স্বাধীনতাঃ একটা প্রবাহ, অবদমনের হাতিয়ার নয় : দেবাশিস দত্ত
জন্মেছি ওদের আমলে সালটা তখন তেতাল্লিশ। ওরা যখন গেল, ঘাড় থেকে নামলো বয়েস মাত্র চার। ওদের চাক্ষুষ করিনি কোনদিন। বোঝার প্রশ্ন নেই। চাকুরি জীবনে এক আধ পিস সাদা চামড়া মাথার ওপরে দেখেছি, সেটা অন্য কথা। জ্ঞান হতে জানলাম যে বোঁচকাটা ওরা ফেলে গেছে তার নাম ‘স্বাধীনতা’, হবেও বা। এটাও জেনেছিলাম ঐ বোঁচকাটা পাবার জন্যেই নাকি মানুষ লড়েছিল, ঘর ছেড়েছিল, বুক পেতে গুলি খেয়েছিল, জেলখানায় পচে মরেছিল, ডান্ডাবেরি, কালাপানি ফাঁসি আরও কত কী গিয়েছিল – ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর, আসফাকুউল্লারা নাকি ঐ বোঁচকাটার জন্যে লড়েছিল! হাসি পায়! এতোটা বোকা ওঁরা ছিলেন!! মনে হয় না। ওঁরা কেউ বেঁচে নেই তাই হিসেবটা মেলানোর কোন প্রত্যক্ষ সুযোগ নেই। বোঁচকাটা যাঁরা টাটকা হাতে পেলেন, কিছু সরিয়ে রাখলেন কিনা কেউ জানে না, বাকিদের জন্যে তাঁরা ‘যা পেলেন বলে’ লিস্টি বানিয়ে দেখালেন … ভারতবাসী ওদের চোখে তাই দেখল। আজ যখন সেই স্বাধীনতার বয়েস পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই ঠিক তখনই হিসেবটা মেলাতে আগলে দাঁড়ালেন স্ট্যান স্বামী, অ্যা নিউ এডিশন অর ইন্টারপ্রেটেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স মানে ‘স্বাধীনতা’। ভগৎ সিং আসফাকুল্লারা এবার পথ আগলে দাঁড়ান একথা বলতে ‘স্বাধীনতা’ … ইন্ডিপেন্ডেন্স ইজ নট অ্যান ইন্সট্রুমেন্ট টু রিপ্রেস অর অ্যা কাইন্ড ফর সেল … ইট ইজ অ্যা কাইন্ড নট ইয়েট ডিফাইন্ড … কারণ বানিয়া শাসকেরা খোলাখুলি বুঝেছে লুণ্ঠনের স্বাধীনতা, শাসিতরা বুঝেছে ‘কপালের লিখন’ … আর বাকিরা বুঝেছে কোনমতে পেন্ডুলামের দিনযাপন। দেওয়ালের লিখন কেউ পড়েনি।
ইতিহাস পড়ে, উৎস অনুসন্ধানে ভয়ে কাঁটা হয়ে, অনিকেত দে লিখলেন “সংবিধানে ও আদালতের শুভবুদ্ধির উপর দেশের নাগরিক সমাজ এখনও আস্থা দেখায়। অপছন্দের কিছু ঘটলেই ‘সরকার অসাংবিধানিক কাজ করছে’, বা ‘আদালত তার যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি’ জাতীয় অভিযোগ অবধিই আমাদের দৌড়। অর্থাৎ আমরা ধরে নিই, বা কল্পনা করতে ভালবাসি যে, রাজনীতি আর আইন দুটো পৃথক বিষয়। … যে আইনে স্ট্যান স্বামীকে বিনা জামিনে বন্দি রাখা গেল, শুধু সেই আইনের ইতিহাসটুকুই সংবিধানের প্রতি মোহ চূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।” বলা হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ তাদের শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য ভারতীয় প্রতিরক্ষা আইন তৈরি করে এবং যুদ্ধশেষের পরেও ‘বিনা বিচারে আটক রাখার’ আইন জারি রাখে। এই আইন হল – রাওলাট আইন যার বিভিন্ন বিধি ভিন্ন নামে ছদ্মবেশে বাংলার বিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল’ প্রণয়ন করে এবং চালু রাখে। স্বাধীনতার পরেও এই আইন চালু থাকে এবং কংগ্রেস সরকার নতুন নতুন আইন এনে ‘বিচারহীন রাখার’ ক্ষমতা বাড়িয়ে নেয়। অনিকেত লিখেছেন “পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ ১৯৪৭ সালে কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করার জন্য বাংলায় রাওলাট আইনের নবতম সংস্করণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন পাশ করেন।” সেদিনের নাগরিক প্রতিবাদের জেরে উপ-নির্বাচনে নেহেরুজী মনোনীত প্রার্থীকে পরাস্ত করলেন শরৎ বসু। সে সময়ে বিধানসভায় ‘নিরাপত্তা বিল’ এর বিরুদ্ধে অবিভক্ত সিপিআই নেতা জ্যোতি বসুর তুখোড় ভাষণ আজ আর কেউ মনে না রাখলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখার প্রয়োজনীয়তা মোটেও ফুরিয়ে যায় নি। বরং তা ‘মতাদর্শ নির্বিশেষে’ আজও সকলকে পথ দেখাতে পারে। বিরোধিতা সত্ত্বেও বিধান রায়, মুখ্যমন্ত্রী, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ’৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে আইন পাশ হয়ে গেল। বোঝাই গেল ‘বোঁচকায়’ যা ছিল সেটা ছিল শাসকের ‘স্বাধীনতা’, শাসিতের নয়।
পরে ১৯৪৯ সালে, সংবিধান প্রণয়নের সময়ে এই প্রশ্নটা উঠল যে ‘প্রকৃত নাগরিক অধিকার’ দেওয়া হলে, নাগরিকের নিজের দেহের ওপরে অধিকার, হেবিয়াস কর্পাস – প্রথম অধিকার। এই অধিকার না থাকলে অন্য কোন অধিকারের কোন মানেই হয় না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘অবস্থা বিশেষে সরকার আইন করে হেবিয়াস কর্পাস অগ্রাহ্য করতে পারে। আদালতের হাতেও তেমন কোন ক্ষমতা রইল না। ‘রাওলাটের প্রেতাত্মা শেষে ঠাই পেল স্বাধীন ভারতের সংবিধানে।” এখান থেকেই উঠে আসে হরেক রকমের আইন আফস্পা, মিসা, টাডা, পিডিএ যার সাম্প্রতিক এডিশন ‘আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ (ইউএপিএ)।
অপর একটি আইন ‘সিডিশন অ্যাক্ট’ বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ‘ধারা ১২৪-এ’ যার উৎস হল ব্রিটিশ আমলে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে’ (সেই সময়ে ওয়াহাবি আন্দোলনের বিস্তার রুখতে) ১৮৭০ সালে প্রণীত আইন এর উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই আইনের মূল কথা ছিল ‘… দ্যা অ্যাক্ট অব সিডিশন ইজ টু ব্রিং হেট্রেড অর কন্টেম্পট টুওয়ার্ডস দ্যা গভর্নমেন্ট এস্টাব্লিশড বাই ল ইন ইন্ডিয়া। … দ্যা পানিশমেন্ট মে বি অব ইম্প্রিজনমেন্ট ফর থ্রি ইয়ার্স অ্যান্ড ফাইন।’ ১৯৬৮ সালে ল কমিশন এই আইন বাতিলের চিন্তা-ভাবনা খারিজ করে দেয়। ১৯৭১ সালে ‘ল কমিশন’ এই আইনের ‘স্কোপ’ বাড়াবার সুপারিশ করে। ১২৪-এ আইনের বর্তমান পাঠ: “হুএভার, বাই ওয়ার্ডস, আইদার স্পোকেন অর রিটন, অর বাই সাইনস, অর বাই ভিসিবল রিপ্রেজেন্টেশন, অর আদারওয়াইজ, ব্রিংস অর অ্যাটেম্পটস টু ব্রিং ইনটু হেট্রেড অর কন্টেম্পট, অর এক্সাইটস, অর অ্যাটেম্পটস টু এক্সাইট ডিসএফেকশন টুওয়ার্ডস, দ্যা গভর্নমেন্ট এস্টাব্লিশড বাই ল ইন ইন্ডিয়ান, শ্যাল বি পানিশড উইথ … ” কোন ছিদ্র আর রইল না। ব্রিটিশ আমলের চেয়েও আইনকে আরও কড়া করে তোলা হল অথচ সেদিনের স্বাধীনতার আন্দোলনের চেয়ে আজকের আন্দোলন তেমন গুরুতর হয়ে উঠতে পারল না। ব্রিটেনে ২০০৯ সালে এই আইন বাতিল করে দেওয়া হলেও আজও এই আইনের শিকার জেএনইউ’র মত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান – কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সাহেলা রশিদরা এবং সটান দাঁড়িয়ে স্ট্যান। মাঝে অবশ্যই রয়েছেন নরেন্দ্র দাভলকর, বিজয় পানসারে, এম কালবুরগি,
