লৌকিক – অলৌকিক – অলীক মানুষ : উমাপদ কর
[কবি ও গদ্যকার উমাপদ কর বছর আটেক আগে গল্প ও উপন্যাসকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনন্য উপন্যাস “অলীক মানুষ” নিয়ে চরিত্রভিত্তিক একটি দীর্ঘ আলোচনা তথা গদ্য লেখেন, যা প্রকাশ পায় “বিনির্মাণ” পত্রিকায়। সম্প্রতি অপরজন পত্রিকার তরফে সেই গদ্যটি প্রকাশ করতে চাইলে তিনি পূর্বোক্ত গদ্যটিকে সংযোজন-বিযোজন-বিবর্ধন ইত্যাদির মাধ্যমে পুনর্লিখিত করেন। গদ্যটি দীর্ঘ। লেখকের সম্মতিক্রমে আমরা বেশ কয়েকটি কিস্তিতে (৬-৭) আলোচনাটি প্রকাশ করব ধারাক্রমে প্রতিমাসে। এই সংখ্যায় তার পঞ্চম পর্ব।]
সাইদা বেগম
রক্তমাংসের এক বাঙালী নারী। স্বামী বুজুর্গ পির। তিন সন্তানের জননী। গর্ভধারণ পাঁচবার। স্বামী বদুপির সংসারত্যাগী না-হলেও সংসারে মন নেই। সাইদাই গুছিয়ে সংসার সামলান। স্বামীর বিভূতি বা অলৌকিকত্বে প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং তাঁর আদেশ ও নিদান সদা শিরোধার্য। আবার পূর্ণ না-হলেও নিজের চাহিদাগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সংসারে স্বামীর সময় না-দেওয়া সহ্য করতে পারেন না, আবার বলতেও পারেন না। তার নিজের প্রতি স্বামীর অধিকাংশ সময় উদাসীনতায় মানসিক কষ্ট পান, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেন না। রাগ হয়, ক্ষোভ জন্মে, যা দমন করেই রাখতে অভ্যস্ত। মনে মনে স্বামীর সব নির্দেশ মানতে পারেন না, বিশেষত সন্তানের ক্ষেত্রে। তাই প্রতিবন্ধী সন্তানের শুভ কামনায় মানত চাপাতে যান পির-মাজারে, খাওয়ান কবিরাজের ওষুধ। যদিও জানেন স্বামী এসবের ঘোর বিরোধী। তাই করেন আড়ালে বা লুকিয়ে, জানান দিয়ে করার সাহস নেই। পড়াশোনার জন্য তিনি শফিকে কাছছাড়া করতে চাননি, মন সায় দেয়নি, কিন্তু বাধ্য হয়েছিলেন। তার পরিণতির জন্য দুষেছেন স্বামীকেই। এই ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছুটা ক্ষোভও উগরে দিয়েছিলেন স্বামীর প্রতি। যখনই স্বামীর মতিগতি ভিন্ন ঠেকেছে, তখনই নিজস্ব শারীরিক চাহিদা সত্ত্বেও তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখানে যেন কিছুটা বিদ্রোহী। ইকরাতনকে স্বামীর বিবাহ-সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি অন্তর থেকে, কিন্তু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি, জানতেন তাতে লাভ কিছু হবে না। ইকরাকে বদুপির ‘কাহিন’ সাব্যস্ত করে মজলিশ ডেকে তালাক দেন। সম্ভবত সেই কারণে স্বামীর প্রতি তার দুর্বলতা আবার ফিরে আসে। বদুপিরের আহ্বানকে সাইদা অস্বীকার করতে পারেননি। সাইদা আবার গর্ভবতী হয়েছিলেন। শেষদিকে স্বামীকে অশরীরী এক সত্তা মনে করেও গর্ভবতী হয়েছেন। পরিবারে স্বামীর অনেক কিছুই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। যেমন ভাই ফরিদুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার, কামারুন্নিসার প্রতি তাঁর কর্তব্যে অবহেলা, শফিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া, এতবার করে সংসারের ঠাঁইনড়া, কিন্তু সবই মেনে নিয়েছেন তৎকালীন বাংলার একজন নিষ্ঠাশীল মুসলমান মহিলা হিসেবে। উলটে স্বামীর অলৌকিকত্ব নানাভাবে রং-চড়িয়ে পঞ্চমুখ করে প্রচারও করেছেন। তিনি শাশুড়িকে যথেষ্ট দেখভাল করতেন এবং ভালোও