উৎসব : পূবালী রাণা
আমার উৎসব আজ শেষ হল। বাতাসিয়া লুপের রিনি রিনি মাদকতা আর থাকবে না। এভাবেই আমাকে চলতে হবে আরো অনেকটা পথ। এই চিত্রপটটা একেবারে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে হয়তো একটু স্বস্তি পাব।
সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি। কানা বাউলের গান আমার রাত জাগা চোখে আর ঘুম দিয়ে যায়নি। এখনও সকাল হতে কিছু সময় বাকি।
ডাহির মস্ত পিরান গাছটা যখন শালুকডাঙার দীঘিতে ছায়া ফেলবে তখন সকাল হবে। কি জানি হয়তো সূর্যটাও খোলস ছাড়তে আজ আলসেমি করছে। হুস করে আমার পাশ দিয়ে কলকাতা যাওয়ার একটা বাস চলে গেল ভোরের নিস্তব্ধতা কে কিছু মুহূর্তের জন্য কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়ে। সেই কলকাতা! তোমার শহর আমার শহর! বা আমাদের শহর একেবারেই ছিল না। ধর্ম তলায় ট্রাম ধরতে গিয়ে তোমার চোখে কিছু একটা পড়েছিল। তুমি একটু পিছিয়ে আসতেই হঠাৎই একটা বুলেট তোমায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।ভাগ্যিস সেখানে তুমি ছিলে! তোমার বদলে যদি সেই বাচ্চাটা থাকত! যে সেদিন সেই মুহূর্তে তার মায়ের হাত ধরে স্কুল থেকে ফিরছিল। অকালে একটা শিশুর প্রাণ! এরকম অসংখ্য ‘তুমি ‘কিন্তু এ শহরে নেই, যে বার বার শিশুগুলিকে বাঁচাবে।
ক্লান্তিহীন স্রোতে গা ভাসানো নাবিকের ও কখনো কখনো সমুদ্র মন্থনের প্রয়োজন হয়। তোমার কোনো প্রেমিকা কোনোদিন তোমার কপালের ঘাম মুছিয়ে দেয়নি। এমনকি ভিক্টোরিয়ার সেই রহস্যময়ী পরীও।
#বরং তারা তোমার উদ্দাম যৌবনে মত্ত হয়ে শুধুই শিহরিত হতে চেয়েছে। তুমি যদি তোমার প্রত্যেকটা প্রতারক প্রেমিকার যোনী গহ্বরে বীর্য ঢুকিয়ে দিতে পারতে তাহলে আজ তাদের গর্ভে জন্ম নিত এক একজন অবৈধ সৈনিক। যারা সমস্ত বৈধতার সীমা ছাড়িয়ে তোমারি মত সমুদ্র মন্থন করে এক একটা শোষণহীন পারিজাত রোপণ করত প্রত্যেকটা উঠোনে। এখন তোমার বীর্য শুকোচ্ছে কোনো পরিত্যক্ত বট গাছের কোটরে।
সেগুলো খুঁটে খায় বছরে একবার আসা পরিযায়ী পাখিরা। আমি জানি তারা ক্রমশ শক্তিশালী হবে। কিন্তু মাঝখানে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে অসম সময়।
বাঁকে করে রসের হাঁড়ি নিয়ে হেঁকে চলেছে যে লোকটি। তাকে আমি থামাই। দেখলাম অবোধ্য কুয়াশার চাদর সরিয়ে রোদ্দুর ঢিমে তালে আমার শরীরে তার আলতো চুম্বন চিহ্ন আঁকছে। “রস খাবু কিরে কুনিয়া”? “টাটকা অছি”। (রস খাবি নাকি মেয়ে?) আমি প্রথমে সূর্যটার দিকে তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম তোমরাও শহরের মানুষের মত লোক ঠকানো শিখে গেছ? লোকটা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে খানিক তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “খাই করি দেখ তাড়ি হিই নি ভালা না লাগলে ফাবড়ি দিবু। (খেয়ে দেখ আগে তাড়ি হয়নি। ভালো না লাগলে ফেলে দিবি) “দাম দিতে হবে নি” (দাম দিতে হবে না) বলে, এক গেলাস খেজুর রস আমায় দিল। আমি একবার চুমুক দিতেই সেই গন্ধ সেই মাদকতার আঘ্রাণ পেলাম। যা তোমার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে পেতাম।বললাম, আহা! একদম। খাঁটি। এখনো তাড়ি হয়নি। সে দেখলাম মিটমিট চোখে হাসছে। তাকে বললাম শহরে যাবে আমার সাথে? “নারে কুনিয়া বড়ো ডর লাগে”! (নারে মেয়ে খুব ভয় লাগে) অস্ফুটে বললাম তোমাকেই যে বড় প্রয়োজন এখন। দেখলাম, “খেজুর রস —খেজুর রস– টাটকা রস” বলতে বলতে ধীর গতিতে এগিয়ে গেল গ্রামের পথে।
মনে হল ছলাৎ শব্দে সূর্যটা খসে পড়ল সুবর্ণরেখার বুকে। একটা বাচ্চা ছেলে ডুব সাঁতার দিয়ে তুলে আনল নিভন্ত সূর্যটাকে। এবার একটা সত্যিকারের যুদ্ধ হবে। সমানে সমানে।
বাহ। দারুন।