আফজল গুরু-র ফাঁসি – একটি আইনি আলোচনা : অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
[অতীন্দ্রিয় পেশায় আইন- ও কলমজীবি। কলকাতায় বাড়ি ও বর্তমানে কাজের জায়গা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পীপলস ইউনিয়ন অফ সিভিল লিবার্টি-র একটি দলের সাথে হাফতাখানেক কাশ্মীর উপত্যকার আজাদি-স্পর্ধিত বিভিন্ন অস্থির অঞ্চলে কাজের সূত্রে গিয়ে, সেখানের নানান বন্ধুবান্ধবদের সাথে থেকে, কথা বলে, জেনে-দেখে-শুনে-বুঝে-চলে-ফিরে অনুপ্রেরণা আহরণ ও সেই থেকে আজাদির আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছেন। সে’সকল উৎস থেকে তিনি আইনি পর্যালোচনা করেছেন আফজল গুরুর ফাঁসির আদেশের। ‘অপরজন’-এর পাতায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সেই আইনি পর্যালোচনা। এই সংখ্যায় চতুর্থ তথা অন্তিম পর্ব।]
আফজল-কর্তৃক পুলিশ সমীপে ‘মৃত-টেররিস্ট’-দের লাশ-শনাক্তিকরণ
তবে হ্যাঁ, পুলিশি বয়ানে প্রতিভ – ১৭-ই ডিসেম্বর ২০০১-তে, অর্থাৎ পার্লামেণ্ট হামলার চার দিন পরে দিল্লির ‘এল-এইচ কলেজ হাসপাতাল’-এর মর্গ’-এ নিয়ে যাওয়া হয় আফজল গুরু-কে, যেখানে তিনি তদনীন্তন ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সামনে সনাক্ত করেন মহম্মদ ছাড়া-ও বাকি তিন শহীদ তথা ‘মৃত-টেররিস্ট’-দের – তাঁদের চার দিনের বাসি মরদেহ দেখে। ১৩-ই ডিসেম্বর ২০০১-এর দুপুরের দিকে পার্লামেণ্ট হাউস-এর গেট নম্বর ৯-এর কাছে পড়েছিলো রাজা, রানা ও হামজার লাশ যখন দিল্লি-পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করে সেই এইচ কলেজ-হাসপাতালের কলেজ মর্চুয়ারি-তে চালান করে, যেমন করে সেই একই দিন একই রকমের সময়ে, দিল্লি-র ঐ পার্লামেণ্ট কমপ্লেস-এর গেট নং ০৫-এর সামনে থেকে উদ্ধার হওয়া হায়দার-এর বডি। এঁদের সকলের মরদেহ-ই সেই ১৭-ই অক্টোবর ২০০১-এ উপরোক্ত মর্গ-এ ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের বয়ান অনুসারে আফজল গুরু-ই সনাক্ত করেন। তারপর ১৯-এ অক্টোবর ২০০১ “পোটা” আইনের আওতায় সন্ত্রাসাওবাদের চার্জ আনা হয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে।
টেরর-ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-এর আদিযুগে, অর্থাৎ সোভিয়েত দেশের পতনের সমসাময়িক কাল থেকে-ই ভারতে উক্ত কমপ্লেক্স তথা মেশিনারি-র ধারক ও বাহক ছিলো ‘টাডা’ আইন, ১৯৮৭। তারপরে, তার উত্তরসুরি হিসেবে আসে ২০০২ সালে প্রণীত পোটা আইন। যদিও হালে অনেক বলেন যে পোটা আইন অধুনালুপ্ত, তাঁরা হয় কাপট্যের তাড়নায় বিহ্বল হয়ে অথবা অনিচ্ছাকৃত অজ্ঞানতাবসতঃ বলেন। সন ২০০৬-এ, এই ‘টাডা’ ও ‘পোটা’-র টেরর-কমপ্লেক্স-এর উত্তরাধিকার বহন করে প্রণীত হওয়া, অধ্যাবধি বহাল, ‘আনল্যফুল অ্যাক্টিভিটিস প্রিভেনশান অ্যাক্ট’ (ইউ-এ-পি-এ, ২০০৬) – যার তাণ্ডব-দাপটে অধ্যবধিঃ একাধিক প্রিয়জন ক্লিষ্ট।
সে যাই হোক, ১৩ই ডিসেম্বর ২০০১-এর ভারতীয় পার্লামেণ্ট-অঞ্চলে হামলা ও হিংসার ঘটনা ঘটার ছয় দিনের মাথায় শুধু যে সমস্ত অভিযুক্ত অ্যারেস্টেড হলেন তাই নয়, শুরু হয়ে গ্যালো তাঁদের বিরুদ্ধে ‘টেরর-কেস’ – পোটা আইনের আওতায়। তারিখটা? – ১৯শে ডিসেম্বর ২০০১। এই ঘটনার সাড়ে এগারো বছর পুর্তির হওয়ার আগেই ফাঁসি হয়ে যাবে আফজল গুরু-র।
আফজল ও সওকৎ কর্তৃক দিল্লিস্থিতঃ আলিপুর রোডের সরকারি মেসবাড়িতে পুলিশি হেফাজতে কৃত স্বীকারোক্তি
অতঃপর, ২০শে ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে, দিল্লি পুলিশের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট কমিশিনার অফ পুলিশ (এ-সি-পি) শ্রী রাজবীর সিং, আবেদন জানালেন ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ (‘স্পেশাল সেল’)-এর কাছে – আফজল, সওকৎ আর এস-এ-আর-গিলানি-র ‘স্বীকারোক্তি’ গ্রহণের আর্জি-সহ। ট্রায়াল কেস-এ এ-সি-পি শ্রীরাজবীর প্রোসিকিউশান উইটনেস নং ৬০, এবং সেই স্পেশাল সেল-এর-এর ডি-সি-পি পি ডব্লিউ নম্বর ৮০ হিসেবে চিহ্নিত হয় আদালতের নথিতে। তার ঠিক পরের দিন, ২১শে ডিসেম্বর ২০০১-এ, দিল্লীর আলিপুর রোড-এ অবস্থিত “অফিসার্স-মেস” নামের মেসবাড়িটায় কনফেশান আদায়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা হয়। সর্বপ্রথম, সকাল বেলায় এস-এ-আর গিলানি সেই মেসবাড়িতে এ-সি-পি শ্রী রাজবীর সিং-এর সমক্ষে উপস্থিত হন, কিন্তু এস-এ-আর কোনো স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করতে রাজি হলেন না। তাঁর সেই অরাজি হওয়া পুলিশি রেকর্ডে নথিভুক্ত করলেন পি ডব্লিউ নং ৬০ শ্রীরাজবীর। কিন্তু সেই এক-ই মেসবাড়িতে দুপুর ৩:৩০ এবং সন্ধ্যে ৭:১০-এ এসে সেই পি ডব্লিয় নং ৬০-র সামনেই স্ব-স্ব স্বীকারোক্তি জবানবন্দী করা হলো যথাক্রমে সওকৎ গুরু ও আফজল গুরু।
তবে, সেই পুলিশি বয়ানেই দেখা যাচ্ছে যে, সওকৎ ও আফজল উভয়-ই পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যেই সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি প্রদান করেছিলো। অথচ তাঁদের সেই স্বীকারোক্তি হিসেবে কৃত বক্তব্যের যা ন্যারেটিভ ও ডিটেইল পুলিশি বয়ান তথা আদালতের রেকর্ড-এ, আদেশ-নির্দেশ-সমূহে ফুটে উঠেছে, অত ডিটেইলড ন্যারটিভ ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে গড়গড় করে বলে যাওয়ার বাস্তব কেপ্যাসিটি সাবেকি কথকতা-পারদর্শী কিছু ব্যক্তির ও আধুনিক হিপ-হপ শিল্পীদের আয়ত্ত্ব হতে পারে, আফজল বা সওকৎ-এর ছিলো কি না সে বিষয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে ৫-১০ মিনিট কথা বলে অতকিছু বলে ফ্যালা – তথ্য, কোথায় কী গোপন করা রয়েছে, গোপনীয় ডেরার হদিশ, সামগ্রিক পরিকল্পনা – সব পুলিশকে ঐ পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে জানিয়ে দেওয়া – সম্ভব নয়। পুলিশি বয়ানে তাই ‘উইলফুল সাসপেনশান অফ ডিসিবিলিফ’-এর ছোঁয়া লাগে – অথচ প্রশ্নাতীত ভাবে সেই বয়ানকেই আঁকড়ে ধরে মাননীয় নিউ দিল্লি ট্রায়াল কোর্ট, মহামান্য দিল্লি হাই কোর্ট ও মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট অফ ইণ্ডিয়া। সেই আঁকড়ে ধরার-ই নীটফলস্বরূপ – আফজল গুরুর ফাঁসি।
