মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী

শংকর লাহিড়ী[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]

১১

গভীর মহাকাশে অস্পষ্ট একটি নীলাভ বিন্দু :

সকালে ঘুম ভেঙে উঠে বিছানা থেকেই মনে হল বাইরে বুঝি এক শান্ত নম্র পৃথিবী, নানা উজ্জ্বল ফুলের সাজি হাতে আমারই অপেক্ষায় আছে সে। ঝড়ের গর্জন নেই, এক ফোঁটা বৃষ্টিও নেই, তার বদলে গাছে গাছে পাখি ডাকছে আজও। পোষা পায়রা, কাক, শালিখ, এক ঝাঁক ছাতারে, একলা একটা বসন্তবৌরি। শান্ত চরাচর। জানালা খুলতেই হাল্কা হিম হাওয়া, খুব মৃদু জলজ গন্ধ। তবে আকাশে মেঘ এখন দ্রুতগতিতে। কৃষ্ণ মেঘ, জলভরা, খুব নীচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, উত্তরপূর্ব দিক থেকে।

এখনও এই সকালে গ্রামবাংলা শান্ত, সুন্দর, অক্ষত। আশংকায় অধীর হয়ে আছে। অথচ আর মাত্র কয়েকঘন্টা পরে প্রবল আক্রোশে তাকে চুরমার করে দেবে একটা পাশবিক ঝড়! আর আমরা অসহায় দেখে যাব। গ্রামকে গ্রাম চিহ্নহীন। রেল লাইন উপড়ে ফেলেছে। কত লক্ষ মানুষের স্বপ্ন সংসার নিমেষে তছনছ। মহাপ্লাবন। মৃত পশুর শব চারিদিকে। রাজপথে উপড়ে পড়ে আছে বয়স্ক গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, হাইটেনশান টাওয়ার। এসবই মাত্র কয়েকঘন্টা পরে? বিশ্বাস হয় না। -ছি: । এই চরম অসভ্যতা, মানুষের সকল শ্রম, প্রেম, সংগীত, কবিতা ও চিত্রময়তার প্রতি এই বিপুল অন্যায়, ক্ষমাহীন।
ঊর্ধ্বাকাশে, মাইল মাইল বজ্রগর্ভ মেঘের ওপারে যে অম্লান অন্ধকার মহাকাশ, যেখানে অনন্ত নক্ষত্রগ্রন্থি, কোয়াসার, ব্ল্যাকহোল, সুপারনোভা– তার কাছে কত তুচ্ছ এই ছোট্ট পৃথিবীর এক ছোট্ট দেশের এক প্রান্তে এই একরত্তি ঝড়, আমি ভাবি।

বিশাল মহাকাশের কর্মশালায় দৃশ্যতঃ কত ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ আমরা, তা বোঝা গিয়েছিল একটি ছবি দেখে। বিজ্ঞানীরা দেখে শিহরিত হয়েছিলেন। সেই ছবিটা আমাদের পৃথিবীর। ১৯৯০ সালে ভয়েজার-১ উপগ্রহটি তখন সৌরমন্ডলের প্রায় শেষপ্রান্তে চলে গিয়েছে। যেতে যেতে সে ছবি তুলে পাঠিয়েছে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, ইউরেনাস, এবং নেপচুন গ্রহের। সুর্যের খুব কাছে বুধ হওয়ায়, তার দিকে তাকায়নি ভয়েজার, কারণ তার ক্যামেরা ঝলসে যাবে। আর সৌরমন্ডলের দূরতম প্লুটোর আকার অতি ছোট, বামন গ্রহদের মধ্যে সে একজন। গভীর মহাকাশের ছবিতে সেই প্রত্যন্ত হীম অনুজ্জ্বল প্লুটোকে নজর করে খুঁজে পাওয়াই দুঃসাধ্য, তাই তার ছবিও তোলার পরিকল্পনা ছিল না নাসার। ভয়েজারের ক্যামেরা তখন শাটডাউন করার মাত্র আধ ঘন্টা বাকি আছে, কারণ ছবি তোলার মতো আপাততঃ আর কিছু ছিল না। বিজ্ঞানীরা তখন ভাবলেন, ঘুমিয়ে পড়ার আগে একবার পৃথিবীর দিকে ভয়েজারের ক্যামেরাকে ঘুরিয়ে দেখা যাক, অত দূর থেকে কেমন দেখতে লাগে !

সেদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে গভীর মহাকাশ থেকে ভয়েজার-১ যখন পৃথিবীর এই ছবি তুলেছিল, তখন পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব ছিল প্রায় ৩৭৫ কোটি মাইল! (মনে রাখা যাক, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সাধারণতঃ ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল।) এত বিপুল দূরত্ব থেকে ছোট্ট ভয়েজারের ক্যামেরাকে কন্ট্রোল ক’রে, সেখান থেকে পৃথিবীকে শনাক্ত ক’রে, ছবি তুলে, সেই ছবিকে ৩৭৫ কোটি মাইল দূরের পৃথিবীতে বসে সংগ্রহ করা, সোজা কথা নয়। ছবির পুরো ফ্রেমে পৃথিবীর আকার ছিল মাত্র এক পিক্সেল! বিজ্ঞানীদের কাছে এ এক বিশাল ও সফল কর্মকান্ড। ১৯৯০-সালে তোলা এই আইকনিক ছবিটা আজ সারা বিশ্বে ‘Pale Blue Dot’ নামে পরিচিত।

মহাকাশে এই গোটা পৃথিবীর সবটাই একদিন সম্পূর্ণ মুছে গেলেও বিপুল ব্রহ্মান্ডের কি কিছুই এসে যাবে না ? কম পড়বে কি কোথাও ? ছবিটার দিকে তাকিয়ে নির্বাক বসে থাকি আমি। ওই নীল বিন্দুর মধ্যে একবিন্দু একটা রাজ্যে (পৃথিবীপৃষ্ঠের ০.০২% যার ক্ষেত্রফল) আজ প্রবল ঝড় আসবে, যা প্রত্যক্ষ করতে হবে আমাকে !

আর এই অবসরের বয়সে কিইবা করতে পারি আমি? শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকে, সেই আগুয়ান সাইক্লোনের গতিপথকে ট্র্যাক করে যাই স্ক্রিনে। ঘন্টায় দুবার। ঠিক যেভাবে আমি ট্র্যাক করে থাকি আমার পরিচিতদের সমস্ত ফ্লাইটগুলো। আত্মীয়-বন্ধু, বোন-ভাগ্নে, মেয়ে-জামাই, কাজিন– যে কেউ অফিসের কাজে যাচ্ছে বা, বেড়াতে যাচ্ছে ফ্লাইটে। ব্যাস, ফ্লাইট নাম্বার না জানলেও সময়টা জেনে নিয়ে আমি নিজেই ঠিক খুঁজে নিতে পারি তাকে।

বৃষ্টি বাদলার দিনে আরও উৎকন্ঠা। ব্যাঙ্গালুরু থেকে ফ্লাইট উড়ে কলকাতার কাছে এসেও দেখলাম পাইলট মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে সমুদ্র পেরিয়ে, মাতলার মোহনা পেরিয়ে, সুন্দরবনের পীরখালি বা দোবাঁকির জঙ্গলের গভীরে। ওইসব ভয়ংকর টেরান তো আমি দেখেছি। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকি। অনেক পরে দেখি, প্লেনের মুখ ঘুরেছে কলকাতার দিকে। ক্রমে ল্যান্ড করে, ট্যাক্সি করে, টারম্যাকে এসে এয়ারক্র্যাফট থামে। আমারও ছুটি হয়।

