কতদূর স্বাধীনতা : অনুরাধা কুন্ডা
তালিবান শব্দটি পুস্ত। যার অর্থ ” ছাত্র”। কীসের ছাত্র? তালিবান কি তবে শরিয়তের ছাত্র? ইসলামিক নিয়মের ছাত্র? হয়তো তাই। কঠোর ইসলামিক শাসন না মানলে যারা মানুষকে শাস্তি দেবে , আলোকপ্রাপ্ত মেয়েদের জ্যান্ত অবস্থাতে মাটির তলায় পুঁতে দেবে, স্বাধীন আচরণের জন্য, তারা ছাত্র?
এখন তালিবান একটি মানসিকতার নাম। পুস্ত ভাষার মধ্যে বা কোনো দেশের মধ্যে সে কেবল আটকে নেই। উগ্র ধর্মান্ধতার প্রতিশব্দ তালিবান। হিংসা ও সন্ত্রাস ছড়ানো আতংকবাদের প্রতিশব্দ তালিবান। মেয়েদের চরম অন্ধকার আর অপমানের দিকে ঠেলে দেওয়া আর নির্বিচারে মানবহত্যার নাম তালিবান। শব্দটা প্রপার নাউন থেকে নাউন হয়ে গেছে।
তারপরে বলার থাকে এই যে স্বাধীনতার এত এত বছর পরেও গৌরী লংকেশ যখন গুলিবিদ্ধ হন, নিজের বাড়ীর সামনে, অসুস্থ বয়স্ক সমাজকর্মী বন্দি দশায় মারা যান, সিস্টেম আতংকবাদী মনে হয় নাকি?
মনে হয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’ র ছবি ” উত্তরা” র কথা। যেখানে ছোট, শান্ত গ্রামটিতে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেও কি প্রকারান্তরে আতংকবাদের হানা নয়? চারটি শহরের লোক আসা যাওয়া করে গাড়ি নিয়ে।পুড়িয়ে মারে পাদ্রীকে। যিনি ভালোবাসার কথা বলতেন। মানুষের প্রতি বিশ্বাসের কথা বলতেন। অনাথ ম্যাথ্যুকে কোল দিয়েছিলেন যিনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায় প্রতিবাদী বামনটি। যে দৈর্ঘ্যে ছোট হয়েও মানসিকতায় বিশাল ছিল। ধর্ষিত হয়ে পড়ে থাকে উত্তরার নিথর দেহ। যারা অক্লেশে খুন করে গেল, ধর্ষণ করে গেল, তারা আতংকবাদী নয়, প্রহসন এখানেই।আতংকবাদী হয়ে যাবেন সেই পাদ্রী, যিনি ভালোবাসার গান করেন। এইসব তালিবানি কাণ্ডের সাক্ষী থাকে প্রাচীন বৃক্ষের দল। পাতা ঝরে যায়। বৃষ্টি পড়ে। মানুষ ভয়ঙ্করতর হয়ে ওঠে। হিংস্র। দেশভাগের দাঙ্গার প্রবাহ নিঃশব্দে চলতে থাকে। মানবিকতার প্রবাহকে তিলে তিলে শ্বাসরোধ করে মারা যে কার্যকলাপ, তাকে সন্ত্রাস বলে চিহ্নিত করা হয় না কেন!
