কার্ল ইয়ুং – কুণ্ডলিনী যোগের মনস্তত্ত্ব : অনুবাদ – অর্ঘ্য দত্ত বক্‌সী

[১৯৩২ সালের সেমিনারে প্রদেয় এ বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য ছিল অপরিচিত ভারতবর্ষকে জানা চেনার জন্য পাশ্চাত্যের অপরিসীম কৌতুহলকে কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা। এখানে কুণ্ডলিনী সাধনাকে পাশ্চাত্যের মনোবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে; এমনভাবে যা কিনা হয়তো সিদ্ধ তান্ত্রিকরাও করেন না। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত যেমন ভারতেরই সাধারণ মানুষের কাছে শুধু সেই “আ আ আ আ …” তেমনই কুণ্ডলিনী বা তান্ত্রিক সাধনা বিষয়ে জ্ঞান আপামর ভারতবাসীর কাছেও প্রায় শূন্য, কিছুটা ভয়-ভীতি-ভক্তির ব্যাপার! সেই ধারণাগুলি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের আপামর জনতার কাছেই আজও ৮০% অধরা। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে ধর্ম-সাধনা-যোগ বা দেবদেবী বলে যদি কিছু আসলে থেকে থাকে তার মূল আকর হল কুণ্ডলিনী যোগ। তার থেকেই প্রতীকায়নে দেবমূর্তি, পুজোয় শঙ্খ কাসর ঘণ্টা, তার থেকেই প্রতীকে বলা পুরাণ কী সৃষ্টিরহস্য (সমুদ্র মন্থন)। ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নে বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার আগে ধর্ম বলতে শুধু এটাই বোঝাতো। এগুলি দেহগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আবার এই অভিজ্ঞতা এক একজনের কাছে এক একরকম, তবে দেহগত বলে ( কোন আইডিয়া নয় ) সব ধর্মেই তাই এর প্রভাব কমবেশি আছে। তাই প্রাচীন ধর্মগুলির ‘গল্প’গুলো খানিকটা একরকম।
ব্যস এটাই, এখানে শুধু শরীরী-সংস্থানগতভাবেই নয়, প্রতিটি চক্রের চিত্রিত প্রতীকগুলিকে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে এই শরীরী চক্রস্থানে বীর্য উঠে এলে যা অনুভূতি হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে মনেও এক আলাদারকমের ভাব জেগে ওঠে। সেই ভাবগুলিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ইয়ুং। তিনি নিজে যোগাসন প্রাণায়াম সবই করতেন। এছাড়াও এই বক্তৃতাগুলো গ্রন্থরূপে ও ইংরেজিতে আমেরিকায় প্রকাশিত হচ্ছে নব্বইয়ের দশকে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। এইসব চর্বণগুলি তাই প্রাসঙ্গিক থেকে যায়। কারণ কুণ্ডলিনী এক শাশ্বত জিনিষ ও যা যা শাশ্বত তাতেই অনুবাদকের আগ্রহ।

গত ছয়টি পর্বে প্রকাশিত কার্ল ইয়ুং প্রদেয় দ্বিতীয় বক্তৃতার অনুবাদের ধারাবাহিকতায় এই সংখ্যা শুরু হচ্ছে সপ্তম পর্ব। এই পর্বের মাধ্যমে সমাপ্ত হচ্ছে দ্বিতীয় বক্তৃতার অনুবাদ।]

মণিপুর চক্রের উন্নততর স্তরে পৌঁছোলে এক অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আসে। দেহসংস্থানগতভাবে মধ্যচ্ছদার নিচে অবস্থিত এই চক্রে এসে অদ্ভুত এক পরিবর্তন সংগঠিত হয়। মধ্যচ্ছদার উপরে এলে দেখা পাওয়া যায় অনাহতের, হৃদয় বা বায়ু উপাদানের চক্রের, কারণ হৃদয় ফুসফুসের সঙ্গে ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে ও যৌথভাবে তার কাজ করে থাকে। খুব আনাড়িদেরই এসব কথা বলে বুঝিয়ে দিতে হয়। আদিম জনজাতিদের অভিজ্ঞতাও ঠিক এরকম প্রকারেরই। আসলে এগুলি শারীরবৃত্তিয় সত্য। মণিপুর চক্রের মনস্তাত্ত্বিক অর্থ আমরা কম বেশি আলোচনা করেছি কিন্তু এবার আমরা বড় অভিযানে যাব- অনাহতের অর্থের সন্ধানে। নরকে পতিত হওয়ার পর মনস্তাত্ত্বিকভাবে কী ঘটে? আবেগ, তীব্র আসক্তি ও আদিম কামনা বাসনার ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে গিয়ে পড়ার পর কী ঘটে?

