রাষ্ট্র, অতিরাষ্ট্র এবং স্ট্যান স্বামী : অভিজিৎ সাহা

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত Development as Freedom (1999), (উন্নয়ন ও স্ব-সক্ষমতা এর বাংলা অনুবাদ ) নামক গ্রন্থের লেখক অমর্ত্য সেন তাঁর এই বইয়ে মোট পাঁচ ধরনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। এগুলি হলঃ ক) রাজনৈতিক স্বাধীনতা; খ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা/ব্যবস্থাবিধি; গ) সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা; ঘ) রক্ষণমূলক নিরাপত্তা; ঙ) তথ্যের অবাধ স্বাধীন প্রচার। অমর্ত্য সেনের মতে এই পাঁচটি স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়েই সমাজের উন্নতির বিষয়টিকে কিছুটা পরিমাণে হলেও নিশ্চিত করা যায়। এই ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি বা জিডিপি ও দেশের আয় বৃদ্ধি পেলেই স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না। তাঁর মতে উন্নয়ন যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হয় স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। তাঁর দৃষ্টিতে উন্নয়ন মানে হচ্ছে স্বাধীনতা। তবে তিনি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দিয়ে শুধুমাত্র স্বাধীনতার বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেননি। তাঁর মতে উন্নয়নের অন্তনিহিত অর্থ হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা। এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন “উন্নয়নের লক্ষ্য স্বাধীনতাহীনতার প্রধান উৎসগুলিকে নির্মূল করা——দারিদ্র ও অত্যাচার, অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, নিয়মিতভাবে সামাজিক স্তরে বঞ্চনা, জনসাধারণের কল্যাণের উপেক্ষা, অসহিষ্ণুতা বা রাষ্ট্রের উদ্ধত কার্যকলাপ। অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি বৃদ্ধির পরেও আজকের জগতে অসংখ্য মানুষ সম্ভবত অধিকাংশ মানুষই মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত…… আরো অন্য ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে আঘাত করে কোনও স্বৈরাচারী শাসক কর্তৃক রাজনৈতিক বা নাগরিক অধিকার হরণ এবং মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অংশ নিতে বাধা সৃষ্টি করা’’। তিনি আরো বলেন এই পাঁচটি স্বাধীনতা একে অপরের সাথে পরিপূরক। দেখা গেল কোনো দেশ যদি শিক্ষা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিশ্চিত করতে পারল কিন্তু এমনও হতে পারে যে উক্ত দেশটিতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যথেষ্ট পরিমাণে নেই। যেমন ব্যক্তি মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না, কর্মক্ষেত্রের সুযোগ কম, পাশাপাশি রয়েছে সীমাহীন ও উচ্চ মাত্রায় দুর্নীতি, অনেক ক্ষেত্রেই চাকরির জন্য ঘুষ, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাহলে এই ক্ষেত্রে বলা যায় উক্ত দেশটিতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। সুতরাং শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রভৃতি নিশ্চিত হলেও উক্ত দেশটিতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরিবেশটি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়েছে। ফলতঃ সেনের যুক্তি অনুযায়ী উক্ত দেশটিতে পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন হয়েছে এইকথাটি কখনোই বলা যাবে না। ঠিক একইভাবে একটি সমাজে যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা তথ্যের অবাধ স্বাধীনতার বিষয়টি যদি কারো দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় বিশেষত রাষ্ট্রশক্তির যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে বলা যেতে পারে সেই সমাজটি উন্নয়ন থেকে এখন বহু যোজন অবস্থান করছে। এই কারণে তিনি উন্নয়নের প্রশ্নটিকে স্বাধীনতার এই পাঁচটি মাত্রার সাথে সম্পর্কিত করে দেখেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অমর্ত্য সেনের যে বইটি নোবেল পেয়েছিল তার ইংরেজি নাম ছিল ডেভলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম কিন্তু এর বাংলা অনুবাদের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব, আনুবাদিত হয়ে এর নাম হয়েছে উন্নয়ন ও স্বক্ষমতা। ইংরেজিতে ফ্রিডমের বাংলা স্বাধীনতা না করে স্ব-ক্ষমতা করা হয়েছে এর দ্বারা স্বাধীনতার অর্থটি আরও ব্যাপক হয়েছে। অমর্ত্য সেনের এই দার্শনিক দৃষ্টিকোণটিকে মাথায় রেখে আমরা আজকের দিনের বিশেষত যখন ভারত রাষ্ট্র যখন তার স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পদার্পণ করেছে সেই সময়ে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তি মানুষ কতটা পরিমাণে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এবং কিভাবে রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তোলার জন্য ব্যক্তি মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সীমাহীন আঘাত হেনে তাকে নানাবিধ দানবীয় রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের শত্রু বানিয়ে দেওয়া হয় এবং শেষমেশে বিচারাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আজ এই বিষয়গুলিকেই স্বাধীনতা দিবসের অতি পবিত্র মাসে নতুন করে মূল্যায়ন করার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে কে বড় ——-রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব/প্রাধিকার, নাকি মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার এই ধরনের বিতর্ক আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার হওয়া (Unlawful Activities Prevention Act, 1967), (বেআইনী কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন) ফাদার স্ট্যান স্বামীর (১৯৩৭-২০২১) মৃত্যু রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের পরিধি এবং এর দানবীয় রূপ বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ-পরিধি এগুলোকে নতুন করে পুনঃমূল্যায়ণ করা বর্তমান এই সংকটময় সময়ের দাবি বলে নানা স্তরে বিবেচিত হচ্ছে।

ভারত রাষ্ট্র ও নিবর্তনমূলক আটক, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ, বেআইনী কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনসমূহ

প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার সংবিধানে নাগরিকদের কতগুলি মৌলিক অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় বিশেষত ওপর ওপর দেখলে মনে হবে এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক, অন্তত যেভাবে সোচ্চারে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের কথা বারবার বলে থাকে এবং তার সুরক্ষাকবচ যেভাবে নিশ্চিত করা হয় তাতে এমনটা মনে করা অস্বাভাবিক নয়ও বটে। রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক তা নির্ভর করে কতকগুলি শর্তের ওপর। সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে যদি কোনোরূপ খামতি/ঘাটতি না থাকে বা অন্তত কিছু পরিমাণে যদি ভারসাম্য রক্ষা করা যায় তাহলে রাষ্ট্রশক্তির কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু যদি রাষ্ট্রের চোখে আঙুল রেখে তাকে প্রশ্ন করা হয় বা তার ব্যর্থতার ক্ষেত্রসমূহকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়, তির্যক সমালোচনার বান নিক্ষেপ করা হয় তাহলে কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির দানবীয় রূপটি আমাদের দুয়ারে এসে পড়ে। ফলত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুয়ারে রাষ্ট্র এই বিষম ঠেলা সামলাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে। আমাদের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকদের জন্য ১২-৩৫ নম্বর ধারায় মৌলিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে এবং উক্ত মৌলিক অধিকারসমূহকে রক্ষা করার জন্য শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের কথা উল্লেখ করা আছে। তবে সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকারের কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের উল্লেখের সাথে সাথে বলা হয়েছে যে কোনো মৌলিক অধিকারই অনিয়ন্ত্রিত নয়, রাষ্ট্র নানাবিধ শর্ত আরোপ করে এগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। যেমন জনশৃঙ্খলা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য, জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি শর্তে রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলোকে সংকুচিত করতে পারে বা সাময়িকভাবে রদ করতে পারে। তবে সংবিধানে ২১ নম্বর ধারায় ব্যক্তির জীবন/প্রাণ এবং দৈহিক স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে । এই অধিকার অনুসার বিধি দ্বারা স্থাপিত প্রক্রিয়া ব্যতীত রাষ্ট্রশক্তি এই ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারটিকে কোনোভাবেই, কোনো অবস্থাতেই কেড়ে নিতে পারে না। আবার অপরাধ সংঘটিত হতে পারে বা ভবিষ্যতে হবে এই বিষয়টি মাথায় রেখে রাষ্ট্রশক্তি স্রেফ সন্দেহের বসে তার নিজের নাগরিককে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সাংবিধানিক পরিভাষায় এই ধরণের আইনকে নিবর্তনমূলক আটক আইন বলা হয়। নিবর্তনমূলক আটক আইনের উদাহরণ হিসাবে মিশা (Maintainance of Internal Security Act,1971), কফেপোসা (Conservative and Preventive of Smmugling Activities,1974) টাডা (Terrorist and Disruptive Activities,1985) জাতীয় নিরাপত্তা আইন (National Security Act, 1980) সহ আরো অনেক আইনের কথা বলা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতে এই জাতীয় নিবর্তনমূলক আটক গৃহীত হয়েছিল এক বছরের জন্য। কিন্তু তারপরেও এই আইনটিকে ১৯৬৯ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম নিবর্তনমূলক আটক আইনের নাম হল Preventive Detention Act,1950 (PDA)। ১৯৬৯ সালে এ কে গোপালন বনাম ভারত রাষ্ট্র মামলায় এই আইনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে এই ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আরও বেশ কিছু আইনের অস্তিত্বও রয়েছে। এইসব আইনের মধ্যে অন্যতম হলো Unlawful Activities (Prevention) Act, 1967 (UAPA) বা বেআইনী কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন। আমরা আমাদের আলোচনায় ইউএপিএ নামক যে দানবীয় আইনটি রয়েছে তার নানান দিকগুলোকে বিচার করে দেখব। ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম এই আইনটিকে তৈরি করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এই আইনের দ্বারা সেই সমস্ত সংগঠনগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হত যারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্যের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল। ১৯৮৫ সালের আগে ভারতবর্ষের সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কোনো আইন ছিল না। ১৯৮৪ সালে শিখ দাঙ্গার তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই টাডা (১৯৮৫) আইনটি তৈরি করা হয়েছিল। টাডা আইনটি দেশে প্রচলিত অন্যান্য/ফৌজদারি আইন থেকে অনেক অর্থেই আলাদা ছিল। যেমন দেশের প্রচলিত অন্যান্য ফৌজদারি আইনে দুটি প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ক) অভিযুক্ত ব্যক্তি আগাম জামিনের আবেদন করতে পারে কিন্তু টাডা আইনে জামিনের সুযোগ সহজ ছিল না; খ) সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি আনীত অভিযোগের গভীরতা ও তথ্য-প্রমাণ প্রমাণ নষ্টের সুযোগ ক্ষমতা দেখে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করে আদালত জামিন দিয়ে দেয়, কিন্তু টাডা আইনে এই আগাম জামিনের কোনো সুযোগ ছিল না যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে উক্ত ব্যক্তি কোনো অপরাধ করেনি ততক্ষন তিনি জামিন পাবেন না। অর্থাৎ এই আইনে জামিনের বিষয়টি যখন সামনে আসে তখন আদালত একটা বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় সেটা হল ব্যক্তিটি অপরাধ করেছে কি করেনি। গ) টাডা আইনে রাষ্ট্রশক্তি চার্জশিট পেশ এর জন্য প্রায় এক বছর সময় পেত, এই এক বছরে অভিযুক্ত ব্যক্তি জানতে পারত না তিনি প্রকৃতপক্ষে কী অপরাধ করেছেন অথচ সাধারণ আইনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দু’মাসের মধ্যে চার্জশিট পেশ করতে হয়। ফলত আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার মূল নীতি জেল নয় বেল/জামিন সেইটার স্বীকৃতি ছিল না। এক দশক পরে ১৯৯৪ সালে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখা গেল ৭০ হাজার মামলা টাডা আইনের অধীনে চলছে এর মধ্যে বেশির ভাগের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। বিচারকার্যে বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী টাডা আইনে মাত্র ১% মানুষকে অপরাধী প্রমাণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে সাধারণ আইন অনুযায়ী ৪৪% মানুষের অপরাধ প্রমাণ করা যেতে পারে। টাডা আইনের এই ব্যাপক অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে সারা দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৫ সালে ভারত সরকার এই আইনকে বাতিল করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য Prevention of Terrorism Act, 2001 (POTA) আইন পাস করে। পোটা আইনে বলা হয়েছিল অপরাধী তার অপরাধের স্বীকার বিচারপতির পাশাপাশি পুলিশ অফিসারের নিকট করতে পারবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার এক বছর পূর্ণ হলে জামিন পেতে পারে যদি এই ক্ষেত্রে শর্ত ছিল আদালতের মনে হতে হবে উক্ত ব্যক্তি কোনো অপরাধ করেনি। স্বভাবতই সরকারের বিরুদ্ধে এই আইনের নানা অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠেছিল। বিশেষত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ধর্মঘটী শ্রমিক, কবি এদের বিরুদ্ধে এই আইনের অপব্যবহারের ভুরি ভুরি অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছিল। ২০০৪ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে পোটা আইনটিকে বাতিল করে এবং ইউএপিএ আইনটিকে সামনে আনে এবং