ইতিহাসের ব্যাখ্যায় পক্ষপাত চলে না : কৃষ্ণা ঝা

নতুন শতাব্দীর তৃতীয় দশক শুরু হওয়ার সাথে সাথে দেশের ইতিহাসকে বিস্ময়কর ভাবে কোন ঐতিহাসিকতা ছাড়াই বিকৃত করার এক নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা চলছে। যার সর্বশেষ নিদর্শন হল ১৪ই অগাস্টকে ‘পার্টিশন হররস’ (বিভাজন বিভীষিকা) দিবস রূপে পালনের আহ্বান। এই আহ্বানের অন্তর্নিহিত বিষয় হল বিজেপি সরকার কেবলমাত্র দেশভাগের দিনগুলোতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, শরণার্থীদের বিশাল সংখ্যায় ভিড়, তাদের চোখেমুখে শিকড় উপড়ে চলে আসার জ্বলন্ত ভয়াবহতাকে দেশের মানুষের মনে জিইয়ে রাখতে চায়। যারা দেশভাগের ভয়াবহতা দিবস পালন করার আহ্বান জানিয়েছে তাদের কাছে দেশের মানুষের একটি ব্যাখ্যা পাওনা আছে—কেন আমাদের সমগ্র জনগণকে এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল এবং কারা দেশভাগের বীজ বপনের জন্য দায়ী ছিল।

দেশভাগের শিকড় ১৯২৩ সালে ভি ডি সাভারকারের লেখা মোনোগ্রাফের মধ্যেই ছিল, যখন তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। এই বইয়ে, তিনি লিখেছিলেন যে সমগ্র ভারত হিন্দুদের জন্য, কারণ তারা একা, মুসলিম বা খ্রিস্টানরা নয়, ভারত ভূখণ্ডকে পবিত্র বলে মনে করে । তিনি লিখেছেন, “সমস্ত হিন্দুরা দাবী করে যে তাদের শিরা-উপশিরায় সেই শক্তিশালী জাতির রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে যারা বৈদিক পিতা, সিন্ধুদের থেকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।” তিনি আরও লিখেছেন, “আমরা [হিন্দুরা] এক কারণ আমরা একটি জাতি, একটি গোত্রের এবং একটি সাধারণ সংস্কৃতির শরিক।”

পৃথক হিন্দু জাতীয়তার ধারণাটি প্রথমবারের মতো মোনোগ্রাফে প্রকাশ করা হয়েছে, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা দ্বারা সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নেতিবাচকতার সাথে প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একভাবে এটি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে তার বিভাজন নীতি অনুসরণ করার জন্য একটি সুযোগ করে দিয়েছিল। এটি ছিল হিন্দুত্বের ধারণার উপর জোর দেওয়া যারা দ্বারা বাকী অন্যরা, বিশেষ করে মুসলমানরা, ‘অপর’ হয়ে থেকে যায়। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মানসিকতার প্রসার ঘটানোর কার্যকলাপ পরিচালনা করা সম্ভব হয়। সাভারকারের কাছে হিন্দুত্ব শব্দটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হিন্দু ধর্মের সূচনা করে যা হিন্দুদের একটি জাতি হিসেবে সংগঠিত করতে সক্ষম হবে। এই জাতির গঠনের দৃষ্টিপথে ভারতীয় মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের কোন স্থান ছিল না। বইটিতে শুধু তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই সংজ্ঞায়িত করেননি, সেখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল কারণ তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে “গজনীর মহম্মদ সিন্ধু পার করার পর”-ই, “জীবন-মৃত্যুর সংঘাত” শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই বলা যেতে পারে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের উদ্দেশ্যেই বইটি লেখা হয়েছিল।

১৯২৪ সালে সাভারকার মুক্তি পান। শীঘ্রই ১৯২৫ সালে তাঁর কর্মসূচী রূপায়নের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) গঠিত হয়। কে বি হেডগেওয়ার, বি এস মুনজে, এল ভি পরঞ্জপে, বি বি ঠোলকার এবং গণেশ সাভারকার সহ পাঁচ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের প্রত্যেকেই সাভারকারের প্রতি অনুগত ছিলেন। আরএসএস-এর কোন সংবিধান ছিল না এবং প্রকাশ্যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলী ঘোষণা করা হয় নি। তবুও এটি একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন হিসেবে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছিল। আরএসএস একটি সংগঠন হিসেবে হিন্দুদের ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে তরুণদের আকৃষ্ট করত এবং তাদের “অভ্যন্তরীণ শত্রুদের”, প্রকৃত প্রস্তাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ দিত।

