UAPA, নাগরিক-নিপীড়ন ও সংসদীয় দলগুলি : প্রবুদ্ধ ঘোষ
শোষিত জনগণের যেমন ইতিহাস থাকে, তেমনই শোষকেরও ইতিহাস থাকে। শাসিতর সংগ্রামের ইতিহাসের বিপ্রতীপে থাকে শাসকের আধিপত্যমূলক দমননীতির ইতিহাস। নিপীড়িতের মুক্তির প্রতিস্পর্ধাকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে নিপীড়ক বিভিন্ন আইন-বিচার-আদালতের সাহায্য নেয়। মেহনতি মানুষ তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনার অধিকারে যত আন্দোলন করেছে, সেই সবকিছুর ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে রাষ্ট্র নাগরিকদের চেতনাকে সন্ত্রস্ত ক’রে রাখে। ইউএপিএ রাষ্ট্রের জন্যে খুব প্রয়োজনীয় একটা আইন, যাতে নাগরিকদের সব প্রশ্নগুলোকে পিষে দেওয়া যায় এবং রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা এঁটে নাগরিকদের মন ও মগজের ওপর দখলদারি করা যায়। ইউএপিএ স্বাধীনচেতা অদম্য জনগণের কাছে ঘৃণার্হ একটা কানুন এবং দ্রোহী জনতা এর বিরুদ্ধে সরব থাকবেই। ইউএপিএ, আফস্পা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা- সব আইনেরই ইতিহাস আছে এবং একটা সাধারণ বিষয় আছে এগুলির মধ্যে- রাষ্ট্র ও নাগরিক অধিকারের মধ্যে অনপনেয় দূরত্ব নির্মাণ করে এগুলি। দেশ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অধিকার শব্দগুলি অস্পষ্ট হতে শুরু করে তখন
#
ইউএপিএ-র ইতিহাস ও রাষ্ট্রের মতাদর্শ
১৯৬৭ থেকে ২০০৪ অবধি ইউএপিএ ‘সন্ত্রাসদমনমূলক আইন’ ছিল না। ভারতের প্রথম সন্ত্রাসদমন আইন প্রণীত হয় ১৯৮৭ সালে, টাডা আইন। রাজীব গান্ধী এই আইন সংসদে পাশ করান। কিন্তু, ১৯৯৩ সালে বম্বে বিস্ফোরণের পরে টাডা আইনের যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ নিয়ে সরব হয় মানবাধিকার সংগঠনগুলি। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত টাডা আইনে মোট গ্রেপ্তারির সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৪ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৩৫% মামলার বিচার হয়েছিল এবং ২ শতাংশেরও কম অভিযুক্ত অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিল। ২০০২ সালে এনডিএ সরকার টাডা আইন তুলে দিয়ে পোটা আইন প্রণয়ন করে। পোটা বিল রাজ্যসভার ভোটাভুটিতে প্রত্যাখ্যাত হলেও যৌথ সেশনে পাশ হয়ে যায়। কিন্তু এই আইনের বিরুদ্ধেও যথেচ্ছ অপব্যবহারের অভিযোগ উঠতে থাকে; বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতাদের এবং জাতিসত্তার আন্দোলনের সমর্থনকারীদের ওপরে অনৈতিকভাবে এই আইন প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় এসে পোটা বাতিল করে। উল্লেখ্য, ইউপিএ সরকারের নির্বাচনী ইস্তেহারে পোটা বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এরপরেই ইউএপিএ (সংশোধনী) আইন পুনঃপ্রণয়ন করে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ‘প্রগতিশীল’ ইউপিএ জোট! কিন্তু, সন্ত্রাসদমন করতে গিয়ে ইউএপিএ হয়ে নিজেই উঠল সন্ত্রাসের দ্যোতক এবং ইউএপিএ প্রয়োগকারীরা সচেতনভাবে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিল নাগরিকদের মধ্যে। এই আইনবলে বিনা চার্জশিটে ছ’মাস অবধি অভিযুক্তকে বন্দী রাখা যাবে। এই আইনে জামিনের সমস্ত পথ বন্ধ এবং পুলিশের জমা দেওয়া নথিপত্রের ওপরেই আদালত নির্ভর করতে বাধ্য। দিল্লিতে পিঁজড়াতোড় দলের সদস্য এবং জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রছাত্রীসহ মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারা চাপিয়ে দেওয়ার পরে ১৭,৫০০ পাতার চার্জশিট জমা দেয় দিল্লি পুলিশ। ২০১৮ সাল থেকে এলগার পরিষদ মামলায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁরা কার্যত বিনাবিচারে জেলবন্দী এখনও। ইউএপিএ-র ধার্য ছ’মাস সময় বহু আগে পেরিয়ে গেছে, কিন্তু পুলিশ মামলা সাজাতে পারেনি বলে আদালতও পুলিশকে অনন্ত সময় দিয়ে যাচ্ছে; স্ট্যান স্বামী ইতিমধ্যেই মারা গেছেন, ভারভারা রাও মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচেছেন কয়েক মাস আগে এবং বাকি বয়স্ক বন্দীদের শারীরিক অবস্থাও উদ্বেগজনক। এঁরা প্রত্যেকে ইউএপিএ-তে আটক। দিল্লির ঘটনায় বা ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় আশ্চর্য এটাই