মালেগাঁও বিস্ফোরণ ২০০৬ ও ২০০৮ – হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস, ইউ-এ-পি-এ এবং ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির ভূমিকা – একটি তুলনামূলক আইনি আলোচনা : অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

ভূমিকা

সেপ্টেম্বর ২০০৬ ও সেপ্টেম্বর ২০০৮। দুই বছরের ব্যবধানে দুইটি বিস্ফোরণ-কাণ্ডে বিপন্ন হয় মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলায় অবস্থিত টাউন-শহর মালেগাঁও। এ বিষয়ে হেমন্ত করকরের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখা (এ-টি-এস) তদন্ত আরম্ভ করে। ক্রমে আনল্যফুল অ্যাক্টিভিটিস প্রিভেনশন অ্যাক্ট, ১৯৬৭ (ইউ-এ-পি-এ) আইনের ২০০৪ ও ২০০৮ সালে প্রণীত সংশোধনীর প্রসঙ্গে আসে সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আইনি ধাচাগত ও ফাংশন-গত আলোচনা। কোন চোখে এই প্রসঙ্গটিকে দেখছে ভারতের উচ্চ্ব তর বিচারালয়ের ন্যায়পীঠে আসীন ন্যায়াধীশবর্গ? কোন পথেই বা চলবে ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এন-আই-এ)-র কার্যক্রম?
এই লেখায় সেই দু’টি মালেগাঁও বিস্ফোরণ সংক্রান্ত দু’টি মামলার আদেশের আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসবে বিভিন্ন প্রসঙ্গ। যেমন আসবে কী ভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির এবং সেগুলির সদস্য-সভ্য-প্রচারক-বৃন্দের পক্ষে ইউ-এ-পি-এ আইনের নির্দিষ্ট ধারায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ সত্ত্বেও, সেই সূত্রে এন-আই-এর তদন্তে বারম্বার তাঁদের নাম উঠে আসা সত্ত্বেও, শাস্তি হয় না। তাই প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর-দের মতো ভারতবর্ষীয় গৈরিক সন্ত্রাসীদের পক্ষে কারামুক্তি ও অমিত রাজনৈতিক প্রতাপ-আহরণ কেবল এক বিদ্যমান সম্ভাবনাসূত্রই নয় – আজ তা ঘটমান বর্তমান।
কোথাও কোথাও হয়তো একই প্রসঙ্গ একাধিকবার ঢুকে পড়বে ন্যারেটিভ-এ। কিছু কিছু বিষয়ে বার বার বলার, লেখার, সময় চিরকাল হল, আগত।

আদেশ নং ১ –

তারিখ – ২৩শে এপ্রিল ২০১০
আদেশকারি আদালত – ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট, নয়াদিল্লী।
ঘটনা – মালেগাঁও সেপ্টেম্বর ২০০৬ বিস্ফোরণ।
অভিযুক্ত – জমির আহমদ, লতিফুর রহমান ও ১১ অপর ব্যক্তি।

মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার শহর মালেগাঁও-র প্রথম যে বিস্ফোরণে ৩৭ জন মারা যান, সেটি ঘটে ২০০৬ সালের ৮-ই সেপ্টেম্বর।

ঘটনার ঠিক ১ মাস ২ দিনের মধ্যেই এক মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছাত্র গ্রেপ্তার হলেন। তাঁর নাম নুরুল হুদা। একই সাথে আরো দুইজন সন্দেহভাজনের নাম ঘোষণা করলন তদনীন্তন মুম্বাই পুলিশের ডি-আই-জি শ্রী পি-এস পাসরিচা – সাবির ব্যাটারিওয়ালা এবং রইস আহমদ। প্রথমজন প্রাথমিক তদন্তে সনাক্ত হলেন লস্কর-তইবা-র সদস্য হিসেবে, দ্বিতীয়জন সিমি ছাত্রসংগঠনের সদস্য হিসেবে। এঁরা তিনজন ছাড়াও, গ্রেপ্তার হলেন আরো তিনজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি। অচিরে যোগ হলো। ২০০৭ আসতে না আসতেই তাঁরা সকলেই জেলে।

অথচ সেই পুলিশ-প্রসিকিউশন পক্ষের তদন্ত থেকেই ২০১৩-১৬ সালের মধ্যে ঘটনার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে নির্দোষ প্রতিপন্ন হলেন খালাস তাঁরা। ৬-৯ বছর বিনা অপরাধে জেল খাটার পর।

কীভাবে বেকসুর সাবিৎ হলেন তাঁরা? মূল কারণ এই যে, ১৯শে নভেম্বর ২০১০-এ হরিদ্বার থেকে গ্রেফতার হয়েছেন স্বামী অসীমানন্দ। সামনে এসেছে এই দুই বিস্ফোরণের পিছনে ‘অভিনব ভারত’ সহ ভারতীয় স্বয়মসেবক সংঘের ছত্রছায়ায় লালিত একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের যোগসাজশ।

