতে হতে এভাবে সাক্ষীতে পর্যবসিত হয়ে গেল। কারণ বিচারকদের কাছে যাদুশক্তি একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ছিল, যা গ্রহণ না করলে উল্টোদিকে আর কোনো ব্যাখ্যাই তাদের জানা ছিল না। অতএব তারা প্রথমটিকেই গ্রহণ করাটা তাদের বৌদ্ধিক স্তরের জন্য সুবিধেজনক মনে করেছিল। চিন্তার বিশৃঙ্খলা থেকে এভাবেই তারা রক্ষাও পেতে চেয়েছিল।

প্রতিমানাটকম-এর রচয়িতা যে সমাজে বসবাস করতেন সে সমাজও এই যাদুশক্তির পর্যায় থেকে ধর্মের পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে। ধর্মের মধ্যে বহুল পরিমাণে যাদুশক্তির ক্ষমতা-অক্ষমতা রয়ে গেছে দৈবী আশীর্বাদ অভিশাপের মধ্যে। সুতরাং অন্ধমুনির শাপ কেমন করে জানলেন, বশিষ্ঠ বামদেবরা কেনই বা দশরথকে মরতে দিলেন এ সব প্রশ্ন তাঁর এবং তাঁর দর্শকদের কাছে চলে গেছে নেপথ্যে। শাপ একটি ভয়ানক বিষয় এবং বশিষ্ঠ বা বামদেবরা এত বড় ঋষি যে তাঁদের কোনো কাজকেই প্রশ্ন করা যাবে না – এই দুই’ই নাটককার এবং তাঁর দর্শকদের কাছে স্বাভাবিক। ফলে কৈকেয়ীর এই মহত্বের স্রোত অব্যাহত রাখতে গিয়েই আসে শেষ অঙ্ক। সে অঙ্কে রাম সীতাকে উদ্ধার করেছেন। সঙ্গে তাঁর বানরসেনারা। বিভীষণকে লঙ্কার রাজত্বে বসিয়ে ফিরেছেন ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে। অযোধ্যা থেকে সকলকে নিয়ে ভরত সেখানেই সমাগত হলেন। সেখানে কৈকেয়ী জানালেন চিরকালই তাঁর মনোগত ইচ্ছে ছিল রামই রাজা হোক। এরপরে রাম অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করবেন।

নাটককার যে বৈষ্ণবভাবাপন্ন তা বহু বিশেষজ্ঞই অনুমান করে থাকেন। এবং তত্ত্বজ্ঞ নাটককার তো বটেই। সম্ভবত সেখানেই নাটককারের একটি রুচির কথা আসতে পারে। মানবচরিত্রকে তিনি কেমন করে দেখতে চাইছেন? পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়, এই যে রাস্তায় একদা আব্রাহামিক ধর্মভাবনা থেকে উদ্ভূত খ্রীষ্ট ধর্ম এসে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে বৈষ্ণবমতেরও একদা আগমন হয়েছিল। মহাকাব্যগুলো জুড়ে তার ছায়া ছড়িয়ে আছে। রাবণ নিতান্ত রক্ত-মাংসের রাবণ থাকতে পারেন না তাই সেখানে। তিনি তো আদপে শত্রুরূপে বিষ্ণু ভজনা করছিলেন, যাতে দ্রুত বিষ্ণুলোকে প্রত্যাগমন করতে পারেন। অতএব বিষ্ণুর অবতার বলে যাঁকে ধরাধামে চিহ্নিত করা হবে তাঁর এমন শত্রুর মধ্যেও মহত্বের চিহ্ন রাখতেও হচ্ছিল রচয়িতাদের। এই যে এই নাটকে রাবণ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, এ সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ। রাবণ যে সীতাহরণ করে নিজেই তাঁর গন্তব্যের পথচিহ্ন রেখে চলেছেন সেও এভাবেই আসছে।

