গোলক-ডম : সিন্ধু সোম

শিকড়ে অরুচি…অথবা সময়ের পিঠে ছোট তিল…রাজস্থানের পরে…অনেক দিন সময় আসে নাই…আজকে হঠাৎ…বলি, কীহ্ রে! ডুমুরের ফুল…ঠোঁট কাটে, ধ্যার! ওটা ফুরিয়েছে, বরং কনকচূড় খৈ, তুলাইপাঞ্জি চালও তো বলতে পারো…কী আর…হাসি…এই পরশু তুলাইপাঞ্জির আতপ তুললাম, তাও আরামবাগ থেকে…সময়ের চোখ বড় দাগী…এ কথা সে কথা বাঁধে…হাঁটতে বেরাই…সন্ধের কাজু মেঘ বরফির আলগ জাফরি…ট্রের মাঝে পাহাড়ের বুনো বন…বর্ষা ধাক্কা দিয়ে এগায়ে দিলে দাঁতে নখ…তাই রাস্তা ধরে নাই…বর্ষাকে প্রথম দেখি এক রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যায়…নিচে রিহার্সাল, ওপরে কামড়…পাহাড়ি বুকের মাঝে বন গড়িয়ে নিচু আরো নিচু…প্রোপোজের চিঠি তার থুকে দেওয়া নখের কানাচে…দোলে…দোল খায়…এমন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার দায় পিরিচে চা ঢালে…জুড়ায় চোখের নাদানি…দু এক ফোঁটা মিষ্টি কান্নার সোঁদা…নেট নেট পর্দা পেরিয়ে যতটুকু ছায়া কাটে বাসায়…বাকি পানি যাবতীয় স্পেস গেঁজিয়ে নেশায় উঠে আরো…

“অ্যাই! দেখ দেখ!” সময়ের ডাকে পাশ ফিরি…বনতুলসীর ঝাড়ে টিমটিমে গন্ধ আর মাংসের চপ…লোকটা তার চারপাশে ঘুরছে না…শ্মশানের বিছানায় নদী…এ বোধায় ওদিক থেকে এল…বিজলি তার ভাগাভাগির মাঝে মুড়োহীন পায়রা ভেসে থাকে, তেল মাখে…লোকটার সেদিকেও নজর নাই…খালি গা…ফালি ফালি আঁটি মাখা দাড়ি থেকে চাপ চাপ বর্ষার গন্ধ…লোকটাকে ভালো লাগছে না…সেদিকে বেনজর…গুছানো সালোয়ার আর শার্টের মাঝে কেমন ল্যাল্লেড়ে…চোখ ছোট করি…লোকটা আমার দিকে ঠারে তাকিয়ে থাকে…বিজলির ঝাড় মাখা সন্ধের রাস্তা…ছিল…এখন খেঁকুড়ে…রাস্তার সন্ধে…সময়ের কনুইয়ে চাপ দেই, “দুধ আর কেরোসিনে তোর আবার অরুচি হতে পারে, ফার্মেন্টেশনটাকেও এত নিচে ঢালতে পারছি না! কী করি বল তো!” সময় মুখ ঝামটা দেয়, “নিজের কী আছে? চোখভরা অরুচি দিয়ে কার বাল এতদূর খাওয়া ঘাঁটা যায়! ওর অন্তত অরুচিটুকু সৎ!” বলতে বলতেই…নকল খাবার কিনে একজন লোকটাকে দেয়…চিনি…চেনা নয়…লোকটা ওদলা পেটের ওপর বাটি রাখে…রাস্তায় বসে…পায়রার ছায়া জুড়ে বাদুড়ের ঝাপটানি…শ্মশানবন্ধু হাওয়া ক্রিস্পি ও নোনা…সময়ের ঠোঁট চুপ…তুলতে পারে না…আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে বহুদিন এঁটোকাটা জমে গোছা গোছা অরুচি বেড়েছে…অথবা দেখনদারি…মন বাঁধা অন্য কোনো খানে…চপ ফেলে উঠে আসে সোজা…আমার মুখোমুখি…জাতে বুঝি ডোম টোম হবে…না-বারিশ বর্ষার গন্ধ মাহুত আমায় চালায় প্রায় সময়ের কোলে…মাংসের চপ ভেঙে কানে কানে সময়কে বলি, “এদিকে বেকার এলাম। তার থেকে বাজারের দিকে…” চোখ দেখে বাকি কথা মাংসের টুকরো করে ফেলি…এ পথে আসা যাওয়ার বিরামে বিরামে আম ঝরে, জামরঙা মেঝে…ইতস্তত ভেজা আঁটি ছড়ানো ছেটানো…কদমের রোঁয়া চুঁয়ে মালদার রস…এমন তালিম মায়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে এ বরখুরদারও কখন এড়িয়ে গেছে…খেয়াল করি নাই।