এরকম হয়েছিল মাস দুয়েক আগেও, আমার বোন যখন দিল্লী থেকে নিউইয়র্ক যাচ্ছে। আমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছি প্লেনটাকে। আটলান্টিকের ওপর দিয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, কানাডার ওপর দিয়ে প্লেনটা স্থলভূমিতে ঢুকছে দেখে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে উঠে দেখি, ফ্লাইটটা সেই রাতেই আবার বহুপথ ফিরে গেছিল সমুদ্রের গভীরে! সে কি কান্ড, কিছু বিপদে পড়েছে নাকি? এভাবে তো ফিয়ুল ফুরিয়ে যেতে পারে। পরে খবর পাই, ফ্লাইট অনেক দেরী করেছিল নিউইয়র্কে নামতে। ঠিক কী হয়েছিল কেউ বলতে পারেনি।

আর একবার আমার জামাই ফিরছে- -সে তো ফ্রিকুয়েন্ট ফ্লায়ার–সেদিন ফিরছে ইউরোপ থেকে। ওয়েদার রিপোর্ট মোটামুটি ভালোই। দেখলাম প্রায় চল্লিশ হাজার ফুট অল্টিচিউডে রয়েছে ফ্লাইট। একদম স্টেডি তার স্পীড গ্রাফ। তবু হঠাৎই আমার নজরে এলো, কিছু পরেই আসছে বরফে ঢাকা দুর্গম আল্পস পর্বতমালা। আমার ঘুম উড়ে গেল। বসে রইলাম, যতক্ষণ না ফ্লাইট সেই আল্পসের পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ। আর কখনও যদি গ্রাফে দেখা যায় হঠাৎই প্লেনটার অল্টিচিউড দ্রুত কমে আসছে, প্লেন নেমে আসছে নীচে, হয়তো কোনও এয়ার পকেট, তবে তো কথাই নেই। ঠায় বসে আছি সেই গ্রাফে চোখ রেখে। রিয়েল টাইম গ্রাফ, তিন মিনিট পর পর রিফ্রেশ হয়।

*
কত নির্ভুলভাবে এসব কথা এখন বলতে পারছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। এটা সম্ভব করেছে স্যাটেলাইট ও সুপার কম্পিউটার। নাসার বিজ্ঞানীরা এখন প্রতি তিনঘন্টা অন্তর আমাদের সামনে উপস্থিত করছেন সারা পৃথিবীর ঝড়জল, জলস্রোত ও বায়ু প্রবাহের একটা গোলাকার বাস্তবিক ‘আর্থ’ ম্যাপ। গ্লোবালী ইন্টিগ্রেটেড। সারা বিশ্ব জুড়ে কোথায় কোন স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, কোথায় ধীরে ধীরে জন্ম হচ্ছে এক একটা ভয়ংকর সাইক্লোনের, তার সবই এখন দেখে নেওয়া যাচ্ছে ঘরে বসেই। এই যে এত মহাকাশ গবেষণা, এর হাত ধরেই তো আবিস্কৃত হয়ে চলেছে কত নতুন ও কল্যাণকর প্রযুক্তি।

*
এতদিনে এলন মাস্ক পেলেন দ্বিতীয় সফলতা। এর আগে তাঁর স্পেস-এক্স কোম্পানির তৈরি ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেট মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হয়ে পুনরায় পৃথিবীতে নির্ধারিত জায়গায় এসে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিশ্বে সেই প্রথম। সেই সাফল্য ছিল এক দারুণ উত্তেজনাময় দৃশ্য, যার ভিডিও আমরা অনেকেই দেখেছিলাম ! -এবার সেই রকেটের সাথে যুক্ত হয়েছে তাঁদেরই নির্মিত ‘ক্রু ড্রাগন’ নামের মহাকাশ যান এবং এটিও পুনর্ব্যবহারযোগ্য। যাঁরা এতদিন Crew Dragon যানটির খবরাখবর রাখছিলেন, তাঁদের কাছে এটা আনন্দসংবাদ।

[নীচে ছবি : মহাকাশে ভাসমান স্পেসস্টেশনের সাথে মিলিত হচ্ছে ‘ক্রু ড্রাগন’ মহাকাশযান।]

দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পরে (৩০ মে, ২০২০) আমেরিকার কেনেডি স্পেস সেন্টারের ৩৯ নং উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে এলন মাস্কের বেসরকারি রকেটে চড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নাসার দুজন মহাকাশচারী ; মহাকাশে দীর্ঘদিন ধরে প্রদক্ষিণরত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (ISS) সাথে যুক্ত হতে। সেখানে মাস তিনেক থাকার পরে ক্রুড্রাগন যানে চড়ে তাঁরা ফিরে এসেছেন আমেরিকার মাটিতেই। নাসার বদান্যতায় আমরা টিভিতে লাইভ দেখেছিলাম সেই প্রত্যাবর্তন। এই প্রথম সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং বেসরকারি উদ্যোগে আমেরিকা পেয়েছে এই সাফল্য। এর পরে আরও ক্ষমতাশালী ‘ফ্যালকন হেভি’ রকেটের সাহায্যে এলন মাস্ক পরিকল্পনা করেছেন মঙ্গল অভিযানেরও।

নাসার ট্যুইটারে ক্রু ড্রাগনের এই সাফল্যের খবর নিয়ে হইচই, এবং তার সাথেই রয়েছে কিছু মজার কমেন্টস, যার থেকে এই করোনার দিনে ওদেশের মানুষের মন-মর্জির হদিশ মেলে। কয়েকটা কমেন্টস উল্লেখ করা যাক।

১. ‘আমিও এই পৃথিবীতে আর থাকতে চাই না। আমাকে কি আগামীবার ওরা নিয়ে যাবেন?’
২. ‘আচ্ছা, ওরা ট্রাম্পকে ওর মধ্যে উঠিয়েছে তো? ওকে পৃথিবী থেকে ভাগাও।’
৩. ‘ঐতিহাসিক ঘটনা। খুব সুন্দর আর স্মুথ উড়ান হয়েছে। ঈশ্বর মঙ্গল করুন। কিন্তু দুটো সাদা চামড়ার মাঝ বয়েসিদের নিয়ে গেল কেন? এমনটা তো সেই ষাটের দশকে হোত।’
৪. ‘যখন সারা আমেরিকা জুড়ে বিক্ষোভ আর দাঙ্গা চলছে, তখন পৃথিবী ছেড়ে এঁরা মহাকাশে চলেছেন ! হোয়াট দা ফা* ইজ গোয়িং অন ?’
৫. ‘আমেরিকার এক লক্ষ লোক কোভিড-১৯এ মারা গেছে। সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশ বরবাদ হতে চলেছে, এর মধ্যে মহাকাশ যাত্রা?’

*
কত কিই যে নীরবে দেখে যেতে হচ্ছে এই করোনা যুগে! দিদিমা বলতেন- ঘোর কলি যুগ, এত পাপ ধরিত্তির সইবে না, সব মরে হেজে শেষে হয়তো আবার সত্য যুগ ফিরে আসবে। দিদিমা ক্যানসারে মারা গেছিলেন, আমার ঠাকুমাও ক্যানসারে মারা গেছিলেন, ঠাকুর্দাও। ওঁরা জানতে পারলেন না, কলির শেষপাদে এই করোনা যুগের কথা। ভাবতেও পারেননি যে, জীবনভর পিপিই পরে কাটাতে হতে পারে মানুষকে। ওঁরা বিশ্বাস করতেন- যা নেই ভারতে (মানে, মহাভারতে), তা নেই ভারতে (মানে ভারতবর্ষে)। কিন্তু মহাভারতে তো দেশজুড়ে পিপিই পরে থাকার কোনও কাহিনী নেই। তবে এমনটা হল কী করে এই দেশে? এতকালের প্রবচন মিথ্যে হয়ে গেল? হায় হায়।