এর পাশাপাশিই নাটককার একটি মানবিক রূপকেও সযত্নে লালন করতে চাইছেন তাঁর রচনায়। মানবপ্রেমের আদর্শটি তাঁর কাছে অতি প্রিয়। সেই আদর্শেই কৈকেয়ীকে নিছক ক্রুর, খল হতে পারেন না। তাঁর কার্য অপরিসীম ক্ষতি করেছে পরিবারের। এ কথা সত্য। কিন্তু সে ক্ষতি আসলে তাঁর স্বার্থজনিত কারণে নয়। পরিবারের পরিকাঠামোর মধ্যে নাটককারের অনুসৃত এবং তাঁর মতে উপযুক্ত নীতি-কাঠামোর জন্যই এ ক্ষতির উপস্থাপন।

ভরতকে মন্দিরেও এনেছেন নাটককার ইক্ষ্বাকু বংশের মহৎ দিকটি বোঝাতে। পূর্বজরা শাসন এবং জীবনের কিছু আদর্শকে নিজ প্রাণ অপেক্ষাও মূল্যবান জেনেছেন। তাকে রক্ষা করতে দশরথ প্রাণদানও করেছেন। এই হল ইক্ষ্বাকু পরম্পরা। সে পরম্পরার গৌরবের ভাগীদার হতে গেলে ভরতকে শাস্ত্র এবং নীতিকে সব কিছুর আগে স্থান দিতে হবে। রাজ্য পেলেই নেওয়া যাবে না। কারণ তৎকালীন নীতি-কাঠামো অনুযায়ী পরিবারে জ্যেষ্ঠ কুলরক্ষক এবং সর্বাগ্রে মান্য। পুরুষতন্ত্র বা ক্ষমতাতন্ত্র এই পরিকাঠামোতেই সম্পদের বিভাজন সংসারের বিভাজনকে রক্ষা করার যুদ্ধ করছে। সে যুদ্ধে ভরত গৌরবময় ভূমিকা পালন করছেন রামের হাতেই রাজত্বভার ফেরানোর চেষ্টায়।

তেমনই কৈকেয়ীও নৈতিক দিকটিকে ঠিক রাখতে, শাস্ত্রপ্রদানকারী মুনি-ঋষিদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতেই মুনির শাপকে কার্যে পরিণত করেছেন। সে কাজ করতে গিয়ে সকলের ঘৃণাকেও তিনি মাথায় তুলে নিয়েছেন। এ তাঁর পারিবারিক দায়িত্বের ভূমিকা যে। ইক্ষ্বাকু রাজবংশ ধর্মে-শাসনে-ভালবাসায়-ত্যাগে আদর্শস্থানীয় ছিল এবং থাকবে। এই ভাবনাটিকেই ঘিরে নাটককারের চরিত্র রচনা ও তার কার্যকলাপ নির্মাণ। দশরথ জাতক, যা বৌদ্ধ ভাবনার একপ্রকার অনুসরণ তার ‘সতীন’ চরিত্রচিত্রণের থেকে এভাবে দূরেও যাওয়া। সে সময় দশরথ জাতক প্রচলিত ছিল এমন নয়, কিন্তু বৌদ্ধ বা জৈনাদি প্রস্থানের ধর্মগুলি যে সব জায়গায় আক্রমণ করছিল বেদ পরবর্তী পৌরাণিক ধর্মগুলিকে, এ তার বিরুদ্ধে এক বৈষ্ণব প্রতিক্রিয়া।

এবং এখানে এই প্রশ্নটিও রাখা যায় যিনি এই প্রতিমানাটকম-এর নাটককার তিনি দশরথের পুত্র পরম্পরায় এমন পরিবর্তন কেন ঘটালেন? এক্ষেত্রে স্রেফ অনুমানই করা চলে মাত্র। রাম এবং লক্ষ্মণ এই দুজনের আত্মিক বন্ধনের সঙ্গে ভরত এবং শত্রুঘ্নের বন্ধন তুলনীয়। সচরাচর তাই বলা হয়। রাম-লক্ষ্মণের এই অবিভাজ্যতাই হয়তো তাঁকে ভাবতে সহায়তা করেছে এই দুজন পরপর জন্মেছেন। তাই নৈকট্য বেশী গড়ে উঠেছে। এমন নয় যে ভরত বা শত্রুঘ্ন রামকে ভালবাসেন না, বা তিনি তাঁদের। কিন্তু বনবাসকালে লক্ষ্মণই কোনো বাধা না মেনে রামের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন সংসার ছেড়ে, এমন কী স্ত্রী-কেও ছেড়ে। নাটককার সমাজ-সংসারের সচরাচরের চিত্রে এমন টান পরপর জন্মানো দুই ভ্রাতার মধ্যেই হয়তো কল্পনা করতে পেরেছেন। সেই কারণে তিনি পুত্র-পরম্পরার এমন পরিবর্তন ঘটালেন।