এর বেশ কিছু সংশোধন করে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার পরবর্তী সময়ে ২০০৮, ২০১৩, সালে এই ইউএপিএ-কে সংশোধন করে। ২০১৯ বিজেপি সরকার ইউএপিএ-কে আরো একবার সংশোধন করে। এই তিনটি সংশোধনের ফলে ইউএপিএ আইনটি প্রতিটি পর্যায়ে তুলনায় আরও বেশী বিপদজনক হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে ২০১৯ এর সংশোধনীটি মারাত্মক। পোটা ও ইউএপিএ আইনের মধ্যে কতগুলি পার্থক্য রয়েছে সেগুলি হলঃ ক) পোটার ক্ষেত্রে একটা রিভিউ কমিটি ছিল যেটা প্রত্যেকটি কেসকে পর্যালোচনা করত, ইউএএপি-এর ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো রিভিউ কমিটির অস্তিত্ব নেই; খ) পোটার ক্ষেত্রে এক বছর পর জামিন পাওয়ার একটা সুযোগ ছিল, ইউএপিএ-এর ক্ষেত্রে এরকম কোনো সময়সীমা ধার্য করা হয়নি। ইউএপিএ-এর ক্ষেত্রে জামিন পাওয়ার ব্যাপারে কঠিন শর্ত আরোপ করা হয়েছে যাতে করে জামিন পাওয়াটাই একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাতে পরিণত হয়েছে এবং এটা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের স্বাভাবিক আইন এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। গ) টাডা এবং পোটা উভয় ক্ষেত্রেই Sunset Clause (এর অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে পুরো আইন বা এর অংশ বিশেষ বাতিল হয়ে যায়) হিসেবে তিন বছর এবং দু’বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল কিন্তু ইউএপিএ আইনটিতে এইরূপ কোনো Sunset Clause কথা বলা হয়নি। সুতরাং ইউএপিএ পূর্বেকার টাডা এবং পোটা এই দুই ধরনের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী নিয়ন্ত্রণ আইনের তুলনায় অনেক বেশি ভয়ঙ্কর দানবীয় এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ। রাষ্ট্রশক্তি এই আইনকে ব্যবহার করে ক্রমাগত তার বিরোধী কণ্ঠস্বর সহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন করছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই ধরনের আইনে সবথেকে বড় সুবিধা হল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনাবিচারে, বিনা জামিনে দীর্ঘদিন ধরে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে আটক করা যেতে পারে। ১৯৬৭ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত এই ইউএপিএ আইনতি মোট ছয়বার সংশোধিত হয়েছে। প্রত্যেকবার সংশোধন করে আইনটিকে ক্রমাগত আগের তুলনায় আরও বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ দানবীয় ও শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে যা ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাভাবিক ন্যায়-নীতির বিরোধী। ২০০৮ সালে মুম্বাই-এ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পরে তৎকালীন ইউপিএ সরকার পোটা আইনের বেশ কিছু দানবীয় ধারা ইউএপিএ-তে যুক্ত করেছিল। যেমন জামিন ছাড়াই আটকের মেয়াদ ৯০ থেকে বৃদ্ধি করে ১৮০ দিন করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২ আগস্ট ইউএপিএ-এর আরও একটি সংশোধনী পাস করা হয়। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ইউএপিএ-তে বেশ কিছু নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে যা সব অর্থে পূর্বেকার যাবতীয় সংশোধনীকে—– অমানবিকতা ও দানবীয়তার অর্থে ছাপিয়ে গিয়েছে। যে পরিবর্তনসমূহ এই সংশোধনীতে আনা হয়েছিল সেগুলি হল ১) বেআইনি কার্যকলাপে যুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যখন এনআইএ তদন্ত করবে তখন রাজ্য পুলিশের ডিজির যে পূর্ব অনুমতি লাগতো নয়া- সংশোধনীতে সেটাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন এনআইএ সরাসরি বেআইনি কার্যকলাপ-এর যুক্ত যে কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি সরাসরি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। আমরা সকলেই জানি যে আইন-শৃঙ্খলা রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়। এটা করে সরাসরি রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হলো যা সব অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর বিরোধী; ২) দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তিকে এককভাবে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি কোনো সন্ত্রাসবাদি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন কি নেই সেটা মুখ্য বিষয় থাকলো না। এই সংশোধনীটি সরাসরি ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আক্রমণ; ৩) তৃতীয় সংশোধনীতে অপরাধের তদন্তকারী অফিসারদের স্তরবিন্যাস পাল্টানো হয়েছে। আগে এনআইএর ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ পদমর্যাদা অফিসার এই তদন্ত করতেন এখন থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কোনো অফিসার তদন্ত করতে পারবেন। এর ফলে ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ বেড়েছে। এই সংশোধনী বলে এনআইএর তদন্তের পরিসর এমন ভাবে সম্প্রসারিত করা হয়েছে যা এই তদন্তকারী সংস্থাটিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে। এর ফলে এনআইএ একটি অতি কেন্দ্রীভূত সংস্থাতে পরিণত হয়েছে। রাজ্য সরকার ও রাজ্য পুলিশের আওতায় থাকা নানাবিধ ক্ষমতাও এনআইএ-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০১৯ সালের ২ আগস্ট শুধুমাত্র ইউএপিএ আইনে সংশোধন করা হয়েছে তাই নয় এর সাথে সাথে এনআইএর গঠন ও কার্যাবলী সংক্রান্ত বেশ কিছু সংশোধনও করা হয়েছে। এইসব সংশোধনের ফলে এনআইএর ক্ষমতা পূর্বের থেকে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউএপিএ আইনের ২০১৯-এর সংশোধনের পক্ষে যুক্তি রাখতে গিয়ে পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন “কোনো সংগঠনকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করলেই কোনো ব্যক্তি বিশেষকে এই ধরনের কাজ থেকে নিবৃত্ত করা যায় না। কোনো ব্যক্তি বিশেষকে সন্ত্রাসবাদি তকমা দিলে তারা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্য নামে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে পারে। এই সংশোধনী পাশের ফলে যারা জঙ্গী কার্যকলাপ অংশ নেয়, যারা এই ধরনের কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দেয় বা জঙ্গি আদর্শকে ছড়িয়ে দেয় এবং একইসঙ্গে জঙ্গী সংগঠনের সদস্য তারা সকলেই জঙ্গী হিসেবে ঘোষিত হবে”। অমিত শাহ আরো বলেন “সন্ত্রাসবাদ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘও কোনো চিহ্নিত ব্যক্তিকে জঙ্গী ঘোষণার পক্ষে আইন বলবৎ করেছে”। তিনি আরো বলেন “যারা এই বিলটির বিরোধিতা করছেন তাদের মনে রাখা উচিত আসল আইনটি বর্তমান সরকার প্রণয়ন করেনি। আমরা চাই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একটি কড়া আইন প্রনয়ন করা হোক। এই লক্ষ্যে যে কোন সংশোধন আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। ভারত থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার জন্য একটি কঠোর আইনের প্রয়োজন এবং আমরা সেটিকে সমর্থন করি”। (রাজ্যসভায় প্রদত্ত ভাষণ, ২ অগাস্ট, ২০১৯)। যদিও বিরোধীরা সরকারের এই প্রচেষ্টাকে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সাংবিধানিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ মনে করেন সন্ত্রাসবাদ বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোই যথেষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে নতুন করে কোনো আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তবে তারা মনে করেন এই ধরনের সংশোধনীর পিছনে সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য হল বিরোধী কণ্ঠস্বর, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, নাগরিক অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট ব্যক্তিগণকে হেনস্তা করা, এবং দেশদ্রোহিতার মামলা দেওয়া।