আমাদের দেশের অসংগঠিত শ্রমিক তো দুর্ভাগা, তার ঘর নেই, পেট ভরা খাবার নেই, বোনাস নেই, জীবনবীমা নেই, সেফটি বেল্ট নেই, আগামীকালের নিশ্চয়তা নেই। কী আশায়, কী বিশ্বাসে, কেন সে মিছিলে হাঁটে, ভোট দেয়– তা সে জানে না। মালিক তাকে সময়মতো মাইনে দেয় না, রোগ হলে হাসপাতাল তাকে দূর দূর করে, তবুও সে চড়া সুদে টাকা ধার ক’রে একফালি জমি কিনে একদিন একটা ঘর তোলার স্বপ্ন দেখে। তার নিজের এক কামরার ঘর, আর শৌচালয়। এ জীবন আজ তাকে এক লহমায়, সপরিবারে পথে নামিয়েছে।

জীবন যে এরকমই, তা তো আমরা কবেই মেনে নিয়েছি। সবই চোখে সয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু আজ বিত্তবান ইউরোপের এ কি অবস্থা! স্পেনের রাজপথে খাবারের লাইনে মধ্যবিত্ত মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন, সংকোচে ম্রিয়মাণ, নির্বাক। এমন দিনের কথা তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি কখনও। এই পৃথিবী কি সত্যিই তবে আর বাসযোগ্য থাকবে না ? বজ্রবৃষ্টি, সমুদ্রতুফান, ভূমিকম্প, প্রবল তাপ, গ্রহাণু অথবা, মারণজীবাণু কি একদিন মুছে দেবে এত লক্ষ বছর ধরে গড়ে ওঠা এই বিচিত্র সুন্দর জীবজগত ? আমাদের এতকালের রূপকথা, আম আঁঠির ভেঁপু, ক্ষীরের পুতুল, যমুনাকিনারে শ্যাম বাজায় বাঁশরি ? আমরা তাহলে যাই কোথা ?

আমার মনে পড়ে গেল, ১৯৭৭ সালে ভয়েজার-১ এবং ২ উপগ্রহদুটির সাথে বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের পাঠানো সেই গোল্ডেন ডিস্কের কথা। যদি কোনোদিন পৃথিবী থেকে মুছে যায় মানবসভ্যতা, তবে সুদূর কোনো নক্ষত্রজগতের কোনো উন্নত প্রাণীর হাতে হয়তো একদিন পৌঁছতে পারবে আমাদের পাঠানো ওই রেকর্ডেড ডিস্ক। হয়তো তারা সেদিন জানতে পারবে আমাদের কথা, শুনতে পাবে পৃথিবী নামক এই গ্রহের ঝড়বৃষ্টির শব্দ, মেঘের গর্জন, জলকল্লোল, শিশুর হাসিকান্না, পাখির কলকাকলি, গভীর সমুদ্রে তিমিমাছের ডাক, আর কত বিচিত্র মধুর ভাষায় মানুষ কথা বলে। তাদের তো জানাতে হবে আমাদের বাদ্যযন্ত্র, ঢাকের বাজনা, হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীত, শেহ্‌নাই, পিয়ানো কনচের্টো, আকা পিগমিদের পলিফোনিক বৃন্দগান। এই গোল্ডেন ডিস্কের (নীচে ছবি) এক পিঠে নানা পার্থিব শব্দের সাথে রাখা হয়েছে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বিখ্যাত গায়িকা সুরশ্রী কেসরবাঈ কেরকর-এর কন্ঠের একটি গান—‘যাতো কহাঁ হো’ অর্থাৎ, কোথায় চলেছ? এই ডিস্কের অপর পিঠে ছবি এঁকে বোঝানো আছে মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীর অবস্থান কোনখানে, কোন নক্ষত্রলোকে। আছে কিছু গণিতনির্ভর রেখাঙ্কন ও সাংকেতিক চিহ্ন। এমনভাবে লেখা আছে, যাতে ভিনগ্রহবাসীদের বিজ্ঞানীদের পক্ষেও বোঝা সহজ হয়।

আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৭ সালে যখন পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে ছুটে গিয়েছিল ভয়েজার উপগ্রহ, সেই বছরই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন জয়পুর ঘরানার এই খেয়াল গায়িকা, কেসরবাঈ (১৮৯২-১৯৭৭)।

কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর পরেও, পৃথিবীতে যখন কোনও জীবজগৎ থাকবে না, পৃথিবী যখন একটা পরিত্যক্ত তপ্ত কটাহ মাত্র, সেইসময় কোনও সুদূর নক্ষত্রলোকের কোনও গ্রহে, কোনও উন্নত সভ্যতার কাছে হয়তো পৌঁছে যাবে ভয়েজার এবং তার এই গোল্ডেন ডিস্ক। অবাক হয়ে ভিনগ্রহের ‘মানুষ’ তখন শুনবে এই গান। পৃথিবীর মানুষ আজ এমনটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
গানটা শুনে মনে হয়, যেন কোনও বালিকাবধূ পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর তার মা আর্তস্বরে গাইছেন এই গান—কোথায় চলে যাচ্ছো, প্রিয় কন্যা আমার? -এই গান শুনেই কার্ল সাগান হয়তো ভয়েজারকে সেই কন্যাসম ভেবেছিলেন, যাকে পৃথিবী থেকে অজানার উদ্দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

ইউটিউবে সেই গোল্ডেন ডিস্কের গানের লিঙ্ক এখানে দিলাম, যাঁরা শোনেননি, তাঁদের জন্যে।

https://youtu.be/Qyj8QF5-6Fs

সেই ভয়েজার উপগ্রহ আজ এখন (২০২১ সালে) পৃথিবী থেকে প্রায় ৭৫০ কোটি কিলোমিটার দূরে। পৃথিবী থেকে আলোর গতিতে বেতার সংকেত পাঠালেও, ভয়েজারে সেটা পৌঁছতে এখন সময় লাগছে প্রায় ২০ ঘন্টা। সৌরমন্ডলের সীমানা পেরিয়ে আজও সে ছুটে চলেছে। আনুমানিক তিরিশ হাজার বছর পরে সে পৌঁছে যাবে পরবর্তী নক্ষত্রমন্ডল ‘প্রক্সিমা সেন্টাউরি’-তে। হয়তো সেখানেও আছে পাখিডাকা জ্যোৎস্নামাখা অজানা কতো গ্রহ। অথবা হয়তো চলে যাবে আরও দূরে কোথাও, আরও লক্ষ বছর পরে তাকে খুঁজে পাবে কোনও সভ্যতা। আমাদের পৃথিবী তখন পরিত্যক্ত, প্রাণহীন। যদি তার অনেক আগেই আমরা বসতি স্থাপন করতে পারি অন্য গ্রহে, বা অন্য নক্ষত্রলোকে, তবে আমাদের মহান ইতিহাস আর অস্তিত্বটুকু টিঁকে থাকবে বিশ্বসংসারে। এলন মাস্ক ও তাঁর সঙ্গী বিজ্ঞানীরা সবে শুরু করেছেন সেই কাজ।

*
মাত্র ‘চার মাইল’ দূরেই রয়েছে একটি ব্ল্যাকহোল!

রাতের আকাশে ওই যে বিস্তৃত ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, তার এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব প্রায় দেড় লক্ষ আলোকবর্ষ। তাতে রয়েছে প্রায় তিরিশ হাজার কোটি নক্ষত্র, আর আনুমানিক দশ হাজার কোটি গ্রহ, যার একটিতে আমাদের বাস। এবং সমগ্র ছায়াপথ জুড়ে এসবের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে অজস্র কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল, লক্ষ লক্ষ। ছায়াপথে বামন নক্ষত্র বা হোয়াইট ডোয়ার্ফের সংখ্যাই প্রায় এক হাজার কোটি !

