কাজাকিস্তানের কড়চা : শ্রুতি ঘোষ

[শ্রুতি ঘোষ কথক নৃত্যশিল্পী, শিক্ষিকা, কোরিওগ্রাফার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলচ্চিত্রবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। তাছাড়াও কথক নৃত্যেও এম. এ. করেছেন। কাজাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসে চাকরীসূত্রে দুবছর কাটিয়েছেন। বর্তমানে কলকাতা শহরে থাকেন। শ্রুতি বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে নানারকম প্রজেক্টে কাজ করেছেন এবং কলকাতা, দিল্লি, সিডনী, মেলবোর্ন, ক্যানবেরা, লন্ডন শহরে পারফর্ম করেছেন। নাচ ছাড়াও, শ্রুতির গভীর আগ্রহ সিনেমা, থিয়েটার, মিউজিক-এ। বাংলা এবং ইংরেজি বিভিন্ন পত্রিকা এবং এন্থোলজিতে ওনার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। শ্রুতি  ২০১৮’র মার্চ থেকে ২০২০’র জুলাই পর্যন্ত কাজাকিস্তানে ভারতীয় দূতাবাসের ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রতে (বর্তমান নাম স্বামী বিবেকানন্দ কালচারাল সেন্টার) নৃত্য শিক্ষিকা-পারফর্মার পদে চাকরী করেন। এই দু’বছরে, সেই দেশের বিভিন্ন শহরে শ্রুতি ট্র্যাভেল করেন ওয়ার্কশপ-পারফর্ম্যান্স-সেমিনারের কাজে। তারই কিছু কিছু অভিজ্ঞতা শ্রুতি লিখবেন এই ধারাবাহিকে।]

ওস্কেমেন শহরঃ নিষিদ্ধ আর নৈসর্গিকের মাঝের গল্প (১)

এইবার যে গল্প ফেঁদেছি, তার টুকরো কিছু অংশ নিয়ে মুখোমুখি আড্ডা দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল আশি বছরের এক যুবার সঙ্গে, যিনি গত ২২শে জুলাই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁকে, যাকে (আমরা অনেকেই) ডাকতাম দীপকজেঠু বলে, আর সামনে বসে পুরো গল্প শোনানো হল না। অবশ্য গল্প কি কখনই পুরোয়? ঠিক কতটা দূর এগিয়ে, কোথায় গিয়ে থামলে বলা যায় যে এখানেই শেষ?! জানি না। তবে জানি যে দীপক মুখোপাধ্যায়, বিখ্যাত আলোকশিল্পী, নাট্যব্যাক্তিত্ব, আছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না। জেঠু আছেন। আমার এই গল্পও শুনছেন। “ওয়াট ইস এসেনশিয়াল ইস ইনভিসিবল টু দ্যা আই”। আজকের এই গল্প আমি দীপক জেঠুকে উৎসর্গ করলাম।
কাজাকিস্তানের পূর্ব প্রান্তের শহর ওস্কেমেন। কাজাক নাম। রাশিয়ানদের দেওয়া নাম উস্ত-কামেনা-গোর্স্ক। রুশ সম্রাট, পিটার দ্যা গ্রেট ওস্কেমেনে সৈন্য পাঠান সোনার খোঁজে। সেখানে ১৭২০ সালে তৈরি হয় একটা দুর্গ এবং ব্যবসার একটি কেন্দ্র। তারপর গড়ে ওঠে শহর। ইরতিশ আর উলবা নদীর সংযোগ স্থলে দাঁড়িয়ে আছে ওস্কেমেন, যা বর্তমানে পূর্ব কাজাকিস্তানের মূল প্রশাসন-কেন্দ্র। তাছাড়া, সোভিয়েত সময় থেকেই ওস্কেমেন খননের কাজ এবং বিভিন্ন ধাতুদের প্রক্রিয়াকরণের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কমিউনিস্ট নেতা জর্জি মালেনকভকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল ওস্কেমেনে। সেসময়ে উনি স্থানীয় একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ম্যানেজার পদে নিযুক্ত ছিলেন।
আস্তানা থেকে প্লেনে দুঘণ্টা। ফ্লাইট থেকে নামতেই দেখলাম আমাদের জন্য দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে। মালপত্র গাড়িতে তুলে হোটেলে যেতে যেতে আগামী কয়েকদিনের কর্মসূচী ঝালিয়ে নিলাম আমরা। হোটেলের ঘরে ঢুকে পর্দা সরাতেই চোখে পড়ল একটা নদী। শান্ত ভাবে বয়ে চলেছে।

