বিনা বিচারে আটক ও স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ : কিরীটি রায়

নিবর্তনমূলক আটক আইন পৃথিবীর বহু দেশেই দেখা যায়। তা সে সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী বা সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সমাজ – যাই হোক। প্রথার বাইরে গিয়ে নাগরিককে জোর করে যখন রাষ্ট্র বা সরকার আটকে রাখে তার কারণ সহজেই অনুমেয়। এক কথায় সেই ব্যক্তি সেই রাষ্ট্রিক সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। যে আইন দ্বারা ব্যক্তি মানুষকে উক্ত কারণে আটক রাখা হয় তাকে আইনি পরিভাষায় নিবর্তনমূলক আটক আইনে রাষ্ট্রদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় নামাঙ্কিত করা হয়। এই সব আইনে আটক ব্যক্তি সেই রাষ্ট্রের সাধারণ ফৌজদারি আইনের, ন্যায় বিচারের বা যথাযত বিচারের গন্ডীর বাইরে থেকে যান। এইসব আইনগুলির সামাজিক মান্যতা পাওয়ার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রনেতারা ‘বিশেষ অবস্থা’-কে দায়ী করেন। যদিও ১৯৪৮ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ৭, ৮, ৯, ১০ এবং ১১ অনুচ্ছেদে আইনের কাছে সমতা, সকলের সাথে সমানভাবে আইনি রক্ষাকবচ পাওয়া, নাগরিকের মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে ন্যায়বিচার পাওয়া, বেআইনিভাবে গ্রেফতার না হওয়া, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচারালয়ে বিচার পাওয়া, ইত্যাদি প্রভৃতি নানারূপ অধিকারে বাস করেন ভারতীয় নাগরিকগন; কারন ভারতরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষনাপত্রে সম্মতি দিয়েছে; সংবিধান রচনার প্রায় ২ বছর পূর্বে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ১৯৪৭-এর ১৫ই আগষ্ট থেকে আজ পর্যন্ত, গত ৭৪ বছরে ভারতীয় নাগরিকরা একাধিক নিবর্তনমুলক আটক আইনের মধ্যে দিয়ে গেছেন। অসংখ্য ভারতীয় পরিবারের সদস্যরা এইসব কালা কানুনের ফাঁদে আটকে বছরের পর বছর ধরে কারাগারের ছোট্ট খুপড়িতে কাটিয়েছেন বা স্ট্যান স্বামীর মতো কেউ কেউ সেখানেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

আন্তর্জাতিক উদাহরণঃ-

বাংলাদেশঃ আমাদের পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেখানকার আইনও ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে নকল করে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে বেশ কিছু আইন আছে যার দ্বারা সেখানকার নাগরিকদের নিবর্তনমূলক আটক করা যায়। একটি উল্লেখযোগ্য আইন ‘বিশেষ ক্ষমপ্রা আইন, ১৯৭৪’-যে আইনটি হুবহু পাকিস্তানি আমলে চালু হওয়া ‘পূর্ব পাকিস্তান জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮’-কে নকল করে নতুন বোতলে পুরনো মদ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

পাকিস্তানঃ বাংলাদেশ ও ভারতের মতোই পাকিস্তানে নাগরিককে নিবর্তনমূলক আটক করার বহু আইন রয়েছে। পাকিস্তানের সংবিধান এইরূপ আইন করার জন্য সরকারের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। ‘তেহেরিক-ই-তালিবান’, ‘জর্ব-ই-আজব প্রভৃতি সংগঠনকে দমন করার অভিপ্রায়ে পাকিস্তানে বহুবিধ আটক আইন তৈরী হয়েছে যার ফলে ঐ দেশের অসংখ্য নাগরিক বিনা বিচারে কারাগারে কালাতিপাত করছেন। পাকিস্তানের কয়েকটি কালাকানুন প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য – ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন (আটা) ১৯৪৭’, ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধীর পর দ্বিতীয় সংশোধনী ২০১৩ আইন’, ‘জন সুরক্ষা আইন ১৯৬০’ ইত্যাদি প্রভৃতি।

আমেরিকাঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রথা বহির্ভূত আটকের, জামিন না পাওয়ার, মাদক পাচার প্যারোলে মুক্তিদান নয়-এইরূপ বহু ধরনের আইন বিদ্বমান। এক কথায় বলা যায় যে মার্কিন যুক্তরাওহট্রের ফৌজদারি আইনে প্রসিকিউসনের হাতে এইরূপ ক্ষমতা দেওয়া আছে, যার দ্বারা কিছু আইনে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তকে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারেই থাকতে হবে।

স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ সমূহঃ এখনও পর্যন্ত যে সকল রাষ্ট্রে নিবর্তনমূলক আটক আইনের চর্চা করা হয়েছে এবং তা থেকে যে সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থান করছে পৃথিবীর অল্প কয়েকটি দেশ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ সমূহ; যার মধ্যে আছে ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি। উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগর তীরবর্তী এইসব দেশে নিবর্তনমূলক আটক আইন নেই বললেই চলে। কেবলমাত্র বিনা অনুমতিতে বিদেশী নাগরিক যদি সেইসব রাষ্ট্রে প্রবেশ করেন তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয় ততদিন, যতদিন পর্যন্ত না উক্ত সমস্যাটির আইনি সমাধান হয়। নেদারল্যান্ডে ‘ডাচ জেল আইন’ ১৯৫১ সালে রচিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ‘অপরাধী’-দের কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সেখানকার বিচারক মিঃ কেল্ক কারাগার প্রথা টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। নেদারল্যান্ডের পাঁচটি বড়ো জেলখানা বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কর্মরত ১৯০০ কর্মীকে অন্যত্র কাজে লাগান হয়েছে।

বিভিন্ন দেশে নিবর্তনমূলক আটক আইনে এক ঝলকে আমরা দেখেছি যে, বিশ্বের বহু দেশে সরকার তাদের নাগরিকদের জোরপূর্বক ফাটকে আটক করার বিধি যেমন বর্তমান ঠিক তেমনই অল্প হলেও এই বিশ্বেরই কিছু দেশ এইসব নিয়ম নীতি, আতঙ্ক, শান্তিপ্রিয় নাগরিকের কাছে জুজুর ভয় দেখানোর নিয়ম কানুনকে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে। এবার দেখা যাক ভারতে দেশের নিরাপত্তার নামে জোর করে আটকে রাখার আইনগুলো কিরকম- (১) DIR, (২) PVA, (৩) PDA, (৪) MISA, (৫) ESMA, (৬) CAFEPOSA, (৭) UAPA ইত্যাদি প্রভৃতি।

নিবর্তনমূলক আটক আইনি আলোচনায় ঢোকার আগে একটি কথা স্মরণে রাখার দরকার যে, ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে যে সকল মৌলিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ১২ থেকে অনুচ্ছেদ ৩৫ পর্যন্ত) -গুলি ভারতের নাগরিকদের হাতে দেওয়া হয়েছে সেগুলির প্রত্যেকটির পদটিকায় তা কেড়ে নেওয়ার, খর্ব করার, লঙ্ঘিত করার প্রতিবিধানও রাষ্ট্রের হাতে দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরা যাক অনুচ্ছেদ ১৯(ক) অনুযায়ী ভারতের নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। তেমনই অনুচ্ছেদ ১৯(২) উপধারা; যার দ্বারা সরকারের/রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে সরকার এই অধিকার রদ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন রচনা করতে পারে। সোজা কথায় দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে বা জনগনের শান্তির স্বার্থে বা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার/স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত আমাদের সংবিধানেই রাখা আছে। সোজা কথায়, এক হাতে দেওয়া হয়েছে, আবার অন্য হাত দিয়ে কেড়ে নেওয়ার প্রতিবিধান রাখা হয়েছে। একথা ঠিক, কোনো অধিকার-ই নিঃশর্ত হতে পারে না। আবার অধিকার আছে আবার নেই – এই অবস্থা সর্ব অর্থে নঞর্থক।