বাসতেন। মনেপ্রাণে এক বাঙালী মহিলা। বড়ো ছেলে নুরাজ্জামান দেওবন্দ থেকে ‘ফাজিল’ হয়ে ফিরে অনবরত হিন্দিতে কথা বললে বিরোধিতা করেছেন, ‘খোট্টা’-দের ভাষা না-বলার জন্য। শেষদিকে শফির জন্য পাগলপ্রায় হয়েছিলেন। সন্তানের জন্য মায়ের চিরকালীন দুঃশ্চিন্তা আর টান তার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। কয়েক মুহূর্তের জন্য একবার দেখাও হয়েছিল, সেক্ষেত্রে নিজেকে হতভাগিনী মনে হয়েছিল। ছেলের প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহে স্বামীর ‘না’ তাঁর বুকে বিঁধেছিল। একবারই এরজন্য সক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন স্বভাবের বাইরে গিয়ে। সবমিলিয়ে সাইদা বেগম সেই সময়কালের এক অশিক্ষিত পতিব্রতা মুসলিম গৃহবঁধূ হিসেবে জীবন্ত, চোখের জলই যার সবচেয়ে বড়ো সম্বল। তার হৃদয়াকুতি স্পর্শ করার মতো। তার ধর্মভীরুতার অর্থ আমরা খুঁজে পাই, কিন্তু বুজুর্গ স্বামীর সিদ্ধান্তে প্রতীবন্ধী সন্তান মনিরুজ্জামানের সঙ্গে দিলরুখের বিবাহ নিঃসংকোচে মেনে নেওয়ার অর্থ খুঁজে পাই না। এই অবস্থানে তার চরিত্র কিছুটা জটিল এবং ভিন্নদর্শী। হতে পারে, একদিকে স্বামীকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, অন্যদিকে প্রতীবন্ধী ছেলের প্রতি মায়ের বিশেষ দুর্বলতা বা বিয়ে দিলে ছেলে যদি আরেকটু স্বাভাবিক হয়! ইকরাতনকে নিয়ে স্বামীর কাণ্ডকারখানা তিনি মেনে নিতে পারেননি, শাশুড়ি কামুরান্নিসার মৃত্যুর পর তাঁর ভূমিকা মেনে নিতে পারেননি, তেমনি মনিরুজ্জামানের ছেলের নাম নিয়ে বদুপিরের মতামত মানেননি তো বটেই, বিরোধিতা করেছেন, বাতিল করে দেন স্বামীর দেওয়া নাম, নিজে নাম রাখেন, রফিকুদ্দিন। এমনকি স্বামী খোঁড়াপিরের ঘোর বিরোধী জেনেও আয়মনির সঙ্গে যুক্তি করে আড়ালে রফিকুজ্জামানকে নিয়ে যান খোঁড়াপিরের মাজারে নাতির মঙ্গলার্থে সিন্নি চড়াতে। ফলে তার চরিত্রে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যা চরিত্রটিকে একইসঙ্গে সমঝোতাকারী ও প্রতিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রতিবাদ অবশ্য যৎসামান্য।
দিলরুখ বেগম
কিছুটা বাচাল, প্রগলভ, খোলামেলা হিসেবে চরিত্রটির উপন্যাস যাত্রা বা প্রকাশ। শফির প্রতি অনুরক্ত। ভালোবাসার চেরাগ জ্বালিয়েছিল তারই উদ্দেশ্যে। শফিরও তাকে নিয়েই ভালোবাসার স্বপ্ন। কিন্তু এই প্রেমের পরিণতি ভিন্ন ধরনের। বিয়োগান্তক। দিলরুখের মা দরিয়াবানুর নিরবিচ্ছিন্ন তাড়নায় দিলরুখের বিয়ে হয় শফিরই মেজ দাদা মনিরুজ্জামানের সঙ্গে, যে একদিকে জন্ম প্রতিবন্ধী অন্যদিকে বিকৃতকাম। জীবৎকালে হয়তো কখনই স্বামীকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু স্বামীর তীব্র যৌনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। মা ও শফির প্রতি তীব্র অভিমান ও ক্ষোভে সংক্ষুব্ধ হয়েছে, কিন্তু তার বহিপ্রকাশ করেনি। বস্তুত সুন্দর প্রেমময়ী নারীটি এক কাষ্ঠ-পুত্তলিকায় পরিণত হয়। রাগ-দুঃখ-অভিমান-কষ্ট-জ্বালা এমনকি আনন্দ প্রকাশেও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত করে দেয়। শুধু শরীরটাই ছিল, কোনোরকম সাড়া ছিল না তাতে, জীবনে ছিল না কোনো আনন্দ-উদ্দীপনা— সে স্বামীর ভালো হয়ে ওঠার জন্যই হোক, তার কাম চরিতার্থ করার বাসনাতেই