২০১১ সালের ১৫-ই জানুয়ারি হরিয়ানার পঞ্চকুলা জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ভারতের ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড, ১৯৭৩-এর ধারা ১৬৪ অনুসারে কবুলনামা তথা স্বীকারোক্তি পেশ করেন স্বামী অসীমানন্দ। অবারিত হয় গৈরিক সন্ত্রাস কীভাবে ছড়িয়ে পরছে – তার নীল নক্সা। ক্রমশঃ উঠে আসতে থাকে আর-এস-এস, বজরং দল, অভিনব ভারতীর মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের নাশকতামূলক কার্যকলাপের প্রমাণাদি। দেখা যাচ্ছে কীভাবে অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় আর্মির কিছু ‘মেজর’ ও ‘কর্নেল’ বিভিন্ন সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা-সদস্যদের একাধিক প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে আগ্নেয়াস্ত্র চালনা ও বিস্ফোরক নির্মাণ ও নিক্ষেপের তালিম দিয়ে চলেছেন বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে। কীভাবে অবাধে আগ্নেয়াস্ত্র সাপ্লাই হচ্ছে বিভিন্ন শাখা-শিবিরে।
২০০৬-এর সেপ্টেম্বরে মালেগাঁও-এর প্রথম বিস্ফোরণ ঘটলে তার সরাসরি প্রভাবে ৩৭-জন মারা গিয়েছিলেন। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন ১০ জন, আহত সংখ্যা – ৮০।

ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এন-আই-এ)-র তদন্তে সরারসি যুক্ত হিসেবে উঠে এসেছে হালের বিজেপি লোকসভা সাংসদ প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর রমেশ উপাধ্যায়দের নাম – ইউ-এ-পি-এ-র একাধিক ধারায় ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগে চার্জশীট আনয়ন করেছে মহারাষ্ট্র অ্যান্টি-টেরর স্কোয়াড (এ-টি-এস)।

তবে, আমাদের আলোচ্য এই প্রথম জাজমেণ্ট-এ এই সকল তথ্য নেই। রয়েছে কিছু ‘পয়েন্ট অফ ল্য’ বিষয়ক চর্চা। সেইই চর্চা কি ধাচের ছিলো, তা জেনে রাখা জরুরী, কারণ, ২০০৪ ও ২০০৮ সালে ভারত সরকার প্রণীত দুটি সংশোধনী-র জেরে ইউ-এ-পি-এ আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপাধারায় সংযুক্ত হয়েছে একটি সেকালের হিসেবে কিছুটা নব্য ধারণা – ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ’।

সন্ত্রাস দমনে ইউ-এ-পি-এ আইনের ভূমিকা নিয়ে এই প্রথমালোচ্য মামলায় খতিয়ে আইনি পর্যালোচনা করলেন খোদ মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট। মামলার নাম – জামির আহমদ, লতিফুর রহমান শেখ বনাম মহারাষ্ট্র। সুপ্রিম কোর্ট কেসেস সাইটেসন – (২০১০) ৫ এস-সি-সি ২৪৬। মাননীয় ডিভিশন বেঞ্চ প্রণীত আদেশ।

আসলে, ২০০৪ ও ২০০৮ সালে, কিছু সংশোধন হয়ে গ্যাছে ইউ-এ-পি-এ আইনটির মুখবন্ধ তথা প্রি-অ্যাম্বল-এ। সংশোধিত হয়েছে আইনটির ব্যখ্যা-ধারা তথা ধারা ২-এর বেশ কিছু উপধারা। সাথে সাথে সংশোধিত হয়েছে ঐ আইনের ধারা ১৫ – ‘টেররিস্ট অ্যাক্ট’ – অর্থাৎ, সন্ত্রাসবাদী কে, তাঁর কোন আচরণ ‘সন্ত্রাস’ – তার চিহ্নায়ণ, থুড়ি, বৈশিষ্টায়ণ।

কি ছিলো সেই সব ‘সংশোধন’ – তা জানলে হয়তো আমরা নির্মোহ যুক্তি ও বিচার সহযোগে সামগ্রিক ভাবে একটা দর্পন তুলে ধরতে পারবো কোনো এক দিন – আশা। চোখ পাতি সুপ্রীম কোর্ট কেসেস-এর পাতায়।

জরুরি হয়ে দাঁড়ায় উপরোক্ত মামলার অনুচ্ছেদ ৭২ এবং অনুচ্ছেদ ৭৫-৮০ – সুপ্রীম কোর্ট কেসেস-এর e-মহাফেজখানায় নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদন অনুসারে।

সেদিনের ভারতীয় উচ্চ্বতম আদালতের মাহামান্য ডিভিশন বেঞ্চের সামনে পর্যালোচিত হয়েছিলো ইউ-এ-পি-এ এবং অন্য একটি আইনের মধ্যে একটা তুল্যমূল্য বিচার। সেই অপর আইনটি হলো – মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গ্যানাইসড ক্রাইমস অ্যাক্ট, ১৯৯৯ (এরপর থেকে – এম-সি-ও-সি-এ)। জামির আহমদ, লতিফুর রহমান শেখ বনাম মহারাষ্ট্র – (২০১০) ৫ এস-সি-সি ২৪৬ – আদেশের অনুচ্ছেদ ৬০ থেকে ৮০ অবধি মাননীয় বিচারপতি শ্রী মুকন্দকাম শর্মা এই এম-সি-ও-সি-এ আইন ১৯৯৯-এর প্রিঅ্যাম্বল এবং ইউ-এ-পি-এ আইন, ১৯৬৭-এর উত্তর-সংশোধনী প্রিঅ্যাম্বল – এই দু’টির তুল্যমূল্য, স্বচিহ্নিত ‘অ্যানালিসিস’ করেন।