‘UAPA’-Unlawful Activities (Prevention) Act, 1967 -এই আইনটি লোকসভায় পাশ করানো হয় ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মোরারজী দেশাই সেই সময় উপ-প্রধানমন্ত্রী। আজ ভারতের সুশীল সমাজ কেন্দ্রের NDA সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বে এবং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত অনিলচন্দ্র শাহ-র পরিচালনায় ভারত সরকার UAPA আইনটিকে অস্ত্র করে যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তাতে ভারতের বিরোধী কন্ঠস্বর স্তব্ধ করানোর প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। সাংবাদিক থেকে পত্রপত্রিকার মালিক, মানবাধিকার কর্মী থেকে চিত্র সাংবাদিক, সামাজিক কর্মী থেকে লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ সকলেই আজ আক্রান্ত। এক কথায় বলা যায় দেশের গণতান্ত্রিক আধার, আর দার্শনিক ধারণা গনতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়াটিকেই এই আইনটি প্রয়োগ করে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

আলোচনাকে বেশী দীর্ঘ করা যাবে না। আবার এই আলোচনা আইনী আলোচনা হোক এটিও কাম্য নয়। তবুও আলোচনায় যেহেতু UAPA আছে। আমরা সংক্ষেপে UAPA আইনটির Section 1 – এর উপধারা (O) – এর উপধারা (i) (ii) (iii) অনুযায়ী রাষ্ট্র তথা সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা বারণ। রাষ্ট্রের প্রহরীদের কাছে যদি মনে হয় আপানার বক্তব্য, আপনার লেখা, আপনার ভাবনা- সেটা ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক যাই হোক , তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের সংহতি, জননিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাহলে আপনি UAPA -তে আটক হতে পারেন। অর্থাৎ, আপনি যদি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পঙক্তি ‘আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল ! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!’ প্রকাশ্যে উচ্চারন করেন তাহলেও আপনি UAPA-তে আটক হওয়ার যোগ্য। আশা করি এই আইনটি কতটা সংবিধান সম্মত, আইন সম্মত, গণতান্ত্রিক ভাবনা প্রসূত তা বোঝাতে পেরেছি।

আরও একটি কথা। ভারতে কালা কানুনের কথা বলতে গেলেই সামাজিক মানুষরা ইউ এ পি এ, আফস্পা, মিসা, নাসা-র কথা বলেন। আমার প্রশ্ন, দেশের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারাকে কোন গোত্রে ফেলা হবে? বা, এন ডি পি এস (নারকোট্রিক ড্রাগস সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস) আইনকে? এই বাংলায় কতজন মানুষ এন ডি পি এসে জেলে পচছে, তার খোঁজ কে রাখে? যারা এইসব মাদকের ব্যবসা চালায়, তাদের পুলিশ সাধারণভাবেই ধরেনা; কারণ বলা বারণ। কিন্তু শান্ত, নিরীহ নাগরিকদের, যাদের রাষ্ট্র টাইট দিতে চায়, তাঁদের এই আইনে চিরুণি দিয়ে বাছা হয়। বছর ঘুরে যায়, তাঁদের জামিন হয় না, তাঁরা জেলের লপসি খেয়ে রামধুনে মত্ত থাকেন। “সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ এঁদের গলায় আসেনা।

স্বাধীনতা তুমি কার?
এবার আসা যাক ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের মধ্যরাত্রে পাওয়া, ‘স্বাধীনতা’-র প্রকৃত রূপ বিশ্লেষণে। ভারতবাসীর একজন হিসাবে ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক ঝলকে দেখা যাক আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে। সারা দুনিয়ার মধ্যে কোন দেশে অনাহারে বেশী লোক মারা যায়? কোন দেশে সবথেকে বেশী মানুষ যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত? কোন দেশে ভ্রূণ কন্যা হত্যার সংখ্যা বেশী? কোন দেশে সবথেকে বেশী অন্ধ মানুষের বাস? এই সব প্রশ্নের উত্তর একটাই। সে যে আমার জন্মভূমি। এই সামাজিক চালচিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা, ভারতীয় জনগণ কি পেয়েছি এবং তার স্বাদ কেমন?