Shruti-July21-01

দূরে পাহাড়ের অস্পষ্ট রেখা। নদীর ধারে ফুল দিয়ে সাজানো রাস্তা। কিন্তু একটা বিটকেল মাথা ব্যথা তখন আমায় বেশ জ্বালাচ্ছে! খুব ভোরে উঠে ফ্লাইট ধরতে হয়েছে, রাতে ঠিক ঘুম হয়নি, হয়তো সেই জন্য…ভাবতে ভাবতে কফিতে চুমুক দিয়ে গোছগাছ শুরু করলাম। সন্ধেবেলা পার্ফর্ম্যান্স। গাড়ি আসবে একটু পরেই।
পার্ফর্ম্যান্স হবে একটা মিউসিয়ামের ভেতর। তার একতলার ঘরগুলোতে প্রদর্শনী রাখা – কাজাক পোশাক, খাবার, হাতের কাজ, বাদ্যযন্ত্র, ওস্কেমেনের ইতিহাস, মানচিত্র, ছবি, বইপত্র ইত্যাদি। আর একটা হলঘর। তার একদিকে ছোট্ট একটা মঞ্চ। মূলত বক্তৃতা আর গান হয়। সেদিনের অনুষ্ঠানের জন্য, সেখানে নাচ-নাটক-আবৃত্তি-গান-বাজনা নানান কিছু প্রস্তুত করা হবে। অনুষ্ঠানের নাম এথনোফেস্ট – হ্যাপি টুগেদার। ভারতীয় দূতাবাস থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আমাদের। অনুষ্ঠানের মধ্যে আছে ওই শহরের স্কুলের বাচ্চাদের নাচ-গান-নাটক-আবৃত্তি। আমার নাচ। ভারতীয় দূতাবাসের শিক্ষকের যোগের ওয়ার্কশপ। আর দূতাবাসের ডিরেক্টরের বক্তৃতা। অনুষ্ঠান শেষ করে হোটেলে ফেরার পথে গাড়িতে বসে আলোচনা চলছে রাতে কোথায় ডিনারে যাওয়া যায়। খাবারের ব্যাপারে আমার অন্যদের থেকে সাধারণত উৎসাহ বেশিই থাকে, কিন্তু তখনো মাথা ব্যথাটা অনুভব করছি, ফলে উৎসাহ একটু কম। ডিনার সেরে হোটেলে ফিরলাম। সবাই তাঁদের ঘরে চলে গেলেন। ঘড়িতে সবে নটা। ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করা যাক। নূরগুল, আমাদের একাউন্ট্যান্ট এসে বললেন, “ম্যাডাম, একটা ওষুধ অবশ্যই খেয়ে শোবেন। কাল ভোরে ওঠা। আর এই মাথা ব্যথাটা এখন কিন্তু থাকবে। গুডনাইট।“ মাথা ব্যথা থাকবে? কেন? জিজ্ঞেস করার আগেই নূরগুল চলে গেলেন। আমি নদীর ধারের সেই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। শীত পড়ে গেছে। জ্যাকেট, মাথায় টুপি, মোজা আর জুতো। খুব মনোরম। বরফের দিন আসতে তখনো দেরী। ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু আরাম লাগল, ঘুম পেল। ঘড়িতে দশটা। কাল ভোরে উঠে আবার ওয়ার্কশপ, পার্ফর্ম্যান্স। আর দেরী না করে হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে আমরা পৌঁছলাম জাস্তার পার্ক।

