ব্রুস অ্যান্ড্রুজ ও ভাষা-কেন্দ্রিক লেখন : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

অপরজনের এই সংখ্যায় আমাদের এবারের কবি ব্রুস অ্যান্ড্রুজ। আপনাদের পরিচিত সেই ভাষা-কবিতার কবি। সত্তরের দশকে কবিতাকে বিষয়হীন করে, ব্যাকরণে বেঁধে দেওয়া শব্দার্থের বিরোধিতা করে, বস্তুগতভাবে চিহ্নকের কাছে ফিরে গিয়ে চিহ্নিতকে মুছে রেফারেন্সকে অদৃশ্য করার থিয়োরি নিয়ে শুরু হয়েছিল ভাষাকবিতার চলন, যাকে ব্রুস অ্যান্ড্রুজ বলছেন ভাষা-কেন্দ্রিক লেখন। ১৯৭১ সালে রন সিলিম্যানের সঙ্গে এই শব্দবন্ধটির কয়েনেজ করেন ব্রুস অ্যান্ড্রুজ এবং ১৯৭৮ সালে চার্লস বার্নস্টাইনের সঙ্গে সম্পাদনা শুরু করেন L=A=N=G=U=A=G=E পত্রিকা। এই পত্রিকা এবং তার সঙ্গে যুক্ত বহু কবির সম্মেলনে মার্কিন কাব্যতত্ত্বের গুরুত্ত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটে যা ভাষা-কেন্দ্রিক লেখন নামে পরিচিত। সম্প্রতি ২০২০ সালে নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকা চলাকালীন সমস্ত লেখার সংগ্রহ─ Recencies Series : Research and Recovery in Twentieth-Century American Poetics, সম্পাদনা করেছেন ম্যাথু হফার ও মাইকেল গলস্টোন, ভূমিকায় লিখছেন: এই গ্রন্থটি সমালোচনামূলক অনুসন্ধান, ঐতিহাসিক দলিল এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের এমন একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে যা আলোকিত করে সাম্প্রতিক অতীতের উদ্ভাবনী কাব্যতত্ত্বের সেই অর্জনগুলো যা বর্তমানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।[১]

“কবিতার গঠনতন্ত্র আসলে ভাষারই গঠনতন্ত্র”,[২] বলেছিলেন বাংলা নতুন কবিতার প্রাণপুরুষ বারীন ঘোষাল: আর সেই ভাষার কেন্দ্রে থাকে শব্দ। অথচ শব্দের কোনো একক অর্থ নেই। সমস্ত শব্দই বহুস্তরীয় ও ডাইনামিক, অসংখ্য অর্থের সম্ভাবনায় পূর্ণ। চিহ্নক ও চিহ্নিতের সাধারণ সংযুক্তিকে কবি অস্বীকার করেন, বাগধারার মানদণ্ড অগ্রাহ্য করেন। রচনাকে কেন্দ্রচ্যুত ক’রে তার ভেতর ও বাইরের সীমা ভেঙে দেন, সৃষ্টি করে্ন ভাষার সন্ত্রাস। সৃজনশীল ভাবনার বিকাশের জন্য যৌক্তিক অসামঞ্জস্যগুলোকে চিহ্নিত ক’রে সৃষ্টি করেন এক অন্তরঙ্গ ও সৃজনশীল পাঠ, যা রচনার ঘোষিত ও প্রতিষ্ঠিত উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেয়। এ জগতে দর্শকনিরপেক্ষ বাস্তব বলে কিছু নেই। সমস্ত অভিজ্ঞতাই জগতের সঙ্গে আমাদের নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ার উদ্ভাস, যেখানে পূর্বনির্ধারিতের কোনো স্থান নেই। লিখিত শব্দ নিজেকে চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত করে বলে তার মানে মুলতুবি থাকে ভবিষ্যতে ভিন্ন মানে প্রসব করার জন্য, যা একইসঙ্গে পূর্বনির্ধারিতের অস্বীকার আর সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত করে। আর এই প্রসববেদনাই ডাক পাঠায় পাঠককে, সম্পূর্ণ হয় কবি-কবিতা-পাঠকের ত্রিভূজটি। পাঠকৃতির মধ্যে থাকে পাঠকের ভাবনা, অভিক্ষেপ ও অন্তর্মুখ তীব্রতর করে তোলার উদ্দেশ্য আর পাঠকৃতির বহুরৈখিক সময় ও প্রসঙ্গনির্ভর পরিসর তৈরি করে এক সাময়িক স্পেস, যা পাঠককে দেয় তার নিজস্ব কল্পনার জগতে ভ্রমণের ছাড়পত্র। এই সময় ও পরিসরের সমকেন্দ্রিকতায় পাঠক শুরু করেন তাঁর অবিনির্মাণ পদ্ধতি। জীবনের চলপথের মুহূর্তের অভিজ্ঞতাগুলো কবির কল্পনায় অনুভবের রসে জারিত হয়ে তৈরি করে পাঠকৃতি। কবির মূর্ত অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপ পাঠকের চেতনায় মূর্ত হয়ে উঠলে সম্পূর্ণ হয় কবি-কবিতা-পাঠকের কমিউনিকেশন, যেখানে কবির সেই নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাটির নবমূল্যায়ন ঘটে। তো সেই ভাষা-কবিতার লেখনপদ্ধতি যেখানে অনুরণন আমাদের বাংলার “নতুন কবিতা”র (New Poetry) ভাবনা। তারই একটা ধারণা দিয়েছেন ব্রুস অ্যান্ড্রুজ তাঁর “Meaning, Method, Motive: Empire and so-called Language Writing”[৩] গদ্যে, যার অংশবিশেষ এখানে অনূদিত করলাম।

প্রথম পার্ট : তথাকথিত (So-Called)

১৯৭০ থেকে যে ভাষা-কেন্দ্রিক লেখনের কথা বলা হচ্ছে এটা তারই একটা সংক্ষিপ্ত স্কেচ। কীভাবে তাকে একটা ফ্রেমে ধরা যায়? কীভাবে তাকে ঠাহর করতে পারি?

গুরুত্বপূর্ণ স্বাতন্ত্র্যতা : মূলত পাঠক-কেন্দ্রিক লেখন ─ যা পাঠকের অভিজ্ঞতার দাবিকে সম্মান দেয় ─ ‘গতিশীল’ আর আত্ম-রূপান্তরের জন্য উন্মুক্ত। এবং সেই কাজটা করে পাঠকের অভিজ্ঞতার জন্য একটা স্বতন্ত্র অবস্থান চিহ্নিত ক’রে ─ পূর্ব নির্ধারণ থেকে, প্রোগ্রামিং থেকে, নিষ্ক্রিয়তা থেকে মুক্ত ক’রে।

প্রেরণা জোগানো কেন্দ্রে পাঠকের অভিজ্ঞতাকে রেখে পরিবেশের কেন্দ্রে অবস্থান করে ভাষা। উপযুক্ত তীব্র পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে ও চালনা করে আরো বড় দায়িত্ব, আত্মসমালোচনা ও বিভ্রমগুলোর দিকে।

(লেখন) পদ্ধতি ও (পঠন) প্রেরণা একই সূত্রে গাঁথা। প্রেরণাকে বহন করে পদ্ধতি আর প্রেরণা চালিত করে পদ্ধতিকে। তাহলে অর্থ নিরুপণের জন্য কী সেই পদ্ধতি যা এক ধরণের মুক্ত ও গতিময় পঠন দাবি করে? এই পদ্ধতিই ভাষা-কবিতার বৈশিষ্ট্য।

