কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ

Subhankar Guha[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]

১২

ঘটনা বারে বারে ফিরে আসে। বারে বারে একই ঘটনা ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে অন্য এক ভুবন গড়ে দেয়। হ্যাঁ, সেই একই রকম ঘটনা, একটি সাদা পাতার মধ্যে মা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছিলেন, মাসকাবারি সব জিনিসপত্রের তালিকা। বাবা আজকে মাস মাহিনা ঘরে তুলে আনবেন। যেদিন বাবার মাইনে আসত, সকাল থেকেই মায়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। আর দম ছেড়ে ছেড়ে বলতেন,- উঃ !!! কি একটা মাস গেল, দম ফেলতে দিল না।
আমি বারে বারে কিসমিসের কথা বলছিলাম। মা আমাকে ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করলেন না। না শোনার ভান করছেন। কিশমিশ এলে, আমি জানতাম মা একটি ছোটো সুন্দর কৌটার মধ্যে কিশমিশ রাখতেন। সেই কৌটার ভিতরে কিশমিশ আছে কি নেই সেটি আমার নজরে থাকত। মা বারে বারে বলছিলেন, আছে। আমি বারে বারে বলছিলাম, নেই। কিশমিশ মাসকাবারির সাথে এলে, আমার স্বাদ আহ্লাদের ঘর ভরে থাকে। মা জানতেন, তাঁর চোখের আড়ালে, আমি কিসমিসের কৌটো খুলে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতাম। যেদিন মায়ের কিসমিসের প্রয়োজন পড়ত, কৌটো খুলে দেখতেন, কিশমিশ নেই। সে এক ভয়ানক সময়। নিজেকে আর কত আড়াল করে রাখা যায়। ঠিক খুঁজে বার করে, কিসমিসের হিসেব বুঝে নিতেন।
আমি লিখছিলাম, বলছিলাম, আর…আর…
লেখ কালোজিরে, মেথি, গুঁড়ো জিরে, সন্ধক লবণ…
আমি মাথা নিচু করে লিখছিলাম, বাবা কখন যে অফিস থেকে ফিরে এসেছেন, বুঝতেই পারিনি। মায়ের কোচরে একটি কাগজ দিয়ে বললেন, পড়ে দেখ।
মা কাগজটি খুলে দেখলেন, বললেন, – বাঃ রে। একী বাংলায় লেখা আছে যে গড়গড়িয়ে পড়ে যাব। ইংরেজিতে লেখা আছে, তুমি জানো না।
মাসকাবারির লিস্ট করছ তো।
করব না? প্রতিমাসেই এটা সেটা ভুলে যাই। এখানে কি কলকাতার মতো মোড়ে মোড়ে দোকান? পরে আবার কাউকে না কাউকে দৌড়তে হয়।
তোমার লিস্ট রাখো, এখন লিখো না। যা কিছু প্রয়োজন সব আগ্রায় গিয়ে কিনে নেব।
মা শুনলেন কি শুনলেন না, মাকে কোনোদিন কোনো কথার পিঠে খুব উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি। বাবাকে বললেন,- অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাইনি। ভাবছিলাম, তোমাকে বলব, একবার তাজমহল দেখে আসি। এত কাছে এসেও যদি না যাওয়া হয়? দোকানের লিস্ট করে রাখি। লাগবে তো?
আর কয়েকদিন পর থেকেই রোজ তাজমহল দেখতে পারবে। আগ্রায় বদলি হয়ে গেল। অর্ডার হয়ে গেল। তুমি বরং সব গুছিয়ে নাও। এই সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের চলে যেতে হবে।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,- তোমার চাকরি কোথাও একটুও থিতিয়ে নিতে দিচ্ছেনা। এই তো কলকাতা থেকে এলাম, এখনও শরীর থেকে ট্রেনের গন্ধ যায়নি, আর এর মধ্যেই আবার বাক্স প্যাটরা নিয়ে চলো। ছেলেগুলোর পড়াশুনো গোল্লায় গেল। এত সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আবার চলো অন্য শহরে। কি ভীষণ যাযাবরের জীবন। ন
পরের দিন বিকেলের দিকে জেঠিমার কাছে গেলাম। তিনি একটি বড় আকারের কাঠের চেয়ারে বসে, একটি মোটা বই পড়ছিলেন। আমি যেতেই খুব খুশি হয়ে বললেন, – ভাবছিলাম কখন আসবে? তা তুমি একা কেন? আরও দুইজন কোথায়? ছোটোজন ও সেজ জন?
