বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ ও সপ্তম অঙ্ক: আদর্শ সংসার, নারীর ভূমিকা এবং যুদ্ধ

এই নাটকচক্রমের নাটককার যদি সত্যিই ভাস হন বা অন্য কেউও হয়ে থাকেন, এ নাটক অবশ্যই অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতের পরেই লিখিত। বিশেষজ্ঞরা এখনো অশ্বঘোষের নাটককেই এখনও অবধি পাওয়া প্রথম সংস্কৃত নাটক বলে ধরে থাকেন। এ কথা বলার প্রয়োজন হল এই কারণে, যে বৌদ্ধধর্মের উদয়, এই প্রতিমানাটকম-এর আগে হয়েছে, সে কথা মাথায় রাখলে আমাদের নাটককারকে বুঝতে কিছুটা সুবিধে হবে।
ষষ্ঠ অঙ্ক শুরু হচ্ছে রাবণের সঙ্গে জটায়ুর যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে। যুদ্ধ, পরবর্তী কালে নাট্যশাস্ত্রের পন্থা অনুযায়ীও মঞ্চে দেখানো চলে না। ভাস, যদি ভরতের নাট্যশাস্ত্রের পূর্ববর্তী নাটককার হয়ে থাকেন (অন্যথায় নাট্যশাস্ত্র সর্বদা মেনে চলেন না বলে ধরতে হবে) তাহলে বলতে হবে তিনিও এই রীতি মেনে চলতেন। নেপথ্যে জটায়ুর বীরবিক্রমে যুদ্ধ, দশরথের ঋণ শোধার্থে এবং সীতা রক্ষার্থে, বিফল হল। রাবণ সীতাকে নিয়ে চললেন লঙ্কা। এই বিষ্কম্ভকটি সমাপ্ত হলে শুরু হচ্ছে অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের দৃশ্য। সেখানে সুমন্ত্র আসবেন, রাম সন্দর্শন করে। ভরত তো আগেই ফিরেছেন, তারপরে সুমন্ত্র আবার গিয়েছিলেন রামের সংবাদ জানতে। তিনি ফিরছেন ভরতের কাছে সীতাহরণের শোকাকূল সংবাদ নিয়ে। তারপরে নাটক কোনদিকে গড়াচ্ছে আমরা জানব নিশ্চয়ই। কিন্তু আগে একটু বোঝার চেষ্টা করি, সীতাহরণের পরে প্রচলিত রামায়ণে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ রয়েছে নাটককার কেন সে সবকে এড়িয়ে সম্পূর্ণ অন্য রাস্তা নিলেন।
প্রথমত, যুদ্ধ, মঞ্চাভিনয়ের জন্য একটি বৃহৎ ঘটনা। দুটি চরিত্রের অস্ত্রের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি যাও বা দেখানো সম্ভব, তাতেও সরাসরি আঘাত ইত্যাদি দেখানো চলে না। নৃত্যকে ব্যবহার করে কিছুটা সম্ভব। বস্তুত লোকনৃত্যের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতির আদিম সম্পর্ক আছে। তা সত্ত্বেও কেন যুদ্ধাভিনয় মহাকাব্যের ক্ষেত্রে করা যাচ্ছে না? যুদ্ধ, আসল হতে হওয়ার তো কোনো প্রয়োজন নেই। মঞ্চে ঘটনাসমূহ, অভিনয় কিছুই যে আসল নয় তা দর্শকেরা যথেষ্ট জানেন। তাহলে? এখানে আমরা অরবিন্দের লেখা থেকে কিছু অংশকে কাজে লাগাতে পারি একটি পক্ষের ভাবনাকে বুঝতে।
“Certainly poetry was regarded as a force for elevation as well as for charm, but as it reaches these objects through aesthetic beauty, aesthetic gratification must be the whole basis of dramatic composition, all other super-structural objects are secondary. The Hindu mind therefore shrank not only from violence, horror and physical tragedy, the Elizabethan stock-in-trade, but even from the tragic in moral problems which attracted the Greek mind; still less could it have consented to occupy itself with the problems of disease, neurosis and spiritual medicology generally which are the staple of modern drama and fiction. An atmosphere of romantic beauty, a high urbanity and a gracious equipoise of the feelings, a perpetual confidence in the sunshine and the flowers are the essential spirit of a Hindu play; pity and terror are used to awaken the feelings, but not to lacerate them, and the drama must close on the note of joy and peace; the clouds are only admitted to make more beautiful the glad sunlight from which all came and into which all must melt away. It is in an art like this that the soul finds the repose, the opportunity for being confirmed in gentleness and in kindly culture, the unmixed intellectual and aesthetic pleasure in quest of which it turned away from the crudeness and incoherence of life to the magic regions of Art.”
-THE HARMONY OF VIRTUE/Hindu Drama
যে অরবিন্দ একদা বিপ্লববাদী ছিলেন, তিনি পরবর্তী কালে লিখছেন এই কথাগুলি। হিংসা এবং তার ব্যবহার সম্বন্ধে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কারণেই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। এভাবে এলিজাবেথিয়ান থিয়েটার অথবা গ্রীক নাট্য থেকে সংস্কৃত নাটকের দূরত্ব তিনি চিহ্নিত করছেন।
