শংকরাচার্য্যের মায়াবাদ: ধারে কাটে কি ভারে! : রঞ্জন রায়
দ্বিতীয় কিস্তি
তাহলে সাপটা কোথায় ছিল আর কোথায় গেল?
সাপ ছিল আমার ভ্রমিত চেতনায় ক্ষণেক তরে। সঠিক জ্ঞান হতেই সে নেই হয়ে গেল। তেমনই এই মায়ার সংসার আসলে নেই, তাই কারও এসে সৃষ্টি বা ধ্বংস করার প্রশ্নটি এই মডেলে অর্থহীন। এ শুধু জন্মায় জীবের ব্যক্তিচেতনায় বিভ্রমের ফলে, তার আয়ু ওই আমাদের ভুল ভাঙা অবধি।
যেমন জাদুকরের জাদুতে মঞ্চে একটা হাতি দেখছি। আবার ম্যাজিকের মোহ বা আচ্ছন্নভাব কেটে যেতেই সেই হাতি মিলিয়ে গেল।
যেমন, কাদার তাল থেকে তৈরি হাঁড়িকুড়ি সব ক্ষণস্থায়ী ; যে মাটি থেকে এসেছিল ক’দিন পরে তাই হবে। এভাবে হাঁড়িকুঁড়িকে কাদার তাল হিসেবে দেখাটাই সম্যক দর্শন। ঠিক এভাবেই নামরূপের দুনিয়া আসলে ব্রহ্মের থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মেই মিলিয়ে যায়। মরুভূমিতে জল দেখাও ওইরকম। ব্রহ্মান্ডকে ব্রহ্মের থেকে আলাদা করে দেখাটাই ভুল বা বিভ্রম।
তাহলে মুক্তি কী? মুক্তির পথ কী? ঈস্বরের আরাধনা?
না; কারণ ঈশ্বরেরও কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। পুজোপাঠ, ভজনকীর্তন, আরাধনার মাধ্যমে ব্যক্তি নিরাকার পরব্রহ্মকে সগুণ ভাবে, ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা ভাবে। ওই দর্শন অদ্বৈতবেদান্ত নয়। ওতে দ্বৈতবুদ্ধি অর্থাৎ ঈশ্বর ও ব্রহ্মান্ড স্বতন্ত্র এই ভেদ থেকে যায়। সগুণ ব্রহ্ম উপাসকদের ভক্তিবাদ হল ঘুরপথ। ওসব অবান্তর।
মুক্তি বা মোক্ষলাভ হল পরব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধ হওয়া, তারজন্যে দরকার ভেদবুদ্ধি ছেড়ে জীবের ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদ বোধ। উত্তম পন্থা হল সোজা জ্ঞানমার্গের পথে সম্যকদৃষ্টি অর্জন। এই জ্ঞান অর্জনের জন্যে চাই শাস্ত্রের অধ্যয়ন।
পুজোপাঠের বদলে শাস্ত্রের অধ্যয়ন? কোন কোন শাস্ত্র? ধরুন ন্যায়শাস্ত্র(logic) পাঠে, মানে প্রত্যক্ষ অনুভব(perception) , আর তার ভিত্তিতে যুক্তির প্রয়োগে অনুমানের(inference) মাধ্যমে কি পরব্রহ্মকে জানা যায় না?
না; প্রত্যক্ষ অনুভুতির সত্য আসলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্যজগত বা পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সত্য। আর পরিবর্তনশীল দুনিয়া নিজেই ক্ষণস্থায়ী, কাজেই অসত্য। এই ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তিপরম্পরা শুধু ব্যবহারিক সত্যের ক্ষেত্রে খাটে, পারমার্থিক সত্যের অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়। তাই ব্রহ্মকে বা পারমার্থিক সত্যকে জানতে হলে শ্রুতি এবং স্মৃতিশাস্ত্রই একমাত্র নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ, বেদাদি শ্রুতি এবং মনু-পরাশর-যাজ্ঞবল্ক্য আদি স্মৃতির অধ্যয়নেই অজ্ঞান দুর হয়ে জ্ঞানের আলো দেখতে পাওয়া যায়।
অবিদ্যা কী? অবিদ্যা ও মায়া কী আলাদা? দুটোর কাজ কী?