জনৈকাঃ সম্ভবত মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরস্পর বিপরীত দুইয়ের অমোঘ মিলন। এবং তারপর কিছু অলৌকিক দর্শন অথবা হয়ত আরো ব্যক্তি-অতিক্রান্ত কিছু কিছু অভিজ্ঞতা।

ইয়ুংঃ পরস্পর বিপরীতের মিলনে নৈর্ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা। মানুষ আর তার আসক্তির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে না। এই তত্ত্বগুলির আলোচনা করা বেশ কঠিন কারণ বেশিরভাগ মানুষই মণিপুরের সঙ্গেই একাত্মতা অনুভব করে। এর অতীতে কী আছে তার অনুমান করা বেশ কঠিনই তাই। তাই শুরুতে আমরা অনাহতের প্রতীকটিকে নিয়েই কাজ করব। আগেও বলেছি যে এই চক্রটি বায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত। মধ্যচ্ছদা যেন মাটির উপরিতলটি আর অনাহতে পৌঁছোতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সেই ভূমিতল ছেড়ে উপরে উঠে যেতে হবে। কিন্তু কীকরে তা সম্ভব?
যতক্ষণ মণিপুরে আছি আমরা খুব সচেতন নই যে আমরা কোথায় অবস্থান করছি, সেখানে আমরা মূলাধারের সঙ্গেও যুক্ত থাকছি, অন্তত আমাদের একটি পা তখনও মূলাধারেই ভর দিয়ে আছে; কিন্তু অনাহত চক্রে আমরা পুরোপুরি মাটির থেকে উপরে উঠে গেছি। তাহলে আক্ষরিকভাবে কীপ্রকারে আমরা মাটির থেকে উপরে উঠতে পারি?
জনৈকাঃ বায়ুর মাধ্যমে।
ইয়ুংঃ হ্যাঁ, এটি প্রতীকটির মধ্যেই ব্যক্ত, কিন্তু আরো কিছু আছে যা একে খানিকটা সহজভাবে ব্যাখ্যা করে।
জনৈকঃ একপ্রকারের পাতনক্রিয়া?
ইয়ুংঃ এটা খুব ভালো ভাবনা যা আমাদের সোজা অপরসায়নের প্রতীকগুলোর মধ্যে নিয়ে যায়। একজন অপরসায়নবিদ একে ঊর্দ্ধপাতনের প্রক্রিয়া হিসাবে হয়ত ব্যাখ্যা করবেন। কিন্তু যে প্রতীকটিকে নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করেছি তার মধ্যে থেকে কি কিছু বেরিয়ে আসছে?
জনৈকঃ সূর্য দিগন্তরেখা থেকে উপরে উঠে আসে।
ইয়ুংঃ হ্যাঁ, মিশরীয় প্রতীকানুযায়ী সূর্যের সঙ্গে একাত্ম হলে ব্যক্তি সূর্যের জাহাজে চেপে দিগন্ত থেকে উপরে উঠে স্বর্গে গিয়ে পৌঁছায়। সূর্যই সর্বোচ্চ শক্তি। ফ্যারাওয়ের লেজুড় হলে ব্যক্তিকে সূর্য পবিত্রতম স্থানে তুলে নিয়ে যায়। মণিপুরে অবস্থিত থেকে যদি সূর্যের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায় তবে তা ব্যক্তিকে ধরিত্রীর পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর শূন্যে তুলে নিয়ে যায়। বাতাসেরও এইজাতীয় ক্রিয়া করার ক্ষমতা আছে, কারণ আদিম গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিশ্বাস করা হয় যে পবিত্র শক্তি বা আত্মা একধরণের বাতাস। তাই বহু ভাষাতেই বাতাস ও আত্মার জন্য ব্যবহৃত