কিন্তু এ নন্দনতত্ত্বের সমস্যা হচ্ছে একটি গুরুতর বিষয়কে এ অস্বীকার করছে। হিংসা শুধুমাত্র যুদ্ধ বা মৃত্যুর দৃশ্যে থাকে না। হিংসা মূলত আশ্রয় করে ভাবনাকে। নাট্যমঞ্চে হিংসা সরাসরি রক্তপাত ইত্যাদির মাধ্যমে দর্শিত না হলেও ভাবনার হিংসার গুরুত্ব কমে যাবে? সুধাকরের মার খাওয়া থেকে শুরু করে কাঞ্চনপার্শ্ব মৃগের পশ্চাদ্ধাবন হিংসা নয়? লক্ষ্মণের নিজ পরিবারকেই রামের বনবাসের প্রতিশোধে ধ্বংস করে দেওয়ার আষ্ফালনের কথা হিংসা নয়? শূর্পণখার সীতাকে আক্রমণ, তাঁর অঙ্গচ্ছেদ, খর-দূষণের মৃত্যু ইত্যাদি দেখানো না হলেও উল্লিখিত তো! হিংসার ভাবনা নয়? এ সবের জন্য রাবণের সীতাহরণ হিংসা নয়? মঞ্চে যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি যদি দর্শকদের মধ্যে হিংস্রতার উদ্রেক করে বলে মনে হয়, তাহলে এ সব ভাবনা তার বিরোধ করে কি আদৌ? করে না।
হিংসা, পশুপ্রবৃত্তির মধ্যে অন্যতম বলে আমরা মনে করি। খাদ্যচক্র সে কথা বলে। কিন্তু পশুর হিংসা খাদ্যের পরিসরের বাইরে কতটা? মানুষের হিংসক প্রবৃত্তি জ্ঞানত, শুধুমাত্র খাদ্যের জন্য নয়। প্রভাব থেকে সম্পদ নানা কারণে সে হিংসা করে, যা তথাকথিত ভাবে প্রাকৃতিক নয়। প্রকৃতির অকথিত নিয়মকে ছাড়িয়ে গিয়েই সে হিংসা করে। সেখানে মঞ্চের ক্ষেত্রে যুদ্ধ ও মৃত্যুদৃশ্য নিষিদ্ধ হলেই কি তা থেমে যায়? ইতিহাস, এতদিন অবধি অন্তত সে কথাকে সমর্থন করেনি। বরং হিংসা কেন সে কারণগুলিকে পরিষ্ফুট করতে থাকলে মানুষের বোধগম্যতার সীমার মধ্যে পড়লে পড়তেও পারে তার পরিবর্তনের জন্য কী করণীয় তার কথা।
এই প্রসঙ্গেই আমরা একটি প্রাচীন গ্রীক নাটকের কথা বলব। ‘লিসিত্রেতা’ একটি প্রাচীন গ্রীক কমেডি। এরিস্তোফানিসের লেখা। নাটকটি গ্রীক নগর-রাষ্ট্রগুলির যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা। প্রথম অভিনীত হয়েছিল কমন এরার ৪১১ বছর আগে। আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনাই করব এখানে। লিসিত্রেতা, এক নারী, যুদ্ধে বিধ্বস্ত নগর রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আথেন্স-এর বাসিন্দা। তিনি প্রথমে তাঁর বন্ধু ক্যালোনিয়াকে সঙ্গী করেন এই যুদ্ধ থামানোর জন্য। তাঁদের মতে পুরুষেরা অর্থহীন যুদ্ধ করেই চলে আর করেই চলে। তিনি, ক্যালোনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলির নারীদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন। যুদ্ধের মধ্যে কেমন করে এ সভা তিনি ডাকলেন তা নিয়ে নাটকে কোনো কথা না থাকলেও সভাটি অনুষ্ঠিত হল তা আমরা জানতে পারি।
সভাতে তাঁর বক্তব্য কি? তিনি সভাস্থ সকল নারীকে রাজী করান পুরুষকে যৌনতার সাহচর্য্য না দেওয়ার জন্য। নারীরা সকলেই যে খুব ইচ্ছুক ছিলেন এমন না। তবু তাঁরা রাজী হলেন এবং শপথ নিলেন। তার মধ্যেই প্রবল চিৎকার শোনা গেল। জানা যাবে যে লিসিত্রেতার প্ররোচনাতেই বৃদ্ধা এবং প্রৌঢ়া নারীরা নগরের এক্রোপলিসের দখল নিয়েছেন। এক্রোপলিসেই যেহেতু আথেন্সের ধনাগার, তাই পুরুষেরা এবারে সেখান থেকে যুদ্ধের জন্য ইচ্ছেমত সম্পদ নিতে পারবে না।
এ নাটকের আলোচনা আমরা আপাতত এখানেই থামাব। কারণ আমাদের আলোচনার জন্য দুটি অদ্ভূত গুরুত্বের বিষয় এই কমেডির থেকে পেয়েছি। পুরুষের সম্পদ দখলের যুদ্ধের পাল্টা হল তাদের যৌনতার পূর্তিকে স্তব্ধ করে দেওয়া এবং তাদের হাত থেকে সম্পদের অধিকার কেড়ে নেওয়া। কিছুটা সরলীকরণ আছে অবশ্যই এ মতামতে। কিন্তু সত্যও আছে। দশরথকে প্রচলিত রামায়ণে কামার্তই বলা হচ্ছে। সে কারণে কৈকেয়ীর বশ। কৈকেয়ীকে যুবতী সম্বোধন আছে নাটকে। বিরাধ রাক্ষস সীতা হরণের প্রথম ভাগটা করে ফেলেছিল। তখন সেও কামের বশবর্তী। পরবর্তীতে বালী, সুগ্রীবকে শুধু বিতাড়িত করলেন না, স্ত্রী কেড়ে নিলেন। সুগ্রীব, রামের বদান্যতায় রাজ্য পেলেন, স্ত্রী পেলেন, সঙ্গে বালীর স্ত্রী তারাকেও নিলেন। শূর্পণখা এবং অয়োমুখীও পাল্টা কামের বশবর্তী। রামায়ণ এখানে ‘লিসিত্রেতা’-র কিছুটা উল্টোদিকে চলেছে। কিন্তু কৈকেয়ীকেও কামের বশবর্তী দেখায়নি। অর্থাৎ কামের বশ হওয়া শুধু রাক্ষসাদি তথাকথিত অনার্যদের বিষয়।বারংবার রাক্ষসদের উল্লেখ এলেই প্রচলিত রামায়ণ কামরূপী রাক্ষস বলে চলেছে। আর রাবণ তো শূর্পণখার অঙ্গচ্ছেদ, খর-দূষণের মৃত্যুকে সামনে রেখে সীতাকেই হরণ করলেন। অর্থাৎ গোটা মহাকাব্য জুড়ে হিংসার অন্যতম প্ররোচনা হিসেবেই কাম এবং যৌনতা ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরুষের যৌন চাহিদার বেশী উল্লেখ থাকছে।
পাশাপাশিই সম্পদের কথায় আসা যাক। কামের বশবর্তী দশরথ রাজ্য-সম্পদ থেকে রামকে বঞ্চিত করলেন। বালী-সুগ্রীব দ্বন্দ্বও তা নিয়ে। রাবণ, কামের বশবর্তী বলে বিভীষণ বিরোধ করলেন। বিভীষণ নির্বাসিত হলেন তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ এবং স্ত্রী-র থেকেও। অন্যান্য অনেক কিছু বাদ রাখলেও দেখা যাচ্ছে মহাকাব্যেও কাম এবং সম্পদ গুরুতর ভূমিকা পালন করছে। একে অপরের সংযোগে হিংসার ভয়াবহ ফলাফল তৈরী করছে। আমাদের নাটককার সরাসরি ‘লিসিত্রেতা’-র মত চরমপন্থায় না গিয়েও কিন্তু কাম এবং হিংসার মোকাবিলা করছেন। আগে আমরা দেখে নিই কোন পদ্ধতিতে মোকাবিলা করছেন, তারপরে পদ্ধতিগতভাবে এমন রাস্তা নিলেন কেন তা নিয়েও কিছু আলোচনা করা যাবে। সঙ্গে দেখা যাবে প্রাচীন কালে অন্যত্র এই হিংসার মোকাবিলার আর কোনো রাস্তা ছিল কী না!