দেশভাগের কাল থেকেই মুসলমান মনে জাগানো হয় হিন্দু বিদ্বেষ।হিন্দুদের মনে মুসলমান বিদ্বেষ।ইদানীং সেটা বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। যার ফলে “মাই নেম ইজ খান”-এর মতো ছবি বানাতে হয়। “আমি খান, আমি আতংকবাদী নই।” আজও আদিবাসী জনগোষ্ঠী লড়াই করে যান শিক্ষার জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য। হাল আমলেও চূণী কোটাল বা রোহিত ভেমূলাকে আত্মঘাতী হতে হয়। “আদিবাসী” হিসেবে অপমানিত হন শিক্ষক। টিভি সিরিয়াল সগৌরবে ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার, বহুগামিতা ও হিংসা প্রমোট করে যায়। করেই যায়। কেউ বোঝে। অধিকাংশ বোঝে না।
আতংকবাদের বিভিন্ন দিক আছে। দলিত বলে একটি মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেওয়াও আতংকবাদ। সংখ্যালঘুকে পিটিয়ে মারা আতংকবাদ। নারীকে ধর্ষণ করা আতংকবাদ। তপন সিংহের “আতঙ্ক” ছবিটির কথাও ভাবি। এখন আমরা কেউই কিছু দেখি না। রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের ফলে দুহাজার চোদ্দ থেকে উনিশের মধ্যে তিনশো ছাব্বিশটি মামলা হয়েছে। চার্জশিট হয়েছে একশো একচল্লিশ জনের। দোষী মাত্র ছয়জন। ঝাড়খণ্ডে চল্লিশে একজন। হরিয়ানাতে একত্রিশে একজন। জম্মু কাশ্মীরে পঁচিশে তিনজন। আসামের ছাপ্পান্ন জনে কেউ দোষী নন।
ভারতবর্ষর স্বাধীনতার সঙ্গে উগ্র ধর্মান্ধতার সম্পর্ক অতি গুরুতর। স্বাধীনতার বয়স যত বাড়ছে, উগ্রতা তত বেড়ে চলেছে। ভাগ্য বিশ্বাস করতে হলে এটাই চরমতম দুর্ভাগ্য। অথচ এই বিভাজন সম্পূর্ণ মনুষ্যসৃষ্ট।
ঋত্বিক “দলিল” নাটকে লিখেছিলেন: “বাংলারে কাটিছ কিন্তু দিলেরে কাটিবার পার নাই।”
বেঁচে থাকলে দেখতেন, দিলও কাটি গেছে। একেবারে কাটি গেছে।
ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের পরে স্বাধীনতার হাত ধরে এসেছে দেশভাগ আর ছিন্নমূল মানুষ। তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং দাঙ্গা। একদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে, অন্যদিকে শরণার্থী হবার গ্লানি মাথায় করে পূব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ভারতবর্ষে এসেছেন। রাতারাতি অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। ভিখিরি হয়ে গেছে মানুষ। এদিকে কলকাতার দাঙ্গা। ওদিকে পশ্চিম প্রান্তে ট্রেন ভরা লাশ। এত রক্তপাত কেন ?
এই রক্তপাতকে মহিমান্বিত করে যখন “গদর, এক প্রেমকথা”-র মতো ছবি হিট হয়, তখন স্বাধীনতার স্বরূপ বোঝা যায়।
উনিশশো সাতষট্টিতে এই স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা এবং ঐক্য বজায় রাখার জন্য তৈরি হয়েছে ইউ এ পি এ বা আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট। কোনো আতংকবাদী শক্তি যাতে দেশকে ধ্বংস করতে না পারে সেজন্য এই অ্যাক্ট। বছর বছর এর সংশোধন হয়েছে। স্বাধীনতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনের প্রয়োজন হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্য রক্ষা করার জন্য।
দুহাজার উনিশে এই আইনের শেষ সংশোধন। এই সংশোধনে আতংকবাদীর নতুন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষকে চতুর্থ চ্যাপ্টার সেকশন পঁয়ত্রিশ ও ছত্রিশের অধীনে আতংকবাদী বলা যেতে পারে। সেকশন পঁচিশের অধীনে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। এন আই এ’ র ডিজি এটি করতে পারেন। সেকশন তেতাল্লিশের অধীনে ইন্সপেক্টর এবং তদূর্ধ্ব অফিসাররা কেসের তদন্ত করার অধিকারপ্রাপ্ত।
একটি রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার ফলে যে ব্যক্তিকে আতংকবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাঁকে ডিনোটিফাই করা যাবে, অর্থাৎ অতঃপর তিনি আর আতংকবাদী বলে অভিহিত হবেন না। সেও কী কার্যত হয়ে থাকে? একবার চিহ্নিত হবার পরের বিপদগুলি জানেন সবাই।