যে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সন্ত্রাসী ভূমিকার প্রতি রাষ্ট্র নীরব। দলিত, সংখ্যালঘু এবং সমাজকর্মীদের ওপরে প্রতিহিংসামূলক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র। সংশোধিত ও অতি-হিংসাত্মক ক’রে ইউএপিএ আইনের পুনঃপ্রচলনের সময়, ২০০৮ সালের ১৫ই ডিসেম্বর সংসদে মাত্র ১ দিনের বিতর্ক (?) ও ভোটাভুটিতে পাশ হয়ে যায় দু’টি বিল- আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট ১৯৬৭ এবং ন্যাশন্যাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি অ্যাক্ট (NIAA); নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতিগুলোর পর্যবেক্ষণ ছাড়া কিংবা এই বিলের ভাল-মন্দের অবকাশ ভারতীয় জনগণের কাছে বিশ্লেষণের আগে সংসদীয় দলগুলির ষড়যন্ত্রে পাশ হয়ে যায় বিলটি এবং আইনে পরিণত হয়। যে টাডা বা পোটা নিয়ে সাংবিধানিক স্তরে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বহু সমালোচনা চলেছিল, সেই টাডা ও পোটার বেশ কিছু মানবাধিকার বিরোধী শর্ত ইউএপিএ-তে ঢুকিয়ে নেওয়া হল। সামনে রাখা হল সন্ত্রাসবাদ দমনের উদ্দেশ্য, কিন্তু প্রত্যেকটি সংসদীয় দলেরই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠল মাওবাদী কমিউনিস্টদের প্রতি প্রতিহিংসা মেটানো। সংখ্যালঘুদের অধিকার আন্দোলন কিংবা দলিতদের সোচ্চার প্রতিবাদে কিংবা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের দাবিগুলিতেও ‘মাওবাদী’ ভূত দেখতে শুরু করল রাষ্ট্র (কেন্দ্র ও সবকটি রাজ্য সরকার)। ইউএপিএ ব্যবহার ক’রে প্রমাণহীন অভিযোগে আদিবাসীদের ওপরে ক্ষার মেটাতে লাগল সিআরপিএফ, কৃষকদের আন্দোলনে ইচ্ছেমতো ইউএপিএ প্রয়োগ করতে লাগল পুলিশ এবং ছাত্র-বুদ্ধিজীবীরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাদের ওপরেও যথেচ্ছ ইউএপিএ ধারা প্রয়োগ করা হতে লাগল। গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে শুরু করল এনআইএ। কারণ, এই কার্যক্রমগুলির সঙ্গে সংবিধানের বহু বিরোধ থাকলেও, ইউএপিএ রাষ্ট্রকে খুল্লমখুল্লা অনুমতি দিল নাগরিকদের সন্ত্রস্ত রাখার। আর, আরএসএসের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মুখোশ বিজেপির কাছে এই আইন হয়ে উঠল হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার। যা কিছু হিন্দুত্ববাদী খাপে আঁটে না, তাকেই ‘বেআইনি’ বলে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যারাই ব্রাহ্মণ্যবাদী-পিতৃতান্ত্রিক ধ্বজাকে প্রশ্ন করে, তাদেরই শায়েস্তা করার ব্যবস্থা বাড়ছে। দেশের আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উন্নত দিশায় বদল করতে চেয়ে এবং জনগণের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে চেয়ে রাষ্ট্রকে যারাই প্রশ্ন করছে, তাদের হাতে ও ভাতে দু’ভাবেই মারার ব্যবস্থা পাকা করেছে শাসক। আর, ইউএপিএ এই সবকিছুকেই আইনি ন্যায্যতা দিয়েছে। যেহেতু প্রমাণ-নথির সব নিয়ন্ত্রণই পুলিশের হাতে, তাই অভিযুক্তের কম্পিউটারে ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য ভরে দিচ্ছে তারা; তথ্য বিকৃত ক’রে কিংবা ভুয়ো তথ্য সাজিয়ে সাজিয়ে কাল্পনিক অপরাধ-তালিকা তৈরি ক’রে দিচ্ছে প্রতিবাদীর নামে কারণ এইসব আইনে অভিযুক্তের বিচার হতে হতে বহুযুগ পেরিয়ে যাবে, তা তারা জানে।
ইউএপিএ প্রয়োগ নিয়ে যে প্রশ্নগুলি উঠছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের অনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন। ২০০৫ সালে জাতিপুঞ্জ প্রদত্ত সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞার সঙ্গে ইউএপিএ (২০০৮) প্রদত্ত সংজ্ঞার অনেক ফারাক। এই সংজ্ঞাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদকেও এর আওতায় ঢুকিয়ে ফেলা যায়; যে কোনও প্রাদেশিক বা ধর্মীয় বা জাতিগত বিক্ষোভকেও ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে দেগে দেওয়া যেতে পারে। ইউএপিএ আইন মোতাবেক ভারতরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে কেউ প্রশ্ন করলে কিংবা ভারতরাষ্ট্রের প্রতি কেউ ‘ডিসঅ্যাফেকশন’ প্রদর্শন করলে সেটাও এই ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ; আর, এই ‘অপরাধ’-এর সঙ্গে দূরদূরান্তে ক্ষীণভাবে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন জড়িয়ে আছে এমত সন্দেহেই রাষ্ট্র তার/তাদের ওপরে ইউএপিএ প্রয়োগ করতে পারে। এই ধারায় অভিযুক্তের বিচারপদ্ধতি নাগরিকদের স্বাভাবিক মানবাধিকারগুলি নস্যাৎ করে। শাসককে অধিকার দেওয়া হয়েছে যথেচ্ছ গ্রেপ্তারির, যথেচ্ছ ধরপাকড়ের এবং বাজেয়াপ্ত তালিকায় ‘আপত্তিকর বস্তু’ বলে যা-খুশি অন্তর্ভুক্ত করার। এনআইএএ এবং ইউএপিএ এনআইএ-কে সীমাহীন অধিকার দিয়েছে, তাতে ব্যক্তি- স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা খর্ব হতে পারে প্রতিমুহূর্তে। গ্রেপ্তার ও বিচারপদ্ধতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিটির অনেক শর্তই লঙ্ঘন হয় এই আইনে।
#
ইউএপিএ আইন ১৯৬৭ সালের। তারপর রাষ্ট্রের বজ্রমুঠি অটুট রাখতে সংশোধিত হয়েছে বেশ কয়েকবার- ২০০৪, ২০০৮, ২০১২, ২০১৯। রাষ্ট্র যা কিছু নিজের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করে, তাকে আইন-পেয়াদা দিয়ে বেঁধে ফেলে। আর, আধুনিক রাষ্ট্র অজুহাত হিসেবে খাড়া করে ‘সন্ত্রাসবাদ’। সন্ত্রাসবাদ শব্দটা জনমানসে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেকগুলি বাইনারি তৈরি ক’রে ফেলা যায় বা বজায় রাখা যায়। রাষ্ট্রীয় পদ্ধতির গর্ত-উপগর্ত-খুঁতগুলো ঢেকে রাখা যায়। এই পদ্ধতিতেই রাষ্ট্র নিষিদ্ধ-তালিকা তৈরি ক’রে দেয় ব্যক্তি ও সংগঠনের নামে। নাগরিকদের থেকে বাধ্যতামূলক সম্মতি আদায় ক’রে নেয়, যেন নাগরিকদের সুরক্ষাভারে ভাবিত হয়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের মঙ্গলাকাঙ্খায় এমন তালিকা এমন সব বজ্রআঁটুনি আইন তৈরি করছে। আদতে নাগরিকদের তথা নিপীড়িত জনগণের সুরক্ষা-মঙ্গল নিয়ে নয়, রাষ্ট্র চিন্তিত থাকে উপরশ্রেণির মুষ্টিমেয় কিছুজনের আর্থ-রাজনৈতিক সুরক্ষা নিয়ে। এই দেশের রাষ্ট্র ব্যস্ত থাকে আধিপত্যমূলক ধর্ম ও নিপীড়ক বর্ণব্যবস্থাকে সুরক্ষা দেওয়ায়। ভারতরাষ্ট্র যে ৪১টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি তিনটি। সিপিআই (এম-এল) পিপলস ওয়র, মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার এবং সিপিআই (মাওবাদী); প্রথম দু’টি কমিউনিস্ট পার্টি ২০০৪ সালে সংযুক্ত হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) গঠন করে। উপরোক্ত ৪১টি সংগঠনের মধ্যে প্রায় সবকটিই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন (যার সিংহভাগ ইসলামে বিশ্বাসী) এবং জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রাদেশিক সংগঠন। বাকি তিনটি কমিউনিস্ট পার্টি, যারা কৃষিবিপ্লবকে অক্ষ ক’রে শ্রমিকশ্রেণির অগ্রবর্তী বাহিনীর সক্রিয়তার দ্বারা নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে চায়। আর, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদী ধর্মীয় সংগঠনও নয় কিংবা প্রাদেশিক দাবিভিত্তিক সংগঠনও নয় (তাদের নিজস্ব প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে ধর্মপ্রসঙ্গে ও জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে; এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকটাই আলাদা)। নিষিদ্ধ-তালিকা বা ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর প্রকৃত সংজ্ঞায়ন খোঁজার পরিসর এই লেখায় নেই। ধর্ম ও জাতিসত্তার প্রসঙ্গও এই লেখায় অবান্তর। কিন্তু, এটুকু বোধহয় বোঝা সহজ যে, কমিউনিস্ট পার্টি ধর্ম নিয়ে ব্যবসা ফাঁদে না, প্রাদেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না; কমিউনিস্ট পার্টি মানুষের মৌলিক অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়, মেহনতি মানুষের মেহনতের ন্যায্য প্রাপ্য নিয়ে সরব হয় এবং সমানাধিকারের উন্নত সমাজব্যবস্থার লক্ষ্যে অনুশীলন ক’রে চলে। যে কোনও শোষক রাষ্ট্রের কাছে কমিউনিস্ট পার্টি ‘বিপজ্জনক’। আর, ভারতবর্ষের মতো আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব রাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন ক’রে রাখে। তাই বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদী সংগঠনগুলির হিংসাপ্রকাশ, দাঙ্গা-উস্কানি, অর্থনৈতিক জালিয়াতি নিয়ে রাষ্ট্র যত না ভাবিত, তার থেকে অনেক বেশি চিন্তিত কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-কৌশল