শব্দের একই উৎস। বায়ু ও পবিত্র আত্মার মধ্যে যোগাযোগের কারণ হল আত্মাকে প্রাথমিকভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস হিসাবেই মনে করা হত; বিশ্বাস করা হত যে অন্তিম নিঃশ্বাসের সঙ্গে আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে সেই জাদু বায়ু অথবা সূর্যই একজনকে ভূমিপৃষ্ঠ থেকে উপরে তুলে নিয়ে যেতে পারে। এবং কখন আমরা এই দুই শক্তিকেই একত্রে পাই? মনঃসমীক্ষণ সাহিত্যের সেই অতি আগ্রহব্যঞ্জক মনোরোগীর কথা হয়ত আপনাদের মনে আছে। এটা সেই উদাহরণ যার থেকে আমি বায়ু ও সূর্যকে পরস্পর সদৃশ বলে দাবি করেছি। সেই মনোরোগীটি দেখেছিল যে একধরণের নল সূর্যের থেকে নিচে ঝুলে আছে। সে ওটিকে ‘সূর্যের লিঙ্গ’ ভেবেছিল এবং যখন সেই রোগী মাথা নাড়াত তখন সেই সূর্যলিঙ্গও দুদিকে দুলত ও তার ফলে বায়ু বেগে প্রবাহিত হত। এই দর্শন এটাই প্রমাণ করে যে সূর্য ও বায়ু প্রকৃতপ্রস্তাবে একই।
জনৈকঃ গ্রিক পুরাকথায় সূর্য উদয়ের পূর্বে একপ্রকার ধ্বনি শ্রুত হয়।
ইয়ুংঃ সেটা মিশরীয় পুরাকথায় মেমননের মূর্তি যে সূর্যোদয়ের সময় একপ্রকার অদ্ভুত শব্দ করত, কারণ গ্রিক পুরাকথা অনুযায়ী মেমনন ঊষার দেবী অরোরার পুত্র, তাই ঊষালগ্নে সে মাতৃবন্দনা করত। কিন্তু যথার্থভাবে এ সূর্য ও বায়ুর বিষয়ে বলে না। প্রতীকগুলি আমাদের জানায় যে অনাহতে গেলে কী হয়। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে এর বিশ্লেষণ করে না। এতক্ষণ আমরা পুরাকথা দিয়েই একে ধরার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মনস্তত্ত্ব দিয়ে নয়। মণিপুর চক্রের থেকে উপরে ওঠা কীভাবে সম্ভব, সেই ঠুনকো আবেগের জগতের উপরিতল থেকে আরো উপরে?
জনৈকাঃ আমাদের বৃদ্ধি হয় ও আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হই।
ইয়ুংঃ হয়ত, সেক্ষেত্রে কারোর পক্ষে সেটা বড্ড বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, কিন্তু এখানে আমরা স্বাভাবিক মানুষের জন্য প্রযোজ্য বিষয়ে আলোচনা করব। আমরা ধরেই নেব যে কুণ্ডলিনীর স্তরগুলির ক্রমপর্যায় একটি স্বাভাবিক ক্রমপর্যায়, কারণ এটি সহস্র বছরের অভিজ্ঞতার ঘনীভূত রূপ।
জনৈকঃ কেউ যদি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে তখন সে সংগীত বা কবিতার দ্বারা তার প্রকাশ ঘটায়।
ইয়ুংঃ অর্থাৎ আপনি বলছেন অনাহত কিছু উচ্চারিত বা প্রকাশিত করে। কিন্তু আবেগ সবসময়ই কিছু না কিছু উচ্চারিত করে। যতক্ষণ আপনি আবেগায়িত হয়ে আছেন- সবধরণের প্রকাশমাধ্যমে নিজেকে উচ্চারিত করে চলেন। কিন্তু অনাহত আবেগের উর্দ্ধে।
জনৈকাঃ এর অর্থ কি তবে এই যে মানুষ তখন ভাবতে শুরু করে?