প্রথমত অর্থ নিরুপণের অনুভূমিক অক্ষে থাকে সময়, যেখানে ফলাফলগুলো প্রত্যক্ষভাবে বিচ্ছিন্ন। সে যেমন একরৈখিক আখ্যান অস্বীকার করে, তেমনি ছন্দের যান্ত্রিক কঠোরতা ও ব্যাকরণের মাননির্ণায়ক নিয়মকেও প্রত্যাখ্যান করে। যুক্তিশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। বাক্যের আঠালো গঠনতন্ত্র দ্রবীভূত হয়ে যায় আর সময়ের তির্যক ও আঁকাবাঁকা চলনে ঠিকরে ওঠা শব্দ ধারাবাহিকতা উপড়ে ফেলে একধরণের যুগপৎ সংগঠনে মেতে ওঠে।

দ্বিতীয়ত অর্থ নিরুপণের উল্লম্ব অক্ষে থাকে প্রসঙ্গমূলক ও অভিব্যক্তিমূলক পরিসর, যেখানে কোনোরকম প্রতিনিধিত্ব না করে দৃশ্যমান স্বতন্ত্রতায় ফলাফল চিহ্নিত হয়। এই পরিসর অস্বীকার করে ভাষার সেই স্বচ্ছতা যা পাঠকৃতির ভেতর খোঁজ করে মায়া বা গোপন কল্পিত গভীরতা অথবা কোনো বিবরণ, গালগল্প বা লেখকের আত্মঅভিব্যক্তির প্রকাশ।

এই পাঠকৃতি যেমন অনুভূমিক অক্ষে সময়ের পূর্বতন রেখা বা প্রোগ্রামিঙের নিরঙ্কুশ অধীনতা স্বীকার করে না, তেমনি উলম্ব অক্ষে প্রতিনিধিত্ব করা বা অভিব্যক্তির চিহ্ননির্মাণও স্বীকার করে না। কেবলমাত্র একনিষ্ঠ পাঠক নয় বরং এই পাঠকৃতি পাঠককে উসকে দেয় পূর্বতন চিহ্নায়ণের সীমাবদ্ধতাকে আক্রমণ করতে।

তিনটি পৃথক ক্ষেত্রে বা অক্ষে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে গিয়ে পাঠকৃতি নিজেই একটা নীতি বা কৌশল অবলম্বন করে, যেখানে পদ্ধতি তার নতুন উদ্দেশ্য বা প্রেরণাকে জিইয়ে রাখে ─ অর্থ নিরুপিত হয় অনুভূমিকভাবে পাঠযোগ্য সময়ে এবং উল্লম্বভাবে চিহ্নিত পরিসরে।

মোটিভ বা প্রেরণা হ’ল তৃতীয়, যা প্রসঙ্গনির্ভর ক্ষেত্র তৈরি করে, যেখানে অভিজ্ঞতা একটি অক্ষে আহ্বান জানায় পাঠককে অর্থের সময় ও পরিসরের সমকেন্দ্রিকতায়। পদ্ধতি একটা সুরক্ষার পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করে এবং একটি নির্দিষ্ট ধরণের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করে।

এবারে আসি ব্রুস অ্যান্ড্রুজের কবিতায়। এখানে তাঁর প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ Mistaken Identity[৪] থেকে প্রথম পাঁচটি কবিতার অনুবাদ করা হল। তাঁর বইটির এই প্রস্তাবিত প্রচ্ছদটির ডিজাইন করেছেন ডির্ক রাওনট্রি। ওপরে অনূদিত এই “তথাকথিত” ভাষাকবিতার ‘zero degree’-র ধারণা, যাকে ব্রুস অ্যান্ড্রুজ “পাঠকের মৃত্যু” বলে মনে করেন তা অনেকটা ভাষার অন্তরতম অঞ্চলের minimalist ধারণার মতো। তাই এই বদ্ধতা থেকে উত্তরণের পথনির্দেশ করেন কেন্দ্রাতিগ চলনে যেখানে কেন্দ্রছুট ভাবনার বিকেন্দ্রীকরণ স্বপ্ন কবিকে ছুটিয়ে দেয় বহুমুখী বৈচিত্র্যের দিকে আর ডেকে আনে সম্ভাবনার পাখি। ফলত রচিত হয় কবিতার মানে বা অর্থ নিরূপণের নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত আর তারই আভাস অ্যান্ড্রজের এই কবিতায়।

আজকের দুনিয়ায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা ওড়ানো ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মানুষের পরিচয় কীভাবে কেন ভুল হয়ে উঠছে?─ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমে খোঁজ করতে হয় একজন ব্যক্তির প্রকৃত Identity বলতে আমরা কী বুঝি? সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড মূলত কাল, শক্তি, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ প্রভৃতির মূলে থাকা ক্ষুদ্রতম (micro) সত্তায় আছে এক বিন্দুরূপিণী বা অংরূপিণীর ধারণা, যা সমগ্র বৃহত্তম (macro) সত্তার একক রূপে চিহিত। বস্তুত এই অংরূপিণী হল তেজকণা ও তার আধার বিষয়ক উপলব্ধি। এই তেজ বা শক্তির (energy) আত্মোপলব্ধিকেই (self-awareness) কলিম খান বলছেন ব্যক্তির identity, যার বর্তমান বিজ্ঞানসম্মত নাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা। এই ব্যক্তিসত্তাটির পরিচয় হল রাশিকৃত বা দঙ্গলভুক্ত অবস্থান থেকে সার্বিক চয় থাকে যাতে। চয় অর্থ চয়িত যে, অর্থাৎ যাকে চয়ন করে রাখা হয়েছে। এই চয়ন ক্রিয়া হল ‘চয়’ কে তার পারিপার্শ্বিক সত্তাগুলোর মাঝখানে রেখে চিহ্নিত ক’রে তার পরিচয় জানা। নিঃসন্দেহে একজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার এটিই ছিল মানবসভ্যতার আদি পদ্ধতি। একদিকে তার আত্মজ্ঞান, বৈদিক ভাষায় যার নাম ব্রহ্মজ্ঞান এবং অন্যদিকে তার পরিপার্শ্বের সতত চলমান পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার নিরন্তর মিথস্ক্রিয়া─ এই সম্পর্কায়ন একজন মানুষের ব্যক্তিপরিচয়ের ভিত্তি। একদিকে ব্যক্তির নিজস্ব আবিষ্কারক, আত্মমগ্ন ব্রহ্মজ্ঞানী শিবসত্তা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করে এবং সেই ব্রহ্মজ্ঞানকে (knowledge) রপ্ত করে সার্বজনীন করার (generalisation) চেষ্টা করে, অপরদিকে শিবপ্রেমী দক্ষ সেই ব্রহ্মজ্ঞান সুবিন্যস্ত করে গুছিয়ে তোলে ও বিশেষভাবে বহন করার (specialization) কাজ করে। দক্ষ (doxa) গ্রিক ভাষার এই শব্দ যা knowledge–এর বিপরীতার্থক, যার রেশ রয়ে গেছে ইংরেজির orthodox শব্দের ভেতর; দক্ষ শব্দটি বর্তমান ইংরেজি ভাষায় specialist, expert অর্থে ব্যবহৃত। দক্ষ কোনো ব্যক্তিবিশেষ বোঝায় না, দক্ষ হল এক সামাজিক সত্তা। মানবসভ্যতার অর্জিত ব্রহ্মজ্ঞান বা বিদ্যা এভাবেই বাহিত হয়ে অর্থাৎ পুনরাবৃত্ত হয়ে ব্যবহৃত হতে থাকলে তা বেদজ্ঞান বা বেদ (Veda) নামে পরিণতি লাভ করে। বৈদিক যুগের শুরুতে ব্রহ্মজ্ঞান ও বেদজ্ঞানের সমুচ্চয়ী দ্বৈতাদ্বৈত সম্বন্ধের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত ছিল এই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক শিবনীতি। অর্থাৎ বেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া, বিশ্বের সকল দেশেই আজও প্রচলিত এই প্রক্রিয়া, আবিষ্কারকের ক্রমবিকশিতমান জ্ঞান দিয়ে যার পুনর্নবীকরণ হতে থাকে।

