‘তাদের’ স্বাধীনতা নিয়ে কি আমরা সত্যি বিচলিত? : সৌম্যদীপ চ্যাটার্জী

স্বাধীনতার ৭৫ বছর! শুনলেই গায়ে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে বলুন! কত সংগ্রাম, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, হাজার হাজার মানুষের নিঃস্বার্থ বলিদান, বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষার ফল যে জলে যায়নি, তার প্রমাণ আমি-আপনি বা বলতে পারেন, আমরা সকলে। আমরা তো ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে, অফিস, কাজ, বন্ধুত্ব, প্রেম আর গত দুইবছর ধরে আমাদের নিত্যসঙ্গী করোনা, সে তো আমাদের রোজ-নামচা। । সামনে বাঙালির শ্রেষ্ঠ ‘ফেস্টিভাল’, দুর্গা পুজো। আসতে কমবেশি পঞ্চাশ দিন বলতে পারেন, তাই না! আসুন, আজ এক অন্য গল্প শোনাই। অনেক না বলা কথার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমাদের এই গল্প।

ছোট্ট মণ্ডপ। সুন্দর একটা দুর্গা প্রতিমা। মণ্ডপের ভিতর দুইপাশ মিলিয়ে গোটা তিনেক ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছে। পাড়ার কচিকাচারা সেই সকালবেলা একবার এসেছিল, তারপর আবার তারা রাতে ঠাকুর দেখে বাড়ি ঢুকে যাবে। পাড়ার বয়স্ক মানুষদের ঘরের ভিতর থেকেই এবারের পুজো কাটবে। পুরো পাড়াটা জঞ্জাল মুক্ত। ঝাঁ চকচকে বলতে যা বোঝায়। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় পুরো এলাকা স্যানিটাইজ হচ্ছে আর তার তত্ত্বাবধানে পুজো কমিটির সদস্য-সদস্যরা। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাদের ‘ডিউটি’। দূর থেকে পুরো পাড়াটা দেখলে মনে হবে, যেন পুরোটাই প্যান্ড্যাল। আসলে তা নয়। গোটা পাড়া জুড়ে যত বাড়ি আছে, প্রতিটা বাড়ির দেওয়ালে এতো সুন্দর করে আঁকা, আর রাস্তার উপর এতো প্রফেসানালি আলপনা দেওয়া হয়েছে, যেন গোটা পাড়াটাই একটা ‘থিম’-এ পরিণত হয়েছে। প্রতি দশ মিটার অন্তর অন্তর বক্স লাগানো। তাতে কে না নেই, হেমন্ত, সন্ধ্যা, দ্বিজেন, মান্না, কিশোর…উপরে তাকালে প্যান্ডেলের ছাউনি নয়, পুরোটাই খোলা আকাশ। শুধু মাত্র মা দুর্গার মাথার উপর একটা শক্তপোক্ত চাঁদোয়া। আকাশ থেকে পানি নামলে, প্রতিমা যাতে ভিজে না যায়, তার জন্যই এই পরিকল্পনা। সূর্য ডুবলেই, সুন্দর একটা অডিও-ভিসুয়্যাল চলছে ঠিক মণ্ডপে ঢোকার আগে। ষষ্ঠী থেকে নবমী কমিটির মেম্বাররা সকাল থেকে শিডিউল করেছেন, যৌন কর্মীদের ছেলেমেয়েদের সাথে শহরের নামীদামী স্কুলের মাস্টারমশাই, দিদিমণি আর