অবিদ্যা হচ্ছে সেই দোষ যার জন্যে চেতনা মলিন হয়ে একমাত্র সত্য বস্তু ব্রহ্মের জায়গায় বাহ্যজগৎ বা মানুষ,পশু, উদ্ভিদ, পাহাড়,নদী ইত্যাদি স্থাবর ও জঙ্গম বিশ্বের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সত্য বলে মনে হয়। যেমন চোখের দোষে আকাশে দুটো চাঁদ দেখা যেতে পারে বা আজকাল থ্রি-ডি ফিল্মে উপযুক্ত চশমা না পরলে দু’তিনটে মাথাওলা মানুষ দেখা যেতে পারে তেমনই অবিদ্যার প্রভাবে সত্যির বদলে মিথ্যাবস্তুর দর্শন হয়।
অবিদ্যার দুটো কাজ। এক, আসল রূপকে আবৃত করা। যেমন মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দেয়। দুই, মায়াজালের মত কাল্পনিক কিছু সৃষ্টি করা।
যেমন সর্প-রজ্জু উদাহরণে বিভ্রান্তির ফলে দড়ির আসল চেহারা আবৃত হয়। তারপর সেখানে সর্প বলে এক ইমেজ সৃষ্টি হয় যা আসলে ওখানে নেই, যা পুরোপুরি কাল্পনিক।[৪]
অবিদ্যা ও মায়া একই প্রক্রিয়ার দুটো অংশ। অবিদ্যার ফলে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, সত্য আবৃত হয় আর তার জায়গায় যা দেখতে পাওয়া যায় তাই হল মায়া।
অবিদ্যা হল অনাদি, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ে অবিদ্যার নাশ হয়। চেতনার মলিনতা ধুয়ে গিয়ে সমস্ত কিছু ব্রহ্মময় জ্ঞান হয়। যেন কুয়াশা সরে গিয়ে রোদ উঠল, আর মায়ার দুনিয়াটা ‘কোথায় বা কি ভুতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে’।
মায়াবাদের দার্শনিক কাঠামোঃ কিছু সমস্যা
শংকরাচার্য্য নির্মিত অদ্বৈত বেদান্ত বা মায়াবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোটি দেখা যাক। এতে আছে ব্রহ্ম, জীব, বাহ্যজগত, মায়া এবং অবিদ্যা। এদের পারস্পরিক সম্পর্কটি কীরকম?
প্রথমে রয়েছে পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম। তিনি নির্গুণ; তাঁকে কোনও বিশেষণে বাঁধা যায় না। তিনি বাক্য ও মনের অতীত। কিন্তু তিনি সর্বব্যাপী, অথচ দেশকালের সীমার বাইরে। তিনিই একমাত্র অস্তিত্ব বা সৎ, তাঁকে ছাড়া আর কিছুই নেই।
তাহলে বাকিরা?
বাহ্যজগতের অস্তিত্বই নেই। যা অনবরত প্রত্যক্ষ করা যায় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগত আসলে মায়ার খেলা। এই মায়া কি ব্রহ্মের শক্তি? না, এ হোল চেতনায় অবিদ্যার মালিন্যের ফলে সাময়িক বিভ্রম। সঠিক জ্ঞানের বোধ হলে অনিত্য দুনিয়া অস্তিত্বহীন হবে।
তাহলে এই দুনিয়া বাস্তবে ছিল না?এর অস্তিত্ব কেবল কারও চেতনানির্ভর? প্রশ্ন ওঠে কার চেতনা? অবশ্যই জীবের। ব্যক্তি আত্মার চেতনায়।
তাহলে অসংখ্য জীবের চেতনায় অসংখ্য মায়ার দুনিয়া? এবং যাদের তত্ত্বজ্ঞান হয় নি, তাদের চেতনায় বিশ্বব্রহ্মান্ড টিঁকে থাকবে আজীবন? এতে বেশ কিছু সমস্যা দেখতে পাচ্ছি।
এক, অবিদ্যার বা মায়ার শক্তি হোল অদ্ভুত নতুন কিছু নির্মাণের, খানিকটা পি সি সরকারের ম্যাজিকের মত। কিন্তু অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন দেখছে তাজমহল, কুতুবমিনার বা আইফেল টাওয়ার। কয়েক দশক বা শতক ধরে কোটি কোটি মানুষ এদের অবিকৃত একই চেহারায় দেখছে। কেউ নিজস্ব আইফেল টাওয়ার বা তাজমহল দেখছে না। তাহলে এদের স্বতন্ত্র বাহ্য অস্তিত্ব স্বীকার না করে পারা যায়?
