শংকরাচার্য্যের মায়াবাদ: ধারে কাটে কি ভারে! : রঞ্জন রায়

তৃতীয় পর্ব

 

আর একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

 

মজার ব্যাপার হল, রামানুজ দেখিয়েছেন যে ‘অবিদ্যা’-যার অস্তিত্ব আছে আবার নেই, মানে যা বাস্তবও নয়, অবাস্তবও নয়—এমন কোন সংজ্ঞা বেদে বা উপনিষদে কোথাও নেই। এটি শংকরাচার্য্যের সৃষ্টি যাতে তাঁর মায়াবাদের মডেলটি দাঁড়ায়।[৫]
কিন্তু ‘মায়া’ শব্দটি আছে। মায়া অসত্য বা মিথ্যা নয়। মায়া হল বিস্ময়কর কিছু সৃষ্টি করার শক্তি। সৃষ্টিশীল প্রকৃতিকেই মায়া বলে সম্বোধন করা হয়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছেন, ‘মায়াধারী ঈশ্বর মায়ার শক্তিতে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত জীব মায়ার বাঁধনে বদ্ধ’।[৬] স্পষ্টতঃ ‘মায়া’ ঈশ্বরের কোন ‘অভাব’ বা ‘বিকৃতি’ বা ‘অবিদ্যা’ নয় বরং জীব মায়ার অধীন। বৃহদারণ্যক বলছে “ঈশ্বর মায়ার শক্তিবলে এক থেকে বহু হলেন’। এখানে মায়া বলতে ঈশ্বরের বহুমাত্রিক শক্তির কথা বলা হয়েছে।
তাহলে শংকর যুক্তিতর্কের বদলে সর্বোচ্চ প্রমাণ বলে যে বেদ-উপনিষদের দোহাই দিচ্ছেন সেখানেও নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের সমর্থন নেই। বরং এই বিশ্বব্রহ্মান্ডকে ঘোর বাস্তব বলেই বর্ণনা করা হয়েছে।

 

মায়াবাদের যুক্তিপরম্পরাঃ দুই সত্যঃ শাস্ত্র সর্বোচ্চ প্রমাণ

 

শংকরের দর্শনের যুক্তিপরপম্পরার বিচার করতে বসলে খেয়াল রাখা দরকার উনি প্রথমেই ন্যায়শাস্ত্রের যে কাঠামো, প্রত্যক্ষ (perception)-অনুমান (inference)-প্রমাণ(proof) তাকে খারিজ করে শাস্ত্রবচনকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
উনি জানেন যে প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা বাইরের জগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ে সংযোগে প্রাপ্ত সংবেদন (perception) হল শ্রেষ্ঠ প্রমাণ, কারণ এটাই অনুমানের (inference) তথা সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এবং শাস্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুভবের বিরোধ হলে প্রত্যক্ষকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। কিন্তু উনি মনে করেন বেদ আদি শ্রুতি এবং মনু আদি স্মৃতিশাস্ত্র হল এই নিয়মের ব্যতিক্রম। কারণ ওরা অপৌরুষেয়, স্বতঃপ্রকাশ, এবং নিজেরাই স্বতন্ত্র জ্ঞানের উৎস। যদিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ব্যাখ্যায় ন্যায়শাস্ত্রের প্রত্যক্ষ অনুভব সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে শ্রুতি ও স্মৃতিকে বেশি মানতে হবে।[৭] এর পরে উনি ব্রহ্মসূত্রের মূল ভাষ্যে বলছেন শাস্ত্রবচনকেই মেনে নেওয়া উচিত, তর্কবিচারকে নয়। কারণ তার্কিকরা নিজেরাই যে সহমত নন। এমনকি কপিল,[৮] কণাদের[৯] মত দার্শনিকরাও সত্যের স্বরূপ নিয়ে সহমত হননি। কাজেই যুক্তি যত ভালই হোক, তা’ যদি শাস্ত্রবচনকেই খন্ডন করে তখন শাস্ত্রকেই মানতে হবে। কারণ ব্রহ্মকে বুঝতে হলে শাস্ত্রই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ।[১০]