প্রিন্সিপালদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, যাতে তারা মেধা অনুযায়ী সেই সমস্ত স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, সরকার থেকে স্কুল খোলার নোটিশ জারি হলেই। আমার-আপনার ছেলে মেয়েরা যেমন বড় স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়, তেমন ভাবেই তো ‘ওদের’ ছেলেপুলেরাও অন্ধকার ঘরে খুপরি কোণে বসে স্বপ্ন দেখে, তারাও ভোরবেলা উঠে স্কুলে যাচ্ছে, স্কুলের বাস হর্ন দিচ্ছে আর চটপট ‘রেডি’ হয়ে বেরিয়ে পড়ছে। আপনার-আমার ছেলেমেয়েদের মত তারাও তো নামজাদা স্কুলে পড়তে চায়, জীবনের অন্ধকার দিকটা ফেলে রেখে আলোর সুখ তো তারাও পেতে চায়। এইসব কথাই বিগত কয়েকমাস ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল পাড়ার ছেলেপুলেদের মাথায়, তাই হঠাৎই একদিন এলাকার M.L.A-এর কাছে প্রস্তাবটা রাখে আর চট করে রাজিও করিয়ে নেয়। সবাই মিলেমিশে শেষ অবধি এবারের বেশিরভাগ বাজেট ধার্য হয়, এইসব কাজের জন্য। এবছর তো আর পাঁচটা বছরের মত নয়, করোনা অতিমারির আবহে এইবারও পুজোতে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। হাতে স্যানিটাইজার আর মুখে মাস্ক। একজনের সাথে আর একজনের দূরত্ব-মেনে চলাটা, এক কঠোর নিয়মপালন করতে হচ্ছেই প্রতিপদে। বাইরের দর্শনার্থী খুব কম, কারণ শুধুমাত্র চেনা-পরিচিত গণ্ডির বাইরে কাউকে কার্ডই দেওয়া হয়নি এবারে। আর পুরো সাজসজ্জা আর পুজো, লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে পাড়ার বাইরে, জায়েন্ট স্ক্রিনে, যাতে বাইরের দর্শকরাও ভার্চুয়ালি দেখতে পারেন। পল্লির মানুষজন এবার পাড়ার বাইরে বেরোচ্ছেন না বললেই চলে। রান্নার ঠাকুর রান্না করছেন আর বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে দুপুর-রাতের খাবার। যেখানে যৌন-কর্মীর ছেলে মেয়েদের জন্য অনুষ্ঠান করা হয়েছে, সেখানে এক সুবিশাল মঞ্চ বানানো, যাতে ‘Social Distancing’ মেনে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করা যায়। একটা ভলভো বাস ভাড়া নেওয়া হয়েছে আর তাদের যাতায়াতের জন্য আর সাথে এলাহি লাঞ্চ । তাদের মায়েদের জন্যও পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে খাবারদাবার। ষষ্ঠী থেকে নবমীর অনুষ্ঠানের পর, বিজয়া দশমীর দিন সুষ্ঠু ভাবে বিসর্জন। আশা, পরের বছর পুজোতে সবাই আবার আগের মতই হইহুল্লর করতে পারবে, আবার হবে লোকসমাগম, কে হবে প্রথম, তার লড়াই।