জেস্যুইট ফাদার স্ট্যানইস্লাস লারডু স্বামী – রাষ্ট্র যাকে হত্যা করেছে … বয়েস যাঁর চুরাশি, পারকিনসনে আক্রান্ত, চশমা ছাড়া যিনি কার্যত দৃষ্টিহীন, স্ট্র সিপার ছাড়া যিনি খেতে পারেন না এমন একটি মানুষও ভারত রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ নয়। শাসক ওঁর মধ্যেও বিপদ আশঙ্কা করে। প্রায় আট ন’ মাস আগে ভীমা কোরেগাও সন্ত্রাস মামলায় মাওবাদীদের সংগে যুক্ত থাকার ‘অভিযোগে’ ৮ অক্টোবর ২০২০ স্ট্যান স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুম্বাইয়ের টিলোজা জেলে তাঁকে পাঠান হয়। সেখানে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। অভিযোগ করেও কোন ফল হয়নি। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি বার বার জামিনের আবেদন করলেও ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশনের এজেন্সি’র আপত্তিক্রমে আদালত জামিন অগ্রাহ্য করে। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেও তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। খেতে পর্যন্ত পারছিলেন না। তাঁকে একটা নল (স্ট্র) দেবার জন্য আদালতে আবেদন পর্যন্ত করতে হয়। এই ঘটনা সরকার ও প্রশাসনের মুখটা চিনিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের তথা আইনের নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা, অমানবিকতা ও নিকৃষ্ট মানসিকতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। স্ট্যান স্বামী গত পাঁচ দশক ধরে আদিবাসীদের জমির অধিকার রক্ষা, তাদের উচ্ছেদ ও জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশে ছিলেন। দুর্বলের প্রতি দুর্বলতা থাকা, তাদের পাশে দাঁড়ানো অপরাধ? রাষ্ট্রের বিচারে তাই এবং সেকারণেই ‘নকশাল অভিযোগে’ ধৃত কয়েক হাজার আদিবাসীর অন্যায় গ্রেপ্তার ও মুক্তির দাবিতে স্ট্যান সটান দাঁড়িয়ে আদিবাসী আন্দোলনের প্রতিবাদী মুখ একটা প্রতীক রাষ্ট্রের কাছে ‘বিপদ’ হয়ে উঠেছিলেন।
স্ট্যান স্বামী বলেছেন: “হোয়াট ইজ হ্যাপনিং টু মি ইজ নট সামথিং ইউনিক হ্যাপনিং টু মি অ্যালোন। ইট ইজ অ্যা ব্রডার প্রসেস দ্যাট ইজ টেকিং প্লেস অল ওভার দ্যা কান্ট্রি। উই আর অল অ্যাওয়্যার হাউ প্রমিনেন্ট ইন্টেলেকচুয়ালস, লইয়ার্স, রাইটার্স, পোয়েটস, অ্যাক্টিভিস্টস, স্টুডেন্টস, লিডারস, দে আর অল পুট ইনটু জেল বিকজ দে হ্যাভ এক্সপ্রেসড দেয়ার ডিসেন্ট অর রেইজড কোয়েশচেনস, অ্যাবাউট দ্যা রুলিং অব ইন্ডিয়া। উই আর পার্ট অব দ্যা প্রোসেস। ইন অ্যা ওয়ে আই অ্যাম হ্যাপি টু বি পার্ট অব দিস প্রোসেস। আই অ্যাম নট সাইলেন্ট স্পেক্টেটর, বাট পার্ট অব দ্যা গেম, অ্যান্ড রেডি টু পে দ্যা প্রাইস হোয়াটএভার বি ইট।” এমন স্পষ্ট কথন রাষ্ট্রের আছে বিড়ম্বনার বৈ কি!!