ওরা দুইজন মায়ের সঙ্গে বোঝা বাঁধার কাজ করছে।
সংসারের অনেক বোঝা থাকে, সেইগুলিকে না বাঁধলেই নয়। গুছিয়ে না রাখলে বিড়ম্বনা হয়।
আমরা এই সপ্তাহেই চলে যাব, বাবার বদলি হয়ে গেছে।
জেঠিমা আমার চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে রইলেন। তারপরে খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলেন,- তোমরা চলে যাবে?
হ্যাঁ, জেঠিমা আমরা চলে যাব। বাবার বদলি হয়ে গেল।
কোথায় কানপুরে না এলাহাবাদে?
না জেঠিমা। আগ্রায়।
তোমরা এখন যেখানে আছো, ওই বাড়িতে কেউ বেশিদিন থাকে না। কয়েকদিনের মধ্যেই বদলি হয়ে যায়। চলে যায় অন্য কোথাও। কারও ওপরে মায়া চিরস্থায়ী হতে দেয় না। তা কবে চলে যাচ্ছ? তুমি কিছু জান?
সম্ভবত শুক্রবার চলে যাব।
জেঠিমা আমার খুব কাছে এসে মাথায় হাত রাখলেন।
কি বই পড়ছ?
রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়ছি।
আমাকে মা কাবুলিওয়ালা পড়িয়ে শুনিয়েছেন।
আমি পোস্টমাস্টার পড়ছিলাম।
তুমি খুব বই পড়। মা খুব বই পড়েন। কিন্তু এখানে বাঙলা বই কোথায় বলো? তোমার ওই ঘরে কত বই। এত বই তোমার পড়া?
প্রায়ই। তবে সব পড়তে নেই। বই পড়ার তৃষ্ণা রেখে মরতে হয়।
কেন?
পরের জন্মে বইয়ের পাতায় পোকা হয়ে জন্ম নেয়। দাঁড়া, তোমাকে একটা জিনিস দিই।
জেঠিমা এই বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পরে একটি চৌকো আকারের সুন্দর বাক্স আমার হাতে তুলে দিলেন। তার ঢাকনায় রূপকথার মতো সব ছোটো ছোটো ডানাওয়ালা পরীদের ছবি। বাক্সটি নানা রঙয়ের। আমি তো হাতে নিয়ে অভিভূত। এই বাক্স জেঠিমা আমাকে দিলেন !!! ভাবতেই পারছি না। কোনোদিন কেউ আমাকে কিছু দেয় নি। তাই আশ্চর্য হয়ে বললাম,- আমাকে দিলে?
হ্যাঁ। তোমাকেই তো দিলাম। ঢাকনা খুলে দেখ।
তুমি দেখনি?
তোমাকে উপহার দেব বলে, ভিতরে কি আছে দেখিনি। খোলো তো একবার?