হোক, প্রেমাস্পদ শফির অনুপস্থিতি বা কখনো একবার দেখা হওয়ার ক্ষেত্রেই হোক। মা দরিয়াবানুর আত্মহত্যাও টলাতে পারেনি তাকে। পরিবার সংসার অর্থকরী সম্পত্তি কিছুই আর তার চাহিদার মধ্যে ছিল না। বলা যেতে পারে এটাই এই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, সেই সময়কালে একজন মুসলমান নারী হিসেবে, তার ব্যক্তিইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার দুই পরিবারের সাজসের বিরুদ্ধে নীরবতাই ছিল তার প্রতিবাদ। এ-সবই হয়তো স্বাভাবিক, কিন্তু অস্বাভাবিক মনে হতে পারে এই স্বামীর জন্য তার শেষদিকের হৃদয়াবেগকে। তার মৃত্যুতে তাকে শোকাহত পাগলীপ্রায় হতে দেখি। কিন্তু বস্তুত অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, হাজার হোক তারই গর্ভেজাত তার স্বামীর সন্তান। মাকে ক্ষমা করতে পারেনি, পারেনি হয়তো শফিকেও; কিন্তু শেষাবধি স্বামীকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেছিল। চেয়েছিল, মৃত্যুর পর স্বামীর কবরের পাশে গোরে শুয়ে থাকতে। এটা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। ঔপন্যাসিক চেয়েইছেন বাংলার আদি এবং অকৃত্রিম সংস্কৃতির প্রকাশ হোক তার চরিত্রে, তাই তাকে ব্রুট করে তোলেননি। একজন নারীর সংসারের যাবতীয় অভ্যাসে গড়ে ওঠা এক মূল্যবোধ তার চরিত্রে আরোপ করেছেন। তাই স্ববিরোধিতা মনে হলেও এ-ও স্বাভাবিকই তার ক্ষেত্রে। প্রতিটি বিষয়ে নিরুৎসাহীতা ও নিস্পৃহতার মাধ্যমে যে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ যতটা সম্ভব তার মধ্যে দেখা গেছে, শেষে দেখা গেছে বাঙালী-নারীর সয়ে-নেওয়া মেনে-নেওয়া ও সম্পর্কের মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার বরাবরের রীতি। তার চরিত্রের সহিষ্ণুতার দিকটিও পাঠকের মনে দাগ ফেলে। মার মৃত্যুতে নিস্পৃহ উদাসীন যেমন, তেমনি বোন রোজি মায়ের সমস্ত সম্পত্তি ভোগদখল করলেও তার মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া বা হিংসার ভাব দেখা যায় না। বরং ঐ সম্পত্তি ‘হারেম’-এর, শ্বশুরের এই বিধান মেনে নিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যথেষ্ট সহিষ্ণু সে। আবার নাতি ও নাতনী খোকা ও কচির সঙ্গে যখন বারবার চরিত্রটিকে আনা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে, সেখানেও সে শান্ত, সৌজন্য প্রদর্শনে স্থির, বিচারশীলা, একইসঙ্গে স্বামীর প্রতি এক ধরনের করুণা ও টানে আবদ্ধ। আবার তার প্রেমাস্পদ শফির প্রতি এক আকর্ষণ ও নাতি-নাতনিদের তার ছোটোদাদাজি যে একজন বীর, একজন লেখাপড়া জানা হিন্দু-প্রায় আদর্শবান পুরুষ তা প্রমাণে সচেষ্ট। সেখানেও দেখা যাচ্ছে কারো বিরুদ্ধেই যেন তার কোনো অভিযোগ নেই। তাই নাতি-নাতনির পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে নানা অপ্রীতিকর মন্তব্যে তার সায় থাকে না, বরং আগ্রহ থাকে তারা যেন যথার্থ শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখায়। উপন্যাসে এক গ্রাম্য সহজসুন্দর অনুগামী মুসলমান মহিলা চরিত্র হিসেবেই তাকে তুলে ধরা হয়েছে। এই মহিলা বাংলার গৃহবঁধু, যার বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। আর চরিত্রটি হয়ে উঠেছে একেবারে রক্তমাংসের। মূলত, বিবাহ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে হলেও, তার সন্তানের জননী হলেও, উপন্যাসকার শফিকে যেমন এই উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়েছেন, তেমনি উপন্যাসের শেষাবধি দিলরুখকে বাঁচিয়ে রেখে, তাকেও কেন্দ্রীয় চরিত্রের গুরুত্ব দিয়েছেন। শেষে নিজের জীবনের নানা কষ্টবোধ ও অবদমন এবং স্বামীর প্রতি তার মনোভাবের জন্য পরিতাপের সৃষ্টি হয়। বার বার ক্ষমা চায়। উন্মাদের মতো হয়ে যায়। সিন্দুকে রাখা শফির রোজনামচা, শ্বশুরের কেতাব মৃত্যুর আগে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, যেন তার মৃত্যুর পর এই পরিবারের নানা অসমঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তা আর সেভাবে গুঞ্জরিত উচ্চারিত বিচার-বিবেচিত না-হতে পারে। বংশমর্যাদা রক্ষার শেষ প্রহরী সেই, পরম্পরা অনুসারে তাকে অক্ষুন্ন রাখতে যেন বদ্ধপরিকর সে। মৃত্যুর পর তার দেহ আবিষ্কৃত হয়, তার স্বামি মনিরুজ্জামানের কবরের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে রাখা অবস্থায়। এ যেন জীবৎকালে অর্ধপশু স্বামীর প্রতি তার যে ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা, আর মনিরুজ্জামান যে একসময় তাকে পরিত্যাগ করেছিল সেই বোধানুভবের প্রেক্ষিতে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আকুল প্রার্থনার প্রতীক।
ইকরাতন
আবদুলের বউ। আবদুল কুষ্ঠরোগী। বাইশ-তেইশ বছরের যুবতী, তেজী ইকরাতন। বদিউজ্জামান যেভাবে তাকে প্রথম মোল্লাহাটে দেখেন— সে নদীতে স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে পিরের সাঁকোয় মানত করছিল। প্রণাম শেষে চলে গিয়েছিল নদীতে পা ছড়িয়ে জল নিয়ে খেলতে, বদিউজ্জামানের করা তার নাম, নিবাস, জাতি সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের উত্তর না-দিয়েই। মৌল্লাহাটের মুসলমানদের কাছে সে এক অলৌকিক মেয়ে মানুষ, ডাইনি। নাঙ্গা হয়ে মাথায় পিদিম জ্বেলে সে কী সব আবৃত্তি করে আর নাচে। কিংবা তাকে দেখা যায় বাঁশবনে বা খোঁড়াপিরের মাজারে। জনশ্রুতি, সে হিন্দু ঘরের বউ ছিল। ব্রাহ্মন। সতীদাহের সহমরণকালে আবদুল তাকে চিতা থেকে তুলে নিয়ে আসে ও নিকা করে। আবদুল মনে করে এই পাপে তার হাতে কুষ্ঠ। ইকরা পৌত্তলিকতা ছাড়তে পারেনি। এই সামান্য মেয়ের জীবনে ঘটনাপ্রবাহ ভীষণই চমকানো। তার বেঁচে থাকার লড়াইও অদ্ভুত জেদী। বদুপির তখন স্ত্রী সাইদা বেগম থেকে ক্রমাগত দূরে। শারীরিক মিলনেও স্বামীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এদিকে পৌত্তলিক মুসলিমকে ফরাজি মুসলমানে পরিণত করার তাগিদ বদিউজ্জামানের মধ্যে উগ্র। সম্মিলিত তাড়া সামলাতে না-পেরে একদিন ইকরা ঢুকে পড়ে বদিউজ্জামানের ঘরে। উনি নাঙ্গা মেয়েকে কাপড় যোগান, তওবা করান, কল্মা শাহাদতঃ করান। তাদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথপোকথন এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না—
অ্যাই বেশরম লেড়কি! তোর এত সাহস আমার ঘরে ঢুকে পড়লি?
ওঁরা আমাকে মেরে ফেলত।
নাঙ্গা হয়ে মাথায় চেরাগ জ্বেলে নাচ করছিলি?
আমি থানে ওষুধ তুলতে গিয়েছিলাম।
নাঙ্গা হয়ে কেন?
নৈলে ওষুধে ফল হয় না।
লোককে ঠকিয়ে ধোঁকা দিয়ে রোজগার করিস?
পোড়া পেটের দায়, পিরসাহেব।
তোকে ছোটগাজির বাড়ি পাঠিয়ে দেব। সেখানে থাকবি। রাজী?