তো মানুষের এই আদি ব্যক্তিপরিচয় কীভাবে আজ “ভুল পরিচয়”-এ পর্যবসিত হ’ল তারই খোঁজ করেছেন ব্রুস অ্যান্ড্রুজ, দিকনির্দেশ দিয়েছেন সেই প্রাকৃতিক পদ্ধতির যেখানে শোনা যায় বর্তমানের অধুনান্তিক কালখণ্ডে নিমগ্ন অভেদসূত্রের (Advaitism) অনুরণন, বাংলাভাষায় উত্তরাধুনিক ধারণার প্রবক্তা সমীর রায়চৌধুরীর ভাষায়, “একবৈধ ব্রহ্মময়ীর শনাক্তকরণ আর বহুবৈধ রূপময়তার সম্পর্কয়ায়ন”[৫] যেখানে রাবীন্দ্রিক অনুরণন─

বাহিরের সঙ্গে ভিতরের একটা যোগ আছে বটে, কিন্তু সে যোগ অনুরূপতার যোগ নহে; বরঞ্চ দেখিতে পাই, সে যোগ সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ্যের যোগ। দুই মিলিয়া আছে, কিন্তু দুইয়ের মধ্যে মিল যে কোনখানে তাহা ধরিবার জো নাই। তাহা অনির্বচনীয় মিল; তাহা প্রত্যক্ষ প্রমাণযোগ্য মিল নহে।… এই-যে ‘আমি’ বলিতে যাহাকে বুঝি তাহা বাহিরের দিকে কত শব্দ গন্ধ স্পর্শ, কত মুহূর্তের চিন্তা ও অনুভূতি, অথচ এই সমস্তেরই ভিতর দিয়া যে একটি জিনিস আপন সমগ্রতায় প্রকাশ পাইতেছে তাহাই ‘আমি’ এবং তাহা তাহার বাহিরের রূপের প্রতিরূপ মাত্র নহে, বরঞ্চ বাহিরের বৈপরীত্যের দ্বারাই সে ব্যক্ত হইতেছে। …বিশ্বরূপের অন্তরতর এই অপরূপকে প্রকাশ করিবার জন্যই শিল্পীদের গুণীদের এত ব্যাকুলতা। এইজন্য তাঁহাদের সেই চেষ্টা অনুকরণের ভিতর দিয়া কখনোই সফল হইতে পারে না।[৬]

বর্তমানের পণ্যনির্ভর ধনতান্ত্রিকতায় কবিকথিত এই ‘আমি’-র শনাক্তকরণ (identification) ও পরিপার্শ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কায়নে সামঞ্জস্যের অভাব আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় অ্যান্ড্রুজের “ভুল পরিচয়”-এর সামনে, যার ভিত রচিত হয়েছিল মানবসভ্যতার যাত্রাপথের শুরুতে। একদিকে যখন সমাজ-সংহতির ক্ষেত্রে শিবতার নীতি অনুসরণ ক’রে যৌথসমাজ চলছে, অন্যদিকে তখন দক্ষতার নীতি অনুসরণ করে উৎপাদন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। এক একটি দক্ষ গোষ্ঠীর কিছু কিছু উৎপন্ন উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছে অথচ বিনিময় প্রথার প্রচলন নেই সমাজে। এমতাবস্থায় প্রাচীন ভারতে দক্ষযজ্ঞের মহাসংগ্রাম ঘটে। ফলত দক্ষযজ্ঞের পর আবিষ্কৃত জ্ঞানের বাহক বা বেদবাহক দক্ষসত্তার সুপ্রিমেসি সনাতন যুগ পেরিয়ে আদিম সমাজতান্ত্রিক বৈদিক রাষ্ট্রের সূত্রপাত করে। দক্ষ (specialist) কর্তৃক পরিচালিত রাষ্ট্র দক্ষিণপন্থী (দক্ষিণ=right) হয়ে পড়ে, যেখানে মানুষের ব্যক্তিপরিচয়ের ভেতর বেজে ওঠে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয়ডঙ্কা, যেখানে বামপন্থী বা শিবপন্থী তার যজ্ঞভাগ পায় না। কিন্তু শিবসত্তার আবিষ্কারের উপনদী এসে প্রচলিত জ্ঞানধারায় যোগ না দিলে দক্ষ-বাহিত জ্ঞানধারা শুকিয়ে যাবার উপক্রম হয়। সেই কারণে দক্ষ শিবের আবিষ্কার আত্মসাৎ করে প্রাণ বাঁচায়, অথচ শিবকে তার মর্যাদা আর ফিরিয়ে দেয় না বরং শিবের সঙ্গে তঞ্চকতা শুরু করে অর্থাৎ যাকে আজকের বর্তমানের ভাষায় বলা যায় বামপন্থী (leftist) ও দক্ষিণপন্থীর (rightist, conservative) বিরোধ। সেই সর্বপ্রথম মানুষে মানুষে ভেদের সূত্রপাত; আদিকাল থেকে আগত যৌথ মানবসমাজ বিভাজিত হতে শুরু করল। বর্তমান পৃথিবীর যা কিছু সমস্যা, বিপদ বা ক্ষতি, তার মূলে আছে সমস্ত দেশেই সমাজপতির আসনে বসা দক্ষসত্তার এই ভূমিকা।

একজনের অভাব অন্যের উদ্বৃত্ত দিয়ে পুরণের জন্য শুরু হয়েছিল পণ বা চুক্তি রেখে বিনিময় প্রথা। কিন্তু এই উৎপন্ন ‘স্বাধীন’ হতে পারে না, যতক্ষণ না যৌথসমাজের নিয়মের নিগড় থেকে মুক্তিলাভ ক’রে উৎপন্ন পণ্যে (commodity) পরিণত হচ্ছে। মানুষকে বোঝানো হল ‘স্বাধীন-উৎপন্নের-ধারা’ বা পণ্যধারা (গঙ্গাধারা=commodity flow) প্রবাহিত হলে সে তার কর্মফল (পরিবর্ত বস্তু, টাকা ইত্যাদি) পাবে। অর্থাৎ বর্তমানের অর্থনীতির ভাষায় ওই পণ্যধারায় বা গঙ্গাধারায় স্নান করলে ‘সাধারণ-পরিবর্ত’ রূপে ‘পবিত্রতাসম্পাদক-পদার্থ’ (=পুণ্য বা virtue) বা অর্থ (=money) অর্জন করবে। সেই বৈদিকযুগ থেকেই ক্রমে জনমানসে দর্শনের বদল ঘটল─ অখণ্ড আধ্যাত্মিকতা থেকে খন্ডদর্শনের প্রাদুর্ভাব হল। সমাজে উৎপন্ন আছে কিন্তু বিনিময়ের জন্য বা পণ করার জন্য কোনো পণ্য নেই, সেই পণ্যজাত পুঁজি হল লক্ষ্মী-পুঁজি। আদিম যৌথসমাজ থেকে পরবর্তীকালে ব্যক্তিসাতন্ত্র্যবাদী সমাজে উত্তরণকালে কেবলমাত্র বিনিময়ের উদ্দেশ্যে পণ্য উৎপাদন ক’রে তাকে commodity-তে পরিণত করা হল, যে পণ্যজাত পুঁজি হল কুবের-পুঁজি, বর্তমানের ভাষায় যাকে বলা হয় capital. এই পুঁজি বা সামাজিক-উদ্বৃত্ত নিয়ে কী করা উচিত তা সেই প্রাচীনকালের সভ্যতার সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তাই কলিম খান বলছেন, “আমরা এমন এক ধরণের মানব-সমাজে বা ঝাঁকে বাস করি, যেখানে দক্ষনীতি অনিবার্য, অতএব সম্পদের পুঞ্জীভবন অনিবার্য, পুঁজিভরা ফোঁড়ার টনটনানি অনিবার্য, সেই টনটনানি থেকে মুক্তির দুরাশায় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য… অতএব ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’”[৭]।

