টিউশন ফেরত লোকটি : ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী
(১)
বাস স্ট্যান্ডের উলটো দিকে একটা গলি রয়েছে। সে গলি দিয়ে ভিতরে গেলে আরেকটা পার্ক পাওয়া যায়। পার্কের চারিধারে বাড়ি,। সে সমস্ত বাড়িকে ডজ করে বিকেলের রোদটা ঘড়ি দেখে ঠিক পাঁচটার সময়, পার্কের উপর পড়ে। সুদেব বাবু রোজ ওই রোদটাকে টার্গেট করে। পার্কের বেঞ্চিতে রোদ যখন বিশ্রাম নেয়, সুদেব বাবু তার উপর বসে তাকে বিরক্ত করবে। একটু নস্যি নেবে, রুমাল দিয়ে নাক মুছবে। আঙ্গুল মটকাবে, আর যদি ঘটি গরমের দেখা পায় তাহলে তার থেকে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি খাবে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সে হেঁটে হেঁটে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাবে বাস ধরতে। ছেলেরা ক্রিকেট খেলে পার্কে। সুদেব বাবু ক্রিকেট খেলা দেখতে ভালবাসে। বাড়িতে কাগজ এলে প্রথমেই, খেলার পাতায়, ক্রিকেটের খবরটা দেখে নেয়।
কিন্তু আজ সুদেব বাবু বেঞ্চিতে বসছেন না, মাঠের চারপাশে গোল গোল হাঁটছেন। অংকুরের বাড়ির থেকে বেড়িয়ে সমস্ত কিছু গুলিয়ে গেছে। কিছুতেই মন সংযোগ করতে পারছেন না। ভালো করে অঙ্ক পারেন নি আজ। আজ তাকে বিরক্ত করার কেউ নেই। সুদেব বাবু তবু বেঞ্চিতে এসে বসছেন না। তার সাথে দুটো কথা বলছে না কেউ। চেতনা আর প্রকৃতি এই সব সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। পৃথিবীর মানুষের খবর সব সময় আসে না, দু এক বার কিছু মানুষের হাত ধরে আসে । সেই সব মানুষের জন্য তারা অপেক্ষা করে থাকে।
…………………………………………………………………………………………………………………
“কারখানা তো বন্ধ হয়ে গেল। এখন কি করবেন?”
“অঙ্ক করব ভাবছি”
“অঙ্ক করবেন মানে! ”
“আমার অঙ্ক অনার্স ছিল, ভালোই নম্বর পেয়েছিলাম, একটুর জন্য ফার্স্ট ক্লাসটা মিস হয়। আপনারা তো জানেন, কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া কতটা কঠিন।”
“হ্যাঁ, সে জানি। কথা হচ্ছে আপনি কি স্কুলে পড়াবেন? স স সি, বি –এড এই সব আপনাকে করতে হবে, আর কলেজ যেতে হলে আপনাকে এই বয়সে নেট পরীক্ষায় বসতে হবে। ওই সব ভাবছেন নাকি? জানিনা এই সব পরীক্ষায় বয়স সীমা আছে কি না? ”
“না না ওসব হবে না। ওই পরীক্ষার কথা ভাবলে ভয় লাগে। এত পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করেনা”
“তাহলে কি করবেন? আপনার তো বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী। টাকা কড়ি আসবে কোথেকে?”
“টিউশনি করব। দু একটা যোগার করে দিন না , সেই জন্য আপনার কাছে আসা। ”
“আরে মশাই, এ তো আপনি নতুন কথা শোনালেন। আপনার কাছে ছেলেরা টিউশনি করবে কেন? আজকাল বাচ্চারা সব কোচিনে পড়ে। তারা সব বড় বড় স্কুলের প্রতিষ্ঠিত মাস্টারদের কাছে পড়ে। আপনার কাছে কেন আসবে? ”
“স্যার, আমি চেষ্টা করব ওদের মতো অঙ্ক করানোর। আমার ভীষণ শার্প মেমরি। এক বার অঙ্ক করলে আমার মনে থেকে যেত টেকনিকটা । এখন চর্চা নেই, একবার মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্য পুস্তক গুলো নিয়ে দেখে নিলে আমি আবার স্টার্ট করে দিত পারব। তাছাড়া জয়েন্ট এনট্রান্সের অঙ্ক দেখে নিতে হবে স্যার। ”
“ঠিক আছে, দেখুন ।”
“শুরুর দু একটা টিউশনি আপনি যদি একটু সুপারিশ করে দেন। তাহলে সংসার চালানোর মতন রোজগার আস্তে আস্তে আমি শুরু করে দিতে পারব। সেই বিশ্বাস আছে স্যার।”
“দেখছি, কি করা যেতে পারে, আপনাকে টিউশনি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা অতটা সহজ নয় । তবে চেষ্টা করব। আর একটা কথা, অত্যন্ত খাজা ছাত্র পেতে পারেন কিন্তু।”
“তাতে কোনও অসুবিধা নেই।”
“বেশ, আর বাড়ির খবর কি আপনার ?”