এইখানে, আরো কিছু খটকা তথা লজিকাল ফ্যালাসির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমতঃ, এস-এ-আর গিলানি-র প্রাথমিক বয়ানের উপর ভিত্তি করে প্রথমে নভজ্যোৎ সান্ধু ওরফে আফসানা গুরু-কে এবং উক্ত আফসানা তথা নভজ্যোৎ-এর স্বীকারোক্তি-র উপর ভিত্তি করে সওকৎ ও আফজলকে গ্রেফতার করলো পুলিশ। অথচ, যখন সেই এস-এ-আর এবং নভজ্যোৎ সান্ধু শেষমেশ বেকসুর খালাস হয়ে যাচ্ছেন সুপ্রীম কোর্টের মাধ্যমে – এমনকি, পুলিশি তদন্তের প্রাক্কালেই এস-এ-আর কোনো স্বীকারোক্তি করতে অস্বীকার করছে দিল্লি পুলিশের সামনে – তবুও একই সময়ে, সেই এস-এ-আর গিলানির প্রাথমিক জবানবন্দী এবং কিছু মোবাইল ফোন নম্বর ট্যাপ করে জোগাড় করে কল-রেকর্ডিং-এর ভিত্তিতে গ্রেফতার হওয়া আফজল গুরু-র ফাঁসি-র হুকুম বলবৎ করা – যে হুকুম সুপ্রীম কোর্ট-মারফৎ অচিরেই ন্যায্য-সংজ্ঞানে তুলে ধরা, এই ন্যারেটিভে যত যুক্তি-সঙ্গত ফাঁকফোঁকড় রয়েছে তা নিয়ে পুলিশি বয়ান, কোর্টের রেকর্ড অথবা তিন স্তরের হুকুমনামাগুলিতে কোথাও কোন আলোচনা হয় নি। প্রাথমিক কনফেশানের পর এস-এ-আর-এর নৈঃশব্দের বিষয়ে পুলিশি তদন্তের যা ট্রেইল অদ্যবধি ঠাউর করা যায় আবছা আবছা ভাবে – সেই ট্রেইলময় ময়নাতদন্ত-ও নিঃশব্দ।
গ্রেফতারের এক সপ্তাহ পর মেট্রোপলিটিন ম্যাজিস্ট্রেট-র কোর্ট-এ পেশ হল চার অভিযুক্ত
২০০১-সালের ১৫-ই ডিসেম্বর সকাল থেকে ২২শে ডিসেম্বর সকাল অবধি – অর্থাৎ টানা সাত দিনের পুলিশি হেফাজতের পর নির্ধারিত অ্যাডিশানাল চিফ মেট্রোপলিট্যান ম্যাজিস্ট্রেট, এক কথায় এ-সি-এম-এম তথা জেলাস্তরীয় ক্রিমিনাল জজম্যাজিস্ট্রেট-এর সামনে সিস্টেম-এর কমপ্যাশন-বর্জিত চলতা-বহতা ভাষ্যে ‘চালান’ হলেন পার্লামেণ্ট হামলার চার অভিয়ুক্ত – আফসান ওরফে নভজ্যোৎ, এস-এ-আর, সওকৎ এবং আফজল। আইন কিন্তু অন্য অধিকার দিচ্ছে। গ্রেফতার হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পর্যাপ্ত ও সঠিক জ্যরিসডিকশনের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আবার-ও সিস্টেম-এর কমপ্যাশন-বর্জিত চলতা-বহতা ভাষ্যে, ‘প্রোডিউস’ করতে হয় গ্রেফতার হওয়ার ব্যক্তিকে। একদিকে সেইটা যেমন পুলিশের দায়িত্ব যা আফজলদের ক্ষেত্রে পুলিশ পালন করে নি, কয়েনের অপর পিঠে এর ফলে এই চার অভিযুক্তের শুধু ক্রিমিনাল প্রোসিডিওরাল কোড প্রদত্ত এইভাবে ২৪ ঘণ্টা-র ভিতর ম্যাজিস্ট্রেট-এর সামনে চালান হওয়ার প্রোসিডিওরাল অধিকার-মাত্র-ই নয়, লঙ্ঘিত হল এ’ বিষয়ে তাঁদের সংবিধান-মারফৎ লব্ধ তথা প্রাপ্য মৌলিক অধিকার-ও চরমভাবে লঙ্ঘণ করা হলো পুলিশি-প্রোসিডিওর-এর নামে, টেরর আইন-এর দোহাই পেরে। তবে সেই লঙ্ঘনের বিষয়েও কোন রেকর্ড নেই, কোন ন্যায়নবীশ ধর্মাবতারকৃত আলোচনা-র ছাপ নেই। এমনকি, ১৫-ই ডিসেম্বর ২০০১-এ শ্রীনগরে গ্রেফতার হওয়া আফজল গুরু-কে উড়োজাহাজে উড়িয়ে আনা সত্ত্বেও তাঁকে ফর্মালি অ্যারেস্টেড দ্যাখাতে আরো একটা গোটা দিন লেগে গ্যালো দিল্লি তা নিয়ে কোন আলোচনা দেখা যায় না কোনো নথিতে বা চর্চায়, মহামান্য আদালতের আধটুকরো কোনো বয়ান বা প্রকাশে। এ যেন শুধুই পুলিশের বয়ান মেনে মেনে চলার এক অনন্তর বুনন।
‘ফ্রেমিং অফ চার্জেস’ সম্পন্ন এবং ট্রায়াল আরম্ভ ও সমাপন
প্রসিকুশান, অর্থাৎ দিল্লি সরকার ও পুলিশ এই পার্লামেণ্ট হামলা ও সেই হামলায় অভিযুক্ত চার ব্যক্তির গ্রেফতারের পরের চার্জ ফ্রেম করতে নিলো ছয় মাস – ৪-ঠা জুন, ২০০২-তে জেলাস্তরীয় ট্রায়াল কোর্ট-এ জমা পড়লো সেই চার্জ-শীট। ট্রায়াল আরম্ভ হওয়ার আগেই এই মামলার জন্য সুনির্দিষ্ট তথা মহামান্য ‘ডেসিগনেটেড’ বিচারপতি জানিয়ে দিলেন যে অকুস্থল থেকে প্রাপ্ত সমস্ত এভিডেন্স কোর্ট যথার্থ হিসেবে গ্রাহ্য করে নিচ্ছে কারণ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন পক্ষই কোনো অন্যমত পোষণ করেন না। তবে, ট্র্যায়াল শুরু হতেই বোঝা গ্যালো, ওই ট্যাপ করে আড়ি পেতে শোনা টেলিফোনিক কথোপকথন-ই দোষীদের ঘটনার সাথে লিঙ্ক করছে – এমন এভিডেন্স – যা ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড হিসেবে ভারতীয় এভিডেন্স আইন, ১৮৭২-এর ধারা ৬৫-বি মারফৎ ডক্যুমেণ্টারি তথা সেকেণ্ডারি আইনে স্বীকৃত হয়েছে ২০০০ সালে। বিবাদীপক্ষ দেখলো যে যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, খুন, সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ-সংঘটনের গুরু অভিযোগ এনেছে দিল্লি পুলিশ তথা প্রোসিকিউশান, তথাপি, সেই অভিযোগের সমর্থনে উক্ত পুলিশ-প্রোসিকিউশান ট্রায়াল কোর্ট-এর দাখিল করা এভিডেন্স বলতে সেই সকল ইলেকট্রনিক এভিডেন্স – নেহাতই সেকেণ্ডারি ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স। অথচ এরই ভিত্তিতে এই দোষী চারজনকে গুরুদণ্ডে দণ্ডিত করার আয়োজন নিয়েছে প্রোসিকিউশান। এই প্রতিবাদে বিবাদীপক্ষের এস-এ-আর গিলানি, সওকৎ এবং নভজ্যোৎ একত্রে আবেদন করলেন যেন সেই সেকেণ্ডারি এভিডেন্স তথা ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্সগুলিকে কোর্ট ধার্য্য না করে, কারণ তাঁদের বিরদ্ধে আরোপসমূহ এমনই গুরুতর যে তা প্রত্যক্ষপ্রমাণ তথা স্বীকৃত প্রাইমারি এভিডেন্স-এর মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ার দাবী রাখে। অথচ ২০০২ সালের ১১ই জুলাই অর্ডার-মারফৎ এই আবেদন নাকচ করে মানানীয় ট্র্যায়াল কোর্ট।
এ’খানেও প্রভূত ধোঁয়াশা-র অবকাশ। প্রথমতঃ, ট্রায়ালের অরম্ভলগ্নেই তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে ফোন-রেকর্ডিং- বা তার অনুলিখন/ ট্র্যান্সক্রিপ্ট যাতে এভিডেন্স হিসেবে গ্যাহ্য না হয় সেই নিয়ে স্বীয় প্লীডার মারফৎ এই মর্মে আবেদন রাখলেন। অথচ আবেদন রাখতে পারলেন না, অথবা সেই আবেদনে স্বীয় নাম ও হস্তাক্ষর রাখতে প্রতিহত হলেন আফজল। কারণ, কোনো অজ্ঞাত কারণে প্রাথমিকভাবে আফজল গুরু তাঁর ফাঁসির মামলায় কোনো উকিল নিযুক্ত করেন নি, বা করতে পারেন নি, বা ত্যামোন করা থেকে তাঁকে কোনোভাবে প্রতিহত করা হয়েছিলো। সেকেণ্ড-গেস করে লাভ নেই। ওতে চর্চা সমৃদ্ধ হয় না।