প্রসঙ্গক্রমে, ইউ-এ-পি-এ-র মুখবন্ধ ও তার নব্য একবিংশ শতক-আনীত সংশোধনীদ্বয়ের সাথে সাথেই এসে পড়েছিলো একত্রিত ভাবে সংশোধিত ধারা ২-এর বিভিন্ন উপধারা, কিছুটা সংশোধিত ধারা ১৫-র প্রসঙ্গ।

আলোচ্য জাজমেণ্ট-এর অনুচ্ছেদ ৬৪-তে প্রথমবার এসে পরে ইউ-এ-পি-এর মুখবন্ধ বা প্রি-অ্যাম্বেল ও তার সংশোধনীর প্রসঙ্গ। কি ছিলো সেই সংশোধনী-তে যে তার আলোচনা জরুরি হয়ে পরেছিলো ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কাছে? এই অনুচ্ছেদ ৬৪ ও ৬৫ মিলে জানান দিচ্ছে তা –

অনুচ্ছেদ দুটির একটি আনকোরা অনুবাদ দেওয়া হলো নীচে –

মামলা নং – (২০১০) ৫ এস-সি-সি ২৪৬, অনুচ্ছেদ ৬৪,

“২০০৪ সংশোধনীর পূর্ব্বকালে ইউ-এই-পি-এ আইনে সন্ত্রাসবাদ (‘terrorism’) এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ (‘terrorist activities’) বিষয়ক কিছু ছিলো না। ২০০৪ সালের সংশোধনী মারফৎ সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ রোধ করতে নতুন কিছু অংশ জোড়া হয় ইউ-এ-পি-এ আইনে। আইনের মুখবন্ধ (‘Preamble’)-টি-র-ও রদবদল করা হয়, যে রদবদলের পর সেই মুখরায় এই আইনের উদ্দেশ্যসমূহের সাথে সংশোধিত হয়েছে কিছু ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত (‘individuals and associations’) বেআইনি কার্যকলাপ নিবারণ করার জন্য এবং প্রাসঙ্গিক ভাবে জড়িত বিষয়সমূহের সাপেক্ষে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপসমূহ (‘terrorist activities’) যাতে অধিকতার কার্যকরি ভাবে প্রতিহত করা যায় (‘more effective prevention’) – সেই উদ্দেশ্যে।”

মামলা নং – (২০১০) ৫ এস-সি-সি ২৪৬, অনুচ্ছেদ ৬৫,

“[২০০৪-এর সংশোধনীর পর,] ২০০৮ সালে পুণরায় সংশোধিত হয় মুখবন্ধ (‘Preamble’)। অতএব, বর্তমানে এই মুখরায় উল্লেখ্য হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা ২৮/০৯/২০০১ তারিখে প্রণীত একটি প্রস্তাবের প্রসঙ্গ। উল্লিখিত হয়েছে উক্ত নিরাপত্তা পরিষদ পারিত অপরাপর কিছু প্রস্তাব। সেই সকল প্রস্তাবে জাতিসংহের সদস্য দেশগুলির কিছু সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা (‘to take action against certain terrorist and terrorist organisations’) বলা ছিলো। সেখানে [আলোচ্যমান ২০০৮-সংশোধিত মুখরা, ইউ-এ-পি-এ, ১৯৬৭-তে] আরো উত্থাপিত হয়েছে [ভারতীয়] কেন্দ্র-সরকার দ্বারা আনীত একটি বিশিষ্ট নির্দেশিকা (‘Order’) – প্রিভেনশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অফ টেররিসম (ইমপ্লিমেন্টেশন অফ সিকিউরিটি কাউন্সিল রেসলিউশানস) নির্দেশিকা, ২০০৭ – যা আনীত হয়েছিলো [ভারতের কেন্দ্রীয় আইন] জাতিসংঘ (নিরাপত্তা পরিষদ) আইন, ১৯৪৭ এর ধারা ২-দত্ত ক্ষমতাবলে।”

এই অবধি বলেই কিন্তু ইউ-এ-পি-এ আইনের মুখবন্ধ তথা প্রিঅ্যাম্বল ও তার সংশোধনী বিষয়ক আলোচনায় ইতি টানেন নি সেই দিনের সেই কোর্ট, উক্ত মাননীয় বিচারকপ্রবর। তার ঠিক পরের অনুচ্ছেদেই তিনি মেলে ধরলেন সেই ২০০৪ ও ২০০৮ এর সংশোধনি-সমূহের পরে কেমন দেখায় সেই প্রিঅ্যাম্বেল –
আসুন, এই মওকায় আমরাও দেখে নি কেমন সেই ইউ-এ-পি-এ আইনের উত্তর সংশোধিত মুখবন্ধ, যা মূল আইনটির গৌরচন্দ্রিকা টেনে দিচ্ছে? তায় এখন কিমদোপায়ে শোভা পাচ্ছে জাতিসংহ নিরাপত্তা পরিষদ আনীত বিভিন্ন প্রস্তাবনার ভিড়? –