সারা দেশে সিডিশন আইনের বিরুদ্ধে নানা স্তরে বাদ-প্রতিবাদের জেরে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বলেছে: “চিফ জাস্টিস অব ইন্ডিয়ান এন ভি রামান্না’স রিমার্কস ইন ওপেন কোর্ট অন থার্সডে সেন্ডস অ্যা স্ট্রং মেসেজ টু দ্যা গভর্নমেন্ট দ্যাট দ্যা সুপ্রিম কোর্ট ইজ প্রাইমাফ্যাসি কনভিনসড দ্যাট সিডিশন ইজ বিং মিসিউজড বাই দ্যা অথরিটিজ টু ট্র্যাম্পল আপন সিটিজেনস’ ফান্ডামেন্টাল রাইটস অব ফ্রী স্পীচ অ্যান্ড লিবার্টি। দ্যা চিফ জাস্টিস হ্যাজ সেন্ট অ্যা ক্লিয়ার সিগন্যাল দ্যাট সেকশন হান্ড্রেড টুয়েন্টি ফোর এ (সিডিশন) অফ দ্যা ইন্ডিয়ান পিনাল কোড মে হ্যাভ পাজড ইটস টাইম।” (সুত্রঃ দ্যা হিন্দু / ১৫ জুলাই ২০২১ / দিল্লী সংস্করণ)।
এখানেই সংবিধানের স্মরণাপন্ন একটু হতেই হয়। স্মরণ করতে হয় স্বাধীনতা হস্তান্তরের মুহূর্তে, সাতচল্লিশের মধ্য রাতে, সারা দুনিয়া যখন ঘুমিয়ে, এক প্রান্তে তখনও রক্তক্ষরণ চলছে, তারাই মধ্যে দাঁড়িয়ে, ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন: “ লং ইয়ার্স অ্যাগো উই মেড অ্যা ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি, অ্যান্ড নাঊ দ্যা টাইম কামস হোয়েন উই শ্যাল রিডিম আওয়ার প্লেজ, নট হোলি অর ইন ফুল মেজার, বাট ভেরি সাবস্ট্যানশিয়ালি। অ্যাট দ্যা স্ট্রোক অব দ্যা মিডনাইট আওয়ার, হোয়েন দ্যা ওয়ার্ড স্লিপস, ইন্ডিয়া উইল অ্যাওয়েক টু লাইফ অ্যান্ড ফ্রিডম। অ্যা মোমেন্ট কামস, হুইচ কামস বাট রেয়ারলি ইন হিস্টরি, হোয়েন উই স্টেপ আঊট ফ্রম দ্যা ওল্ড টু নিউ, হোয়েন আন এজ এন্ডস, অ্যান্ড হোয়েন দ্যা সোল অব অফ অ্যা নেশন, লং সাপ্রেসড, ফাইন্ডস আটারেন্স … ” ইতিহাস কি আবার কথা ক’য়ে উঠছে, আমরা কি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দ্বারপ্রান্তেই উপস্থিত … প্রশ্ন উঠছে এটাই কি ছিল অভিসার, আমাদের গন্তব্য??
‘স্বাধীনতা’র পঁচাত্তর বর্ষারম্ভের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যা বলা হয়েছিল তার উল্লেখ জরুরী। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল: “উই দ্যা পিপল অব ইন্ডিয়া, হ্যাভিং সলেমনলি রিজলভড টু কনসটিটিউট ইন্ডিয়া ইনটু অ্যা সভারেন, সোশ্যালিস্ট, সেকুলার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অ্যান্ড টু সিকিওর টু অল সিটিজেনস:
জাস্টিস, সোশ্যাল, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল;
লিবার্টি অব থট, এক্সপ্রেশন, বিলিফ, ফেইথ অ্যান্ড ওয়ারশিপ;
ইক্যুয়ালিটি অব স্ট্যাটাস অ্যান্ড অপরচুনিটি; অ্যান্ড টু প্রমোট অ্যামাং দেম অল
ফ্র্যাটারনিটি অ্যাসিওরিং দ্যা ডিগনিটি অব দ্যা ইন্ডিভিজুয়াল
অ্যান্ড দ্যা ইউনিটি অব দ্যা নেশন:
ইন আওয়ার কনসটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি দিস টুয়েন্টি সিক্সথ ডে অব নভেম্বর, ১৯৪৯, ডু হিয়ারবাই অ্যাডপ্ট, অ্যানেক্ট অ্যান্ড গিভ টু আওয়ারসেলভস দিস কনস্টিটিউশন
অর্থাৎ ‘আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে এবং তার সকল নাগরিক যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায় বিচার; চিন্তার অভিব্যক্তির বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা; প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতভাবে লাভ করেন; এবং তাঁদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক ভ্রাতৃভাব বর্ধিত হয়; তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সাথে সঙ্কল্প করে আমাদের সংবিধানে সভায় আজ, ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে এতদ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং আমাদেরকেই অর্পণ করছি’।
শাসকরা, সাড়ে সাত দশক ধরে যেভাবে স্বাধীনতা ও সংবিধানকে ‘গ্রহণ করেছে, বিধিবদ্ধ করেছে, অর্পণ করেছে’ এবং রূপায়ন করেছে তার নীট ফল, তার প্রতিচ্ছবি জেস্যুইট ফাদার স্ট্যানইস্লাস লারডু স্বামী, যিনি মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত, অসুস্থতার জন্যে হাসপাতালে স্থানান্তরিত, যেখানে খাবার স্ট্র টুকু পেতে আদালতে আবেদন করতে হল। অবশেষে রাষ্ট্রের হেফাজতে মৃত্যু বরণ করতে হল। আমাদের সংবিধান কি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং তার সঞ্চালকদের এতটাই অমানবিক হওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে? নাকি মানবিকতার সংজ্ঞাটাই রাষ্ট্রপ্রধানরা বদলে দিয়েছে?