দেশের ঐক্য, সংহতি, ঐতিহ্য, সমাজ সমস্ত কিছুকে নিরাপদ রাখার জন্য এই আইন প্রণয়ন এবং সংশোধন।
এই সংশোধিত আইনের সমস্যা হল এই যে আগে শুধুমাত্র কোনো সংগঠনকে আতংকবাদী বলে চিহ্নিত করা হত। এখন ব্যক্তি বিশেষকে আতংকবাদী নির্ধারণ করা যেতে পারে। এই জায়গাটি চরম বিপজ্জনক বিশেষ করে সেই দেশে যেখানে আমিও লাল, তুমিও লাল, আমিও সবুজ তুমিও সবুজ হলেই তুমি ভালো। আমি হলুদ তুমি সবুজ হলেই তুমি আতঙ্কবাদী। দ্বিতীয়ত এই আইন সাতষট্টি সালে নির্মিত আন্তর্জাতিক কভেনান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের পরিপন্থী। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয়ত এই আইন আতংকবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে না। আতংকবাদকে অবদমন করে। একজন ব্যক্তিকে আতংকবাদী হিসেবে চিহ্নিত করলে কোনো নির্ণয় বা দণ্ডের পথে এগোনো সম্ভব নয়। উপরন্তু, ব্যক্তিবিশেষকে আতংকবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে কোনো অবজেক্টিভ ক্রাইটেরিয়ন নেই।রাষ্ট্রের হাতে এই বল্গাহীন ক্ষমতা, যার ফলে যে কোনো মুহূর্তে কেবলমাত্র প্রতিবাদ করার জন্য একজন ব্যক্তি আতংকবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন, গ্রেপ্তার হতে পারেন, তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে, কতটা বিপজ্জনক সেটা নাগরিক মাত্রেই বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
স্বাধীনতা শুধুমাত্র গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের হাত ধরে আসেনি।চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আতংকবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন সূর্য সেন। গণেশ ঘোষ। অনন্ত সিংহ প্রমুখ। ব্রিটিশ সরকার এঁদের আতংকবাদী আখ্যা দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে এঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী আখ্যা পেয়েছিলেন। এঁরা বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র আন্দোলনের পথ। সশস্ত্র বিপ্লবকে ব্রিটিশ সরকার আতংক মনে করতেন বৈকি। আর সশস্ত্র বিপ্লবীকে আতংকবাদী। মাস্টারদা সূর্য সেনকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি অচৈতন্য ছিলেন।প্রহারের ফলে ভেঙে গেছিল তাঁর নাকের হাড়।চোখ মুখ ক্ষতবিক্ষত। এঁরা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন।
দেশের সংবিধান বিরুদ্ধ কাজ, আইন ভঙ্গ, হিংসাত্মক কাজ, নাশকতামূলক কাজ অতি অবশ্যই অপরাধ। কিন্ত ব্যক্তি বিশেষকে প্রমাণের আগেই আতংকবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা আরো গুরুতর চিন্তার বিষয়।
স্ট্যান স্বামীর গ্রেপ্তার ও মৃত্যু বারবার ভাবিয়ে তোলে স্বাধীনতা ও ইউ এ পি এর মাঝখানে আমরা ঠিক কোথায় আছি?
ইনোসেন্ট আনটিল প্রুভেন গিল্টি।
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্দোষ।
অতি পরিষ্কার একটি বক্তব্য। ইউ এ পি এ, এবং সংশোধিত ভার্সন তীব্রভাবে একে লঙ্ঘন করে।
উনিশশো উনিশে সজল অবস্থী পাবলিক ইন্টেরেস্ট লিটিগেশন, পি আই এল এনেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে ইউ এপি এ’ র বিরোধিতা করে। তাঁর বক্তব্য, এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। ইট কার্টেইলস দ্য রাইট টু ডিসেন্ট।
আর্টিকল চোদ্দ। সাম্যের অধিকার।
আর্টিকল উনিশ। বাকস্বাধীনতা ও মনোভাব প্রকাশের অধিকার।
আর্টিকল একুশ। জীবনের অধিকার।
মূল সমস্যা এই যে ইউ এ পি এ’র প্রয়োগের ফলে ব্যক্তিবিশেষ, যাঁকে আতংকবাদীর ছাপ্পা দিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর কোনো অধিকারই থাকে না আত্মপক্ষ সমর্থন করার।