যেমন, ইউ এ পি এ আইনের মুখবন্ধ আজ বলছে, ৯/১১-এর ঘটনার ঠিক একুশ দিন পর, ২৮/০৯/২০০১ তারিখে, জাতিসংহ নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা স্বীয় ৪৩৮৫-তম বৈঠকের অবসানে, জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায় অনুসারে পারিত ২০০১ সনের প্রস্তাবনা নং ১৩৭৩-র কথা। ইউ-এ-পি-এ আইনের মুখবন্ধে আরো চিহ্নিত রয়েছে জাতিসংহের অন্যান্য কিছু প্রস্তাবনা-সমূহ – ১২৬৭(১৯৯৯), ১৩৩৩(২০০০), ১৩৬৩ (২০০১), ১৩৯০ (২০০২), ১৪৫৫(২০০৩), ১৫২৬(২০০৪), ১৫৬৬(২০০৪), ১৬১৭(২০০৫), ১৭৩৫(২০০৬) এবং ১৮২২(২০০৮)

অর্থাৎ, যদিও টুইন টাওয়ার পতনের পর থেকেই যে এই ‘টেরর-ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ গঠনের হিড়িক-এ জোয়ার লেগে রয়েছে, তার দুনিয়াব্যাপ্ত তদ্বির জাতিসংহ স্তরে নব্বুইয়ের দশকের শেষপাদ থেকেই টের পাওয়া যেতে থাকছিলো।

আলোচ্য জাজমেণ্ট তথা আদেশ নং – (২০১০) ৫ এস-সি-সি ২৪৬ অনুচ্ছেদ নং – ৭৫ মারফৎ ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট যা জানান দিচ্ছে, তা প্রয়োজনীয় এবং অনুরূপ –

“ইউ-এ-পি-এ-র উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসবাদী এবং কিছু বেআইনি কর্যকলাপ প্রতিহত করা যা ভারতের ঐক্য, অখণ্ডতা, নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত করছে, অথবা যার উদ্দেশ্য হলো ভারতের জনগণকে অথবা ভারতের এবং বিশ্বের জনগণের কোনো অংশকে সন্ত্রস্ত করা, অথবা, ভারতের কোনো অঞ্চল পৃথকীকরণের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে”

আলোচনার এই অংশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর নিরিখে। এই অংশ থেকে স্পষ্ট ভারতরাষ্ট্র এই ইউ-এ-পি-এ আইনটিকে কোন চোখে দেখছে। মূল জাজমেণ্ট-এর অনুচ্ছেদ ৭৫-এর যে অংশে ইউ-এ-পি-এ আইনের উদ্দেশ্য ব্যখ্যায়িত হয়েছে তা মূল ইংরেজি ভাষ্যেও দেওয়া হলো তাই –
The aim of UAPA, is to deal with terrorist and certain unlawful activities, which are committed with the intent to threaten the unity, integrity, security or sovereignty of India or with the intent to strike terror in the people or any section of the people in India or in any foreign country or relate to cessation or secession of the territory of India.
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আলোচিত সুপ্রীম কোর্ট জাজমেন্ট এই অনুচ্ছেদেই এম-সি-ও-সি-এ আইন, ১৯৯৯ এবং ইউ-এ-পি-এ, ১৯৬৭ – এই দুই আইনের মূল উদ্দেশ্যগত ব্যবধান তুলে ধরছে এই ভাবে, যে, ১৯৯৯-এ প্রণীত মহারাষ্ট্রের আইনটির মূল উদ্দেশ্য সন্ত্রাসবাদ দমন নয়, বরং, সংগঠিত অপরাধ-‘সিন্ডিকেট’ বা ‘গ্যাং’ দ্বারা কৃত অপরাধমূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ।

মূল ইংরেজি ভাষ্যে, ওই একই অনুচ্ছেদে তুলনামূলক বিচারের খাতিরে এম-সি-ও-সি-এ ১৯৯৯ আইনের মৌলিক উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে এই আলোচ্য সুপ্রীম কোর্ট জাওমেণ্ট-এর একই অনুচ্ছেদ নং ৭৫ এর নির্দিষ্ট অংশ তুলে ধরে হ’লো –
“So far as Mcoca is concerned, it principally deals with prevention and control of criminal activity by organised crime syndicate or gang within India and its purpose is to curb a wide range of criminal activities indulged in by organised syndicate or gang.”