“খবর বিশেষ ভালো না, স্ত্রী বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনা । প্রায় ছ মাস হয়ে গেল কারখানার খোলার কনও নাম নেই স্যার। আমাদের পাওনা টাকাটাও পেলাম না, কবে খুলবে তাও জানিনা। ইউনিয়ন চেষ্টা করছে, দেখা যাক, এতদিন তো বসে থাকা যায় না। ছেলেটার পড়াশোনা আছে, সংসার আর কতদিন ব্যাঙ্কের জমানো টাকায় চলবে। অন্য কিছুর তো ব্যবস্থা করতে হবে, তাই ভাবলাম, যদি দু একটা ছুটকো ছাটকা প্রাইভেট টিউশনি পাওয়া যায়। অঙ্কে তো ভালই ছিলাম, করাহলনা এই আর কি! ”
ঘড়িতে তখন বিকেল ছটা বেজে দশ। সুদেব বাবুর চোখ ঘড়িতে পরে গেল। তাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, দোকানে কিছু মাস কাবারি কেনা কাটা আছে। সেসব কিনে বাড়ি গিয়ে রান্না বসাতে হবে। চোদ্দ বছরের ছেলেটাকে একা রেখে এসছে, তার স্ত্রী নমিতাকে দেখার জন্য। ফ্যাক্টরি যখন খোলা ছিল, অসুখটা তখন জাঁকিয়ে বসেনি। জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে বেরত, ছেলের যখন স্কুল থাকত না, তখন ছেলেই দেখত। আর বাকি সময়টা স্ত্রী নমিতা কোনও ভাবে ম্যানেজ করে নিত। আজ শনিবার ছেলের স্কুল নেই। দুপুরের পরে বেরিয়ে পরে দেবেশ বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। অনেকেই বলেছিল দেবেশ বাবুকে ধরতে, তার অনেক জানা শুনা আছে। কিছু টিউশনি সুপারিশে পেয়ে যাবে। বিশেষত রাজু বলেছিল। বলেছিল যে দেবেশ বাবুকে জানিয়ে রাখবে তার কথা। রাজুর থেকেই খবর পায় যে শনিবার বিকেলে সময় দিয়েছে দেবেশ বাবু।
না আর দেরী করা যাবেনা, দেরি হয়ে গেলে রান্না বসাতে লেট হয়ে যাবে। হেঁটে ফিরতে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। এখান থেকে বাড়ি প্রায় তিন কি মি দূর।
—————————————-
বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ফ্ল্যশ ব্যাকের মত দু বছর আগের কথা সুদেব বাবুর মনে পরে যায়। নমিতা গত বছর মারা গেছে। বাড়িতে লোক বলতে সে আর ছেলে কৌশিক। এর মধ্যে মিল আর খোলেনি, তবে টিউশনি অনেক বেড়েছে, তার নিজের হাত যশে। শুরুর দিকে যত মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকের বই, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বই সুদেব বাবু কিনে ফেলেন আর শুরু করেন অঙ্ক কষা, যেখানে যত কঠিন কঠিন অঙ্ক , বুদ্ধির অঙ্ক করে ফেললেন। অঙ্ক বোঝানো নয়, অঙ্ক প্র্যাকটিস করানো, আর নিত্য নতুন ট্রিক শেখানো যা করলে নানান পরীক্ষায় ভালো ফল হয়, তার জন্য মোটামুটি একটা নাম হয়ে গেল সুদেব বাবুর। আর টিউশনি আসতে শুরু করল। সুদেব বাবু আরও অঙ্ক আরও অঙ্ক করতে থাকলেন, ছাত্রর বাড়ি গেলে আগে জিজ্ঞেস করেন,”প্র্যাকটিস করছ? কি কি অঙ্ক আটকাল বল?” ছাত্ররা অঙ্ক দেখালেই, তার চোখ জ্বলে উঠত। জীবনের প্রতি তার প্রতিশোধ নেবার একটাই জায়গা ছিল, সেটা ছিল অঙ্ক কষা। অঙ্ক কষে তার অদ্ভুত তৃপ্তি হত। নিজেকে শিকারীর মত মনে হত, বহু বছর আগে একটা বিদেশী ছবিতে এক শিকারীকে দেখে ছিল, তার সব কিছু ভালো লেগেছিল সুদেব বাবুর। নিজেকে