ভীমা কোরেগাঁও ও ইউএপিএ আইন

সংশোধিত আইন কতটা যে ভয়ঙ্কর ও দানবীয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁওতে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে পুনার জেলার কাছে ভীমা কোরেগাঁওতে দলিতদের একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে অশান্তির/ দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিবছর পুনে থেকে ২৮ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে অবস্থিত ভীমা কোরেগাঁও নামে একটি জায়গাতে দলিতরা একত্রিত হয়। ২০১৮ সাল থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সালে প্রায় ৬০০ জন মাহার সম্প্রদায়ের দলিত সেনাবাহিনী ইংরেজদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে দ্বিতীয় পেশোয়া বাজিরাও-কে ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধে পরাজিত করে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধ নামে খ্যাত। যুদ্ধ জয়ের ফলে ইংরেজরা সেখানে একটি গৌরবস্তম্ভ/ বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিল। যুদ্ধ জয়ের পর সেখানে ইংরেজদের সৈন্যদের নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে আরো বেশকিছু মাহার সম্প্রদায় সৈন্যদের নাম এই বিজয়স্তম্ভে উৎকীর্ণ করা হয়। স্বভাবতই পুরো বিষয়টা মহারাষ্ট্রের দলিত সম্প্রদায় গৌরবের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। দলিতরা এই ঘটনাটাকে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের জয় হিসেবে দেখে থাকে। ১৯২৭ সালে বি আর আম্বেদকর এই ভীমা কোরেগাঁওতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। ৯০ বছর ধরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা হয়নি। উত্তেজনা পরিবেশটি সর্বপ্রথম লক্ষ্য করা গেল ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারিতে। বিভিন্ন সাংবাদিকদের বয়ান এবং গণমাধ্যমের ভিডিওতে দেখা গেছে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গেরুয়া পাতাকাবাহী একটি সম্প্রদায়ের ভীড় আচমকা পাথর বৃষ্টি শুরু করে। এই ঘটনায় বেশ কিছু দলিত ও সাধারণ মানুষ আঘাত প্রাপ্ত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী ঘটনার পরের দিন, ২ জানুয়ারী ২০১৮ এ পুরো ঘটনাটার জন্য মনোহর শম্ভাজি ভিদের শিব প্রতিষ্ঠান এবং মিলিন্দ এগবোটের সমস্ত হিন্দু আজাদী-কে দায়ী করে এফআইআর করা হয়। কিন্তু আজ অবধি তাদের বিরেদ্ধে ভারত সরকারের তরফ থেকে কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। একবার মাত্র একবোটে-কে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কিন্তু তিনি খুব তাড়াতাড়ি জামিন পেয়ে যান, কিন্তু মনোহর ভিদ-কে এখনও অবধি গ্রেফতার করা হয়নি এবং অনেকেই তাকে গুরুজী বলে ডাকেন। উক্ত হিংসাত্মক ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরের দিনই বেশ কিছু দলিত সংগঠন ও বামপন্থীরা মহারাষ্ট্রে ধর্মঘট ডেকেছিল। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে ঘটনার দিন রাহুল পাটাঙ্গলে নামক ২৮ বছরের একজন যুবক মারা যায় এবং ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ধর্মঘটের দিন পুলিশি আক্রমণ আরো একজন যুবক তরুণের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ৩৫ জন আহত হয়েছিল। সর্বমোট ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুনে পুলিসের পক্ষ থেকে বলা হয় হিংসার পিছনে মাওবাদী, আরবান নকশাল এবং বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীরা জড়িত রয়েছে এবং এই ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে পরবর্তী সময় সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৭ সালে বেশকিছু সমাজকর্মী, রাজনৈতিক নেতা এমন এমনকি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা পুনের কাছাকাছি শানিওয়ার ওয়াদা নামক একটি দুর্গে ভীমা কোরেগাঁও দিবস পালনের জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। তারা এলগার পরিষদের (congress for speaking aloud) ডাক দিয়েছিলেন। এই এলগার পরিষদের অন্যতম সংগঠক প্রাক্তন বিচারপতি পি বি সামন্তের মতে, এলগার পরিষদের অর্থ হল উচ্চনাদে ঘোষনা। এলগার পরিষদ দুশো সংগঠনের এক সমন্বয়। এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন, পথনাটক এবং বেশ কিছু বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করা হয়েছিল যার মধ্যে অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য ছিল দলিতদের অধিকার রক্ষা এবং নরেন্দ্র মোদি সরকারের বেশ কিছু নীতির সমালোচনা। এলগার পরিষদ নিজেই প্রতিবছর ভীমা কোরেগাঁও দিবস উদযাপন করে থাকে। এই সমাবেশের পরের দিনই ১ জানুয়ারি ২০১৮ ভীমা কোরেগাঁও-তে যুদ্ধ জয়ের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিশাল সমাবেশ হয়েছিল। পুনে পুলিশ ৮ জানুয়ারী ৩১ ডিসেম্বর এলগার পরিষদের অনুষ্ঠানটিকে ভীমা কোরেগাঁও-এর সাথে যুক্ত করে এবং দেখানোর চেষ্টা করে যে ঐ দিন সন্ধ্যাতে এলগার পরিষদের মঞ্চ থেকে বেশ কিছু উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশ করা হয়েছিল যা কিনা ভীমা কোরেগাঁও-তে দাঙ্গা সৃষ্টি এবং দেশদ্রোহিতা ও প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এই সুত্রেই ভীমা কোরেগাঁও মামলার সুত্রে এলগার পরিষদ এবং এর ফ্রন্টাল সংগঠন কাবির কালা মঞ্চ ও এর সাথে যুক্ত বাক্তিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এরা সাম্প্রদায়িক অনৈক্য সৃষ্টি এবং উস্কানি মূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন। এছাড়াও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) যেটা কিনা একটি নিষিদ্ধ সংগঠন তার সঙ্গে এরা যুক্ত বলে দাবিও করা হয়েছে। এই মর্মে এদেরকে ইউএপিএ এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের বেশ কিছু ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য এর পূর্বে ৬ দিন আগে ২ জানুয়ারি ২০০৮ এই ঘটনায় দুজন হিন্দুবাদী নেতার বিরুদ্ধে দলিতদের ওপর আক্রমনের অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, অন্যদিকে ৮ জানুয়ারি ২০১৮ এই মামলায় তুষার রমেশ দাঙ্গুদে (এই ব্যক্তি আবার ফেসবুকে ভিদের অনুসরণকারী) নামক একজন ব্যক্তি এফআইআর করেন এবং এর ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক চার্জশিটের মাধ্যমে মোট ১৬ জন সমাজকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুলিশ প্রথম এফআইআর-টিকে যেটা ২ জানুয়ারী প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিত্তিতে করা হয়েছিল তার পরিবর্তে ৮ তারিখে দাঙ্গুদের করা এফএইআর-টিকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছে আর এরই ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যেমন ২০১৮ সালের জুন মাসে সোমা সেন, সুধীর ধাওয়ালে, সুরেন্দ্র গাদলিং, মহেশ রাউত, এবং রোনা উইলসন এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে সুধা ভরদ্বাজ, ভারভারা রাও, অরুণ ফেরেরা, ভারনন গনসালভেস এদের গ্রেফতার করা হয়। ১৪ এপ্রিল ২০২০ আনন্দ তেলতুম্বদে, এবং গৌতম নওলাখা-কে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হানি বাবুকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী সময় ২২ শে আগস্ট ২০১৮ দ্বিতীয় এফআইআর-এর ভিত্তিতে পেশ করে ফাদার স্ট্যান স্বামী সহ আরও অনেক ব্যক্তিকে অভিযুক্তদের তালিকায় যুক্ত করা হয়। যদিও পুলিশের মত অনুযায়ী ফাদার স্ট্যান স্বামী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না তৎসত্ত্বেও তিনি নাকি দেশদ্রোহী এবং প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে শামিল ছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এখনো অবধি ভীমা কোরেগাঁও মামলাতে দুটি চার্জশিট হয়েছে। এরমধ্যে পুনে পুলিশ নভেম্বর ২০১৮ সালে প্রথম চার্জশিট পেশ করে এবং ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বা অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করে। অতঃপর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সরকার এই মামলাটি এনআইএর হাতে তুলে দেয় এবং এনআইএর মুম্বাই দপ্তর এই মামলা পরিচালনা করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আরও একটি চার্জশিট পেশ করা হয় যেখানে বলা হয় সমাজকর্মী গৌতম নওলাখার সাথে পাকিস্তানি আইএসআইয়ের সম্পর্ক রয়েছে। এই হল সংক্ষেপে ভীমা কোরেগাঁও মামলার এফআইআর এবং চার্জশিট সংক্রান্ত ইতিবৃত্ত। আমরা আমাদের আলোচনায় রাষ্ট্র কর্তৃক এই দানবীয় ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার হওয়া ফাদার স্ট্যান স্বামীকে নিয়ে আরো কিছু কথা বলব। তাত্ত্বিকভাবে বললে বলা যেতে পারে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার হওয়া স্ট্যান স্বামীর ঘটনাটিকে আমরা একটি কেস ষ্টাডি হিসাবে দেখার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ একটি উদারনৈতিক- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অন্যদিকে রাষ্ট্রের দানবীয় আইন যা রাষ্ট্রকে অতিরাষ্ট্রে পরিণত করেছে ——এই দুইয়ের মধ্যেকার দ্বন্দের রূপ- চরিত্রটি কীরূপ তার ওপর খানিকটা হলেও আলোকপাতের চেষ্টা করব।