জি হ্যাঁ।
কিন্তু হরিণমারা যাওয়ার পথে সে আলি বখশকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। বদুপির তাকে ভুলতে পারেন না। থেকে থেকেই তাঁর চোখে ভাসে সেই পিঙ্গলচক্ষু, ঠোঁটে তিল, নাঙ্গা, সিঁদুর মাথায় ইকরাকে। ‘হুঁশিয়ার নামায়’ হুঁশিয়ারি থাকলেও তিনি নিকাহ করেন ইকরাতনকে। অদ্ভুতভাবে ইকরার চাহিদাও আশ্চর্যরকম। “কিছু দিবস পরে কাজীসাহেব আমাকে জ্ঞাত করিলেক যে বিবি ইকরাতন নিজমুখে কহিয়াছে যে তোমাদিগের পিরসাহেবের যদি আমার নিকাহ দেওয়ার একপ্রকার তাকিদ থাকে তাহা হইলে তিনিই আমাকে নিকাহ করুন।” বোঝা যায় এক যুবতী এক প্রৌঢ়কে বিয়ে করতে চায় স্রেফ পেটের দায়ে এবং নিরাপত্তার কারণে। নুরপুরে বদুপিরের ইকরাকে নিকা ও শেষে কাহিন সাব্যস্ত করে মজলিশ ডেকে তালাক দেওয়া, যখন ইকরার গর্ভে বদুপিরের সন্তান। কিছুটা দিশাহারা ইকরা তখন পালিয়ে ব্রহ্মপুরের কাছাকাছি, পেশার পরিবর্তন, সুতা কাটুনি। সেখানে সে নাম নেয় করুণা। শফি তাকে চিনতে পারলেও সে ধরা দেয় না। সন্তানের জন্ম হয়। পির সাহেবের কুৎসা রটে যাচ্ছে ভয়ে ঐশী বিধি অনুসারে একসময় কোতল করা হয় তাকে ডাইনি আখ্যায়। সত্যিই কি সে ‘কাহিন’? তাহলে সন্তানের জন্য এত মমতা কেন? সে নিকাহ করতে চায় না, পুরুষরা নেমকহারাম বলে। একই নেমকহারামি সে পায় এমনকি পির-স্বামীর কাছেও। তালাক। বদুপিরের হয়তো সাময়িক মতিভ্রম, হয়তো শরীরের খাহেস, হয়তো ফরাজি বানানোর চেষ্টা, কিন্তু ইকরা নিজেকে বদলাতে পারে না, চলতে চায় নিজস্ব সংস্কারে, আর তার মূল্য দিতে হয় জীবন দিয়ে। জীবনের প্রাথমিক চাহিদা (খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ইত্যাদি) মেটাতেই তার চরিত্রের যত জটিলতা, যা থেকে সে আলাদা, অলৌকিক। অথচ বাস্তবের প্রকৃত ছবিটা তো ঔপন্যাসিক বর্ণিত এমনই— “ইকরা বাঁশবনে বা খোঁড়াপিরের মাজারে কেন ঘুরে বেড়ায়, তার একটা ব্যাখ্যা ছিল। সে আসলে জড়িবুটি সংগ্রহ করে ওই জঙ্গল থেকে। সে ভিনগাঁয়ে গিয়ে বউ-ঝিদের কাছে ওইসব আজব জিনিস বেচে আসে। তার বদলে চালডাল, হাঁস-মুরগীর ডিম পায়। কখনও পায় আনাজপাতি, একটা কুমড়ো বা দুটো বেগুন। তার কুঠো স্বামী আবদুল সারাদিন দাওয়ায় পড়ে থাকে আর খোনাসুরে আপনমনে গান গায়।” বোঝা যাচ্ছে, ইকরা বদুপিরের সঙ্গে নিকার আগে পর্যন্ত জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত, প্রায় অথর্ব স্বামীকে সেই দেখভাল করেছে। কিন্তু তৎকালীন সমাজ সেই যুবতীর প্রতি সহনুভূতিশীল না-হওয়ায় বা কিছু মানুষের কামনার স্বার্থে না-লাগায়, তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, ডাইনি প্রচার, যা একসময় এমন তুঙ্গে ওঠে যে তাকে নিহতও হতে হয়। উপন্যাস বিচারে এই চরিত্রটি বাস্তবের ঘর্ষণে অলৌকিকতার দিকে গিয়ে সামাজিক কুসংস্কারের বশবর্তীতায় এক ট্রাজিক চরিত্র। ইকরার কোতল হয়ে যাওয়া তাই শেষ পর্যন্ত হা-ইকরায় পরিণত হয়। এমনকি সে সংবাদে পির-এর চোখেও জল আসে। বোঝা যায় না তা কুম্ভীরাশ্রু নাকি প্রকৃত মনখারাপের! ইকরাতন সেইসময়কালের সামাজিক কুসংস্কারের বলি, যা আজকের সমাজেও আমরা মাঝেমধ্যে খেয়াল করি। ইকরাতনের চরিত্রকে যথেষ্ট ধ্যান দিয়ে তৈরি করেছেন উপন্যাসকার। অদ্ভুত এক রুজির পন্থা অবলম্বনকারী সে শুধুমাত্র তার প্রাণউদ্ধারকারী আবদুল ও নিজের জন্য, সমাজ যা মানতে রাজি নয়। এই স্বাভাবিকত্বকে কোনোরকম সহানুভূতির জালে ফেলে প্রকৃত সামাজিক অবস্থানের হেরফের করতে চাননি উপন্যাসকার। আর এই চালেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার চরিত্র, যেখানে সহানুভূতি জড়িয়ে থাকে।