“ও বুড়া! মানিক! কী খাইস? এখন ট? খাঞে লিছিস হারামি? উদোড়ঘাম ধৈরবেক! ভেলকি খাইলে পাদ দিবি লাথাইড়ে…’এখন’ যারে বলিস, সেইটথো ভূইতা হারামি, হাওয়ার বাড়া না…থাক রে কুকুর মাড়ের আইশে…ফ্যান দিব সেই মৈসোর মাসে”…ওদলা বুকে জট…লোকটা তেলতেলে প্যান্ট‌ ঘষে…ছড়া কাটে…পাছা চুলকায়…তারপরে নজর ছোঁড়ে সিধা…অথচ সে নজরে রেশ ছাড়া ভার নাই কোনো…কখনও ছিল না…পাহাড়ের স্তন ভেঙে‌ মুচড়ায় ঝোরা…আশেপাশে ঘুরালের ডাক…চ্যাটালো পাথরে… কবেকার ফাকুন্দায় নিবে আসা জ্যোতি…চমক হারিয়ে তাতে ঘরানা ধরেছে…সে চোখ চোখের চেয়ে বড়…মলিন প্রবাসী…তাতে ইবন বতুতা যেন ক্রমেই ঝাঁঝালো…সে নজর ততদূরে…এই সেই এখানেই…এখানেই শুরু…মধ্যিখানে ত্যারছা কিছু নেহাৎ আসমান…মাটিও গড়িয়ে গেলে শেষ থেকে ফোটে…বলি, “কী বলিস কাকা! লদী তকখ যাইতে দে! লদী পারাইলে কেওট রাজা! আগুড়ি রাইস্তা আগুলছিস ক্যানে?” মাংস পেটাই আরাম করি মুখের ভিতর…লোকটা মিটিমিটি হাসে…সময় আমার কাঁধের কাছে নখ দেয়, “কী বলিস? অ্যাঁ? কী বলিস?” ঝালে নাক ভেজে…”একটু বেশি মরিচ দিসে, তাই বলতেসিলাম!” সময়ের চোখ বড় বড় করে, “এতক্ষণ ধরে! ও কি আমাকে পছন্দ করছে না?” “আরে বাবা, যাবি তো এখুনি চলে, একটু অন্য কথা বল বরং…চপের দোকানে লাভ প্রচুর…” শেষ হয় না, আবার হেঁড়ে গলা, “যার যখন চলে, মুইতে বাতি জ্বলে! লয় বুড়া? ও বুড়া তুইঁ বাস লে, এখন বৈলে কিছু লাই গো, বাস থাকে রং থাকে, এথো কথা তোর থাইকবেক? মাগের বাস নে, তাথে তুইঁও রাজা আমিও রাজা…গল্প কৈরবি, উদোড়ঘাম ধৈরবেক…হজম কৈরবি কৈটুকু! মানিক! বাস লিয়ে রঙ লিয়ে থাক…উপর উপর লাচিস না…চেঁইড়ে খাইলি, আর চেঁইড়ে হাগলি…মাঝটথে রৈল কী? খালি হাওয়া? না না, ‘এখন’-এর পাল্লায় পৈড়িছো কি মৈরিছো”…”ধুর বাঁড়া! তুই যাঞে ঐ জামতলার দিখে বৈস তো! জ্বালাইস না! এড়িচোমড়ি দিঞে লাইগিছে শালো, উঠ উঠ…বাস লেঁ, বাসে তো পু্রা ভাগাড় তুইলেই আইনছ…তুমার বাস আবার লিথে হবে ক্যানে! ডম কুথাকার!” লোকটা বিশ্বাস করে না প্রথমে, অবাক চোখে তাকায়…মুখে না…জামায়…জুতায়…তারপর ঢোঁক গিলে একটু দূরে গিয়ে তাকিয়ে থাকে ফের, মিনমিন করে বলে, “ডমে সব জানে, লয়! এখনের পর থেইকে সব কিছু ডম, লয়!” ধীরে ধীরে কথার সঙ্গে ওদলা সিল্যুয়েট জামতলার দিকে মিশে যায়…চপ ঠাণ্ডা…সময় উঠে যায়…অনেক দিন পর…সবটাই…নিজেকে থাবড়াবার সাহস জোটে না…দাঁতে দাঁত ঘষি…সার্কুলার বললে ভাবি দিল্লি দেখিয়াছি…মাল্টিন্যাশনাল…শিকড়ে প্রবৃত্তি নাই…ও সব বালের হজমি আমার লাগে না…আদতে কিছু কি বলি? চোরাগোপ্তা টান…বর্তমানের দু পেগ ফুলে রুটি রুটি ছাঁদ…মোলারের খাঁজে খাঁজে মাংস লেগে থাকে…লোকটার অদ্ভুত দেউড়ি খানা দেখি…একা লোক বোকা লোক…অথবা কেউটে…অমন কত শেয়ানা মাড়িয়ে দিয়ে এলাম…সময় অথবা লোক কোনোটাই ‘এখনে’ ছিল না…থুতু ফেলি…এড়িয়ে যাওয়া যেত…খানিকটা সেভাবেই ভেবে রেখেছিলাম…অথচ ওদলা গায়ে বাদুলে দাড়ি বুড়ো…গোল গোল নিজে ঘোরে না, তাকানো ছুঁড়ে মারে…এ সব ক্যালানে……আঁশ আঙুলে টেনে…চপ নাই, হাল্কা রসুন ছিল…মেহশুস করি…