খুলে দেখলাম, বাক্সর ভিতরে, পানাগড়ের কাশবনের জঙ্গল ধু ধু করছে। আর বহুদূরে, সেই পরিত্যক্ত রেল ওয়াগনের মাথায় এক ঝাঁক ছাতারে ডাকছে। বাবা আমার হাত ধরে অতিক্রম করছেন পায়ে চলা দাগ ধরে সীমানার ওধারে। বাবাকে মনে মনে বললাম,- চলো যাই ঠিক ওইদিকেই, আমি নুড়ি পাথর দিয়ে একটি শহর বানিয়ে রেখেছি। দেখবে চলো। নুড়ি পাথরের শহরের ভিতরে জল তির তির করে বয়ে যাচ্ছে, আমার গত জন্মের সাঁকোর দিকে। সেই সাঁকোর ওপরে তুমি ও মা দাঁড়িয়ে আছো।
সেই টিনের বাক্সটি আমার কাছে বহু বছর ছিল। সেই বাক্সর ভিতরে স্ট্যাম্প ও বিরল পাখির পালকের টুকরো রেখে দিতাম। এমনই যেমন পিতলের সুতো কাটার তকলি ভাঙ্গা এরোপ্লেন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বিচিত্র আকারের রূপোর মতো চকচকে নাটবল্টু এই সব কিছুই সংগ্রহে ছিল। কিন্তু বিনা নোটিশে এই সব সংগৃহীত বস্তুগুলি কোথায় যে সরে পড়ে কে জানে।
জেঠিমা বললেন,- কয়েকদিনের মধ্যেই তোমরা খুব আপন হয়ে গেছিলে। ভাবতাম তোমরা তো আছো। কিন্তু চলে গেলে ভাবব একদিন এখানে ছিলে। জেঠিমা অনেক কথা বলছিলেন, আমি তার ঘরের ভিতরে ঘুরে ঘুরে পাথরের মূর্তিগুলিকে দেখছিলাম। কয়েকটি সাদা পাথরের মূর্তিকে জেঠিমা কাঁচের বাক্সের মধ্যে রেখেছেন। তার মধ্যে একটি মূর্তি মা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে একটি খিলানের ওপরে বসে আছে। আরেকটি মূর্তি রোমান পুরুষদের মতো। গালে হাত দিয়ে কি যেন চিন্তা করছে। মূর্তিগুলি এতই সুন্দর, যেন মনে হচ্ছে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে শরীরের উত্তাপ অনুভব করতে পারব। ঘরের দেওয়াল জুড়ে কাঠের ফ্রেমের মধ্যে বড় বড় ঘোড়ার ছবি বাঁধানো। কি চমৎকার সব ঘোড়া। কালো বাদামি সাদা বাদামির মধ্যে সাদা ছোপ ছোপ কি চমৎকার সব। জানতে চাইলাম এই ঘোড়াগুলি তোমাদের ছিল?
হ্যাঁ রে। ওই যে সাদা ঘোড়াটি দেখছ। আমি যখন এই বাড়িতে এলাম, ওই সাদা ঘোড়াটির পিঠে চেপে এই বাড়ির সামনেই ঘুরে বেড়াতাম।
তুমি ঘোড়ার পিঠে চেপে ঘুরতে?
এই বাড়ির সামনে তখন সুন্দর ঘাসের জমি ছিল। বিস্তৃত জমি। গাঢ় সবুজ রঙয়ের ঘাসের লন। উদ্যান। রাতের বেলায় ঘাসের ওপরে জোনাকি উড়ে বেড়াত, দিনের বেলায় হরিণ আসত। জমি জুড়ে জুড়ে ঘাস খেয়ে বেড়াত। মাঝে মাঝে আমাদের এ্যালশেসিয়ান ওর নাম ছিল লাকি মাঝে হরিণগুলিকে তাড়া করত। আমি যখন ওকে একটি কাঠের বল ছুঁড়ে দিতাম, ও তখন হরিণগুলিকে ছেড়ে দিয়ে কাঠের বল মুখে নিয়ে ছুটে আসত। এই ভাবে বারে বারে।
কি বললে? লাকি?
হ্যাঁ। ওর নাম ছিল লাকি। কুয়োতলার পাশেই ওকে কবর দেওয়া হয়েছিল। এখন ওর ওপরে ওই যে কাঠচাপালি গাছটি। তোমরা রোজ ফুল নাও।
আমরা যখন পানাগড়ে ছিলাম, আমাদের কোয়ার্টারেও একটি কুকুর ছিল। ওর নামও লাকি ছিল। সেই বার ক্যান্টনমেন্টে রটে গেল কুকুরের থেকে একপ্রকার রোগ হচ্ছে সবার। তাই মেজর সাহেব অর্ডার দিলেন গুলি করে কুকুরকে মেরে ফেলতে হবে। আমাদের রান্নাঘরের জানালার পাশে ছায়াতে লাকি বিশ্রাম নিচ্ছিল। ওকে তখন গুলি করল সৈনিক। তুমি লাকি বললে, তাই পানাগড়ের লাকির কথা মনে পড়ে গেল। ওর কথা মনে পড়লেই, মনে পড়ে ওর তলপেট দিয়ে রক্তস্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে।
ইসসস্। এ তো মর্মান্তিক। কুকুর থেকে কি রোগ ছড়াবে? আর তার জন্য কুকুরকে গুলি করে মারতে হবে? এই পৃথিবীতে একমাত্র মনে হয় মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তোমরা সৈনিককে কিছু বললে না কেন?