ফিরে আসি ষষ্ঠ অঙ্কে। ভরতের কাছে সুমন্ত্র পৌঁছোনোর পরে ভরত সীতাহরণের কথা জেনে চললেন কৈকেয়ীর কাছে। কৈকেয়ী ভরত আসছেন শুনে বুঝলেন, ভরত তাঁকে নিন্দা করতেই আসছেন। তাঁর আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হল। ভরত এসেই সীতাহরণের জন্য তাঁকে দায়ী করলেন। তখন কৈকেয়ী ধীরে ধীরে সুমন্ত্রের সহায়তায় জানালেন দশরথের অন্ধ মুনির পুত্রবধ করে অভিশপ্ত হওয়ার কথা। শব্দভেদী বাণে বন্যগজ ভেবে দশরথ মুনিপুত্রকে হত্যা করেছিলেন। মুনি অভিশাপ দিয়েছিলেন, দশরথকেও পুত্রশোকে বিপন্ন হতে হবে।
এই অভিশাপ অবধি নাটককার প্রচলিত রামায়ণের পাঠকে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু তারপর থেকেই স্বতন্ত্র কাহিনীর অবতারণা করলেন। কৈকেয়ী ভরতকে জানালেন এ জন্যই তিনি উপলক্ষ হয়ে রামের প্রবাসে যাবার ব্যবস্থা করেছেন। শব্দটা কিন্তু বনবাস নয়, প্রবাস। নাটককার এটিই ব্যবহার করছেন। ভরত স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইছেন তাঁকে কেন প্রবাসে পাঠানো হল না। কৈকেয়ী জানাচ্ছেন মাতুলালয়ে ভরত স্বাভাবিক প্রবাসে ছিলেন বলে পাঠানো যায়নি। এরপরে ভরত জানতে চাইলেন তাহলে চোদ্দ বছর বনবাস কেন? কৈকেয়ী বলছেন চোদ্দ বছরটা তিনি মনের উত্তেজনায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। বলার কথা ছিল চোদ্দ দিন। এরপরে সাক্ষ্য চাইলেন ভরত। কৈকেয়ী জানালেন বশিষ্ঠ, বামদেব প্রমুখ মহর্ষিরা এ কথা জানেন। তাঁরা সাক্ষী এর।
বাল্মীকির রামায়ণ বলে প্রচলিত রামায়ণের থেকে এ কাহিনী বহু দূরের। নাটককার এই কাহিনী নির্মাণ করে কৈকেয়ীকে দোষমুক্তই শুধু করলেন না, মহানতায় প্রতিষ্ঠা করলেন। সংসারের বিপদের দায় নিজ স্কন্ধে নিয়ে ধিক্কৃত হবার জন্য। ভরত, মাতার কাছে ক্ষমা চেয়ে রামের সাহায্যার্থে রাবণের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবেন বলে স্থির করলেন। এমন সময় সংবাদ এলো কৌশল্যা এই সংবাদ শুনে মূর্চ্ছিতা। ভরত, কৈকেয়ী তাঁর শুশ্রূষায় চলে গেলেন। এখানেই ষষ্ঠ অঙ্ক সমাপ্ত হচ্ছে।
নাটককার কেন সৃষ্টি করলেন নতুন কাহিনী সে প্রসঙ্গে পরে আসব। আগে দেখি কাহিনী কতটা মজবুত। কৈকেয়ী যদি দশরথের জ্ঞাতসারেই মুনিবাক্য সত্য করতে এ কাজ করে থাকেন তাহলে দশরথ কৈকেয়ীকে দূষছেন কেন নাটকে? বশিষ্ঠাদি ঋষিরা যদি জেনেই থাকতেন তাহলে কৈকেয়ীকে অপমানের মধ্যে দিয়ে যেতে দিলেন কেন? এ কথা রামকে বলতে বা বাকীদের বলতেই বা কি সমস্যা ছিল? সকলের আলোচনাক্রমেই তো করা যেত এই কাজ। তাতে কৈকেয়ীর এত উত্তেজনার প্রয়োজন হত না, চোদ্দ দিন চোদ্দ বছর হত না। এ কাজ কৈকেয়ীকে গোপনে করতে হবে এমন কোনো শাপ ইত্যাদি তো নেই। তাছাড়া মুনিবাক্য সত্য করার জন্য যদি কৈকেয়ীর সাহায্যের প্রয়োজনই হয় তাহলে মুনির অভিশাপের জোরই বা কী? গোটাটাই ভারী অহেতুক হয়ে বসে আছে।
তারপরে ভরত যখন জানছেন সব তখন প্রশ্নগুলো এত এলোমেলো কেন? ভরতকে সুমন্ত্রই বলছেন যখন দশরথের শাপের কথা, আগে বললেন না কেন? প্রবাসে পাঠানোই যদি বিষয় হয়, দশরথের যে কোনো পুত্রকেই তো পাঠানো যেত। ভরত-শত্রুঘ্ন মাতুললালয়েও ছিলেন, কিন্তু লক্ষ্মণও তো ছিলেন রামের সঙ্গেই। সর্বসম্মতিক্রমে লক্ষ্মণকে পাঠানো হল না কেন? লক্ষ্মণকে এ প্রস্তাব দিলে তিনি অস্বীকার করবেন এমন কোনো চিহ্ন কোথাও রাখেননি নাটককার। তাহলে যুক্তিটা ঠিক কী?
নাহ্‌, এ সব প্রশ্নের কোনো উত্তর এই নাটক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে আমরা কি কোনো সূত্রই পাব না এই পরিবর্তন বোঝার? সরাসরি পাব না এ কথা সত্যি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়কে পাশাপাশি রাখলে কিছুটা হলেও সম্ভব এই সব পরিবর্তনের কারণ অনুমান করা। প্রচলিত রামায়ণে দেখেছি বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সংলাপ বসানো হয়েছে একেবারে রামের মুখেই। রাম-জাবালি সংবাদের অংশ সেটি। এ সংলাপ সেখানে আসার কারণ আছে। দীর্ঘদিন ধরেই প্রাচীন ভারতে নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরোধ তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অহিংসা থেকে অন্যান্য মোড়কের মধ্যে ঢেকেও রাখা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ডি এন ঝা-র সাম্প্রতিক কাজের মধ্যে অন্যতম ‘Against the Grain: Notes on Identity, Intolerance and History’। এখানে তিনি ইতিহাস থেকে দেখাচ্ছেন বৈষ্ণব-শৈব-বৌদ্ধ-জৈন বিরোধের অজস্র উপাদান কেমন ভাবে ছড়িয়ে আছে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আর অহিংসার মেটা-ন্যারেটিভ যাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ধরা যাক অশোকের শাসনকালের কথা। অশোক বৌদ্ধ ধর্মকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে সহায়তা করেছেন এ আমাদের জানা। কিন্তু অশোকেরই এক পুত্র জলৌকার উল্লেখ আছে কাশ্মীরি ঐতিহাসিক কলহণের রাজতরঙ্গিনী-তে। সেখানে কলহণ বলছেন জলৌকা শৈব, অসংখ্য বৌদ্ধ মঠ তিনি ধ্বংস করেছেন। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ, বাহিনী নিয়ে সেকালের শকল বা আজকের শিয়ালকোট অবধিও বৌদ্ধ স্তুপাদি ধ্বংস করেছেন। ইনি, মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সেনাপতি, যিনি মৌর্য্য সম্রাট বৃহদ্রথ মৌর্য্যকে, সেনা-পরিদর্শনের সময় হত্যা করে সম্রাট হয়েছিলেন। দিব্যাবদান বলছে বৌদ্ধ স্তুপ ধ্বংসই শুধু নয়, বৌদ্ধ শ্রমণের মাথার দাম ধরেছিলেন পুষ্যমিত্র এক হাজার দিনার। যে কেউ শ্রমণ হত্যা করে তাঁর কাছে আনলেই এই পুরস্কার। আবার কেউ কেউ এই মতবাদের বিরোধ করেছেন, পুষ্যমিত্র এমন ছিলেন না বলে। তবু পুষ্যমিত্রর ক্ষেত্রে দিব্যাবদান ইত্যাদি বা হিউ-এন-সাঙ-এর কথা মিহিরকুলের ক্ষেত্রে। একেবারে উপেক্ষাও করা যায় না।