দুই, জীবাত্মার সংখ্যা বিগত তেরশ’ বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে সর্বত্র বেড়ে চলেছে -শংকরাচার্যের জন্মভূমিতে, গোটা ভারতবর্ষে এবং সমগ্র বিশ্বে। তাহলে কি এতগুলো বছর ধরে সমান্তরালে কয়েক’শ কোটি মায়ার বিশ্ব বা জগতও সৃষ্টি হয়ে চলেছে? কারণ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কোথায়? যদি থাকেনও, মানে যাদের চেতনায় অবিদ্যার ময়লা সরে গিয়ে ব্রহ্মান্ড লুপ্ত হয়েছে, তাদের সংখ্যা মাইক্রোস্কোপে দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। অষ্টম শতাব্দীতেই শংকর আফসোস করেছিলেনঃ
বালকাঃ সর্বে ক্রীড়াসক্তা,
তরুণাঃ সর্বে তরুণীরক্তা,
বৃদ্ধাঃ সর্বে চিন্তাবিলগ্ন
পরম্ব্রহ্মপর কোঅপি মগ্নঃ।।
বালকের দল মেতেছে খেলায়,
তরুণ-তরুণী বালুকাবেলায়
বুড়োদের বুঝি ধরেছে মাথা,
ব্রহ্মকে নিয়ে নেই কারও ব্যথা।।
আর চেতন জগতের মধ্যে শুধু মানুষ কেন? মানুষ ছাড়াও অসংখ্য প্রাণী রয়েছে, তাদের চেতনায়ও রয়েছে বাহ্যজগত। তাদের খন্ডিত অনুভবের উপর ভিত্তি করে তারা খাদ্যসংগ্রহ করে বেঁচে থাকে এবং নতুন সদস্যদের জন্ম দিয়ে নিজেদের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে। শংকরাচার্যের মডেলে এদের অস্তিত্ব নিয়ে কোন কথা নেই, যেমন নেই উপনয়ন না থাকার ফলে বেদ অধ্যয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত জনসংখ্যার অধিকাংশ সদস্য শূদ্র ও নারীদের কথা।
তিন, আর এই মডেলে শংকরাচার্য নিজে কোথায় দাঁড়িয়ে? স্পষ্টতঃই এই স্ট্রাকচারের বাইরে এক স্বতন্ত্র মানুষ বা জীব হিসেবে। নইলে উনি কী করে দেখছেন সর্বব্যাপী ব্রহ্মকে এবং অসংখ্য জীবাত্মাকে আর সন্দেহ প্রকট করছেন বাহ্যদুনিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে? উনি ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বা লীন হয়ে গেলে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য ও শিবাষ্টক স্তোত্র লিখতে পারতেন না।
‘লুনের পুতুল সাগর মাপতে গিয়েছিল। ফিরে এসে খপর দেয় নাই’ (কথামৃত)।
চার, ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে আধুনিক দর্শন চিন্তার জনক ফরাসী দার্শনিক রনে দেকার্ত যেমন বলেছিলেন— Cogito ergo sum (I think, therefore I exist.)! আমি চিন্তা করছি মানে আমি আছি, আমার অস্তিত্ব আছে। নইলে চিন্তা করছি কী করে? একই ভাবে শংকরাচার্য বিচার করছেন—ব্রহ্ম নিয়ে, জীবের ও বাহ্যদুনিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে, মায়ার খেলা নিয়ে। এটাই প্রমাণ যে ওঁর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। ফলে ব্রহ্মের সাথে অভেদ হওয়ার তত্ত্ব, একাত্ম হওয়ার তত্ত্ব ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্বের প্রশ্নে এক নয়, বহুর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে।