স্বাভাবিক কারণেই যে ব্যক্তির হাতে পণ্যের মূলশক্তিরূপে আদি গৌরব (science and valour) ছিল, এবং তা নিয়ে মনের অহঙ্কার ছিল; তার সেই মনের-অহঙ্কার (প্রকৃতিগুণ) এবার বুদ্ধির-অহঙ্কারে (পুরুষগুণ) পরিণত হ’ল। ‘আমি এটা বানিয়েছি’ এই অভিমানাত্মক বোধ বা আমিত্ববোধ জন্মালে উৎপন্ন (পুরোডাশ=product) পণ্যে (commodity) পরিণত হয় এবং ব্যক্তিমালিকানা পূর্ণ রূপ পেয়ে আবির্ভূত হয়ে যায়। অর্থাৎ শুরু হয় ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা (capitalist society) যেখানে কাজ হয় যৌথভাবে, অথচ ফল ভাগ হয় ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়মে। কলিম খান যথার্থই বলেছেন, “আধুনিক ও মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা যে এতদিন ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা ওড়াচ্ছিলেন, আমাদের ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা বিষয়ে এত কথা বলছিলেন, সেরকম বিশুদ্ধ ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা বিশুদ্ধ ব্যক্তিমালিকানা বলে সমাজে কিছু হয় না”, কারণ মানুষ মাত্রই ঝাঁক-প্রাণী, তার পক্ষে কোনদিনই যৌথব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা একেবারেই অসম্ভব। শুধু প্রয়োজন দুটো ব্যবস্থার ভেতর সামঞ্জস্যবিধান, যার অভাব আজকের দুনিয়ায় আমাদের ব্যক্তিপরিচয়কে ভুল পরিচয়ে পর্যবসিত করেছে, যার বিরুদ্ধে অ্যান্ড্রুজের কণ্ঠ গর্জে উঠেছে তাঁর এই কবিতা সিরিজে।

আমাদের পরমাপ্রকৃতি এই সামঞ্জস্যবিধানের নমুনা রেখেছে আমাদের পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতির মধ্যে, যেখানে পৃথিবীর নিখুঁত আত্মকেন্দ্রিক গতিই তাকে সূর্যের চারিদিকে ঘোরায়। সুতরাং এমন আত্মকেন্দ্রিকতাও সম্ভব, যাতে সার্বজনীনতার সাফল্যও নিশ্চিত হতে পারে। এই উৎপন্ন বা পুরোডাশের সঙ্গে অ্যারিস্টটলের poetics সংক্রান্ত সেই বহুবিতর্কিত Katharsis ধারণার purify, purgation এর তুলনা টানা যায়। যৌথসমাজে দক্ষনীতির অনুসরণে বস্তুর ভেতর শ্রম (মার্কসীয় labour) ও মেধা (দেকার্তীয় rationality) পুরে দিয়ে শুরু হয়ে গেল পুরোডাশ তৈরি (production) এবং তার সঙ্গে বিনিময় (exchange) প্রথা জুড়ে শুরু হয়ে গেল পণ্য-ত্যাগ বা পণ্য-বিনিময়। সমাজপতিরা আভাস পেলেন যৌথব্যবস্থা ভেঙে পড়ার। তাই এই পণ্যকে পুরীষ বা মল বলে নিন্দা করতে লাগলেন। বিধান দিলেন, কেবলমাত্র নিজের তৈরি করা উৎপন্নই ভোগ করা উচিত, অন্যের উৎপদিত মাল (শব্দার্থভিত্তিক অর্থ─ মল জাত মাল) নিয়ে আপন মাল মনে করে ভোগ করা উচিত নয়। আর দক্ষপন্থীরা (পণ্যপন্থী) বোঝাতে লাগলেন, আমরা তো দিচ্ছি আমাদের উদ্বৃত্ত, সমাজদেহের আবর্জনা সাফ করে (purgation) সমাজকে পবিত্র (purify) রাখতে। কালে কালে এই ধারণার জয় হতে লাগল, যা থেকে জন্ম হল পুণ্য, পবিত্র (to ease oneself of, to defecate) এইসব ধারণা। ব্রুস অ্যান্ড্রুজের সহযাত্রী চার্লস বার্নস্টাইনের কয়েনেজ “Official Verse Culture”[৮] এই মাল-এর ভেতর normal এর ধারণাকে কে পুরে দিয়ে শুরু করে দিল normalization প্রক্রিয়া, যার বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁদের কণ্ঠ শোনা যায় ভাষাকবিতার অঙ্গনে।

এই ভাষার ভিত রচিত হয় শব্দ দিয়ে। কলিম খান বলছেন শব্দ হল ‘শব দান করে যে’ বা ‘মনোভাবের শব দান করে যে’ কিংবা ‘ঘটনা বা ক্রিয়া অতীত হলেও তার যে মৃতদেহ আওয়াজ রূপে চাউর হয়ে থাকে’ তাকেই শব্দ বলে। প্রকৃতি মানুষকে যে নিয়মে কথা বলায়, তাকে ক্রিয়াভিত্তিক বা গুণভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে সংস্কার করেই সংস্কৃত ভাষা (Sanskrit), পৃথিবীর আদিমতম ভাষার জন্ম হয়েছিল, যেখানে প্রতিটি শব্দই বহুরৈখিক। যেসকল বর্ণ দিয়ে শব্দ বানানো হয়েছিল, সেই বর্ণগুলো নির্দিষ্ট ক্রিয়া বা গুণের ধারক। তাই শব্দমাত্রই নির্দিষ্ট গুণ বা গুণাবলিকে বোঝাত। কিন্তু আদিম সভ্যতার সূচনালগ্নে দক্ষনীতির অনুসরণে বৈদিক সমাজে পণ্য বিনিময় প্রথা শুরু হ’লে শব্দের জগতে শুরু হ’ল বিপর্যয়। পণ্য উৎপন্ন হয়েই তার মালিকের খোঁজ করল আপন গৌরবের মূল্য নির্ধারণে─ “Could commodities themselves speak, they would say…The owner must, therefore, lend them his tounge…”[৯] ইন্দ্রস্ত্রীপতি (industrialist) অর্থাৎ industry (ইন্দ্রস্ত্রী)-র আদি পুরুষ ইন্দ্রর কাছে পণ্য তার জিভটা ধার করল নিজের দাম বলার জন্য। সুতরাং ইন্দ্রের ওপর ভার পড়ল বিনিময়ের প্রতীকিভাষা (logo-centric language) সৃষ্টির। পণ্যবিনিময় প্রথায় একটি শব্দে অনেকগুলো বস্তুকে বোঝালে সেই বহুরৈখিক ভাষায় আর যাই হোক পণ্য বিনিময় চলে না। সুতরাং শুরু হল একই কর্মের পুনরাবৃত্তিমূলক দক্ষনীতির রূপান্তরিত মৌলবাদী (fundamentalist) জীবননীতি, যেখানে বহুরৈখিক শব্দের যেকোনো একটিমাত্র গুণকে বারংবার উল্লেখ করে পূর্বসূরির বহুরৈখিক (dianamic) শব্দসম্ভার একরৈখিক (static) শব্দসম্ভারে অধঃপতিত হল। এই একরৈখিকতা থেকেই জন্ম হয় বদ্ধ (close-ended) মানসিকতা, যা বৈধতার (normative) সীমা নির্ধারণ ক’রে মানবসমাজে সর্বপ্রথম মানুষে মানুষে ভেদের সূত্রপাত ঘটাল, যার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ব্রুজ অ্যান্ড্রুজের।