প্রথমেই বলে রাখা ভালো ভারতের স্বাধীনতা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হাত থেকে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর হাতে ১৫ই আগস্ট রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হলেও তার আইনী রূপ রচিত হয়েছিল ১৯শে জুলাই, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘Indian Independence Act’ – এর দ্বারা। আরো পরিষ্কারভাবে বললে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা এসেছিল মাউন্টব্যাটেনের ৩রা জুনের পরিকল্পনা অনুযায়ী। এই স্বাধীনতার পিছনে যে অসংখ্য লড়াই, অহিংস ও সহিংস আন্দোলন, সুভাষ বোসের INA বাহিনীর কর্মকান্ড, তেভাগা ও তেলেঙ্গানার লড়াই, নৌ বিদ্রোহ ইত্যাদিকার ঘটনাগুলির অবদান আছে, তেমনিভাবেই ১৯৮৫-এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ও নবগঠিত রাষ্ট্রসংঘের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অবসানের ভাবনা-এই সকল কিছুই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।

আমার ভারতমাতার বুকে ছুরির ফলা বসিয়ে ফালাফালা করেছিল এই দেশেরই সন্তানরা – নেহেরু, জিন্না, প্যাটেল এবং অন্যান্যরা। শরৎচন্দ্র বসু এবং তাঁর মতো কিছু মানুষ যার বিরোধিতা করেছিলেন। ভারতের মানচিত্র চিরে দু-তিন টুকরো করে এসেছিল ভারতের স্বাধীনতা, যার ৭৫ বছর পুর্তি আসন্ন। ভারতকে দুটুকরো করে ক্ষমতার লালসায় ক্ষমতায় যারা এসেছিলেন তারা দেশপ্রেমী কতটা তা জানা নেই কিন্তু ক্ষমতাপ্রেমী ও স্বপ্রেমী নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা, ১৪ই এবং ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭,-র পরে যারা ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন তারা কেউ জনগনের দ্বারা নির্বাচিত নেতা ছিলেন না।

শোনা যায়, সেদিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সোমনাথ লাহিড়ী সংবিধান পরিষদের সভায় ভারতের সংবিধান রচনার পরে মন্তব্য করেছিলেন, “এটি একটি পুলিশ রাষ্ট্র বানানো হল। সেদিন হেমাঙ্গ বিশ্বাস মাউন্টব্যাটেনকে মাউন্ট ব্যাটন সাহেব বলে গান বেঁধেছিলেন। গান্ধীজী কিন্তু ১৯৪৭-এর ১৫ই আগষ্ট দিল্লীতে ক্ষমতাপ্রাপ্তির সমারোহে গা ভাসান নি, তিনি সেইদিন আমাদের বাঙলায় ছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের বিধ্বস্ত ক্ষতে মলম লাগাচ্ছিলেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির মুহূর্তে তাঁর সেই অকপট বক্তব্য – “আমার কাছে, হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি রক্ষার কাজ বেশী গুরুত্বপূর্ণ, স্বাধীনতা উতসবে থাকার চেয়ে”। আজ যদি গান্ধীজী জীবিত থাকতেন ও এইসব কথা বলতেন, কে জানে, তাঁর স্থানও কোন কেন্দ্রীয় কারাগারে হত কিনা!

টুকরো স্বাধীনতাঃ
আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে আছে স্বাধীনতা শব্দটি। একটি দেশ বা একটি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে অপরের দ্বারা শাসিত হওয়ার থেকে। প্রথমে আমরা দেখতে চাই ভারত নামক দেশটির স্বাধীনতা ‘কি হয়েছে, কতটা হয়েছে এবং কিভাবে হয়েছে?’ স্বাধীনতার নামে দেশকে টুকরো করার কথা আগেই আলোচিত হয়েছে। ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা এসেছিল রাতের অন্ধকারে এবং তাদের কাছে গ্রহণীয় ও প্রিয় মানুষদের হাতে। স্বাধীন ভারতের নামে ব্রিটিশ স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তার পরোক্ষ অঙ্গীকারক্রমেই কমনওয়েলথ্‌-এর সদস্য হয় ভারত ও পাকিস্তান।

স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, ‘ইউনিয়ান জ্যাক’ পতাকা সরিয়ে ‘তেরঙ্গা’ পতাকা ভারতে মাথা তুলেছে এটা ঠিক। যেমন পাকিস্তানে উঠেছে সবুজ রঙের ওপর চাঁদ তারা পতাকা। কিন্তু, ৪৭ পূর্ব ভারতের বা ৪৭ পরবর্তী ভারতের জনগনের স্বাধীনতা এসেছিল কি? অসাম্য, শোষণ, বঞ্চনা – এসব থেকে কি দেশের মানুষের মুক্তি মিলেছে?