এছাড়াও, ট্রায়াল কোর্ট তাঁদের সেই আবেদন ১১-০৭-২০০২ তারিখে নাকচ করলেও, সেই অর্ডারের বিরুদ্ধে আফসান-সওকত-এস-এ-আর হাই কোর্টে আপীল করলে হাই কোর্ট সেই আবেদন গ্রহণযোগ্য ধার্য্য করলো। সেই হাই কোর্টের অর্ডার-এর বিরুদ্ধে ফরিয়দীপক্ষ তখন সুপ্রীম কোর্ট-এ উপস্থিত হয়ে এই মর্মে জ্ঞাপন পেশ করলো যে, যেহেতু মাননীয় ট্রায়াল কোর্ট-এর ১১-ই জুলায় ২০০২-এ জারি করা অর্ডার-টি মধ্যবর্তী বা অন্তর্বর্তীন রায় – ইংরেজি-তে ‘ইন্টেরিম অর্ডার’-জাতীয়, সেহেতু সেই অর্ডারের বিরুদ্ধে, পোটা আইনের ধারা ৩৪-এর প্রয়োগবলে, উচ্চ্বতর ন্যায়ালয়ে কোনো আবেদন গ্রাহ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়। মহামান্য শীর্ষ আদালত বিষয়টির ‘মেরিট’-নিয়ে কোন উচ্চ্ব্বঃবাচ্য না করে স্বীয় (২০০৩) ৬ এস-সি-সি ৬৪১ – সাইটেশন-চিহ্নিত আদেশ-মাধ্যমে বিষয়টা মীমাংসার জন্য পাঠিয়ে দিলো মাননীয় দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিশান বেঞ্চ-এর কাছে।
তবে সেই ধরণের কোনো মীমাংসা হওয়ার আগেই, সেই ২০০২-এর জুলাই মাসের অর্ডার-নির্দিষ্ট অবস্থানে অনড় থেকে-ই, ১৬-ই ডিসেম্বর ২০০২ এবং ১৮-ই ডিসেম্বর-এর দু’টি হুকুমনামা মারফৎ আফজল ও সওকৎ গুরু এবং এস-এ-আর গিলানি-র ফাঁসির আদেশ জারি করলো, সাথে সাথে, নভজ্যোৎ অরফে আফসান নামে ভারতীয় দণ্ডবিধি সংহিতা-র ধারা ১২৩ উল্লঙ্ঘনের অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন।
অর্থাৎ, এই যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইশ্যু, অর্থাৎ, কেবলমাত্র অভিযুক্ত ব্যক্তির অজ্ঞাতসারে আড়ি পেতে ট্যাপ করে রেকর্ড করে নেওয়া ফোন-কথোপকথন, যা-ও কিনা তথ্যপ্রমাণ হিসেবে কেবলমাত্র সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স-রূপেই আইনগ্রাহ্য, কেবলমাত্র তার ভিত্তিতে কারুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, খুন, সন্ত্রাস ও বিস্ফোরণ সংঘটনের অভিযোগ আনা কতদূর আইনসঙ্গত, তাই নিয়ে হাই কোর্টের ডিভিশান বেঞ্চ থেকে প্রয়োজনীয় নিদান আসার আগেই ট্রায়াল কোর্ট পার্লামেণ্ট হামলায় অভিযুক্ত তিনজনের ফাঁসি ও একজনের পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হলো। তখন ২০০২ সালটা সবে শেষ হচ্ছে। তার ঠিক এক বছর আগেই দিল্লিতে ঘটে গিয়েছে পার্লামেণ্ট হিংসা-র ঘটনা, যাকে ‘পার্লামেণ্ট হামলা’ নাম দিয়ে জিঙ্গোইস্টিক রাষ্ট্রবাদের পেশি ফুলিয়েছে সেদিনের নব্যমুক্তবাজারের ক্যাপিটালময় আসমানে উড্ডীন প্রাইভেট গোষ্ঠী-র মিডিয়া-মহল।
তবে, ট্রায়াল কোর্টের সেই ফাঁসি ও কারাবাসের আদেশ আসার পরেও আরো কিছু বাকি সেই বিচারের নামে প্রহসনের অলীক কূনাট্য রঙ্গ। সেই পালার মূল অংশ শেষ হতে আরো পৌনে দুই বছর বাকি। তারও সাড়ে সাত বছর পর, ২০১৩ সালের ৯-ই ফেব্রুয়ারি এই পালায় সম্পূর্ণ ড্রপসীন পড়ে যাবে।
সিদ্ধান্তগতঃ ‘ফ্যালাসি’ তথা বিচারের নামে প্রহসন
ইতিমধ্যে, এই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত এভিডেন্স সত্ত্বেও, সেই অপ্রতুল এভিডেন্স-এর ভিত্তিতেই এমন গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার অ-ন্যায়জনক দিকগুলি থেকে চোখ ও বচন সরিয়ে নিলো আইন-আদালত-প্রসিডিও-এর নিগড়ে বাঁধা পথ। আরম্ভ হল অন্যান্য নানান আলাপ – যেমন, স্বর্গতঃ কিংবদন্তীসমঃ সুপ্রীম কোর্ট ক্রিমিনাল লইয়ার শ্রী রাম জেঠমালানি রাখলেন এই প্রসঙ্গে বিতণ্ডা যে পোটা আইন-এর আওতায় চলমান প্রকরণের উপর ইনভেস্টিগেশন করার ইউনিয়ন টেরিটরি হিসেবে দিল্লি সরকার ও তার পুলিশের আছে কি না। যে প্রসঙ্গে মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট বিচার রাখলেন যে বিশেষতঃ ও পোটা আইন, ২০০২-এর ধারা ৫০ অনুসারে ন্যাশানাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ ডেলহি-র সরকারের তরফে দিল্লী-নাম্নি এই জাতীয় রাজধানী তথা ইউনিয়ন টেরিটরি-র লেফটেন্যান্ট গভার্নর-এর ক্ষমতা আছে এই ধরণের ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাওয়া-য়।
পুলিশি ইনভেস্টিগেশন সঠিক ও আইনি পথে এগিয়েছে কিনা, অথবা, সেই ইনভেস্টিগেশন-এর প্রসিডিওর যথার্থভাবে ইনভেস্টিগেশন ও ট্রায়াল চলাকালিন মান্যতা পেয়েছে কি না, এই দুই প্রশ্নের সদর্থ উত্তর হিসেবে শেষ অবধি মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত সেই পুলিশি বয়ানে-র উপরেই ভিত্তি করে-ই নিদান দিলো যে, ‘হ্যাঁ, এগিয়েছে ও পেয়েছে’। এ য্যানো যে ‘আমি কলা খাই নি’ বলে উঠলো ঠাকুর ঘর থেকে, তার সেই উক্তি শুনে তার-ই সপক্ষে নিদান দেওয়া যে – ‘হ্যাঁ, অমূকের বয়ান অনুসারে প্রমাণিত হচ্ছে যে সে ঠাকুরঘরে নেই’।
অথবা অন্যভাবে দেখলে বলা যেতে পারে, প্রিন্সিপল অফ ন্যাচারাল জাস্টিস-থেকে ঘোর বিচ্যুতি। অভিযোগকারী তথা পুলিশের বয়ানের উপর ভিত্তি করে, অভিযুক্তের বয়ান অনুসারে সঠিক কোনোপ্রকার মীমাংসা-র অপেক্ষা না রেখে, ক্যানো অভিযুক্তদের বয়ান এইভাবে নস্যাৎ করে দেওয়া হলো সে বিষয়ে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রকাশের অপেক্ষা না রেখে, ফাঁসি হয়ে গ্যালো আফজল গুরু-র, ১০ বছরের সশ্রম কারাবাস হলো সওকৎ-এর। সেই আড়ি পেতে রেকর্ড করা টেলিফোন কনভার্সেশান – যেগুলিকে গ্রাহ্য করার বিরুদ্ধে অভিযুক্তগণ সেই ২০০৭ সালে ট্রায়াল আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে আবেদন এনেছিলো – সেই সেকেণ্ডারি-ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স-এর ভিত্তিতেই এই ফাঁসির ও কারাবাসের সাজা হলো। এমন হওয়া কী আইন বা ন্যায়সঙ্গত কী না, সেই প্রশ্ন ভবীর সেই শিশু করবে – রূপকথায় যে শুধেছিলো – ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’