কিন্তু এখানেই শংকরের মুশকিল শুরু। ওঁর যুক্তি ওঁরই বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে বেদ ও স্মৃতির অনেক শ্লোক পরস্পরবিরোধাভাসী এবং তার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদে অনেক দার্শনিক স্কুল গজিয়ে উঠেছে। এমনকি একই ব্রহ্মসূত্র এবং তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক আদি উপনিষদে আস্থাশীল দার্শনিকেরাও নিরাকার ব্রহ্মের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন না। মহাভারতের বনপর্বে বকরূপ ধর্মের কঃ পন্থা প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন-“বেদাঃ বিভিন্নাঃ, স্মৃতয়োর্বিভিন্না, নাসৌমুনির্যস্য মতংনভিন্নম”। এককথায় নানা মুনির নানা মত।এছাড়া বিরুদ্ধবাদীরা এই প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন—যদি কিছু যুক্তি তোমার ভিত্তিহীন বলে মনে হয়, তার থেকে কী করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে ওই ধরণের সব যুক্তিই ভিত্তিহীন?
লক্ষণীয়, এখানে শঙ্করাচার্য্য নিজেও inductive generalisation এর logic ব্যবহার করছেন, যে logic তিনি আগে খারিজ করেছেন।
এভাবে যদি সমস্ত যুক্তিতর্ক ব্যাপারটাকেই (প্রত্যক্ষ থেকে অনুমান হয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়া) খারিজ করে দেয়া হয় তাহলে বাস্তব মানবজীবন থমকে দাঁড়াবে। কারণ মানুষ পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই জীবনে কোন পদক্ষেপ নেয়। তার উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যত জীবনে দুঃখের থেকে মুক্তি এবং আনন্দ পাওয়া।
আর এটা কোন যুক্তি হল না যে বড়ভাই যদি হাবা বা মূর্খ হয় তবে ছোটজনও তাই হবে।[১১]
এখানে লজিকের বিরুদ্ধে শংকরের যুক্তিটি এরকম :
কিছু যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত ভুল এবং নির্ভরযোগ্য নয়।
মায়াবাদ খন্ডনও একটি যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
অতএব, মায়াবাদ খন্ডনের যুক্তিটি নির্ভরযোগ্য নয়।
এভাবে যুক্তিতর্কের জায়গায় শ্রুতি ও স্মৃতিকে অন্তিম প্রমাণ বললেও শংকরকে রামানুজের সগুণ ব্রহ্ম এবং সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈনমত খন্ডনের জন্যে তর্কযুদ্ধে নামতে হয়েছে। কারণ, উনি বিশেষ একটি দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠা করতে চান। ব্রহ্মসূত্রের শাংকরভাষ্যের দ্বিতীয়ভাগের পুরোটাই অন্যমত খন্ডনে নিযোজিত।
সেখানেও শংকর প্রতিপক্ষের যুক্তিতে কোণঠাসা হলেই শাস্ত্রবিরোধী তর্ক স্বীকৃত নয় বলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। এ যেন আদালতে প্রমাণ করতে না পারলে কাউকে দেশদ্রোহী বলে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আইনে জেলে পুরে দেয়া। অনেকেরই মনে পড়বে জনকসভায় গার্গীর প্রশ্নের উত্তর দিতে অসমর্থ হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের ধমক- অধিক প্রশ্ন করলে মাথা খসে পড়বে![১২]
স্থানাভাবে মাত্র একটি উদাহরণ দিচ্ছি: বিরোধীপক্ষ বলছেন- ব্রহ্মকে সৃষ্টির আদি বা উপাদান কারণ বললে মানতে হয় যে

ক) সমগ্র ব্রহ্ম সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাহলে আর ব্রহ্ম রইল কোথায়? কেবল সৃষ্টিই রইল। কিন্তু শ্রুতি অনুযায়ী ব্রহ্ম তো অবিনশ্বর, তাহলে?