কি করে বলব, মেজর সাহেবের অর্ডার ছিল যে।
খুব মন চাইছিল জেঠিমার মহলের মতো বাড়ির আনাচ কানাচ মুখস্থ করে ফেলি। কি আছে এইখানে, কি আছে সেইখানে – পাথরের মূর্তি থেকে শুরু করে, গ্যারেজে যত্নে রাখা টিয়া পাখি রঙয়ের গাড়ি। মাঝে মাঝে জেঠিমা ওই গাড়িতে চেপে মথুরা শহর ভ্রমণ করে আসেন। খুব ইচ্ছে ছিল, সে এক ভয়ানক ইচ্ছে, জেঠিমার ওই গাড়িতে চেপে একদিন তাঁর মতই মথুরা শহর ঘুরে বেড়াব। আমি গাড়িটির টিয়া পাখি রঙ হাতিয়ে হাতিয়ে দেখছিলাম। আর কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরে দেখে ভাবছিলাম, এই গাড়িতেই চেপে মানুষ চলে যায় আমাজনের জঙ্গলে।
বাবা প্রায়ই রাত্রে আমাদের আমাজনের জঙ্গলের গল্প বলতেন। বাবা জঙ্গলের গল্প বলতে বলতে, মনে হত পিঁপড়ের ঢিবির খোঁজ করতেন। বড় হয়ে পিঁপড়ের ঢিবির অর্থ গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। পিঁপড়েদের অদ্ভুত সংসার। ওই ঢিবির ভিতরে পিঁপড়েদের অনুশাসনের এক চমৎকার বেঁচে থাকার অবলম্বন। পিঁপড়েরা ঢিবির ভিতরে যায় আর আসে। আর গভীর গর্তের ভিতরে আছে তাদের রানি। অনেকটাই জেঠিমার মতো। রানি সে তাঁর মহল নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে।
জেঠিমা হঠাৎ করে আমাকে বললেন, বিকেলে ভালো রঙ্গিন জামাকাপড় পড়ে এস। আর সাদা কাপড়ের জুতো পড়ে।
কেন !!!
এসো না। জানতে পারবে।
তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?
কেন, তুমি জানোনা?
আমাকে কোনোদিন কেউ তোমার মতো সাদা জুতো পড়ে আসতে বলেনি।
পাগল ছেলে !!! ভালো করে চুল আছড়ে, সাদা জুতো পড়ে, মাকে বলবে রঙ্গিন জামা পড়িয়ে দিতে। ঠিক বিকেল চারটের সময় আসবে।
আমার সঙ্গে সেজোও আসবে।
না তুমি একা আসবে।
আমি একা আসব?
হ্যাঁ। একাই আসবে।
চুপি চুপি না মাকে বলে আসব?
বাঃ রে। মা যে তোমাকে রঙ্গিন জামাটা পড়িয়ে দেবে।
ঠিক আছে।
বিকেল চারটের সময়।
জেঠিমা খুব কাছে এসে আমার মাথার চুলগুলিকে এলোমেলো করে দিলেন। তারপরে নিজের শাড়ির গভীরে টেনে নিয়ে বললেন, আমি তোমার ইচ্ছেটা বুঝেছি।
অবাক হয়ে জেঠিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

ঠিক বিকেল চারটের সময় আমি জেঠিমার ঘরে ঢুকে দেখি একটি ঘিয়ে রঙয়ের শাড়ি পড়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন। লম্বা কাঁচা পাকা চুল পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বারে বারে নিজেকে আয়নার সামনে বিভিন্ন বিন্যাসে দেখছিলেন। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে বললাম,- আমরা কোথায় যাবো?
জেঠিমা একেবারে ছেলে মানুষের মতো মিহি হেসে বললেন, গাড়ি যেদিকে যাবে আমরাও সেইদিকে যাব।
আমি হাসতে হাসতে বললাম,- আমাজনে?
সে আবার কি !!!
