জ‍্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা

কাল রাতের স্বপ্নগুলো

খুব বিচ্ছিরিরকম ভালো ছিল। তো দেখলাম, একটা সাদা ঘোড়া আমার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার পিঠে উঠতে যেতেই, সে ছিটকে ফেলে দিল। ভুলেই গেছিলাম, ঘোড়ার পিঠে উঠতে গেলে ঘোড়াকে আগে হ‍্যালো বলতে হয়। (স্বপ্নে কি আর অতো মনে থাকে?)। তো, তার সামনে হাতের চেটো ধরলাম। মাথাটা এদিক ওদিক কয়েকবার নাড়িয়ে চেটো শুঁকল। পিঠে ওঠার অনুমতি পাওয়া গেছে। লাফিয়ে উঠলাম। উঠে বসতেই দেখি আমার দুপায়ের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে এল দুটো ডানা। বাড়িগুলো ছোট হতে লাগল। সে হুস করে আকাশে উঠতেই আমি গড়িয়ে পড়লাম। মেঘেদের ঘা ঘেঁষে স্লো-মোসনে পড়ছি। স্বপ্নে খালি পড়ে যাই কেন আমি! ভয়ে পায়ুদ্বার টিপটিপ করছে। এইটুকু আমি বুঝতে পারছি। বুঝতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কিন্তু স্বপ্নটা এতো সুন্দর ছিল! আর সাদা ঘোড়াটা! উজ্জ্বল নীল আকাশ আর সাদা সাদা মেঘ! এসব হারিয়ে বেশ মনখারাপ হয়ে গেল। শুয়ে নতুন করে আবার স্বপ্নটা দেখতে লাগলাম। এবার আর পড়িনি যদিও, তবে বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আমাদের গন্তব্য ছিল কৈলাশ পর্বত। তার আশেপাশে কী অপূর্ব সব হ্রদ! আমার খুব শীত করছিল। ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর এদিকে ফুলস্পিডে ফ‍্যান। উঠে বসলাম। কিন্তু গোলমালটা লাগল ঠিক তখনই। তখন কি আমি ঘুমের ভেতর ঘুম থেকে উঠে বসেছিলাম? না, এই উঠে বসা, আদতে এক স্বপ্ন?

বিকালে

বসি মাঠে। কিছুক্ষণ একা। ধীরে ধীরে বন্ধুরা আসে। একা থাকার এই সুযোগে দেখি ফড়িংদের ওড়াওড়ি। ওরা আর ভয় পায় না আমাকে। হাতে বসে, পায়ে বসে। একটা ধূসর আর একটা লাল, কাপল্ ওরা। বাকি সব আর যারা আসে, তাদের সম্পর্কগুলো এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে ওখানে বসে থাকতে থাকতে একটা জিনিস বুঝেছি, পিঁপড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী। হিসাবটা এইরকম, প্রতি সেকেন্ডে ওরা ওদের দৈর্ঘ্যের তিনগুন দূরত্ব অতিক্রম করে। সোজা কথায়, একটা চিতার চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগামী এবং সবসময়ের জন্য। তাদের ছোটা বা হাঁটা বলে কিছু নেই, বা দুটো একই। ভাবা যায়! একটা চিতা সবসময়ের জন্য ছুটছে বা আমি! অসম্ভব! অসম্ভব তো এটাও, আলোর বেগে ছুটতে ছুটতে আমি আলো হয়ে গেলাম। থিওরি হিসাবে ঠিক আছে, কিন্তু প্রাক্টিক‍্যালি সম্ভব নয়। অর্থাৎ ম‍্যাটার কখনও টাইম ট্রাভেল করতে পারে না। পারবে না। এনার্জি পারে। আর কোয়ান্টাম লেভেলে তো ব‍্যাপারটা একই‌। অথচ সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোতে দেখি কী অনায়াসে টাইম ট্রাভেল করছে মানুষ! কিন্তু কীভাবে সম্ভব? টাইম-স্পেস আদতে তো এক একটা চারমাত্রার ফ্রেম। অর্থাৎ একটা ব্লক বা ঘরের মতো। পাশাপাশি সাজানো। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ পাশাপাশি এরকম অসংখ্য ফ্রেম। অর্থাৎ অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে সময় বয়ে যায় না। একইসঙ্গে আছে। আমরা শুধু একটা ফ্রেম থেকে আর একটা ফ্রেমে সরে সরে যাই। ধরা যাক, এই ছ’টা বেজে ছয় মিনিটে মাহাতার এই মাঠে ‘A’ টাইম-স্পেস ব্লকে রয়েছি আমি। এক ঘন্টা পর বাড়ি যাব, তখন ধরা যাক আমি ‘B’ টাইম-স্পেস ব্লকে ঢুকে পড়ব‌। এখন যদি আমি এই মুহূর্তে টাইম মেশিনে চড়ে বা কোনও ওয়ার্মহোল দিয়ে A থেকে B – এ চলে যাই, তাহলে A ব্লকে কে থাকবে? অথচ B ব্লকে একইসঙ্গে থাকবে দুটো আমি! বা ধরা যাক, আরও কোনও সুদূর অতীতে গিয়ে আমি আমার কোনও পূর্বপুরুষকে হত্যা করলাম, তাহলে আর আমি কোথায়? যে আমার জন্ম-ই হয়নি, সে আমি হত্যা করব কীভাবে? সমস্যাটা এখানেই। যদি আমি ম‍্যাটার হই, কিন্তু যখন আমি এনার্জি? তখন কিন্তু আর কোনও গোলমাল নেই। টাইম-স্পেস ব্লকগুলোতে কোনও পরিবর্তন করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এনার্জি হিসাবে আমি শুধু দেখতে পারি বা জানতে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। এই বিষয়ে সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোর থেকে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত কথা বলে বিভিন্ন জাতির মাইথোলজি ও তন্ত্র। ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষরা সূক্ষ্মদেহে ভ্রমণ করতে পারে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, বা ডেলফির ওরাকল। জানতে পারে, কিন্তু কখনওই পরিবর্তন করতে পারে না নিয়তি। এমন কিছু কি সম্ভব? ঠিক নিশ্চিত নই, তবে নিশ্চিতভাবে জানি আমাদের চিন্তা-ভাবনা আদতে এক ইলেক্ট্রো-ম‍্যাগনেটিভ ওয়েভ। কিন্তু আমাদের এই দৈনন্দিন জীবনের চিন্তা-ভাবনা নিশ্চয়ই ভাঙতে পারে না টাইম-স্পেসের ব্লকগুলো। যদি পারত, তাহলে তো সমস‍্যাই ছিল না, শেয়ার মার্কেটে নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করে মাসে মাসে চলে যেতাম পাহাড়। তাহলে কীভাবে সম্ভব? উপায় তো কিছু একটা আছেই। আর যেসব চিন্তা-ভাবনা আমাদের মনে, সেই মন-ও তো একটা নয়। সচেতন মন চুপ হলেই দেখি ঘটতে থাকে আশ্চর্য সব ম‍্যাজিক। দৃশ্য। আলো। যেন প্রকাণ্ড এক আমি। ভারহীন। শূন্য

Facebook Comments

Leave a Reply