খ) যদি বলা হয় গোটা ব্রহ্ম নয়, তার অংশমাত্র সৃষ্টিতে রূপান্তরিত, কাজেই বাকি অংশ তো বেঁচে রইল,(ছান্দোগ্য,৩.১২.৬)।
তাহলে মানতে হয় ব্রহ্ম অনেকগুলো টুকরো বা খন্ড দিয়ে তৈরি। কিন্তু শ্রুতি তো ব্রহ্মকে অখন্ডমন্ডলাকার বলে, তাহলে শাস্ত্রও পরস্পরবিরোধী কথা বলে? এ তো অযৌক্তিক।

তখন শংকর যুক্তি ছেড়ে সোজাসুজি বলেন, মানছি কিন্তু এ’ব্যাপারে শাস্ত্রে বলা আছে ব্রহ্মই সৃষ্টির আদিকারণ, ব্যস।[১৩]
শেষে শংকর পেশ করেন দুই সত্যের তত্ত্ব- ব্যবহারিক সত্য ও পারমার্থিক সত্য। একটা আপেক্ষিক(relative),অন্যটি পরম(absolute)। উনি আরও বলেন যে প্রচলিত ন্যায়পদ্ধতি শুধু দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সত্যের বেলায় খাটে। পারমার্থিক সত্য বা ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে কেবল শ্রুতি এবং স্মৃতিশাস্ত্রই প্রমাণ।

রামানুজ দুই সত্যের তত্ত্ব মানেন না। ওঁর বক্তব্য হল দুটো পরস্পরবিরোধী জিনিস একসঙ্গে সত্য হতে পারে না এবং সেক্ষেত্রে শাস্ত্রবাক্যের চেয়ে প্রত্যক্ষ অনুভব উত্তম প্রমাণ।[১৪]

 

[ক্রমশ…]

_____________________________________________________________________
তথ্যসূত্রঃ-

[৫] ব্রহ্মসূত্রের শ্লোক ১.১.১ এর শ্রীভাষ্যে (রামানুজ)আপত্তি। ব্রহ্মসূত্র, অদ্বৈত আশ্রম এডিশন, স্বামী বীরেশ্বরানন্দ সম্পাদিত; পৃ -৭২।
[৬] শ্বেতাশ্বতর, IV,9.
[৭] ঐ , অধ্যাস, পৃঃ ৭।
[৮] কপিলঃ সবচেয়ে প্রাচীন দার্শনিক মত সাংখ্যের প্রণেতা
[৯] কণাদঃ প্রাচীন আণবিক দর্শন বা বৈশেষিক সূত্রের প্রণেতা।
[১০] ব্রহ্মসূত্র; শাংকরভাষ্য, অদ্বৈত আশ্রম সংস্করণ, শ্লোক ২.২.১১।
[১১] দেবীপ্রসাদ, ‘হোয়াট ইজ লিভিং অ্যান্ড হোয়াট ইজ ডেড ইন ইন্ডিয়ান ফিলজফি”, পৃঃ ২০৪।
[১২] বৃহদারণ্যক উপনিষদ; ৩.৬.৯।
[১৩] ব্রহ্মসূত্র, শাংকরভাষ্য, শ্লোকঃ ২.১.২৬ এবং ২.১.২
[১৪] ব্রহ্মসূত্র, শ্রীভাষ্য, দ্বিতীয় সংস্করণ,শ্রীবলরাম ধর্মসোপান, খড়দহ; পৃঃ ৩৮।
____________________________________________________________________
[লেখক – জন্ম কোলকাতায়; গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিসূত্রে ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে-গঞ্জে বনেবাদাড়ে কয়েক দশক ধরে ঘুরে বেড়ানো। অবসর জীবন কাটে বই পড়ে, লেখালিখি করে।
প্রকাশিত বই: বাঙাল জীবনের চালচিত্র (গাঙচিল); রমণীয় দ্রোহকাল (লিরিক্যাল); দেকার্তঃ জীবন ও দর্শন (অনুষ্টুপ); যে আঁধার আলোর অধিক (সৃষ্টিসুখ); ফেরারী ফৌজ (ঋতবাক); ছত্তিশগড়ের রূপকথা (ঋতবাক); শহুরে ছত্তিশগড়ের গল্পগুচ্ছ (ঋতবাক); ছত্তিশগড়ের চালচিত্র (সুন্দরবন প্রকাশন); আহিরণ নদী সব জানে (জয়ঢাক প্রকাশন); তিনটি রহস্য গল্প (জয়ঢাক প্রকাশন)।]

Facebook Comments

Leave a Reply