নিয়ে। কমিউনিস্ট পার্টি কতজনকে মতাদর্শে প্রভাবিত করল, কমিউনিস্ট পার্টি কোন কোন স্থানে প্রতিরোধের নতুন দিশা দেখাল কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির গণসংগঠনগুলি শাসনের ভিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বিকল্প আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিসরকে কতটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারল- এইসব রাষ্ট্রশাসকদের কপালের ভাঁজ বাড়ায়। উপরোক্ত ৪১টি ‘নিষিদ্ধ’ সংগঠনের ওপরে, নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির ওপরে এবং তাদের সঙ্গে জড়িত কারোর ওপরেই কি শুধু তবে ইউএপিএ বলবৎ হবে? না! রাষ্ট্রের যাকেই মনে হবে সম্ভাব্য মাওবাদী এবং রাষ্ট্র যাকেই মনে করবে ভবিষ্যতের সন্ত্রাসবাদী, তার/তাদের যে কোনও সময় ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করবে। সাফুরা জারগার মাওবাদী নয়, কোনও মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলনা। পিঁজড়াতোড়ের পারফর্মাররা কোনও ‘নিষিদ্ধ’ সংগঠন করত না। উমর খলিদের বিরুদ্ধে ‘প্রমাণ’ কোথা থেকে পাওয়া গেছে তা নিয়ে আদালত-রিপাবলিক টিভি-মন্ত্রীর ট্যুইটের লুকোচুরি খেলা চলছে। ইউএপিএ-র প্রথম শহীদ স্বপন দাশগুপ্ত একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। স্ট্যান স্বামী একজন ক্যাথলিক পাদ্রি ছিলেন। সোমা সেন, জি এন সাইবাবারা অধ্যাপক শিক্ষাবিদ্। তবে, একটা মিল এঁদের সবার মধ্যে আছে- এঁরা দেশকে ভালবাসেন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন- সেইজন্যেই এঁরা ‘মাওবাদী’ তকমায় অভিযুক্ত।
২০১৯ সালে ইউএপিএ আইনে সারা দেশে ১৯৪৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং ১২২৬টি কেস দাখিল হয়েছিল। ২০১৮ সালে ১৪২১ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ও ১১৮২টি কেস দাখিল হয়েছিল। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৫৫৪ ও ৯০১। ২০১৬ সালে ৯৯৯ ও ৯২২ এবং ২০১৫ সালে ১১২৮ ও ৮৯৭। ২০১৪ সালে মোট ৯৭৬টি মামলা রুজু হয়েছিল ইউএপিএ ধারায়। ২০১৯ সালে সর্বাধিক সংখ্যক কেস দাখিল হয়েছিল মণিপুরে, ৩০৬টি। তামিলনাড়ু, জম্মু-কাশ্মীর ও ঝাড়খণ্ডে যথাক্রমে ২৭০, ২৫৫ ও ১০৫টি কেস। ২০১৯ সালে ইউএপিএ-তে সর্বাধিক সংখ্যক গ্রেপ্তার হয়েছিল উত্তর প্রদেশে, ৪৯৮ জন। মণিপুর, তামিলনাড়ু ও ঝাড়খণ্ডে যথাক্রমে ৩৮৬ জন, ৩০৮ জন ও ২০২ জন। ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত যতজন ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত/বন্দী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২% মানুষকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করা গেছে। আর, ২০১৯ সালে সারা দেশে যে ১৯৪৮ জনকে ইউএপিএ দিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল এনআইএ ও পুলিশ, তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনকে এখনও পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করতে পেরেছে রাষ্ট্র।
#
অ-বিজেপি সংসদীয় দলগুলির ভূমিকা
১৯৬৭ সালের পরে ইউএপিএ আইনের সংশোধন ও পুনর্প্রয়োগ শুরু হয় ২০০৮ সালে। মনে রাখা প্রয়োজন, তখন কেন্দ্রে ‘প্রগতিশীল’ ইউপিএ জোটের সরকার। অ-বিজেপি দলগুলি এবং বামফ্রন্ট ইউপিএ সরকারের জোটসঙ্গী ও নিয়মনীতি প্রয়োগের অংশীদার। ২০০৮ সালে যখন ইউএপিএ সংশোধন হয়ে আরও দানবীয় রূপে ফিরে আসছে, তখন সংসদে সব সংসদীয় দলই সমর্থন করেছিল; কারণ সন্ত্রাসবাদকে দমন করার ছলে মনমোহন সিং বিবৃত “the problem of naxalism is the single biggest internal security challenge ever faced by our country.” মেনে কমিউনিস্ট মাওবাদী পার্টিকে শায়েস্তা করার ইচ্ছে তাদের ছিলই! ২০০৯ সালে ইউএপিএ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে ইউএপিএ-র দাঁতনখ বেরোতে শুরু করে। ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইউএপিএ-২০০৮ প্রয়োগ হয় পশ্চিমবঙ্গে, বামফ্রন্ট সরকারের দ্বারা। ২০০৭/৮ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সরকারি অপশাসন, জবরদস্তি ভূমি অধিগ্রহণ, সেজ্-নীতি ও পরমাণু চুল্লী স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে বামফ্রন্ট তথা সিপিআই (এম)-র শাসনভিত্তি টলমল করতে শুরু করে। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে পুলিশি সন্ত্রাস, সিপিআই (এম) ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলা এবং বামফ্রন্টের শ্রমিক-কৃষক-বিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে লালগড় বিদ্রোহ দানা বাঁধলে সরকার আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। ‘জঙ্গলমহলের আদিবাসী=মাওবাদী’, ‘সেজবিরোধী/জমিঅধিগ্রহণ বিরোধী=মাওবাদী’ এবং ‘আদিবাসীদের দ্রোহের সমর্থক=নকশাল’ এমন সরল সমীকরণ বিভিন্ন মতাদর্শগত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানুষের চেতনায় গেঁথে দিতে থাকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। শোষিত আদিবাসীদের পক্ষে ও প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে কেউ সওয়াল করলেই তাকে ইউএপিএ দিয়ে ‘শাস্তি’ দেওয়া হবে, বামফ্রন্ট ও ইউপিএ এমন ভয় দেখাতে থাকে নাগরিকদের। উদাহরণ- ২০০৯ সালে ছত্রধর মাহাতোকে সিআইডি গ্রেপ্তার (২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯) ক’রে ইউএপিএ কানুন প্রয়োগ করার পরে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিবের বিবৃতি, “The UAPA says that those helping banned organizations in various ways like providing funds and publicity are punishable under the act. Thus, those who are advocating his release are also punishable.” [The Hindu, 3rd October, 2009] যদিও, ছত্রধর সেই সময়ে পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির নেতা ছিলেন, আর, সংগঠনটি ‘নিষিদ্ধ’ ছিল না। ২৩শে জুন ২০০৯ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কিছুক্ষণের মধ্যেই গৌর চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, চাপিয়ে দেওয়া হয় ইউএপিএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। গৌর চক্রবর্তী ২০১৬ সালে বেকসুর খালাস পান, কিন্তু ততদিনে দু’বার তাঁর ব্রেনস্ট্রোক হয়ে গেছে এবং শরীর ভেঙে পড়েছে। ২০০৯ সালের ৬ই অক্টোবর কলকাতার গড়িয়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন বাঙলা পিপলস্ মার্চের সম্পাদক স্বপন দাশগুপ্ত। যথারীতি ইউএপিএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার। অথচ, বাঙলা পিপলস্ মার্চ সরকারি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত (WB BEN/2004/15681) একটি মাসিক পত্রিকা ছিল; কেরালা সরকার ২০০৯ সালের শুরুতে ইংরাজি পিপলস্ মার্চকে নিষিদ্ধ করলেও, ২০০৯ সালের অগাস্টের সাত তারিখে ‘নিষিদ্ধ’ তকমা হঠিয়ে দেয় প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অ্যাপেলেট বোর্ড। ২০১০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি পুলিশি হেফাজতেই বিনা চিকিৎসায় রাষ্ট্রের সচেতন অবহেলায় খুন হন স্বপন। ভারতে ইউএপিএ আইন প্রয়োগে প্রথম নিহত ব্যক্তি একটি বাঙলা পত্রিকার সম্পাদক। সিআইডির এক অফিসার বলেন, “We interrogated him for several days. But we did not find anything substantial to book him under the UAPA… No charges were proved against him and we did not get any evidence against him to submit the chargesheet.” [The Indian Express, 3rd February, 2010] অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে কোনও ব্যক্তিকে ইউএপিএ ধারায় গ্রেপ্তার ক’রে যথেচ্ছ অত্যাচার করা যায় এবং যা খুশি মামলা তার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যায়- জঙ্গলমহলের নিপীড়িত আদিবাসীরা অধিকারের দাবিতে গণআন্দোলন শুরু করার পরে তাঁদের অনেককেই এভাবে বন্দী করা হয়েছে। বুদ্ধদেব মাহাতো, ২০১০ সাল থেকে বিচারাধীন, ইউএপিএ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতাসহ আরও বহু মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। এখনও তিনি বিচারাধীন, শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। সুদীপ চোংদার, ২০১০ সালে পুলিশ ও এসটিএফ গ্রেপ্তার করে তাঁকে ইউএপিএ ধারায়, বিচারাধীন অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় খুন করা হয় তাঁকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। না, এঁদের কারোর বিরুদ্ধেই কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি আদালতে। আর, বামফ্রন্ট বা তৃণমূল দু’টি দলই ইউএপিএ বা রাষ্ট্রদ্রোহ ধারায় বিরোধীদের গ্রেপ্তার করতে কার্পণ্য করেনি।
