তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা

চ্যুত

মাতৃহাড় সেলাইয়ের শব্দ। আমরা ভয়ে ভয়ে নাড়ি পেরিয়ে গেলাম।
এই আমরা লিখতে বসেছি কায়াভাঙনের গল্প, এই আমরা
শিকড় কোপানোর গন্ধ শুঁকছি এ-ওর গায়ে। আমাদের পাগুলি
মহানিষ্ক্রমণে বেরিয়ে পরিধি বরাবর বেঁকে যাচ্ছে, দ্যাখো।
মাথা তুললে কানা হয়ে যাব, হাত তুললে পাথর…
লঙ্গরের ধোঁয়ায় হু-হু ক’রে উঠছে বাথান। গাভী ঘাস চিনতে পারছে না।

মাতৃহাড় সেলাইয়ের ধ্বনি। আমরা স্তন বদল ক’রে
নতুন অন্নে এলাম। আর মুখ যেন মাদারির ভল্লুকের মতো
দুলছে! এ-প্রান্তের উদ্‌গীতে গলা মেলাতে গিয়ে মাথা খসে পড়ল।
কবন্ধে কবন্ধে ঠোকাঠুকি। দূরে আমাদের মাথাগুলি
রিলিফ ক্যাম্প অবধি গড়িয়ে যাচ্ছে দলে দলে।
মুখে কারা ভাত দিল? গলার নীচে বিছিয়ে রাখা থালায়
সব ভাত ঝ’রে ঝ’রে বরফ… ধড় জানতেই পারল না এতকিছু!

মাথা তুললে কানা হয়ে যাব, হাত তুললে স্মৃতি…
এক নদী থেকে আর-এক নদীতে এসে
এ-ওর স্নায়ু শনাক্ত করতে করতে ভাসছি। এখানে আমাদের
তুলসী গাঁথার মাটি নেই। শুধু জল। মরা ষাঁড়ের পিঠে কার খোকা ভাসছে?

মাতৃধড় সেলাইয়ের শব্দ। আমরা সারা শীত রাত পেরিয়ে এলাম।
শিকড় কোপানোর গন্ধে ম-ম করছে মাথা। বাঁকা পাগুলি বৃত্ত বানাল, দ্যাখো!
এই আমি খেতে বসেছি কল্পতরুর ফল,
এই আমি ডুবোপাথরের কাঁধে ব’সে মধ্যরাতে ক্রমে
“ঘাসের জাত নাই” বলতে বলতে গাভীর চোয়ালে
ছায়া-ছায়া হাত রেখে জেগে আছি। একা…

দরজা

দরজা থেকে সংঘাত সরে গেল; বিগ্রহ দুয়ার আড়াল ক’রে
দাঁড়িয়ে আছে। যেন অদ্ভুত সৌরমৃত্তিকার থকথকে কাঠামোয়
তার গলে যাওয়া শরীর আমাদের অন্তিম শুদ্ধ প্রণাম নিয়ে
মিলিয়ে যাবে আয়ুতে যন্ত্রের ধ্বনি হলেই।
দরজা ঢেঁকির মতো ওঠানামা করছে, দৃশ্য গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যায়
এমন প্রাবল্যে। আমরা গৃহস্থ ছিলাম কিংবা আছি, পুরুষোত্তম
খুঁজতে খুঁজতে পাথর অবধি এসে গন্তব্য খসে পড়ার
ঘটনায় মুচড়ে যেতে দেখছি ঘটনার হাড়।
উঁচুতে মজ্জা কাপাস তুলোর মতো মেঘ, নীচে কে কার শরণে যাব
বুঝতে বুঝতেই দরজা সরে যাচ্ছে ঘরের কাঠামো থেকে।

এই অবধি ধর্ম। এই অবধি কুকুরের স্বর্গারোহণ। এরপর
যেটুকু পথ তা পূর্ণ একা প্রাণ দাবি করে। প্রব্রজ্যা’র আঁশ
ছাড়াতে ছাড়াতে আমাদের নখ চমকে উঠছে, যেন মূর্তির
চামড়া ছিঁড়ে রক্তিম জগৎ দেখে ফেলছি! দেখে ফেলছি
সৌরমৃত্তিকার অনিয়ত পেটের ওপর বিগ্রহের শিকড় বনবন ক’রে
ছড়িয়ে যাচ্ছে… আর কালো কালো গাছের বক্র চেহারা
হু-হু ক’রে জগৎ চাগাড় দিয়ে মুড়ো তুলছে। যেন পুরুষোত্তম
আদপে বিকট মাংসাশী গাছ, আমরা বোধে আনতে না পেরে ফল ছড়িয়ে
শান্ত হও, শান্ত হও জপেছি হিমকালের শুরু থেকে আজ অবধি।

দরজা থেকে বিগ্রহ সরে গেল, আমরা বাইরে তাকাতেই
চোখের কাঠামো গলুইয়ের মতো ধাক্কা দিচ্ছে বাইরের পাহাড়ে।
ওই অবধিই যাব আমরা। তারপর আবার নতুন দরজায়
আমাদের পা জড়িয়ে যাবে…

Facebook Comments

Leave a Reply