অবশ্য শুধু এই জাতীয় ধ্বংস বা হত্যাই নয়, আদর্শগত ঘৃণা ইত্যাদিও ছিল। পতঞ্জলির মহাভাষ্য শ্রমণ এবং ব্রাহ্মণদের সম্পর্ক বিষয় অহি-নকুলের সম্পর্কের কথা বলছে। বারোশো শতকের জৈন পণ্ডিত হেমচন্দ্র মনুস্মৃতিকে খারিজ করছেন প্রথাবদ্ধ হিংসাকে সমর্থন করার জন্য। বৌদ্ধরাও ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে খুব উদার কখনোই থাকতে পারে না। পারলে বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মমত সৃষ্টিই হত না। অশোকাবদান আমাদের জানাচ্ছে সম্রাট অশোক চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হওয়ার পরেও তাঁর রাজত্বে আজীবিক হত্যা সংঘটিত হয়েছে। বুদ্ধের ছবি নিয়ে পুণ্ড্রবর্ধনের আজীবিকদের কাণ্ডের প্রেক্ষিতে সম্রাট তাঁদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিপুল গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আবার বেণীমাধব বড়ুয়াদের মতন কেউ কেউ এই কাহিনীকে বানানো বলেই দেখাচ্ছেন। ওদিকে অশোক যে আজীবিকদের একদা গুহা উৎসর্গ করেছেন সে প্রমাণের কথা অনেকেই উল্লেখ করেন। পাথুরে প্রমাণ। আবার সেই প্রমাণেই দেখা যাচ্ছে (বিহারের বারাবার/বিশ্বামিত্র/ বিশ্বকর্মা গুহা) আজীবিক শব্দটার উপরে পরের দিকে ছেনি দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। এমন কোনো সময়, যা পঞ্চম শতকের আগে, ব্রাহ্মী লিপির অর্থ অপরিস্কার হয়ে যায়নি, তখন আক্রমণ হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নষ্ট হয়নি বলে এখনো পাঠ করা যায়। সে আক্রমণ নিশ্চয়ই বিরোধী সম্প্রদায়েরই কাজ। তাই হওয়া স্বাভাবিক। অন্যদিকে, রামায়ণের মতই মহাভারতের প্রচলিত পাঠেও বৌদ্ধ বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়।
এত কথা বলার কারণ হল নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বিরোধ যখন হয় তখন প্রত্যেক সম্প্রদায়ভূক্ত নির্দিষ্ট ধর্ম বা ধর্মাচারকে মহিমান্বিত করার টেক্সটগুলি তার প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। প্রতিমানাটকেও অবশ্যই এই বিরোধের প্রভাব পড়েছে। কৈকেয়ীকে দোষমুক্ত করার প্রয়োজন কেন হচ্ছে তা বিশ্লেষণের জন্য আমরা একটি জাতকের কথা ব্যবহার করতে পারি। সে জাতকের নাম হল দশরথ জাতক। শ্রীলঙ্কাতে পালি ভাষায় এই জাতকটির পুঁথি রক্ষিত ছিল। ধীরে ধীরে তার অনুবাদ হতে থাকে অন্যান্য ভাষাতে। প্রথম অনুবাদটিতে বেশ কিছু বিষয় বাদ গিয়েছিল বলে পালি পুঁথির যথাসম্ভব নিখুঁত অনুবাদ হয় ১৮৭১-এ।
দশরথ জাতকের ইংরেজি অনুবাদ কোপেনহাগেন এবং লন্ডনে যখন প্রকাশিত হয় তখন উপশিরোনামে লেখা ছিল ‘Being the Buddhist story of King Rama’। জাতকের কাহিনীর মধ্যে এ কাহিনী বুদ্ধ বলছেন। তিনি থাকেন জেতবনে তখন। এক গৃহস্থকে পিতৃবিয়োগের জন্য শোকগ্রস্ত দেখে বুদ্ধ তাঁর কাছে গেলেন অবশেষে। তাঁকে বললেন প্রাচীন ঋষিরা অষ্টাঙ্গিক জানতেন। তাঁদের কারো পিতার মৃত্যু হলে তাঁরা বিন্দুমাত্র শোক করতেন না। এই বলে তিনি শুরু করলেন দশরথ এবং রামের কাহিনী বলা।
দশরথ বারানসীর রাজা। পালি টেক্সট বলছে দশরথ একদা পরোয়াহীন জীবন কাটিয়েছেন। তারপরে সুশাসন শুরু করেছেন। ষোলো হাজার নারী-র মুখ্য অধিকারিণী যিনি, তাঁর সেই রাণী তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। প্রথম সন্তান ঋষি রাম অথবা রাম পন্ডিত। পরের সন্তান রাজকুমার লক্ষ্মণ। তার পরের সন্তান রাজকুমারী সীতা। তারপরে তাঁর রাণীর মৃত্যু হয়। কিছুকাল রাজা শোকগ্রস্ত হয়ে থাকেন। কালে কালে মন্ত্রীদের পরামর্শে বিগত রাণীর জন্য ক্রিয়াকর্ম করেন। অবশেষে নতুন একজনকে রাণী করে আনেন। সেই রাণীর গর্ভে জন্মান ভরত। ভরতের জন্মকালে, দশরথ রাণীকে বর দিতে ইচ্ছুক হলে রাণী সেই বর পরে নেবেন বলেন। ভরতের বয়স যখন সাত বা আট বছর, তখন ভরতকে রাজা করার জন্য সেই বর চাইলেন সেই রাণী।
দেখা যাচ্ছে কাহিনীর শুরু থেকেই রামায়ণের সঙ্গে প্রবল দূরত্ব আছে। রাম এখানে শুরুতেই ঋষি বা পন্ডিত। লক্ষ্মণ রাজকুমার। এবং সীতা, জনকের কন্যা নয়, তাঁদের ভগিনী। ভরতের জন্ম আছে, শত্রুঘ্ন নেই। জন্মের আনন্দে বরের কথা আছে, মুনিপুত্র হত্যা অথবা যুদ্ধে আহত দশরথের প্রাণ বাঁচানো – এ সবের প্রসঙ্গই নেই। পরের অংশ যথারীতি অনেক বদলে গিয়েছে। অনেকবার দশরথ রাণীকে বিমুখ করেন, তারপরে একসময় নিজেই সন্দিগ্ধ হলেন।
নারীর চরিত্র, টেক্সট বলছে, যেমন সবাই জানে অকৃতজ্ঞ ও বিশ্বাসঘাতিনীর। অতএব তাঁর প্রথম পক্ষের পুত্রগণ, যাঁরা অগ্নিসম তেজে জ্বলন্ত, তাঁদের ক্ষতি করতে পারেন রাণী। রাজার নামে মিথ্যে চিঠি লিখে অথবা কাউকে উৎকোচ দিয়ে তাঁদের হত্যা করতে পারেন। এ সব ভেবে দশরথ তাঁর পুত্রদের ডেকে বললেন রাজ্যান্তরে অথবা বনে যেতে। তিনি চিতায় উঠলে যেন তাঁরা ফিরে এসে রাজ্যভার নেন, তাও বললেন। তারপরে আবার জ্যোতিষীদের ডেকে নিজ আয়ু জানতে চাইলেন। তাঁরা গণনা করে বললেন আর বারো বছর আছে তাঁর আয়ু। রাজা, সন্তানদের বললেন, বারো বছর অতিক্রান্ত হলেই যেন তাঁরা ফেরেন। দুই ভাই বনে যাবেন জেনে রাজকুমারী সীতা-ও তাঁর ভায়েদের সঙ্গে বনে যাওয়াই মনস্থ করলেন। এঁরা তিনজন চললেন বনে।