Shruti-July21-02

Shruti-July21-03

Shruti-July21-04

এটা ইস্ট কাজাকিস্তান রিজনাল আরকিটেকচারাল এথনোগ্রাফিক এন্ড নেচার ল্যান্ডস্কেপ মিউসিয়াম এন্ড রিসার্ভ বিল্ডিং-এর অংশ। এই চত্বরটা আগে ছিল মার্কেট স্কোয়ার, অর্থাৎ খোলা বাজার। ১৯৩৫এ কমিউনিস্ট নেতা, সেরগেই কাইরভ আসেন এই অঞ্চলে। তারপরেই এই পার্ক তৈরি হয়।

Shruti-July21-05

২০০১ সালে নিকোলাই যায়েৎসেভের তত্ত্বাবধানে আরেক দফা সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হয় এখানে। বিভিন্ন রকমের ফুল আর কয়েক হাজার গাছ লাগানো হয়। বেশ কয়েকটা ভাস্কর্য বানানো আছে পার্ক জুড়ে। এখানে গরমকালে অনুষ্ঠান, মেলা, উৎসব হয়। পার্কের একটা দিকে ২০০৯ সালে স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি।

Shruti-July21-06

সেই মূর্তির সামনেই সকালের অনুষ্ঠান করা হল। কাজাক আর রাশিয়ানে অনূদিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করল অনেকে। স্কুলের বাচ্চাদের আঁকা দিয়ে মূর্তির চারপাশটা সাজিয়ে একটা প্রদর্শনী আর প্রতিযোগিতা করা হল।

Shruti-July21-07

Shruti-July21-08

Shruti-July21-09

Shruti-July21-10

Shruti-July21-11

আঁকার বিষয় ভারতবর্ষ। বাছাই করা ছবিকে পুরস্কার দেওয়া হল। নাচ আর যোগের ওয়ার্কশপ হল। আর নাচের দিদিমণি বাঙালি হওয়ায় একখানা রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরোধ আগেই এসেছিল। এটাও বলা ছিল, যে গান/কবিতার কাজাক/রাশিয়ানে অনুবাদ আছে, সেরম একটা গান গাইতে হবে! তবে গাইতে গিয়ে হঠাৎ বুঝলাম ডান কানে তালা ধরে আছে! নাচ-গান-আবৃত্তি-আঁকা সব মিলিয়ে খুব ভালো কাটল সকালটা। সন্ধ্যের অনুষ্ঠানের আগে কয়েক ঘণ্টা আছে। লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফিরব। নূরগুল এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম, মাথা ব্যথা সেরেছে?”
আমি- হ্যাঁ, কিন্তু আজ আবার কানে তালা!
নুরগুল – (হেসে) স্যারেদেরও হয়েছে।
বুঝলাম আমার বাকি কোলিগদেরও একই হাল। কিন্তু ব্যাপারটা কি?!
আমি – “তোমারও কি মাথা ব্যথা হয়েছে?”
নুরগুল- হ্যাঁ, অল্প। এখানে হবেই ম্যাডাম।
নুরগুল বলতে থাকেন যে, যুদ্ধ পরবর্তী সোভিয়েত এটমিক বম্ব প্রোজেক্টের সঙ্গে ওস্কেমেনের ইতিহাস সম্পৃক্ত। যে জায়গায় সোভিয়েতের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়ে সেটা এই অঞ্চলের সংলগ্ন। তাছাড়া, একটা প্রধান শিল্পোদ্যোগ, উলবা মেটাল ওয়ার্ক্স (ইউ এম ডাব্লিউ), ইউরেনিয়াম প্রোডাক্ট বানিয়ে চলেছে কয়েক দশক ধরে। সোভিয়েত কালে গোটা কাজটাই গোপন ভাবে করা হত। বাইরের লোকেদের যাতায়াত বন্ধ ছিল এ শহরে। ১৯৯০ সালে হঠাৎ বিস্ফোরণ হওয়ায় বিষাক্ত গ্যাস বেরোতে থাকে যা আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে এমনভাবে মিশে যায় যে এই অঞ্চলে দূষণ মারাত্মক বৃদ্ধি পায়। যারা বাইরে থেকে আসেন, তাঁদের প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, নাক-কান বন্ধ এরম অনুভূতি হয়ে থাকে। এই শহরে বেশ অনেক মানুষেরই ফুসফুসের রোগ আছে। নূরগুল আরো জানান যে, ওস্কেমেন খুবি ‘শক্তিশালী’ শহর। সেই শিল্পোদ্যোগ ইউ এম ডাব্লিউ, আজও অব্যাহত, দূষণও।
সেদিন সন্ধ্যের অনুষ্ঠানও খুব ভালো হল। প্রচুর লোক, প্রচুর আদর-আপ্যায়ন-হৈ হুল্লোড়, প্রচুর উৎসাহ।
পরের দিন। কিছুটা কাজ, কিছুটা বেড়ানো। মুহামদি সিটি মস্ক, ওস্কেমেনের মসজিদ।