প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, প্রথম কয়েক বছরে সংগঠনটি বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয় নি। হেডগেওয়ারের পৃষ্ঠপোষক মুনজে মুসোলিনির সাথে দেখা করার পর এবং তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শন করার পরেই তিনি আরএসএস-এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাণসঞ্চার ঘটাতে সক্ষম হন। বৈঠকটি ১৯৩১ সালে ইতালিতে হয়েছিল, যখন সেদেশে ফ্যাসিবাদ ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।

মুনজে তার নতুন ধারণা নিয়ে ইটালি থেকে ফিরে আসার পরেই প্রকৃত অর্থে সংখ্যালঘুদের, বিশেষত মুসলমানদের, ধাক্কা দেওয়ার কর্মসূচীর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৯৩৩ সালে, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো আরএসএস-এর কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে বলা হয়, সাম্প্রদায়িক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তুতির নামে আরএসএস-এর সদস্যদের বর্শা, তলোয়ার ও খঞ্জর ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, “সাম্প্রতিক সময়ে সংঘ আরও উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে এবং ১৯৩২ সালে নাগপুরে দশেরার সময় ড. কে বি হেডগেওয়ার, যিনি প্রাদেশিক কমান্ডার এবং সংগঠক, দাবি করেছিলেন যে হিন্দুস্তান হিন্দুদের জন্য, তারাই ভারতের ভবিষ্যৎ সরকারের উপর কর্তৃত্ব করবে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর তাদের কর্তৃত্ব করার অধিকার থাকবে।”

এটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল যা হেডগেওয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, অনেকটা স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট ভাষায় যেটা ছিল সাভারকারের বইয়ে। যাইহোক, সংগঠন সেই সময়ে নিজেই একটি নবজাতক পর্যায়ে থাকায় সেই বার্তা বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছতে পারেনি।

১৯৩৭ সালে সাভারকর হিন্দুমহাসভার সভাপতি হন। পার্টির আহমেদাবাদ অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে, সাভারকার দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রথম স্পষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তিন বছর পর তা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ গ্রহণ করেন। হিন্দুত্ববাদী নেতার দ্বিজাতি তত্ত্ব দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির সূত্রপাত ঘটায় এবং শেষমেশ দেশভাগের ভয়াবহ পরিণতি ঘটে।

সাভারকর আহমেদাবাদে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, “ভারতে দু’টি প্রতিপক্ষ জাতি পাশাপাশি বাস করে। কিছু ছেলেমানুষ রাজনীতিক ভারতকে ইতিমধ্যেই একটি এক সুরে বাঁধা জাতি হিসেবে ভেবে বা তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য এক সুরে বাঁধা যাবে ভেবে গুরুতর ভুল করেন। এই সব সুন্দর ভাবনার অচিন্তক বন্ধুরা বাস্তবতার বদলে স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তাই তারা সাম্প্রদায়িক জটে অধৈর্য হয়ে কৌম সংগঠনগুলিকে দায়ী করেন। কিন্তু কঠিন সত্য হল এসব তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সমস্যাবলী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও জাতীয় বিরোধজাত উত্তরাধিকার।” আরও বলেছিলেন, “অপ্রীতিকর বাস্তবকে সরাসরি গ্রহণ করা উচিত। আজ ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও সমসত্ব জাতি হিসেবে ভাবা যায় না। বরং বিপরীতে বলা যেতে পারে, ভারতে দুটি জাতি আছে—মূলত: হিন্দু এবং মুসলমান।”

কেবল দুই জাতি তত্ত্বের বীজ বপন করাই যথেষ্ট ছিল না। আরএসএস-এর প্রধান হওয়ার ঠিক পরে আর এক হিন্দুত্ববাদী নেতা এম এস গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকল্পটিকে জার্মান ইহুদী বিদ্বেষের সাথে নির্লজ্জভাবে তুলনা করেন। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত তার বই, “We or Our Nationhood Defined”-এ ইহুদীদের প্রতি হিটলারের ব্যবহার একটি নিদর্শন হিসেবে ভারতীয় মুসলমানদের উপর প্রয়োগের কথা বলেছিলেন।

গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, “জাতি এবং সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য, জার্মানি তার মাটি থেকে ইহুদীদের নির্মূল করে বিশ্বকে হতবাক করেছে।” তিনি আরও লিখেছিলেন, “এখানে জার্মানির মাটিতে জাতির গরিমার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে এবং প্রমাণ হয়ে গেছে শিকড়ের গভীরে জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের জন্য একটি সমষ্টিতে একত্রিত হওয়া অসম্ভব—এটা হিন্দুস্থানে আমাদের জন্য একটি ভাল শিক্ষা এবং এর দ্বারা উপকৃত হওয়া যাবে।”

পরবর্তীকালে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, “এই অবস্থান থেকে, […] হিন্দুস্থানে বসবাসকারী অহিন্দু জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই হয় হিন্দু সংস্কৃতি এবং ভাষা গ্রহণ করতে হবে, অবশ্যই হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও গ্রহণ করতে শিখতে হবে, অবশ্যই হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব ভিন্ন অন্য চিন্তা করবে না, […] এবং অবশ্যই তাদের পৃথক অস্তিত্ব ত্যাগ করে হিন্দু জাতির সাথে সম্মিলিত হতে হবে অথবা হিন্দু জাতির অধস্তন হিসেবে কোন দাবি ব্যতিরেকে, কোন সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশা না করে, কোন অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা এমনকি নাগরিকের অধিকারের প্রত্যাশা না করে তারা দেশে থাকতে পারবে।”

এই বইটি একদিকে ভারতের প্রেক্ষাপটে জার্মান নাৎসিবাদ নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে এটি ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’-র মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজন তৈরি করেছে। এটি ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি মানসিকতা সম্পর্কে একটি বিস্তৃত পরিকল্পনার সূচনা করেছে ।

এই সবই এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যা মুসলিম লীগের পক্ষে তার সাম্প্রদায়িক অবস্থান কঠোর করার জন্য অনুকূল ছিল। এর পরের বছর, ১৯৪০ সালে, লাহোর অধিবেশনে মুসলিম লীগ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান দুটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে উল্লেখ করে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি জানানো হয়। অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ প্রায় সাভারকারের অনুভূতির প্রতিধ্বনি করেন। জিন্নাহ বলেছিলেন, “আমাদের হিন্দু বন্ধুরা কেন ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে ব্যর্থ হয় তা বোঝা বেশ কঠিন। শব্দের সঠিক অর্থ অনুসারে তাদেরটা ধর্ম নয় বরং প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র সামাজিক ব্যবস্থার সমন্বয় এবং এক্ষেত্রে সহমত যে হিন্দু ও মুসলমানরা কখনোই একটি অভিন্ন জাতীয়তা গড়ে তুলতে পারে না এবং একটি অভিন্ন ভারতীয় জাতির ভুল ধারণা তার সকল সীমা ছাড়িয়েছে এবং আপনাদের বেশিরভাগ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যদি আমরা সময়মত আমাদের ভাবনাগুলিকে সংশোধন করতে ব্যর্থ হই তাহলে তা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।” তিনি আরও বলেছিলেন, “একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে এই ধরনের দুটি জাতিকে একত্রিত করা, যেখানে একটি সংখ্যাসূচক সংখ্যালঘু এবং অন্যটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে থাকবে—এই অবস্থা ক্রমশ অসন্তোষ বাড়াবে এবং অন্তিমে রাষ্ট্রের সরকারের জন্য তৈরি হওয়া যে কোনও বুননকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

তখন থেকে, পাকিস্তানের গঠনের বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের মুখ্য বিষয়গুলির অন্যতম হয়ে ওঠে। যদিও কংগ্রেস কোনো প্রকার বিভাজন মেনে না নেওয়ার বিষয়ে কঠোর ছিল কিন্তু উভয় পক্ষের সাম্প্রদায়িকরা দেশের পরিবেশ বিঘ্নিত করতে থাকে। একদিকে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবিতে মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জানায় অন্যদিকে হিন্দু জঙ্গি সংগঠনগুলো, যাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য কোনো আন্দোলন সংগঠিত করার ইতিহাস নেই, তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক বিতর্কে প্রবেশের সুযোগ পায়। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কে দিয়েছিল এবং ভারতে হিন্দুদের জন্য একচেটিয়া অধিকার দাবি করেছিল, এইভাবে মুসলমানদের ভয়কে আরও ব্যাপ্ত করা হয়েছিল, একইসাথে ঘোষণা করেছিল যে তারা কোনওভাবেই ভারত বিভাজন মেনে নেবে না।