সংস্কৃতে অর্থ─ meaning (মানে) ও money (টাকা) দুই অর্থেই ব্যবহৃত। অর্থ= √ঋ+থ(থন), ঋ থাকে যাতে তাই অর্থ। নিরুক্তমতে─ ঋ ধাতুর অর(or=বিকল্প)+স্থা ধাতুর থ অন(=on)। অর্থাৎ বিকল্প গতি থাকে যাতে তাই অর্থ─ তা মানসগতি (= meaning) বা দৈহিকগতি (=money) দুটোই হতে পারে। যা কিছু অর্থকরী বস্তু জনন করে, যার পেছনে আমাদের চেষ্টা কাজ করে, তাই অর্জ্জন। meaning ও money দুটোই অর্জিত বস্তু। কিন্তু সমাজের নানা বিভাজন, বিধিনিষেধ একদিকে যেমন white money ও black money-র জন্ম দিল, তেমনি প্রাচীন ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ ক্রমে logos-এর একরৈখিক মানেতে পরিণত হতে থাকল। তথাকথিত সভ্যতার অগ্রগতি মানসিক ও দৈহিক এই দুই অর্জনের ভেতর সেতুকে ভেঙে দিয়ে meaning এর ভেতর money-কে পুরে দিল─ কাব্যজগতে প্রাতিষ্ঠানিক কবিতা সংস্কৃতির সেই মূলমন্ত্র, যেখানে কবিতার অর্থ (meaning) পাওয়া গেলে হাতে অর্থ (money) পাওয়াও সম্ভব! কবিতার এই ‘অর্থ জাত অর্থ’ (money from meaning) থেকেই কি “সমাজস্বীকৃত মান” (=অ্যাকাডেমি পুরস্কারের) জন্ম? ব্রুস অ্যান্ড্রুজ এই একরৈখিক বা close-ended মালিকানাভিত্তিক শব্দার্থের বিরোধিতা করে নীরাজনবোধকতার[১০] (open-endedness) কথা বলেন, যেখানে নীর জাত নীরজ অর্থাৎ ব্যক্তিগত পণ্য নির্গত হয়ে ঈরণ করছে বা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, যা রক্ষণকামিতার ফলে সৃষ্ট ভেদমনস্কতার বিরুদ্ধে এক অভেদমূলক অবস্থান গড়ে তোলে। ফলত পাঠকৃতির অর্থ নিরূপণের (making meaning) মানদণ্ডের (standard/value) গভীরে থাকে জীবনমনস্কতা অর্থাৎ অখণ্ডমূলক মনন-বৃত্তি জাত মান (faculty of mind) এবং খণ্ডমূলক বুদ্ধি-বৃত্তি জাত মানের (faculty of intellect) ভেতর সুসামঞ্জস্যবিধান─ যা ঘোষণা করে স্ববিরোধী বাস্তবতার সঙ্গে সতত চলমান বিক্রিয়ায়, বিশ্বের সাথে সতত পরিবর্তনশীল সম্পর্ক নিয়ে, বাস্তবতার কোয়ার্ক ও অ্যান্টিকোয়ার্কের দোলাচলে, ভাষার অবিরাম সম্মেলনে উৎসারিত ভাষাকবিতার নতুন চলনের মন্ত্র। ব্যক্তিপরিচয়ের সেই মন্ত্র একদিকে যেমন বিশ্বের অপরিসীম বৈচিত্র্যের মধ্যে আপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে চিনে নিতে পারে, তেমনি অন্যদিকে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে, অপরের (other) সঙ্গে সম্পর্কায়ন করতে গিয়ে আপন শ্রেষ্ঠত্ব কমিয়ে নিতে দ্বিধা করে না। সত্তার সেই চেষ্টাই সুন্দরের মূল, সাম্যের ধর্ম।

কবি যা করেন, ‘তা’ কবিতা আর পাঠক কবির ‘তা’ দেওয়া শব্দলিপিতে তরিয়ে যায়। কবি ও কবিতার এই-ই সম্পর্ক। একই space-time-এ বিদ্যমান। কবিতা কবিকে চেনে না কিন্তু কবি চেনেন তাঁর কবিতাকে। কবি পাঠককে নিয়ে যেতে চান কবিতার সেই নিজস্ব সময় ও পরিসরে, স্পর্শ করতে চান পাঠকের চেতনার পরিসর। তাই ব্রুস অ্যান্ড্রুজ পাঠক-কেন্দ্রিক লেখনপদ্ধতির কথা বলছেন, যেখানে পাঠকের অভিজ্ঞতার নতুনায়ন হয় অভিন্নতার (sameness) বিপরীতে পার্থক্যের (difference) মধ্যে দিয়ে অর্থাৎ পাঠকের প্রচলিত পরিচয়ের (identity) বিপরীত অবস্থানের পরিচয়, যাকে অ্যাদর্নোর ভাষায় non-identity বলা যায়, যেখানে তাঁর negative dialectics এর ধারণা। neg[ative]: ative─ ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হ’লে ক্রিয়াসম্পাদনের ক্ষমতা বোঝায়; dialectics শব্দটির উদ্ভব গ্রিক dialektikē থেকে, যেখানে ektikē অতিক্রমণের কথা বলে। অর্থাৎ এই নেতিবাচক দ্বান্দ্বিকতা প্রচলিত ডিসকোর্সের না-করণ, অ্যাদর্নোর ভাষায় “the dialectics not of identity but of non-identity”[১১] যা হ’ল অভিন্নতা নামক মিথটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তথাকথিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতায় সত্তার স্ব নিজেকে বিশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে গড়ে তোলে সেই অপর, যাকে সে নির্বাসন দেয়─ মার্কসবাদের শোষক-শাসিত সম্পর্ক, যা আধিপত্য নিশ্চিত করতে একে অন্যকে দাবিয়ে রাখে। অ্যাদর্নোর নেতিবাচকতা এই একরৈখিক চলনের বিপরীতে এক বহুরৈখিক সম্ভাবনার ইতিবাচক উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, যেখানে শোনা যায় অন্য বা অপর স্বর (other voice)। এই অপর কণ্ঠস্বরই হ’ল ব্যক্তির নিজস্ব স্বর (self-voice) যা অন্যের কাছ থেকে শোনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হয়; যা প্রতিফলিত হয় যুক্তি তক্কোর (discourse/counter-discource) মাধ্যমে এবং তাকে নিশ্চিত উপলব্ধি করতে হয় আপন ধ্যানে জ্ঞানে গভীর চিন্তায়। একজন ব্যক্তির এই আপন স্বরকেই অ্যান্ড্রুজ ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় বলে মনে করেন যা কখনই অন্য কারোর পরিচয়ের ভিত্তিতে রচিত হতে পারে না।

বারীন ঘোষাল বলছেন, বর্হিজগতের সঙ্গে মানুষের শিক্ষা ও সংস্কার অনুযায়ী বুদ্ধিগত বা ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার ফসল জমা হতে থাকে মগজে এবং কবিতা হ’ল সেই অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপ। আবার অভিজ্ঞতা বিমূর্ত হতে পারে না। তাই মূর্ত অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপ পাঠকের চেতনায় মূর্ত হয়ে উঠলে কবি ও পাঠকের মধ্যে কমিউনিকেশন সম্ভব। ভাষাকবিতায় রেফারেন্স লোপাট ক’রে লেখন তার শব্দকে বস্তু (material) হিসেবে উপস্থাপিত করেছিল, যেখানে অক্ষরধ্বনি এবং চিহ্নকরণের সম্পর্ককে অপ্রতিভ করাই ছিল উদ্দেশ্য। বলা হয়েছিল পাঠকৃতি যেন নিজেই অর্থ উৎপাদন করে এবং শব্দধ্বনি ও শব্দবিমূর্তি পাঠ অভিজ্ঞতা গড়ে তোলে। ব্রুজ অ্যান্ড্রুজ তাঁর রেফারেন্সের পলিটিক্স (“politics of the referent”) নিয়ে খোঁজ করেছেন এক নতুনতর প্রক্রিয়া, যেখানে ধ্বনি ও সিন্ট্যাক্সের নতুনতর প্রয়োগ, যেখানে চিহ্ন ও চিহ্নকের, বস্তু ও বস্তুগুণের পাশাপাশি অবস্থান, যাকে অ্যান্ড্রুজ বলছেন “materiality of the signifier.” ফলত অর্থ ও রেফারেন্স সম্পূর্ণ লোপাট না হয়ে ভাষাগত রেফারেন্সের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে। কবি ও পাঠকের মাঝে রচিত হয়েছে ডায়নামিক ইন্টার‍্যাকটিভ স্পেস, যেখানে নিরন্তর চলে action ও reaction এর আন্তরক্রিয়া, অ্যান্ড্রুজের ভাষায় “reader in motion”, যার মাধ্যমে পাঠক নিজেদের ফ্যান্টাসি, আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগগুলো প্রকাশ করতে পারে। কবিতার শব্দগত উপাদান পাঠককে নিয়ে যায় এক সংবেদনশীল বিজড়নে, ট্রিগার করে পাঠকের imagination. কবির কম্পাঙ্কে অনুরণিত পাঠক স্বয়ং শুরু করে তার নিজস্ব নির্মাণ। কবিতা কোনো বিনোদন সামগ্রি নয়, পাঠক তার নিষ্ক্রিয় ভোক্তা (consumer) নয়, বরং অর্থ উৎপাদনে সেও অংশগ্রহণ করে যাকে ব্রুস অ্যান্ড্রুজ বলছে reader’s active participation. অর্থাৎ কবিতার ‘আমি’-কে ছাপিয়ে, ভাবনার সার্বিক দখলদারিত্ব অগ্রাহ্য ক’রে ব্যক্তিমালিকানার উত্তরণ ঘটছে যৌথমালিকানায়। এইখানে ব্রুজ অ্যান্ড্রুজের কবিতা ভাবনার সঙ্গে বাংলার “নতুন কবিতা”র কাব্যতত্ত্বের অনুরণন।