রামায়ণের সঙ্গে তুলনা করলে দেখাই যাচ্ছে বর এবং বনবাস দুই-ই পৃথক। রাম-সীতা-লক্ষ্মণ এই চরিত্রগুলি আছে, বাকী সবেই অমিল। সীতা ভগিনী হওয়াতে সম্পর্কগুলিও গিয়েছে পাল্টে। তার সঙ্গেও দেখার আছে কয়েকটি বিষয়। নারীর সম্পর্কে ধারণা জাতকের এই কাহিনীতে যথেষ্ট পুরুষতান্ত্রিক। অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসঘাত ইত্যাদির নারী-পুরুষ বা অন্য লিঙ্গ হয় না। যে কোনো লিঙ্গেই এমন দোষ থাকতে পারে। জাতক, স্পষ্টতই, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতই নারীকে আক্রমণ করছে একদিকে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতই সীতাকে অনুগমনের ভূমিকা দিয়ে নারীর কর্তব্য রচনাও করছে। তার সঙ্গেই উল্লেখযোগ্য জ্যোতিষীর ভূমিকা। জাতক এই গণনাকে গুরুত্ব দিল কেন তা আমরা এবারে কিছুটা বুঝে নেব।
কাহিনীর পরের অংশে তিনজনের বনবাস চলছে। সীতা ও লক্ষ্মণ, রাম পন্ডিতকে বড় বলে পিতৃ-সমান হিসেবে দেখছেন। বনবাসের ফল-জল ইত্যাদির দায়িত্ব নিচ্ছেন নিজেরা। ফলাহারেই বনবাস কাটছে এঁদের। এখানে মৃগবধ ইত্যাদির বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। মাংসাশি এবং নিরামিশাষি প্রভেদ একেবারে স্পষ্ট। বৌদ্ধ মতানুসারীও। অন্যদিকে দশরথ শোকে-তাপে এঁদের বনবাসের নবম বছরে মৃত্যুবরণ করছেন। একদিকে, রামায়ণের রাম বনবাসে যাবার পরেই দশরথের মৃত্যুর সঙ্গে মিলছে না।
অন্যদিকে জ্যোতিষীদের গণনাও মিললো না। তাহলে তো জ্যোতিষের গুরুত্ব খর্বই হল! অথচ তক্ষশীলাতে একদা ভবিষ্যদবাণী বিষয়ক শিক্ষা অন্য অনেক শিক্ষার সঙ্গেই প্রচলিত ছিল। আবার বারাণসীরই এক বালকের কথা আমরা জানতে পারি বৌদ্ধ সূত্রগুলি থেকে যিনি একদা ভবিষ্যদবাণী বিষয়ক শিক্ষা লাভ করে পরে শিকারীর বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। তাহলে ভবিষ্যদবাণীর শিক্ষা যে আদপেই অক্ষম ভবিষ্যদবাণী করতে, তার পরোক্ষ প্রমাণ এই দশরথের আয়ু গণনা? সে জন্যই বারাণসীর ছাত্রটিও শেষে শিকার বৃত্তি নিল? এ প্রশ্নের উত্তর আশু আমাদের হাতে নেই। আমরা ফিরে আসি আমাদের প্রসঙ্গে।
দশরথের মৃত্যুর পরেই রাণী বললেন তাঁর সন্তান ভরতের নামে রাজছত্র তুলতে। মন্ত্রী-আমাত্যাদিরা রাজী হলেন না। তখন ভরত বললেন, বন থেকে নিয়ে আসবেন তাঁর দাদা রাম পন্ডিতকে। রাম শুনলেন দশরথের মৃত্যু সংবাদ। তিনি ভাবলেন লক্ষ্মণ এবং সীতার কথা। ধীরে ধীরে তাঁদের সংবাদ জানানো হল। তাঁরা শোকগ্রস্ত হলেন। ভরতও শোকগ্রস্ত। কিন্তু রাম শোকহীন।
কেন? জীবন নশ্বর। শোকের দ্বারা নিজের ক্ষতি ব্যতীত জগতে আর কিছুই হয় না। জ্ঞানীরা এ কথা জানেন। এই জাতীয় নানা দার্শনিক ভাবনা, যা বুদ্ধের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গত বলে মনে করেছেন জাতককার/কারেরা, তার বয়ান আছে কাহিনীতে। অতঃপর, ভরত রামকে রাজ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। রাম, পিতার বারো বছরের বনবাসের কথার সত্য রক্ষার জন্য ভরতকেই শাসন করতে বললেন বাকী তিনবছর সময়কাল। ভরতের সঙ্গে লক্ষ্মণ এবং সীতাকেও ফিরে যেতে আদেশ দিলেন। ভরত, রামের পাদুকা এখানে চাইছেন না। ভরত, নিজে রাজ্য শাসনে অসম্মত দেখে, রামই তাঁকে বলছেন তাঁর পাদুকা নিয়ে যেতে। পাদুকা রেখে শাসন চালাবেন ভরত। তিন বছর অতিক্রান্ত হলে রাম ফিরলেন বারাণসীতে। একটি উদ্যানে প্রবেশ করলেন। সেখানেই তাঁকে রাজত্বে বরণ করা হল। সীতা হলেন রাণী। তারপরে রাম রথচারী হয়ে প্রবেশ করলেন রাজপ্রাসাদ সুছন্দকে। তিনি ষোলোহাজার বছর রাজত্ব করলেন।
এ কাহিনীতে ভরত প্রথমেই রামকে রাজ্য দিতে এগিয়ে আসেননি। মন্ত্রী-আমাত্যগণের বিদ্রোহের পরে এগোলেন। রাম, পিতৃবাক্য পালনের জন্য আরো তিন বছর নিজে অপেক্ষা করলেও বাকীদের পাঠিয়ে দিলেন। পাদুকাও রামই দিলেন। প্রচলিত রামায়ণে ভরতের ভ্রাতৃভক্তি, পাদুকা রেখে শাসন সবই আছে – কিন্তু অন্য ভাবে। আর যা নেই, তা বিপুল এক বিষয়। বনবাসে সীতাহরণ থেকে লঙ্কা ধ্বংস এই সমগ্র পরিসরই নেই এই রামায়ণে। রাম-সীতার বিবাহের ক্ষেত্রে ভাইবোনের বিবাহের অনুষঙ্গও যুক্ত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, বৌদ্ধ পরিসরের এই কাহিনী, ভারতের এই ভূখণ্ডে কমই প্রচলিত এখন।
আমাদের আলোচনায় কাহিনীটিকে আনার কারণ রামায়ণের বহুপাঠ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়। সে তো আছেই। বরং, এই কাহিনীর মূল দ্বন্দ্বটিকে দেখার জন্য। এই যে দশরথের দ্বিতীয়া স্ত্রী, এঁর নাম পাচ্ছি না। কিন্তু এঁর আচরণ প্রচলিত রামায়ণে কৈকেয়ীর মতই। রামেদের বনবাস থেকে দশরথের মৃত্যু সবেতেই এঁর হাত স্পষ্ট। এই আচরণ, সমাজ জীবনে আদর্শ পরিবারের পক্ষে আদর্শ নয়। দশরথ জাতক, তৎকালের পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ আচরণ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই পরিবারের ত্রুটিগুলিকে স্পষ্ট করে রেখেছে। যাতে তার থেকে সংসার কেমন হওয়া উচিত নয় তার পাঠ নেওয়া যায়। যেমন প্রচলিত রামায়ণও। নাটককার অথচ কৈকেয়ীকেও দোষমুক্ত করতে চাইলেন। কেন?