কে এই ফাদার স্ট্যান স্বামী এবং কেন ইনি শক্তির কাছে বিপদজনকঃ

২২ আগস্ট ২০১৮ সালের আরও একটি এফআইআর-এ ভিত্তিতে অন্য অনেকের সঙ্গে স্ট্যান স্বামীকে ভীমা কোরেগাঁও মামলার অভিযুক্তদের তালিকায় যুক্ত করা হয়। আর দ্বিতীয় একটি চার্জশিটের ভিত্তিতে স্ট্যান স্বামীকে ভারতরাষ্ট্র ভীমা কোরেগাঁও মামলাতে অর্থাৎ মাওবাদী যোগাযোগ, দেশদ্রোহিতা এবং প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা এই মামলায় গ্রেপ্তার করে। স্ট্যান স্বামী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যায় বিচারের নামে কী ধরনের প্রহসন পেয়েছিলেন সেই প্রক্রিয়াকে পর্যালোচনা করার পূর্বে স্ট্যান স্বামী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং কী তার কাজ এবং কেন তিনি রাষ্ট্রের কাছে বিপদজনক বলে চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোকে সংক্ষেপে তুলে ধরব। স্ট্যান স্বামী একজন জেসুইট ক্যাথলিক পাদ্রী ফাদার ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি মূলত ঝাড়খন্ডে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করতেন। এই সাধারন আদিবাসী, মূলনিবাসী, হতদরিদ্র, ভারতবাসীদের একদম নিজের আপন করে নিয়েছিলেন এবং এদের মধ্যে তিনি ঈশ্বরকে দেখতে পেতেন। তিনি এই ভূমিপুত্রদের জল, জঙ্গল এবং জমির অধিকারের ওপর যে অধিকার রয়েছে সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন গরিব মানুষ তাদের নিজেদের অধিকার নিজে বুঝে নিক আর শুধুমাত্র অধিকার বুঝে নেওয়া নয় সেগুলোকে আদায়ের জন্য তিনি বারবার দলিত আদিবাসী মানুষদের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি বারবার প্রশ্ন তুলেছেন কেন সংবিধানের পঞ্চম তফসিল তৈরি করা হয়নি, কেন আদিবাসীদের উন্নতির জন্য উপজাতি পরামর্শদাতা কাউন্সিল তৈরি করা হয়নি। স্ট্যান স্বামী যে কেন্দ্রে/রাজ্যে যখন যে দলের সরকার থাকুক না কেন বারবার এই প্রশ্নগুলো ভারত রাষ্ট্রের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন। জনগণের অধিকার নিয়ে তিনি শুধু বিজেপি নয় কংগ্রেস আমলেও অপারেশন গ্রীন হ্যান্টের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এইভাবে জনগণের হয়ে প্রশ্ন তুলতে তুলতে তিনি কখন ভারত রাষ্ট্রের চোখে মাওবাদী হয়ে গেছেন সেটা তিনি নিজেও কখনোও বুঝে উঠতেও পারেননি। সুধা ভরদ্বাজ ও স্ট্যান স্বামীরা একত্রে ‘পারসিকিটেড প্রিজর্নাস সলিডারিটি কমিটি’ তৈরি করেন করেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল মাওবাদী তকমা দিয়ে যে ৩০০০ নারী-পুরুষকে জেলে ভরা হয়েছে তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করা। গ্রেপ্তারির পর স্ট্যান স্বামী বলেছিলেন তার কাজ অর্থাৎ মানুষের মুক্তির জন্য লড়াইয়ের যে কাজটি নিয়েছেন তার সঙ্গেই হয়তো তার গ্রেপ্তারি যুক্ত। স্ট্যান স্বামীর কাজের যা ধরন তার দ্বারা এই বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছিল যে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য তিনি কর্পোরেটদের সরাসরি মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং আমরা জানি আজকের দিনে ভারত রাষ্ট্র এই কর্পোরেটদের অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি যত্নবান। ফলত কর্পোরেটের একচেটিয়া মুনাফার পথে যিনি বা যারা বাধা হবেন তাদেরকে ভারত রাষ্ট্র বিশেষ নজরে দেখবে। হয়তো এই মনোভাব থেকেই স্ট্যান স্বামীর ওপর দানবীয় ইউএপিএ আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিচারাধীন থাকাকালীন শারীরিক অসুস্থার কারণে( তিনি পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত্র ছিলেন) একাধিকবার তিনি জামিনের আবেদন করেছেন কিন্তু বারবার তার জামিনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। অথচ যেদিন তার জামিনের শুনানি ছিল সেদিনই তার মৃত্যু হয় এর থেকে বড় দুর্ভাগ্যের এবং হতাশার আর কিছু আছে বলে আমাদের মনে হয় না। স্ট্যান স্বামী তালোজা জেল থেকে চিঠিতে লিখেছেন “আমার প্রয়োজন সীমিত। আদিবাসীরা এবং দ্য সোসাইটি অফ জিসাস আমাকে সহজ জীবন যাপন শিখিয়েছে। জল ও চা পানের জন্য আমি নল-লাগানো পানপাত্র এনেছিলাম। কিন্তু ৯ অক্টোবর এখানে ঢোকার সময় জেলখানার গেটে সেটি বাজেয়াপ্ত করা হল। এখন আমি শিশুদের জন্য উপযুক্ত একটি চুষে পান করা পাত্র ব্যবহার করছি। এটি আমি জেল হাসপাতাল থেকে কিনেছি। আমি আমার এই প্রয়োজনটা আমাদের আইনজ্ঞদের জানিয়েছি। আমি এখনও আমার ওই নল-লাগানো পানপাত্রটা ফেরত পাবার অপেক্ষা করছি। ভারভারা রাও খুব অসুস্থ। দয়া করে ওঁর জন্য প্রার্থনা করুন। এই তালোজা জেলে গরিব কারাবন্দীদের জীবনের গল্প শোনাতেই আমার আনন্দ। আমি ওদের যন্ত্রণা ও হাসির ভেতর দিয়ে ঈশ্বরকে দেখতে পাই’’। আসলে স্ট্যান স্বামী ঈশ্বরের ধারণা কে শত শত যোজন দূরে অবস্থিত মহাকাশ এবং স্বর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি ঈশ্বরকে মর্ত্যে নামিয়ে এনেছিলেন। তাই তিনি গরীব প্রান্তিক আদিবাসীদের মধ্যেই সারা জীবন ঈশ্বরকে খুঁজেছেন আর জেলের গরীব কারাবন্দীদের যন্ত্রণা, হাসিতে দেখেছেন ঈশ্বরকে,ঈশ্বর পুত্রদের। তিনি মনে করতেন ঈশ্বর তার সকল সন্তানদের জন্য যে জঙ্গল প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন তার ওপর কতিপয় লোক নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় এদেরকে এই কাজে আটকে দেওয়াটাই স্ট্যান স্বামীর কাছে প্রকৃত ধর্ম বলে বিবেচিত হয়েছে। এইভাবে আমাদের দেশে একসময় পীর মাওলানা ভাসানী সাধারণ গরিব খেটে-খাওয়া মজলুম অত্যাচারিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এই ছিল স্ট্যান স্বামির কাজ এবং মানুষ বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে স্ট্যান স্বামী কেন রাষ্ট্রের কাছে বিপদজনক ? যে কোনো লড়াই বিশেষ করে তা যদি খেটে খাওয়া, প্রান্তিক গরীব মানুষের জন্য হয় তাহলে সেটা শুধুমাত্র আর্থিক দাবী দাওয়ার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এর সাথে নিজেদের হক বুঝে নেওয়ার উপযোগী চেতনা নির্মাণের বিষয়টিও যুক্ত থাকে। সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষ কতটা পরিমাণে নিজের দাবী আদায় করতে সক্ষ্মম, নাকি তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লড়াইয়ে বাইরে থেকে কোনো একজন ব্যক্তি এসে তাদের হয়ে