ঘুম ভাঙল তপেশের। মায়ের উপর চট করে রেগে গিয়ে সে বলে উঠল, “স্বপ্নটা ভেঙে দিলে তো ?” বড্ড রাত করে ঘুমিয়েছে তপেশ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েগিয়েছিল আর সাথে এক অলীক স্বপ্নে বিভোর তপেশ ভাবছিল, যদি সত্যিই এমনটা হতো! কথিত আছে, বারবনিতা পল্লির মাটি ছাড়া দুর্গা পুজো হয় না। আর সেই সব মানুষদের ছেলেমেয়রা যদি সত্যিই অত্যাধুনিক মানের স্কুলে পড়ার সুযোগ পেত কতটা নাই ভালো হত বলুন তো? “ছোটবেলায় আমার নিজের জ্যেঠু আমাকে পাড়ার এক দাদার হাতে বেচে দেয়। তখন বয়স কত হবে আমার? এই ধরুন মেরেকেটে ১৪ বছর! আমার বয়সী গ্রামের সব মেয়েরা যখন হেসেখেলে স্কুলে যাচ্ছিল, আমার আস্তানা হয় সোনাগাছির এই এঁদো গলির এক খুপরি ঘরে। বাবুরা তো আসে, আর ‘ভোগ’ করে আমাকে। আমার মেয়েটা বড় হচ্ছে। বাবুরা তো একদম সুবিধার নয়, ওনাদের দৃষ্টি খুব খারাপ। এখন মনে হয় নজর যাচ্ছে আমার মেয়ের দিকে। এখানে থাকলে আমার মেয়েটাকেও আমার মত ‘পথ’ বেছে নিতে হবে। আর কিই বা উপায় আছে বলুন তো ! আমার সব স্বপ্ন আমার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটাকে ভালোভাবে মানুষ করতে চাই, অনেক বড় স্কুলে পড়াতে চাই, যাতে বড় হয়ে আমার মত ‘কাজ’ না করতে হয়। সমাজের চোখে যেন ‘বেশ্যার মেয়ে’ হিসাবে পরিচয় না পেয়ে, নিজের পরিচয় নিজেই তৈরি করতে পারে।”, কথাগুলি বলতে বলতে হতাশায় চোখ ভিজে যায় শ্যামলীর (নাম পরিবর্তিত)। এরকম কতই না অজানা কাহিনী লুকিয়ে আছে, ঠোঁটে লিপস্টিক, ধপধপে সাদা গাল, আর শরীরের বেশীরভাগ অংশ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লালবাতি এলাকার মেয়েদের হারিয়ে যাওয়া জীবনের অন্দরমহলে। কজনই বা খোঁজ রাখে বলুন তো তাদের? ‘ভোগ’ করা হয়ে গেলেই, টাকা দিয়ে সটান বাড়ি। টাকার জন্য দিনরাত ‘খেটে’ চলেছে অজস্র যৌনকর্মী। বাবুদের সাথে তাদের সম্পর্ক ঠিক একটা ক্রেতা আর বিক্রেতার মত। ঘণ্টার হিসাবে টাকা। আবার কোথাও কোথাও ‘শট’ হিসাবে। “আমাদের উদ্দেশ্য Second Generation Prostitution বন্ধ করানো। মানে, আজ যারা যৌনকর্মী, তাদের ছেলেমেয়েরা যেন আর এই পেশায় না আসে। তারা যেন বাঁচতে পারে ঠিক আমার-আপনার মত। সঠিক শিক্ষা আর সুষ্ঠু পরিকল্পনাই হতে পারে এই অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ। আর তার জন্য আমাদের সকলের মিলিতভাবে কাজ করা উচিত।” সংলাপ নামক এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান পিনাকী রঞ্জন সিনহা-এর কথায় উঠে এলো এই সমস্ত ভাবনা। তাহলে, তপেশের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটা কি বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারি না কি আমরা? আসুন না নিজেদের গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসি এবার। এই তো সুবর্ণ সময়, যেখানে অনেকটা সময় আমরা বাড়িতে থাকতে পারছি, Work From Home-এর চক্করে। সমাজ তো শুধু আমি বা আপনি নই, শ্যামলী, টুম্পা বা রুনার মত মেয়েরাও আছে সেখানে। আমার-আপনার স্বপ্নের মতন, তাদের স্বপ্নটাও তো স্বপ্ন, সেটা আর ফেলে না দিয়ে, এবার না হয় তাদের জন্যও কিছু করি। তপেশের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটা বাস্তবে পরিণত করি। আসুন, সবাই মিলে এইবার স্বাধীনতা দিবস পালন করার মাধ্যমে, একটা সুষ্ঠু সমাজ গড়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই। ভেঙে ফেলি সমস্ত বেড়াজাল, গুড়িয়ে দিই সমস্ত দম্ভ, অহংকার। এবার না হয়, আমার-আপনার চিন্তা-ভাবনাটা হোক তাদের নিয়ে, নিজেদের গণ্ডি ভেঙে না হয় এবার বেরিয়ে আসুন। এবার না হয় তাদের নতুন জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য জন্য কিছু একটা করি। নিজেরা ভাবি, অন্যদেরকেও ভাবতে শেখাই। তাহলেই তো আমারা অন্যদের মধ্যে নিজেদের ভাবনার সূচনা দেখতে পাবো, দেখতে পাবো এক নতুন সমাজ, যেখানে আমার আপনার মত ‘ওদের’ কাছে স্বাধীনতার মানে কি তা উপলব্ধি হবে।

[লেখক – Development Communication পেশাজীবী।]

Facebook Comments

Leave a Reply