আদেশ নং ২ –

তারিখ – ১১ই অক্টোবর, ২০১৩
আদেশকারি আদালত – বম্বে হাই কোর্ট।
ঘটনা – মালেগাঁও ২০০৬ এবং ২০০৮ বিস্ফোরণ।
অভিযুক্ত – প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, অবসরপ্রাপ্ত মেজর রমেশ উপাধ্যায়, প্রমুখ।

২০০৬ এর পর ২০০৮। বিস্ফোরণে আবার কেঁপে ওঠে মালেগাঁও, নাসিক, মহারাষ্ট্র, ভারত। সেই নিয়ে এইবারে তথ্যনির্ভর বয়ান ফুটে উঠতে দেখা যাবে মাননীয় বম্বে হাই কোর্ট-এর রাষ্ট্রস্বর-মারফৎ।

২০১১-র পর, এবার, ২০১৩। এবারের বিচারালয় বম্বে হাই কোর্ট। এবারেও ডিভিশন বেঞ্চ। মাননীয় বিচারপতি দুইজন – এস-সি ধর্মাধিকারি এবং এস-বি শুক্রে। তবে এবারে অভিযুক্তগন মুসলমান ধর্মাবলম্বী নন। গৈরিক সন্ত্রাস তত দিনে বাস্তবায়িত ও প্রসারমাণ ভারতের আকাশে।

২০০৬ সালের ৮-ই সেপ্টেম্বরের ঠিক ২ বছর ২১ দিন পর ২০০৮ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বরে আবার নাসিক জেলার শহর মালেগাঁও কেঁপে উঠেছিলো বিস্ফোরণে।

পুলিশি অনুসন্ধানে এগিয়ে এলো মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখা (অ্যান্টি-টেররিসম স্কোয়াড বা এ-টি-এস)। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই যথাযথ ইনভেস্টিগেশন সুনিশ্চিত করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এলেন স্বনামধন্য পুলিশ অফিসার প্রয়াত শ্রী হেমন্ত করকরে।
মালেগাঁও-র এই দ্বিতীয় বিস্ফোরণ কাণ্ড ঘটে ২০০৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর। অথচ, শেষমেশ, ইউ-এ-পি-এ আইন ১৯৬৭-এর নব-সংশোধিত ধারা ২, ধারা ১৫ সহ একাধিক ধারা এবং বিস্ফোরক পদার্থ আইন, ১৯০৮ এবং অস্ত্র আইন, ১৯৫৯-এর একাধিক ধারায় চার্জশীট জমা পড়লো। মালেগাঁও-র আজাদনগর থানা শেষমেশ গিয়ে চার্জশীট পেশ করলো ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ – ঘটনার ১১ দিন পর।

চার্জশীটে উঠে এলো অভিযুক্ত প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, রমেশ উপাধ্যায় সহ রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সংঘের আঞ্চলিক শাখার ১১-জন তালিমপ্রাপ্ত হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী। ইউ-এ-পি-এ আইনের ধারা ১৫ ছাড়াও সেই আইনের ধারা ১৬-১৮, ২০ এবং ২৩ অনুসারে সন্ত্রাসমূলক অপরাধের অভিযোগ উঠলো সেই গৈরিক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।

অর্থাৎ, আজকের লোকসভা সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর ও সেই বাকি ১০ রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবা সমিতির মদতপুষ্ট অভিযুক্ত-সন্ত্রাসীদের নামে ইউ-এ-পি-এ আইন-এর ঠিক যে যে ধারা লেগে গ্যালো পুলিশি অনুসন্ধান-মারফত আনীত চার্জশীট-এ, সেগুলি হলো –

ধারা ১৫-১৬ – সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও সেই কার্যকলাপের শাস্তি – ঘটনার ফলে যেহেতু প্রাণহানী ঘটেছে, সেহেতু এই সাজার পরিমাপ, অপরাধ প্রমাণে, মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ফাইন সহ।

ধারা ১৭ – সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য চাঁদা তোলা। দোষী সাব্যস্ত হলে সাজা – অন্যূন ৫ বৎসরকাল থেকে যাবজ্জীবন অবধি কারাদণ্ড, ফাইনসহ।

ধারা ১৮ – সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ষড়যন্ত্র – এই ক্ষেত্রেও, অপরাধ প্রমাণে অন্যূন ৫ বৎসরকাল থেকে যাবজ্জীবন অবধি কারাদণ্ড, ফাইনসহ।

ধারা ২০ – সন্ত্রাসবাদী গ্যাং অথবা সংগঠনের সদস্য হওয়ার অপরাধ – অনির্দিষ্টকালীন কারাবাস যা যাবজ্জীবন অবধি হতে পারে।

ধারা ২৩ – বর্ধিত শাস্তি – অপরাধ প্রমাণে অন্যূন ৫ বৎসরকাল থেকে যাবজ্জীবন অবধি কারাদণ্ড, ফাইনসহ। এইখানে নির্দিষ্ট করা রয়েছে যে যাবজ্জীবন অর্থে দশ বছর।

ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবনে প্রয়োজনীয় তথ্য ফুটে উঠতে থাকে হাই কোর্ট আদেশের ছত্রে ছত্র। মালেগাঁও-এর প্রথম নয়, দ্বিতীয় বিস্ফোরণের পর তদন্ত আরম্ভ হয়েছিলো সন্ত্রাসে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে। প্রাথমিক ভাবে সেই এম-সি-ও-সি-পি আইন, ১৯৯৯ অনুসারে গঠিত বিশিষ্ট আদালতে সামনেই চার্জশীট জমা করলো মহারাষ্ট্র পুলিশ।