এই ছায়াপথের কেন্দ্রেই আছে, পৃথিবী থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে, এক অতিকায় ব্ল্যাকহোল– বাংলায় আমরা যার নাম দিয়েছি ‘গভীর মল্লিকা’। তার ভর সূর্যের প্রায় চল্লিশ লক্ষ গুণ। এর কথা এখন আমরা অনেকেই জানি। এই ব্ল্যাকহোল নিয়ে পরে লিখবো।

তবে এতদিন যা জানা যায়নি সেটা হচ্ছে যে, আমাদের পৃথিবীর খুব কাছেই নাকি খোঁজ পাওয়া গেছে একটি ছোট্ট ব্ল্যাকহোল, মাত্র ১০০০ আলোকবর্ষ দূরে, তার ভর মাত্র চারটে সূর্যের সমান! এতটাই কাছে যে খালি চোখেই দেখা যায়। আসলে ব্ল্যাকহোলকে তো সরাসরি দেখা যায় না, দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল নীল রঙের একটা নক্ষত্রকে, যার নাম HR 6819 (নীচের ছবিতে), যাকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশে, সেখানে এখন শীতকাল।

তবে ওই নীল নক্ষত্রটা (HR 6819) কিন্তু একা নয়। টেলিস্কোপে চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে ওরা আসলে দুটো, একটা খুব বড় আর আরেকটা ছোট। এদের বলা হয় বাইনারি স্টার সিস্টেম, এরা পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে এবং এদের কক্ষপথ ও গতিবিধি মাপজোখ করে বোঝা যাচ্ছে যে ওরা শুধু দুজন নয়, ওদের মধ্যেই ফাঁকা যায়গায় রয়েছে আরও কিছু যার আছে প্রবল আকর্ষণ বল, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ সেটা নির্ঘাৎ একটা ব্ল্যাকহোল। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে, খুব কাছেই তার অবস্থান। মাত্র ১০১১ আলোকবর্ষ দূরে। তবে মহাবিশ্বের হিসেবে, খুব কাছে বললেও ঠিক বোঝা যায় না। ধরা যাক পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মাত্র এক চুল ; মানে, মাথার একটা চুলের প্রস্থ যতটুকু। সেক্ষেত্রে ওই ব্ল্যাকহোলটা রয়েছে আমাদের থেকে মাত্র চার মাইল দূরে। এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি, ৬-মে ২০২০.

নীচে ছবিতে ঠিক মাঝখানে রয়েছে সেই বাইনারি নীল নক্ষত্র। তারা আসলে দুটো, যার মধ্যে বড়টি সূর্যের চেয়েও অনেক বেশি উত্তপ্ত এবং ঘূর্ণনবেগও সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি। এদের কক্ষপথের কেন্দ্রেই তো লুকিয়ে রয়েছেন সেইজন, যাকে দেখাই যাচ্ছে না, অর্থাৎ সেটা একটা ব্ল্যাকহোল। নাহলে একটা ফাঁকা জায়গাকে ঘিরে দুটো নক্ষত্র তো শুধু শুধু ঘুরতে থাকবে না। কেউ তো ঘোরাচ্ছে তাদের। এই হল আমাদের সবচেয়ে কাছের একটা ব্ল্যাকহোল, মাত্র ১০০০ আলোকবর্ষ দূরে। আর আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে রয়েছে যে ‘গভীর মল্লিকা’ (Sgr.A*) নামের কৃষ্ণগহ্বর, পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব অনেক বেশি— ২৬,০০০ আলোকবর্ষ।