কিন্তু এ তো অনুমান মাত্র। প্রমাণ নয়। প্রমাণের দিকে তাকালে আমরা বরং নাটককার ভাস সম্পর্কে প্রচলিত একটি কাহিনীর কথা মনে করতে পারি। শ্রী এ এস পি আইয়ার দীর্ঘকাল অসামান্য কিছু কাজ করেছেন নাটককার ভাসকে নিয়ে। তিনিই জয়ানকার পৃথ্বিরাজবিজয়-এর একটি অংশের উল্লেখ করেছেন এই কাহিনীর সূত্র হিসেবে। জয়ানকা কাশ্মিরী কবি বলে অনুমান। এবং অনুমান তিনি কাব্যটি রচনা করেছিলেন ১১৯১-১১৯২ সাধারণ সময় (কমন এরা)-এর মধ্যে। কাব্যটির একটি টীকায় আছে ব্যাস এবং ভাসের প্রতিযোগিতার কাহিনী।

বেদব্যাস এবং ভাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে শ্রেষ্ঠ রচয়িতা তা নিয়ে! দুজনেই তাঁদের নানা কাজের মধ্যে থেকে একটি করে কাজ অগ্নিতে সমর্পণ করলেন। শ্রী আইয়ার বেদব্যাসের কাজের নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু ভাসের কাজটির নাম উল্লেখ করেছেন ‘বিষ্ণু ধর্ম’ বলে। দেখার মত বিষয় হল বৈষ্ণব নয়, ‘বিষ্ণু ধর্ম’। এর বাইরে দেখার বিষয় কাহিনীতে কী হল। অগ্নি বেদব্যাসের কাজটি গ্রাস করলেন। রয়ে গেল ‘বিষ্ণু ধর্ম’। না, এই নামে ভাসের কোনো কাজ আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। তাহলে? ভাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এ কাহিনী প্রচারিত, এখানেই এর ব্যাখ্যা শেষ?

সম্ভবত নয়। ভি এস সুথংকর, যিনি ‘ভান্ডারকর প্রাচ্য গবেষণা কেন্দ্র’-র হয়ে ‘মহাভারত’-এর মান্য পাঠের সম্পাদনা করেছিলেন, তাঁর একটি বক্তব্য ছিল ‘মহাভারত’-এর প্রচলিত পাঠ নিয়ে। তিনি বলতেন ভার্গব বংশজরা একে তাঁদের মহত্ব প্রচারের কাজে লাগিয়েছেন। প্রকারান্তরে গ্রাস করেছেন। তাই নানা অবান্তর বিষয় এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে বসেছে, যেখানে ভার্গব পরম্পরার মুনি-ঋষিরা প্রধান। নানা উদাহরণও দিয়েছেন। যেমন নৈমিষারণ্যে যখন কূলপতি শৌনকের কাছে উগ্রশ্রবা সৌতি মহাভারতের কাহিনী বয়ান করবেন, তখন আচমকাই শৌনক আগে ভৃগুবংশের কথা জানতে চাইলেন ইত্যাদি। সত্যিই ভৃগুবংশের মাহাত্ম্যর সঙ্গে মহাভারত-এর সম্পর্ক তেমন কিছু নয়। কাহিনী পরম্পরায় এ কথা বলাই চলে।