স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি আবশ্যিক শর্ত হল সার্বভৌমতা। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট সার্বভৌম ভারত রাষ্ট্রের আয়তন বা তাঁর মানচিত্র ১৯৫০ সালে কি একই থেকেছে, না পরিবর্তিত হয়েছে? আবার ১৯৫০ সালে ভারত একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হলেও, ১৯৭৬ সালে ভারতের সার্বভৌমত্ব কি ১৯৫০-এর মতোই এই সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ ছিল? আবার ১৯৭৫ সালে ভারতের যে মানচিত্র ভারত সরকার ছাপিয়েছিল তা কি ২০১৬ সালে অপরিবর্তিত রয়েছে? এইসব হিং-টিং-ছট প্রশ্ন ভারতবাসী হিসেবে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ১৯৪৭-এ দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন ভারতের মধ্যে অসংখ্য রাজা-নবাব ছিল। তাদের রাজত্ব ছিল, তাদের সেনা বাহিনী ছিল, তাদের আলাদা আলাদা অর্থনীতি ছিল, তাদের আলাদা পতাকা ছিল, তাদের রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান/নিয়ম কানুন ছিল, আদালত ছিল, বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল। এক কথায় ৪৭-এর ১৫ই আগস্টের ভারতীয় মানচিত্র এই রাজাদের রাজত্বগুলি পৃথক অস্তিত্ব নিয়েই ভারতের মধ্যে ছিল, যা ১৯৫০-এর মধ্যে একে একে অন্তর্হিত হয়। আবার ১৯৫০-এর ২৬শে জানুয়ারি ভারতের যে সার্বভৌম এলাকা দেখান হয়েছিল তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় পার্শ্বপর্তী স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিম – ১৯৭৫ সালে। ফলে আবার সার্বভৌম এলাকা পরিবর্তিত হল। আবার ২০১৫ সালে ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলগুলির মালিক হল ভারত। পাশাপাশি বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলির মালিক হল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। আবার সার্বভৌমত্ব পরিবর্তিত হল। দেশের মানচিত্র পালটে গেল। যত যাই হোক, দেশের মানচিত্র যতই বাড়ুক বা কমুক, দেশের মানুষের কি অর্থনৈতিক, কি রাজনৈতিক, কি সামাজিক, কি সাংস্কৃতিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? আবার মাথার মধ্যে আবোল তাবোল সব প্রশ্ন গিজগিজ করে। কবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘মাথার মধ্যে এক বোধ কাজ করে’, বা, ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা’।

কুচবিহারের দিনহাটা শিবিরের রসিদুলের কাহিনি দিয়ে স্বাধীনতা দিবস পালনের অর্থ বোঝান যেতে পারে। রসিদুলের পিতা-মাতার (আবু বক্কর ও আশিয়া) ভারতে জন্ম। অর্থাৎ, জন্মসূত্রে ভারতীয়। ১৯৪৭-এর ১৫ই আগষ্ট ওঁদের দেশ স্বাধীন হয় নি; কারণ কুচবিহারের রাজার প্রজা ওঁরা। কুচবিহার ভারতে আসল ১৯৪৯ সালে। ওঁদের গ্রাম / ছিট পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। ওঁরা পাকিস্তানি? না। ওঁরা, পাকিস্তানের মধ্যে ভারতীয় ছিটের বাসিন্দা। তাই ঐ ছিটে কোন রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা- হবে না। ১৯৭১ এল। আবার দেশ বদলাল। পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ। বাংলাদেশেও সেই অবস্থা। অবশেষে ১৯৯৫ এল। মোদী-হাসিনা চুক্তি স্বাক্ষর হল। ভারতের সংবিধান বদলাল। রসিদুলদের সপরিবারে আনা হল দিনহাটায়। রাখা হল দিনহাটা অস্থায়ী শিবিরে। বাংলাদেশী থেকে আবার ভারতীয়। কিন্তু পরিবারের মুখে ভাত যোগাতে রসিদুলকে বেরোতে হল। শ্রমিক হয়ে চলল দিল্লী। বেশ চলছিল, বাড়ীতে টাকা পাঠাচ্ছিল, আনন্দে ছিল। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল কিনা জানিনা, কিন্তু দুবেলা খেতে পাচ্ছিল। হঠাৎ দিল্লী্র মোদী-পুলিশ রসিদুলকে ধরল। জেরায় বেরোল, আগে বাংলাদেশে থাকত। ব্যস, কেল্লা ফতে। মুসলমান অনুপ্রবেশকারী। ৫৬” ছাতি আরও চওড়া। রসিদুল কাঁদে, দেখায় যে তাকে ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে গাড়ি করে ভারতে নিয়ে এসেছে। কে কার কথা শোনে! পুলিশের কথা শুনে মহামান্য বিচারক দ্রুততার সাথে রায় লিখতে শুরু করলেন। ভারতের বিদেশী আইনের ১৪ নং ধারায় “রসিদুল দোষী”। রসিদুল চলল জেলে। মেয়াদ শেষে রসিদুলকে বি এস এফ-এর ঘাড় ধাক্কায় পাঠান হল বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ছোট গাড়ালিঝোড়া ছিটের রসিদুল স্বাধীনতার অর্থ বুঝে ঐ বাংলাদেশেই বাস করছে। ছোট গাড়ালিঝোড়া ছিট ২০১৫ ভারতীয় ছিট ছিল। এখন বাংলাদেশের। রসিদুল এখন বাংলাদেশী।