মার্কিন প্রশাশন ও বানিজ্য সমাজের মালিকানাবোধে ফাটল ধরিয়ে তার উল্টোমুখে অ্যান্ড্রুজের এই পদ্ধতির মননশীলতা। ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক পদ্ধতি কেবলমাত্র কিছু পূর্বনির্দিষ্ট মোডে প্রোগ্রাম করা সীমিত পাঠকবর্গের জন্য একটা সুরক্ষার আবহ তৈরি করে, যেখানে পাঠকের দায়বদ্ধতাও সীমাবদ্ধ। পরিবর্তে অ্যান্ড্রুজ একটি ভিন্ন মুক্ত পরিসরের কথা বলছেন, “free range reader— in motion, taking responsibility, self-reflexively & off the grid, it confirms an experiential status quo.”(ref:3) তিনি প্রশ্ন তুলেছেন─ মার্কিন বহুজাতিক পুঁজি, পণ্যভোক্তা ও ভোগবাদ বা উদারবাদী বহুত্ববাদ যথেষ্ট বলে যে দাবি করা হয়, তা কাদের জন্য যথেষ্ট? একটি নির্দিষ্ট বা সীমিত, রিজিড বা সংকীর্ণ অফিসিয়াল ভাবকাঠামোর ভেতর একজন ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রকৃত স্বরূপ বা তার identity নির্ণয় করা সম্ভব নয়. তা হয়ে ওঠে “ভুল পরিচয়”; প্রয়োজন এক মুক্ত পরিসর, যেখানে কবিতার কোয়ার্ক সম্ভাব্য পাঠকের আপন অভিজ্ঞতার আলোয় আলোকিত হবে।

আসুন পাঠক, এবারে তাঁর কিছু কবিতা পাঠ করা যাক─

ভুল পরিচয় (Mistaken Identity)

৫।

বয়ঃসন্ধি সঙ্গ ভালোবাসে — পাঁচমিশেলি সুর
কোটেক্স তির্যকতা হাইহিলকে প্রেমপ্রলুব্ধ করে
রোমিও মুরগি চটজলদি
মুহূর্তে মোরগশোষণে আমরা
সহানুভূতি শুকিয়ে যায়
খামখেয়াল — বন্ধু যেজন সেজন তোমায় গ্রাস করে
রূপমুগ্ধ ভাবনাহীন কাঠগুঁড়োর মিহি ক্ষত
আকস্মিক কামনা
গোপন রোমাঞ্চ বিছানায় টানে
খেলা বন্ধ করুন
হে ঊরুবিলাসিনী
ময়নাতদন্তই প্রেম ব’লে ভাবছেন?!
কুরূপ কেন কামোত্তেজকের কাজ করে না?
বহুবিধ ব্যক্তিত্বের ঠিক কোনটা আপনি তৈরি করতে চাইছেন বন্ধু
মেয়েলি প্রসঙ্গ – সহানুভূতি জঘন্য
মিষ্টিপ্রলেপে যৌনাকাঙ্ক্ষা, ঘোরানো চেয়ারে কন্ডোম
জিভ সেমিকোলন
পাগলাটে বিষাদ, রক্তচাপে ফুলে উঠছে মাথা
মোহগ্রস্ত বেড়ালছানা — ক্যালিফোর্নিয়াকরণ
স্বাদু কায়া — যাকে আমরা বলি ‘মেষপালন’
সতীচ্ছদের আকর্ষণ
ভি-ট্যাং
বিষদাঁতের সুড়ঙ্গ – সাময়িক মোহের ঠ্যালা
হৃদয়ভঙ্গকারী পাল্টায় না
ছুঁলেই যৌনাকাঙ্ক্ষা ভেঙে পড়ে
রেডিমেড চুমু, প্রেম বই কেনে
খামখেয়ালের সর, আপনার বন্ধুত্বের কার্বন-ডেটিং
১-৯০০ নিতম্ব
এগোনো ঠোঁট রোমাঞ্চিত বাক
কন্ডোম রসিক
বিবিধ — ঠোঁট শিয়াৎসু — ইন্দ্রিয়সুখের ঘের
প্রেমগলি, দুয়ো
কৃত্রিমকায়া কুলায়
প্রেম কটাক্ষে বীর্য, ভুলো-না-আমায় গুচ্ছ
তন্দুরি-সোয়াদমাখা তুলোর পট্টি, রাস্তায় মরা পশুর পরিমিতাহার বিধি
আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হয়?
অন্য যন্ত্রে লাগান ভগ্নহৃদয়, করুণার ফাঁদ
তবু বিদায় নিচ্ছি
স্বমেহন করুন, খোঁচা দিন এইখানে
আঁকড়ে ধরুন
অন্তরঙ্গতায় অনালাপী — মিউ
আমার মৌখিক বৃত্তি কই?
ওহো হয়তো — সঙ্গমের জন্য কিছুটা পক্ষপাত থাকতেও পারে
গোধূলিচেরা ক্লাব
পুরো পরিবার পছন্দ করবে
ভগাঙ্কুর ব্যাপক ধ্বংস
বোকা বোকা কথা বোলো না
যেন তুমি আমাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে
মিষ্টি মধুর মিশ্রণ, ঠোঁট যেন জাহাজঘাটা
জিপারে আইনগত অধিকারের প্রশ্ন
৯১১ নম্বর টেপা
আপনার রুমমেটের মতো লাগছে কি আমায়?
আপনার সহযোগীকে মাই দিন
আপনার প্রতিভা দিয়ে, একে অন্যের ওপর নির্ভরতার প্রয়োজন
বি-ঠোঁট, বিচারাধীন ভগ্নহৃদয়
ভায়াগ্রা ভ্যালেন্টাইন
উভলিঙ্গ ফ্যালোপিয়ন বেঢপ
বিছানায় টুপি খুলে রাখি
আমার পোষা চিড়িয়াখানা হয়ে উঠুন
কাগজ ঊরু, নিতম্ব আনুগত্য
আপনাকে সতর্ক করছিলাম না, যাচাই করছিলাম আমি