লোকটা এগিয়ে গেছে…ফিরে আসি…ছিল ঠিক যনভাবে হবে হয়ে আসে…রাস্তার ওপর রাস্তা…হাগুন্তি খোদ দেখুন্তি হয়ে লাজে লাজে লাল…জলপাইগুড়ি মজে সাঁওতাল গ্রাম…এর ওর গা-ঢলানি স্তরগুলা নাচে…মাংসের ঢেকুর ওঠে…রসুনের বাস…থেকে গেছে…অথবা যাবেও হতে পারে…চাঁদের নখ…ড্রেনে জড়োসড়ো…শঙ্করাচার্যের ঘোড়া পাছে দেয় ঢেকে…জামতলা পেরোচ্ছি, হঠাৎ গা জাগানি…ধূসর মেঘের টিপে রাস্তা মুছে আসে…জামের মোটা লেই সেইখানে পেতে গেছে দিনের চোদ্দকুড়ি গাড়ি…শ্মশানের দিকে অথবা শ্মশান পেরিয়ে…ভাসতে থাকা গুঁড়া গুঁড়া চাদ জামে মাখিয়ে লোকটা লেই চেটে তোলে আর গেলে…উবু ডোম…শ্মশান ছেড়ে আজ এত দূরে…চপের দোকানটা ছিল…মিথ্যে মনে হয়…সময় সত্যিই? সন্ধে থেকে মাঝরাত কোথায় কাটালাম? মিহি চাঁদ বর্ষার কাজলে কেমন দুরন্ত নেভে…ড্রেনে কালো স্রোত…লোকটা আমায় ঠেকে এই টের পেল…চারিদিকে নরম পাক ঘোলা ঘোলা কাদা…লোকটার হাসিটুকু ছব ছব করে…”বুড়া, দেখ…কেমন রঙ ট ধৈরে লিছি দ্যাখ…” মিটিমিটি হাসি ঠেলে গাঢ় বেগুনি জিভ…লোক না জনানা এইবারে বড় ধাঁধা…

চপের দোকান ফেরে…মুখে চপ…সামনে সময়…বর্ষার সন্ধেয় বাসার থেকে দূরে…ডোম নাই…চুল্লির নাগাড়ে ধোঁয়া দেখি…কিছু চুলে রঙ পিচ্চি টায়ার নিয়ে খেলে…খালি টায়ার…
গোল….………
গোল………….…
গোল…………………
গোল…………….…………
আগুড়ি নাই পিছুড়ি নাই…এইখানে, এই ঠিক গোলের মাঝখান…কেমন জানি মনে লাগে যা খাচ্ছি তাও অতীত, যনভাবে খাচ্ছি তাও অতীত, কাল সকালে যা হাগব, যনভাবে হাগব তাও অতীত…আদতে শিকড়হীন অতীতের বিচে রসুনের বাস এবং জামের বেগুনিটুকু বাড়তি পড়ে থাকে…সেটুকুই মেহশুস…অস্তিত্ব…মওজুদ…ডম…

লয়?

Facebook Comments

Posted in: July 2021, PROSE

Tagged as: ,

Leave a Reply