সেই শিকারীর মত মনে হতে থাকে। ছাত্রদেরকে বার বার প্রশ্ন করে “আর কি অঙ্ক আছে দাও”। অঙ্ক কষা শেষ হলে বলে,”দেখ এই অঙ্ক গুলো এই ভাবে করতে হয় , এটাই হচ্ছে ট্রিক।” ছাত্ররা অঙ্ক জমিয়ে রাখে, স্যার আছে, স্যার সব অঙ্ক করতে পারে। আড়ালে, দু এক জন ছাত্র তাকে “সলিউসশন সেট” বলে ডাকতে থাকে। সুদেব বাবু নিজের ছেলেকে অঙ্ক অনার্স নিয়ে পড়াবে ভাবে। কৌশিককে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। শুধু মনে মনে পার্থনা করে কৌশিক যতক্ষণ না নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে ততক্ষণ নিজে যেন সুস্থ থাকে, স্ত্রীর মত কিছু না হয়, আর বাকিটা সে ম্যানেজ করে নেবে।
(২)
প্রথমে কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে পারেনা সুদেব বাবু। অতবড় লোকের ছেলেকে টিউশন পড়াতে যেতে হবে। “বাবা যেখানে এত বড় বিজ্ঞানী, তার ছেলেকে কেন আমার কাছে পড়াবে? বাবাই তো পড়াতে পারে?”
“দূর বাবার কি অত সময় আছে নাকি? সে অনেক কাজে ব্যাস্ত। ছেলেকে টাইম দিতে পারেনা। আর তুমি কি তাকে অঙ্ক বোঝাচ্ছ নাকি? প্র্যাকটিস করাচ্ছ। সে যা পড়ার শেখার স্কুল থেকে শিখে নিয়েছে। তোমায় যত না করতে পারা অঙ্ক দেবে তুমি কষে দেবে।”
“সে ঠিক আছে। তবে আমি শুধু অঙ্ক কষে দি না, ট্রিকটা শেখাই। কোন অঙ্কে কোন ট্রিকটা সেটা বোঝাও একটা গুরুত্ম পূর্ণ ব্যাপার। একদিনে হয় না। এটা একটা শিল্প।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটাই তুমি শেখাবে, আমি তো তোমাকে বারণ করছি না”
মনে মনে খুশি হয় সুদেব বাবু, কিন্তু সেটা না প্রকাশ করে কাপ থেকে প্লেটে চা ঢালে। গলা ভেজায়। গোপালের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে কিছু নাম ডাক হয়েছে। এত বড় মানুষের কাছে তার খবর পৌঁছেছে যখন, আর সে নিজের ছেলের প্রাইভেট টিউশন তার কাছে পড়াতে চাইছে, তবে এটাকে তার সাফল্য বলতে হবে। মনে মনে ঠিক করে নেয় সে পড়াবে। তাকে বোঝাতে হবে তার জ্যা টা কোথায়? না পড়ানোর কোনও প্রশ্নই আসে না।
“তুমি এই শনিবার গিয়ে কথা বলে এস, তারপরে একটা ডেট ঠিক করে পরের মাস থেকে চালু করে দাও।”
“আচ্ছা শোন তোকে একটা কথা জিগ্যেস করি? ছেলেটা কি খুব খাজা? ”
“একেবারেই না, খুব ভালো না হলেও, শুনেছি মোটামুটি ভালো”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“দেখ, অঙ্ক কষে দেওয়া, ট্রিক শিখিয়ে দেবার ব্যাপারে তোমার নাম শুনেছে, তাই ছেলেকে সব রকম ভাবে তৈরী করে রাখছে, সামনে অনেক এন্ট্রান্স পরীক্ষা আছে না”, চা শেষ করে গোপাল দোকানে পয়সা দেয়।
“এই কাগজটা ধর সুদেবদা, এখানে ঠিকানাটা দেওয়া আছে, শনিবার চলে যেও। কোনও দরকার হলে আমাকে ফোন করও, নাম্বার তো আছে তোমার কাছে। ” গোপাল রাস্তা ক্রস করে উলটো দিক থেকে বাস ধরে বেরিয়ে যায়। সুদেব বাবু হাত ঘড়ি দ্যাখে, বাড়ি যেতে হবে কৌশিক অপেক্ষা করছে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সামনে একটা সাদা প্লেটে দু রকমের মিষ্টি রাখা রয়েছে। দরবেশ আর ক্ষীরের চপ। কাঁচের