জাতকের কাহিনীও এককালে, একজনের হাতে সৃষ্টি হয়নি। মহাকাব্যেও নানা হস্তের অবলেপন ঘটেছে। অর্থাৎ একটি বিস্তৃত সময়কাল ধরে এ সকলের বাড়বৃদ্ধি। তার মধ্যেই থেকেছে ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব। নাটককার যদি এই দ্বন্দ্বের মধ্যকার সময়কালে নাটকটি রচনা করে থাকেন, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর আখ্যানে দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়বে। কৈকেয়ীর দোষকে স্বীকার করে নিলে ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থায় সব পরিবার আদর্শ আচরণ করছে এমনটা প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু যদি কৈকেয়ীর দোষই না থাকে? যদি তিনি পরিবারকেই মুখ্য বলে বিবেচনা করে আত্মত্যাগ করেন? নিজের স্কন্ধে দায় নিয়েও পরিবার ও ব্রাহ্মণ্য পরিসরে ঋষির অভিশাপের মর্যাদা দুই-ই বজায় রাখেন? তাহলে চরিত্রটি মহান হয়ে ওঠে।
কৃষিভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থায় পরিবারের ভাঙনের মত সর্বনাশ খুবই কম থাকে। জমি-পশু ইত্যাদি সম্পদের বাঁটোয়ারা সকলকেই যে দুর্বল করে, সে সময়কালের ভাবনার আলোচনা আমরা আগে করেছি। প্রবল সম্ভাবনা, যে নাটককার নিজে এ কথা লক্ষ্য রেখেছেন। সঙ্গে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব দ্বন্দ্বের মধ্যে, তার উত্তাপ অনুভব করতে করতে, কৈকেয়ীকে দোষমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার প্রভাব শুধু তাঁর নাটকে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমরা পরবর্তী নাটককার, ভবভূতির আলোচনা প্রসঙ্গেও দেখব, কৈকেয়ীকে দোষমুক্ত করার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রচেষ্টাকেও। আদর্শ সংসারের ধারণা প্রতিষ্ঠা করাটা শুধু সেক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক যুদ্ধই থাকছে না, হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধর্মীয়-রাজনৈতিক লড়াইও। আবার, কৈকেয়ীকে মহিমান্বিত করে আমাদের নাটককার, আদর্শ সংসারে কাম ও হিংসার যে সম্পর্ক তাকেও অস্বীকার করার জায়গা তৈরী করলেন।
এই রাজনৈতিক লড়াই-এর অংশ হিসেবেই আমরা সপ্তম অঙ্ককে দেখব, যেখানে যুদ্ধ একেবারেই নেপথ্যে চলে গিয়েছে। হিংসার প্রত্যক্ষ চিহ্নই আর নেই। সপ্তম অঙ্ক শুরুই হচ্ছে রাবণের বিরুদ্ধে রামের যুদ্ধজয়ের সংবাদ দিয়ে। মুনিজনের তপোবনে রাম, সীতাকে নিয়ে বিমান থেকে অবতরণ করলেন। সঙ্গে রাক্ষসবিরুদ্ধস্বভাব বিভীষণ এবং তাঁর সঙ্গী রাক্ষসগণ। রাম এবং সীতাকে একত্রে আনছেন এক তাপসী। রাম-সীতা তখন তাঁদের সেই তপোবন এবং সংলগ্ন অঞ্চলে পূর্বজীবনের স্মৃতিচারণ করছেন। ক্রমে ক্রমে লক্ষ্মণ, ভরত এবং শত্রুঘ্ন আসবেন। কৈকেয়ী, দোষমুক্ত, রামের জয় ঘোষণা করছেন। সুমিত্রাও তাই। এখানে কৌশল্যা নেই। রামের অভিষেক সেখানেই সমাপন হচ্ছে। তারপরে কৈকেয়ী অযোধ্যাতে রামের এই অভ্যুদয় উৎসব দেখতে ইচ্ছুক হলে, সকলে বিমানে করে চললেন অযোধ্যা। এখানেই সপ্তম অঙ্ক সমাপ্ত। নিতান্তই পারিবারিক এবং শান্ত পটভূমি। আগের সকল দ্বন্দ্বের সমাপন হয়ে গেল। এ কাজ করতে গিয়ে নাটককার আবারও প্রচলিত রামায়ণ থেকে বহুদূরে সরে গেলেন। আমরা এই প্রসঙ্গে প্রচলিত রামায়ণের কথায় ঘুরে আসি খানিক।
লঙ্কার যুদ্ধ শেষ। পবনপুত্র হনুমান, যাঁকে বাল্মিকী রামায়ণ সহস্রবুদ্ধি বলে সম্বোধন করছেন, তিনি রামচন্দ্রকে বললেন শোকসন্তপ্তা জনকনন্দিনীর কথা। যাঁর জন্য এই সুদূর লঙ্কায় এসে যুদ্ধ এবং বিজয়, যিনি এই সকল কার্যের ফলস্বরূপ, তাঁকে দর্শন করার কথা মনে করালেন। ‘পূর্ব্বকাৎ প্রত্যয়াচ্চাহমুক্তো বিশ্বস্তয়া তয়া’, পূর্বপ্রতীতিবশত বিশ্বস্ত হৃদয়ে ব্যাকুল নয়নে যিনি কিছুক্ষণ আগেই হনুমানকে বলেছেন পতিকে তিনি দেখতে চাইছেন সত্বর। বাল্মিকীর রামায়ণ বলছে রামচন্দ্র এর পর অশ্রুপূর্ণলোচনে চিন্তা করতে লাগলেন।
যাঁর জন্য এই যুদ্ধ, যাঁর জন্য এত কাণ্ড, তাঁকে দেখতে এত কিসের চিন্তা? জানব সে কথাই। রাম চিন্তান্তে বিভীষণকে বললেন জনক দুহিতাকে দিব্যবস্ত্র এবং দিব্য অলঙ্কারে ভূষিত করে আনতে। চললেন বিভীষণ। সীতা বললেন পতিকে দেখতে আকুল তিনি। স্নান না করেই যেতে চাইলেন। বিভীষণ রামের আদেশ জানালেন। সীতা, স্নান সেরে পরিপাটি সেজে চললেন স্বামী সন্দর্শনে। শিবিকায় রাক্ষস-প্রহরি পরিবৃতা হয়ে চললেন।
বিভীষণ সংবাদ দিতে গেলেন রামচন্দ্রকে। তিনি মৌনভাব এবং চিন্তাপরায়ণ। সীতা আসছেন শুনে রাম শোক-হর্ষ এবং ক্রোধের বশীভূত হলেন। সীতাকে গ্রহণ করবেন না বর্জন তা নিয়ে বিতর্ক করতে করতেই বিভীষণকে আদেশ করলেন জানকীকে দ্রুত তাঁর সম্মুখে আসতে বলতে। বেত হাতে উষ্ণীষধারী কঞ্চুকিরা পুরুষদের চারিদিক থেকে সরিয়ে দিতে লাগল। ঋক্ষ, বানর, রাক্ষসেরা নানা দিকে পালাতে শুরু করল তাদের তাড়নে। মহাকোলাহল উপস্থিত হল। সেই দেখে রামচন্দ্র ক্রোধে বিভীষণকে দৃষ্টি দ্বারাই যেন দ্বগ্ধ করে দেবেন এমন চেয়ে বললেন ‘কিমর্থং মামনাদৃত্য ক্লিশ্যতেহং ত্বয়া জনঃ’ ইত্যাদি। ‘কি জন্য আমাকে অবজ্ঞা করে এঁদের ক্লেশ দিচ্ছ? এঁরা সকলেই আমার স্বজন, সুতরাং তাঁদের উদ্বেগ দূর কর। গৃহ, বস্ত্র, প্রাচীর অথবা এইভাবে লোকাপসরণ স্ত্রী লোকের আবরণ না। স্বামিকর্তৃক সম্মানিত হওয়াই তাঁদের আবরণ।’