আরো অনেক সাবস্ট্যাণ্টিভ আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে সুপ্রীম কোর্ট-এর এই জাজমেণ্ট-এ। আলোচনার মোড় ঘুরেছে এই মামলা আদৌ পোটা আইনের আওতায় আসতে সক্ষম কি না, সেই প্রসঙ্গে; এবং – সেই প্রসঙ্গের হাত ধরেই এসেছে পোটা আইন, ২০০২-র ধারা ৩, ৪, ৫, ২০, ২১ এবং ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড-এর ধারা ১২০-বি, ১২১, ১২১-এ, ১২২, ১২৪-এর দিকে। এই প্রসঙ্গে এই তথ্য প্রয়োজনীয় যে – ২০০১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর যখন আফজল গুরু সহ পার্লামেণ্ট হিংসা-র ঘটনায় ধৃত অভিযুক্ত চার জনের বিরুদ্ধা আনা মামলা পোটা আইন-এর আওতাও আনা হলো, তখন সেই আইন একটি অর্ডিন্যান্স-আকারে স্বীয় অস্তিত্ব সদ্য জ্ঞাপন করেছে। তবে, এর ছয় মাসের মধ্যে যখন ট্রায়াল শুরু হলো, ততদিনে সেই অর্ডিন্যান্স-এর বিষচারা পোটা আইন, ২০০২-নাম্নী বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ঠাউর করলে এ-ও দ্যাখা যায় যে, ২০০১ সালের ১৩-ই জানুয়ারি দিল্লিস্থঃ পার্লামেণ্ট হাউস পুলিশ স্টেশন-এ সন্ধ্যে ০৫-টার সময়ে যে এফ-আই-আর জমা হয়েছিলো এই পার্লামেণ্ট-হিংসা-র ঘটনাপ্রসঙ্গে, সেখানেও, তখন-ও, সেই প্রিভেনশান অফ টেরর অর্ডিন্যান্স বা পোটা-র বিভিন্ন প্রভিশন ও তার উল্লঙ্ঘনের কথা লেখা ছিলো। এমনকি সেই যে ‘রুক্কা’ যার ভিত্তিতে পার্লামেণ্ট হাউস স্ট্রিটের অদনীন্তন এস-এইচ-ও-র তত্ত্বাবধানে এফ-আই-আর গৃহীত হয় পার্লামেণ্ট হিংসা-র ঘটনার নিরীখে, তখন, যদিও সেই ‘রুক্কা’ অথবা ‘এফ-আই-আর’ কোনোটির বয়ানেই অভিযুক্ত চারজনের নাম ছিলো না, কিন্তু দুটিতেই বেশ কিছু স্থানে বিধৃত ছিলো সেই পোটোকথা। অর্থাৎ, এই পার্লামেণ্ট হিংসা-র বিরুদ্ধে, প্রথম থেকেই টেরর বিষয়ক আইন ও প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিকরণের উদ্দেশ্যে একটা স্পষ্টতঃ প্রিমেডিটেশন মামলা বা এমনকি তদন্ত শুরু হওয়ার-ও আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিলো ফরিয়াদীপক্ষ তথা প্রোসিকিউশান তথা দিল্লি পুলিশ ও সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে। সেই পোটো-চারা অচিরেই বিষ-পোটা-বৃক্ষ হিসেবে সটান দাঁড়িয়ে ওঠে সেই মামলায় ট্রায়াল প্রকরণ চালু হওয়ার আগেই। এখানেও প্রশ্ন জাগে – এও কী নিছক-ই সমাপতন?
প্রোসিডিওরাল গরমিল ঢাকাচাপা পরে যায় সাবস্ট্যান্টিভ ল্য-এর আলোচনার তোড়ে
সে যাই হোক, জাজমেণ্টের পাতায় চোখ রেখে বোঝা যায় ঢাকা চাপা পড়ে গ্যালো প্রোসিডিওরাল আইনের দিকগুলো। এই যে এভিডেন্স-এর অপ্রতুলতা – এবং নিছকই সেকেণ্ডারি তথা ডীপ-স্টেট-এর বদান্যতাকৃত ফোন-ট্যাপিং প্রসূত ইলেক্ট্রনিক রেকর্ডের ভিত্তিতে এই সকল গুরু অভিযোগে গুরুদণ্ড – তা নিয়ে আলোচনা যেন একপ্রকার ঢাকাচাপা-ই পড়ে গ্যালো সুপ্রীম কোর্টের সামনে। বরং বিপুলাংশে পোটা আইন, ২০০২ এবং ভারতীয় দণ্ডবিধি সংহিতা, ১৮৬১-র উপরোক্ত ধারা নিয়ে, কিয়দাংশে বিস্ফোরক পদার্থ আইন, ১৯০৮-এর ধারাগুলি নিয়ে – অর্থাৎ প্রোসিডিওরাল থেকে সাবস্ট্যাণ্টিভ ল্য-এর পথে ঘরে গ্যালো আলোচনার মোড়। সেই খাতেই আলোচনার স্রোত জ্যানো বইয়ে দিলেন বাদী-বিবাদী দুইপক্ষের তরফ থেকেই নিযুক্ত নামীদামী কিংবদন্তী-প্রতিভ উকিলগণ – রাম জেঠমালানি, গোপাল সুব্রমনিয়ম, শান্তি ভূষণের মত ক্ষুরধার আইনি মনন। ক্যানো এই স্রোত বয়ে যাওয়া, মোড় ঘুড়ে যাওয়া, এই চোখ সরিয়ে নেওয়া মূল গরমিল যেখানে সেই এভিডেন্স আইন ও পুলিশ প্রোসিডিওর-এর প্রসঙ্গ থেকে? এইসব প্রশ্নগুলো-ও এখনো খোলা থেকে যায়।
যেমন থেকে যায় উপরে বিভিন্ন জায়গায় রেখে যাওয়া বিভিন্ন প্রশ্নগুলো – ক্যানো পুলিশপক্ষ যখন বললো যে ‘ফরেনসিক’ পরীক্ষা-এর ভিত্তিতে ফোন-কলের রেকর্ডিং থেকে সেই রেকর্ডিং-এ ধরে রাখা কণ্ঠস্বরের অধিকারী কে বা কারা সেটা তারা বুঝতে পেরেছে, তখন প্রশ্ন করা হলো না ক্যানো যে – ‘কি ধরণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছিলো? সেই পরীক্ষা কারা করেছিলো? কী ছিলো সেই পরীক্ষার প্রোগ্রাম, প্রযুক্তি ও প্যারামিটার? কে বা কারা, কোন ‘ফরেনসিক’ বিশেষজ্ঞ করেছিলো সেই পরীক্ষা? – অথচ এই প্রশ্নের সদুত্তরের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই লেখার একদম গোড়ার দিকে গৌড়চন্দ্রিকা করে আলোচনা করে রাখা এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ধারা ৬৫-বি, বিশেষতঃ উক্তি ধারা-র উপধারা নং ‘২’ থেকে ‘৫’-এর যথাযথ পালন হয়েছিলো কি হয় নি সেই প্রশ্ন-র উত্তর আগের প্রশ্নগুলোর উপর যথাযথ ও সঠিক উত্তরের উপরে নির্ভরশীল। অথচ সেই ভাবে সত্যের সন্ধান আদৌ করলো কি পুলিশ বা আদালত? যেহেতু একজন মানুষের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে তফাৎ গড়ে দিলো এই স্বেচ্ছাকৃত অবহেলা – সেহেতু অনায়াসেই, যদিও সক্ষেদে, বলতে হয় যে – ‘না, করলো না’।
এই সব সাবস্ট্যান্টিভ আইন কানুনের আলোচনায় বেশীমাত্রায় নিবিষ্ট হলে চোখ সরে যাবে আসল অন্যায় যেখানে ঘটে গ্যালো সেই এভিডেন্স ও প্রোসিওডিওরের দোরগোড়া থেকে। সুপ্রীম কোর্টের সেই ১৯৭ পাতা, ৩৩৯ অনুচ্ছেদ জুড়ে বিস্তীর্ণ আলোচনায় এই ইলেকট্রনিক এভিডেন্স ও তার এভিডেনশিয়ারি মূল্য নিয়ে আলোচনা বোধকরি সাকুল্যে ৬-৭ পাতা জুড়ে-ও ঠাঁই পায় নি। এদিকে সেই ১৯৭ পাতা জাজমেণ্ট, যার প্রথম ৪১-৪২ পাতা জুড়ে আইনি হেডনোট, তার মোটমাড় শ’দেড়েক পাতা জুড়েই নিরন্তর বর্ষিত হয়েছে সাবস্ট্যান্টিভ আইনের হ্যাজ – রাজদ্রোহ তথা ‘সিডিশান’ আইনের কী-ক্যানো-কখন, যুদ্ধের সাথে রাজদ্রোহের পার্থক্য, অথচ সাযুজ্য, কখন কতটা মাত্রা বা ডিগ্রী-তে সিডিশানের পারদ চরলে তখন তা টেররিসম হিসেবে অ্যাণ্টি-টেরর আইন তথা তৎকালীন বলবৎ পোটা, ২০০২-এর আওতাধীন হয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা ‘ওয়েজিং ওয়ার আগেন্সট দ্য স্টেট’ কখন কি পরিস্থিতে ও কী উপায়ে প্রমাণ তথা এস্টাব্লিশ করা যায় কোনো রাষ্ট্রদ্রোহে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরিদ্ধে- এই সব প্রসঙ্গেই যেন মত্ত ও নিমজ্জিত থেকেছে এই জাজমেণ্ট-এর সুদীর্ঘ আলোচনাপরিসর। অপ্রতুল ও কেবলমাত্র সেকেণ্ডারি এভিডেন্সের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে জ্যানো এক বিপুলবপু ‘এডফিস বিল্ট অন কুইক-স্যাণ্ড’।
অথচ, যদিও অপ্রতুল এভিডেন্স সত্ত্বেও ফাঁসির আদেশ হলো অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত আফজল গুরু এবং ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হলো অপর অভিযুক্ত ও কিছুমাত্রায় দোষী-সাব্যস্ত সওকৎ গুরু-র, অথচ সেই একই কারণে, অর্থাৎ, সেই টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ডিং এবং ট্র্যান্সক্রিপ্ট-কেই অপর দুই অভিযুক্তের অভিযোগ প্রমানে অপারগ – ‘স্ক্যাণ্টি এভিডেন্স’ হিসেবে চিহ্নিত করে, সেই একই মামলায়, এই একই মহামান্য শীর্ষ আদালতের একই ডিভিশান বেঞ্চ, বেকসুর রিহা করে দিলো এস-এ-আর গিলানি আর নভজ্যোৎ ওরফে আফসান।
আফজল ও সওকৎ-এর পুলিশি হেফাজতে পুলিশ-সমীপে প্রদত্ত স্বীকারোক্তি – তা কী আদৌ আইনের চোখে ধার্য এভিডেন্স হিসেবে ওঁদের অপরাধপ্রমাণে সক্ষম?
আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আফজলদের তথাকথিত ‘স্বীকারোক্তি’-সমূহ, এমনকি এস-এ-আর গিলানি-র ‘রিট্র্যাক্টেড কনফেশন’-এর প্রসঙ্গও। প্রসংতঃ এসেছে এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এর ধারা ১৭-৩০-এর কথা – বিশেষতঃ সেই ধারা ২৫-এর কথা যার মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে পুলিশের সামনে করা স্বীকারোক্তি অপরাধের প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য নয়, যদিও, সেই প্রসঙ্গেই আবার এলো ১৮৭২ সালে প্রণীত সেই একই আইনের ধারা ৩০-এর কথা – যা অনুসারে, তেমন যে কোনো স্বীকারোক্তি অপরাধের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ না করলেও প্রাসঙ্গিক হিসেবে গ্রাহ্য করার ডিস্ক্রিশানারি ক্ষমতা রয়েছে আদালতের – অর্থাৎ, এই ধারা ৩০-এর ইং-বয়ান অনুসারে; ‘দ্যা কোর্ট মে…’। আবার সেই কনফেশন বা স্বীকারোক্তি-র প্রসঙ্গেই এলো টাডা আইন, ১৯৮৭-র ধারা ১৫ এবং পোটা আইন, ২০০২-এর ধারা ৩২, যা অনুসারে ‘টেরর কেস’-এর ক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশন চলাকালীন পুলিশের সামনে করা অভিযুক্তকৃত স্বীকারোক্তি অভিযুক্তের অপরাধের প্রমাণ হিসেবে আদালতে গ্রহণযোগ্য। এই গ্রহণযোগ্যতার পিছনে যে কি বিপুল পরিমাণ অসাংবিধানিকতা ও ইনিকুইটি লুকিয়ে রয়েছে সেই বিষয়ে কোন আলোচনার পরিসর সঙ্গত কারণের সৃষ্ট হয় নি সুপ্রীম কোর্ট সমীপে অথঃ তদকৃত জাজমেণ্ট-এর আয়তে ও আয়তনে। অতএব, সেই পুলিশের সামনে করা স্বীকারোক্তি, সেই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে অচিরেই পুলিশের রিকভার করা কিছু সরঞ্জাম এবং ফরিয়াদী রাষ্ট্রপক্ষকৃত আড়ি-পেতা শোনা দুইটি ফোন-কথোপকথনের রেকর্ডিং ও তার অনুলিখন-এর ভিত্তিতেই ফাঁসি হয়ে গ্যালো আফজল গুরু-র।
পুলিশি প্রোসিডিওর ও ‘প্রোসিডিওরাল সেফগার্ডস’ কীভাবে তদন্ত চলাকালীন লঙ্ঘন করে পুলিশ-ই – এই বিষয়ে মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট-এর ইঙ্গিত –
তবে, এই বিষয়ে – তা, পোটা-আইনের, বিশেষ করে সেই আইনের ধারা ৩২(৫) নির্দিষ্ট, আদালতের ভাষায় ‘প্রোসিডিওরাল সেফগার্ডস’ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, পোটা আইনের প্রোসিডিওর তো বটেই, এমনকি এই স্বীকারোক্তি-র প্রসঙ্গে এমনকি ক্রিমিনাল প্রোসিডিওর কোড-এর ধারা ১৬৪-এর-ও লঙ্ঘণের ইঙ্গিতবাহী – এমনকি, সেই প্রোসিকিউশান উইটনেস নং ৬০ এ-সি-পি শ্রী রাজবীর সিং দিল্লিস্থ আলিপুর রোড-এর সেই অফিসারদের মেসবাড়িটিতে যে দুপর ও সন্ধ্যা ব্যলা সওকৎ ও আফজলের স্বীকারোক্তি নথিভুক্ত করেছিলেন, সেই পুলিশি রেকর্ড অনুসারে, সেই স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন, গ্রহণ ও পুলিশি তদন্তের খাতায় তা নথিভুক্তিকরণের প্রক্রিয়া, দুই অভিযুক্তের ক্ষেত্রেই, ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হচ্ছিলো। মহামান্য সর্বোচ্চ্ব আদালতের সেই ২০০৫ সালের ৪-ঠা অগাস্ট প্রণীত জাজমেণ্ট-এর অনুচ্ছেদ নং ১৮৪-এ এই অবজার্ভেশন রয়েছে, এবং এই অবজার্ভেশন-এই ভিত্তিতে পরবর্তী অনুচ্ছেদ নং ১৮৫-এ মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এই মর্মে জানান দিচ্ছে যে –
‘পুলিশি প্রক্রিয়ায় ‘প্রোসিডিওরাল সেফগার্ডস’ সম্পর্কির ‘ল্যাপসেস অ্যাণ্ড ভায়োলেশনের চিহ্ন স্পষ্ট। সে’ কারণে, যদিও আফজলের স্বীকারোক্তির উপরে অনেকটাই জোর দিয়েছে পুলিশ তথা প্রসিকিউশান, তবুও, সেই স্বীকারোক্তি-কে এভিডেন্স-হিসেবে ধার্য করে এগোনো ‘সেফ’ নয়।’ (অনুবাদ – আমাকৃত)
কেবলমাত্র কিছু ‘সারকামস্ট্যানশিয়াল’ ফাইণ্ডিং-এর ভিত্তিতে আফজলকে কী ভাবে দোষী সাব্যস্ত করে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা
অথচ, এই জাজমেণ্টের পাতাতেই, এর পরের বেশ কিছু অনুচ্ছেদ ধরে চলতে থাকা আলোচনার মাধ্যমে আফজলের বিরুদ্ধে ‘সারকামস্ট্যানশিয়াল’ অর্থাৎ পরিস্থিতগিত কিছু ফাইণ্ডিং-এর দিকে দিশা নির্দেশ করে কোর্ট জানায় যে সেই সব ‘সারকামস্ট্যানশিয়াল’ ফাইণ্ডিং থেকেই আফজলের অপরাধ প্রমাণিত হয়। যেমন – সেই ‘মৃত টেরিরিস্ট’-দের মরদেহ শনাক্তিকরণ, ঘটনাস্থলে প্রাপ্ত একাধিক টেলিফোন এবং আই-এম-ই-আই নম্বরের মাধ্যমে কিছুটা হলেই এস্ট্যাব্লিশ হওয়া লিঙ্ক, যে লিঙ্ক-এর বিষয়ে, যদিও, পুলিশি বয়ানের যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন কোনো স্তরেই তোলা হয় নি আদালতের তরফ থেকে, তদসহযোগে আফজলের বিরুদ্ধে আরেকটি ‘সার্কামস্ট্যানশিয়াল’ ফাইণ্ডিং তথা টেলিফোনিক কথোপকথনের রেকর্ড, আবার, সেই আফজলের স্বীকারোক্তির ফলে প্রাপ্ত কম্পিউটারের সংরক্ষিত কিছু রেকর্ড – যে বিষয়ে দুই কম্পিউটার একস্পার্ট তথা প্রোসিকিউশান উইটনেশ নং ৭২ এবং ৭৩ ট্রায়াল কোর্টের সামনে বয়ান রেখেছিলেন। সন ২০০৫-এর ৪-ঠা অগাস্ট প্রণীত স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্ট-এর অনুচ্ছেদ ১৯০ থেকে ২০৩ মারফৎ এইভাবে একের পর এক ডক্যুমেণ্টারি অথা ইলেকট্রনিক রেকর্ড ও সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স ইঙ্গিতবদ্ধ করেছেন মহামান্য শীর্ষ আদালত।
এরপরে, বিভিন্ন সেই সেকেণ্ডারি এভিডেন্স নিয়ে আলোচনা হয়েছে এই জাজমেণ্ট-এ, এসেছে হাইড-আউট তথা ঘাটি-ঠিকানা এবং রিকভারি-র প্রশ্ন, এসেছে তদন্তভার প্রাপ্ত ইন্সপেক্টার গিল-এর গ্রহণ করা বিভিন্ন স্থানীয় দোকানদার ও বাসীন্দার বয়ান, এসেছে প্রসিকিউশান উইটনেস নং ৪৪ মোবাইল ফোন বিক্রেতার বয়ানের প্রসঙ্গ, পড়ে থাকে নি সেই সাদা অ্যাম্ব্যাসাডর গাড়ি ও সেই গাড়ির লাইসেন্স-এর প্রসঙ্গ। সেইসব মোবাইল ফোন, আফজল-সওকৎ-কে গ্রেফতার করার সময়ে সেই ট্রাক থেকে শ্রীনগর পুলিশের ‘রিকভার’ করা ল্যাপটপ – সেই সব যে এগসহিবিট তথা এভিডেন্স হিসেবে ট্রায়াল কোর্ট সমক্ষে পেশ করা হয়েছে ফরিয়াদী-পক্ষের তরফ থেকে – সে তথ্য জ্ঞাপন করতেও কসুর করে নি মাননীয় দিল্লি হাই কোর্ট অথবা মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট উভয়ের কেউ-ই। এই প্রসঙ্গে কিছু কিছু একস্পার্ট-এর দ্বারস্থ হওয়ায় ক্ষীণ-বিবরণ পর্যন্ত্য রয়েছে সেই জাজমেণ্টে – এবং সেই আলোচনাও মূলতঃ পুলিশি বয়ান ও বাদী তথা ফরিয়াদী তথা প্রোসিকিশুয়ান তথা রাষ্ট্রপক্ষের আনায় নয়ান ও ন্যারেটিভ-এর প্রতি যথার্থই অনুগত থেকেছে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু মামলার স্বীয় জাজমেণ্ট বিরচনকালে। জাজমেণ্ট-এর অনুচ্ছেদ নং ২৯৩-২৯৫-এ আলোচিত হয়েছে বিস্ফোরক পদার্থ আইন, ১৯০৮ ও তার আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে তা উল্লঙ্ঘনের আরোপ। এবং, এই স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্টের-ই ক্ষুদ্রকায়, অথচ প্রবল ও নিদারুণ প্রভাবশালী অনুচ্ছেদ নং ২৯৬-তে আফজালের ফাঁসির আদেশ যথার্থ গণ্য করেছ মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট অফ ইণ্ডিয়া।