তবে, এই দ্বিতীয় মালেগাঁও বিস্ফোরণের ঘটনার ঠিক ২ মাস ৮ দিনের মাথাই মুম্বাই শহরে চললো আরেক সন্ত্রাসবাদী তাণ্ডব। তাজ হোটেলের কোনো আলিন্দে এনকাউণ্টারে লুটিয়ে পড়লেন মালেগাঁও মামলায় মূল তদন্ত করছিলেন সেদিনের যে পুলিশ অফিসার – হেমন্ত করকরে। সামগ্রিক তিনদিনব্যাপী ঘটনায় উত্তাল হলো দেশ। ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই এসে গ্যালো এন-আই-এ আইন, ২০০৮। ভারতীয় সংসদের সকল রাজনৈতিক দল মোটমাট সমর্থন করলো সেই আইন – সেদিনের সেই রাজনৈতিক আবহে।
মিডিয়া-নামাঙ্কিত সেই ‘২৬/১১ মুম্বাই হামলা’-র জেরে জনমানস তথা মিডিয়া-দর্পণে আবছা হলো মালেগাঁও বিস্ফোরণের ছায়া।
অথচ, মালেগাঁও বিস্ফোরণের ইনভেস্টিগেশন চরমভাবে প্রভাবিত হলো তার ২ মাস ৮ দিন পরের মুম্বাই হামলার কাণ্ড ও সেই কাণ্ডের বিভিন্ন ফলশ্রুতির কারণে। হেমন্ত করকরের মৃত্যুতে চ্ছেদ পড়লো মালেগাঁও হামলার তদন্তে, ট্রায়াল আরম্ভ হওয়ার বহু আগের থেকেই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে ২০০৯ সালেই এম-সি-ও-সি-পি আইন, ১৯৯৯ থেকে ও সেই আইনের অধীনে গঠিত কোর্ট থেকে প্রজ্ঞা ঠাকুর, কর্নেল পুরোহিত, মেজর উপাধ্যায়দের বিরুদ্ধে আনীত এ-টি-এস পরিচালিত মামলা চালান হলো সেদিনের নব-প্রণীত ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি আইন, ২০০৮-এর আওতাধীন ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির তদন্ত-আওতায় এবং নির্দিষ্ট এন-আই-এ কোর্ট-এ।

সেই এন-আই-এ কোর্ট এ মামলা চালান হওয়ার বিষয়ে রিট পিটিশন-কারি হিসেবে সেদিনের মুম্বাই হাইকোর্টের সামনে হাজির হয়েছিলেন অভিযুক্তবৃন্দ। বিষয়টি ক্যানো এন-আই-এ আইন, আদালত ও তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের আওতাধীন, তার সমর্থনে মাননীয় আদালত সমক্ষে অ্যাফিডেভিট রাখলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ, এন-আই-এ, নয়াদিল্লী।

মাননীয় বম্বে হাই কোর্ট প্রণীত ২০১৩ সালের ১১ই অক্টোবরের আলোচ্য এই আদেশনামায় ঈষৎ বিশদায়িত হয়েছে ঘটনাক্রম।
২০১০-এর নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হন স্বামী অসীমানন্দ। ২০১১-র ১৫ই জানুয়ারি পঞ্চকুলা জেলার চিফ জ্যুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জমা পড়লো উক্ত স্বামীজ্বির স্বীকারোক্তি। প্রথম মালেগাঁও বিস্ফোরণ এর ও ৪-৫ বছর পর থেকে এন-আই-এর তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ্য হয়ে উঠতে থাকে ২ বছরের ব্যবধানে ঘটা মালেগাঁওয়ের দুইটি বিস্ফোরণের সাথেই যুক্ত আর-এস-এস এর ছত্রছায়ায় লালিত মিলিট্যাণ্ট হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী ‘বজরং দল’ ‘অভিনব ভারত’-দের সন্ত্রাসবাদী ভূমিকা, উঠে আসতে থাকে প্রজ্ঞা ঠাকুর, ‘মেজর’ উপাধ্যায়-দের নামে।

চোখ ঠিকরে যেতে থাকে বম্বে হাইকোর্টে পারিত আলোচ্য এই জাজমেণ্ট-এর পাতায় পাতায়।

প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর এবং অন্যান্য বনাম মহারাষ্ট্র পুলিশ এ-টি-এস। মামলা নং – ২০০৩ (৬) অল ইন্ডিয়া রিপোর্টার (এ-আই-আর) ‘আর’ – ১১৭১। এ-আই-আর ব্যাতিরেকে অপর প্রমুখ মহাফেজখানা সুপ্রীম কোর্ট কেসেস এর নম্বরি হিসেবে, মামলা নং – ২০১৩ এস-সি-সি অনলাইন বম. ১৩৫৪। অদ্ব্যর্থবোধক ভাষ্যে রাষ্ট্রস্বর ব্যক্ত হতে থাকে – লিপিবদ্ধ হতে থাকে এই সকল কোল্ড ফ্যাক্টস – আদালতের আদেশনামা-বয়ানে।