গ্লাসে জল রাখা আছে। আর কাপে চা রয়েছে। চারিদিকে তাকিয়ে দ্যাখে কত বই, কত বই। মনের ভিতরটা হু হু করে ওঠে, যদি বই গুলো পড়া যেত। কত বই, বিজ্ঞান, অঙ্ক, সাহিত্য, দর্শন। কিছুদিন যাক, চেয়ে দেখবে, যদি কিছু পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পরে জয়ন্ত বাবু তার ছেলে কে নিয়ে ঘরে ঢোকে। সুদেব বাবুর দিকে হাত তুলে নমস্কার জানান, সুদেব বাবুও উঠে প্রতি নমস্কার জানান।
“বসুন, বসুন” তারপর দেখিয়ে বলে,”এই আপনার ছাত্র অংকুর। যাও মাস্টার মশাইকে প্রণাম কর।”
সুদেব বাবু ব্যাস্ত হয়ে ওঠেন বলে,“থাক থাক ”
“আপনাকে ওর অঙ্কটা একটু দেখতে হবে, ও অঙ্ক করছে, কিন্তু সেটা সাফিসিয়েন্ট নয়। এখন কার পরীক্ষার জন্য ওর আরও প্র্যাকটিস চাই। অঙ্ক সবই বোঝে, আলাদা করে বোঝানোর কিছু নেই। কিন্তু প্র্যাকটিস টা কম হচ্ছে। এতো শুধু বোর্ড পরীক্ষার ব্যাপার নয়, ওকে তো এন্ট্রান্স গুলো ক্লিয়ার করতে হবে। সেখানে অনেক অনেক ট্রিকি অঙ্ক থাকে। আপনাকে আর নতুন কি বলব , আপনি তো সব জানেন, এতদিন পড়াচ্ছেন। ”
“সে তো বটেই স্যার, বোর্ডের অঙ্ক আর এন্ট্রান্সের অঙ্ক অনেক তফাত।”
“প্লিজ স্যার ট্যাঁর বলবেন না, কলোনিয়াল হ্যাংওভারটা এখনও আমদের মধ্যে রয়ে গেল”
“আজ্ঞে”, মনে মনে ভাবে,” কি বলল কথাটা ভালো করে বোঝা গেল না। কি হ্যাংওভার। মদ খেলে তো হ্যাংওভার হয়। কোনও মদের নাম বলল নাকি? কি জানি বাপু। অত ভেবে কাজ কি? ছেলে পড়াবো টাকা নেবো।“
তারপর নানান কথা বার্তা চলতে থাকে। আর কিছুক্ষণ থেকে অংকুরের সাথে কথা বলে সেদিনের মত বাড়ি চলে এসেছিল। পরের ব্হস্পতিবার ক্লাস চালু হয়ে গেল। অংকুর খুব ভালো না হলেও, খারাপ না, বরঞ্চ মোটামুটি ভালোর দিকেই। গোছানো ছেলে, এটাই ওর প্লাস পয়েন্ট, অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রায় দু তিন মাস ক্লাস নিয়ে ফেলে । এর মধ্যে একদিন জয়ন্ত বাবু এসে তার ভূয়সী প্রশংসা করে গেল,
“অনেক উন্নতি করেছে আপনার ছাত্র, আপনি সফল শিক্ষক।”
সুদেব বাবুর একটা চাপা আনন্দ হতে থাকে, মনে মনে ভাবে এই হচ্ছে ব্যাপার। শিক্ষিত বাবা শিক্ষকদের সন্মান দিতে জানে।
……………………………………………………………………………
“ও দাদা উঠুন, স্টপেজ এসে গেছে”
সুদেব বাবু ঘুমিয়ে প্রেছিল, জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে স্টপেজ এসে গেছে। থ্যাংক উ বলে নেমে পরে। কিছুটা হেটে গিয়ে দেখে পাড়ার মোড়ে নতুন কোচিং সেন্টারর বিজ্ঞাপন জ্বলজ্বল করছে। সামনের আকাশ এখন শান্ত, সেও এখন যবনিকার জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো বা নিতান্তই করুণা করছে তার প্রতি। এই আকাশ একদিন তার সমস্ত সূর্য নিয়ে সুদেব বাবুর উপর ঝাঁপিয়ে পরেছিল যখন তার ফ্যাক্টরির চাকরিটা চলে যায়। তারপর একটা দুটো করে টিউশনি বাড়াতে বাড়াতে ক্রমে স্বস্তির মুখ দেখেছিলেন সুদেব বাবু। তার আজ অংকুরের বাড়িতে ঢোকার সময় অংকুর আর জয়ন্ত বাবুর কথা গুলো বার বার কানের সামনে বাজছে আর মনে আসছে।
“কিরে স্যার কেমন অঙ্ক করাচ্ছে? তুই পারছিস তো সব?”