আমাজনের জঙ্গলে।
জেঠিমা মিষ্টি হেসে বললেন,- দুষ্টু।
জেঠিমা আগে আগে সোনালি চামড়ার চপ্পলের শব্দ তুলে। আমি তাঁর পিছনে। গাড়িটি দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক জেঠিমার মহলের সিঁড়ির কাছে। ড্রাইভার এসে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। জেঠিমা উঠে বসলেন। আমি সামনের সিটে বসতে যাচ্ছিলাম, জেঠিমা বললেন,- না, পিছনে এসো। আমার পাশে।
গাড়ি চলতে থাকল। গাঙ্গুলি বাড়ির সীমানা অতিক্রম করে, গেট পেড়িয়ে গাড়ি ঠিক বিশ্রাম ঘাটের দিকে যাওয়ার উল্টো দিকের রাস্তা ধরল। এই রাস্তাটাই সান্যাল কাকুদের কোয়ার্টারের ওইদিকেই গেছে। আমরা যেদিন প্রথম গাঙ্গুলি বাড়িতে এলাম, টাঙ্গা করে এই রাস্তা দিয়ে সান্যাল কাকুদের বাড়ি থেকে এসেছিলাম।
জেঠিমা বললেন,- এই রাস্তা দিয়ে গেছ কোনোদিন?
যাইনি। তবে এসেছি।
বুঝেছি। কথা বলতে পারো সুন্দর।
মা বলেন, আমি নাকি বোকা বোকা কথা বলি। সেই জন্য কারও সামনে আমাকে কিছু বলতেই দেন না।
অনেক সময় কথা বলতে বলতে তুমি খুবই বোকার মতো কথা বল বটে। জানো কথার সঙ্গে অনেক সময় মনের ও বুদ্ধির যোগাযোগ থাকে। কেউ যদি শুধুই মনের কথা বলে সেই কথা বোকা বোকা হয়। আর কেউ যদি শুধুই চতুর ভাবে বলে তাহলে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তোমার কথার মধ্যে ভাবনার একটা জগত আছে।
ধ্যাত।
ধ্যাত কেন।
জেঠিমার পোশাক ও শরীর থেকে চমৎকার সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। মথুরার বিকেলের সোনালি রোদ তাঁর ঠোঁটে পড়েছে। জেঠিমা ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের আভা ঢেলেছেন। রোজ যে জেঠিমাকে আমি দেখতে অভ্যস্ত, এ সেই গাঙ্গুলি বাড়ির জেঠিমা নয়। অন্য কেউ। মথুরা, একটি প্রাচীন শহরের মধ্যে এক বালিকা, যে আমার হাতটি টেনে নিয়ে আঙ্গুলগুলিকে ভীষণ ভীষণ আদর করতে থাকল। আমি প্রথমে লজ্জা পাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম, জেঠিমার আদরের অন্য এক ভাষা আছে। মানুষের শরীরের বয়স বা শরীর কত প্রাচীন, অনেক সময় তা গৌণ। গাড়ি চলেছে।
এই প্রথম একটি প্রাইভেট গাড়িতে বসে, যাচ্ছিলাম একটি প্রাচীন শহরের রাস্তা ধরে, যেই শহরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। মথুরার বিকেলের আলোকে রঙ্গিন করে তুলল, শুকনো হলুদ ঘাসের খোলা মাঠে এক ঝাঁক ময়ূর। বড় বড় পুচ্ছ। তারকাটার ঘেরাটোপের মধ্যে হরিণ ও তার গুটিকয়েক শাবক। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো পাকাবাড়ির ওপরে খাটো খাটো টোপর।
আমি বললাম,- দেখ বাড়িগুলির মাথায় অদ্ভুত টোপর।
ওইগুলি কাঁচের চুরির কারখানা। তুমি যাকে টোপর বলছ ওইগুলি চিমনি। উনুনের ধোঁয়া বার করার জন্য।
ওখানে কি কাঁচের চুড়ি হয়।
মথুরা কাঁচের চুড়ির জন্য বিখ্যাত।
মনে পড়ছে, মা বলেছিলেন।
মথুরার কাঁচের চুড়ি খুব বিখ্যাত।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মথুরা বাজারের দিকে।
তারপরে?
তোমার বাবার গল্পের কাছে।
তাহলে তো বেশ হয়। আমি তোমার কাছে সারাজীবন আমাজনের জঙ্গলেই থেকে যাব।
জেঠিমা খুব মোলায়েম কণ্ঠে হেসে বললেন,- তা হলে বেশ হয়। একা একা থেকে মন আমার মহলের পাথরের মতো হয়ে গেছে।
গাড়ির ড্রাইভার মথুরার খাস ব্রাহ্মণ। খুবই কম কথা বলেন। শুধু একবার বললেন,- চক্রবর্তীর দোকানে?