ইয়ুংঃ একদম তাই।
জনৈকঃ বলা হয় যে এখানে পুরুষের জন্ম হয়, সুতরাং তাহলে এখানেই আরো পূর্ণরূপে আত্মনকে অনুভব করার শুরু। এখানেই নৈর্ব্যক্তিকতাকে চেতনে উপলব্ধি করা শুরু হয়।
ইয়ুংঃ হ্যাঁ, এখানেই যুক্তিবোধের, চিন্তনের, অনুধ্যানের প্রারম্ভ। আর তাই এখানেই আবেগগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে সংকুচিত করে নেওয়ার শুরু হয়। নিজের আবেগগুলির পিছনে পাগলের মতো না ছুটে এমন কিছু উপায় উপচার আবিষ্কার করে যাতে ব্যক্তি তার আবেগগুলির থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে অথবা নিজের আবেগগুলিকেই অতিক্রম করে যায়। নিজের ঝোড়ো মানসিক ক্রিয়াগুলিকে থামিয়ে হঠাৎ ব্যক্তি প্রশ্ন করে ‘আমি এরকম অদ্ভুত আচরণ করে যাচ্ছি কেন?’
এই চক্রেই আমরা তার প্রতীককে পাই। অনাহতে পুরুষকে অবলোকন করা যায়, এক ছোট্ট প্রতিমা যা পবিত্র আত্মনের প্রতীক, যা শুধুমাত্র যুক্তি-তর্কসাপেক্ষের উর্দ্ধে, কেবল নিসর্গ-প্রকৃতি বা নিম্নে দিকভ্রান্তের মতো প্রবাহিত হওয়া প্রাণশক্তির অর্থহীন অপচয় নয়। (পতঞ্জলির যোগসূত্রের ভাষ্যে ইয়ুং ‘পুরুষ’-এর ইয়ুরোপীয় পরিভাষা নিরূপণে ব্যাখ্যা দেন যে, জ্ঞানের বিষয়গততা যা যাবতীয় বস্তুগততা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কিন্তু এই সংজ্ঞায় দ্বিধা থেকে যায়- এ যেন খুব বেশি যুক্তিময়, আর প্রাচ্য মন পর্যবেক্ষণশীল সাক্ষীর মতো আর স্বজ্ঞামূলক। তাই পুরুষকে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয় যে পুরুষ যেন কোন সুপ্রাচীনকালের মানুষ বা আলোকপ্রাপ্ত কোন মানব।) মানুষ তার আবেগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায় আর এরম করতে করতে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে শেষপর্যন্ত চিতার আগুনে পুড়ে এক মুঠো ছাইয়ে পরিণত হয়। এমনই পরিণতি হয় উন্মাদদের ক্ষেত্রেও, তারা কোনো এক মানসিক দশায় চলে যায় আর সেখান থেকে কখনও বেরিয়ে আসতে পারে না। তাদের আবেগ দাহ্যপদার্থের মতো জ্বালাময়ী হয়ে উঠে বিস্ফোরণে নিজেকে ধ্বংস করে দেয়। নিজের আবেগ আকাঙ্ক্ষা থেকে বিযুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যদিও থাকে, আর যখন এই ঘটনা ঘটে ও মানুষ তা আবিষ্কার করে তখন সে সত্যিকারের ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠে। মণিপুর অবধি সে প্রকৃতির গর্ভেই অবস্থান করে; আসামান্যভাবে স্বয়ংক্রিয় অচেতন দশায়; সেই দশা একটি প্রক্রিয়া ব্যতীত কিছু নয়। কিন্তু অনাহতে নতুন এক অনুভূতি হয়, আবেগজাত বিকারগুলির থেকে নিজেকে উচ্চস্তরে তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে অবলোকন করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সে ‘পুরুষ’কে তার হৃদয়ে অনুভব করে, ‘সে যে ক্ষুদ্রের থেকেও ক্ষুদ্রতর আর বৃহতের থেকেও বৃহৎ’। অনাহত চক্রের কেন্দ্রে ‘লিঙ্গ’রূপে পুনরায় শিবকেই দেখা যায়, এবং মধ্যস্থিত ছোট অগ্নিশিখার অর্থ আত্মনের প্রথম ও অতিক্ষুদ্ররূপে আবির্ভাব।
জনৈকঃ একেই কি মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তিরূপায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা বলা যেতে পারে?