তবে, এই ক্রিমিনাল রিট পিটিশানে কোর্টের সামনে অভিযুক্তগণ দোষী না নির্দোষ তা বিচার্য্য ছিলো না। বিচার্য্য ছিলো অন্য কিছু। সেই ‘অন্য কিছু’-র প্রসঙ্গেই আবার এসে পরবে সেই এম-সি-ও-সি-এ আইন, ১৯৯৯ ও ইউ-এ-পি-এ, ১৯৬৭-র মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার।

কেন আসবে? না, এম-সি-ও-সি-পি ১৯৯৯-এর আইনের ‘অর্গানাইসড ক্রাইম’ তথা ‘ক্রিমিনাল গ্যাং’-দের কার্যকালাপ বনাম ২০০৪ ও ২০০৮ এর যুগল-সংশোধনী মারফৎ ইউ-এ-পি-এ আইনের মুখবন্ধে রদবদল, ধারা ২-এর বিভিন্ন উপধারা এবং ধারা ১৫ সংযোজন ঘটে, এবং তার ফলে যে ‘টেররিস্ট’ নামের একটা ক্যাটেগরি তৈরি হয়ে যায় ভারতীয় আইনব্যবস্থায়, সেই ‘টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটি – এই দু’য়ের মধ্যে ফারাক, যা ২০১০ সালে সুপ্রীম কোর্ট দ্বারা বিবেচ্য ও আলোচিত হয়েছিলো জামির আহমদ লতিফুর রহমান শেখ বনাম মহারাষ্ট্র, সাইটেশন – – (২০১০) ৫ সুপ্রিম কোর্ট কেসেস ২৪৬, মারফৎ, তা আবার প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত হলো বম্বে হাই কোর্ট-এর সামনে।

কী ভাব-এ এই পুরুত্থাপন? আরেকবার চোখ বোলানো যাক ঘটনাক্রমের দিকে –
মালেগাঁও-এ দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার বোমা পরার দুই মাসের মধ্যেই মুম্বাই শহরে ২৬ থেকে ২৯শে নভেম্বর, ২০০৮-এর কুখ্যাত নাশকতামূলক হামলা চললো। তার দুই মাসের মধ্যে, অর্থাৎ, ২০০৯ সাল আরম্ভ হতে না হতেই, বিনা প্রতিরোধে ভারতের পার্লামেন্ট-এ পাশ হয়ে গ্যালো ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি আইন, ২০০৮। গঠিত হলো ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি।

এদিকে প্রজ্ঞা ঠাকুরদের বিরুদ্ধে আনীত মূল ফৌজদারি মামলার দায়ভার এম-সি-ও-সি-পি থেকে চালান হয়ে গ্যালো সেদিনের সেই নবগঠিত ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সির আওতায়। এরই বিরুদ্ধে বম্বে হাই কোর্ট-এ রিট পিটিশন আনলেন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর এবং ‘মেজর’ উপাধ্যায়।
আসুন চোখ রাখি সেই রিট পিটিশানের যে চুড়ান্ত আদেশ পারিত হলো ২০১৩ সালের ১১-ই অক্টোবর বম্বে হাই কোর্ট-এর ডিভিশন বেঞ্চ মারফৎ, তার অনুচ্ছেদ নং ২২-এর দিকে। সেইখানে প্রকাশ পাচ্ছে এন-আই-এ-র সপক্ষে এন-আই-এ পুলিশ সুপার রাষ্ট্রের তরফ থেকে যে বয়ান দিচ্ছেন, তা – কাঁচে হাতে প্রাসঙ্গিক অংশটুকু অনুবাদ করলাম। এইখান থেকে স্পষ্ট হবে এন-আই-এ আইন ও ইউ-এ-পি-এ আইনের মধ্যেকার ঐকান্তিক ও পারস্পরিক আইনি সম্পর্কের ধরণ-ধারণ –

প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর এবং অন্যান্য বনাম মহারাষ্ট্র পুলিশ এ-টি-এস, মামলা নং – ২০১৩ এস-সি-সি অনলাইন বম. ১৩৫৪, অনুচ্ছেদ নং ২২

“এন-আই-এ আইনের তফশিল দ্বারা নির্দিষ্ট একটি আইন হল ইউ-এ-পি-এ। এই আইন যে বিষয়ে কার্যকরী তা হলো কীভাবে ক্রস-বর্ডার এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন। শুধু ভারতের ভিতরেই না, ভারতের আন্তর্জাতিক সীমারেখা অপেক্ষা বৃহত্তর পরিসরেও এই আইন কার্যকরী। [তদন্তে] সংগৃহীত তথ্যসমূহ গোপনীয় এবং সংবেদনশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে (‘confidential and sensitive’)। অপরাধীদের পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির আসতে পারে এই ধরণের তথ্য ফাঁস হলে। ফলতঃ এনআইএ -এর কার্যকারিতা বজায় রাখতে এই তথ্য জনসাধারণের জ্ঞান হওয়ার উপযুক্ত নয়। এনআইএ আন্তঃ-সীমান্ত সন্ত্রাস (‘cross border terrorism’) সম্পর্কিত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবযুক্ত মামলাগুলি নিয়ে কাজ করে। এন-আই-এ-র গোয়েন্দাদের সংগৃহীত তথ্যাবলির মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নকশা, পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি। তা প্রকাশের ফলে তথ্যদাতাদের পাশাপাশি মামলার তদন্তকারীদের নিরাপত্তা প্রভাবিত হতে পারে। তদন্তে তার বিরূপ প্রভাব পরতে পারে। এমনকি, তা জনশৃঙ্খলা/জাতীয় সুরক্ষাকে প্রভাবিত করে ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই সকল সংবেদনশীল এবং গোপনীয় তথ্য কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে সংগৃহীত। সেই ধরনের তথ্য প্রকাশের ফলে দেশগুলির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রভাবিত হতে পারে এবং কূটনৈতিক প্রটোকল লঙ্ঘন হতে পারে।”