এহেন অচলাবস্থা ভারতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকের করুণাপ্রার্থী করে তুলেছিল এবং তারা স্থির করে যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো পদক্ষেপ তখনই সম্ভব হবে যখন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ তাদের মতপার্থক্যের অবসান ঘটাবে। সেটা কখনো ঘটেনি। একদিকে মুসলিম লীগ এবং অন্যদিকে আরএসএস-এর কার্যকলাপের কারণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ফলস্বরূপ ভারত ভাগ হয়।

পার্টিশন দাঙ্গায় আরএসএস যে ভূমিকা পালন করেছিল, দেশভাগের ভয়াবহতা যেভাবে সর্বগ্রাসী করেছিল তা ইতিমধ্যেই এই বিষয়ের উপর ধারাবাহিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ধরণের রচনার সাম্প্রতিকতম হচ্ছে ক্লেমেন্স সিক্স রচিত “Secularism, Decolonisation and the Cold War in South and Southeast Asia”। আরএসএস দেশভাগ পরবর্তী দিনগুলিতেও তার কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পর আরএসএস-এর নিষিদ্ধ হওয়া এবং তার নেতাদের গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র সাময়িক বিরতি এসেছিল। সরকারের তরফ থেকে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছিল, আরএসএস-এর সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত “অবাঞ্ছিত এবং এমনকি বিপজ্জনক কার্যকলাপ”-এর জন্য এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হল। “দেখা গেছে যে দেশের বেশ কিছু অংশে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ব্যক্তি সদস্যরা অগ্নিসংযোগ, লুঠ, ডাকাতি এবং হত্যা এবং অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছে।সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতি অবলম্বন করে অস্ত্র সংগ্রহ করা, সরকারের প্রতি অসন্তোষ ছড়ানো এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীকে প্রভাবিত করার আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র বিতরণ করতে দেখা গেছে আরএসএস সদস্যদের। এই ক্রিয়াকলাপগুলি গোপনীয়তার সাথে পরিচালিত হয়েছে এবং সরকার সময়ে সময়ে বিবেচনা করেছে যে এইসব ক্রিয়াকলাপ সঙ্ঘ-এর সাথে কতটা যুক্ত এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তার মোকাবিলা কিভাবে করা যায়।”—বিজ্ঞপ্তিতে এই কথাও লেখা ছিল।এর সাথে যুক্ত হয়েছিল, “সঙ্ঘের আপত্তিকর এবং ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড অবশ্য অবাধে অব্যাহত থেকেছে এবং সংঘের কার্যক্রম দ্বারা অনুপ্রাণিত হিংসার সংস্কৃতি অনেককে ভুক্তভোগী করেছে। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মূল্যবান পরিণাম ছিলেন গান্ধীজী নিজেই।”

অতএব যদি দেশভাগকে মনে রাখা হয়, তবে এটিকে তার সামগ্রিকতায় মনে রাখা উচিত, যার মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষীদের ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসকে তার প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে, মোদী এবং তার প্রভুরা যেভাবে আমাদের দেখাতে চান সেভাবে নয়। তারা জানেন যে ইতিহাস তাদের সঙ্গে নেই, সে’কারণেই তারা অতীতকে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা করছেন। দেশভাগ পর্ব ভারতীয় ইতিহাসের একটি অনিবার্য দু:স্বপ্ন এবং সেক্ষেত্রে আরএসএস তার ভূমিকা কোনদিনই মুছে ফেলতে পারবে না।

[লেখক – সমাজকর্মী এবং ‘নিউ এজ’ পত্রিকার উপসম্পাদক।]

[মূল ইংরেজি রচনা থেকে ভাষান্তর করেছেন কার্তিক দাস।]

Facebook Comments

Leave a Reply