এমন অনেক কথা আরো বলে সীতাকে শিবিকা ছেড়ে বানরদের সামনে দিয়ে হেঁটে আসতে বললেন। বিভীষণ, সীতার এই অনাদরে ব্যথিত হয়েও নিঃশব্দে আনতে চললেন সীতাকে। ব্যথিত লক্ষ্মণ, বানরবর সুগ্রীব এবং পরম ভক্ত হনুমানও। মহাকবি জানাচ্ছেন জানকী শিবিকা ছেড়ে নিজ দেহমধ্যেই লজ্জায় প্রবিষ্ট হতে হতে বিভীষণের পেছন পেছন হেঁটে এলেন। রাম তখনো বিভ্রান্ত, সীতাকে গ্রহণ-বর্জন নিয়ে। সীতা? এসে দাঁড়ালেন। ‘বিষ্ময়াচ্চ প্রহর্ষাচ্চ স্নেহার্চ্চ পতিদেবতা…’ ইত্যাদি। মহাকবির কথায় পতিদেবতা রামের শুভবদন বিষ্ময়, হর্ষ এবং স্নেহভরে দেখতে থাকলেন। আহা কী সুন্দর কৃষ্ণ মুখশ্রী। পূর্ণচন্দ্রতুল্য সে মুখ দেখে জানকীর মনোব্যথা দূর হল।
জানকীকে পাশে দেখে এবারে রাম বলতে শুরু করলেন তাঁর বীর্য এবং পৌরুষের কথা। শত্রুবিনাশের কথা। অপমান মুক্তির কথা। বললেন ক্রোধের পার এইভাবে প্রাপ্ত হয়েছেন। দৈবকৃত দোষে যা হয়েছিল, তা তিনি মানব হয়েও নিবারণ করেছেন। বললেন হনুমানের বীরত্বের কথা, সুগ্রীবের সসৈন্য মন্ত্রণা এবং শ্রমের কথা। বিভীষণের শ্রমের কথাও বললেন। ‘যৎ কর্ত্তব্যং মনুষ্যেণ ধর্ষণাং পরিমার্জ্জতা…’। ‘তোমার ধর্ষণা স্খালন করার জন্য মানুষের যা কর্তব্য, নিজের মান রক্ষার জন্য রাবণবধ করে তা আমি করেছি’। তারপর আবারও বলে চললেন অগস্ত্যের দুর্জ্জয় দক্ষিণদিক জয়ের ন্যায় তিনি রাবণকে জয় করেছেন।
কিন্তু সুহৃদদগণের সঙ্গে দারুণ রণপরিশ্রমে যে কর্তব্য করেছেন তা সীতার জন্য নয়। সীতা হরণের জন্য তাঁর অপবাদ-অপনয়ন এবং তাঁর বিখ্যাত বংশের মর্যাদা রক্ষার্থেই করেছেন।
‘প্রাপ্তচারিত্রসন্দেহা মম প্রতিমুখে স্থিতা।
দীপো নেত্রাতুরস্যেব প্রতিকূলাসি মে দৃঢ়ম্‌।।’
স্ত্রী-কে লোকলজ্জায় পরিত্যাগ করার কথা ভাবার আগে যে এতগুলো কথা বলছেন বাল্মিকীর রামায়ণ বলে কথিত প্রচলিত পাঠের রাম, তা কৃত্তিবাসী রামায়ণে নেই। রামচন্দ্রের এই যাবতীয় বীরত্ব ব্যাখ্যানে কোথাও নেই তাঁর প্রাপ্ত দৈব সহায়তার কথা। মন্দোদরীর থেকে রাবণের মৃত্যু নিমিত্ত অস্ত্রলাভ, যা কৃত্তিবাস নানা মত সংগ্রহ করে বাল্মিকী মত বলে ঘোষণা করেছেন, তাও বাল্মিকীর রাম বলেননি। বস্তুত বাল্মিকীর রামায়ণের বর্তমান পাঠে ঋষি অগস্ত্য দ্বারা ব্রহ্মাস্ত্র দানের কথা আছে। মন্দোদরীর কাছে বান রাখা ইত্যাদি নেই। হতে পারে কৃত্তিবাসের জানা বাল্মিকীর পাঠে এমন কোন কাহিনী ছিল। যেহেতু রামায়ণ প্রাথমিকভাবে শ্রুতি, পরে লেখা হয়েছে, তাই নানা পাঠ নানা কারণে হওয়াটা অস্বাভাবিক না। অথবা কবি কৃত্তিবাস, তাঁর স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে কাহিনীর পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। যাই হোক, রাবণ বধের আগে বাল্মিকী রামায়ণে সূর্য-স্তবে রামের যে শক্তিলাভের কথা আছে তাও উল্লেখ করেননি রামচন্দ্র। সবটাই যেন তাঁর পৌরুষ এবং বাকীদের বীর্যবল।
কৃত্তিবাসী শ্রীরাম পাঁচালি যা পরে কৃত্তিবাসী রামায়ণ বলে পরিচিত হবে সেখানে সীতার আগমনকালের এক কাব্যিক এবং মনোরম বর্ণনা আছে। আছে এসে রামকে প্রণাম এবং লক্ষ্মণকে বাৎসল্যভাব দেখানোর কথাও। এক প্রকার ভাবালুতাকে বাঙালির গৃহোপযোগী করতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি কৃত্তিবাস। কিন্তু এই সন্দেহ? এই তীক্ষ্ণ এবং তীব্র আক্রমণ? একে তিনিও পুরোপুরি আচ্ছাদন দিতে অক্ষম হয়েছিলেন।
“আমার না ছিল কেহ সীতা তব পাশ।
ব্যবহার তোমার না জানি দশমাস।।
সূর্য্যবংশে জন্ম, দশরথের নন্দন।
তোমা হেন নারীতে নাহিক প্রয়োজন।।
তোমারে লইতে পুনঃ শঙ্কা হয় মনে।
যথা তথা যাও তুমি থাক অন্য স্থানে।।
এই দেখ সুগ্রীব বানর-অধিপতি।
ইহার নিকটে থাক যদি লয় মতি।।
লঙ্কার ভূপতি এই বীর বিভীষণ।
ইহার নিকটে থাক যদি লয় মন।।
ভরত শত্রুঘ্ন মম দেশে দুই ভাই।
ইচ্ছা হয় থাক গিয়া তাহাদের ঠাঁই।।”
এই অংশে বাল্মিকীর কঠোরতা কমেছে কিঞ্চিত। বা যথাসম্ভব। বাল্মিকীর রাম বলছেন ‘দশদিকের যেদিকে ইচ্ছে যাও সীতা। যে স্ত্রী পরগৃহে বহুকাল বাস করেছে, সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ তাকে গ্রহণ করতে পারে না। রাবণ তোমাকে কুদৃষ্টিতে দেখেছে, কোলে নিয়েছে, অতএব নিজ কূল কলঙ্কিত করা যাবে না তোমাকে নিয়ে।’
লক্ষ্মণের কথা কৃত্তিবাস উচ্চারণ করেননি। সম্ভবত বুঝেছিলেন বাঙালির মন সন্তানসম দেবরের সঙ্গে যাবার কথা সইতে পারবে না। কিন্তু বাল্মিকীর রাম লক্ষ্মণকেও সংযুক্ত করেছেন ভরত, শত্রুঘ্নের সঙ্গে। এমন কী সুগ্রীব বা বিভীষণের ঘরেও যেতে পারেন তাঁদের বরণ করে। আপন ভাই, যাঁদের প্রতি তাঁর প্রীতি ভুবনখ্যাত তাঁদের ঘরে কেন বললেন যেতে রাম? কেনই বা তাঁর অন্ধ অনুগামী সুগ্রীব এবং বিভীষণের কথাই বা বললেন? এতে তাঁদের সম্মান বাড়ল? সীতা যথেচ্ছগামী হতে পারেন, এখানেই তো শেষ হতে পারত এ আদেশ। এবং লক্ষ্মণীয়, যে সবার কথা এলেও একবারের জন্যও হনুমানের কথা আসেনি। পুরুষতান্ত্রিকতাও অমন ভক্তির কাছে খাপ খুলতে পারে না।
এই সীতাকে বশ করার জন্য রাবণ মৃত রামের মুণ্ড দেখিয়েছেন মায়া বলে। এমন কী কুম্ভকর্ণ যুদ্ধে যাবার আগেও মন্ত্রণা হয়েছে রামের মৃতুসংবাদ এনে সীতাকে বিচলিত করে বশে নেওয়া হবে। বিভীষণ-পত্নী সরমা রাবণেরই আদেশে সদা-রক্ষা করেছেন তাঁকে। তিনিও তো এক মহৎ সাক্ষী! তাঁকে এই সভার কোথাও দেখা যায় না। অথবা এ সন্দেহ আসলে লঙ্কাপুরীতে কালপাতের নয়। রাবণ সীতাকে হরণ করে আনার পথে কী হয়েছিল তাই নিয়ে সন্দেহ!