৪।

সৃষ্টিবাদী চুনি চপ্পল
পাজামা টেকিলা প্রেতের অগ্নিশিখা
উন্নত প্রযুক্তির তর্জনীতোলা — খুব সামান্য আহত মানুষেরা
জঘন্য গোলামি বস্তাবন্দী করে ছিটিয়ালদের
নির্যাতনের সঙ্গে প্রেমের ভান করো, যেকোনও ন্যাকামি চলবে
শঙ্কু নাক অনিশ্চিত – যাই হোক না কেন স্বস্তি দেয় না মোটে
মানিব্যাগে আত্মবিশ্বাস
সেপিয়েন্স ওরফে আস্থাহীন
ভাড়া করা হলোকাস্ট
বিপরীতমুখি জালতি পরান, ছুকরি সাহায্য করে
দ্বিভাষিক, ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি
ছালছাড়ানোয় ওস্তাদ
টর্পেডো বিশ্বে স্বাগতম
পাপা—ওওও—মাউমাউ
নিংড়ে নিন হুডিনি — ককটেল ফলক ইতিবাচক ঢিমেতাল
গোপন ধাপ্পাবাজি গাদায় ফেলুন
দোতলা চটকদারি ঘুরিয়ে দিন বিপক্ষে
আমি কি আপনার বলয়ে চেষ্টা করতে পারি,
আমি কি আপনার বন্দুকটা ব্যবহার করতে পারি?
উচ্চাশাহীন বুলেট-অভেদ্য ভেতর অথবা বাইরে যা কিছু
বেনযেড্রাইনের বিজ্ঞাপনী চটক
বিষাক্ত সাবধানতা
জ্যাজ হার্ট, সাইবার চামড়ার ঘুস
স্বার্থসিদ্ধি
ডিভা ষড়যন্ত্র
আপনি আমার মাথাটি খাবেন না প্লিজ
বিবর্তন আমার অন্তরে
হ্যাঁ — আস্থা আক্রমণ করে উপহারগুলো
আলিভাই চর্বি বানাতেই থাকে যতক্ষণ না ভুল দাগ পড়ে
পরিস্থিতির নজরদারিকমিটির সদস্য খ্রিষ্ট প্রতিদিন
নকশা করা ভাবালুতা, লক্ষ্য নবীনের দিকে
সুরক্ষিত বাইলাইনের সঙ্গে জীবসত্তা তা্লেগোলে
গোপন তথ্য ফাঁসকারী পাখির ছানা
জনতার ঘেরাটোপে আপনি, আমি
অপারেশন মঙ্গুজ ফরেনসিক চিনি
না, হাসপাতালের মতো পরিপাটি
ইচ্ছামৃত্যু বাড়িয়ে দিয়েছে, পুণ্য গর্ভবতী হয়
খুব বেশি নবীন কেউ নেই সেখানে, বড্ড লম্বা…
দারুণ উদ্যমে টাকার লেই হট্টগোল, সর্বকালের সবচেয়ে বড় খিঁচুনি
রক্সি প্রক্সি ছাত্রবৃত্তি আপনার মুখের জন্য
সম্ভবত কিটক্যাট ক্লাব — চলতে চলতে হঠাৎ উল্টোমুখী
রোম্যান্স করতে চায় প্রতিটা দাতব্য উপাদান
বিপদ রেডিমেড খুপরি কর্টেক্স
ছানা ও বাকি অংশ
অনুমাত্র আপনার
স্বাদু বানানোর রামধনু মুখের রক্ত তোলে, চোষ্য মার্কিনি
আপনি একটা জন্তু, আপনি একটা বোমা
মৃতে আসক্ত অকেজো অলংকার
বিবর্তন খাজনা দাবি করে

৩।

ক্ষতি আত্তীকরণ করুন
স্বচ্ছ ব্যায়যোগ্য মনোরম লগবগে ছন্দ
গো-গো রা-রা সমাধান পদ্ধতি
হেঁচকি তুলে সাদা চামড়ার হল্লা চুনকাম করে দিন
বাড়তি হাইপেনওয়ালা হুকুমদেনেওয়ালা সাদা চামড়া
রিনকন পেরেস্ট্রোইকা
আবর্জনা আবর্জনাই
গারদ
অ্যান্টি-ইউবু আমার অব্যর্থ সাথী
গোয়াগুয়াঙ্ক, পাবামুক্ত ইহুদি
মেক্সিক্যালি বুগালু ফুটফুটে ধাত্রীমাতা
দুধের মতো ধূসর, জিগিরতোলা নগ্নতা
ধানিলঙ্কা নাকি বন্ধুবিদ্যা
মসৃণ ও পিচ্ছিল
সমালোচিত
পাঙ্কগীত থেকে এত দূরে
আমাদাউ
ক্রীতদাসে গড়া ভিত আমায় ধ্বংস করে
গোলেমের মতো সাদা চামড়ার বেওয়ারিস
উঁচুদরের বাবালু সন্দেহজনক বহুরূপী
সর্বেসর্বা মনোভাব, উত্তর-বর্ণবৈষম্য
ফিরে আসা স্বরবর্ণ

২।

লুলু লুয়াউ
সাই-ফাই না হাই-ফাই?
ব্যাবিলনের হুলা
গুঞ্জন জোরালো করুন
খলনায়কের আশা, গীতিধর্মী ছুরি
মৃতদের জন্য তহবিল গড়ে তুলুন
মন্তব্য থেকে বিরত হোন— স্যার? — আমি বলছি, মন্তব্য থেকে বিরত হোন
মনরাখা দাওয়াই — মজাদার কুস্তি দেখার আসন
সেঁকেতোলা-যন্ত্র আকারে আবেগ
ভুট্টাক্ষেতের রোদরোধক কাস্ত্রো শিকার
কে দিচ্ছে খেসারত, খেলছে কে
অপেশাদারি দৌড়বাজি ষাঁড়খেপানো বেপরোয়া শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়
আমরা লোভনীয় টোপ, চলুন খাওয়া যাক
আপনার চারপাশে ঘুসোঘুসি চালিয়ে যান
ভাইরাসকে শুভেচ্ছা জানানো লক্ষ্যে পৌঁছোনোর সহজপথ
আশার আলো জ্বালিয়ে তুলুন
ব্যথানাশকেরা — বিনোদনকারীকে অনুকরণ করে
পিস্তলের বাঁট দিয়ে ঘা দিন
মোটেই গ্রাহ্য করবেন না
বাধ্য-করা ছুটিতে যান, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন
ধান্দাবাজদের ঘা-খাওয়া গঠনবিন্যাস
টাই-ডাই করা ইস্করা — আমাকে ডুবিয়ে দিল
সেইসব সরেস হতচ্ছাড়া বেআইনি প্রচারপত্রগুলো
বিকাশ-কত্তারা শুষে নেয়
আমি একটা মালবাহী উড়োজাহাজ ভাড়া করতে যাচ্ছি