রাইট টু রেপুটেশন বলে একটি বিষয় আছে। মৌলিক অধিকারের একটি অন্তর্ভুক্ত। লাইফ উইদ ডিগনিটি।ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল একুশের আওতায় পড়ে।যে কোনো ব্যক্তিকে আতংকবাদী বলে গ্রেপ্তার করা একটি সংবিধানবিরোধী কাজ।
অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস। এপিসিআর। এঁরা আরেকটি প্রতিবাদ করেছিলেন। নতুন সেকশন পঁয়ত্রিশের অধীনে এই যে ব্যক্তি বিশেষকে আতংকবাদী বলা যেতে পারে, এবং তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে, দেগে দেওয়া যায় এটি আগে কেবল সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল।
সংশোধনের ফলে গ্রেফতারের পেছনে কোনো কারণ না দেখালেও চলে। শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন এভাবেই সর্বনেশে।
স্ট্যানসাউস লর্ডুস্বামী। সংক্ষেপে স্ট্যান স্বামী।দলিত অধিকার অ্যাক্টিভিস্ট। এক রোমান ক্যাথলিক পুরোহিত। আতংকবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন যেসব মানুষ তাঁদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ এইদেশে। জেসুইট পরিচালিত ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইন্সটিটিউট, ব্যাঙ্গালোরের ডিরেক্টর ছিলেন স্ট্যান। উনিশশো পঁচাত্তর থেকে ছিয়াশি সেখানে তাঁর কাজ। তারপর মধ্যপ্রদেশে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সংবিধানের পঞ্চম শিডিউলের অপব্যবহার সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই স্কেজিউল অনুসারে, আদিবাসীদের রক্ষার্থে, উন্নতির পরিকল্পনায়, সার্বিক মঙ্গলার্থে সম্পূর্ণভাবে আদিবাসীদের দ্বারা পরিচালিত একটি ট্রাইবস আদিবাসী কাউন্সিল গঠনের দাবী জানিয়েছিলেন। দু’হাজার আঠেরোর ভীমা কোরেগাঁও হিংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা করে এন আই এ। মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত তিন হাজার মানুষের মুক্তির প্রকল্পে তিনি ও সুধা ভরদ্বাজ যে পার্সিকিউটেড প্রিজনার্স সলিডারিটি কমিটি তৈরি করেছিলেন সেটিকেও নাশকতামূলক বলা হয়। মানবাধিকারের জন্য মুকুন্দন সি মেনন পুরষ্কার প্রাপ্ত এই মানুষটি, যাঁর পার্কিনসনস রোগ ছিল, তাঁকে বন্দি করা এবং আতংকবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা আবারো আমাদের এক বিশাল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই স্বাধীনতা, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এসেছে, উদ্বাস্তু মানুষের জীবনের বিনিময়ে এসেছে, এ কী প্রকৃতই স্বাধীনতা? তিনি কী আদৌ সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না মানবাধিকার কর্মী ছিলেন? আদৌ আতংক ছড়ানোর মত, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটানোর মত কাজ করেছিলেন কী? আমাদের জানা নেই। জানা আছে যে তিনি জামিন পান নি।
আবারো ঋত্বিক ঘটকের “যুক্তি তক্কো গপ্পো” । নীলকণ্ঠরা পুলিশের গুলিতে মরে যায় অকাতরে। অথবা আততায়ীর গুলিতে।গৌরী লঙ্কেশ। ভারভারা রাও জেলে যান। অস্ট্রেলিয়ার পাদ্রী পুড়ে যান বজরঙ্গ দলের হাতে।
স্ট্যান স্বামীর পার্কিনসনস ডিজিজ ছিল। বারবার মুক্তির আবেদন করেও কোন লাভ হয়নি। দ্য পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিক লিবার্টিজ, অল ইন্ডিয়া ক্যাথলিক ইউনিয়ন, দ্য ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অব ইন্ডিয়া, কেরালা ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স, ফেডারেশন অব এশিয়ান বিশপস কনফারেন্স, ইন্টারন্যাশনাল জেসুইট কম্যুনিটি, কেরালা ল্যাটিন ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশন সহ আরো অনেক সংগঠন তাঁর বন্দিত্বের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জানিয়েছেন বহু সংবেদনশীল মানুষ। বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বুদ্ধিজীবী শব্দগুলি ব্যবহার করবো না। শব্দের