জেঠিমা বললেন,- হ্যাঁ।
আমরা পরের পর কাঁচের চুড়ির কারখানা পার হয়ে, চলেছি মথুরা বাজারের দিকে। অধিকাংশই লাল পাথরের বাড়ি। বড় বড়। বাড়ির নিচে দোকান। গাড়ি থামল একটি বড় দোকানের সামনে। জেঠিমা বললেন,- নেমে এসো।
জেঠিমার পিছনে পায়ে পায়ে দোকানের পাথরের সিঁড়ি টপকে পৌঁছে গেলাম। জেঠিমা হিন্দিতে কয়েকটি কথা বলার পরে বাংলায় কত কিছু বলতে থাকলেন। কত বড় বইয়ের দোকান। জেঠিমার জন্যই যেন সাজানো আছে। সব বাঙলা বই। কত বই। জেঠিমার জন্য। পড়ছিলাম এক একটি বইয়ের নাম অক্ষর ভেঙ্গে ভেঙ্গে। এত বই !!!
কলকাতা থেকে এসেছে। বহুদিন আগে অর্ডার করতে হয়। তারপরে বই এলে, দোকানদার জেঠিমাকে খবর দিয়ে দেন। এখানে মথুরায় বাঙলা বই দেখে, নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। জেঠিমা এই বইগুলি পড়তে পড়তে পাষাণের মতো কঠিন একাকীত্ব কাটিয়ে উঠবেন। বইগুলিকে সুন্দর মোড়ক করে, দোকানদার গাড়িতে তুলিয়ে দিলেন। জেঠিমা চক্রবর্তী বাবুর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলে নিলেন। তারপরে পাথরের সিঁড়ি টপকে গাড়ির কাছে এসে, ড্রাইভারকে বললেন,- চলো মাথুরের মিষ্টির দোকানে।
মিষ্টির দোকানে ঢুকে, আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন, একটি চমৎকার বোতল। গভীর কালো লাল রঙয়ের তরল, আর বোতল সাইবেরিয়ার বরফের মতো ঠাণ্ডা। জেঠিমা বললেন,- তাড়াতাড়ি চুমুক দিয়ে নাও। আমি চুমুক দিয়ে শিউরে উঠলাম। নাক মুখ জ্বলে গেল দাউ দাউ করে ঝাঁঝে। জীবনে সেই প্রথম কোকাকোলা। উদরের ভিতর থেকে ঝাঁঝ গড়িয়ে এসে ঢেঁকুর। জেঠিমা তাই দেখে হাসি থামাতে পারলেন না। বললেন,- বেশ হয়েছে।
বললাম,- চোখ নাক মুখ জ্বলে যাচ্ছে।
বেশ তো। আরেকটি নেবে?
ভাগ্যিস একটাতেই।
জেঠিমা আমার হাতে ক্ষীরের বড় বড় প্যারা তুলে দিয়ে বললেন,- খেয়ে নাও ভালো লাগবে। কোলার জ্বালা জুড়বে।
জেঠিমা দ্রুত পায়ে পায়ে বালিকার মতো চঞ্চল হয়ে, হাঁটছিলেন না যেন, উড়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। ঘিয়ে রঙয়ের শাড়িতে মথুরার বাজারের অদ্ভুত আলো পড়েছে। দুধের দোকানে বড় বড় কড়াইয়ে দুধ জ্বাল হচ্ছিল।
বললাম,- তুমি কিছু খাবে না?