সৎ বা অস্তিত্বের অদ্বৈতরূপ বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদের ধারণার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ শংকরাচার্য নিজে। যদি শংকরাচার্যের অস্তিত্ব মায়াবদ্ধ জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়, তবেই তিনি স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকারী হতে পারেন।অন্য ভাবে দেখলে বলা যায়, জগৎ মায়াময় কথাটি সিদ্ধ বাক্য হতে পারে তখনই যখন দ্রষ্টা নিজে এই মায়াময় জগতের উর্ধে বিরাজমান হন। মায়ার জগতে দাঁড়িয়ে “এই জগৎ মায়াময়” তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা যুক্তি হিসাবে বিফল হতে বাধ্য (negation of negation)।
পাঁচ, প্রশ্ন ওঠে—উনি নিজে কতখানি বিশ্বাস করতেন নিজের তৈরি ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ মডেলটিকে? ব্যক্তিজীবনে উনি কিন্তু আদৌ ব্যবহারিক সত্যের এই দুনিয়াকে তাচ্ছিল্য করেননি। চষে বেরিয়েছেন ভারতবর্ষের এ’মাথা ও’মাথা; স্থাপন করেছেন চার-চারটে মঠ, গড়ে তুলেছেন সন্ন্যাসীদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ করে দশনামী সম্প্রদায়। তারপর মাত্র ৩২ বছর বয়সে চলে গেছেন এই ‘মায়ার ভুবন’ ছেড়ে।
দেকার্ত আরও বলেছিলেন—মানুষ চিন্তাশীল জীব। মানুষের অস্তিত্ব ততক্ষণই আছে যতক্ষণ সে চিন্তা করছে। একইভাবে শংকরাচার্য যেই অল্প বয়সে তাঁর মায়ার ভুবন ছেড়ে চলে গেলেন তখন তাঁর ভুবন এমনিতেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল। আলাদা করে ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমে অবিদ্যা দূর করা অর্থহীন হয়ে পড়ল। অর্থাৎ দেহের অবসানেই চেতনারও(তার অবিদ্যাজনিত মালিন্য সমেত) অবসান হচ্ছে। এটি শংকরের মডেলে অনুপস্থিত। কারণ তাহলে দেহের বাস্তব অস্তিত্ব এবং বাহ্যজগতের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। এও স্বীকার করতে হয় যে জীবের দেহধারণের সঙ্গে তার চেতনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
শংকরের প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বৈতবাদী ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরা দেহ ও বাহ্যজগতের অস্তিত্ব স্বীকার করে এই ফাঁদে পড়েননি।
ছয়, অবিদ্যা- এই তত্ত্বটি শংকরের মডেলের অ্যাকিলিস হীল। এ ব্রহ্মের মতই অনাদি। কিন্তু যখন কোন জীবের ব্রহ্মজ্ঞান হয় তখনই তার নাশ হয়। কিন্তু জীব তো গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞানী ক’জন? বাকি কোটি কোটি মানুষের জীবৎকালে তাদের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত এই অবিদ্যা যে ভাইরাসের মত বেঁচে রয়েছে এবং ধ্বংস হবার বদলে মিউটেট করে টিঁকে রয়েছে। তাহলে নিত্যনতুন সৃষ্টি করার ক্ষমতায় এ তো প্রায় ব্রহ্মের প্রতিদ্বন্দ্বী।
অতএব, যেমন ‘গো করোনা, গো’ বলে যজ্ঞ করলে বা থালা বাজিয়ে শাঁখ ফুঁকে নিশ্চিন্ত হলে করোনা যায় না, বরং দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসে তেমনই ‘সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম’ বলে ভেবে নিলেই বাহ্যজগত এবং তার দৈনন্দিন সমস্যাগুলো গায়েব যায় না বরং আরও করাল রূপ নেয়।