Shruti-July21-12

ঝাঁ চকচকে দেখতে। মীনে করা কাজ দেওয়া বড় গম্বুজ। মসজিদের চারদিকে ফুল দিয়ে সাজানো। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। মসজিদের এক পাশ দিয়ে লম্বা রাস্তা। শুধু সবুজ আর সবুজ। এখান থেকে এথনো পার্কের শুরু। কিছুদূর যেতেই লেনিনের মূর্তি।

বিভিন্ন সোভিয়েত নেতাদের মূর্তি। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত রকেট, ট্যাঙ্ক, বন্দুক আরো নানা জিনিস রাখা পার্কের সেই অংশে। সুসজ্জিত ফুল, গাছপালা, মসজিদের বড় গম্বুজের এক ফালির মাঝখানে লেনিন মূর্তি আর সোভিয়েত মিসাইল!! বিচিত্র ফ্রেম! অদ্ভুত সমাপতন?! একটা বিশাল চাতালে দুদিকে রাখা ট্যাঙ্ক, আর মাঝে মানুষের হাতের মতো দেখতে আর্ট ইন্সটলেশান যা যুদ্ধর পরিবর্তে শান্তির বার্তা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

Shruti-July21-14
আরো কিছু দূর হেঁটে গেলে, এথনিক ভিলেজের শুরু। যেসব দেশগুলো সোভিয়েতের মধ্যে ছিল, তাদের প্রত্যেকটির ট্র্যাডিশনাল বাড়ি বানানো আছে সারি দিয়ে।

Shruti-July21-15

বেলারুশের বাড়ি

Shruti-July21-16

ওল্ড বিলিভারের স্টাইলে বাড়ি

Shruti-July21-17

জর্জিয়ান বাড়ি

প্রতিটা বাড়ির ভেতরে সাজানো আসবাব, বইপত্র, প্লাস্টিক, সেরামিক বা মাটি দিয়ে বানানো খাবারের মডেল। একের পর এক বাড়ি! এক দেশ থেকে আরেক দেশ। কি পরিশ্রম, ধৈর্য আর ভালোবাসা দিয়ে বানানো। যায়েৎসেভের মস্তিস্কপ্রসূত এই পার্ক। কয়েকশো একর জায়গা নিয়ে বানানো হয়েছে। বাড়িগুলো দেখা শেষে করে পার্কের মুখে ফিরছি যখন, সন্ধ্যে নামছে। বৃষ্টি শেষে, সবুজ আরো ঘনীভূত হয়েছে, সূর্যাস্তের হাল্কা আভা ছড়াচ্ছে। শীতের অনুভূতি তীব্রতর হচ্ছে। নীল আকাশ। কোথায় ইউরেনিয়াম আর বিষাক্ত গ্যাস আর ফুসফুসের সমস্যা?! চোখের সামনে সবই তো স্বচ্ছ, সুন্দর! গাড়িতে বসতেই বোধ হল পা দুটো বেশ ক্লান্ত। আজকের মত ঘোরা শেষ। কালকের দিনটা বাকি। কালকে বেড়ানো আরেকটু বাকি। ওস্কেমেনের গল্প আরো কিছুটা বাকি।

[চলবে…]

Facebook Comments

Leave a Reply