অথচ, এত কিছু করেও, সেই অপ্রতুল এভিডেন্স ও প্রসিডিওরাল গলদের প্রসঙ্গ কি সত্যিই ধামাচাপা দিয়ে, সেই আলোচনা থেকে আমাদের চোখ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন মাননীয় শীর্ষ আদালত?
অন্যায়, ইনইকুউইটি তথা বিসমতা, এবং যে সকল খোলা প্রশ্নগুলো থেকেই যায়
তবে, সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে, এই আফজল গুরু-র ফাঁসির আদেশের পিছনে যে অ-ন্যায় – তার পরিমাপ যতো না সাংবিধানিক তদিধিক ইকুইটি-মূলক। বিষয়টা দুই পক্ষের প্রতি অপক্ষপাতিত্ব-র জায়গা থেকেই যেন সরে এসেছে মহামান্য আদালত এই ‘টেররিসম’-এর দোহাই পেরে, অর্থাৎ এই অদ্যবধি ক্রমঃবর্ধমান, রাষ্ট্রসুরক্ষার নামে ক্রমঃ গঠমান, ক্রমঃনির্মিয়মাণ টেরর ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-এর ছত্রছায়ায় অবস্থিত থেকে।
২০০১-এর ডিসেম্বর মাসের সেই পার্লামেণ্ট হিংসার ঘটনা, ২০০৪-এর অগাস্টে সুপ্রীমকোর্ট-কৃত আফজল গুরু-র ফাঁসির আদেশ, এবং, সেই আদেশ অনুসারে, ২০১৩-র ডিসেম্বর মাসের ৯-ই ফেব্রুয়ারি আফজল গুরু ফাঁসি – এই পুরো সময়কাল জুড়ে সেদিনের নবোদারিত মুক্তবাণিজ্যের প্রাসাদে তুষ্ট তদধুনা ভারতের সংবাদমাধ্যম – সবেতেই চলেছিল এক উদগ্র টেররিস্ট-দমন-এর পাশবিক দন্তবিকাশ – সে বিকাশ অদ্যবধি বিদ্যমান। দেশপ্রেমের মুখোশধারি জিঙ্গোবাদ ছড়িয়ে পড়েছিলো সেদিনের জ্বলন্ত কাশ্মীর-গুজরাট-দের চিতাশকটে চেপে তার পোলিটিকাল জয়যাত্রার পথে। সে যাত্রাপথ অদ্যবধি বিদ্যমান। এই পৌনে সাত মাস সময়ে, এই ধরণের পারিপার্শ্বিক হেজিমনি যখন শ্বদন্তনখরে জেগে উঠছিল মূলধারার জোয়ার-স্রোত জুড়ে, তার মধ্যে এমন কি তথ্য পাওয়া গ্যালো যার মাধ্যমে এই অভিযুক্ত তথা দণ্ডিতদের বিরুদ্ধে জৈশ-এ-মহম্মদের তরফ থেকে পার্লামেণ্ট-এ হামলা করার সুস্পষ্ট প্রমাণ উঠে আসছে?
অথচ, আবার, যদি আদালতের রেকর্ড খতিয়ে দেখা যায়, সেই জৈশ-ই-মহম্মদ বা অন্য কোন নামধারী আণ্ডার্গ্রাউণ্ড কোনো সংস্থা অথবা তার কার্যকলাপের সাথে আফজল-সহ অভিযুক্ত চারজনের কারুর-ই গতিবিধির কোনো লিঙ্ক কোর্টের সামনে উপস্থাপন বা স্বীয় চার্জশীট-মাধ্যমে এস্ট্যাব্লিশ করতে পারে নি সেদিনের দিল্লিপুলিশ। অথচ সেই অক্ষমতার হিসাবনিকাশ ধৃতরাষ্ট্রসম অ-প্রেক্ষণে, অনালোচনা ও অব্যক্ততার মাধ্যমেই যেন, মহামান্য আদালত যেন উপেক্ষিত অনালোচনার ফলে শূন্যে বিলীন করে দিলো সেই ২০০৫ সালের ৪-ঠা অগাস্টের সেই ৩৪৯-অনুচ্ছেদ-ব্যাপী জাজমেণ্টের মাধ্যমে। জাজমেণ্ট থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই জৈশ-ই-মহম্মদের সাথে আফজল গুরু অথবা বাকি চারজন অভিযুক্তের কারুর-ই কোনোপ্রকার লিঙ্ক এস্টাব্লিশ করতে পারে নি তদন্তকারী দিল্লি-পুলিশ।
অন্য কোন ভিত্তিতে এই তিনজনের নামে ফাঁসির আদেশ রুজু করতে ‘কনস্ট্রেইণড’ হচ্ছে সেই স-কন্সট্রার্নেশ্ দিল্লিস্থ ট্রায়াল কোর্ট? অথবা, এই যে এভিডেন্স আইনের ধারা ৮, ১০, ১৬-২৩, ২৪, ৪৫, ২৬, এমনকি ধারা ৩০ নিয়েও এতো বিশদ আলোচনা করলো মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট অফ ইণ্ডিয়া, তবে ক্যানো সেও আইনের-ই ধারা ৬৫-বি তথা ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স-এর মান্যতা নিয়ে এত সংক্ষেপ ও সীমিত আলোচনায় সীমাবদ্ধ রইলো সেই আদালত? এ’ সব প্রশ্ন খোলা পড়ে থাকে অনুত্তরের অবহ্যালায়। শেষের প্রশ্নটির প্রসঙ্গে দ্যাখা যায়, ৩৩৯ অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই যে সুবৃহৎ জাজমেণ্ট যার পোষাকি নাম ‘স্টেট অফ দিল্লি বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু’ – তার কেবলমাত্রা অনুচ্ছেদ নং ১৪৮ থেকে ১৫২- এই পাঁচটি অনুচ্ছেদে অতি-সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে এই এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি-র নিরিখে, ট্যাপ করে রেকর্ড করে নেওয়া ফোন-কথোপকথনের আইনি গ্রহণযোগ্যতা। এছাড়া, অনুচ্ছেদ নং ১৫৩ থেকে ১৫৫ – এই তিন অনুচ্ছেদে আরো সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে ফোন ট্যাপিং – আদালতভাষ্যে – ‘ইন্টারসেপশান’ – সেই প্রসঙ্গে।
অর্থাৎ, সেই ৩৩৯-টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৮-টি অনুচ্ছেদ, তথা, সুপ্রিম কোর্ট কেসেস কম্পেন্ডিয়াম-এর ২০০৫ সালের ভলিউম নং ১১-র ১৯৭-টি পৃষ্ঠাময় বিরাজমান এই যে সুপ্রীম কোর্ট ডিভিশান বেঞ্চ কর্তৃক সন – ২০০৫, তাং – ৪-ঠা অগাস্ট প্রণীত আফজল গুরুর ফাঁসির চুড়ান্ত নিদান-নির্ঘোষ, তার মাত্র ৬-টি পৃষ্ঠা – উল্লিখিত এস-সি-সি ২০০৫, ভলিউম ১১-৪ পৃঃ নং ৭১৩ থেকে পৃঃ নং ৭১৯ – এইটুকুমাত্র জায়গায় আলোচিত হল এই দুই গুরুতর ও কানেক্টেড ইশ্যু-নিবদ্ধ প্রসঙ্গে – প্রথমতঃ, আই-বি-র সহায়তায় পুলিশের আড়ি পেতে ‘ইন্টারসেপ্ট’ করে রেকর্ড ও অনুলিখন করিয়ে নেওয়া কথোপকথন যথার্থ এভিডেন্স আকারে গ্রাহ্য কি গ্রাহ্য নয়, এবং, যদি বা তা গ্রাহ্য হয়, তবে সেই সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স হিসেবে, অর্থাৎ এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬৫-বি অনুসারে গৃহীত ইলেকট্রনিক রেকর্ডের ভিত্তিতে এমন গুরুতর অপরাধের গুরুদণ্ড বিধান সম্ভব কি সম্ভব নয়।
এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি – সে বিষয়ে কোন অ্যাপ্রোচ নিলো সুপ্রীম কোর্ট?