তাদের অধিকারের জন্য কতটা লড়াই করতে পারে এইসব অনেক বড় বড় নিয়ে বিতর্ক আছে। কোনো একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বাইরে থেকে চেতনা নির্মাণ বা বাইরে থেকে চেতনা অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের মধ্যে আমরা যাচ্ছি না। তবে এই ধরনের বিতর্ককে সম্পূর্ণ পাশ কাটানো সম্ভব নয়। একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে স্ট্যান স্বামী গরিবের হয়ে, তাদেরকে নিজের আপন ভেবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। প্রান্তিক মূলনিবাসী মানুষের জন্য তার যে আত্মিক টান সেটাকে তিনি তার জীবনের শেষ দিন অবধি বজায় রেখেছেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের বিচারে স্ট্যান স্বামী দুই অর্থে রাষ্ট্রশক্তির কাছে বিপদজনক ছিলেন। এগুলি হল ক) স্ট্যান স্বামী দেখিয়েছেন কীভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রান্তিক, মূলনিবাসী, খেটেখাওয়া মানুষগুলোকে ধর্মের বিষবাষ্পে আবদ্ধ করে রেখেছে। এই ধর্মীয় বিষবাষ্পে বিভ্রান্ত করে রেখে তাদেরকে মূল আর্থ-সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তার ওপর তিনি আলোকপাত করেছেন এবং এই বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সোচ্চারও হয়েছেন। খ) নয়া উদারবাদী অর্থনীতি ও কর্পোরেটের অতি আগ্রাসন কীভাবে প্রান্তিক, মূলনিবাসী মানুষের জল- জমি, জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে নিজেদের বাসভূমি থেকে বিস্থাপন করার জন্য অতি তৎপর, আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন সেই বিষয়টিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে স্ট্যান স্বামী কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা জানি আজকের দিনে বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র প্রকৃতি অনুযায়ী ভারত রাষ্ট্র একদিকে নয়া-উদারবাদী এজেন্ডাগুলোকে খোলাখুলিভাবে লাগু করার জন্য বদ্ধপরিকর (আজকের দিনে গোপনে নয়)। আর অন্যদিকে এই কাজটিকে নিপুণভাবে করার জন্য ভারত রাষ্ট্র জনগণের সামনে ধর্মীয় মেরুকরণের এক মোটা দাগের বাতাবরণ তৈরি করেছে আর এই বাতাবরণের তলদেশ দিয়ে সূক্ষ্মভাবে গোটা দেশের সম্পদ কতিপয় বিত্তশালীদের হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ একদিকে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ অন্যদিকে নয়া- উদারবাদী রাজনীতি-অর্থনীতি এই দুইয়ের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অর্থে স্ট্যান স্বামী নিরপেক্ষ ছিলেন না, তিনি আদিবাসী মানুষের পক্ষেই কাজ করেছেন কারণ এই ধরনের নীতিসমূহের সবথেকে খারাপ প্রভাব পড়বে এই আদিবাসী, মূলনিবাসী প্রান্তিক মানুষদের ওপরে। এই প্রসঙ্গে আমরা স্ট্যান স্বামী কর্তৃক রচিত একটি প্রবন্ধের নাম উল্লেখ করতে পারি। প্রবন্ধটির নাম হল “হিন্দুত্বের ছাতার নিচে আদিবাসী সমাজের হিন্দুত্বকরণ”( ২০১৪)। এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “ হিন্দুত্ববাদী দলগুলো এবং অন্যান্য দলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ‘বনবাসী’ শব্দ ব্যবহার করে কারণ আদিবাসীরা ভারতের আদি বাসিন্দা এই সত্যটা স্বীকার করতে চায় না, যার অর্থ আর্যরা অনুপ্রবেশকারী। বদলে বনবাসী বলে তাদের প্রান্তিককরণ করা অনেক সুবিধাজনক, যার অর্থ তারা অসভ্য এবং বাস্তবত তারা আধুনিক সমাজের অন্তর্গত নয়। এই কারণেই যখন ঝাড়খন্ড রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছিল তখন এই একই হিন্দুত্ববাদী বাহিনী নামটি বনাঞ্চল হওয়া উচিত বলে হইচই শুরু করেছিল। জনগণের সোচ্চার দাবির ফলে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। কিন্তু এখনও তারা স্পষ্টই বলে যে আদিবাসীদের তারা সমতুল্য নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং তাদেরকে বনবাসী হিসেবে জঙ্গলে পাঠাবে”। তিনি আরও লিখেছেন হিন্দুত্ববাদীরা এই উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক হারে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে। মূলত “একল বিদ্যালয়ের” (যা আমেরিকায় বসবাসকারী হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা সৃষ্ট একল বিদ্যালয় ফাউন্ডেশনের অর্থে পরিচালিত হয়) মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে। বলাবাহুল্য সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একল বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০০০ (সূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনলাইন বাংলা সংস্করণ, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯) এটা যথেষ্ট চিন্তার কারণ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বেশকিছু জেলা এবং ঝাড়খন্ড সীমান্তবর্তী বেশকিছু জেলাতে এই ধরনের স্কুলের সংখ্যা বেশি পরিমাণে রয়েছে। স্ট্যান স্বামী লিখেছেন, একল বিদ্যালয়গুলিতে ইংরেজি বর্ণমালা শেখানোর জন্য শুধুমাত্র হিন্দু দেবতার নাম হুবহু ব্যবহৃত হয়। যেমন এ-তে অর্জুন, বি-তে ব্রম্মা , সি-তে কাউ, ডি-তে ধ্রুব। মজার কথা ‘ই’, ‘এফ’,’ কিউ’, ‘ডব্লিউ’, ‘এক্স’, ‘জেড’ প্রভৃতি অক্ষরগুলি অস্তিত্ব এই পুস্তিকাটিতে নেই, কারণ এই আদ্যক্ষর অনুযায়ী কোনো হিন্দু দেব-দেবী নাম সহজে পাওয়া যায় না। তাহলে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য কি এই প্রশ্নের উত্তর হল— হিন্দুত্ববাদীদের মূল লক্ষ্য হলো সমগ্র আদিবাসী সমাজকে হিন্দু করে নেওয়া। আর এই অশুভ প্রচেষ্টা আরএসএস এবং এই ধরনের সংগঠন গুলি করে থাকে।
স্ট্যান স্বামীর বিচার প্রক্রিয়াকে যদি খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করে করা যায় তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশে বিচার পদ্ধতি এবং আইনের শাসনের যে মূলনীতি রয়েছে অর্থাৎ জামিন পাওয়া হল অভিযুক্তের নায্য অধিকার জামিন না পাওয়াটাই ব্যতিক্রম এটা স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রে বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বত্রই স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক নীতিগুলিকে বারবার বাতিল করা হয়েছে। আমরা একটা সারণীর সাহায্যে স্ট্যান স্বামীর গ্রেপ্তার হওয়া থেকে জামিনের আবেদন থুড়ি মৃত্যু অবধি সম্প্রসারিত বিচারপ্রক্রিয়াকে তুলে ধরলাম।