এই অংশ গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে এন-আই-এর তদনীন্তন সর্বভারতীয় প্রধানের বয়ানে, এবং বম্বে হাই কোর্টের বুননে, আমরা জানতে পারছি এন-আই-এ আইন এবং ইউ-এ-পি-এ-র মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক। দেখছি ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি কোন চোখে দেখছে ইউ-এ-পি-এ-কে। আরো দেখছি, রাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস’-এর, তথা ইউ-এ-পি-এ আইনের আওতায় প্রণীত চলমান তদন্তের ক্ষেত্রে ক্যানো কোনো রকমের কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করে।

উপসংহার

মালেগাঁও-এর প্রথম বিস্ফোরণ-এ যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০০৭ সাল আসতে না আসতেই ১৩-জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি গ্রেফতার হন। তাঁদের মধ্যে সিংহভাগের, অর্থাৎ ৯-জন-এর কারামুক্তি হতে হতে ২০১৬ সাল হয়ে যায়। ইতিমধ্যে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সংঘটিত মালেগাঁও-এর সেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণের পর থেকেই সাধ্বী প্রজ্ঞা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর রমেশ উপাধ্যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত প্রসাদ পুরোহিত, স্বামী অসীমানন্দ প্রমুখের নাম রাষ্ট্রীয় তথা পুলিশ তথা জাতীয় গোয়েন্দাসংস্থার তদন্তে উঠে আসতে থাকে।

সাথে সাথে, দুই বিস্ফোরণের সাথেই থেকেই হিন্দুত্ববাদী একাধিক সংগঠনের যোগসাজশের কথাও ২০১০ সালে স্বামী অসীমানন্দের গ্রেফতার ও আইনি স্বীকারোক্তির ফলে খোলসা হয়ে উঠতে থাকে। জানা যায় অভিনব ভারত, বজরং দল, আর-এস-এস, আখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে-দের এই গৈরিক সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত থাকার কথা। কিন্তু, প্রাথমিক ভাবে প্রথম বিস্ফোরণের সূত্রে যে ১১ জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি যাঁরা ২০০৭ সালের আগেই গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৩-র শেষের দিকে গিয়ে ছাড়া পেলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন। বাকিদের ছাড়া পেতে পেতে ২০১৬ এসে যায়।

ইতিমধ্যে সুপ্রীম কোর্টের ২০১০ সালের যে জাজমেণ্ট-টি আলোচিত হলো সবার প্রথমে, সেইটির নিদান অবলম্বন করেই ২০১৫ সালে মাহমান্য ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের দ্বিজাজবিশিষ্ট মাননীয় বেঞ্চ এই মর্মে নিদান দিলেন, আদেশ নং ২০১৫ (৭) সুপ্রীম কোর্ট কেসেস ৪৪০ মারফৎ, যে, মালেগাঁও বিস্ফোরণ ছাড়াও ২০০৩ সালের যে পরভানি বিস্ফোরণের সাথে তাঁর নাম জড়িয়ে ছিলো সেটির খাতেও কারামুক্তি চুড়ান্ত হলো মালেগাঁও মামলায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের প্রধানতম অভিযুক্ত তথা হিন্দুজঙ্গী গোষ্ঠী অভিনব ভারত-এর প্রতিষ্ঠাতা তথা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত প্রাসাদ পুরোহিতের।

মালেগাঁও মামলা প্রসঙ্গে ২২শে এপ্রিল ২০১৭-এ বম্বে হাই কোর্ট জামিন মকুব করে বর্তমান সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের। উক্ত মাননীয় বর্তমান লোকসভা সাংসদের বিরুদ্ধে সুনীল যোশী নামের অপর এক আর-এস-এস প্রচারককে খুন করার অভিযোগে চার্জশীট পরেছিলো মধ্যপ্রদেশ পুলিশ-মারফৎ। মহারাষ্ট্রে ঘটা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বিষয়ক তদন্তের পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশে সংঘটিত ওই খুনের অভিযোগ-খচিত চার্জ-শীট-এর ভিত্তিতে খাতায় কলমে কিছুকাল তদন্ত করে এন আই এ ২০১৩ সালের মধ্যেই অবশ্য সংশ্লীষ্ট ন্যায়পীঠের নির্দিষ্ট মাননীয় ন্যায়মূর্তি-সমীপে জানান দেয় যে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে সেই খুনের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও প্রমাণ-অযোগ্য।

[লেখক – পেশায় আইন- ও কলমজীবি।]

Facebook Comments

Leave a Reply