বারি চৌধুরী
আবদুল বারি চৌধুরী। ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ। নবাব বাহাদুরের দেওয়ান। ‘নেচার’ বিশ্বাসী। প্রকৃতিই যে মানুষের প্রকৃত স্থান, সেই যে নিয়ন্তা, সমস্ত যাপন-প্রক্রিয়ার পেছনে যে সেই-ই, সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি সবই প্রকৃতির অধীনে— এমন বিশ্বাসে আস্থাবান। মানুষটি অকৃতদার, কেন তা জানা যায় না। মাঝেমধ্যে মৌল্লাহাটে দরিয়াবানুর বাড়িতে এসে হৈ-হুল্লোড় করে যান। বুজুর্গ, পির, মাজার, এবং অলৌকিকত্বে বিশ্বাস নেই। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে পশ্চাদপর মুসলমান সমাজ একইসঙ্গে হিন্দু ও ইংরেজদের সঙ্গে লড়তে সক্ষম হবে, এটা তার বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস অনুসারে কাজ করে যান। ১৬-১৭ বছরের শফির মধ্যে তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করেন, যে তাকে তার বাবার কাছ থেকে চেয়ে নেন। প্রথমে হরিণমারা স্কুলে এবং পরে লালবাগে নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। তার কাছেই শফির প্রথম প্রকৃতিপাঠ, হাতিতে চড়া, বনে-বনান্তরে ঘোরা, বন্দুক হাতে স্পর্শ করা ইত্যাদি। তারই প্ররোচনা ও যুক্তিতে শফি নাবালক অবস্থায় রুকুকে (দিলরুখ) বিয়ে করতে মানসিক দোলাচলে পড়ে। প্রথমদিকে শফির ওপর তার প্রভাব যথেষ্টই দেখা যায়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হলেও মানুষটি অত্যাচারী নন, বরং কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। শফি নিপাত্তা হয়ে গেলে সেই মানুষটি উদ্বেগী, আবেগপরায়ণ, অপত্যস্নেহে কাহিল হয়ে পড়েন। নিজের বিবেকের কাছে ছোট হয়ে যান। পাগলের মতো ছুটে বেড়ান এখানে-ওখানে শফির নাগাল পেতে। তিনি যে একজনের কাছে শফিকে চেয়ে নিয়েছিলেন তাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, তা যখন এক আশ্চর্য দিকে মোড় ঘুরছে, তখন তিনি দিশেহারা প্রায়। শফির বাবা ও মায়ের কাছে লজ্জিত, কুণ্ঠিত; তাদের কাছে মুখ দেখানোর যোগ্যতা যে তিনি হারিয়েছেন সেটা বোঝার মতো ব্যক্তিত্বের মানুষ তিনি। শেষে শফির দণ্ডাজ্ঞা হলে তাকে বাঁচাবার চেষ্টায় নামেন। স্বাক্ষর-সংগ্রহে নামেন এবং ব্যর্থ হন। একরকম হতাশায় একসময় দেওয়ানির চাকরি ছেড়ে বহরমপুরে এসে বসবাস শুরু করেন, একাকী। ওকালতিতে জড়ান। অকৃতদার মানুষটি সম্ভবত পুত্রস্নেহে শফিকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে আরও নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বনে যান। কাল্লু পাঠানকে হত্যা করার পর শফি খোঁজ করে বহরমপুরে বারি চৌধুরীর কাছে যায়। অতি রুগ্ন বারিচৌধুরীকে শফি যেন চিনতেই পারে না। আর বারি চৌধুরী শফিকে প্রথম দর্শনে চিনতেই পারেন না। বড়ো বেদনার