যে লোকনিন্দার ভয়ে এত কিছু সেই লোকসমাজ তবে বীর, সদ্বংশজাত, সুপণ্ডিত বলে কথিতের বুদ্ধিও আচ্ছন্ন করতে পারে এই ভাবে? এবং আশ্চর্য, এর কিছু আগেই রাম রাবণের কাছে পাঠ নিয়েছেন রাজ শাসনের। রাবণ লোকনিন্দার ভয়ে সীতাকে ফিরিয়ে দেননি রামের কাছে। রাবণের থেকে রাজত্বের পাঠে, শাসনের প্রয়োজনে লোকসমাজের মতের উর্দ্ধে যাওয়ার কথাও কি তবে কোথাও ছিল না?
যে মহৎ বীর্যবান রাম, দেবভক্ত এবং সাধুচরিত্রের, যিনি পররাজ্য গ্রাস করেন না, রাবণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যাঁর শত্রুতা বোধের অবসান হয়, সেই রাম নিজ দুঃখলগ্না স্ত্রী’র সঙ্গে এ কি করলেন? কেমন করে করলেন? যে দেশে সাবিত্রীর মত স্ত্রী দাম্পত্যের রীতিকে প্রেমে যুগোত্তীর্ণ করে তুলতে পারে, সে দেশে পুরুষোত্তম তাঁর স্ত্রী-র জন্য সংসারের আংশিক মতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন না? আংশিক কথাটা ভেবেচিন্তেই বলা। রামের সহায়-সুহৃদ কেউ এমন কাণ্ডে দুঃখ না পেয়ে পারেননি। সীতার প্রতি তাঁদের সমর্থন প্রশ্নাতীত। তাহলে কোন সে নিন্দাকামীর দল যাদের সন্তুষ্ট করতে অগ্নিপরীক্ষায় যেতে হল সীতাকে?
এবং জানকী যখন অগ্নিসংবৃতা, তখন বাল্মিকীর মহাকাব্য জানাচ্ছে রামের নিন্দা করছেন ত্রিলোক-বাসিনী রমণীগণ। রমণীই বোঝে রমণীর দুঃখ সকলের আগে। তারপর রাজা বৈশ্রবণ, পিতৃগণ, যম, দেবরাজ, জলেশ্বর বরুণ, মহাদেব স্বয়ং এবং ব্রহ্মা এলেন অন্যান্য দেবগণ সমভিব্যহারে। রামকে তাঁর দেবত্ব স্মরণ করালেন। অগ্নি, আপন ক্রোড়ে জানকীকে নিয়ে চরিত্র সম্পর্কে নিঃসংশয় ঘোষণা করলেন। অতঃপর রাম জানালেন তিনি সব জানেন, শুধু তাঁকে যাতে লোক কামপরতন্ত্র এবং সাংসারিক ব্যবহারে অনভিজ্ঞ না বলে তাই এই অগ্নিপরীক্ষা হতে দিয়েছেন।
মহাকাব্যের অন্যতম লক্ষ্মণ ট্রাজেডি বা বিয়োগান্তক ধাঁচ। রামায়ণ কাহিনীকার সে রসের দিকে বস্তুত এইখান থেকে যেন দৃষ্টি দিলেন। মানবধর্ম পালন করতে মানব হিসেবে অক্ষম হতে থাকলেন লোকনায়ক রাম। প্রজানুরঞ্জক হতে গিয়ে দেবত্বের আড়াল ছাড়া নিজ সংসারেও তিনি প্রকৃত বিচার ঘটাতে পারলেন না।
বস্তুত মহাকবির কাহিনীতে আমাদের দেশের সবচাইতে ট্র্যাজিক আখ্যানই রচিত হয়েছে রাম-সীতার কাহিনীতে। এই যে আজও আমাদের নারীদের এত অত্যাচার অনাচার সইতে হয়, এ সেই সমাজের কাণ্ড যেখানে ত্রিলোকবাসিনী রমণীরা ছাড়া অন্য কেউ সরাসরি পুরুষের শাসনের ত্রুটির সমালোচনা করে না। যা সীতার ন্যায্যত প্রাপ্য তা পাওয়াতে দেবত্বের আড়াল দিয়ে নিন্দক এবং হীনবুদ্ধি পুরুষের সমর্থনে আদায় করাতে হয়। এবং বলাই বাহুল্য এমন আদায় টেকে না। এ দেশে তাই অহরহ সীতাদের পাতাল-গমন ঘটে।
আমাদের নাটককারও কি এভাবেই ভেবেছেন? সীতার অপমান, নারীর এই অমর্যাদা কি তাঁর মনেও বেজেছিল? তার সরাসরি উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু এ কথা আমরা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি, তিনি সীতার কোনো প্রকার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেননি। রামের চরিত্রে সঙ্কীর্ণতা লেপন করেননি পুরুষতন্ত্রকে সন্তুষ্ট করতেও। বরং রাম-সীতা মিলনে তিনি মনোহর স্মৃতি সংযুক্ত করে তাকে আবেগময় মিলন হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সমগ্র নাটকে তিনি যে আদর্শ পরিবার কল্পনা করতে চেয়েছেন তা তাঁর মত করে অবশেষে গড়ে তুলেছেন।
সে পরিবার ব্রাহ্মণ্য পরিসরে পুরুষতন্ত্রের ভাবনার ফসল হলেও, তার সকল নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। শূদ্রকে তার অমর্যাদা থেকে রক্ষা করতে না পারলেও, তারও যে বিরোধ ইচ্ছে আছে তা মুছে দেননি। রাক্ষস পরিসরের নারীর ক্ষেত্রে না হলেও, অন্তত ব্রাহ্মণ্য পরিসরে নারীকে, শুধুমাত্র অকৃতজ্ঞা- বিশ্বাসঘাতিনী রূপে উপস্থাপিত করতে তাঁরও আপত্তি ছিল।
সে কারণে কৈকেয়ীকে ত্রুটিসম্পন্ন পদ্ধতিতে হলেও দোষমুক্ত করেছেন। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়নি। অর্থাৎ প্রচলিত রামায়ণের পাঠকেই সর্বদা আদর্শ বলে ভাবেননি নাটককার। তাঁর এই স্বাধীনতার ভাবনাকেও আমাদের সমালোচনায় যথাযথ লক্ষ্য করা উচিত। তাহলে বুঝতে সুবিধে হয়, কোনো তন্ত্র বা বাদই একরৈখিক ভাবে সমাজে-ইতিহাসে প্রযুক্ত থাকে না। দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই তার রূপ-চিহ্ন-উপস্থাপনা-ভাবনা সব পাল্টাতে পাল্টাতে যেতে থাকে। সেই পাল্টানোর ক্রমে এরপরের অংশে আসবে ভবভূতির একটি নাটকের কথা।

Suddhasatya Title Card

Facebook Comments

Leave a Reply