তারিখ সমূহ               ঘটনার বিবরণ সমূহ

২২-০৮-২০১৮          ভীমা কোরেগাঁও মামলাতে দ্বিতীয় একটি এফআইআর-এর মধ্য দিয়ে স্ট্যান স্বামীর নাম প্রথমবার এই
মামলায়  অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অভিযোগ মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং দেশদ্রোহীতা ও প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার
ষড়যন্ত্র।
২৮-০৮-২০১৮         স্ট্যান স্বামীর রাঁচির বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি।
২৩-১০-২০১৮         এই অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য স্ট্যান স্বামীর আদালতের কাছে আবেদন।
২৬-১০-২০১৮         মহামান্য বোম্বে হাইকোর্টের দ্বারা পুলিশকে স্ট্যান স্বামীর গ্রেফতারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
০১-১১-২০১৮          বোম্বে হাইকোর্ট স্ট্যান স্বামীর গ্রেপ্তারের ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়।
২২-১১-২০১৮         এনআইএ দাবি করে স্ট্যান স্বামী সহ আরো অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উক্ত মামলায় যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
০৬-১২-২০১৯         স্ট্যান স্বামীর রাঁচির বাড়িতে পুলিশি হানা।
২৫-০১-২০২০         ভীমা কোরেগাঁও মামলা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএর) হাতে সমর্পণ।
০৮-১০-২০২০        এনআইএ কর্তৃক স্ট্যান স্বামী গ্রেফতার।
২৩-১০-২০২০        এনআইএ-র বিশেষ আদালত কর্তৃক স্ট্যান স্বামীর জামিনের আবেদন নাকচ (প্রথমবার)।
২৩-০২-২০২১        শারীরিক অসুস্থতার জন্য স্ট্যান স্বামীর এনআইএ-র বিশেষ আদালতের কাছে জামিনের আবেদন কিন্তু আবার
নাকচ (দ্বিতীয়বার )।
২৬-০৪-২০২১       স্ট্যান স্বামী কর্তৃক এনআইএর বিশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বোম্বে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন।
০৪-০৫-২০২১       বোম্বে হাইকোর্ট মহারাষ্ট্র সরকারকে বলে স্বামীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট অতিসত্বর জমা দিতে হবে।
১৫-০৫-২০২১       স্ট্যান স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ে।
২১-০৫-২০২১       স্ট্যান স্বামী আদালতে জানান তিনি অশক্ত ও খুব অসুস্থ ফলে তিনি হাঁটতে দাঁড়াতে পারছেন না। তার চিকিৎসা
প্রয়োজন।
২৮-০৫-২০২১       বোম্বে হাইকোর্টের স্ট্যান স্বামীকে বেসরকারি হাসপাতালে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান।
১৭-০৬-২০২১       অবশেষে হাসপাতালে প্রেরণ।
০৪-০৭-২০২১       স্ট্যান স্বামীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
০৫-০৭-২০২১       বোম্বে হাইকোর্টে স্ট্যান স্বামীর জামিনের আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়
০৫-০৭-২০২১      দুপুর দেড়টায় স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু

স্ট্যান স্বামীর বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে বার বার বিচারবিভাগের একটা অংশের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাষ্ট্রশক্তির স্বৈরাচারী- দাম্ভিকতা স্বীকার হয়েছে উক্ত সারণীর মাধ্যমে তা দিনের আলোর পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। স্ট্যান স্বামী যাতে কোনোভাবেই জামিন না পায় বা বাইরে বেরোতে না পারে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রশক্তি সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। স্ট্যান স্বামীসহ আরো অন্যান্য সমাজকর্মীদের যে সমস্ত মামলাতে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তার অন্যতম ভিত্তি ছিল এদের সকলের কম্পিউটারে নাকি নানান ধরণের দেশবিরোধী তথ্য পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময় আমেরিকা স্থিত একটি সংস্থা এই তথ্য সামনে আনে যে একটি সফটওয়্যার বা অ্যান্টিভাইরাসের মধ্য দিয়ে স্টান স্বামীদের কম্পিউটারে আপত্তিজনক তথ্যগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক কথায় বললে তাদের কম্পিউটার হ্যাক করে এই ধরণের বিপদজনক তথ্যগুলোকে তাদের কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং এই পরিপেক্ষিতে অন্যান্য অভিযুক্তরা দাবি করেছেন তারা নির্দোষ এবং তারা দেশবিরোধী, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র সহ কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভারত রাষ্ট্র মাওবাদী, আরবান নকসাল হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে এদের মুক্তি না দিতে অনড়। ভারত রাষ্ট্র এই ধরনের দানবীয় আইনকে ব্যবহার করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, দলিত, আদিবাসি, মূলনিবাসী মানুষদের প্রতি দরদী, বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষিত, এই ধরনের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষদের জেলে আটক করে রেখেছে। ভারত রাষ্ট্রের এই ভূমিকা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো, সংবিধানের পরিপন্থী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু আমাদেরকে গভীর হতাশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন ভারত রাষ্ট্র স্ট্যান স্বামীকে খুন করেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুকে বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যু বলেছেন, ইংরেজিতে বললে Judicial Death বলা যায়। আবার এই মৃত্যুকে অনেকে আইনের ভাষায় ‘ডায়াবলিক্যাল হোমিসাইড অ্যামাউণ্টিং টু মার্ডার’ বলেছেন। আবার অনেকে স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুকে রাষ্ট্র কর্তৃক একজন সংবেদনশীল, আদর্শ নাগরিকের পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত হত্যা বলেছেন। বিচারাধীন অবস্থায় স্বামীর এই মৃত্যুকে অনেকে গ্রেপ্তারীকৃত অবস্থায় মৃত্যুর এক নতুন উদাহরণ হিসেবে মনে করছেন। আবার অনেকে স্ট্যান স্বামীর বিচার প্রক্রিয়াকে এক্সিকিউটিভ জুডিশিয়ারি (executive judiciary) বলে চিহ্নিত করেছেন যেখানে বিচার বিভাগ শাসনবিভাগের বা নির্বাহিতন্ত্রের ন্যায় যান্ত্রিকভাবে কাজ করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ওয়াটালি জাজমেন্ট (২০১৯) (Watali Judgement) অনুযায়ী ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির পক্ষে জামিন পাওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফৌজদারি আইনের অন্যতম বিশেষজ্ঞ রেবেকা জন এই বিশেষ অবস্থাকে পর্যালোচনা করে লিখেছেন “the watali judgement effectively sanctions pretrial detentions and incentivizes prosecution under the statue”। সর্বোপরি বর্তমান সময়ে সুপ্রিম কোর্টে এই ধরনের রায় প্রদান করে সুপ্রিম কোর্টের তার পূর্বেকার অবস্থান থেকে অনেকটা সরে এসেছে। এই ক্ষেত্রে আদালত তার পূর্বেকার রায়কে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছে। বালচান্দ কেসে (১৯৭৮) সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল “bail is the rule and jail is the exception”। এইভাবে সুপ্রিমকোর্ট ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্যবোধসমূহ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মধ্যে যে ভারসাম্য রক্ষা করেছিল যা আজকের দিনে সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয়েছে। ভীমা কোরেগাঁও মামলাটি তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো অবধি সর্বমোট তিনটে চার্জশিট পেশ করা হয়েছে আর এর ভিত্তিতেই ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে স্ট্যান স্বামী গ্রেপ্তারাধীন অবস্থায় মারা গেছে, আর ভারভারা রাও জামিন পেয়েছে। কিন্তু বাকিরা কবে জামিন পাবে বা আদৌও পাবেন কিনা এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধোঁয়াশার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যা কোনোভাবেই আমাদের মত একটি উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক আইনের শাসন ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কাম্য নয়, বিশেষ করে আমরা যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পূতিতে পদার্পণ করেছি। এখন এটা আমাদের কাছে এত লজ্জার বিষয় বলে বিষয় পরিণত হচ্ছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