অবস্থান। শফি পরিচয় দিলে, তিনি তাকে আড়ালের চেষ্টা করেন, কেঁদে ফেলেন, সারেন্ডার করতে বলেন এবং একবার যেন মা-বাবার কাছে গিয়ে সে দেখা করে আসে তার পরামর্শ দেন। দেখা যাচ্ছে, তখনো তিনি ভোলেননি তার ব্যর্থতার কথা, মা-বাবার সঙ্গে একবার দেখা হলে অন্তত তার কিছুটা স্বস্তি ঘটবে। এইসময় তাদের মধ্যে কিছু দার্শনিক কথাবার্তাও হয়, বোঝেন শফিকে বোঝানোর মতো অবস্থায় তিনি আর নেই। তবু তার নিরাপত্তার কথা ভাবতে ভোলেন না। তখনো শফিকে নিয়ে তার অপত্যস্নেহ বিদ্যমান। বারি চৌধুরীর চরিত্রে বড়োগাজির নাস্তিকতা নেই, আবার নেই ধর্মের প্রতি মোহ। অলৌকিকত্বে বিশ্বাস নেই, আছে প্রকৃতির শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার মধ্যে জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা আর আছে শিক্ষার প্রতি টান। এই চরিত্রে সেভাবে স্ববিরোধিতা কিছু নেই, আছে যাতনায় বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া।
বড়োগাজি
গাজি সইদুর রহমান। হরিণমারা অঞ্চলে বড়োগাজি নামে খ্যাত। জেলাবোর্ডের মেম্বার ও প্রসন্নময়ী এইচ ই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার। প্রভাবশালী ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ। বারী চৌধুরীর বন্ধু। বড়োগাজি শৌখিন মানুষ। তাঁর মোট নিকের (বিয়ের) সংখ্যা এগারো, বর্তমানে দুজন টিকে আছে, যার একজনকে আবার তালাক দেওয়ার মুখে। আমুদে ও বাচালটাইপের মানুষ। সেই তল্লাটের এক মানুষবাঘ। আড়ালে লোকে তাকে বাঘাগাজি বলে। অবশ্য তিনি তার পদবী গাজি নিয়ে গর্বিত। কারণ, তার পূর্বপুরুষ ফরিদ খান কাফের ফতে সিং-এর মাথা কেটে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন এবং এই উপাধি লাভ করেছিলেন। প্রথম দর্শনেই শফির সঙ্গে মসকরা করায় শফি অপমানিত বোধ করে। তিনি বদুপিরের জিন-টিন মানেন না, পির-মাজারেও বিশ্বাস নেই, নাস্তিক বলা যায়। এই নিয়ে ভাই ছোটোগাজির সঙ্গে তার বিতণ্ডাও ঘটে। বড়োগাজি ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ান, জিনের পাশে খাপে ঢাকা তলোয়ার ঝোলে, সুন্দর পোশাক ও মাথায় অদ্ভুত টুপি। ঘোড়া শফিকে আকৃষ্ট করে। বারী চৌধুরীর কাছে শফি সম্পর্কে শুনে বড়োগাজি শফিকে ইংরেজি শেখাতে আগ্রহী হন। শফিকে ডেকে বাড়িতে নেন, নাশতা (সকালের খাবার) করান। বারী চৌধুরীর মতো এত অল্প বয়সে শফির বিয়ের বিরোধিতা করেন। আসলে তিনি হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় পাল্লা দিয়ে মুসলমান-অস্মিতা বজায় রাখার পক্ষে। “আমরা চাইছি, মুসলমান ছেলেরাও ইংরেজি স্কুলে পড়ুক। যে মুসলমান এই সেদিন পর্যন্ত বাদশাহি করেছে, সে মুসলমান হিন্দুর গোলাম হয়ে যাবে— এই সহ্য করা যায় না।” তার বিশ্বাস— ‘ইংলিশ শিখলে সে (মুসলমান) হিন্দুদের গোলামে পরিণত হবে না।’ শফি তার তরোয়াল পরখ করে দেখে এবং অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায় তার শরীরে। ঘোড়া ও তলোয়ার তাকে ক্রমে বড়োগাজির দিকে ঠেলে দেয়। শফির গার্জিয়ানি নিয়ে বড়োগাজি এবং বারি চৌধুরীর মধ্যে যেন একটা প্রচ্ছন্ন রেষারেষি। সেই ১৬-১৭ বছর বয়সে শফি অবশ্য দুজনের দ্বারাই কিছুটা প্রভাবিত। যদিও বারি চৌধুরীর প্রভাব বেশি ছিল। উপন্যাসে বড়োগাজির চরিত্র নির্মাণে উপন্যাসকার অদ্ভুত এক খেলা খেলেছেন। একদিকে মুসলমান অস্মিতা তারই বিপরীতে নাস্তিকতা। একদিকে পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অন্যদিকে নারীলোলুপ, মুসলিম ধর্মের তালাক প্রথার সুবিধাভোগী। পরের দিকে তিনি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। বোঝা যায় না, উপন্যাসকার এমন স্ববিরোধী সুবিধাবাদী মানুষকে রাজনীতির দিকে এগিয়ে দিয়ে ক্ষমতাশালী বানানোর পেছনে কোনো ইঙ্গিত রেখেছেন কিনা! কিন্তু একটা সম্ভাবনার কথা অন্তত আমার মাথায় এসেছে।
দেবনারায়ণ রায়
প্রকৃতপক্ষে জমিদারনন্দন। কাপালীতলার জমিদারদের ছোটতরফ। কিন্তু সংসারী নন। খেয়ালি মানুষ। দাদা ও জ্ঞাতিদের সঙ্গে বনিবনা না-থাকায় মামলা-মোকদ্দমা করে জমিদারির শাঁখালা নামে একটা অনাবাদী জঙ্গলমহল ভাগে পান। নাবাল জমি। তাতেই তিনি গড়ে তোলেন এক ব্রাহ্মবাদী আশ্রম। নাম দেন ব্রহ্মপুর। তিনি নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী। সবকিছুতেই আনন্দের হাতছানি দেখেন এবং উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হন। ধর্ম মানে তার কাছে এক মিলিত শক্তি। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-ব্রাহ্ম নির্বিশেষে সবাইকে আনন্দপুত্র ভাবেন আর তাদের সম্মিলীত করতে চান আশ্রমের কাজে, মানুষের উন্নতিতে। রাজনীতিতে সেভাবে বিশ্বাস নেই, স্বদেশীর দ্বারা দেশের মঙ্গল কিনা সেভাবে ভেবেও দেখেন না, বরং ‘আত্মনং বিদ্ধি’ এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে আশ্রম ও সমবায়ের মাধ্যমে নিজেকে সমাজের কাজে লাগাতে চান। সেই উদ্দেশ্যেই গরীব-গুর্বোদের জন্য আশ্রমের কার্যপ্রণালী ঠিক করেন। তিনি জাত-বেজাত মানেন না। বলতেন ‘একো ব্রহ্ম দ্বিতীয়ো নাস্তি’। মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পারতেন। তাই কপালীতলায় স্বল্প পরিচয়ে শফির মধ্যে মুসলমান নয়, এক মানুষকে আবিষ্কার করেন তিনি। নিয়ে আসেন ব্রহ্মপুরে। ভীষণ ভালোবাসেন তাকে এবং আশ্রমের কাজে লাগান। অসহায় স্বাধীনবালা ও সুনয়নীকেও আশ্রয় দেন। সেখানেও স্বদেশী নয়, প্রাধান্য পায় মানুষ। জমি চাষযোগ্য করে তোলা, আবাদ, সুতাকাটার ব্যবস্থা, লাইব্রেরি চালু করা, ধর্মালোচনার পরিবেশ তৈরি ও আলোচনায় অংশ নেওয়া, বৈদিক মন্ত্রপাঠ ও তার ব্যাখ্যা, আশ্রমের রূপ ও শ্রীবৃদ্ধি, ক্রমে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার-প্রসার, ইত্যাদি সবই তার আনন্দময় জীবনের প্রকাশ। স্বরূপ উপলব্ধির প্রয়াস। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা চাপে ব্যর্থ না-হলেও সফল না-হতে পেরে একসময় কলকাতায় চলে যান আশ্রম ছেড়ে। তখন কখনো-সখনো আসতেন শুধু খাজনা আদায়ের জন্য। শফির জীবনে এই মানুষটির প্রভাব যথেষ্ট, যদিও কোনো ভাবনাতেই থিতু হতে না-পারা শফির পরিণতির খবর হয় তিনি রাখতেন না, নয়তো রাখলেও ছিলেন নির্বিকার। জমিদার হয়েও তিনি একজন ত্যাগী মানুষ ও সমাজের হিতার্থে নিবেদিত প্রাণ। এভাবেই চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসে।
Posted in: July 2021 - Serial, PROSE