তুমি তো খেলে, তাতেই হল যে।
আমার মা এমন বলেন।
সব মা তাই বলেন।
সন্ধ্যে গড়িয়ে যাচ্ছিল। চারদিকে সুন্দর বেলফুলের গন্ধ। জেঠিমা একটি বড় ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে, দুইটি ফুলের তোড়া কিনলেন। আর বেলফুলের গুচ্ছ। ফুলের দোকান বেলফুলের গন্ধে ভরে আছে। চারদিকের দোকানগুলিকে দেখে মনে হচ্ছিল, এত প্রাচীন, চাইলে হয় তো দোকানদার ফিরিয়ে দিতে পারবেন, সেই সময়, যখন মথুরা জুড়ে বিরাজ করতেন, শ্রীকৃষ্ণ। ঠিকই দুধ ও ফুলের শহর এই মথুরা। আর কয়েকদিন পরেই আমরা চলে যাব আগ্রা শহরে। ফেরার পথে জেঠিমা কাঁচের চুড়ির দোকান থেকে প্রায় চার ডজন কিনলেন। নানা রঙয়ের চুড়ি, রঙয়ের বিন্যাস দেখে পছন্দ করে। নিজে দুইহাতে চুড়ি পড়ে আমাকে বললেন,- কেমন লাগছে দেখতে?
খুব ভালো। যখন কলকাতায় যাই, অনেক অনেক চুড়ি নিয়ে যাই।
তুমি কলকাতায় যাও?
সে কি যাবনা? কলকাতাতেই তো আমার জন্ম।
কলকাতার নাম করতেই জেঠিমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠার পরেই আউটরাম ঘাটের হুগলী নদীর সান্ধ্য পার এঁকে দিল। কলকাতার কত কথা বলতে বলতেই ফিরে যাওয়ার রাস্তা ধরলাম। ফিরতে ফিরতে বললেন,- খুব কি দেরি হল?
আমার তো ভালোই লাগছিল, কি করে বলি, – হ্যাঁ দেরি হয়ে গেল?
গাড়িতে বসে, জেঠিমা আবার আমার হাত নিজের কোলে টেনে নিয়ে আঙ্গুলগুলিকে আদর করতে থাকলেন। গাড়ির ভিতরে জেঠিমার শাড়ি ও শরীর থেকে সেই গন্ধ আর বেলফুলের গন্ধ মিলে মিশে গিয়ে এক নতুন গন্ধের সৃষ্টি করল। কে জানে আমি জানিনা, হয় তো সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে গন্ধ অনুভূতি ও চেতনা আর সবার মতোই আমারও প্রখর।
আমার এখন এই প্রবীণ বয়সে খুব বলতে ইচ্ছে করে, – জানো জেঠিমা, বর্ষাকালের পরে মাঠে কাদা শুকিয়ে ওঠার শেষে সুন্দর গন্ধে পোকামাকড় ও হাজার হাজার প্রজাপতি ডানা মেলে দেয়। আর পানাগড়ে পেয়েছিলাম বাতাসে কাশফুলের গন্ধ একপ্রকার গন্ধ। সেই গন্ধ যেন ঘরছাড়া শরীরের। কিন্তু তোমার গাড়ির ভিতরে আজ যে গন্ধ, আমার ভিতরে যে চেতনার জন্ম দিয়েছিল, তার বিবরণ একমাত্র চুপ করে থাকাই খাসা উত্তর। এই গন্ধের কোনো ব্যাখ্যা হয়না।
জেঠিমার গলা খুব মিহি, আমি শুনেছি কখনও কখনও তিনি তাঁর কণ্ঠে খুব সুন্দর গান গাইতেন। সেই কণ্ঠেই তিনি বলে উঠলেন,- জানো, একা একা থাকি তো, কখনও কখনও মনে হয়, বাড়ির পাথরগুলি আমাকে গিলে নেবে। কিছুদিন পরে পরে অনেকেই আসে, আবার ভোররাত্রে সবাই চলে যায়, টেবিলের ওপরে ডালমুঠ পেঠা প্যাড়া চায়ের কাপ ছড়িয়ে থাকে। আমি সরিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার করিনা। প্লেট চায়ের কাপ, জলের গ্লাস ছড়ানোই থাকে, ইচ্ছে মতোই সব পড়ে থাকে। দেখে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিই, কেউ তো এসেছিল। ফিরে এলাম যখন, তখন রাতের ময়ূর কুৎসিত ভাবে ডেকে ডেকে চারধারের নির্জনতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছিল।
জেঠিমা বললেন,- আমরা কোথায় গেছিলাম?
আমি বললাম,- আমাজনের জঙ্গলে।
জেঠিমা খুব হেসে বললেন,- দুষ্টু।

[চলবে…]

Facebook Comments

1 thought on “কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ Leave a comment

Leave a Reply