মোদ্দা কথা, অষ্টম শতাব্দীতে কেরালার কালাড়ি গ্রামে জন্মানো আদি শংকরের নিজস্ব ভুবন ছিল অত্যন্ত সীমিত। তাঁর দর্শনের মডেল এই বিশাল ডায়নামিক বিশ্বের প্রকৃতিকে বুঝতে অক্ষম হয়ে সোজাসুজি তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। কিন্তু চেতনাসম্পন্ন অসংখ্য জীব, শংকর নিজেও যার অংশ, তার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং লাগাতার বৈচিত্র্যময় বিস্তারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জাহির করছে যে জীব ও বস্তুজগত দস্তুরমত বাস্তব।
বাস্তব জীবনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল প্রয়োগ। যদি আমরা অতীতের অনুভব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার ভিত্তিতে বর্তমানে কোন প্রয়োগ করে ভবিষ্যতে ফল পাই তাহলে মানতেই হবে বাহ্যজগত আছে, তার অনুভব মিথ্যে নয়। নইলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাই সার হত।
মানুষ আজ চাঁদের বুকে পা রেখেছে। এ জিনিস স্পষ্টতঃ শংকরের কল্পনার বাইরে। ব্রহ্মের অস্তিত্ব দার্শনিক স্পেকুলেশনের বিষয়, শাস্ত্রবচন ছাড়া যার কোন স্বতন্ত্র বা যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাহ্যজগতের স্পন্দনকে তেরশ’ বছর আগের তুলনায় আজ অনেক বেশি করে টের পাওয়া যাচ্ছে এই প্রয়োগের মাধ্যমে।
স্পেকুলেটিভ ফিলজফির তত্ত্ব প্রয়োগের কষ্টিপাথরে বারবার যাচাই করে শোধন না করলে তা’ অসার প্রকল্প বা বুদ্ধিবিলাস (sophistry)হয়ে যায়। শংকরের মায়াবাদের মডেলেও নির্গুণ ব্রহ্ম, অসংখ্য জীব, অনাদি অবিদ্যা এবং মায়া তাদের আপাত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে প্রকট। তাদের এড়িয়ে গিয়ে সমস্তই ব্রহ্মময় প্রকল্পটি দার্শনিক স্তরে একটি জোড়াতালির বেশি মনে হচ্ছে না
[ক্রমশ…]
_____________________________________________________________________
তথ্যসূত্রঃ-
[৪] ব্রহ্মসূত্র, শ্রীভাষ্য, জিজ্ঞাসাধিকরণম, প্রথম অধ্যায়, সূত্র ১, পৃঃ৩৩।
____________________________________________________________________
[লেখক – জন্ম কোলকাতায়; গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিসূত্রে ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে-গঞ্জে বনেবাদাড়ে কয়েক দশক ধরে ঘুরে বেড়ানো। অবসর জীবন কাটে বই পড়ে, লেখালিখি করে।
প্রকাশিত বই: বাঙাল জীবনের চালচিত্র (গাঙচিল); রমণীয় দ্রোহকাল (লিরিক্যাল); দেকার্তঃ জীবন ও দর্শন (অনুষ্টুপ); যে আঁধার আলোর অধিক (সৃষ্টিসুখ); ফেরারী ফৌজ (ঋতবাক); ছত্তিশগড়ের রূপকথা (ঋতবাক); শহুরে ছত্তিশগড়ের গল্পগুচ্ছ (ঋতবাক); ছত্তিশগড়ের চালচিত্র (সুন্দরবন প্রকাশন); আহিরণ নদী সব জানে (জয়ঢাক প্রকাশন); তিনটি রহস্য গল্প (জয়ঢাক প্রকাশন)।]
Posted in: ARTICLE, July 2021 - Serial