ইয়ুংঃ এটি আবেগের সঙ্গে বিযুক্তি; ব্যক্তি আর এগুলির সঙ্গে একাত্মবোধ করে না। নিজেকে যদি নিজেরই তীব্র আসক্তি আর আকাঙ্ক্ষার থেকে আলাদাভাবে আবিষ্কার করতে পারা যায় তবেই আপনি আত্মনকে আবিষ্কার করেছেন; আপনার ব্যক্তি-রূপায়ন শুরু হয়েছে। সুতরাং অনাহতেই এই সত্ত্বায়ন শুরু হয়। ব্যক্তিরূপায়নের অর্থ এই নয় যে আপনি একটি অহং-এ পরিণত হলেন- তাহলে তো আপনি হয়ে উঠবেন একজন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবাদী বা অহংবাদী। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবাদী একজন মানুষ কখনও ব্যক্তি-রূপায়নবাদী হয়ে উঠতে পারেন না; তিনি বরং দার্শনিকভাবে বিশুদ্ধ একজন অহংবাদীই। ব্যক্তি-রূপায়ন হল তাই হয়ে ওঠা যা অহং না হয়ে ওঠা এবং এটাই হল আশ্চর্যের। তাই কেউই বুঝে উঠতে পারে না যে আত্মন কী, কারণ আত্মন তাই যা তুমি নও, যা তোমার অহং নয়। অহং নিজেকে আত্মনের সঙ্গে খুব আলতো বন্ধনে যুক্ত সামান্য ও প্রায় অপ্রয়োজনীয় এক অংশরূপে আবিষ্কার করে। কারণ অহং-এর অবস্থান একেবারে নিচে মূলাধারে আর সে হঠাৎ নিজেকে চারস্তর উপরে অর্থাৎ অনাহতে সম্পূর্ণ অন্যরূপে আবিষ্কার করে এবং তাই হচ্ছে আত্মন।
কেউ যদি এরকম ভ্রান্ত ধারণা করে যে সে একইসঙ্গে মূলাধারে আর অনাহতে অবস্থান করছে আর সে স্বয়ং পুরুষ, তাহলে তাকে উন্মাদই বলতে হবে। একেই বলে মাটির সঙ্গে সংযোগ না থাকা নিরালম্ব অবস্থা। আমরা সেই স্তরে গিয়ে শুধুমাত্র পুরুষকে উপলব্ধিই করতে পারি। কিন্তু নিজে আমরা পুরুষ নই, পুরুষ ব্যক্তি-নিরপেক্ষ এক অবস্থার প্রতীক। পুরুষ সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তি-নিরপেক্ষ এবং সর্বপ্রকারেই নৈর্ব্যক্তিক। আপনি যদি আত্মনরূপে কর্ম করেন তাহলে আপনি কোনোভাবেই আর ব্যক্তি-আপনি নন— আত্মনের বোধ আপনি তখন উপলব্ধি করেন। তখন আপনি নিরাসক্ত কর্ম করেন, আপনি বাজারে যান, কেনেন কিন্তু কেনেন না, বেচেন কিন্তু বেচেন না, অথবা সন্ত পলের মতো করে বললে, ‘ আমি যেন আমি হয়ে বাঁচি না, আমার মধ্য দিয়ে যিশুই যেন বাঁচেন,’ এর অর্থ তার জীবন এক নৈর্ব্যক্তিক বেঁচে থাকায় পরিণত হয়েছে, তা ব্যক্তিগততা ছাড়িয়ে অনেক বিরাট এক সত্তায় বেঁচে থাকা অর্থাৎ পুরুষে বেঁচে থাকা।
উন্নততর সভ্যতার সব আদিম জনগোষ্ঠীগুলিই অনাহতকে আবিষ্কার করেছে। অর্থাৎ তারা যুক্তি দিয়ে বিচার করে ভাবতে পারে; তারা আর ততটা বন্য থাকে না। তাদের অনুষ্ঠানগুলি খুবই জাঁকালোভাবে হয়—যত তারা আদিম হয় তাদের আচার-অনুষ্ঠান ততই বড় করে হয়। মণিপুরের মনস্তাত্ত্বিক (আবেগের) বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে এর প্রয়োজন আবশ্যিক। বিবিধ প্রকাশ্য আলোচনাসভা বা যৌনতা– সবক্ষেত্রেই তাদের করা আশ্চর্য সব আচার-অনুষ্ঠানগুলি মণিপুরের ক্ষতিকর শক্তিগুলি থেকে বাঁচার মনস্তাত্ত্বিক উপায়। আদিবাসীদের মধ্যে প্রকাশ্য আলোচনাসভায় থাকতে গেলে আপনাকে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম পালন করতেই হবে যা পূর্ণতই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয়—কিন্তু এর মাধ্যমেই আপনি তাদের চিনতে পারবেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সেই আলোচনাসভাগুলিতে থাকবে অভ্রান্ত ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ, যিনি আলোচনাসভা ডাকবেন তাকে তাই অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সম্মানীয় হতে হবে। যেমন তিনি বসবেন একটি চৌকিতে আর সবাই মাটিতে বসবে; তিনি বসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বসে পড়তে হবে নাহলে তাদের কশাঘাত করে বসিয়ে দেওয়া হবে। তারপরও তারা কিছু বলতে পারবে না। প্রথমে কর্তাকে সিগারেট দেশলাই ইত্যাদি উপহার দেওয়া হবে আর মোড়ল সেগুলি সাধারণদের থেকে অনেক বেশি পাবেন, কারণ এই মর্যাদা হিসাবে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগকে মান্যতা দিতেই হবে। এগুলি সবই মণিপুরের জ্বলন্ত আবেগে ফিরে যাওয়ার থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রক্রিয়া এবং এই আচারগুলি সেভাবেই পালিত হলে যে ব্যক্তি এই আলোচনাসভা ডেকেছেন তিনি বলা শুরু করবেন। তিনি একটি শায়েরি/মন্ত্র বলবেন। তারপর থেকে সভা শুরু হবে। মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে যে আর কেউ কোনো কথা বলবে না। তারপর কর্তা তার বক্তব্য বলবেন, আর যার সঙ্গে তিনি সমঝোতা করতে চান তিনি তারপর বলবেন, কিন্তু খুবই নিচু স্বরে যাতে প্রায় শোনাই না যায় আর তিনি দাঁড়িয়েও কথা বলতে পারবেন না। কেউ যদি একটু জোরে কথা বলে তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে কশাঘাত করা হবে যাতে কোনোভাবে কেউ আবেগতাড়িত না হয়ে পড়ে, কারণ ঐ জমায়েত যদি একবার আবেগতাড়িত হয়ে ওঠে তবে মারামারি বেঁধে যাওয়ার আর খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এইধরণের সভায় অস্ত্র নিয়ে আসা নিষিদ্ধ। আর সভা শেষ হলে বলতে হবে আবারও মন্ত্র যার অর্থ ‘সভা এবার শেষ হল’।
একবার আমি এই কথা না বলেই উঠে পড়েছিলাম এবং মোড়ল অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন— ‘না, আপনি এখন উঠতে পারেন না!’ আর তারপর আমি মন্ত্র বলি এবং ওঠার অনুমতি পাই। সেই জাদুবৃত্তবৎ সভার সমাপ্তি হওয়ার আগেই মন্ত্র না বলে উঠে গেলে সন্দেহ করা হবে যে কাউকে মানসিকভাবে আঘাত করা হয়েছে বা তাকে মারাত্মকভাবে উত্তেজিত করা হয়েছে। এই নিয়ম মান্য না করলে তা খুবই বিপদজনক হয়ে ওঠে, এমনকি তাকে হত্যাও করা হতে পারে, কারণ এভাবে না বলে কেউ যদি ওঠে তাহলে ধরেই নেওয়া হয় যে সে উন্মাদ হয়ে গেছে। এমনও হতে দেখা যায় যে তারা অনুষ্ঠানে নাচতে নাচতে এতই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে পরস্পরকে হত্যা করতে শুরু করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সারাসিন ভ্রাতৃদ্বয় ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সুলাওসিতে উপজাতিদের পুরাতাত্ত্বিক তত্ত্বানুসন্ধান করতে গিয়ে প্রায় প্রাণ হারাচ্ছিলেন সেই মানুষগুলির হাতেই যারা তাদের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করছিল। তারা তাদের যুদ্ধযাত্রার নাচ দেখাচ্ছিল এবং তা দেখাতে গিয়ে নিজেরা এতই যুদ্ধের মানসিকতায় চলে গিয়েছিল যে সারাসিনদের উপর তারা তীর মারতে শুরু করে। ভাগ্যবলেই তারা বেঁচে ফিরেছিলেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অনাহত এখনও খুবই অস্পষ্ট ধারণা আর আমরা মণিপুরের মনস্তত্ত্বের বেশ কাছাকাছি মানসিকতায় আছি। তবুও মণিপুরের আবেগের বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে আমাদের যথেষ্ঠ বিনয়ী ব্যবহার করা উচিত।

Facebook Comments

Leave a Reply