*
আমার বরং মন টেনেছে (ভয়ে নয়, উৎসাহে) বহুদূরের একটা অন্য দৃশ্য। সুদূর ও মহাজাগতিক সেই দৃশ্য, যা নাসার জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন। গভীর মহাকাশের দূরতম প্রান্তে, কর্কট রাশিতে, পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ‘OJ 287’ নামক এক বিশাল গ্যালাক্সিতে আছে একজোড়া কৃষ্ণগহ্বর বা, ব্ল্যাক হোল। একটি বড়, তার ভর ১৮০০ কোটি সূর্যের ভরের সমান। দ্বিতীয়টি ছোট, তার ভর ১৫ কোটি সূর্যের ভরের সমান। ওই বড় ব্ল্যাকহোলকে ১২ বছরে একবার করে প্রদক্ষিণ করছে ছোটজন। ওপর থেকে নেমে এসে, বড়টির চারপাশে যে কোটি কোটি মাইল বিস্তৃত ঘূর্ণায়মান গ্যাসের পুরু চাদর (accretion disk), তাকে ভেদ করে নীচে চলে গিয়ে অপরদিক দিয়ে সেই গ্যাসের চাদর পুনরায় ফুঁড়ে সে ওপরের দিকে উঠে আসছে তার কক্ষপথে। অর্থাৎ প্রতি ১২ বছরে দুবার হচ্ছে ওই চাদর ভেদ করে ওপর-নীচে যাতায়াত। এবং ঠিক সেই সময়গুলোতেই সৃষ্টি হচ্ছে আলোর বিস্ফোরণ, যার ঔজ্জ্বল্য প্রায় দশ হাজার কোটি সূর্যের মতন। এই হোল এক বিপুল মহাজাগতিক নাট্যশালা !

এবার নাসার বিজ্ঞানীদের Spitzer ইনফ্রারেড টেলিস্কোপে দেখতে পাওয়া গেছে ৩৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের সেই ক্রমান্বয়ে জ্বলে ওঠা উজ্জ্বল আলোর ছ্বটা। বিজ্ঞানীরা এর সমস্ত তথ্য দিয়ে সুপারকম্পিউটারে সিমুলেশন মডেল তৈরী করে ফেলেছেন। দেখা গেছে, হুবহু মিলে গেছে (মাত্র চার ঘন্টার হেরফের) বাস্তবের দৃশ্যের সাথে। ল্যাপটপে দেখা যাচ্ছে ওই আলোক বিস্ফোরণ !

দেখুন, এর কেন্দ্রে রয়েছে বড় ব্ল্যাকহোলটি। এবং ওপর থেকে বাঁদিক দিয়ে একটা কালো বলের মতো নেমে এসে, তার অ্যাক্রিশান ডিস্ককে বিদ্ধ করে, ঝলসে উঠে নেমে যাচ্ছে অন্যটি। প্রতি বারো বছরে দুবার করে ঝলসে উঠছে আলো, দশ হাজার কোটি সূর্যের মতো। জীবন সার্থক করা এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, ৩৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে! নীচে সেই মডেলটার ভিডিও ক্লিপ* দিলাম।

https://youtu.be/HBE8qBtQMuA

এবার পাঠক ভাবুন। তিনশো পঞ্চাশ কোটি আলোকবর্ষ দূরের এইসব দৃশ্য দেখে নিয়ে কম্পিউটারে মডেল বানিয়ে ফেলছে যে মানুষ, তাকেই কিনা এক ‘অদৃশ্য’ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা-ভাইরাস আজ আতংকে হতাশায় গৃহবন্দী করে রেখে দিয়েছে !!

এইসব ব্যাধির বিরুদ্ধে জিততেই হবে মানুষকে। আমরা জিতবই। আমাদের সপক্ষে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এবার শুধু চাই সহযোগ ও সদিচ্ছা। পাঠক, দয়া করে এখন শনির কোপ, বৃহস্পতির দশা, আর রাহু-কেতু ছেড়ে, বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠতে সাহায্য করুন। -ব্রহ্মজ্ঞান নয়, আমাদের চাই বিশ্বজ্ঞান। বিশ্বপ্রকৃতি। মহাবিশ্ব।

[*Video credit: NASA/JPL/Abhimanyu Susobhanan, Tata Institute of Fundamental Research]

(ক্রমশঃ)

Facebook Comments

Leave a Reply