এই প্রসঙ্গে কয়েকটি ধারা ও জাজমেণ্ট থেকে উদ্ধৃত করে, কোনোপ্রকার যুক্তিপ্রদর্শনের পথে না গিয়েই, সুপ্রীম কোর্ট যে অবস্থান গ্রহণ করলো আফজল গুরুর ফাঁসির মামলা তথা স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু মামলায়, তার প্রকাশ, মূলতঃ এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি-র প্রসঙ্গে যেমন ধরা পড়লো তা হল –
“যদিও এভিডেন্স আইন-এর ধারা নং ৬৫-বি, উপধারা নং ‘৪’ অনুসারে কোন ইলেকট্রনিক রেকর্ড অর্থাৎ আলোচ্য ফোন-ইন্টার্সেপ্ট-গুলির যথার্থতার স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো সার্টিফিকেশন জমা পড়ে নি কোর্টের কাছে ফরিয়াদী রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে, তবুও, ঐ একই আইনের ধারা নং ৬৩ ও ৬৫ অনুসারে সেই ইন্টার্সেপ্ট-সমূহ, অর্থাৎ আড়ি পেতে শোনা, রেকর্ড, কখনো অনুবাদ ও অনুলিখিত করা তথ্যকে সেকেণ্ডারি/ ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স হিসেবে আদালত গ্রাহ্য করতেই পারে এবং করেছে।” (সূত্র: স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু, ২০০৫, ১১ এস-সি-সি ৬০০, অনুচ্ছেদ নং ১৫০; অনুবাদ – আমাকৃত)
এই প্রসঙ্গে ও বিষয়ে, আলোচ্য মামলায়, মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট অফ ইণ্ডিয়া-র অবস্থান আরো স্পষ্ট করা হয়েছে এই জাজমেণ্টের-ই অনুচ্ছেদ নং ১৫২-এ –
“সেই (ইলেক্ট্রনিক) রেকর্ড – [অর্থাৎ, সেই আড়ি পেতে শুনে রেকর্ডিং, অনুবাদ ও অনুলিখনের মাধ্যমে বাদীপক্ষ তথা প্রোসিকিউশান-কর্তৃক আদালতে পেশ করা কথোপকথনগুলি] – যেই সিস্টেম-এ সংরক্ষিত হয়েছে সেই সিস্টেমের বা সেই সংরক্ষিত রেকর্ড-গুলির কোনপ্রকার ট্যাম্পারিং তথা বিকৃতিকরণ ঘটেছে – এমন অভিযোগ উভয়পক্ষের কারুর তরফ থেকেই উঠে আসে নি। সেই রেকর্ড তথা রেকর্ডিং পর্যাপ্ত রেগ্যুলারিটি-র সাথেই করেছে প্রোসিকিউশান। অর্থাৎ, সাধারণ ব্যবহারিক ও সচল কম্পিউটার/ সিস্টেম-এর মাধ্যমেই গৃহীত তথা সংরক্ষিত হয়েছে সেই বৈদ্যুতিন তথ্যপ্রমাণ। অতএব, এই রেকর্ডিং-গুলির যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য এর উপরে আরো কোনো উইটনেসকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রয়োজন দেখতে পাচ্ছে না এই আদালত” – (অনুমাদ – মদীয়)
অর্থাৎ, শুধু যে সেই কল রেকর্ডিং অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়ে তার মূল ভিত্তিতে ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে আফজলের শুধু তাই নয়, তেই অপ্রত্যক্ষ্য সেকেণ্ডারি ডক্যুমেণ্ট তথা ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড/ এভিডেন্স-এর সমর্থনে কোনো ব্যক্তি- সাক্ষাতের প্রমাণস্বরূপ সার্টিফিকেশান অথবা উইটনেস-আকারে সেই সেকেণ্ডারি এভিডেন্স এর যথার্থতা সুনির্দিষ্ট করা – তাও এই ফাঁসির হুকুম বলবৎ করার পথে অপ্রয়োজনীয় অতিরেক হিসেবে গণ্য করছেন মাননীয় শীর্ষ আদালত, ভারত। য্যানো সব আগের থেকেই ঠিক হয়ে আছে।
এভিডেন্স-এর অপ্রতুলতা, অপরাধের সাথে অভিযুক্তদের সরাসরি লিঙ্ক করছে ত্যামোন কোনো তথ্যপ্রমাণের অভাব – এই সব অগ্রাহ্য করে, এই বিষয়ে কোন আলোচনার অপেক্ষা না রেখে, কেবলমাত্র পুলিশি বয়ানে বিধৃত ফ্যাক্ট-এর উপর নির্ভর করে, সেই অপ্রতুল ও অপ্রতক্ষ্য প্রমাণের দুর্বল ভিত্তিতে-ই আফজল গুরু-র ফাঁসির আদেশ বহাল করলো মহামান্য শীর্ষ আদালত।
সামগ্রিক ভাবে এই আলোচনা আরম্ভ হয়েছিলো এভিডেন্স আক্ট, ১৮৭২-এর ২০০০ সালে প্রণীত সেই সালের কেন্দ্রীয় সংশোধনী আইন নং ২১ মারফৎ প্রবিষ্ট ধারা ৬৫-বি তথা ইলেকট্রনিক এভিডেন্স বিষয়ে। ইলেকট্রনিক রেকর্ডস তথা বৈদ্যুতিন উপায়ে সংগৃহীত তথ্য প্রামাণ্য মূল্য – বিশেষতঃ এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি-র নিরিখে, প্রথমবার আলোচিত হয় ২০০৫ সালের ৮-ঠা অগাস্ট সুপ্রীম কোর্ট ঘোষিত ঐ স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্টের সংক্ষিপ্ত পরিসরের মাধ্যমেই- অর্থাৎ যে জাজমেণ্টে আফজল গুরু-র ফাঁসির আদেশ তুলে ধরে মহামান্য শীর্ষ আদালত সেই জাজমেণ্টের অনুচ্ছেদ ১৪৮ থেকে ১৫৩-র মাধ্যমেই।
এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি এবং সুপ্রীম কোর্ট কী ভাবে এই বিষয়ে অন্যান্য জাজমেণ্ট-এ এই ‘স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু’ মামলায় গৃহীত স্বীয় অবস্থান থেকে থেকে সরে এসেছে।
গত ১৫-১৬ বছরে এই ইলেকট্রনিক রেকর্ডস-এর এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আরো একাধিক জাজমেণ্ট পাশ করে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট। এই স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্ট-এ ইলেকট্রনিক এভিডেন্স হিসেবে এই যে সেই জাজমেণ্টের-ই অনুচ্ছেদ নং ১৫০ মারফৎ স্ব-ঘোষিত অবস্থান – যে, এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ধারা ৬৫-বি-র শর্তগুলি উপেক্ষা করলেও সেই আইনেরই ধারা ৬৩ এবং ৬৫-র যৌথ ভূমিকাবলে ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার দাবী রাখে আদালতের দরবারে – সেই অবস্থান থেকে ২০১৪ সালে সরে এলো সুপ্রীম কোর্ট। ‘আনোয়ার পি-কে বনাম পি-ভি-কে বশীর’ নামক জাজমেণ্ট, যার সুপ্রীম কোর্ট কেসেস-নির্ধারিত সাইটেশন নং হল (২০১৪) ১০ এস-সি-সি ৪৭৩, সেইখানে জানানো হলো যে আইনের, বিশেষতঃ এভিডেন্স আইনের চোখে সেই আইনের ধারা ৬৩ ও ৬৫ ওভাররাইড করতে পারে না, অর্থাৎ নস্যাৎ করে দিতে পারে না ধারা ৬৫-বি-র নিদান।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সুপ্রীম কোর্টের ২০০৫ সালে প্রণীত স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সাধু জাজমেণ্ট-টি পাশ করেছিলো সুপ্রীম কোর্টের দুইজন জাজের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের জাজমেণ্ট-এর মাধ্যমে মহামান্য সর্বচ্চ্ব ন্যায়লায় যে নতুন অবস্থান গ্রহণ করলো, সেই জাজমেণ্ট পাশ করেছিলো যে সুপ্রীম কোর্ট-এর বেঞ্চ তাঁর স্ট্রেন্থ – ৩, অর্থাৎ তিনজন জাজ একত্রে সুপ্রীম কোর্টের তরফ থেকে সেই মামলার শুনানীতে বসেছিলেন। অথচ, এই তিন-জাজ ভূষিত বেঞ্চ প্রণীত জাজমেণ্ট মারফৎ ২০১৪ সালে সুপ্রীম কোর্ট-এর ইলেকট্রনিক এভিডেন্স-প্রসঙ্গে এই নতুন অবস্থান গ্রহণ করার বছরখানেক আগেই সেই আগের ভুল হিসেবে স্বীকৃত ও পরিত্যক্ত অবস্থানের ভিত্তিতে ফাঁসি হয়ে গ্যাছে আফজল গুরু-র।