শেষের কথা

একথা অনস্বীকার্য যে ইউএপিএ ধাঁচের আরো অন্যান্য যে সমস্ত দানবীয় আইনসমূহ রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই কংগ্রেস আমলে প্রণীত হয়েছে। বিজেপি আমলে নয়। ইউএপিএ কার্যকারী হওয়ার পর থেকে এখনো অবধি মোট ছয়বার সংশোধিত হয়েছে। তারমধ্যে ২০১৯ সালের সংশোধনীটি মারাত্মক এবং দানবীয়, যেখানে কোনো একজন ব্যক্তিকে সরাসরি সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় এবং উক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নিজে নিরপরাধী। আবার এই নয়া সংশোধনী অনুযায়ী এনআইএ রাজ্য সরকারগুলোকে অন্ধকারে রেখে যে কোনো অঙ্গ রাজ্যের যে কোনো বিষয়ে সরাসরি তদন্তভার নিজের হাতে তুলে নিতে পারে এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্ষেত্রে একটা বড় আঘাত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এখন প্রশ্ন হল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কেন এমন ধরনের স্বৈরাচারী- দানবীয় উদ্ধত আইন প্রণয়ন করে। এর কোনো সহজ সোজা উত্তর আমাদের কাছে নেই। হয়তো রাষ্ট্র তার গঠন কাঠামো এবং তার অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদেই শুরু থেকেই এই ধরনের আইন সময়ে সময়ে তৈরি করেছে। বরং এই কথা বলা যায় এই ধরনের উদ্ধত, দানবীয় আইনের মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র নিজেকে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে যেটাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘অতিরাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করে থাকেন। স্ট্যান স্বামী এই’ অতিরাষ্ট্রের’ অতি দানবীয় কার্যকলাপের স্বীকার। তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না যে সারা পৃথিবী জুড়ে বিশেষত্ব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এবং আমাদের দেশে ২০০৮ সালে মুম্বাইতে সন্ত্রাসবাদী হানার ফলে সন্ত্রাসবাদকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্র এই ধরনের কঠোর আইন এবং বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। ফলত আজকের দিনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ-প্রতিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানবতার স্বার্থেই সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করতেই হবে এ নিয়ে কারুর মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু দেখা গেছে সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধের নামে যে সমস্ত আইন, বিধি-ব্যবস্থা তৈরি করা হয় তার অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, গণআন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার কর্মীদের ওপর প্রযুক্ত হয়, তখন এই ধরণের আইন তৈরী এবং তার সংশোধনীগুলো নিয়ে জনমানুষের ভ্রু কুচকানোর যথেষ্ট অবকাশ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যারা রাষ্ট্রের কার্যাবলী, রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদের ওপর এই ধরনের দানবীয় আইন নির্বিচারে প্রয়োগ করা হয়। বিজেপি অভিযোগ করে ইউপিএ ১ ও ২ এর সময় স্বামী অসীমানন্দ, সাধ্বী প্রজ্ঞানন্দ, কর্নেল পুরোহিত, ইন্দ্র কুমার এদেরকে হিন্দুত্ববাদী বা হিন্দু সন্ত্রাসবাদি তকমা দিয়ে নানাবিধ ধারা দিয়ে মক্কা মসজিদ মামলা, সমঝোতা এক্সপ্রেস সহ অনেক মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সেই সময় বিজেপির অভিযোগ ছিল এগুলো মিথ্যা এবং যথার্থ নয়। পরবর্তীকালে দেখা যায় ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এরা সকলেই জামিন পেয়ে যায়। সুতরাং সরকার এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যে এই নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ থাকবে। এর ফলে আমরা কখনও হিন্দু সন্ত্রাসবাদী বনাম আরবান নকশাল, মাওবাদী, আন্দোলনজীবী এই ধরনের নতুন নতুন শব্দ বন্ধনীর সাথে পরিচিত হচ্ছি। সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যম থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার বন্দির সংখ্যা ৭০ এর কাছাকাছি। মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত সূরের মতে পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার বন্দির সংখ্যা ৭২। রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে কাজে লাগিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা আবার কাউকে কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের রাজ্যে বিরল নয়। এই ক্ষেত্রে ছত্রধর মাহাতোর নাম উল্লেখ করা যায়। এইরূপ পরিস্থিতিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের সদাসর্বদা এই বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিৎ যে আমাদেরকে এমন এক পরিবেশ রচনা করতে হবে যেখানে উদ্ধত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা প্রাধিকার যেন কোনোভাবেই ব্যক্তি-স্বাধীনতা পরিসরকে বা ব্যক্তির মত প্রকাশের সুযোগকে সংকোচনের দিকে না এগোয়। তাই বলে আমরা নৈরাজ্যবাদী বা উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের মত এমন দাবি করতে পারি না বা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করার অনুকূল শর্তসমূহ বিকশিত করতে পারি না যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা প্রাধিকারের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এই সমস্যার সমাধানে অমর্ত্য সেন বর্ণিত স্বাধীনতার পাঁচটি শর্তকেই পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় বিকাশ সাধনে উপর জোর দিতে হবে। তাহলে উন্নয়ন স্বাধীনতা তথা স্ব-ক্ষমতার সমার্থক উঠবে। কারণ উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলো স্বাধীনতার পাঁচটি মাত্রার একযোগে বিকাশসাধন ও নিশ্চিতকরণ। পরিশেষে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ও সংবিধান প্রণেতারা সারা জীবন এই ধরনের দানবীয় ও অমানবিক আইনের বিরোধিতা করেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রাণাতিপাত লড়াই করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজকে আমরা তাদের তৈরি করা সংবিধানে সেই ধরনের অমানবিক, দানবীয় আইনগুলোকে যুক্ত করার এক উন্মত্ত খেলায় নেমেছি যা কোনোভাবেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংবিধানের মূল মর্মবাণী এবং ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্যের সাথে মানানসই নয়। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাধীন, নিরপেক্ষ কার্যকরী বিচার ব্যবস্থা এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। আর এটাই যেন আমাদের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের শপথ হয়।

উল্লেখপঞ্জি
অমর্ত্য সেন, উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা, আনন্দ পাবলিশার্স , ২০১৪
অনীক, মে ২০১৯, মে ২০২১, জুলাই ২০২১ সংখ্যা।
https://pib.gov.in/PressReleasePage.aspx?PRID=1581168
http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2019-08-03/201908022357003.jpg&category=0&date=2019-08-03&button=
https://eisamay.indiatimes.com/eisamaygold/current-affairs/who-is-responsible-for-the-death-of-stan-swamy/story/84168634.cms

The Dangers of UAPA Were Sown in Earlier Preventive Detention Laws in India

Preventive Detention Laws in India: A tool for executive tyranny?


https://m.thewire.in/article/rights/bhima-koregaon-case-trying-without-a-trial-is-the-intent-of-draconian-uapa-law
https://peoplesdemocracy.in/2021/0711_pd/persecution-stan-swamy
https://m-thewire-in.cdn.ampproject.org/v/s/m.thewire.in/article/rights/bhima-koregaon-case-trying-without-a-trial-is-the-intent-of-draconian-uapa-law/

2 years, 3 charge sheets & 16 arrests — Why Bhima Koregaon accused are still in jail

Gautam Navlakha had links with Pakistan’s ISI, says NIA in Bhima Koregaon chargesheet


https://scroll.in/tag/Elgar-Parishad
https://scroll.in/latest/1002471/elgar-parishad-case-nia-files-draft-charges-against-15-accused
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4538353836188684&id=100000423376473
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4356599441030792&id=100000423376473

[লেখক- সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, তেহট্ট সরকারি মহাবিদ্যালয়]

Facebook Comments

Leave a Reply