“হ্যাঁ বাবা, স্যারের অঙ্কের স্টক হেব্বি, যা দিই করে দেয়। দুর্দান্ত ম্যাথেমেটিশিয়ান।”
“বাবু এটার সাথে ম্যাথেমেটিশিয়ান হবার কোনও সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে কোনও ক্রিয়েটিভিটি, লজিকাল রিসেনিং বা গবেষণার ব্যাপার নেই। এটা মুখস্থ বিদ্যা। এত অঙ্ক প্র্যাকটিস করেছেন যে, সব মুখস্থ হয়ে গেছে। দেখলেই বলে দিতে পারেন কি ভাবে করতে হবে। এটা একটা স্কিল। সেটা তিনি ভালো ভাবে রপ্ত করেছেন।”
“কিন্তু আমাদের স্কুলের স্যারের থেকেও ভালো অঙ্কের স্কিল”
“শুধু স্কুলের স্যার কেন? কলেজের স্যার দের থেকেও ভালো স্কিল হবে। কিন্তু বাকি লোকেরা স্কুলে, কলেজে আর ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন, আর উনি পড়াচ্ছেন না কেন? তুই এখন বুঝতে পারবি না, বড় হলে বুঝবি”
“কিন্তু ব্যাপারটার ক্রেডিট আছে বল?”
“নিশ্চই আমি একবারও সে কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু ওই যে বললাম। তুই ম্যাথেমেটিশিয়ান বললি, তাই এত কথা বললাম। তবে তুই কখন এসব নিয়ে আলোচনা করবি না আর মাস্টারমশাইকে ছোট করবি না।”
“আরে না না তুমি যে কি বল!”
অন্যদিন হলে হয়তো কথা গুলো সাধারন বা সত্যি মনে হত। গায়ে লাগতো না । আজ যেন কি হয়ে গেল। গায়ে লেগে গেল। মানুষের তো এক একদিন একেক রকম হয়। গায়ে লেগে যায়। ক্রিয়েটিভিটি মানে সৃজনশীলতা, ম্যাথেমেটিশিয়ান মানে গণিতজ্ঞ; ভারী ভারী শব্দ গুলির মানে কানের সামনে বাজতে থাকে। কেউ যদি তাকে অন্য একদিন গণিতজ্ঞ বলত তাহলে সে হাসত বা লজ্জা পেত অথচ আজ মন মানছে না, বার বার প্রশ্ন করছে কেন সে গণিতজ্ঞ নয়? আর সৃজনশীলতা বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি, কিন্তু সে কোনও উত্তর পায়না। সামনে তাকালে বাড়ি দেখা যাচ্ছে, অথচ সুদেব বাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ভাবে ছেলেকে অঙ্ক অনারস করিয়ে, মাস্টার্স করিয়ে , ডক্টরেট করিয়ে তারপর টিউশনি করতে বলবে। সবাইকে দেখিয়ে দিতে বলবে কেমন ম্যাথেমেটিশিয়ান সে। কিচ্ছুক্ষণ পরে নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে। ভাবে এসব ভাবলে চলবে না, কাল আবার নতুন দিন, অনেক টিউশনি আছে। আজকে একটা বিছিন্ন দিন ছিল।
এখান থেকে একটা ড্রোন শট নিলে দেখা যেত একজন প্রান্তিক মানুষকে ঘিরে ধরেছে, ম্যাট্রিক্সের মত অজস্র বাড়ি। গভীর অঙ্ক রয়েছে সেখানে। আর সেই ম্যাট্রিক্সের মত শহরে এডি ব্লকের ‘এ’রো আর ‘ডি’কলামের মধ্যে দিয়ে একটি মানুষ অঙ্কের জন্য অঙ্কের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
Posted in: August 2021, STORY