স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় মুক্তি, তাহলে দেখা যাক ৪৭ পুর্ববর্তী সময় থেকে ভারতীয় জনগণ কতটা মুক্তি পেয়েছে। জাতির মুক্তি না দেশের মুক্তি? স্বাধীনতার মধ্যেই একটি লুক্কায়িত শব্দ আছে যা হল নিয়ন্ত্রণের অধিকার। কোনভাবেই কি ভারতীয় জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে? কাশ্মীর, উত্তর-পূর্ব ভারতের কথা বাদ দিলাম; পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের অস্তিত্ব, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজ কি খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নেই? প্রশ্ন তুলতে ভয় হয়, পাছে ‘ইউ এ পি এ’-তে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।

স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় ন্যায় বিচার, তাহলে প্রশ্ন আসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পূর্বে যে কাজকে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য করেছিল, ২৮ বছর পরে সেই কৃত অপরাধীরা কিভাবে নিরপরাধ বলে সাব্যস্ত হয়? তাহলে কি এটাই সত্য? বিচারও কেনা যায়, বিচারককেও?

স্বাধীনতার অর্থ যদি সমতা হয়, তাহলে ভাবা যাক, গত বছর কাজের খোঁজে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁরা পদব্রজে নিজের বাড়িতে ফিরতে গিয়ে পথে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের নাম, সংখ্যা সরকারের জানা নেই কেন? ঐ সময়েই যাঁরা আরবে আটকে গেছিলেন, তাঁদের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হল কিভাবে? সমতার কথা সংবিধানে লেকা থাকবে আর একদল মানুষকে, পড়ুন দলিত মানুষদের, আজও অপরের পাইখানা, নর্দমা পরিষ্কার করার কাজ করতে হবে; কী অর্থ এইসব ভাল ভাল কথা সংবিধানে রাখার, যা মানা হয় না? আমরা জানি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক দলিত মানুষকে এই নোংরা কাজে নিয়োজিত করে রেখেছে সরকারের রেল দপ্তর। সরকার নিজেই যেখানে সংবিধান ভাঙে, সেখানে ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার, আইনের চোখে সমান … এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা পাগলামি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

তবু, ভগত সিং-এর সাহস, রবীন্দ্রনাথের ও মার্টিন লুথারের স্বপ্ন বুকে বেঁধে, কেউ কোথায় এখনও স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটে, কোনো ছবি আঁকে, গান গায়, পাগলা মেহের আলি-র মত কেউ এই গভীর রাতের অন্ধকার চিরে ‘সব ঝুট হ্যায়’ সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে আকাশ দীর্ণ করে, এটাই আমাদের আশা। যে যেখানে লড়ে যায়, আমাদেরই লড়া। আমরা স্বাধীনতা বলতে বুঝতে চাই “সেই বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর গিয়ে দাঁড়ানো যেখানে সূর্যের আলো সব জায়গায় সমানভাবে এসে পড়ে”।

[লেখক – বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর সম্পাদক।]

Facebook Comments

Leave a Reply