২০১১ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলার ক্ষমতায়। কিন্তু, প্রতিবাদীদের ইউএপিএ দিয়ে বন্দী করার মনোভাবে ফ্যাসিস্ত বিজেপির থেকে কোনও অংশে কম নয়। ২০১৭ সালে জাতীয় অপরাধ নথিভুক্তির দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ইউএপিএ আইনে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ভাঙ্গর আন্দোলন এবং দার্জিলিং জেলার বিক্ষোভে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় ইউএপিএ দিয়ে, সঙ্গে অন্যান্য গুরুতর অভিযোগও ছিল, যেমন সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইত্যাদি। এঁদের মধ্যে ভাঙরের আঠারো বছর বয়সী আব্দুল্লা মোল্লাও ছিলেন, জেল থেকেই যিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৫ সালে ইউএপিএ ধারায় ১৩টি মামলা রুজু হয় এবং গ্রেপ্তার হন ২৫ জন। ২০১৬ সালে ৯টি মামলা এবং ৫১ জন গ্রেপ্তার হন ইউএপিএতে। ২০১৭ সালে সংখ্যাদু’টি যথাক্রমে ১২ ও ২৪।
কেরালায় ২০১৫ সালে ইউএপিএ ধারায় ৩৫টি মামলা রুজু হয় এবং গ্রেপ্তার হন ১৪ জন। ২০১৬ সালে ৩৬টি মামলা ও ২০ জন গ্রেপ্তার। ২০১৭ সালে ৪টি মামলা ও ২০ জনের গ্রেপ্তারি। ২০১৮ সালে যথাক্রমে ১৭টি ও ৬ জন। ২০১৯ সালে যথাক্রমে ৫৩ ও ২৫। উল্লেখ্য, ২০১১-১৬ সাল পর্যন্ত কেরালায় ইউডিএফ ক্ষমতায় ছিল এবং ২০১৬ সাল থেকে এখনও অবধি এলডিএফ ক্ষমতায়। পাঞ্জাবে ২০১৭ সাল থেকে ইউপিএ ক্ষমতায়। ২০১৭-২০১৯ পর্যন্ত মোট ১০১ জন ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার হয়েছে এবং ১৬টি মামলা রুজু হয়েছে। ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত মণিপুরে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৭টি আসন। এই সময়ে সারা ভারতের মধ্যে মণিপুরে সর্বাধিক পরিমাণে গ্রেপ্তার ও কেস দাখিল হয়েছিল ইউএপিএ আইনে। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসী সরকারের আমলে ২০১৮ সালে ১০টি মামলা রুজু হয়েছে এবং ৪ জন গ্রেপ্তার; ২০১৯ সালে ২টি মামলা এবং ৩২ জনের গ্রেপ্তারি ইউপিএ আইনের অধীনে। এই গ্রেপ্তারি ও মামলা রুজু করার সিংহভাগই ‘মাওবাদী যোগসাজশ’-এর অভিযোগে এবং ‘নকশাল বিপ্লবী’ সন্দেহে। ওড়িশায় ২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে মোট ১০টি মামলা রুজু হয় ইউএপিএ ধারায় এবং মোট ৬জন গ্রেপ্তার হন।
অ-বিজেপি সংসদীয় দলগুলি সম্প্রতি স্ট্যান স্বামীর হত্যা নিয়ে সরব হয়ে ইউএপিএ-র বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়। এই দু-মুখো সাপেদের ইতিহাস মনে রাখা প্রয়োজন। মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কিংবা পূর্ব ভারতের বহু অঞ্চলে খনি-জঙ্গল-জমি লুঠ করার চেষ্টা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বহু দশক থেকে করছে। মূলবাসী মানুষ, কৃষিজীবীরা তার প্রতিরোধ করলে ‘অপারেশন গ্রিনহান্ট’ (ইউপিএ আমলে) এবং ‘অপারেশন সমাধান’ (বিজেপি আমলে) শুরু করে ভারতরাষ্ট্র। সেনা, আধা সেনা, কোবরা, স্ট্র্যাকো, এসটিএফ, পুলিশ, সালবা জুড়ুম, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র এবং বিপুল অর্থসম্ভার নিয়ে মূলবাসী ও কৃষিজীবীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাষ্ট্র। যথেচ্ছভাবে প্রযুক্ত হতে থাকে ইউএপিএ। বিনাবিচারে জেলে বন্দী হন অসংখ্য মানুষ, ইউএপিএ-র ভয় দেখিয়ে সহনাগরিকদের মুখ বন্ধ ক’রে দেওয়া হয়। আর, প্রত্যেকটি সংসদীয় দল সেই সময় হয় গণহত্যায় বগল বাজিয়ে লাফিয়েছিল নয়তো মুখে রাষ্ট্রীয় চুষিকাঠি গুঁজে চুপ ছিল। কারণ প্রত্যেকটি সংসদীয় দল জানে যে, এই আদিবাসী-মূলবাসী মানুষ, এই কৃষিজীবী-শ্রমিক এবং এই দলিতদের সংগ্রামের পাশে থাকে মাওবাদী বিপ্লবীরা; যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ চাপিয়ে এবং ইউএপিএ দিয়ে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করা যায়, তা’লে এই নিপীড়িত মানুষগুলিকে নিছক ভোটবাক্সে পরিণত করা যাবে। সেইজন্যেই এই দলগুলো কখনও না-কখনও ইউএপিএ প্রয়োগ করেছে প্রতিবাদীদের ওপরে, প্রতিরোধী জনগণকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিনাবিচারে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রেখেছে। ‘প্রগতিশীল’ কেরালা সরকার এখনও ইউএপিএ প্রয়োগ ক’রে চলেছে নকশালদের ওপরে, ‘লেসার ইভিল’ তৃণমূল সরকার দীর্ঘ ১০ বছরে রাজনৈতিক বন্দীদের অবস্থা আরও শোচনীয় ক’রে তুলেছে এবং ইউএপিএ-তে আটক বিচার-না-হওয়া বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে উদাসীন।