১।

পরিস্থিতির একটা পরিস্থিতি থাকে
বৈদ্যুতিক শকের মতো মতামত আমাদের গ্রাস করে
ডলারিকরণের নোংরা কিনার, অর্থের পাণিপীড়ন, গবগবে অর্থ
লাভের সূচক মার্কিন ক্রিম, শকুনদের স্বপ্নের সংস্কৃতি
একটি সামাজিক বিড়ম্বনা, ক্ষতিগ্রস্থরা নিজেকে গুটিয়ে নেয়
জেলিফিশ এফবিআই — আপনি কি পণ্যবিক্রির মেশিন?
মুক্তি পাবার লড়াই কারা করে? শোষিতদের তবু একটা ভবিষ্যৎ আছে
চকচকে নৈতিকতা, কর্পোরেট বিশ্বব্যাপী প্রিয় মাংসফালি
পতাকা হারায়, অনুকরণের মান পুলিসের লাঠি নিয়ে আমার পেছনে খোঁচা দেয়
যুক্তরাষ্ট্র, গুলিভরা বন্দুক চুষতে থাকুন
পাল্লা দেওয়া স্বর্ণকেশী মডেল — জোলোফ্ট, প্যাকসিল, লুভক্স, সেলেক্সা
টাকার প্রয়োজন? — এ খুব সহজসাধ্য, অতিসাধারণ
আন্তর্জালের বিনামূল্যলোভী লিঙ্গত্বক বিদায়
গরমাগরম দামবাড়ানো অলস বাবুটি প্রদর্শনীতে
*
মানুষ হিসেবে আপনি একজন শ্রম-এড়ানো কৌশল
সংস্কৃতি, প্লিজ — কেউই ধর্মপ্রচারক নয়
কুকুর-ঘুমের কড়াডোজের ওষুধ — মতবদলের জন্য পুনঃশিক্ষা বন্ধ করে
বাস্তুতন্ত্রের সেবক
রকেটের পরোয়ানাজারি এত উদ্বেগের
আত্মনিক্ষেপের পিএফসি সিম্মি নাচ
ধারালো ছুরি, মশলাদার ক’রে তুলুন — এর জন্যই মরুন বাঁচুন
মহারাজের জয় হোক
ভবিষ্যৎ সেলাই করে ভাতা-পাওয়া তোতলামি
আপনার নিরাপত্তাহীনতাই আপনাকে হিংসুটে ক’রে তোলে
কদর্য অনুকরণ — আপনি ঝাঁকুনি খান, ভুলে গেছেন আপনার পিস্তল
পোষ্য ঝলসে বনভোজন — বন্ধ করুন
দখলদারি বিরূপতা হড়কে যায়
আপনি রাখাল আর আমরা গরুছাগল
আর স্ক্রুজ ম্যাকডাক
আভিজাত্যহীন চোখামন্তব্যকারীর জ্বালাতন
শোনো প্রিয়, আমরা এটাকে নিস্ক্রিয় পশ্চাদ্‌গমন বলি
অপরাধ দৃশ্যের ময়লা — রঙ্গালয়ের চাঁদনিতে ফক্সট্রট নাচ
বাবুবৃত্তির জাল — নিভে গেল খ্রিস্ট সেধে
সংস্কৃতি মৃত, প্রোগ্রাম রচয়িতা নিরাশ, পূর্বপ্রলাপ ইন্ধনের সলতে পাকায়
টাকার থলে সেজে উঠছে
পুলিশের পয়সা শয়তান
এমন প্রাসঙ্গিক যে্ন ফোয়ারা হয়ে ছিটকে পড়ে
বৃত্তিসহ বীজগুটি — অপারেশনের আগেই মিটমাট
ব্যাঙ্কব্যবসায় আরও কিছু প্রধানের জামিনজারি
বিপরীতবাদীরা পেল মাদক নগদ
অছিরা বিলাসিতার জগতে
চুক্তিপত্র আমাদের অধিকার পুনরাধীন করতে চিৎকারিল
প্রিস্টিনা — তার ওপর আমাদের কাজগুলো ঘষে তুলল
রেড আর্মি ঘোঁট পাকাল — শাবাশ সংঘসদস্যগণ
যত বেশি প্রতিক্রিয়াশীল ও বোকা, তত বেশি জনপ্রিয়
গিলোটিনে গলা দেওয়া স্বেচ্ছাসেবীরা — পুলকিত
গলাদ্ধকরণ করুন সবা্র-জন্য-উন্মুক্ত, ক্ষণস্থায়ী পরিচালনার আসনে
নিমজ্জিতগণ
আমরা কেবল এটা সহজ করতে চাই
ক্ষমতাশালীরা আর দালালেরা, বড্ড বেশি বটিকা
পক্ষপাতী হামলার জন্য নগদ খুব দ্রুত বারোটা বাজিয়েছে

_____________________________________________________

কবি পরিচিতি :

মার্কিন ভাষা-কবিতার অঙ্গনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় কবি ব্রুস অ্যান্ড্রুজ। জন্ম ১৯৪৮ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে। বাল্টিমোরের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলার ও মাস্টার ডিগ্রি করার পর হার্ভাড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। ১৯৭৫ সালে নিউইয়র্কে এসে ১৯৭৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ফোর্ডহাম ইউনিভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সে শিক্ষকতা করেন এবং বর্তমানে ফোর্ডহাম ফ্যাকাল্টি মেম্বার। বর্তমান নিবাস নিউজার্সি শহরে। নিউইয়র্কে ১৯৭৫ সালে চার্লস বার্নস্টাইনের সঙ্গে শুরু করেন L=A=N=G=U=A=G=E পত্রিকার সম্পাদনা। ব্রুস অ্যান্ড্রুজের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ প্রায় তিরিশ: Edge (Washington, D.C.: Some Of Us Press, ১৯৭৩); Acappella (Ghost Dance no.17, Fall, ১৯৭৩); Corona (Providence: Burnng Deck, ১৯৭৪); Vowels (Washington, D.C.: O Press, ১৯৭৬); Film Noir (Providence: Burning Deck, ১৯৭৮); Praxis (Berkeley: Tuumba Press, ১৯৭৮), I Don’t Have Any Paper So Shut Up (Or, Social Romanticism) (১৯৯২) ইত্যাদি এবং সাম্প্রতিক কালে Swoon Noir (২০০৭); Designated Heartbeat (২০০৬); Lip Service (২০০১); প্রবন্ধ সংগ্রহ : Paradise & Method: Poetics & Praxis (১৯৯৬). বর্তমানে তিনি “Sublime in Aesthetic Theory” নামে নন্দনতত্ত্বের ওপর গবেষণা করছেন যা ভাষাকবিতার ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক লেখনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করেন। এই সব্যসাচী কবি একইসঙ্গে বহুমুখী নান্দনিক কর্মে যুক্ত। আলবান বার্গের LULU অপেরার নৃত্য-সংস্করণ করেছেন কোরিওগ্রাফার স্যালি সিলভার্স যার নাম ‘Pandora’s Cake Stain.’ অ্যান্ড্রুজ বর্তমানে এই কোরিওগ্রাফির সঙ্গে শব্দধ্বনির ডিজাইনের কাজ করছেন। এখানেই শেষ নয়, UPSTAGE নামে কবিতা ও ফটোগ্র্যাফির কোলাবরেশন প্রজেক্টেও কাজ করছেন ফটোগ্র্যাফার স্যালি সিলভার্সের সঙ্গে, যেখানে কবিতায় বর্তমানের বিশ্বব্যাপী মহামারীর সংকেতগুলো সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন পোস্টার, স্টিকার, টি-শার্ট, স্টোর উইন্ডোতে ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যাংশ থেকে।

_____________________________________________

তথ্যসূত্রঃ

[১] L=A=N=G=U=A=G=E : The Complete Fascimile by Bruce Andrews and Charles Bernstein. Edited by Matthew Hofer and Michael Golston. Published by University of New Mexico Press, 2020.

[২] অতিচেতনার কথা (On Expansive Consciousness), বারীন ঘোষাল, কৌরব, জামসেদপুর, ইন্ডিয়া, ১৯৯৬

[৩] Essay: “Meaning, Method, Motive: Empire and so-called Language Writing”, Talk in Convolution, source: http://fordhamenglish.com/by-poetry-essays-interview-per

[৪] Mistaken Identity by Bruce Andrews, forthcoming, proposed graphic design by Dirk Rowntree.

[৫] উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ, সমীর রায়চৌধুরী, আবিষ্কার প্রকাশনী, কলকাতা, ইন্ডিয়া, ২০০২, পৃ: ১১৩

[৬] গদ্য: “অন্তর বাহির”, গ্রন্থ: পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ইন্ডিয়া, ১৯৪৭

[৭] বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান-কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, ভাষাবিন্যাস, ২০০৯

[৮] Bernstein’s Essay “The Academy in Peril: William Carlos Williams Meets the MLA”, collected in Content’s Dream : Essays 1975-1984 by Charles Bernstein, Los Angeles: Sun & Moon Press, 1985.

[৯] Capital by Karl Marx, Vol—1, Progress Publication, 1977, p-87

[১০] নীরাজনবোধক শব্দটির কয়েনেজ করেন বাংলার উত্তরাধুনিক চিন্তাধারার প্রাণপুরুষ সমীর রায়চৌধুরি

[১১] Lectures on Negative Dialectics by Theodor W. Adorno, 1965/1966, ed. Rolf Tiedemann, tr. Rodney Livingstone, Polity Press, 2008.

Facebook Comments

Leave a Reply