হঠাৎ এ প্রসঙ্গে আসলাম কেন সে কথা বলি। শ্রী আইয়ার তাঁর ভাস নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে আরেকটি ভাবনাকেও সামনে এনেছেন। সে ভাবনা হল ‘ভাস’ গোত্রনামও বটে। অগস্ত্যগোত্রের একটি শাখার নাম ভাস।যেমন পতঞ্জলি বা যৌগন্ধনারায়ণ ইত্যাদিও গোত্রনাম। তাহলে কি এই বেদব্যাস এবং ভাসের প্রতিযোগিতার রূপকের আড়ালে আছে বৈষ্ণবধারার প্রতিযোগিতাও? রামায়ণ এবং মহাভারতীয় আখ্যান নির্ভর কাহিনী নিয়ে ভাস যখন নাটকরচনা করছেন (যদি ধরে নিই এই সকল নাটক আসলে ভাস-এরই) সেখানে ব্যতিক্রমগুলি ইচ্ছাকৃতই? এমন কী, অন্য কোনো নাটককারের নাটকও যদি এইগুলি হয়ে থাকে, তাহলে কি তিনিও এই অন্তর্বিরোধের অন্তর্ভূক্ত? তাই ভায়েদের জন্মের ক্রম বদল করা থেকে শুরু করে কৈকেয়ীকে কালিমামুক্ত করার প্রচেষ্টা সকলই সেই দৃষ্টি সঞ্জাত? নিশ্চিত উত্তর দেওয়ার অধিকার আমার নেই। ভাবনাসূত্র হিসেবে একে গ্রন্থন করার কাজটুকুই আপাতত আমার কাজ।

আজকের কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে একে বিচার করতে গেলে অবশ্যই নাটককারকে অনেকাংশে দুর্বলও লাগে। কিন্তু মনে রাখতে হবে তিনি তাঁর সময়কালের একটি প্রচলিত কাহিনীকে যা ধর্মশাস্ত্রের রূপের দিকে ক্রমে এগিয়ে চলেছে তা ভাঙতেও দ্বিধা করছেন না। তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর রচনা। সেখানে শূর্পণখার নাক-কান কাটা জাতীয় কার্য বৈষ্ণব মানবপ্রেমের পরিপন্থীও। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে নারীর প্রতি হিংসার এই স্থুল চিহ্নকে লক্ষ্মণের চরিত্রে আরোপে তাঁর আপত্তি নিঃশব্দে জানিয়ে দিয়েছেন ঘটনাটিকেই না রেখে। লক্ষ্মণ ক্রোধী। তাই দশরথের আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে রামকে বলছেন রাজার মূর্ছা সহ্য না হলে ধনুক ধর, দয়া কর না। স্বজনদের প্রতি ক্ষমাশীল ও স্বভাবকোমলেরা এভাবেই লাঞ্ছিত হয় বলছেন।

কিন্তু সে ক্রোধ তাঁর ন্যায়বোধ থেকে জন্মাচ্ছে। জ্যেষ্ঠ বলে রামের যা তৎকালে স্বীকৃত ন্যায্যপ্রাপ্তি তার বঞ্চনায় জন্মাচ্ছে। সেই ক্রোধ এবং নারীর প্রতি নাক-কান কাটার হিংসার প্রকাশ এক সমতলে থাকতে পারে না। নাটককার অন্তত তা মনে করছেন বলেই এই ভিন্ন পাঠ। দয়াশীলতা, ক্ষমাশীলতা, সংবেদনশীলতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য নীতির নির্দেশে চালনা এ সকল নানা আদর্শকে তিনি ঘটনাপ্রবাহ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। পুরুষতন্ত্র, ক্ষমতাতন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পরিসরের মধ্যে থেকে তাঁর সাধ্য যে অবধি তাঁকে নিয়ে গিয়েছে সেই অবধিই তিনি চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই সে চেষ্টার সঙ্গে সমঝোতা করেননি। তাই তাঁর প্রচলিত পাঠ ভাঙা এবং পুনর্নির্মাণ প্রচেষ্টা। এবং এই যে কালের সংস্কৃতিকে পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা ও অদম্য সাহস এইজন্য তাঁর সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য।

Facebook Comments

Leave a Reply