এই বিষয়ে, অতিসম্প্রতি, অর্থাৎ, ২০২০ সালে, সুপ্রীম কোর্টের আপরাপর একটি তিন-জাজ ভূষিত বেঞ্চ মারফৎ ‘অর্জুন পণ্ডিতরাও খোটকর বনাম কৈলাশ কুশান-রাও গোরাণ্টিয়াল’ – সাইটেশন – ২০২০ এস-সি-সি অনলাইন, এস সি ৫৭১ -এর মাধ্যমে আবারও বলেছে যে এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি অনুসারে কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড বা তথ্য-কে এভিডেন্স হিসেবে নথিভুক্ত করতে হলে সেই ধারার-ই উপধারা নং ‘৪’-এর পালন হিসেবে সার্টিফিকেশন জরুরি। এই একই অবস্থানে ২০১৪ সালে ‘আনোয়ার বনাম বশীর’ জাজমেণ্ট-ও উপনীত হয়েছিল মাননীয় সর্বোচ্চ্ব আদালতের আরেকে তিন-জাজ সন্নিবিষ্ট বেঞ্চ। অথচ, তার নয় বছর আগে যখন সেই সুপ্রীম কোর্টের-ই দুই-জাজ-বিশিষ্ট ডিভিশান বেঞ্চ ‘স্টেট অফ দিল্লি বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু’ মামলায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে সেইধরণের কোন সার্টিফিকেশান-এর প্রয়োজন নেই, তখন, সেই অপসিদ্ধান্তের বদৌলত তথা প্রকোপেই সেই সেব বে-সার্টিফায়েড টেলিফোন রেকর্ডিং-কে এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫-বি, উপধারা ‘৪’ একপ্রকার অমান্য করার দরজা-ই য্যানো সবলে স(রাষ্ট্র)রোষকষায়িত তাড়নাতেই বুঝিবা, সম্পূর্ণ ও সর্বতঃভাবেই বিনা যুক্তিপ্রদর্শনে-র মাধ্যমে অবারিত করেছিলো। প্রাসঙ্গিক শুভবুদ্ধির ক্রমে উদয়ে হয়েছে ভারতীয় হায়ার জ্যুডিশিয়ারি-র মনন আঙিনায় ঐ বৈদ্যুতিন তথ্য ও রেকর্ডের যথার্থতা-নির্ণায়ক সার্টিফিকেশন প্রসঙ্গে। আবার বন্ধ হয়েছে এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ধারা ৬৫(৪) অমান্য করার কবাটবীথিকা। অথচ, ততদিন, ওই অমান্যে ও অন্যথায় গৃহীত ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড তথা ফোন-কল রেকর্ডিং ও ট্র্যান্সক্রিপ্ট-এর গাজোয়াড়ি-জোরের ফলস্বরূপ ফাঁসি হয়ে গিয়েছে আফজল গুরু-র।
ফোন রেকর্ডিং যথার্থ এভিডেন্স কি না সেই প্রসঙ্গে সুপ্রীম কোর্ট ১৯৮২ সালে প্রথমবার যা বলেছিলো
অথচ, বিষয়টি অ্যামোন-ও নয় যে সেই ২০০৫ সালের স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্টে-ই প্রথমবারের মতো টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখা টেলিফোনিক কথোপকথনের রেকর্ড বা রেকর্ডিং- এভিডেন্স হিসেবে গ্রাহ্য কি না তা সুপ্রীম কোর্টের সামনে আলোচ্য বিষয়বস্তু হিসেবে প্রতিভাত হয়। ১৯৮২ সালে সুপ্রীম কোর্টের এক ডিভিশান বেঞ্চ – মহাবীর প্রসাদ বর্মা বনাম সুরিন্দর ক্য’র – (১৯৮২) ২ এস-সি-সি ২৫৮-এর অনুচ্ছেদ নং ২২-এ এই মর্মে নির্ধারণ করে যে টেপ রেকর্ডার-এ ধরে রাখা টেলিফোনিক কথোপকথন অবশ্যই এভিডেন্স হিসেবে গ্রাহ্য, তবে সেই গ্রহণযোগ্যতা কেবল ‘করোবোরেটিভ এভিডেন্স’ – হিসেবে – অর্থাৎ যা মৌলক তথ্যপ্রমাণ-কে সেকেণ্ডারি এভিডেন্স হিসেবে ‘করোবোরেট’ করছে।
এই প্রসঙ্গে, স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্ট-এর ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এ’হ্যানো ‘করোবোরেটিভ এভিডেন্স’, পুলিশের সামনে করা ‘স্বীকারোক্তি’, এবং, সেই তথাকথিত ‘স্বীকারোক্তি’-র ফলে পুলিশের উদ্ধার করা কিছু মামুলি সরঞ্জামের এভিডেনশিয়ারি ভিত্তিতেই ফাঁসি হয়ে যায় আফজল গুরু-র। পুলিশের বয়ানে যদিও এমন প্রতিভ যে, সেই ‘স্বীকারোক্তি’-র জেরে প্রাপ্ত সরঞ্জামগুলির মধ্যে বোমা তৈরির মশলা ছিলো। সেই বিষয়ে-ও সমস্ত স্তরেই পুলিশি বয়ানকেই অপ্রশ্নে শিরোধার্য করে এগিয়েছিলো আদালত। তবে সেক্ষেত্রেও, যদিও বা এক্সপ্লোসিভ সাবস্ট্যান্সের আইন, ১৯০৮-এর আওতায় কিছু অপরাধ প্রমাণীত হয় আফজলের বিরুদ্ধে – তা দিয়ে অদনীন্তন অ্যাণ্টি-টেরর-আইন তথা পোটা, ২০০২ অনুসারে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ লিপ্ত হওতার অভিযোগের কোনোভাবে প্রমাণিত হয় না, যেমন হয় না ‘পিনাল কোডের কোহিনুর’ তথা রাজদ্রোহে কোনো ইনগ্রেডিয়েণ্ট।
উপসংহার – চরম অন্যায়
এত কিছু না-হওয়ার মাঝ দিয়ে দিয়ে-ই, এই স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু জাজমেণ্টের মাধ্যমেই, সর্বোপরি ঘটে গ্যালো যা তা হল চরম অন্যায় – সাংবিধানিক নৈতিকতার হৃৎকমল শেলবিদ্ধ হল এই মামলায়, এই জাজমেণ্টে তুলে ধরা, কালক্রমে বীভৎস মজা হিসেবে সমাদরে-সমারোহে পালিত হওয়া, ফাঁসির আদেশের মাধ্যমে। এই ভাবে এবং এই কারণসমূহের মাধ্যমেই, ভারতীয় জ্যুডিশিয়ারির তথা ন্যায়বিচারব্যবস্থা-কে, ভারতীয় আইনব্যবস্থার মাধ্যমে ‘ইকুইটি;-র ধরণ-ধারণ-লালন-পালনের ডিসকোর্স-কে , এবং, সর্বোপরি, ভারতীয় সাংবিধানিকতা-র ইতিহাসকে ‘হন্ট’ করে চলবে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট দ্বারা ২০০৫ সালের ৪-ঠা অগাস্ট প্রণীত এই ‘স্টেট বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু’ জাজমেণ্ট, যার মাধ্যমে আফজল গুরু-র ফাঁসির আদেশ চুড়ান্ত হয়।
[সমাপ্ত]
Posted in: ARTICLE, August 2021 - Serial