সম্পাদকীয়

একটা দিন যদি প্যালেটে আটকে যায় দিনটা রঙের হয়ে যায়। দিনটার সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা বলে আলাদা কিছু থাকে না। আলো হারিয়ে যাওয়া দিনটাকে ঠাট্টা করে দিবাকর। কিন্তু রঙ তো রয়ে যায়! সেই রঙের দিনে আমরাও রঙ নিয়ে দুঃখ ভুলি। যেমন স্বাধীনতার দিনকে ভুলি তেরঙ্গা দিয়ে, ঝাণ্ডা দিয়ে। আগের দিন রাত থেকে উত্তেজনা—পারলে গায়ে হাতে বুকে কাগজের ছোট ছোট তেরঙ্গা চিটিয়ে ছুটছে মানুষ—কাল যে রঙের দিন, ঝাণ্ডার দিন!

ছোটবেলার রঙে তবু সরল ভালোবাসা থাকে। স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের দিন পতাকা উত্তোলনের পর ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—কেউ গান গায়, গানের সাথে নাচে—বাজতে থাকে—এ্যায় মেরে বতন কি লোগো—হিন্দি উচ্চারণের যথার্থতা ছাড়িয়ে সেই গান একদিনের জন্য বা হয়ত বাকি জীবনের অবচেতনকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। আমরা সম্মিলিত হই পতাকা তলে, অভ্যস্ত হই পতাকার রেটরিকে। এই পতাকা-সম্মিলনী জীবনভোর চলতে থাকে। মোহাবিষ্ট আমরা অন্যের রেটরিকে পতাকাকে মান্য করে যাই।

ভুলে যাই জিজ্ঞেস করতে—পতাকা তো আমারও, তোমাদের কথায় কেন এই সম্মিলনী?

জিজ্ঞেস করতে না শেখাটা নিরুপদ্রব সরল জীবনের আপাত অবসর দেয়। দিনকে যে রঙের খাতায় জমা রেখেছিলাম, কেবল সেই জমা খাতার হিসেব গুলিয়ে যায়।

আমার বতনের লোক, দেশের লোককে স্ট্র দিয়ে চা খেতে খেতে এক বা একাধিক স্ট্যান স্বামী বলেন, কেবল এক ১৫ই অগাস্টের দিন নয়, প্রতিদিন দেশের জলের স্বাদ নিতে মহানগর ছেড়ে চাইবাসা যাওয়া। সেই যাওয়াতে নাগরিক অবকাশ যাপন ছিল না, ছিল না আরোপিত উদ্দামতা। জল-জমি-জঙ্গল থেকে প্রতিদিন যে মানুষগুলোকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের পাশে দাঁড়াতে গেছিলাম।

আর সেই মানুষগুলোর বঞ্চনা, শোষণের যন্ত্র-রাষ্ট্র-রঙের অজুহাতে, ঝাণ্ডার অজুহাতে কারাগারে নিঃক্ষেপ করে, খতম করে প্রতিবাদী স্বর। কেবল বাজতে থাকে ঝাণ্ডা উঁচা রহে হামারা! স্বাধীন দেশে রাওলাট আইন বিবর্তিত হয় ইউএপিএ-তে, নিশ্চিত হাসি পায় জালিয়ানওয়ালাবাগের, দেওয়ালের গায়ে বুলেটের দাগগুলোর। আমাদেরই নীরবতার অবসরে আমাদেরই নির্বাচিত সরকার, জনপ্রতিনিধিদের ভর করে জেনারেল ডায়ারের প্রেতাত্মা। স্বাধীনতা রঙ ও ঝাণ্ডা থেকে দূরে সরে যায়। সে হয়ে যায় গরীবের স্বাধীনতা, দলিতের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুর স্বাধীনতা, কাশ্মীরের আজাদি।

অপরজন

অগাস্ট, ২০২১

Facebook Comments

Posted in: August 2021, EDITORIAL

Tagged as:

Leave a Reply