দৈন্য অসীম। ততোধিক দৈন্য যুক্তির। নিতান্তই অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে যে অত্যাচারগুলি দিনের পর দিন চোখের সামনে ঘটে চলে তার কোনো সুরাহা নেই। হরতন, রুইতন, চিঁড়েতন, ইস্কাবন হয়ে না থাকলেই যদি দণ্ড হয় তাহলে স্বাধীনতা কোথায় আর স্বাধীন মানুষ কোথায়? বস্তুত এদেশে স্বাধীনতা ছিল কেবলমাত্র ক্ষমতার হস্তান্তর। তারপর যা যা হয়ে চলে, তার অনেককিছুই নামে নয়, কিন্তু কাজে তালিবানি। অগণিত শিষ্য তৈরি করে চলো। চলো নিয়মমতে। ইসলামের ছাত্র। হনুমানের শিষ্য।
অতএব একজন মানবাধিকার কর্মী, বয়স তিরাশি বা চুরাশি, তিরিশ বছরের ওপর যিনি ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের জন্য কাজ করে চলেছেন, জেলে যান। কোনো ওষুধ পান না। স্ট্র পান না। ভূমি, অরণ্য এবং শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বললে যদি আতংকবাদের তকমা লেগে যায়, একটি স্বাধীন দেশে তার চেয়ে বড় দুর্দশা আর কী ই বা থাকে! মানুষ আদৌ স্বাধীন নয় অর্থাৎ স্বাধীনভাবে কথা বলার জায়গা নেই, সমালোচনার জায়গা নেই, অধিকার চাইবার বোধ নেই এবং চাইলেই সন্ত্রাসবাদের লেবেল সেঁটে যেতে পারে এটাই গণতান্ত্রিক অধিকারের সবচেয়ে বড় পরিপন্থী। একে তো অধিকাংশ মানুষের নিজের অধিকার ও দাবিদাওয়া সংক্রান্ত বোধ নেই। যাদের কিছুটা বোধ আছে, তাঁদের অনেকেই সুবিধেটুকু নেন। দায়িত্ব নেন না।
যে ক’ জন হাতে গোণা মানুষ অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠটি চুপ করিয়ে দেওয়ার চাবুক যদি এন আই এ’ র হাতে থাকে, তবে দেশের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ শূন্যতার মধ্যে হাহাকার করবে। এও একপ্রকার তালিবানি বিচার বটে।
ভয় হয়। আতংক গ্রাস করে।মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবেই এমন বিশ্বাস ছিল এদেশে একসময়। যেভাবে লাভ জিহাদ ইত্যাদি প্রচার পাচ্ছে তাতে কে কখন আতংকবাদী হয়ে যাবে কে জানে! সন্ত্রাসের প্রকৃত রূপ অহরহ চোখের সামনে। রোজ একটি দুটি করে বধূহত্যার খবর। প্রকাশ না পাওয়া ঘটনার কথা আর কে বলে। এর কোনো সুরাহা নেই। উদার অর্থনীতি দেদার উন্নতি করে ফেলেছে। শপিং মলের আলোতে ঢেকে গেছে সব অভাব। লোভ বেড়েই চলেছে শুধু। মধ্যবিত্ত এখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতে হানিমুন “মানায়”।লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বি এড পড়ে। পি এইচ ডি কেনে। অধ্যাপক হয়। ডাক্তার হয়। এন্জিনিয়র হয়। এইসব আতংক কারু চোখে পড়ে না। দেদার টাকা উড়ছে একশ্রেণীর হাতে। মধ্যবিত্ত এখন অ্যাপলের ল্যাপটপ বা আইফোন ব্যবহার করে। বই পড়ে না। উইকিপিডিয়া আছে। অশিক্ষিত জনতার হাতে প্রযুক্তি টিকটক খেলছে। এই হচ্ছে প্রকৃত সন্ত্রাস।
এই সর্বসমক্ষে ঘটে যাওয়া পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সন্ত্রাসের গ্লানি আর অন্ধকার আইনক্স, শপিং মল, মন্দির, মসজিদে ঢাকা পড়েনি। স্বাধীনতার প্রকৃত ভাব, প্রকৃত স্বভাবের ধারেকাছেও যেতে পারিনি আমরা। মুখে কুলুপ এঁটে ঘোরা মানুষ, তোলাবাজ সংস্কৃতির ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মানুষ, চাটুকারিতা আর সুযোগসন্ধানে ব্যস্ত মানুষ তৈরি হয়ে চলেছে দিনের পর দিন। এই অন্ধকারে স্বাধীনতাকে দেখা যায় না। এমনকি বোধও করা যায় না। কজন মেয়ে বাড়ির বাইরে সম্পূর্ণ নিরাপদ? আমরা জানি আমাদের সীমিত স্বাধীনতার চারপাশে গণ্ডী টানা আছে। বাকীটা টরে টক্কা এবং ফক্কা।
আজও দেশের সম্ভ্রমকে শ্রদ্ধা করে জাতীয় সঙ্গীতে আপ্লুত হয় মানুষ। মানবাধিকার জয়যুক্ত হওয়ার দিন আসুক।
[লেখক – নাট্যনির্দেশক, লেখক, চিত্রনির্মাতা, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা, মালদা কলেজ।]
Posted in: ARTICLE, August 2021 - Cover Story