লোকসভার প্রাক্তন মহাসচিব, আইনবিদ, রাজনৈতিক কার্যকুশলতা বিষয়ে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় উপদেষ্টা ড.সুভাষ কাশ্যপ একটি মামলার উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে “বাঁচার অধিকার শুধুমাত্র শারীরিক অস্তিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচাও এর পরিধির মধ্যে নিহিত। [A I R 1978 SC 597 সুত্রঃ আমাদের সংবিধানে/সুভাষ কাশ্যপ পৃষ্ঠা ৮৭] ওলগা টেনিস বনাম বোম্বে কর্পোরেশন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন “২১ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘জীবন’ শব্দের অর্থ ‘জীবনধারার অধিকার’। [A I R 1986 SC 180 সুত্রঃ আমাদের সংবিধানে/ সুভাষ কাশ্যপ পৃষ্ঠা ৮৭]
আমাদের সংবিধানে নির্দেশাত্মক নীতির একটি সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সংবিধানের মুখবন্ধে গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের যে স্বপ্ন সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতারা দেখেছিলেন, এই নীতিগুলির মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে। বিচারপতি কে এস হেগড়ের ভাষায় “রাজনৈতিক ও সামাজিক সমতা আনা, সমাজের বিভিন্ন চাপ ও বাঁধন থেকে সাধারণ নাগরিককে মুক্ত করা — মৌলিক অধিকারগুলির অন্যতম উদ্দেশ্য। আর নির্দেশাত্মক নীতির উদ্দেশ্য – অহিংস সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে জরুরী
ভিত্তিতে কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করা। ভারতের জনগণের সত্যকারের মুক্তির জন্য এমন একটা সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ করে সংবিধানে সমাজ কাঠামোয় বদলাতে চায়।” [সুত্রঃ আমাদের সংবিধানে/সুভাষ কাশ্যপ পৃষ্ঠা ৯৯]
রাষ্ট্রনায়করা যে স্বপ্ন দেখলেন এবং দেখালেন – অহিংস সমাজ বিপ্লবের পথে জাস্টিস, লিবার্টি, ইক্যুয়ালিটি, ফ্র্যাটারনিটি! তারই অনুসরণে পঁচাত্তর বছর ধরে যে ছবি শাসকরা নির্মাণ করেছে, তার একদিকে দাঁড়িয়ে ‘অ্যান্টালিয়া’ অন্যদিকে স্ট্যান স্বামী!! এই ছবি একাংশের কাছে স্পষ্ট, অনেকাংশে আজও অস্পষ্ট এবং অধরা। কী এসে যায়, সাদা না কালোয়? ফলেন পরিচিয়তে! ‘ধোঁকা’র কালো ধোঁয়া ছেয়ে ফেলেছে আকাশ। ‘মুক্তি’ তবে কোন পথে?? জিজ্ঞাসা অনন্ত, বিকল্প নিয়ে অনন্ত বিবাদ – শাসিত’র ‘স্বাধীনতা’ আজও অস্পষ্ট অধরা!!! যে স্বাধীনতা একদিন উদ্বাস্তু করেছে, যা দিয়ে শুরু জীবন, সায়াহ্নেও একই ছবি … দুনিয়া জুড়ে উদ্বাস্তুর লাইন দীর্ঘতর … প্রবহমান শাসিত’র সংগ্রাম, এই চলার শেষ কোথায়?
[লেখক – পত্রিকা সম্পাদক এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী।]
Posted in: ARTICLE, August 2021 - Cover Story