#
“Whoever, by words, either spoken or written, or by signs, or by visible representation, or otherwise, brings or attempts to bring into hatred or contempt, or excites or attempts to excite disaffection towards, the Government established by law in shall be punished with [imprisonment for life], to which fine may be added, or with imprisonment which may extend to three years, to which fine may be added, or with fine.”
ইউএপিএ-র সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারা। ঔপনিবেশিক আমলের এক আইন, ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়ালে কিংবা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে চাইলে তার ওপরে প্রযুক্ত হত রাষ্ট্রদ্রোহের আইন। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের আইনে ১২৪এ ধারায় একইভাবে এই আইন প্রয়োগ করা হয় রাষ্ট্রকৃত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে। গত এক দশকে প্রায় সাড়ে আটশো রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রুজু হয়েছে এগারো হাজার মানুষের বিরুদ্ধে। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই শাসকবিরোধী আন্দোলনকারী কৃষক অথবা ছাত্র বা সমাজকর্মী। কয়েকজন সাংবাদিকও এই তালিকায় আছেন। বহু ক্ষেত্রেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ, তকমাটি যে ভুয়ো তা সাব্যস্ত হয়ে যায় আদালতে। কিন্তু, ততদিনে অভিযুক্তের জীবন থেকে হয়তো বেশ ক’টি বসন্ত পার হয়ে গেছে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে তাঁকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেওয়া হয়েছে। স্ট্যান স্বামী ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জেলে চাইবাসা জেলে যে আদিবাসী মানুষগুলোর হয়ে কথা বলেছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই এমন ঘটনার শিকার। ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ২০১৪ সালে শুধুমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহিতা (১২৪এ) আইনে সারা দেশে ,আমলা রুজু হয়েছিল ৪৭টি। ২০১৫ সালে ৩০টি। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে ৩৫, ৫১, ৭০ ও ৯৩টি মামলা। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যতজন মোট রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত ছিলেন, তার ১৬% আসামে, ১৬% ঝাড়খণ্ডে, ১৩% হরিয়ানায় ও ৯% কেরালায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী তিন হাজারেরও বেশি নাগরিককে রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত হতে হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কৃষক রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত। অথচ ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মাত্র ১ জন ক’রে এবং ২০১৮ সালে মাত্র ২ জন রাষ্ট্রদ্রোহিতায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন আদালতে। ২০১৯ সালে অপরাধ সাব্যস্ত করা গেছিল মাত্র ৩.৩% মামলায়। রাষ্ট্রবিরোধী হিংসায় অভিযুক্তদের সিংহভাগ নকশালপন্থী কমিউনিস্ট- ২০১৭ সালে ৪৯৩ জন ও ২০১৮ সালে ৬২১ জনের বিরুদ্ধে নকশাল/মাওবাদী হওয়ার অপরাধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের ঔপনিবেশিক আইনের তকমা এঁটে দিয়েছিল ভারতরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু, আগের কেন্দ্রীয় সরকারও যে নাগরিকপ্রেমী ছিল বা গণতন্ত্রপ্রেমী ছিল তা নয়। এমনকি অ-বিজেপি বাম-ডান রাজ্য সরকারগুলি যারা ‘লেসার ইভিল’ তত্ত্ব আওড়ায়, তারাও কিছু কম যায় না। ২০১৪-১৭ পর্যন্ত মোট ৮টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রুজু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ২০১৪-১৯ সাল অবধি কেরলে মোট ২৫টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। ২০১৭-১৯ সালে তামিলনাড়ুতে মোট ৮টি মামলা রুজু হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৩ই নভেম্বর গোয়ালতোড় থানার কাঞ্জিমাকলি গ্রাম থেকে তিন ছাত্র সহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ- তাঁরা জঙ্গলমহলের গ্রামে গেছিলেন সমীক্ষা করতে এবং গ্রামবাসীদের অবস্থা নিয়ে কথা বলতে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, বেআইনি জমায়েত ও রাষ্ট্রদ্রহিতার মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতা সেই আদ্যিকাল থেকে শাসকের হাতিয়ার। এবং খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র সবসময়েই উচ্চশ্রেণির আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।
আইনটির নাম ‘সিডিশন’ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’। দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিস্তর ব্যবধান। রাষ্ট্রদ্রোহ বা ইউএপিএ আইনগুলি এই ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ঔপনিবেশিক আমলে দেশপ্রেমিকদের ওপরে এমন আইন চাপিয়ে শাস্তি দেওয়া হত, উত্তর-ঔপনিবেশিক আমলেও তা বজায় রয়েছে। সিডিশন নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর অভিমত ছিল, এটি “prince among the political sections of the Indian Penal Code designed to suppress the liberty of the citizen” [India Today, 4th March, 2021] লেক্সিকো শব্দটির অর্থ জানাচ্ছে, “Conduct or speech inciting people to rebel against the authority of a state or monarch.” দেশের শাসকের প্রতি ‘ডিস্অ্যাফেকশন’ দেখানো রাষ্ট্রদ্রোহ! আইনটি ‘দেশদ্রোহ’ নয়, বরং দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবেসে যাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্বস্তিতে ফেলেন, তাঁদের ওপরেই এইসব ধারায় মামলা রুজু হয়। সম্প্রতি এমন এক ঔপনিবেশিক আইনকে গণতান্ত্রিক দেশে বলবৎ রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষতঃ এই আইন ব্যবহার ক’রে সমস্ত বিরোধী কণ্ঠকে দমিয়ে দেওয়ার বাড়াবাড়ি চলছে যখন, তখন অনেক আইনজীবীও তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আর, এগুলির সঙ্গেই জুড়ে থাকে নজরদারির আইন, ব্যক্তির বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের আইন। ১৯৪৭ সালের পরে সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে গেছে। নাগরিকদের তবু ভয় পেতে হয় নিজের দেশের শাসকদের। কথোপকথনের আগে দেখে নিতে হয় কেউ ওঁত পেতে আছে কিনা। কথা বলার আগে শাসকের ভাললাগা মন্দলাগা জেনে নিতে হয়। দেশকে ভালবাসবার আগে বুঝে নিতে হয় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হবে! ২০২১ সালে পৌঁছেও মননে ও চেতনায় উপনিবেশিত থাকতে হয় অমানবিক আইন-কানুন এবং আধিপত্যশালী শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গের কাছে।
তথ্যপঞ্জি–
ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো
বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকা
এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ‘Back to the Future: India’s 2008 counterterrorism Laws’ প্রবন্ধে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ২৭শে জুলাই ২০১০ সালে। প্রবন্ধের লিঙ্ক রইল, উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন- https://www.hrw.org/report/2010/07/27/back-future/indias-2008-counterterrorism-laws
PM’s speech at the Chief Minister’s meet on Naxalism, 13th April, 2006, https://archivepmo.nic.in/drmanmohansingh/speech-details.php?nodeid=302 নকশাল/মাওবাদীদের দমন করাই যে আসল উদ্দেশ্য ইউএপিএ আইন প্রণয়ন ক’রে, তার ইঙ্গিত এই ভাষণেই ছিল। তৎকালীন অন্যান্য রাজ্য সরকারগুলির মতামতও সেই সময় অনুরূপ ছিল।
[লেখক – গবেষক, তুলনামুলক সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।]
Posted in: ARTICLE, August 2021 - Cover Story
খুব দরকারি কাজ এটা। লেখককে কুর্ণিশ ধারালো বিশ্লেষণে এই লেখা মেলে ধরার জন্য।